ভূতের গল্প

ভূতের গল্প

আমি কখনো ভূত দেখি নি, আর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা কি যে দেখেছেন, তা বলতে পারেন না। তাঁদের কথা প্রায়ই অস্পষ্ট, তার কারণ, ভূত হচ্ছে অন্ধকারের জীব—তার কোনো কাটাছাঁটা রূপ নেই।

আমি একটি ভদ্রলোকের মুখে দিনদুপুরে রেলগাড়িতে যে অদ্ভুত গল্প শুনেছি, তার প্রধান গুণ এই যে, ব্যাপার যা ঘটেছিল, তার একটা স্পষ্ট রূপ আছে।

আমি কলেজ থেকে বেরিয়ে রেলরাস্তায় কন্ট্রাক্টরি কাজে ভর্তি হই। ঐ ছিল আমার পৈতৃক ব্যবসা। আমি একবার পারলাকিমেডি যাচ্ছিলুম। পারলাকিমেডি কোথায় জানেন? গঞ্জাম জেলায়। বি.এ.আর.-এর বড়ো লাইন থেকে পারলাকিমেডি পর্যন্ত যে ফেঁকড়া লাইন বেরিয়েছে, সে লাইন তৈরির কনট্রাক্ট আমরাই নিই। আর তারই হিসেব- নিকেশ করতে সেখানকার রাজার ওখানে যাই।

গাড়ি যখন বিরহামপুর স্টেশনে পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় এগারোটা। ঐ এগারোটা বেলাতেই মাথার উপরে আর চার পাশে রোদ এমনি খাঁ খাঁ করছিল যে, কলকাতায় বেলা দুটো-তিনটেতেও অমন চোখ-ঝলসানো রোদ দেখা যায় না। সে তো আলো নয়, আগুন। এরকম আলোয় পৃথিবীতে অন্ধকার বলেও যে একটা জিনিস আছে, তা ভুলে যেতে হয়।

গাড়ি স্টেশনে পৌঁছতেই একটি হৃষ্টপুষ্ট বেঁটেখাটো সাহেব এসে কামরায় ঢুকলেন। তিনি যে একজন বড়ো সাহেব তা বুঝলুম তাঁর উর্দি-পরা চাপরাশীদের দেখে। দুটি-একটি বাবুও সঙ্গে ছিলেন, মাদ্রাজী কি উড়ে চিনতে পারলুম না; কিন্তু তাঁদের ধরন-ধারণ দেখে বুঝলুম যে, তাঁরা হচ্ছেন সাহেবের আফিসের কেরানী। কারণ তাঁরা সাহেবের জিনিসপত্র সব গাড়িতে উঠল কি না দেখতে প্লাটফরমময় ছুটোছুটি করছিলেন আর মধ্যে মধ্যে কুলিদের পিঠে ও মাথায় চড়টা-চাপড়টা লাগাচ্ছিলেন। অবশেষে গাড়ি ছাড়ল। প্রথমে সঙ্গীটিকে দেখে আমার একটু অসোয়াস্তি বোধ হচ্ছিল। কারণ, তাঁর চেহারাটা ঠিক বুল-ডগের মতো—তার উপর তাঁর মুখটি ছিল আগাগোড়া সিঁদুর লেপা। আমি ভাবলুম, রোদে তেতে মুখ এরকম লাল হয়েছে।

পাঁচ মিনিট পরেই হুইস্কির বোতল খুলে একটি গ্লাসে প্রায় আট আউন্স ঢেলে, তার সঙ্গে নামমাত্র সোডা সংযোগ করে এক চুমুকে তা গলাধঃকরণ করলেন।

তার পর ঠোঁট চেটে আমাকে সম্বোধন করে বললেন, যে, “Will you have some?” আমি বললুম, “No, thank you।” এ কথা শুনে তিনি বললেন, “There is not a drop of headache in a gallon of that. It is pucca Perth-my native place ।”

আমি ও হুইস্কি এত নিরীহ শুনেও যখন তাঁর অমৃতে ভাগ বসাতে রাজি হলুম না, তখন তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “Don’t you

you drink?” আমি বললুম, “I do, but I drink brandy।”

এ মিথ্যে কথা না বললে, আমাকে তাঁর এক গেলাসের ইয়ার হতে হত। আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, “Damned constipating stuff, bad for one’s liver. However, don’t drink too much।”

এর পর তিনি আমাকে pucca Perthএর রসাস্বাদ করতে আর পীড়াপীড়ি করেন নি। নিজেই তাঁর মেজাজ ঝালিয়ে নিতে যখন-তখন ঢুকটাক আরম্ভ করলেন। আমি যখন বেলা দুটোয় গাড়ি থেকে নেমে যাই তখন তিনিও তাঁর খালি বোতল গাড়ির জানালা দিয়ে ফেলে দিলেন, আর একটি নূতন বোতলের মাথার রাঙতার পাগড়ি খুলতে বসে গেলেন।

লোকটা দেখলুম বেজায় মদ খায় বটে, কিন্তু বে-এক্তিয়ার হয় না। হুইস্কির প্রসাদেই হোক, আর যে কারণেই হোক, তিনি ক্রমে মহা-বাচাল হয়ে উঠলেন ও আমার সঙ্গে গল্প শুরু করলেন; অর্থাৎ সে গল্পের আমি হলুম শ্রোতা-মাত্র, আর তিনি হলেন বক্তা।

আমার পরিচয় পেয়ে তিনি বললেন যে, তিনিও এ অঞ্চলের একজন বড়ো সরকারি এঞ্জিনিয়ার। আর কার্যসূত্রে তিনি ও দেশে কি কি দেখেছেন আর তাঁর জীবনে কি কি অসাধারণ ঘটনা ঘটেছে, সে সম্বন্ধে নানারকম খাপছাড়া ও এলোমেলো বক্তৃতা করলেন। দেখলুম, লোকটা শুধু মধুরসের নয়, মধুর রসেরও রসিক।

গঞ্জাম ছাড়িয়েই মাদ্রাজ। আর মাদ্রাজে নাকি দেদার অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আছে। যদিচ পথে-ঘাটে যাদের দেখা যায়, তারা সব যেমন কালো, তেমনই কুৎসিত। তবে যারা A. I. সুন্দরী, তারা সব অসূর্যস্পশ্যা। আর এই-সব গুপ্তরত্নের সন্ধান দিতে পারে, আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পার শুধু P. W. D.র বড়ো বড়ো মাদ্রাজি কন্ট্রাক্টররা। সেইসঙ্গে তিনি বললেন যে, তুমি যখন একজন বাঙালি কন্ট্রাক্টর, তখন তুমি যদি এ দেশে প্রেম করতে চাও তো তোমার তা করতে হবে ঐ-সব কালো কুলি স্ত্রীলোকদের সঙ্গে— সে প্রেমের ভিতর কোনো রোমান্স নেই, আর আছে নানারকম বিপদ। তার পর তাঁর অনেক প্রেমের কাহিনী শুনলুম। দেখলুম ভদ্রলোকের জীবনে যা যা ঘটেছে, সবই রোমান্টিক। কিন্তু তার বর্ণনা বিষম realistic। সেই-সব মাদ্রাজী হেলেন-ক্লিওপেট্রাদের কথা সত্য কিম্বা সাহেবের সুরাস্বপ্ন, তা বুঝতে পারলুম না। কিন্তু তার একটি গল্প সত্য বলেই মনে হল, আর সেইটেই আজ বলব। গল্প সাহেব বলেছিলেন, ইংরেজিতে, আর আমি বলব বাঙলায়। আমি তো আর কিপলিং নই যে মাতালের মুখের ভূতের গল্প দা-কাটা ইংরেজিতে আপনাদের কাছে বলতে পারব।

এঞ্জিনিয়ার সাহেবের কথা

আমি যখন বিলেত থেকে চাকরি পেয়ে প্রথম এ দেশে আসি, তখন এ অঞ্চলের একটি জঙ্গুলে জায়গা হল আমার প্রথম কর্মস্থল।

কাজ জঙ্গলের ভিতর দিয়ে একটি পাকা রাস্তা তৈরি করা, আর সেইসঙ্গে আমার পূর্বে যিনি এ কাজে ছিলেন, অর্থাৎ মি. রোজার্স, তাঁর কবরের উপর একটি স্মৃতিমন্দির খাড়া করা। এখানে চাকরি করতে এসে নাকি অনেক এঞ্জিনিয়ার আর বাড়ি ফেরে নি—কবরের ভিতর চলে গেছে।

আমি কতক হেঁটে, কতক ঘোড়ায়, বহু কষ্টে কর্মস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখি, চার পাশে শুধু ঘোর জঙ্গল, আর মধ্যে মধ্যে ছোটো ছোটো নেড়া পাহাড়। আর যেখানে একটু সমান জমি আছে, সেখানেই দু-চার ঘর লোকের বসতি। আর এই-সব স্থানীয় লোকেরাই জঙ্গল কাটে, মাটি খোঁড়ে, রাস্তায় কাঁকর ফেলে, আর দুরমুস দিয়ে পিটিয়ে তা দুরস্ত করে।

একটি দুশো ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর ছিল একটি P. W. D বাংলো। সে বাংলোটির তিন কাল গেছে আর এক কাল আছে। শুনলুম সেখানেই আমাকে থাকতে হবে। সঙ্গে থাকবে আমার আদি-দ্রাবিড় চাকরবাকর আর দুজন স্থানীয় চৌকিদার। আমার বাসস্থান দেখে মন দমে গেল। কোথায় Perth আর কোথায় এই ভূতপ্রেতের শ্মশান!

সে যাই হোক, ঘরে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাত্তিরে ডিনারের পর শুতে যাচ্ছি, এমন সময় একজন চৌকিদার এসে বললে যে, “শোবার আগে নাবার ঘরের দুয়োরটা ভালো করে বন্ধ করবেন, ও ঘরে একটি বাতি রাখবেন। এখানে কত-কিছুর ভয় আছে। আর রাত্তিরে কেউ যদি আপনার ঘরে ঢোকে তো আমাদের ডাকবেন। আমরা এই বারান্দাতেই শুয়ে থাকব।”

শোবার ঘরে ঢোকবার আগে এমনিতেই আমার গা ছম্-ছম্ করছিল, তার উপর চৌকিদারের কথা শুনে গা আরো ভারী হয়ে উঠল। পা যেন আর চলে না। শেষটায় ঘরে ঢুকে দুয়োর বন্ধ করলুম, তার পর বিছানার পাশে টেবিলের উপর একটি ছোট্ট ল্যাম্প ও রিভলভার রেখে শুয়ে পড়লুম।

রাত দুটো পর্যন্ত ঘুম হল না, নানারকম ভাবনা-চিন্তায়— যে ভাবনা-চিন্তার কোনোরূপ মাথা-মুণ্ডু নেই। তার পর যেই একটু ঘুমিয়ে পড়েছি, অমনি একটা খট্‌খট্ আওয়াজ শুনে জেগে উঠলুম। প্রথমে মনে হল, নাবার ঘরের কবাট হয় বাতাসে নড়ছে, নয় ইঁদুরে ঠেলছে। এ দেশে এক-একটা ইঁদুর এক-একটা বেড়ালের মতো।

তার পর যখন দেখলুম শব্দ আর থামে না, তখন বিছানা থেকে উঠে রিভলভার হাতে নিয়ে নাবার ঘরের দরজা খুলে দিলুম।

খুলেই দেখি, একটি স্ত্রীলোক। চমৎকার দেখতে, একেবারে নীলপাথরের ভেনাস। তার গলায় ছিল লাল রঙের পুঁথির মালা, দু কানে দুটি বড়ো বড়ো প্রবাল গোঁজা, আর ডান হাতের কব্জায় একটি পুরু শাঁখের বালা। মাথার বাঁ দিকে চুড়ো বাঁধা ছিল, আর পরনে এক হাত চওড়া লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। এ মূর্তি দেখে আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম।

সে আমাকে দেখে হেসে বললে, “তোমার ও পিস্তল দেখে আমি ভয় পাই নে। গুলি আমার গায়ে লাগবে না। আমি কেন এখানে এসেছি জান? তুমি যার বদলী এসেছ, আমি ছিলুম সেই রাজাসাহেবের রাজরানী। এই হচ্ছে আমার ঘর, এই হচ্ছে আমার বাড়ি। আমি ঐ খাটে শুতুম, আর ঐ চৌকিতে বসে কাঁচের গেলাসে বিলেতি আরক খেতুম। এক কথায় আমি রানীর হালে ছিলুম। তার পর রাজাসাহেব একবার ছুটি নিয়ে বিলেত গেল, আর ফিরে এল মোমের পুতুলের মতো একটি বিলেতি মেম নিয়ে। আর আমাকে দিলে সরিয়ে। সাহেব কিন্তু আমাকে মাস-মাস খরচার টাকা পাঠিয়ে দিত।

“তার মাসখানেক পর সে মেমটি একদিন হঠাৎ মারা গেল, অথচ তার কোনোরকম ব্যারাম হয় নি। রাজাসাহেব তাঁর স্ত্রী কিসে মারা গেল, ভেবে পেলেন না। তার পর তাঁর চৌকিদার তাঁর কানে কি মন্তর দিলে। তাতেই ঘটল সর্বনাশ। ও বেটা ছিল আমার দুষমন।

“মেমটি মারা যাবার কিছুদিন পরে যখন দেখলুম সাহেব আর আমাকে ডেকে পাঠালে না, তখন আমি মনে করলুম, সাহেবের কাছে নিজেই ফিরে যাই। সে আমাকে আবার নিশ্চয়ই ফিরে নেবে। রাজাসাহেবকে আর কেউ জানুক আর না জানুক, আমি তো জানুতম। দিনটে কুলি-মজুর নিয়ে কাটাতে পারলেও, রাত্তিরে আমাকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না।

“যে রাত্তিরে ফিরে এলুম এই নাবার ঘরে দিয়ে, রাজাসাহেব তোমারই মতো পিস্তল হাতে করে এসে আমাকে দেখবামাত্রই গুলি করলে। আর ঐ দু বেটা চৌকিদার আমার লাস জঙ্গলে ফেলে দিলে।”

এই কথা বলে সে ঘরের ভিতর তাকিয়ে বললে, “ঐ দেখো, রাজাসাহেব আসছে।” আমি মুখ ফিরিয়ে দেখি যে, খাটের পাশে ছ ফুট লম্বা একটি ইংরেজ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। মরা মানুষের মতো তার ফ্যাকাসে রঙ, আর শরীরে আছে শুধু হাড় আর চামড়া। আর খাটে ধবধবে কাপড়ের মতো সাদা একটি ইংরেজ মেয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে।

ইংরেজ ভদ্রলোকটি আমাকে দেখে বললে, “ও পিশাচী এখনো মরে নি। ও এখনো বেঁচে আছে। ঐ আমার স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। নতুন সাহেব এসেছে শুনে এখানে এসেছে আবার তার স্কন্ধে ভর করতে। আর ভর ও নির্ঘাত করবে; কারণ ও জাদু জানে। ওর হইস্কির চাইতেও সাদা চামড়ার উপর টান বেশি। আর তুমি যদি ওর রূপের আগুনে পুড়ে মরতে না চাও— যেমন আমি মরেছি—তবে এখনিই ওকে গুলি করো।”

এ কথা শুনে ব্লু-ভেনাস উত্তর করলে, “মিথ্যা কথা। আমি ওর স্ত্রীকে মারি নি। ও- ই আমাকে মেরেছে, তার পর নিজে মদ খেয়ে মরেছে।”

সাহেবটি আমাকে বললেন, “আমার কথা শোনো, শোনো, ছোঁড়ো তোমার রিভলভার—আর দেরি নয়।”

এই-সব দেখেশুনে ভয়ে আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল, আর আমি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলুম। তাই আমি না ভেবেচিন্তে রিভলভার ছুঁড়লুম। সঙ্গে সঙ্গে হুইস্কির বোতল মেঝেয় পড়ে চুরমার হয়ে গেল, আর বাতিও নিভে গেল।

গোলমাল শুনে চৌকিদাররা লণ্ঠন হাতে করে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল। আমি তাদের বললুম যে, “ঘরে চোর ঢুকেছিল, তাই আমি পিস্তল ছুঁড়েছি।” তারা একটু হাসলে, তার পর সমস্ত বাড়ি আর তার চারপাশ খুঁজে কাউকেও দেখতে পেল না। তখন বুঝলুম যে, রাত্তিরে আমার ঘরে যা হয়েছিল, সে ভূতের কাণ্ড। তার পর থেকেই আমি আর একা শুতে পারি নে, শুলেই ঐ ব্লু-ভেনাস চোখের সুমুখে এসে খাড়া হয়, আর আমি অমনি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাই। অবশ্য এখন আর সে আসে না, কিন্তু তার স্মৃতিই আসে তার রূপ ধরে।

এর পর সাহেব এই বলে তাঁর বলা শেষ করলেন যে— “শেষটায় যাতে একা শুতে না হয়, তার জন্য বিয়ে করলুম। আমার স্ত্রী Pucca Perth, ঘোর খৃস্টান ও সম্পূর্ণ নির্ভীক। সে ভূতে বিশ্বাস করে না, করে শুধু ভগবানে। আর আমি ভগবানে বিশ্বাস করি নে, কিন্তু ভূতে করি। আমরা এঞ্জিনিয়াররা সব scientific men, ধর্মের রূপকথা হেসে উড়িয়ে দিই, আর শুধু তাই বিশ্বাস করি, যার প্রত্যক্ষপ্রমাণ পাই। এই-সব কারণে এ গল্প আমি মুখ ফুটে আমার স্ত্রীর কাছে বলতে পারি নি এই ভয়ে যে, আমার কথা সে হেসে উড়িয়ে দেবে।”

.

এঞ্জিনিয়ার সাহেবের গল্প শুনে আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে, তুমি যা দেখেছ তা হচ্ছে blue devil, D. T.র প্রসাদে।—কিন্তু তাঁর মুখে ভীষণ আতঙ্কের চেহারা দেখে চুপ করে রইলুম। তার পরেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লুম।

আমি অবশ্য এই সাদা-কালো ভূতের মারাত্মক প্রণয়-কলহের রোমান্টিক কাহিনী বিশ্বাস করি নি; কিন্তু সে রাত্তিরে পারলাকিমেডির ডাক-বাংলোর চৌকিদারকে আমার ঘরে শুইয়েছিলুম।

জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভূতের গল্প

ভূতের গল্প

আমি ভূতের গল্প বড় ভালবাসি। তোমরা পাঁচ জনে মিলিয়া গল্প কর, সেখানে পাঁচ ঘন্টা বসিয়া থাকিতে পারি। ইহাতে যে কি মজা! একটা শুনিলে আর-একটা শুনিতে ইচ্ছা করে, দুটা শুনিলে একটা কথা কহিতে ইচ্ছা করে। গল্প শেষ হইয়া গেলে একাকী ঘরের বাহিরে যাইতে ইচ্ছে হয় না। তোমাদের মধ্যে আমার মতন কেহ আছ কি না জানি না, বোধ হয় আছে। তাই আজ তোমাদের কাছে একটা গল্প বলি। গল্পটা একখানি ইংরেজি-কাগজে পড়িয়াছি। তোমাদের সুবিধার জন্য ইংরেজি নামগুলি বদল করিয়া দিতে ইচ্ছা ছিল, কিন্তু গল্পটি পড়িলেই বুঝিতে পারিবে যে শুধু নাম বদলাইলে কাজ চলিবে না। সুতরাং ঠিক যেরূপ পড়িয়াছি, প্রায় সেইরূপ অনুবাদ করিয়া দেওয়াই ভাল বোধ হইতেছে।

‘স্কটল্যাণ্ডের ম্যাপটার দিকে একবার চাহিয়া দেখিলে বাঁ ধারে ছোট ছোট দ্বীপ দেখিতে পাইবে। তাহার উপরেরটির নাম নর্থ উইস্ট্‌, নীচেরটির নাম সাউথ্‌ উইস্ট্। এর মাঝামাঝি ছোট-ছোট আর কতকগুলি দ্বীপ দেখা যায়। এ সেকালের কথা, তখত স্টীম্ এঞ্জিনও ছিল না, টেলিগ্রাফ্‌ও ছিল না। আমার ঠাকুরদাদা তখন এর একটি দ্বীপে স্কুলে মাস্টারি করিতেন।’

‘সেখানে লোক বড় বেশি ছিল না। তাদের কাজের মধ্যে কেবল মাত্র মেষ চরান, আর কষ্টে সৃষ্টে কোন মতে দিন চলার মত কিছু শস্য উৎপাদন করা। সেখানকার মাটি বড় খারাপ; তারি একটু একটু সকলে ভাগ করিয়া নেয় আর জমিদারকে খাজনা দেয়। … এরা বেশ সাহসী লোক ছিল। আর ঐরকম কষ্টে থাকিয়া এবং সামান্য খাইয়াও বেশ একপ্রকার সুখে স্বচ্ছন্দে কাল কাটাইত।’

‘এই দ্বীপে এল্যান্‌ ক্যামেরন নামে একজন লোক ছিলেন, তাঁহার বাড়ি গাঁ থেকে প্রায় এক মাইল দূরে। এল্যানের সঙ্গে মাস্টারমহাশয়ের বড় ভাব, তাঁর কাছে তিনি কত রকমের মজার গল্প বলিতেন। হঠাৎ একদিন ক্যামেরন বড় পীড়িত হইলেন, আর কিছুদিন পরে তাঁহার মৃত্যু হইল। তাঁহার কেউ আপনার লোক ছিল না, সুতরাং তাঁহার বিষয়-সমস্ত বিক্রি হইয়া গেল। তাঁর বাড়িটা কেহই কিনিতে চাহিল না বলিয়া তাহা অমনি খালি পড়িয়া রহিল।’

‘এর কয়েক মাস পরে একদিন জ্যোৎন্সা রাত্রিতে ডনাল্ড্‌ ম্যাকলীন বলিয়া একটি রাখাল ঐ বাড়ির পাশ দিয়া যাইতেছিল। হঠাৎ জানালার দিকে তাহার দৃষ্টি পড়িল, আর সে ঘরের ভিতরে এল্যান্‌ ক্যামেরনের ছায়া দেখিতে পাইল। দেখিয়াই ত তার চক্ষু স্থির! সেখানেই সে হাঁ করিয়ার দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার চুলগুলি খ্যাংরা কাঠির মত সোজা হইয়া উঠিল, ভয়ে প্রাণ উড়িয়া গেল, গলা শুকাইয়া গেল।’

‘শীঘ্রই তাহার চৈতন্য হইল। ঐরকম ভয়ানক পদার্থের সঙ্গে কাহারই বা জানাশুনা করিবার ইচ্ছা থাকে? সে ত মার দৌড়! একেবারে মাস্টার-মশাইয়ের বাড়িতে। তাঁহার কাছে সব কথা সে বলিল। মাস্টারমহাশয় এ-সব মানেন না। তিনি তাহাকে প্রথম ঠাট্টা করিলেন, তারপরে বলিলেন, তাহার মাথায় কিঞ্চিৎ গোল ঘটিয়াছি; আরো অনেক কথা বলিলেন-বলিয়া যাথাসাধ্য বুঝাইয়া দিতে চেষ্টা করিলেন যে, ঐরূপ কিছুতে বিশ্বাস থাকা নিতান্ত বোকার কার্য।’

‘ডনাল্ড্‌ কিন্তু ইহাতে বুঝিল না, সে অপেক্ষাকৃত সহজ বুদ্ধি বিশিষ্ট অন্যান্য লোকের কাছে তাহার গল্প বলিল। শীঘ্রই ঐ দ্বীপের সকলেই গল্প জানিতে পারিল। ঐ-সব বিষয় মীমাংসা করিতে বৃদ্ধরাই মজবুত। তাঁহারা ভবিষ্যতের সম্বন্ধে ইহাতে কত কুলক্ষণই দেখিতে পাইলেন।’

‘ঐ দ্বীপের মধ্যে কেবলমাত্র মাস্টারমহাশয়ের কাছে খবরের কাগজ আসিত। মাসের মধ্যে একবার করিয়া কাগজ আসিত আর সেদিন সকলে মাস্টারমহাশয়ের বাড়িতে গিয়া নূতন খবর শুনিয়া আসিত। সেদিন তাহাদের পক্ষে একটা খুব আনন্দের দিন। রান্নাঘরে বড় আগুন করিয়া দশ-বার জন তাহার চারিদিকে সন্ধ্যার সময় বসিয়া কাগজের বিজ্ঞাপন হইতে আরম্ভ করিয়া অমুক কর্তৃক অমুক যন্ত্রে মুদ্রিত হইল ইত্যাদি পর্যন্ত সমস্ত বিষয়ের তদারক ও তর্কবিতর্ক করিত। শেষে কথাগুলি সকলেরই একপ্রকার মুখস্থ হইয়াছিল, এবং পড়া শেষ হইলে ঐ কথাটা প্রায় সকলে একসঙ্গে একবার বলিত।’

‘এই-সকল সভায় রাখাল, কৃষক, গির্জার ছোট পাদরি প্রভৃতি অনেকেই আসিতেন। গ্রামের মুচি ররীও আসিত। ররী ভয়ানক নাছোড়বান্দা লোক। একটি কথা উঠিলে তাহাকে একবার আচ্ছা করিয়া না ঘাঁটিলে সহজে ছাড়িবে না।’

‘ডনাল্ড ম্যাকলীনের ঐ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন সকলে এইরূপ সভা করিয়া বসিয়াছে, মাস্টারমহাশয় চেঁচাইয়া তর্জমা করিতেছেন, এমন সময় একজন আসিয়া বলিল যে, এল্যান্‌ ক্যামেরনের ছায়া আবার দেখা গিয়াছে। এবারে একজন স্ত্রীলোক দেখিয়াছে। এ রাখাল যে স্থানে যেভাবে উহাকে দেখিয়াছির, এও ঠিক সেইরকম দেখিয়াছে।’

‘এরপর আর পড়া চলে কি করিয়া! মাস্টারমহাশয় চটিয়া গেলেন এবং ঠাট্টা করিতে লাগিলেন। ররী তৎক্ষাণাৎ তাহার প্রতিবাদ করিল। ররী কোন কথাই ঠিক মানে না। এবারেও মাস্টারমহাশয়ের কথাগুলি মানিতে পারিল না। প্রচণ্ড তর্ক উপস্থিত। ভূতের কথা লইয়া সাধারণভাবে এবং ক্যামেরনের ভূতের বিষয় বিশেষভাবে বিচার চলিতে লাগিল। আর সকলে বেশ মজা পাইতে লাগিলেন। কিন্তু রীরর মেজাজ গরম হইয়া উঠিল। সে বলিল-’

‘দেখ মস্টারের পো, যতই কেন বল না, আমি এক জোড়া নতুন বুট হারব, তোমার সাধ্যি নেই আজ দুপুর রেতে ওখান থেকে গিয়ে দেখে এস।’

‘সকলে করতালি দিয়া উঠিল। মাস্টারমহাশয় হাসিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিলেন, কিন্তু ররী ছাড়িবে কেন? সে সকলের উপর বিচারের ভার দিল। তাহারা এই মত দিল যে, মাস্টারমহাশয় যখন গল্পগুলি মানিতেছেন না, সে স্থলে তাঁহার যে নিদেন পক্ষে তিনি যে এ মানেন না তা প্রমাণ করিয়া দেন।’

‘মাস্টারমহাশয় দেখিলে, অস্বীকার করিলে যশের হানি হয়। তিনি বলিলেন, “যাব বই কি? কিন্তু আমি ফিরে এলেও এর চাইতে আর তোমাদের জ্ঞান বাড়বে না।”

ররী-‘আচ্ছা দেখা যাউক।’

মাস্টারমহাশয়-‘ভাল, ওখানে গিয়ে আমি কি কর্‌ব?’

ররী-‘ওখানে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনবার বলবে-এল্যান্‌ ক্যামেরন আছে গো!’ কান জবাব না পাও ফিরে এস, আমি আর ভূত মানবো না।

মাস্টারমহাশয় হাসিয়া বলিলেন, ‘এটা ঠিক জেনো যে, এল্যান, সেখানে থাকলে আমার কথার উত্তর দিবেই। আমাদের বড় ভাব ছিল।’

একজন বলিল, ‘তাকে যদি দেখতে পাও, তা হলে মুচির কাছে যে ও টাকা পেতে, সে কথাটা তুল না।’ এ কথায় সকলে হাসিয়া ফেলিল, ররী একটু অপ্রস্তুত হইল।

‘এইরূপে হাসি-তামাশা চলিতে বলিল-‘বারটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। তুমি এখন গেলে ভাল হয়; তাহলেই ঠিক ভূতের সময়টাতে পৌঁছতে পারবে।’

‘বেশ করিয়া কাপড়-চোপড় জড়াইযা মাস্টারমহাশয় যষ্টি হস্তে সেই বাড়ির দিকে চলিলেন। মাস্টারের যাইবার সময়ে সকলেই দু-একটি খোঁচা দিয়া দিল এবং স্থির করিল, ফলটা কি হয় দেখিয়া যাইবে।’

‘রাত্রি অন্ধকার। এতক্ষণ বেশ জ্যোৎস্না ছিল, কিন্তু এক্ষণে কাল কাল মেঘে আসিয়া চাঁদকে ঢাকিয়া ফেলিতেছে। মাস্টার চলিয়া গেলে সকলে আরম্ভ করিল যে, সমস্ত রাস্তাটা সাহস করিয়া যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব কি না। ছোট পাদরি বলিল যে তিনি হয়ত অর্ধেক পথ গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া যাহা ইচ্ছা বলিবেন, তখন আর কাহারো কিছু বলিবার থাকিবে না। ইহা শুনিয়া মুচির মনে ভয় হইল, জুতা জোড়াটা নেহাত ফাঁকি দিয়া নেয়, এটা তাহার ভাল লাগিল না। তখন একজন প্রস্তাব করিল যে, ররী যাইয়া দেখিয়া আসুক।’

‘প্রথমে ররী ইহাতে আপত্তি করিল। কিন্তু উহার বক্তৃতায় পরে রাজি হইল। সকলে তাহাকে সাবধান করিয়া দিল যেন মাস্টার তাহাকে দেখিতে না পায়, তারপর সে বাহির হইল। খুব চলিতে পারিত এই গুণে শীঘ্রই সে মাস্টারকে দেখিতে পাইল। ররী একটু দূরে দূরে থাকিতে লাগিল। রাস্তাটা একটা জলা জায়গার মধ্যে দিয়া। একটি গাছপালা নাই যে মাস্টার ফিরিয়া চাহিলে তাহার আড়ালে থাকিয়া বাঁচিবে।’

‘পরে মাস্টারমহাশয় যখন ঐ বাড়িতে পৌঁছিলেন, তখন ররী একটু বুদ্ধি খাটাইয়া খানিকটা ঘুরিয়া বাড়ির সম্মুখে আসিল। সেখানে একটু নিচু বেড়া ছিল, তাহার আড়ালে শুইয়া পড়িল।’

‘সে অবস্থায় দূতের কার্য করিতে যাইয়া তাহার অন্তরটা গুর গুর করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয় ছিলেন বলিয়া, নইলে সে এতক্ষণ চেঁচাইয়া ফেলিত। কষ্টে সৃষ্টে কোন মতে প্রাণটা হাতে করিয়া দেখিতেছে কি হয়। মনে করিয়াছে, মাস্টারমহাশয় যেরূপ ব্যবহার করেন, তাহা দেখা হইয়া গেলেই সে বাহির হইবে।’

‘গ্রামের গির্জার ঘড়িতে বারটা বাজিল। সে বেড়ার ছিদ্র চাহিয়া দেখিল যে মাস্টারমহাশয় নির্ভয়ে দরজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন।’

‘মাস্টারমহাশয় গলা পরিষ্কার করিলেন এবং একটু শুষ্ক স্বরে বলিলেন-‘এল্যান্‌ ক্যামেরন আছে গো!’-কোন উত্তর নাই।

‘দু-এক পা পশ্চাৎ সরিয়া একটু আস্তে আবার বলিলেন, ‘এল্যান্‌ ক্যামেরন আছ গো!’-কোন উত্তর নাই।

‘তারপর বাড়িতে আসিবার রাস্তাটি মাথা পর্যন্ত হাঁটিয়া গিয়া থতমত স্বরে অর্থচিৎকার অর্থ আহ্বানের মত করিয়া তৃতীয়বার বলিলেন, ‘এল-ক্যামেরন-আছ-।’ তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা নাই।-সটান চম্পট।

‘কি সর্বনাশ! কোথায় মাস্টারের সঙ্গে বাড়ি যাইবে, মাস্টার যে এ কি করিয়া ফেলিলেন মুচি বেচারীর আর আতঙ্কের সীমা নাই।তবে বুঝি ভূত এল! আর থাকিতে পারিল না। এই সময়ে তার মনে যে ভয় হইয়াছিল, তারই উপযুক্ত ভয়ানক গোঁ গোঁ শব্দ করিতে করিতে সে মাস্টারমহাময়ের পেছনে ছুটিতে লাগিল।

সেই ভয়ানক চিৎকার শব্দ মাস্টারমহাশয় শুনিতে পাইলেন। পশ্চাতে একপ্রকার শব্দও শুনিতে পাইলেন। আর কি? ঐ এল্যান্‌ ক্যামেরন! ভয়ে আরো দশগুণ দৌড়িতে লাগিলেন। ররী বেচারা দেখিল বড় বিপদ! ফেলিয়াই বুঝি গেল। কি করে, তারও প্রাণপণ চেষ্টা। মাস্টারমহাশয় দেখিলেন, পাছেরটা আসিয়া ধরিয়াই ফেলিল। তাঁহার যে আর রক্ষা নাই, তখন তিনি সাহস ভর করিলেন এর খুব শক্ত করিয়া লাঠি ধরিয়া সেই কল্পিত ভূতের মস্তকে ‘সপাট’-সাংঘাতিক এক ঘা! তারপর সেটাও যেন কোথায় অন্ধকারে অদৃশ্য হইল।’

‘ভূতটা যাওয়াতে এখন একটু সাহস আসিল, কিন্তু তথাপি যতক্ষণ গ্রামের আলোক না দেখা গেল, ততক্ষণ থামিলেন না। গ্রামে প্রবেশ করিবার পূর্বে সাবধানে ঘাম মুছিয়া ঠাণ্ডা হইয়া লইলেন। মনটা যখন নির্ভয় হইল, তখন ঘরে গেলেন-যেন বিশেষ একটা কিছু হয় নাই। অনেক কথা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিন সকলগুলিরই উত্তরে বলিলেন’-

‘ঐ আমি যা বলেছিলাম, ভূতটুত কিছুই ত দেখতে পেলাম না!’

‘এরপর মুচির জন্য সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিল। মাস্টারকে তাহারা বলিল যে, সে স্থানান্তরে গিয়াছে, শীঘ্রই ফিরিয়া আসিবে।’

‘আধ ঘণ্টা হইয়া গেল, তবু মুচি আসে না। সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করিতে লাগিল। চিন্তা বাড়িতে লাগিল, ক্রমে একটা বাজিল। তারপর আর থাকিতে পারিল না, মুচির অনুপস্থিতির কারণ তাহারা মাস্টারমহাশয়কে বলিয়া ফেলিল। মাস্টারমহাশয় শুনিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলেন। লাফাইয়া উঠিয়া লণ্ঠন হাতে করিয়া দৌড়িয়া বাহির হইলেন এবং সকলকে পশ্চাৎ আসিতে বলিয়া দৌড়িয়া চলিলেন।’

সকলেরই বিশ্বাস হইর, মাস্টারমহাময়ের বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাইয়াছে। হৈ চৈ কাণ্ড! সকলেই জিজ্ঞাসা করে, ব্যাপারটি কি? তাড়াতাড়ি ঘরের বাহির আসিয়া তাহারা মাস্টারকে দাঁড়াইতে বলিতে লাগিল। তাঁহাদের শব্দ শুনিয়া কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করিয়া উঠিল। কুকুরে গোলমালে গাঁয়ের লোক জাগির। সকলেই জিজ্ঞাসা করে, ব্যাপারখানা কি?’

‘এই সময়ে মাস্টারমহাশয় জলার মধ্য দিয়ে দৌড়িতেছেন। মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে- কেবল পুলিস-ম্যাজিস্ট্রট-জুরী-ইত্যাদি ভয়ানক বিষয় মনে হইতেছে। তাঁহার লণ্ঠনের আলো দেখিয়া অন্যেরা তাঁহার পশ্চাৎ আসিতেছে।’

‘সকলে তাঁহার কাছে আসিয়া তাঁহাকে ধরিল এবং ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। মাস্টারমহাশয়ের উত্তর দিবার পূর্বেই সেই মাঠের মধ্য হইতে গালি এবং কোঁকানি মিশ্রিত একপ্রকার শব্দ শুনা যাইতে লাগিল। কতদূর গিয়া দেখা গেল, একটা লোক জলার ধারে বসিয়া আছে। লণ্ঠনের সাহায্যে নির্ধারিত হইল যে এ আর কেহ নহে, আমাদের সেই মুচি। সেইখানে বেচারা দুই হাতে মাথা চাপিয়া বসিয়া আছে আর তাহাদের মাস্টারমারের উদ্দেশে গালাগালি দিতেছে। তাহার নিকট হইতে সকলে সমস্ত শুনিল।’

‘শেষে অনুসন্ধানে জানা গেল যে ঐ বাড়ির জানালার ঠিক সম্মুখে একটা ছোট গাছ ছিল। তাহারই ছায়া চন্দ্রের আলোকে দেয়ালে পড়িত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে সেই ছায়ার আকৃতি দেখিতে ঠিক ক্যামেরনের মুখের মত। সেদিন চন্দ্র ছিল না, মাস্টারমহাশয় সেই ছায়া দেখিতে পান নাই।’

Leave a Reply to HIRA Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *