১.৪৬-৫০ আলী আমজাদের মাথার উপর ছাতা

১.৪৬

আলী আমজাদের মাথার উপর ছাতা ধরে আছে হেকমত। শীত সকালের রোদে ছাতা জিনিসটার দরকার হয় না। তাও রোদ আটকাবার জন্য। যদি ক্কচিত কখনও গম্ভীর হয়ে নামে কুয়াশা, দুপুর পর্যন্ত সুর্যের মুখ দেখা যায় না, রোদ বলতে কিছু থাকে না, কুয়াশা ফুটা করে আচমকা পড়তে শুরু করে গুঁড়িবৃষ্টি, তখন হয়তো গ্রাম গিরস্তের কেউ কেউ ছাতা মেলে মাথার ওপর। তাও খুব সৌখিন গিরস্ত না হলে না, সচ্ছল আর শীতকাতর গিরস্ত না হলে না। বেশিরভাগ গিরস্তই গায়ের চাদর মেয়েছেলের ঘোমটার মতো করে তুলে দেয় মাথায়। বৃষ্টি আটকায়। কিন্তু শীতের দিনের রোদ আটকাবার জন্য ছাতা দেশ গ্রামের কোনও মানুষ কখনও দেখেনি।

দূর থেকে দৃশ্যটা দেখে খুব মজা পেল নূরজাহান। ভুলে গেল সকালবেলার ঘটনা। সড়কের অদূরে এসে দাঁড়াল সে। মুখের মজাদার ভঙ্গি করে আলী আমজাদ আর ছাতা ধরা হেকমতের দিকে তাকিয়ে রইল। লগে যে মাকুন্দা কাশেম আছে ভুলে গেল।

সড়কের কাজে মাটিয়াল বেড়েছে ম্যালা। প্রতিদিন অনেকখানি করে আগাচ্ছে সড়ক। এই তো কয়দিন আগে ছিল জাহিদ খাঁর বাড়ির সামনে, আজ এসে গেছে হযরতদের বাড়ির সামনে। দুইদিন পর দক্ষিণ মেদিনীমণ্ডল ছাড়িয়ে কুমারভোগ ধরবে। তারপর মাওয়ার ঘাট। 

মাটিয়াল, সড়কের কাজ কোনওটাই খেয়াল করছিল না নূরজাহান। সে তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের দিকে, হেকমতের দিকে। আলী আমজাদ নড়ে তো ছাতা হাতে হেকমতও নড়ে। আলী আমজাদ দুইপা আগায়, তিন পা পিছায় তো হেকমতও আগায় পিছায়। যেন কোনওভাবেই রোদের আঁচ কন্ট্রাক্টর সাহেবের গায়ে না লাগে।

আলী আমজাদ এই ব্যাপারটাকে মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না। কালো রঙের কোটপ্যান্ট পরা। কোটের তলায় সাদা শার্ট। গলায় মাফলার আছে। মাফলারটা বেশ টাইট করে প্যাচিয়ে রেখেছে। পায়ে জুতা। দেখে বুঝা যায় এতকিছু পরে থাকার পরও শীতটা তার আছে।

এই অবস্থায় রোদে থাকতেই তো পছন্দ করে মানুষ, হেকমত তাহলে ছাতা ধরে রেখেছে কেন আলী আমজাদের মাথায়!

অল্প কয়দিনে আলী আমজাদ লোকটা বেশ ফুলেছে। বিশেষ করে পেট। এই এতটা দূর থেকেও পোটকা মাছের মতন পেটখান তার দেখা যাচ্ছে। যেন গরুর ফ্যান খৈল খাওয়ার বিশাল একখান গামলা উপুড় করে পেটের লগে বেঁধে রেখেছে আলী আমজাদ। কথাটা ভেবেই খিলখিল করে হেসে উঠতে চাইল নূরজাহান। কী ভেবে শব্দ করে হাসল না, হাসল নিঃশব্দে। তার সেই হাসি মাকুন্দা কাশেম দেখে ফেলল। দেখে খুবই অবাক হল। হাসো ক্যা মা? কী অইছে?

হাসি বন্ধ করল নূরজাহান। কিছু না।

সড়ক মিহি যাইবা কইলা, যাইতাছ না ক্যা? সড়কের সামনে আইয়া খাড়াইয়া রইল্যা ক্যা?

এমতেঐ।

কনেটেকদার সাবরে দেইক্কা?

ক্যা, হেরে দেইক্কা খাড়ামু ক্যা?

কনটেকদার সাবরে ডরাইতেও পারো।

অবাক হয়ে কাশেমের মুখের দিকে তাকাল সে। কনটেকদার সাবরে আমি ডরামু ক্যা?

কাশেম কাঁচুমাচু গলায় বলল, অনেকেই হেরে ডরায়।

কন কী?

হ।

ক্যা, ডরায় ক্যা?

পয়লা কথা অইলো ম্যালা টেকা পয়সা আছে, তরবাদে আতাহারগো লগে দুস্তি। টেকা আর ক্ষেমতা যার থাকে হেরে মাইনষে এমতেঐ ডরায়।

আমি ডরাই না। লন আমার লগে, দেইখেন নে কনটেকদার সাবের লগে কেমতে কথা কই আমি! হেয় কেমতে কথা কয় আমার লগে।

কাম নাই যাওনের। লও আমরা বাইত্তে যাই গা।

হাঁটতে হাঁটতে নূরজাহান বলল, না।

.

১.৪৭

আদিলদ্দি নামের মাটিয়ালটা একেবারেই ভাঙাচোরা শরীরের, একেবারেই কমজোরি। মাপ মতন ভরা মাটির গোড়া বহন করতেই তার জান বেরিয়ে যায়। কোদাল চালিয়ে চাপ চাপ মাটি কেটে ছোঁড়া ভর্তি করে দেয় যেসব মাটিয়াল, হাতের মাপ তো সব সময় আর ঠিক থাকে না তাদের, মাটি তো আর ধান চাউল না যে ওজন রাখতে হবে কাঁটায় কাঁটায়, দুই এক কোদাল মাটি কমবেশি হতেই পারে কোনও কোনও য়োড়ায়। কম হলে আদিলদ্দির কোনও অসুবিধা নাই, বেশি হলেই মরণ। ঘেটি সোজা করে হাঁটতে পারে না। যেন এখনই হরমাইলের (পাটখড়ি) মতন মট করে ঘেটি ভেঙে যাবে তার।

মাথাটা কিছুতেই তখন আর সোজা রাখতে পারে না। মাত্র হাঁটতে শিখা শিশুর ভঙ্গিতে শ্বাস টানে, যেন এখনই জানটা বেরিয়ে যাবে তার। ফলে আদিলদিকে দেখলেই মেজাজ বিগড়াইয়া যায় আলী আমজাদের। মাটিভর্তি য়োড়া মাথায় হেঁটে যাওয়া মানুষটার কোকসা বরাবর লাথথি মারতে ইচ্ছা করে। শইল্লে জোরবল নাই, মাইট্টাল অইতে আইছস ক্যা চুতমারানির পো! টেকার সময় তো একটেকা কম নিবি না!

এখনও ঠিক এমন একটা অনুভূতিই হল আলী আমজাদের। য়োড়া মাথায় ভাঙন থেকে উঠে আসছিল আদিলদ্দি, তার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। দুই এক কোদাল মাটি বুঝি বেশি ছিল আদিলদ্দির য়োড়ায়। সে হাঁটছিল টলোমলো পায়ে। ঘেটি মটমট করছিল তার, হাঁ করে শ্বাস টানছিল। গায়ের চামড়ার মতো চাদরটা লগেই আছে। চিকন মাজার লগে চাদরটা সে প্যাচিয়ে বেঁধে রেখেছে। একপলক চাদরটার দিকে। তাকিয়ে হেকমতের দিকে মুখ ফিরাল আলী আমজাদ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, এই চুতমারানির পোরে দেকলেঐ মেজাজ খারাপ অইয়া যায় আমার।

চারদিকের এত মাটিয়ালের মধ্যে কার কথা বলছে আলী আমজাদ ঠিক বুঝতে পারল না হেকমত। ছাতি ধরা হাত বদল করে বলল, কার কথা কন?

ঐ যে আদিলদ্দি না কী নাম! কামাড়গাও বাড়ি। নাম জিগাইলে পুরা নাম কয়। আদিলউদ্দিন।

হ এই বেডার শইল্লে জোরবল নাই।

জোরবল নাই তয় রাকছো ক্যা?

আপনেঐত্তো রাকতে কইলেন!

আলী আমজাদ জানে সেই আদিলদ্দিকে রাখতে বলেছে। তার কথা ছাড়া লোক রাখার সাহস হেকমতের হবে না। রাখলেও কোনও না কোনও ফাঁকে আলী আমজাদকে বলবে, লোকটাকে ডেকে এনে দেখাবে। এমনভাবে তার গুণকীর্তন গাইতে থাকবে যেন অশুরের মতো শক্তি লোকটার গায়ে। একা তিন মানুষের কাজ করবে। এমন মাটিয়াল আর হয় না।

কিন্তু আদিলদ্দিকে সে রাখেনি। আলী আমজাদ রাখার পরও দুই একবার বলবার চেষ্টা করেছে, এমুন ম্যাড়া (রোগা অর্থে) মাইট্টাল দিয়া কাম অইবো না। সেকথা পাত্তা দেয়নি আলী আমজাদ। কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে। তোক যত পাও লাগায়া দেও। আদিলদ্দি কমজুরি হউক আর যাই হউক মানুষ তো, কিছু না কিছু মাডি তো উড়াইতে পারবো!

এখন যেন এসব কথা আর মনেই নাই আলী আমজাদের। হেকমতের কথা শুনে অন্যদিকে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, আমি রাকছিলামনি! কী জানি, মনে নাই।

হেকমত আমতা গলায় বলল, আপনে না রাকতে চাইলে খেদাইয়া দেই।

না থাউক। কাম তাড়াতাড়ি শেষ করন লাগবো। অহন আর মাইট্টাল খেদাইয়া লাব নাই। পারলে আরও ধরো। কামে লাগাও।

তখনই নূরজাহান আর মাকুন্দা কাশেম এসে দাঁড়াল আলী আমজাদ আর হেকমতের সামনে। প্রথমে নূরজাহানকে খেয়াল করেনি আলী আমজাদ, আনমনা চোখে তাকিয়েছিল হযরতদের বাড়ির উঁচু তালগাছটার দিকে। কী কথা বলবার জন্য হেকমতের দিকে তাকিয়েছে, তাকিয়ে নূরজাহানকে দেখে সেই কথা ভুলে গেল। দুই দিকের ঠোঁট যতদূর লম্বা করা যায় করে হাসল। সোনায় বাঁধানো দাঁতখান চকচক করে উঠল। সেই দাঁত দেখে ব্যাটারির কথা মনে হল নূরজাহানের। হাসি পেল। হাসবার আগেই আলী আমজাদ বলল, কই থিকা আইলা নূরজাহান? তোমারে আইজকাইল দেহিই না!

নূরজাহান বলল, একলগে দুইডা কথা জিগাইতেছেন। কয়ডার জব দিমু?

দুইডারঐ দেও।

একটা একটা কইরা দিমু, না একলগে?

আলী আমজাদ আবার আগের মতো হাসল। তুমি বড় রস কইরা কথা কও নূরজাহান। আমার বহুত ভাল্লাগে।

তাইলে আরেকখান কই?

কও।

 আপনের গরম বেশি?

কিছু না ভেবে আলী আমজাদ বলল, গরমের দিন গরম বেশি, শীতের দিন শীত বেশি।

এইডা শীতের দিন না?

হ।

তয়?

তয় আবার কী! শীতের দিন দেইক্কাঐত্তো সুটকুট ফিনছি। গলায় মাপলার, পায়ে জুতামুজা। আর এই বছর কেমন শীত পড়ছে দেকতাছ না!

নূরজাহান হাসল। হ দেকতাছি। দেইক্কাঐত্তো জিগাইলাম।

এবার আলী আমজাদ একটু চিন্তিত হল। চোখ সরু করে নূরজাহানের দিকে তাকাল। তুমি মনে অয় আমার লগে ঠাট্টা মশকরা করতাছো?

নূরজাহান কথা বলবার আগেই কাশেম হাসিমুখে করে বলল। হ। আপনের মাথায় ছাতি দেকতাছে তো এর লেইগা এত কথা কইতাছে।

কাশেমের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। কীরে মাকুন্দা, তুই আইলি কই থিকা?

কাশেম লাজুক গলায় বলল, মার লগেঐ আইছি।

আতাহরগ বাইত্তে থিকা তরে বলে খেদাইয়া দিছে? তয় তুই অহন থাকচ কই? কাম করচ কই?

নূরজাহান বলল, এই হগল কথা পরে কইবনে। আগে ছাতিডা বুজান।

আলী আমজাদ হেকমতের দিকে তাকাল। যেন ব্যাপারটা খুবই মজার এমন ভঙ্গি করে বলল, সব সমায় ছাতি ধইরা রাখনের কাম নাই। ছাতিডা বুজাও। ঐ মিহি গিয়া কামকাইজ দেহো। আমার থিকা কামকাইজ দেহন ভালো।

হেকমত আড়চোখে একবার নূরজাহানের দিকে তাকাল। ভিতরে ভিতরে ক্ষিপ্ত হয়েছে। মুখে হালকা রাগি একটা ভাব। নরম ভঙ্গিতে ছাতা বন্ধ করল, তারপর দ্রুত হেঁটে মাটিয়ালদের ভিড়ে মিশে গেল।

আলী আমজাদ বলল, বোজলা নূরজাহান, ম্যানেজার অইলে কী অইবো, এই হালায় অইলো চাকর বাকরের লাহান। শীতের দিনেও আমার মাথার উপরে ছাতি মেইল্লা রাখে। কও দিহি, তোমার খবরবাৰ্তা কী!

আলী আমজাদের চোখের দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বলল, আপনের লগে কথা আছে।

তার লগে কথা আছে নূরজাহানের শুনে অদ্ভুত এক আনন্দে বুকের খুব ভিতরে দোলা লাগল আলী আমজাদের। প্রথমে যেন কথাটা তার বিশ্বাস হল না। হাসিমুখে নূরজাহানের দিকে তাকাল। কী কইলা! আমার লগে তোমার কথা আছে!

নূরজাহান বলল, হ।

আলী আমজাদ বিগলিত হয়ে গেল। সত্য কথা কইতাছো তো, না ফাইজলামি করতাছো?

আমি আপনের লগে কোনওদিন ফাইজলামি করি?

করো না!

কবে করছি।

কতদিন করছো!

নূরজাহান মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, একদিনের কথা কন তো! কী ফাইজলামি করছি কন!

কইছিলা না আমার মুকে এমুন পচাগন্দ, আমার বউ আমার লগে থাকে কেমতে!

শুনে নূরজাহান লজ্জা পেয়ে গেল। আড়চোখে একবার মাকুন্দা কাশেমের দিকে তাকাল। অদূরে দাঁড়িয়ে আছে কাশেম। এদিকে তার মন নাই। তাকিয়ে তাকিয়ে মাটিয়ালদের কাজ দেখছে। সে

নূরজাহান যে কাশেমের দিকে তাকিয়েছে ব্যাপারটি যেন খেয়ালই করল না আলী আমজাদ। আগের মতোই আমোদর গলায় বলল, ওই দিন আমার সোনায় বানদাইন্না দাঁত লইয়া ফাইজলামি করতাছেলা। কইছেলা আমি হাসলে বলে তোমার মনে অয় আমি বেটারি লাগাইয়া হাসতাছি।

শুনে এমন হাসি পেল নূরজাহানের! এক হাতে মুখ চেপে ধরে হাসি সামলাল। বলল, আপনের দিহি বেবাক কথা মনে আছে!

থাকবো না! তোমার কথা আমার মনে না থাইক্কা পারে?

 নূরজাহান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, কন কী!

হ। মাইনষে যার কথা বেশি চিন্তা করে তার বেবাক কথা মনে থাকে।

 আমার কথা আপনে চিন্তা করেন?

করি।

ক্যান?

পরে একদিন কমুনে। সমায় অইলে কমুনে। অহন তোমার কথা কও। কী বলে কইবা আমারে! কও।

তারপর হঠাৎ করেই মাকুন্দা কাশেমকে তাদের পাশে দেখতে পেল আলী আমজাদ। নূরজাহানকে কিছু একটা বলবার জন্য আগাইয়া আসছে কাশেম। কথাটা আর বলতে পারল না, তার আগেই কুত্তার মতন খাউ খাউ করে উঠল আলী আমজাদ। এই বেডা, তুই এহেনে খাড়ইয়া রইছস ক্যা? চাছ কী!

আলী আমজাদের এরকম খেউক্কানি (খেঁকুড়ে ভাব )দেখে কাশেম থতমত খেল। মুখের কথা মুখেই রয়ে গেল তার, বলতে পারল না। বলল নূরজাহান। এমুন কইরেন না। হেয় আমার লগেঐ আইছে।

শুনে আলী আমজাদ নরম হল। অ। কীর লেইগা আইছে তোমার লগে?

এমতেঐ।

খাড়ই রইছে ক্যা? যাইতে কও গা।

একটুখানি থেমে থাকল নূরজাহান তারপর বলল, যেই কথা আপনেরে কইতে চাই হেইডা কাশেম কাকার লেইগাঐ।

কাশেম কাকা কেডা?

 নূরজাহান হাসল। এই যে হেয়।

মুখে ভারি একটা তাচ্ছিল্যের ভাব করল আলী আমজাদ। মাকুন্দারে তুমি কাকা কও?

কাকা অইলে কমু না?

কেমুন কাকা তোমার?

আপনা না। এক গেরামের মানুষ। আমার বাবারে কয় গাছিদাদা। হের লেইগা আমি কই কাকা।

আতাহরগো বাড়ির গোমস্তারে কও কাকা, শরম করে না তোমার?

কীয়ের শরম!

আড়চোখে কাশেমের দিকে একবার তাকাল আলী আমজাদ। তারপর বলল, শরম যে কীয়ের তুমি বুজবা না।

না বুজলে বুজান।

কাম নাই। কাইশ্যারে লইয়া কী কইবা কও।

আলী আমজাদের কথায় আচরণে বোঝা যাচ্ছিল কাশেমকে নিয়ে কথা বলবে নূরজাহান এটা তার ভাল লাগছে না। সে আশা করেছিল অন্যকিছু। হয়তো এমন কোনও কথা বলবে নূরজাহান যা শুনে অন্যরকম একটা আনন্দ পাবে সে!

নূরজাহান বলল, কাশেম কাকায় অহন আর মাওলানা সাবের বাইত্তে কাম করে না।

আলী আমজাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, হেইডা জানি।

কাকারে একটা কাম দেন।

চট করে নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরাল আলী আমজাদ। কী?

হ। কাম দেন একখান।

কী কাম?

মাইট্টাল বানাইয়া দেন। মাইট্টাল তো আপনের লাগে।

হ লাগে। মানুষ পাইলেঐ অহন মাইট্টাল বানাই আমি। তয় কাইশ্যারে বানান যাইবো না।

ক্যা?

ও আমার দোস্তের বাড়ির গোমস্তা আছিলো।

আছিলো কী অইছে? অহন তো নাই।

মাওলানা সাবে বাইত্তে থিকা খেদাইয়া দিছে অরে। ঐ বাড়ির খেদাইন্না মানুষ আমি রাকুম না।

ক্যা? রাকলে কী অইবো?

আতাহার গোসা করবো।

আলী আমজাদের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারল না নূরজাহান। তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

নূরজাহানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসল আলী আমজাদ। যেন নূরজাহানের কথার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে এমন ভঙ্গিতে বলল, তয় তুমি যুদি কও তাইলে কাইশ্যারে আমি রাখুম।

শুনে লাফিয়ে উঠল নূরজাহান। সত্যই রাখবেন।

সত্যই রাখুম।

 তয় রাখেন।

তুমি কইলা?

হ।

আলী আমজাদ এবার কাশেমের দিকে তাকাল। ঐ কাইশ্যা, আমার ম্যানাজার হেকমইত্তারে ডাক দে।

কাশেম লগে লগে বলল, দিতাছি।

দূরে, মাটিয়ালদের ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা হেকমতকে চিৎকার করে ডাকল। ম্যানাজার সাব, ও ম্যানাজার সাক্ট এইমিহি আহেন। কনটেকদার সাবে ডাকে।

আলী আমজাদ ডেকেছে শুনে পাগলের মতো ছুটে এল হেকমত। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কন সাব।

নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে আলী আমজাদ বলল, অরে মাইট্টাল বানাইয়া দেও।

কাকে মাটিয়াল বানাতে হবে! নূরজাহানকে! এইটুকু মেয়ে মাটিয়াল হবে কী করে? আজকাল কোনও কোনও এলাকার গরিব মেয়েছেলেরা মাটিয়ালগিরি করে কিন্তু এই এলাকায় তেমন মেয়েছেলে নাই। তাহলে?

হেকমত ভয়ে ভয়ে বলল, কারে?

মুখ ঘুরিয়ে কটমটা চোখে হেকমতের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। বোজ নাই কারে! তুই কী মনে করছস নূরজাহানরে মাইট্টাল বানাইতে কইছি আমি!

শুনে খিলখিল করে হেসে উঠল নূরজাহান। সেই হাসির শব্দে হেকমত বেকুব হয়ে গেল। এই অবস্থা থেকে তাকে বাঁচাল মাকুন্দা কাশেম। কনটেকদার সাবের কথা আপনে বোজেন নাই ম্যানাজার সাব। নূরজাহানরে না, আমারে মাইট্টাল বানাইতে কইছে।

হেকমত বলল, এইবার বুজছি।

 তারপর আলী আমজাদের দিকে তাকাল। কবে থিকা কামে লাগামু সাব

আলী আমজাদ গম্ভীর গলায় বলল, আইজ থিকাঐ।

তাইলে অহনই লাগাইয়া দেই।

দে।

লগে তো য়োড়া নাই।

আমগোই য়োড়া থিকা একটা দিয়া দে।

আইচ্ছা।

কাশেমের দিকে তাকাল হেকমত। আহো আমার লগে।

চএত সহজে এরকম কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে স্বপ্নেও ভাবেনি মাকুন্দা কাশেম। নূরজাহানের জন্য হয়েছে। তার একবার ইচ্ছা হল নূরজাহানকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। কাজে দেরি হয়ে যাবে দেখে করল না। দেরি হলে কাজটা যদি আবার না দেয় কনটেকদার সাবে!

হেকমতের পিছন পিছন ছুটতে লাগল মাকুন্দা কাশেম।

আলী আমজাদ তখন নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে আছে। নূরজাহান তাকিয়েছিল ছুটে যাওয়া কাশেমের দিকে। গভীর আনন্দে মুখটা যেন ফেটে পড়ছে তার। আলী আমজাদের দিকে মুখ ফিরাতেই সে বলল, তোমার কথা তো আমি রাখলাম তাইলে তুমিও আমার একখান কথা রাখো।

নূরজাহান অবাক হল। কী কথা?

আমার লগে এক জাগায় যাওন লাগবো। লও।

সড়ক যেখানে শেষ হয়েছে, যেখান থেকে মাটি ফেলে ফেলে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সড়ক তার থেকে খানিক দূরে সড়কের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আলী আমজাদের মোটর সাইকেল। যেন সড়কটা আলী আমজাদের বাপের সম্পত্তি। সড়কের মাঝখান ছাড়া মোটর সাইকেল সে রাখেই না। লোক চলাচল পুরা মাত্রায় শুরু না হলেও চারপাশের গ্রামের কিছু না কিছু লোক এরমধ্যেই সড়ক ব্যবহার করতে শুরু করেছে। সড়কের মাঝখানে মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে রাখলে হাঁটাচলায় যে তাদের অসুবিধা হতে পারে ওসব ভাবেই না আলী আমজাদ।

নূরজাহানকে তার লগে যাওয়ার কথা বলেই মোটর সাইকেলটার দিকে তাকাল আলী আমজাদ। নূরজাহান বলল, কই যামু আপনের লগে?

আলী আমজাদ নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরাল। হাসি মুখে বলল, আছে একখান জাগা।

কইতে পারেন না কই?

তোমার কি মনে অইতাছে আমি তোমারে খারাপ জাগায় লইয়া যামু!

একথায় নূরজাহান একটু রাগল। খারাপ জাগা ভাল জাগা আবার কী! কই লইয়া যাইবেন হেইডা কন না ক্যা?

রাগি ভঙ্গিতে কথা বলবার সময় খুবই অন্যরকম লাগে নূরজাহানকে। নাকের পাটা একটুখানি ফোলে, চোখ ছোট হয়, ভুরু কুঁচকে অদ্ভুত একটা ভঙ্গি হয় কপালের, সব মিলিয়ে দেখতে অপূর্ব লাগে।

এখনও লাগছিল।

আলী আমজাদ মুগ্ধ চোখে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরই নূরজাহানের ডান গালটা দেখতে পেল লাল হয়ে আছে। মানুষের হাতের পাঁচটা আঙুল যেন ফুটে আছে নূরজাহানের ডানগালে।

আলী আমজাদ আঁতকে উঠল। এমন একটা ভঙ্গি করল মুখের যেন নূরজাহানের গালের এই দাগ দূরজাহানের গালে পড়েনি, পড়েছে তার কলিজায়। পারলে নূরজাহানের গালটা দুইহাতে চেপে ধরে সে এমন দিশাহারা গলায় বলল, কী অইছে?

এইমাত্র হচ্ছিল এক জায়গায় যাওয়ার কথা, সেই কথা শেষ হতে না হতেই হচ্ছে আরেক কথা। তাছাড়া আলী আমজাদের দিশাহারা, ভয় পাওয়া ভাব দেখে, কথা বলবার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কী যেন কী মহা সর্বনাশ হয়ে গেছে তার। এসব দেখে মুখের রাগ উধাও হয়ে গেল নূরজাহানের চোখের দৃষ্টিতে পড়ল দুশ্চিন্তার ছায়া। বলল, কো কী অইছে?

তোমার গালে?

নূরজাহান তার ডানগালে হাত দিল। কী অইছে গালে?

লাল অইয়া রইছে। মনে অয় মাইনষের হাতের পাঁচখান লউং (আঙুল) ফুইট্টা রইছে।

আলী আমজাদের কথায় এতক্ষণের উদ্বিগ্ন ভাব কেটে গেল নূরজাহানের। সে একটু বিরক্তই হল। ইস আপনে যে কেমুন একখান মানুষ! আমার গালে কী অইছে হেইডা লইয়া যে এমুন একখান ভাব করলেন যে জাইত (জাত) সাপে দংসাইছে আপনেরে!

মুখের ভয় পাওয়া ভাব তবু বজায় খল আলী আমজাদ। বলল, করুম না? কও কী? গালডা এমুন অইয়া রইছে তেমার আর হেইডা দেইক্কা আমি কিছু কমু না!

এত কওনের কিছু নাই। এমুন করনেরও কিছু নাই।

আইচ্ছা করলাম না। অহন কও গালে কী অইছে তোমার?

এবার বাবার কথা মনে পড়ল নূরজাহানের। জীবনে প্রথম বাবা আজ তার গায়ে হাত তুলেছে। প্রচণ্ড জোরে থাবড় মেরেছে নূরজাহানের গালে। কথাটা ভেবে গভীর অভিমানে বুক ভরে গেল নূরজাহানের। চোখ ছলছল করে উঠল। চোখের পানি সামলাবার জন্য অন্যদিকে মুখ ফিরাল সে।

আলী আমজাদ বুঝল ব্যাপারটা। একটা সুযোগ নিল। হাত বাড়িয়ে নূরজাহানের একটা হাত ধরল। কী অইছে কও আমারে!

গলার স্বর কাদার মতো, যেন নূরজাহানের কষ্টে মরে যাচ্ছে সে, যেন নূরজাহানের কষ্টে এখনই হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করবে।

আলী আমজাদের এসব কায়দা একদমই পাত্তা দিল না নূরজাহান। আলী আমজাদ তার হাত ধরবার লগে লগে নিজেকে বদলে ফেলেছে সে। চোখের পানি সামলেছে, বুকের ভিতরকার অভিমান চাপা দিয়েছে। প্রথমে রাগি চোখে আলী আমজাদের দিকে তাকাল সে, তারপর ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল। হাত ছাড়েন।

আলী আমজাদের হাত থেকে ঝটকা মেরে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে নূরজাহান এই দৃশ্য কোনও মাটিয়াল দেখল কী না, দেখে কনটেকদার সাবের অপমানে ভিতরে ভিতরে পুলক বোধ করল কী না বুঝার জন্য মাটিয়ালদের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। তাকিয়ে বেকুব হয়ে গেল। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে হেকমত। কিছু একটা বলবার জন্য যেন অপেক্ষা করতাছে। অনুনয়ের চোখে তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের দিকে।

হেকমতকে দেখেই মাথায় রক্ত লাফিয়ে উঠল আলী আমজাদের। প্রচণ্ড ক্রোধে গর্জে উঠতে যাবে তার আগেই ভয়ার্ত গলায় হেকমত বলল, দেখি নাই সাব, আমি কিছু দেখি নাই। একখান কথা কইতে আইছিলাম। এমুন কোনও দরকারি কথাও না। পরে কইলেও অইবো। যাই গা।

আলী আমজাদকে রেগে উঠবার সুযোগ না দিয়ে, বকাবাজি করবার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের বেগে পা চালিয়ে মাটিয়ালদের ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল হেকমত। তবে হেকমতের কারবার দেখে ভিতরে ভিতরে ভাল রকমের ধাক্কা খেল আলী আমজাদ। মনে মনে খারাপ একটা বকা দিল হেকমতকে। চুতমারানির পোয় তো দেহি ভাল কায়দা ধরছে! বেবাক কিছু দেইক্কাও কইলো কিছু দেহে নাই। গাইল দেওনের আগে পলাইলো। কয় কী! এমুন অইলে তো হেকমইত্তার কাছে মাইর খাইয়া যামু আমি!

হেকমতের কথা ভাবতে ভাবতেই পাশে দাঁড়ান নূরজাহানের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। ভুলে গেল ঝটকা মেরে তার হাত ছাড়িয়ে দিয়ে তাকে অপমান করেছে নূরজাহান সেই দৃশ্য দেখে ফেলেছে তার ম্যানেজার। এসব যেন কোনও ব্যাপারই না এমন ভঙ্গিতে হাসল সে। কইলা না কী অইছে গালে?

নূরজাহান মুখ গোমড়া করে বলল কিছু না।

আমার কাছে মিছাকথা কইয়ো। আমি জানি কী অইছে।

কন তো কী?

কেঐ তোমার গালে থাবড় মারছে।

কে কইলো আপনেরে?

এই হগল আমি বুজি।

 তাইলে কন তো কে মারছে।

তোমার বাপে।

কথাটা শুনে চমকে উঠল নূরজাহান। কেমতে কইলেন?

আলী আমজাদ হে হে করে হাসল। কথাডা মিলছে কী না কও।

নূরজাহান মাথা নিচু করে করে বলল, মিলছে।

তয় আরেকখান কথা কই দেখবা ওইডাও মিলবো।

কী কথা?

বিয়ান থিকা অহনতরি তুমি কিছু খাও নাই।

 নূরজাহান কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

আলী আমজাদ বলল, এর লেইগা তোমারে একটা জাগায় লইয়া যাইতে চাইতাছি। তুমি আমার সামনে আইয়া খাড়নের পর তোমার মুক দেইক্কা আমি বুজছিলাম বিয়ান থিকা তুমি কিছু মুখে দেও নাই। থাবরের দাগ দেখছি পরে। কইলে বিশ্বাস করবা না, বিয়ান থিকা আমিও কইলাম কিছু মুখে দেই নাই। বহুত খিদা লাগছে। এক মাইট্টালরে পাডাইয়া কাজির পাগলা বাজার থিকা রসোগোল্লা আনাইছি। গান্দিগোষের (গান্ধি ঘোষ) দোকানের রসোগোল্লা। পাউরুটি আনাইছি। চা ও আছে। আমার লগে বহাইয়া এই হগল খাওনের লেইগা তোমারে লইয়া যাইতে চাইতাছি। আমার ঘরডা অহনতরি জাহিদ খাঁর বাড়ির লগেঐ আছে। লও যাই। দুইজনে মিল্লা খাওয়া দাওয়া করি গা।

নূরজাহান নির্বিকার গলায় বলল, না।

ক্যা?

 আমি কিছু খামু না। খিদা নাই।

না খাইলা তাও লও।

ক্যা?

আমি খাইলাম তুমি বইয়া বইয়া দেকলা। তোমার লগে কথা কইতে কইতে খাইলাম।

না।

এবার অন্য লাইন ধরল আলী আমজাদ। মুখটা শিশুর মতো অভিমানী করে বলল, তোমার এক কথায় এতবড় একখান কাম আমি কইরা দিলাম, মাকুন্দারে মাইট্টাল বানাইয়া দিলাম, ডেলি পনচাইশ সাইট টেকা কামাইবো, মাওলানা সাবের পোলা আতাহার আমার দোস্ত, তাগো কথা চিন্তা করলাম না, আর তুমি আমার একখান কথা হোনতাছো না! আমি কী বদলোক? ঐ ঘর নিয়া তোমার লগে আকাম করুম! বদলোক অইলে তুমি এহেন থিকা চইলা যাওনর পরঐত্তো মাকুন্দারে আমি কামে থিকা ছাড়াইয়া দিতে পারি। তুমি পরে আইয়া জিগাইলে কমু ও কাম পারে না দেইক্কা ছাড়াইয়া দিছি। তহন তুমি আমারে কোনও দোষ দিতে পারবা?

আলী আমজাদের কথায় ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করল নূরজাহান। মন একটু নরম হল তার। তবে মুখের ভঙ্গি বদলাল না। আগের মতোই নির্বিকার গলায় বলল, আইচ্ছা লন।

আচমকা রাজি হয়ে যাবে নূরজাহান এটা ভাবেনি আলী আমজাদ। প্রথমে কথাটা বিশ্বাসই করল না। বলল, কী কইলা?

কইলাম, লন যাই।

এবার গলাকাটা কুকরার মতন একটা ভাব হল আলী আমজাদের। কী রেখে কী করবে বুঝতে পারল না। পারলে নূরজাহানকে কুলে নিয়ে দৌড় দেয়।

তবে এই ভাব সামাল দিল আলী আমজাদ। সরল গলায় বলল, তয় লও।

পাশাপাশি হেঁটে মোটর সাইকেলটার সামনে এল দুইজন। আলী আমজাদ বলল, তুমি কোনওদিন মটর সাইকেলে চড়ছো?

না।

তাইলে আইজ তোমারে চড়ামু। অহনঐ।

মোটর সাইকেলে চড়ার কথা শুনে ভারি একটা আনন্দ হল নূরজাহানের। মোটর সাইকেলে চড়তে কেমন লাগে জানা নাই। নিশ্চয় খুব মজার।

আলী আমজাদ বলল, মটর সাইকেলে আমার পিছে বইয়া আমারে পাচাইয়া ধইরা রাখবকা। আমি তো কইরা চালাইয়া দিমু। চোক্কের নিমিষে দেখবা জাহিদ খাঁর বাড়ির সামনে গেছি গা।

মার কথা মনে পড়ল নূরজাহানের। মা একদিন বলেছিল মেয়েমানুষের শরীর শুধুমাত্র একজন পুরুষের জন্য। সেই পুরুষের নাম স্বামী। স্বামী ছাড়া অন্যকোনও পুরুষ মেয়েদের শরীর ছুঁইতে পারে না। আলী আমজাদের মোটর সাইকেলে চড়ে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরতে হলে তার বুক লেগে যাবে আলী আমজাদের পিঠে। ছি।

নূরজাহান অস্থির গলায় বলল, না না আমি মটর সাইকেলে চড়ুম না।

আলী আমজাদ অবাক হল। ক্যা?

এমতেঐ।

তারপর কথা অন্যদিকে ঘুরাল নূরজাহান। আমার ডর করে।

কীয়ের ডর? আমি আছি না!

থাকলেই বা কী, আমি চড়ুম না। আপনে মটর সাইকলে যান, আমি আইট্টাইতাছি।

আলী আমজাদ চতুর লোক। ব্যাপারটা সে বুঝল। বুঝে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসি হাসল। তাইলে আমিও আর মটর সাইকেল লমু না লও দুইজনেঐ আইট্টা যাই।

মোটর সাইকেল আগের জায়গায়ই দাঁড়িয়ে রইল, আলী আমজাদ আর নূরজাহান পাশাপাশি হাঁটতে লাগল।

.

১.৪৮

ছাপড়া ঘরের পিছনদিকে, পুকুরপারে একটা হিজলগাছ। গাছের গোড়া পুকুরপারের আঁটালমাটি কামড়ে ধরে আছে, দেহ চলে গেছে পুকুরের দিকে, গিয়ে ডিঙ্গি নৌকার মতো বাঁক নিয়ে মাথা তুলেছে আকাশে। সকালবেলার রোদ জাহিদ ধার বাড়ি ডিঙিয়ে, বাড়ির গাছপালা, বাঁশঝাড় আর চৌচালা টিনের ঘরগুলির চাল ডিঙিয়ে যখন এই পুকুরে আসে, মাথার দিককার ঝাঁপড়ানো ডালপালা দিয়ে গাছটা আপ্রাণ চেষ্টা করে বোদ ঠেকিয়ে রাখতে। রোদ পুরাপুরি ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা গাছটার নাই। ডাল পালার ফাঁক ফোকর দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রোদ এসে পড়ে পুকুরের পানিতে। হিজলের ছায়ার তলে পানি, পানির ওপর ছিটরুটির মতো রোদ, জায়গাটা সারাদিন কাল (ঠাণ্ডা) হয়ে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ তাকালে মনের ভিতর কী রকম একটা অনুভূতি হয়। এই অনুভূতির অর্থ বোঝে না বদর। বহুকালের পুরানা একখান হিজলগাছ, তার তলায় পুকুরের পানি, ছড়ানো ছিটানো রোদ, কালভাব, দেশ গ্রামের পথেঘাটে, গিরস্ত বাড়ির লগের আর ছাড়াবাড়ির নির্জন পুকুরপারে তাকালে এরকম দৃশ্য দেখা যেতেই পারে কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে মনের ভিতর এমন করবে কেন!

আজ সকালে এই অনুভূতির অর্থ বুঝতে চাইছিল বদর। কিছুক্ষণ আগে কাজির পাগলা থেকে ফিরেছে। ফিরে গান্ধী ঘোষের দোকান থেকে কাঁঠাল পাতার ঠোঙায় চিকন সুতলি দিয়ে বাঁধা রসগোল্লার পোটলা রেখেছে চৌকির ওপর। হাফ পাউন্ড পাউরুটিটা রেখেছে, কমলা রঙের ফ্লাস্কটা রেখেছে। ফ্লাস্ক ভর্তি চা। আগে চা আনতো কেটলিতে করে। এলুমিনিয়ামের মাঝারি সাইজের একটা কেটলি আছে। কেটলির নলে কাগজের ঢিপলা (দলা) দিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব হেঁটে মাওয়া কাজির পাগলা থেকে ফিরে আসতে আসতে ওই অত যত্নের পরও চা যায় পুকুরের পানি হয়ে। কাগজ জ্বেলে, শুকনা পাতা খড়নাড়া জ্বেলে আবার গরম করো চা। ম্যালা হাঙ্গম (যন্ত্রণা)। এখন এত হাঙ্গাম করবার সময় নাই। বদরকে যে চা গরম করবার কাজে বসিয়ে রাখবে, যতক্ষণে চা গরম করবে বদর ততক্ষণে দুইতিন মোড়া মাটি ফেলবে রাস্তায়, কাজ আগাবে, এসব ভেবে কয়দিন আগে দিঘলী বাজার থেকে এই ফ্লাস্কটা কিনে এনেছে আলী আমজাদ। ফ্লাস্কে রাখা চা ঘন্টার পর ঘন্টা গরম থাকে। এক ফ্লাক্স চা আনলে একা খেলে বেশ কয়েকবার খাওয়া যায়। কাপেরও দরকার হয় না, ঢাকনাটাই কাপ! সময়ে সময় বাঁচে, খেয়েও আরাম।

কিন্তু সময়ের কথা আজ ভাবছে না কেন আলী আমজাদ! এখনও যে নাশতা করতে এল না!

রোদ ওঠার পর আজ কাজের সাইটে গিয়েছে আলী আমজাদ। লগে মোটর সাইকেল। ঘুম থেকে উঠে মুখ তরি ধোয়নি। ঘন মোটা লোমের ভুরুর তলায়, নাকের বাঁকের দুইপাশে চোখের কোণে আমরুজ রঙের কেতুর (পিচুটি)। মাথার চুল এলোমেলো। বালিশে মুখ গুঁজে শুয়েছিল বলে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত পশমি কম্বল মুড়া দিয়ে রেখেছিল বলে চুল মুখে কম্বলের আঁশ লেগে আছে। মুখটা বেশ নোংরা দেখাচ্ছিল। ঘুম ভাঙার পর এসব খেয়াল করেনি আলী আমজাদ। শুধু পোশাক খেয়াল করেছে। লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঘুমিয়েছিল। উঠে কালো রঙের প্যান্ট পরেছে, সাদা শার্ট পরেছে, শার্টের ওপর প্যান্টের লগে মিলিয়ে পরেছে কোট। পায়ে জুতা, গলায় মাফলার। এমনিতেই বেদম শীত, তার ওপর চালাতে হবে মোটর সাইকেল, একদিকে মোটর সাইকেলের বেগ অন্যদিকে শীতের বেগ, দুই বেগে কাবু হয়ে যাবে আলী আমজাদ। তাছাড়া মুখ ধুতে গেলে পরিশ্রমও তো কম না! জাহিদ খাঁর বাড়ির ঘাটলায় যাও, মরার মতন ঠাণ্ডা পানিতে হাত ডুবাও, সেই পানি স্নো পাউডারের মতন লাগাও মুখে। না হয় বালতির ভোলা পানিতেই মুখ ধুইলো, সারারাত বালতিতে থাকার ফলে পুকুরের পানির চেয়ে কম ঠাণ্ডা হয় না বালতির পানি। কথা একই। বাড়িতে থাকলে না হয় গরম পানিতে মুখ ধোয়া যেত। বউ পানি গরম করে দিত। কিন্তু বাড়িতে তো আলী আমজাদ থাকছে না! থাকছে কাজের সাইটে, ছাপড়া ঘরে।

আগে প্রায়ই আতাহারদের বাড়িতে থাকত। ওই বাড়িতে থাকলেও মুখ ধোয়ার গরম পানিটা পেত। মান্নান মাওলানার অজুর জন্য যে পানি গরম করা হত তার অনেকটাই থেকে যেত আলী আমজাদের জন্য। ওই বাড়িতে থাক ল জামাই আদরে থাকা যায়।

কদিন ধরে থাকা হচ্ছে না। সারারাত কাজ চলে। হ্যাজাকের আলোয় মাটি তোলে মাটিয়ালরা, সারাদিন কাজ করে একদল, সারারাত আরেকদল। দিনের তদারকি তো আছেই, রাতের তদাররিকটাও করতে হয়। হেকমত আছে, তার ওপর কতটা নির্ভর করা যায়! কাজ কমিয়ে দিয়ে বিশ পঞ্চাশজন মাটিয়ালের কাছ থেকে এক দুইটাকা করে প্রতিদিন খেলে দিনরাত মিলে ম্যালা টাকা। মাটির কাজ শেষ হতে না হতে বড়লোক হয়ে যাবে হেকমত। মাস ছয়েক পরে দেখা যাবে নিজেই কন্ট্রাক্টর হয়ে গেছে। আজ সে যেমন ছাতা ধরে রাখে আলী আমজাদের মাথায় সেদিন তার মাথায় ছাতা ধরে রাখবে আরেকজন।

টাকা কি হেকমত মাটিয়ালদের কাছ থেকে খাচ্ছে না! বাড়তি রুজি কি তার হচ্ছে! না হলে কোন স্বার্থে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করতাছে। মানুষের শরীর তো! শরীরে কুলাচ্ছে কী করে! দুইজন ম্যানেজারের কাজ একা সে করতাছে কী করে! আলী আমজাদ নিজে তো হেকমতের দশভাগের একভাগ কাজও করতাছে না। দিনরাত মিলে ছয়সাত ঘণ্টার বেশি সাইটে সে থাকে না। যদিও প্রতি গোড়া মাটির লগেই পয়সা উঠছে তার। তবু সময়টা সে পুরাপুরি দেয় না। সাইটে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেই ক্লান্ত লাগে। যদিও দাঁড়িয়ে খুব একটা থাকতে হয় না তাকে। আলী আমজাদ সাইটে আসবার লগে লগে হেকমত এসে মাথার ওপর ছাতা ধরে, বদর ছুটে যায় সড়কের ধারের যে কোনও বাড়িতে, গিয়ে হাতাআলা, হাতছাড়া একটা কাঠের চেয়ার নিয়ে আসে। আরাম করে সেই চেয়ারে বসে আলী আমজাদ। কখনও কখনও আশপাশের বাড়ি থেকে বউঝিরা চা পর্যন্ত বানিয়ে পাঠায় তাকে। এতবড় সড়কের কাজ হচ্ছে, রাতারাতি বদলে গেছে এলাকার চেহারা, কত মানুষ, কত উন্নতি, গিরস্ত বাড়ির বউঝিদের ধারণা এই উন্নতির মূলে আলী আমজাদের মতো কন্ট্রাক্টরদের বিরাট অবদান। সুতরাং এক দুইকাপ চা দিয়ে ফেরেশতার মতো এই সব মানুষের একটুখানি সেবা যদি করা যায়।

তবু সাইটে মন টিকে না আলী আমজাদের। দাঁড়িয়ে থাকলেও ক্লান্ত লাগে, বসে থাকলেও।

কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করবার পরও হেকমতের ক্লান্তি নাই কেন? কোন লোভে, কোন আশায় ওই অসুরের পরিশ্রম সে করতাছে! আলী আমজাদ না হয় অল্প কিছু পয়সা তার বাড়িয়েছে, এই পয়সার লোভে একজন মানুষ কী এতটা পরিশ্রম করে!

রাতের কাজ শুরু করবার পর একটানা চব্বিশ ঘন্টা হেকমতকে কাজ করতে দেখে প্রথমে খুশি হয়েছে আলী আমজাদ। ভেবেছে লোক খুবই ভাল হেকমত, লোক খুবই কাজের। পয়সা যেটুকু বেড়েছে কাজ তারচেয়ে বেশিই করতাছে। এই ধরনের পরিশ্রমী লোক সবাই পছন্দ করে।

কয়েকদিন যাওয়ার পরই খটকা লাগল আলী আমজাদের। মনে হল যে পয়সা সে বাড়িয়েছে শুধুমাত্র ওই পয়সার লোভে নাওয়া খাওয়া ঘুম হারাম করে আবালের (যুবা ষাঁড়) মতো পরিশ্রম করতে পারে না কোনও মানুষ। নিশ্চয় ভিতরে কোনও রহস্য আছে। বড় রকমের কোনও স্বার্থ আছে হেকমতের। সেই স্বার্থটা ধরবার জন্য তারপর উঠে পড়ে লেগেছে আলী আমজাদ। দিন নাই রাত নাই যখন তখন চলে যায় সাইটে। প্রতিবারই যাওয়ার আগে ভাবে এইবার গিয়েই হেকমতের স্বার্থটা ধরে ফেলবে। হয়তো গিয়ে দেখবে দশ বিশজন মাটিয়াল কাজ বন্ধ করে সড়কের পাশে বসে গল্প গুজব করতাছে, বিড়ি খাচ্ছে। নয়তো দেখবে মাটিয়ালদের কাজে গতি নাই। হেকমতও সাইটে নাই। আশপাশের কোনও বাড়ির বাংলাঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। কপাল ভাল হলে হেকমতের আসল স্বার্থটাই হয়তো ধরে ফেলবে আলী আমজাদ। কাজে ফাঁকি দেওয়া মাটিয়ালদের কাছ থেকে মাথা পিছু এক দুইটাকা করে হয়তো বুঝে নিচ্ছে হেকমত আর ঠিক তখনই গিয়ে তাকে হাতেনাতে ধরবে সে।

কিন্তু আলী আমজাদের সেই আশার গুড়ে য়োড়া য়োড়া বালি ঢেলে যাচ্ছে হেকমত। যখনই সাইটে যায় আলী আমজাদ গিয়েই দেখে দৃশ্য এক রকম। মাটিয়ালরা নিয়ম মতো কাজ করতাছে, হেকমত তার নিজস্ব নিয়মে ছুটাছুটি করতাছে, চিৎকার চেঁচামেচি করতাছে, কোথাও কোনও গড়বড় নাই। আলী আমজাদ হতাশ হয়েছে, তবে দমে যায়নি। হেকমতের স্বার্থ রহস্য উদঘাটনের আশায় এখনও সমান উৎসাহে লেগে আছে। যে কারণে রাত বিরাতে আতাহারদের বাড়িতে আর ঘুমাতে যাওয়া হয় না তার। ওই বাড়িতে গেলে যখন তখন সাইটে যাওয়া হবে না। হেকমতকে হাতে নাতে ধরা হবে না।

আজ সকালেও হেমতকে ধরবার আশায়ই সাইটে এসেছে আলী আমজাদ। এসে আগের মতোই হতাশ হণেছে। মাহতাব আলীদের বাড়ি থেকে হাতলআলা কালো রঙের ভারী একখান চেয়ার এনে দিয়েছে বদর, সেই চেয়ারে বসেই পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করেছে। কিছুদিন হল মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বো না আলী আমজাদ, অন্যদিকে তাকিয়ে বলে। বদরের লগেও তাই করল। টেকাডা ধর।

গভীর উৎসাহে টাকা ধরল বদর। আড়চোখে তার টাকা ধরার ভঙ্গি খেয়াল করল আলী আমজাদ। গম্ভীর গলায় বলল, টেকা ধইরা বহুত আরাম, না?

কথাটা বুঝতে পারল না বদর। বলল, কী কইলেন?

আগের মতোই অন্যদিকে তাকিয়ে আলী আমজাদ বলল, তুই মনে করছস টেকাডা তরে আমি আল্লাদ কইরা দিলাম!

 শুনে বদর খুবই লজ্জা পেল। না হেইডা মনে করুম ক্যা? আমারে আপনে টেকা দিবেন কীর লেইগা?

তাইলে যে ভেটকাইলি (হাসলি)।

কুনসুম ভেটকাইছি!

ভেটকাইছস। আমি দেকছি।

এবার সত্যি সত্যি হাসল বদর। কেমতে দেকলেন? আপনে তো অন্যমিহি চাইয়া আছিলেন!

আমার চক্কু অইলো আষ্টডা। সবই দেহি। কুনসুম কুন চক্কু দিয়া দেহি কেঐ উদিস পাইবো না।

তয় আমি কইলাম হাসি নাই কনটেকদার সাব। সত্যঐ হাসি নাই।

না হাসলেও আমদ পাইছস। ক পাচ নাই?

বদর মাথা নিচু করে বলল, হ পাইছি।

কীর লেইগা পাইছস কমু আমি?

কন তো!

তুই বোজছস তরে কোনও কামে পাডামু আমি। মাইট্টালগিরি ছাড়া অন্য যে কোনও কামে পাড়াইলে তুই বড় আমদ পাচ। ক পাচ না?

হ পাই। মাইট্টালগিরি করতে আমার ভাল্লাগে না।

এবার বদরের দিকে মুখ ফিরাল আলী আমজাদ। হাসল। তয় বোজছস আমি কী মাল?

বুজছি।

এইবার তাইলে কাজির পাগলা বাজারে যা। গান্দির দোকান থিকা দুইটেকা দামের আষ্ট রসোগোল্লা আনবি, এক ফেলাচ (ফ্লাস্ক) চা আনবি। করিমের ডাক্তারখানার লগে একখান দোকান আছে ওই দোকান থেইকা একখান পোয়ারুটি (পাউরুটি) আনবি। মাজারকি (মাঝারি)।

কোটের পকেট থেকে ছাপড়া ঘরের চাবি বের করে বদরের হাতে দিয়েছে আলী আমজাদ। জিনিসটি আইন্না ঘর খুইল্লা বহিচ। আমি আইতাছি। দেরি করিচ না কইলাম। আমি আইয়া যদি দেহি তুই আহচ নাই তাইলে কইলাম খাইছি তরে। বহুত খিদা লাগছে আমার।

ভারি একটা উদ্বেগ নিয়ে তারপর কাজির পাগলা ছুটেছে বদর। যত দ্রুত সম্ভব ফিরে এসেছে। এসে যখন দেখেছে আলী আমজাদ আসেনি, খুশি হয়ে ঘরের দুয়ার খুলেছে। জিনিসগুলি চৌকির ওপর রেখে নিজে এসে বসেছে বাইরে, দুয়ারের কাছে এমন জায়গায় যেখান থেকে পুকুরের ওপর ঝুঁকে থাকা হিজলগাছটা পরিষ্কার দেখা যায়। গাছের তলায় পানির ওপর ছিটরুটির মতো রোদ, ঠাণ্ডা একখান ভাব, তাকিয়ে থাকতে থাকতে আশ্চর্য এক ঘোর লেগে গেল বদরের। বুকের ভিতর অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই অনুভূতির অর্থ কী!

কতক্ষণ এই গাছের দিকে তাকিয়ে বসে আছে বদর, মনে নাই। হঠাৎই পিছনে একজোড়া মানুষের পায়ের শব্দ পেল। ঘোর ভেঙে গেল। চমকে পেছন ফিরে তাকাল।

বদরের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আলী আমজাদ। সঙ্গে নূরজাহান। এখানে মাটিয়ালের কাজ করতে আসার পর থেকেই নূরজাহানকে চিনে বদর। সময় সময় সড়কের কাজ দেখতে আসে। চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে। সারাক্ষণই দইকুলির (দোয়েল পাখি) মতন লাফায়। কখনও হাঁটে না, ছুটে বেডায়। গাঙ্গের পানির মতন আওয়াজ করে হাসে। মুখখানা এত মিষ্টি মেয়েটার, মুখের দিকে তাকালে খারাপ মন ভাল হয়ে যায়।

সেই মেয়ে আজ এত বিষণ্ণ হয়ে আছে কেন?

আলী আমজাদকে দেখেই ফাল (লাফ) দিয়ে উঠেছে বদর। যে হিজলগাছের দিকে তাকিয়ে মনের ভিতরকার রহস্য বোঝার চেষ্টা করছিল, কোথায় উধাও হয়ে গেল সেই সব। আলী আমজাদের সঙ্গে কথা বলল না সে। পাশে দাঁড়ান নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রতিদিনকার মতোই ডুরেশাড়ি পরা নূরজাহান। টিয়াপাখি রঙের শাড়ির ওপর টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো লাল রঙের ডোরা। কিন্তু মুখ এমন মলিন কেন মেয়েটার! কোথায় তার চঞ্চলতা, কোথায় হাসি। আলী আজাদের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। চোখে উদাসীন দৃষ্টি! হঠাৎ করে এমন বদলে গেছে কেন নূরজাহান! কী হয়েছে তার? এরকম সকালবেলা আলী আমজাদের লগে কোথা থেকে এল?

বদরের ইচ্ছা করে নূরজাহানকে জিজ্ঞাসা করে, ও মাইয়া, কী অইছে তোমার? আইজ দিহি হাসো না, বইচা মাছের লাহান ফালাও না, আইজ দিহি তুমি অন্য মানুষ! বিয়াইন্নাবেলা কনটেকদার সাবের লগে কই থিকা আইলা?

জিজ্ঞাসা করা হয় না। আলী আমজাদের মানুষের লগে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে তার কোনও মাটিয়াল এমন সাহস, এমন কলিজা কার আছে। আবার যদি হয় মেয়েমানুষ! আগ বাড়িয়ে কথা বলতে গেলে ঢোর (স্বরনালী) ছিঁড়ে ফেলবে আলী আমজাদ। পাছায় লাথথি মেরে কাজ ছাড়িয়ে দিবে। মারের লগে কাজ চলে যাওয়া, কে যাবে এমন কাজ করতে! তারচেয়ে মনের কথা মনে চেপে রাখা ভাল।

নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে বদর, আলী আমজাদ বলল, আনছচ?

আলী আমজাদের দিকে মুখ ফিরাল বদর। দাঁত না বের করা হাসি হেসে বলল, হ আনছি।

কুনসুম?

আট্টু আগে।

তারবাদে কী করছস?

বইয়া রইছি।

ক্যা?

পলকের জন্য নূরজাহানের দিকে তাকিয়েই আলী আমজাদের দিকে তাকাল বদর। মুখটা হাসি হাসি করল। আপনেঐত্তো কইছেন বেবাক জিনিস আইন্না য্যান বইয়া থাকি। আমার আগে য্যান আপনে না আহেন।

তরে কী আমি বাইরে বইয়া থাকতে কইছি।

না কোনহানে বমু হেইডা কন নাই।

বদর আবার নূরজাহানের দিকে তাকাল।

এবার ঘেটি কাত করে ব্যাপারটা খেয়াল করল আলী আমজাদ। ভিতরে ভিতরে রাগল। রাগলে গলার স্বর প্রথমে নিচে নামে তার, তারপর ওঠে। এখনও তাই হল। অরে চিনচ?

কথাটা বুঝতে পারল না বদর। বলল, কারে?

এই যে আমার লগে আইছে, আমার লগে খাড়ইয়া রইছে?

চিনুম না ক্যা?

ক তো কে?

নূরজাহান। দবির গাছির মাইয়া।

এত ভাল কইরা যহন চিনচ তাইলে বারবার অর মুখের মিহি চাইতাছস ক্যা?

একথায় বদর লজ্জা পেল। কথার উত্তর দিল না। মাথা নিচু করল।

আলী আমজাদের গলা এবার একটু উঠল। কইলি না?

বদর ভয় পেয়ে গেল। এমতেঐ চাইছি।

এবার রাগে ফেটে পড়ল আলী আমজাদ। এমতে চাইছো চুতমারানির পো! তুমি একখান বদ। জিনিসপত্র লইয়া ঘরে না বইয়া থাইক্কা তুমি আইয়া বইছে বাইরে। এমুন জাগায় বইছো যেহেন থিকা জাহিদ খাঁর বাড়ির ঘাড দেহা যায়। বাড়ির বউঝিরা ঘাড়ে আহে তুমি চাইয়া চাইয়া দেহে। বহুতদিন তোমারে আমি দেকছি বাড়ির বউঝি দেকলে তুমি মিষ্টাইয়া মিষ্টাইয়া (মিটি মিটি) হাসো।

একটু থেমে, নূরজাহানের দিকে একবার তাকিয়ে, আবার বদরের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। চড়া গলা নামাল। তর কপালে কইলাম শনি আছে।

বদরের ইচ্ছা হল আলী আমজাদকে বলে, সে ভুলেও জাহিদ খার বাড়ির ঘাটলার দিকে তাকায় না, সে তাকায় ওই যে পুকুরের ওপর বাঁকা হয়ে থাকা গাছটার দিকে। গাছটার দিকে তাকালে তার মনের ভিতর কেমন করে।

বলা হয় না। আলী আমজাদ বিশ্বাস করবে না। বললে বকাবাজির মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। ভেক ধরছো চুতমারানির পো! 

অন্য সময় হলে আলী আমজাদের বকাবাজি গায়ে লাগত না বদরের, এরকম বকাবাজি তো দিনে রাতে মিলে বহুবার বহুজনকে করতাছে আলী আমজাদ। দুইচার দিনে এক দুইবার বদরকেও করে। শুনে অভ্যস্ত বদর। কিন্তু আজকের বকাটা খুব গায়ে লেগেছে তার। নূরজাহানের সামনে হুদাহুদি (শুধু শুধু) এমন বকা! নূরজাহানের দিকে তো বদচোখে একবারও তাকায়নি বদর। আর জাহিদ খাঁর বাড়ির বউঝিদের দিকে চোখ তুলে তাকাবার সাহস তার হবে কেন!

দুঃখে অপমানে চোখ ফেটে যেতে চাইল বদরের। আলী আমজাদ ওসব খেয়াল করল না। বলল, কয় টেকা খরচা করছস?

নিজেকে সামাল দিয়ে বদর বলল, সাতাইশ টেকা।

কেমতে?

দুই টেকা দামের আষ্টডা রসোগোল্লা ষোল্ল টেকা, পোয়ারুটি ছয় টেকা, চা পাঁচ টেকা। ষোল্ল আর ছয় বাইশ আর পাঁচ সাতাইশ।

লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বাকি টাকা বের করে দিল বদর। টাকা হাতে নিয়ে আলী আমজাদ বলল, চুরি করছস কত?

একথায় বদর একেবারে আঁতকে উঠল। মুখের অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আলী আমজাদের দিকে। কথা বলতে যেন ভুলে গেল।

আলী আমজাদ আবার বলল, কইলি না?

এতক্ষণ ধরে মানুষ দুইজনের কথা শুনছিল নূরজাহান। নিজে কথা বলেনি। এবার বলল। আলী আমজাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী প্যাচাইল পারতাছেন? বান্দা ইসাব দিছে। এহেন থিকা চুরি করবো কেমতে!

বদরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নূরজাহানের দিকে তাকাল আলী আমজাদ। এতক্ষণের রাগরাগি, বকাবাজি সব ভুলে গেল। সোনায় বাঁধানো দাঁতে ঝিলিক দিয়ে হাসল। করতাছে, করতাছে। এর মইদ্যেও চুরি করনের পথ আছে। আষ্টডা রসোগোল্লা কিন্না ষোল্ল টেকার জাগায় গান্দিরে দিছে পোনরো টেকা। চাইর টেকার চা কিন্না কইতাছে পাঁচ টেকা। খালি পোয়াটিডা থিকা চুরি করতে পারে নাই। ওইডার বান্দা দাম।

বদর তখনও তাকিয়ে আছে আলী আমজাদের দিকে। মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি, চোখে পলক পড়ে না। ব্যাপারটা আলী আমজাদ খেয়াল করল না, পাত্তা দিল না। নূরজাহান খেয়াল করল। বদরের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনে যান গা।

আলী আমজাদও বলল, হ যা গা। যা চুরি করছস, করছস। হেইডা তো আর ফিরত পামু না। যা অহন কামে যা।

বদর তবু নড়ল না। আগের মতোই তাকিয়ে রইল আলী আমজাদের দিকে। চোখে পলক পড়ে না তার।

এবার আলী আমজাদ বিরক্ত হল। খাউ খাউ করে উঠল, কীরে যাচ না?

বদর নড়েচড়ে উঠল। চোখে পলক পড়ল তার। মুখভঙ্গি বদলে গেল। তবে এক পা নড়ল না সে।

বদর নড়ছে না দেখে আলী আমজাদ এবার প্রচণ্ড রাগল। চিৎকার করে বলল, কীরে অহনরি যে খাড়োইয়া রইলি! গেলি না।

কোন ফাঁকে বদরের মুখভঙ্গি আবার বদলেছে, চোখের দৃষ্টি আবার বদলেছে। শীতল চিন্তিত একটা ভঙ্গি তার চোখে মুখে। আলী আমজাদ যত জোরে চিৎকার করল ঠিক ততটাই নিচু গলায় সে বলল, আপনে আমারে চোর কইলেন!

আলী আমজাদ আবার চিৎকার করল। হ কইলাম। তুই চুরি করছস কইছি। চোররে চোর কমু না, দারগা কমুনি!

ক্যান কইলেন? আমি তো চুরি করি নাই।

চুরি কইরা বেবাকতেই এইকথা কয়।

আমি মিছাকথা কই না।

আলী আমজাদ মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, না তুমি মিছাকথা কও না নমবার পো! (নমোরপুত্র অর্থে) তুমি অইলা পীর আউল্লা (আউলিয়া)। যা সর আমার চোক্কের সামনে থিকা।

বদরের দৃষ্টি এখনও আগের মতো। চিন্তিত, অপমানিত মুখভঙ্গি। আলী আমজাদ এত যে চিল্লাচিল্লি করতাছে তার যেন গায়েই লাগছে না।

আলী আমজাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক আগের ভঙ্গিতে আবার বলল, আমি মিছাকথা কই না। একটা পয়সাও আপনের চুরি করি নাই। আমগো বংশের কেঐ চোর না। আমার বাপ দাদায় বহুত পরহেজগার মানুষ আছিলো। আপনে আমারে চোর কইলেন ক্যা?

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না আলী আমজাদ। লগে যে নূরজাহান আছে ভুলে গেল। প্রচণ্ড রাগে ঝাঁপিয়ে পড়ল বদরের ওপর। ডানহাতে এমন জোরে ঘেটি ধাক্কা দিল বদরের, বদর উড়ে গিয়ে তিনচার হাত দূরে পড়ল। মুখটা মাটিতে থুবড়ে গেল। তবু মুখভঙ্গি আর চোখের দৃষ্টি বদলাল না তার। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়াল, হাতমুখে লাগা ধুলামাটি ঝাড়ল তারপর আবার এসে দাঁড়াল আলী আমজাদের সামনে। আপনে আমারে চোর কইলেন!

এবার আলী আমজাদ থতমত খেল। তবে পলকের জন্য। তারপরই নিজেকে সামলাল। আগের তেজ বজায় রেখে বলল, চুতমারানির পোয় তো বহুত দিগদারি (যন্ত্রণা) করতাছে। ঐ বেডা চোর কইছি কী অইছে। তুই কইলাম যা এহেন থিকা। অহনতরি নাস্তাপানি খাই নাই। মেজবান লইয়াইছি নাস্তা খাইতে। মিজাজ আর খারাপ করি না। তাইলে পিডাইয়া মাইরাই হালামু। যা কামে যা।

এসব কথা বদরের যেন কানেই গেল না। সে আগের মতোই বলল, আপনে আমারে চোর কইলেন!

এবার আলী আমজাদের গেল মাথা খারাপ হয়ে। দুইহাত তুলে বদরের গলা টিপে ধরতে গেল কিন্তু পারল না, নূরজাহান এসে মাঝখানে দাঁড়াল। বদরকে কিছু বলল না, বদরের দিকে তাকালও না। আলী আমজাদের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝাল গলায় বলল, কী আরম্ব করলেন আপনে?

নূরজাহানকে এভাবে মাঝখানে দাঁড়াতে দেখে থামল আলী আমজাদ। তবে গলার জোর কমাল না। বলল, অরে চোর কইছি কী অইছে! এমুন করতাছে ক্যা? কামে যায় না ক্যা?

নূরজাহান বদরের দিকে তাকাল যান আপনে কামে যান।

নূরজাহানের কথায় চোখ ছলছল করে উঠল বদরের। কাতর গলায় বলল, কনটেকদার সাবে আমারে চোর কইলো ক্যা? কও বইন, আমি বলে চোর? আমি বলে চুরি করছি। আমগো বাড়ি কান্দিপাড়া। ভাল বংশের পোলা আমি। পেডের দায়ে মাইট্টাল অইছি। চোর অইলে তো আগেঐ অইতে পারতাম!

সামান্য একটা কথায় এমন আঘাত পেতে পারে কোনও মানুষ, এমন করে ভেঙে পড়তে পারে নূরজাহান কখনও দেখেনি। নূরজাহান কী, তার বাপের বয়সী আলী আমজাদও দেখেনি। দুইজনই তারা অবাক হয়েছে। তবে দুইজনের অবাক হওয়া দুইরকম। আলী আমজাদ ভাবছে চুরি বদর করেছেই না হলে এইটুকু কথা এত গায়ে লাগবো কেন তার! এইটুকু কথা নিয়া এমন বাড়াবাড়ি সে কেন করবে! আর নূরজাহান। ভাবছে, চুরি করার কথা শুনে, তাও নূরজাহানের সামনে চোর বলা হয়েছে দেখে এতটা ভেঙে পড়েছে বদর। আসলে চুরি সে করেনি।

মানুষটার জন্য খুব মায়া লাগল নূরজাহানের। বদরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কথাডা কনটেকদার সাবে এমতে কইছে। আমি জানি আপনে চুরি করেন নাই। আপনে ভাল মানুষ। যান কামে যান।

বদর তারপর আর একটাও কথা বলল না। দুইহাতে চোখ মুছতে মুছতে সড়কে উঠল, উঠে ধীরে পায়ে হাঁটতে লাগল। যেন কাজে যাওয়ার কোনও গরজ নাই তার।

একবার বদরের দিকে তাকিয়ে নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরাল আলী আমজাদ। হাসল। বদইরা হালায় পাগল! চোর কইলে এমুন করে মাইনষে! কইছি কী অইছে!

নূরজাহান চিন্তিত গলায় বলল, চুরি হেয় করে নাই।

করছে।

কেমতে বুজলেন?

 চুরি না করলে কথাডা অর গায় লাগতো না।

আমার মনে অয় অন্যকথা। চুরি করে নাই দেইক্কাঐ কথাডা তার গায় লাগছে, মনে লাগছে।

যা ইচ্ছা অউক গা। লও ঘরে লও।

নূরজাহন একটু চমকাল। ক্যা ঘরে যামু ক্যা?

আলী আমজাদ হাসল। নাস্তা খাইবা না?

না। কইলাম যে খিদা নাই!

খিদা তোমার আছে। লও।

বলেই নূরজাহানের কাঁধে হাত দেওয়ার চেষ্টা করল আলী আমজাদ। তার আগেই চট করে সরে গেল নূরজাহান। একটু রাগল। আপনে কইলাম এমুন করবেন না আমার লগে।

নূরজাহানের কথায় দমল না আলী আমজাদ। হাঁসিমুখে বলল, কী করলাম।

 খালি শইল্লে হাত দিতে চান!

কো?

চান। আমি খ্যাল করছি।

এইডা আমি কুমতলবে করি না। আমার আব্বাস।

অব্বাসটা ভাল না।

ভাল অইবো না ক্যা! বেবাকতের লগে তো করি না! যারে আপনা মনে করি তার লগে করি। আপনা মাইনষের হাত ধরলে কী অয়? কান্দে হাত দিলে কী অয়!

কী অয় হেইডা জানি না। আমি আপনের আপনা মানুষ না।

মুখ করুণ করল আলী আমজাদ। তুমি আমারে আপনা মানুষ না মনে করতে পারো, আমি করি। করি দেইক্কাঐ তোমার কথার লগে লগে কাইশ্যারে মাইট্টালগিরির কামে লইয়া লইলাম। কাইশ্যা অইলো আমার দোস্ত আতাহারগো গোমস্তা। আতাহারের বাপে যারে বাইতথনে খেদাইয়া দিছে তার কামে লওন ঠিক না। দোস্ত অইয়া দোস্তর লগে বেঈমানি। হেই বেঈমানি আমি তোমার লেইগাঐ করলাম! তারবাদেও তুমি আমারে আপনা ভাবো না! দেশ গেরামের মাইনষে এর লেইগাঐ কয়, যার লেইগা চুরি করি হেয় কয় চোর।

আলী আমজাদের করুণ মুখভঙ্গি আর কথার বলার ধরন দেখে মন নরম হল নূরজাহানের। সে কোনও কথা বলল না। অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল।

আড়চোখে নূরজাহানকে একবার দেখল আলী আমজাদ। কপট অভিমানের গলায় বলল, আইচ্ছা ঘরে যাওনের কাম নাই। লও যাই গা।

কামের ওহেনে।

ক্যা?

এমতেঐ।

নাস্তা খাইবেন না?

না। খিদা নষ্ট হইয়া গেছে।

নূরজাহান মিষ্টি করে হাসল। যেই নাস্তার লেইগা এতকিছু করলেন, ভাল একটা মানুষরে চোর বানাইলেন আর অহন হেই নাস্তা খাইবেন না?

আলী আমজাদ মুখ গোমড়া করে বলল, না খামু না।

আমি ঘরে গেলে খাইবেন?

না। তাও খামু না।

 ক্যা?

খিদা মইরা গেছে।

আমি লগে বইলে খিদা আবার জ্যাতা (জ্যান্ত) অইয়া যাইবো। লন।

আলী আমজাদের আগে নূরজাহানই গিয়ে ছাপড়া ঘরে ঢুকল।

এবার সাবধানী চোখে চারদিক তাকাল আলী আমজাদ। তারপর ঘরে ঢুকল। তবে মুখ তখনও গোমড়া করে রেখেছে। ভঙ্গি এমন যেন নূরজাহান তার ঘরে ঢোকা না ঢোকায় তার কিছুই যায় আসে না।

চৌকির ওপর রসগোল্লার ঠোঙা, পাউরুটি আর চা ভর্তি ফ্লাক্স। তার একপাশে বসল নূরজাহান। বসে আলী আমজাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই যে আমি বইলাম, অহন খাইতে বহেন।

 মুখ তবু উজ্জ্বল হল না আলী আমজাদের। গম্ভীর গলায় বলল, দুয়ারডা লাগায় দেই।

নূরজাহান নরম গলায় বলল, ক্যা দুয়ার লাগাইবেন ক্যা?

দেশ গেরামের কারবার। কেঐ যদি আমার লগে এই ঘরের মইদ্যে তোমারে বইয়া থাকতে দেহে তাইলে সন্দ করবো।

কী সন্দ করবো?

হেইডা তুমি বোজবা না।

বুজুম না ক্যা? বেবাক বুজি। খোলাঘরে বইয়া থাকতে দেকলে মন্দ কইবো না, দুয়ার বন্দ ঘরে দেকলে মন্দ কইবো।

দুয়ার বন্দ ঘরে মানুষ আছে না আছে বোজবো কেমতে?

বাইর অওনের সুম দেকবো না?

না দেকবো না। পয়লা আস্তে কইরা দুয়ার খুলুম আমি। তারবাদে চাইরমিহি চাইয়া যহন দেহুম কেঐ কুনহানে নাই চুপ্পে চুপ্পে তোমারে বাইর কইরা দিমু।

নূরজাহান কথা বলবার আগেই কপাটে হাত দিল আলী আমজাদ। কিন্তু এখনও ইট বিছানো হয়নি এমন কাঁচা মাটির সড়ক ধরে একটা রিকশা এসে যে গ্রামে ঢুকবে আলী আমজাদ তা কল্পনাও করেনি। বন্ধ করবার জন্য কপাটে মাত্র হাত দিয়েছে, বুক তোলপাড় করতাছে চোরা উত্তেজনায়, সেই উত্তেজনা নাস্তানাবুদ করে মান্নান মাওলানার বাড়ি ডানদিকে রেখে টুং টাং শব্দে এগিয়ে আসছিল একটা রিকশা। রিকশায় পায়ের উপর পা তুলে বসা একজন মাত্র সওয়ারী। চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে ফুলহাতা সোয়টার, জিনসের প্যান্ট। পায়ে সাদা কেডস। কোলের ওপর ধরা কালো রঙের ব্যাগ। এতটা দূর থেকেও রিকশায় তার বসার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায় দাপটের মানুষ।

বেল বাজিয়ে অকারণেই টুং টাং শব্দ করতাছে রিকশাআলা। যে উত্তেজনায় বিভোর হয়ে আছে আলী আমজাদ, রিকশার ওই সামান্য শব্দ তার কানে যেত না। কিন্তু রিকশা এসে গ্রামে ঢোকার লগে লগে সড়কের দুই পাশের বাড়িঘরে সাড়া পড়ে গেছে। বেশ একটা আমোদ ফুর্তির ভাব লেগে গেছে মানুষের মধ্যে। গিরস্ত বাড়ির বউঝি, অল্প বয়েসী পোলাপান, যেখোলায় কাজ করতে থাকা কামলা চাষী, সড়ক পথে চলাচল করা দুই চারজন পথিক আজকের আগে অনেকেই তারা রিকশা দেখেনি বলে কামলা চাষীরা হাতের কাজ ফেলে যে যেখানে ছিল উঠে দাঁড়িয়েছে, পথিকরা বন্ধ করেছে। চলাচল, হই হই শব্দে ছেলেমেয়েরা এসে জুটেছে রিকশার সামনে, পিছনে, ডাইনে বাঁয়ে আর বাড়ির বউঝিরা এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির নামায় কেউ, বারবাড়িতে কেউ। প্রত্যেকের মধ্যেই উত্তেজনা। রিকশা নিয়ে নানারকম কথাবার্তা বলছে বউঝিরা, চাষী কামলা পথিকরা, আর পোলাপানগুলি করতাছে চিল্লাচিল্লি।

এই চিল্লাচিল্লির শব্দটাই পেল আলী আমজাদ। পেয়ে থতমত খেল। দুয়ার বন্ধ না করে গলা বাড়িয়ে সড়কের দিকে তাকাল। তাকিয়ে বেকুব হয়ে গেল। রিকশা ঢোকছে গেরামে।

চিল্লাচিল্লির শব্দ নূরজাহানও পেয়েছিল কিন্তু গায়ে লাগায়নি। আলী আমজাদকে ওভাবে তাকাতে দেখে নির্বিকার গলায় বলল, কী অইছে?

নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরাল না আলী আমজাদ। রিকশাটা এদিকেই আসছে দেখে মহাবিরক্ত হল। রাগে দুঃখে ভিতরটা ফেটে ছ্যাড়াভেড়া হয়ে যাচ্ছিল তার। এই এলাকায় কাজ করতে আসার পর থেকে, নূরজাহানকে প্রথম যেদিন দেখল সেদিনের পর থেকে মেয়েটাকে যে কোনওভাবে একবার, শুধু একবার পাওয়ার জন্য যত রকমের চেষ্টা লোকচক্ষু ফাঁকি দিয়ে, দশদিক ঠিক রেখে করা যায় করে গেছে আলী আমজাদ। তার এতকালের চেষ্টা আজ সফল হতে চলেছে। কোনও রকমে দুয়ারে যদি খিল একবার দিতে পারত সে তাহলে কোনও না কোনও ভাবে মনের আশা আজ পূরণ হতই। মুখের কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে হোক, যত রকমের কায়দা করা যায় করে থোক মনের আশা সে পূরণ করতই। যদি তাতেও না হত তাহলে জোর করত। দরকার হলে হাতমুখ বেঁধে নিত নূরজাহানের।

তীরে এসে তরী ডুবে গেল আলী আমজাদের। কোথা থেকে গ্রামে এসে ঢুকল রিকশা। কারও কিছু হল না সর্বনাশ হল শুধু আলী আমজাদের।

রাগে ক্রোধে ভিতরটা বাঙ্গির মত ফেটে যেতে চাইছে আলী আমজাদের। মনে মনে রিকশায় বসা লোকটাকে বেদম গালাগাল করতে লাগল সে। তুই কেডারে নম্বার পোয় কইথিকা আইলি? খাড়ো, জুইত (সুবিধে) মতন পাইয়া লই, গোয়া মাইরা দিমু তর।

আলী আমজাদ কথা বলছে না দেখে নূরজাহান আবার বলল, কী অইছে! এত চিল্লা চিল্লি কীয়ের!

এবারও নূরজাহানের দিকে মুখ ফিরাল না আলী আমজাদ। রিকশায় বসা লোটার উদ্দেশ্যে মনে মনে করতে থাকা গালাগাল বন্ধ করে মনমরা গলায় বলল, একখান রিকশা আইছে।

কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। বলল, কী হইছে?

রিকশা।

নিজের অজান্তে চৌকিতে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা মেয়েটা তারপর উঠে দাঁড়াল। রিকশা আইছে আমগো গেরামে! কন কী!

নূরজাহানের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাবার আগেই, নূরজাহানের লগে কথা বলবার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ছাপড়া ঘর থেকে পাগলের মতো ছুটে বেরুল নূরজাহান। প্রথমে বেশিদূর গেল না, ঘরের অদূরে, সড়কের মুখে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে রিকশার দিকে তাকিয়ে রইল। আনন্দে উত্তেজনায় মিষ্টি মুখখানা ফেটে পড়ছিল। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া এতগুলি ঘটনার কোনওটাই আর মনে রইল না।

রিকশা তখন হাজামবাড়ি বরাবর থেমেছে চারদিক ঘিরে ধরেছে পোলাপানে। চিল্লাচিল্লি এখন একটু থেমেছে তবে রিকশায় বসা লোকটা তখনও রিকশা থেকে নামেনি। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এই লোককে দেখতে না, রিকশা একেবারে কাছ থেকে দেখবার জন্য আচমকাই দৌড় দিল নূরজাহান।

বাপের হাতে থাবড় খাওয়ার পর নূরজাহান আজ আর নূরজাহান ছিল না, একেবারেই বদলে গিয়েছিল। গ্রামে রিকশা দেখে, আচমকা দৌড় দেওয়ার সময় সে আবার নূরজাহান হয়ে গেল। জোয়ারের পানিতে ছুটতে থাকা মাছের মতো ছুটতে লাগল। পিছনে কপাট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আলী আমজাদের মনের ভিতর যে তখন কী হচ্ছে আলী আমজাদ ছাড়া কেউ তা জানে না। কয়েক পলক ছুটন্ত নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে রইল সে, তারপর মুখ ঘুরিয়ে ঘরের ভিতর চৌকির দিকে তাকাল। চৌকির ওপর কাঁঠালপাতার ঠোঙায় বাঁধা গান্ধি ঘোষের আটখান রসগোল্লা, হাফ পাউণ্ড পাউরুটি আর ফ্লাস্ক ভর্তি চা, জিনিসগুলো যেমন ছিল তেমনই আছে, শুধু পাশে বসা নূরজাহান নাই।

আস্তে ধীরে হেঁটে চৌকিটার সামনে এল আলী আমজাদ। তারপর প্রথমেই যেন রিকশায় বসা লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এমন ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্লাক্সের ওপর। বেদম জোরে একটা লাথথি মারল ফ্লাস্কে। উড়ে গিয়ে ধাম করে ঢেউটিনের চালায় লাগল জিনিসটা। লেগে চৌচির হয়ে গেল। ঢাকনা খুলে, ঢাকনার তলার মুখ খুলে কোনটা কোনদিকে ছিটকে গেল কে জানে? ফাটা ফ্লাস্কের মুখ দিয়ে, তলা দিয়ে ভরভর করে তখন চা পড়ছে। যেন রিকশায় বসা লোকটাকেই লাথথি মেরে নাকমুখ ফাটিয়ে দিয়েছে আলী আমজাদ। ফাটা নামুখ দিয়ে এখন ভরভর করে রক্ত পড়ছে। আর। সড়কের মাটি ভিজছে। তারপর বিশাল ক্রোধে দুই হাতে পাউরুটিটা খামছে ধরল আলী আমজাদ, যেন রিকশাআলার ঘেটি গলা খামছি দিয়া ধরছে। ধরে এমন দলা মোচড়া করতে লাগল যেন রিকশাআলার ঘেটি মুচড়ে, গলা টিপে আধামরা করে ছুঁড়ে ফেলছে সড়কের ধারে এমন ভঙ্গিতে পাউরুটিটা ছুঁড়ে ফেলল।

রসগোল্লার ঠোঙাটা যেমন ছিল তখনও তেমন আছে। ঠোঙাটাকে আলী আমজাদের মনে হল খালি রিকশা। এতক্ষণ সওয়ারী ছিল, রিকশাআলা ছিল, তাদের উপর প্রতিশোধ আলী আমজাদ নিয়ে ফেলেছে। এখন বাকি আছে শুধু রিকশা, রিকশাটাকেও ছাড়বে না আলী আমজাদ। এই রিকশার জন্যই হাতের কাছে এসেও ফসকে গেছে শিকার!

শরীরের সব শক্তি এক করে, শরীরের সব রাগ ক্রোধ এক করে যেন রিকশার হুড ভাঙছে আলী আমজাদ এমন ভঙ্গিতে খচমচ করে মিষ্টির ঠোঙা ছিঁড়ল, ছিঁড়ে একটা একটা করে রসগোল্লা একেকদিকে ছুঁড়তে লাগল, যেন রিকশা ভেঙে টুকরা টুকরা করে রিকশার একেক অংশ একেক দিকে ছুঁড়ে ফেলছে। এরকম শীতসকালেও আলী আমজাদের কপালে ঘেটিতে আর গলায় জমেছে রসগোল্লার সিরার (রস) মতন ঘাম। কোটের তলায়, শার্টের তলায় ক্রোধের গরমভাপ চোখ কান ঝাঁ ঝাঁ করতাছে। নাকমুখ দিয়ে সমানে বের হচ্ছে গরম চায়ের বাষ্পের মতো শ্বাস। আলী আমজাদ আর মানুষ নাই, জন্তু হয়ে গেছে।

.

১.৪৯

হাজামবাড়ি আর সড়কের মাঝখানে দশগণ্ডা জমিন। সেই জমিন চোখের পলকে পেরিয়ে এল তছি পাগলনি। প্রথমে বাড়ির নামা থেকে রিকশাটা দেখেছে সে, দেখে দামড়ি বাছুরের মতো দুই তিনটা লাফ দিয়েছে তারপর চিৎকার করতে করতে সড়কের দিকে ছুটেছে। তোমরা কে কই আছো, দেইক্কা যাও, রিশকা আইছে দ্যাশে।

তছি পাগলনির পরনে বেগুনি রঙের সস্তা একখান কাপড়। কয়দিন ধরে এই কাপড় পরে আছে কে জানে। হদ্য ময়লা। খানে খানে ধুলামাটি লেগে আছে। কাপড়ের তলায় ছায়া ব্লাউজ কিছুই কখনও থাকে না তার। ফলে তছি যখন ছুটাছুটি করে, নিচের দিকে তার কোনও অসুবিধা হয় না, হয় উপরের দিকে। হাওয়ায় আঁচল সরে যায় বুক থেকে, তছির যুবতী বুক দেখা যায়।

জন্ম পাগল হলে কী হবে, মেয়েমানুষ তো, শরীর বোঝে তছি। ফলে ছুটার সময় যেমন করে পারে আঁচল টেনে বুক ঢেকে রাখে।

আজ আর এসব দিকে খেয়াল রইল না তছির। রিকশা দেখে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল সে। দশগণ্ডা জমিন পার হবার আগেই হাওয়ার বেগে কখন বুকের আঁচল খসে পড়ল তার, কখন উন্মুক্ত হল যুবতী স্তন, দৌড়ের তালে তালে লাফাতে লাগল, কিছুই খেয়াল করল না সে। তছির পিছন থেকে এই ব্যাপারটা খেয়াল করল তার মা। করে দিশাহারা হয়ে গেল। রিকশা দেখে তছির লগে বাড়ির নামায় এসে দাঁড়িয়েছিল তছির মা। পাগল মেয়ে আচমকা ছুট দেবে এটা সে জানত না। যখন ব্যাপারটা তার চোখে পড়ল সেও চিৎকার করতে করতে ছুটল তছির পিছন পিছন। ওলো ও তছি, কাপোড় ঠিক কর মাগি। মাইনষে কইবো কী!

মায়ের কথা কানেই গেল না তছির, সে ছুটছে তো ছুটছেই। ছুটতে ছুটতে যখন সড়কে এসে উঠল, ভিড় ঠেলে যখন রিকশার সামনে এসে দাঁড়াল তখনও তার বুক খোলা। রিকশাআলা জোয়ানমর্দ লোক, সে হা করে তাকিয়ে আছে তছির বুকের দিকে। রিকশায় বসা মানুষটাও তাকিয়েছিল। তবে পলকের জন্য। তাকিয়ে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। এটা খেয়াল করল নূরজাহান। করে তহির মায়ের মতো সেও দিশাহারা হয়ে গেল। কী করবে না করবে বুঝতে পারল না। তারপর তছির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কনুই দিয়ে আস্তে করে তছির পেট বরাবর একটা গুতা দিল। লগে লগে রিকশা দেখা বাদ দিয়ে তেড়ে উঠল তছি। ঐ ছেমড়ি, কন্নি (কনুইয়ের গুতো) দিলি ক্যা?

কথা না বলে চোখ ইশারায় তছিকে তার খোলা বুক দেখাল নূরজাহান। তছি তা বুঝল না। খ্যাক করে উঠল। কী কচ?

এবার দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিস করে নূরজাহান বলল, কাপোড় ঠিক কর।

এবার ব্যাপারটা বুঝল তছি। ছটফট করে বুক ঢাকল। লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল।

রিকশায় বসা লোকটা এবার তছির দিকে তাকিয়ে প্রথম কথা বলল, কী রে পাগলনি, কেমন আছ?

প্রথমে রিকশা দেখায় ব্যস্ত ছিল তছি তারপর নূরজাহানের কনুইয়ের গুঁতা খেয়ে ব্যস্ত হয়েছে নিজেকে নিয়ে। ফলে রিকশায় বসা লোকটাকে সে খেয়ালই করেনি। লোকটার কথা শুনে মুখ তুলে তার দিকে তাকাল। তাকিয়ে হাসল। খানিক আগের পাওয়া লজ্জা কোথায় উধাও হয়ে গেল তার! ভারি একটা আমোদর গলায় বলল, হায়। হায় এনামুল দাদায় দিহি! আপনেরে তো আমি খ্যালঐ করি নাই। রিশকা কইরা কই থিকা আইলেন?

সানগ্লাসটা আবার চোখে পরল এনামুল। কোলের ওপর রাখা ব্যাগ হাতে নিল, রিকশা থেকে নামল। হাসিমুখে বলল, ঢাকা থিকা।

ঢাকা থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ির কাছে চলে এসেছে এনামুল এই কথা শুনে নূরজাহান আর তার বয়সী পোলাপানরা তো অবাক হলই, তছি যে তছি, পাগলনি, সেও অবাক। ভুরু কুঁচকে, চোখ পিটপিট করে বলল, কন কী দাদা! ঢাকা থিকা রিশকা লইয়া বাইত্তে আইয়া পড়ছেন।

এনামুল কথা বলবার আগেই রিকশাআলা বলল, আরে না। সাবে তোমার লগে ফাঁইজলামী করতাছে। আইছে ছিন্নগর থিকা।

লোকটার আগ বাড়িয়ে কথা বলা পছন্দ করল না এনামুল। সানগ্লাসে ঢাকা বলে চোখ দেখা যাচ্ছে না তার, দৃষ্টি কতটা বদলেছে বোঝা যাচ্ছে না, তবে মুখটা থমথম করতাছে, নাকের পাটা সামান্য ফুলেছে। রিকশাআলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, এই মিয়া এত কথা কও ক্যা! তোমারে কেঐ জিগাইছে?

রিকশাআলা বলল, না জিগায় নাই।

তয়?

এমতেঐ কইলাম। এত মানুষজন দেইক্কা ফুর্তি লাগতাছে।

 বেশি ফুর্তি ভাল না।

তছি বলল, করুক না। ফুর্তি করলে কী অয়। ও রিশকাআলা ভাই, আমারে ইট্টু রিশকায় চড়াইবেন?

রিকশাআলা প্রথমে তছির মুখের দিকে তাকাল তারপর তাকাল বুকের দিকে। তছির বুক এখন যত্ন করে ঢাকা, কিছুই দেখতে পেল না সে। তবে তার তাকানোটা সানগ্লাসের ভিতর থেকে খেয়াল করল এনামুল, করে রাগল। মুখে কিছু বলল না, মনে মনে খারাপ একটা গাল দিল লোকটাকে। তারপর প্যান্টের হিপ পকেটে হাত দিয়ে মোটা মানিব্যাগ বের করল। একটা দশ টাকা আর একটা পাঁচ টাকার নোট একত্র করে রিকশাআলার হাতে দিল। নেও।

তছির দিকে মন ছিল বলে কয়টাকা ভাড়া দিয়েছে এনামুল রিকশাআলা তা খেয়াল করেনি। টাকা হাতে নিয়ে হা হা করে উঠল। কত দিলেন সাব?

এনামুল নির্বিকার গলায় বলল, গনা জানো না?

জানুম না ক্যা?

তয় গইন্না দেহো।

দেকছি। পোনরো টেকা।

পোনরো টেকা ঠিক আছে না?

না। পোনরো টেকা দিবেন ক্যা?

তয় কত দিমু।

ইনসাফ কইরা দেন।

 ইনসাফ কইরা দিছি।

এইডা কোনও ইনসাফ হয় নাই। পঁচিশ টাকা দেন।

কী? ছিন্নগর থিকা মেদিনমোণ্ডল পঁচিশ টেকা ভাড়া?

হ। পঁচিশ টেকা ক্যা তিরিশ টেকাও অইতে পারে। আমি কমঐ চাইছি। এইমিহি তো রিশকাঐ আহে না। রাস্তা অহনতরি পাকা অয় নাই, ইটাও বিছাইন্না হয় নাই, কাঁচা মাডির রাস্তা। এমন রাস্তায় রিশকা চালাইতে জান বাইর অইয়া যায়। তার উপরে খালি রিশকা লইয়া ফিরন লাগবো। আমি এইমিহি আইতাম না। আপনে জোর কইরা আনছেন দেইক্কা আইছি। এই যে এত পোলাপান দেকতাছেন, রিশকা গেরামে ঢোকনের লগে লগে ঝাঐক্কর (ঋক) দিয়া বাইত থনে বাইর অইছে, রিশকার পিছে পিছে দৌড়াইতাছিল, অন চাইরমিহি ভিড় কইরা খাড়ইছে, কীর লেইগা কন তো? কারণ আছে। কারণ অলো অরা তো ইহ জিন্দিগানিতে (জিন্দেগি। জীবন) রিশকা দেহে নাই। ঐ যে মাইনষের বাড়ির মিহি চান, দেহেন বাইরবাইত্তে নাইলে বাড়ির নামায় আইয়া বাড়ইছে বাড়ির বউঝিরা, বুড়াবুড়িরা। খেতখোলার মিহি চান, দেহেন কিষাণরা বেবাকতে এইমিহি চাইয়া রইছে। রিশকা দেকতাছে। আজ পয়লা রিশকা আইলো এই গেরামে। আপনেঐ পয়লা আইলেন। দেন, পঁচিশটা টেকা দেন।

লোকটা যে শুধু আগ বাড়িয়েই কথা বলে না, বেশিও যে বলে এনামুল তা পুরাপুরি বুঝল। আবার রাগল সে, নাকের পাটা আবার ফুলল তার। গম্ভীর গলায় বলল, এই মিয়া, এত প্যাচাইল পাইরো না।

লোকটা বলল, আর দশটা টেকা দেন, প্যাচাইল পারুম না।

তছি বলল, দেন সাদা। রিশকাআলা ভাইরে দশটা টেকা দেন আর আমারে দশটা টেকা দেন।

তছির কথা শুনে হি হি, হি হি করে হেসে উঠল পোলাপানরা। বেপারি বাড়ির দশ এগারো বছরের দুষ্টের শিরোমণি ছেলে তোতা বলল, পাগলেও টেকা চিনে।

শুনে আবার হাসির রোল পড়ল।

তাকে যে পাগল বলা হল, পাগল বললে সে যে রাগে একথা তছির এখন মনে নাই, সেও হি হি করে হাসতে লাগল। তোতার কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসছিল নূরজাহান। এখন তছিকে হাসতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না সে, খিলখিল করে হেসে উঠল।

 এই প্রথম মুখ ঘুরিয়ে নূরজাহানের দিকে তাকাল এনামুল। চোখ থেকে আবার সানগ্লাস খুলল। তীক্ষ্ণচোখে কয়েক পলক নূরজাহানকে দেখে তছির দিকে তাকাল। সবাই হাসছে দেখে তার মুখেও মৃদু হাসি। সেই হাসি হাসিমুখে এনামুল বলল, টেকাদা কী করবি?

মুরলিভাজা খামু।

তছির কথায় আবার হেসে উঠল পোলাপানরা। এবার তছি আর তাদের লগে গলা মিলাল না। রেগে গেল। মুখ খিচাইয়া (খিঁচিয়ে) বলল, ঐ শয়তানের ছাওরা, ভেটকাচ ক্যা? দিমু ঠোকনা।

তারপর আবার এনামুলের দিকে তাকাল। দেন দাদা।

তছির পিছন পিছন সড়কের অদূরে এসে দাঁড়িয়েছিল তার মা। খানিক আগে মেয়ে তার বুকের কাপড় ঠিকঠাক করেছে দেখে এখন সে নিশ্চিন্ত। তবু বাড়ি ফিরে যাচ্ছে না। গ্রামে নতুন একখান জিনিস আসছে দেখে তছি না কোনও গণ্ডগোল লাগিয়ে দেয়, এরকম একটা ডরে আছে।

 একবার তছির মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিকে এনামুল বলল, মুরলিভাজা খাইতে দশটেকা লাগেনি ছেমড়ি?

না লাগুক, আপনে দেন।

তছির লগে গলা মিলিয়ে রিকশাআলা বলল, হ দেন সাব। দশবিশ টেকায় আপনের লাহান মাইষের কী যাইবো আইবো। আপনে বড়লোক মানুষ। এতবড় একখান গাড়ি লইয়া একলা আইছেন। রাস্তা পাকা অইয়া গেলে আমগো রিশকায় তো আর উডবেন না। গাড়ি লইয়া বাইত্তে আইবেন। দেন।

এনামুল আর কথা বলল না। মানিব্যাগ থেকে চকচকে দুইটা দশ টাকার নোট বের করে প্রথমে রিকশাআলাকে একটা দিল তারপর দিল তছিকে। দিয়েই বলল, টেকা দশটা চাইছস, দিছি। অহন আমার ব্যাগ ল। বাইত্তে দিয়ায়।

তছি নির্বিকার গলায় বলল, পারুম না। আমার কাম আছে।

কী কাম?

আপনেরে কমু না।

তছির এই ধরনের কথায় পোলাপানদের মুখে হাসির রোল পড়ার কথা কিন্তু তেমন কিছু হল না। বোধহয় তছির মুখ খিচানো আর বকাবাজির ভরে কেউ হাসছে না। নূরজাহান দাঁড়িয়েছিল তছির গা ঘেঁষে। একবার তছির মুখের দিকে তাকিয়ে এনামুলের ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল। দেন দাদা, আমার কাছে দেন। আমি দিয়াহি।

এনামুল বলল, তোমারে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। কোন বাড়ির মাইয়া তুমি?

নূরজাহান কথা বলবার আগেই তছি বলল, হায় হায় দাদা, কন কী আপনে? অরে চিনেন নাই? ও তো দবির গাছির মাইয়া নূরজাহান

নূরজাহান! কচ কী?

হ।

ব্যাগ নূরজাহানের হাতে দিয়ে হাসল এনামুল। তরে তো আমি চিনতে পারি নাই নূরজাহান। তুই তো বিয়ার লাইক (লায়েক) অইয়া গেছস। কী রে ছেমড়ি, কবে এত ডাঙ্গর অইলি?

নূরজাহান কথা বলল না। হেসে মাথা নিচু করল।

এনামুল বলল, খালি ডাঙ্গর অচ নাই চালাকও অইছস।

কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। একপলক এনামুলের মুখের দিকে তাকিয়ে সড়কের নামার দিকে হাঁটতে লাগল। এনামুলও চলল তার পিছন পিছন।

.

১.৫০

দশটা টাকা হাতে পাওয়ার পর তছি আর তছি নাই, দিশাহারা হয়ে গেছে, অন্য মানুষ হয়ে গেছে। কী রেখে কী করবে বুঝতে পারছে না। রিকশার দিকেও এখন আর মন নাই তার।

রিকশার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ান ভিড়টা এখন আর নাই। ছেলেমেঘেরা যে যার মতো ফিরে গেছে। রিকশাআলা যায়নি। রিকশা আগের জায়গায়ই দাঁড় করিয়ে রেখেছে। নিজের জায়গায় না বসে এনামুল যেখানে বসেছিল সেখানে বসে খুবই আয়েশি ভঙ্গিতে পা দুইটা লম্বা করে দিয়েছে নিজের সিটের ওপর। প্রায় শুয়ে পড়ার মতো অবস্থা। এই অবস্থায় বিড়ি ধরিয়েছে, আরামছে টানছে, আড়চোখে তছিকে দেখছে।

তছির মা তখনও দাঁড়িয়ে আছে সড়কের নামায়। তার দিকে তাকিয়ে মুখ খিচালো তছি। তুমি এহেনে খাড়ইয়া রইছো ক্যা? বাইত্তে যাও।

তছির মা নিরীহ গলায় বলল, তর লেইগা খাড়ইয়া রইছি। তুইও বাইত্তে ল মা।

আমি অহন যামু না। আমার কাম আছে।

কী কাম?

কইতে পারি না।

এনামুল যে দশটা টাকা দিয়েছে তছিকে, তছি যে মুরলিভাজা খাওয়ার কথা বলেছে সবই শুনেছে তার মা। মেয়ের এলোমেলো কথা শুনে এখন বুঝল সেই টাকা নিয়ে বেদম উত্তেজনায় আছে পাগল মেয়েটা। কী করবে না করবে বুঝতে পারছে না। এই ব্যাপারে মেয়েকে সাহায্য করতে চাইল সে। বলল, বাইত্তে ল মা। আলাদ্দিরে দিয়া মাওয়ার বাজার থনে মুরলিভাজা আনাইয়া দিমুনে তরে।

তছি বলল, না। টেকা আমি কেঐর হাতে দিমু না, দিলেই আমার টেকা দিয়া বেবাকতে মিল্লা মুরলিভাজা কিন্না খাইবো। আমি সীতারামপুর যামু।

ক্যা?

সীতারামপুরের দোকানে মুরলিভাজা পাওয়া যায়। দুই টেকার কিনলে টোপর ভইরা যাইবো। খাইতে খাইতে হাইট্টা আমু। বাইত্তে আহনের আগেই শেষ। কেরে একটা দিমু না। রোজ দুই টেকার কইরা খামু।

পাগল মেয়ে একা সীতারামপুর যাবে শুনে চিন্তিত হল তছির মা। বলল, একলা যাওনের কাম নাই।

ক্যা? গেলে কী অয়? আমি কী আইজ নতুন যাইতাছি নি!

তারপরই মুখ খিচালো তছি। তুমি কইলাম এহেন থিকা যাও মা। আমি কইলাম তোমার মতলব বোজতাছি। আমার হাতে টেকা দেইক্কা সরতাছো না তুমি। টেকাড়া নেওনের মতলবে আছো। মইরা গেলেও এই টেকা আমি তোমারে দিমু না। তুমি যাওগা। আমি সীতারামপুর যামু।

তছির মা বুঝে গেল এরপর দাঁড়িয়ে থাকলে ঘটনা খারাপ হবে। মুখে যা আসে তাই বলে বকাবাজি তো তছি করবেই, সড়ক থেকে দৌড়ে নেমে চুলও টেনে ধরতে পারে মায়ের। গুম গুম করে কিল মারতে পারে মায়ের পিঠে। মাটিতে ফেলে গলা টিপে ধরতে পারে, বুকে চেপে বসতে পারে। যদিও তছির হাতের এসব মার খাওয়ার অভ্যাস আছে তার তবু আজ সে মারটা খেতে চাইল না। রিকশাআলা বসে আছে সড়কে, মেয়ে মারছে মাকে এ দৃশ্য দেখে বেকুব হয়ে যাবে। মেয়ে যে পাগল এটা তো সে জানে না! অচেনা মানুষের সামনে তছির হাতে মার খেতে আজ শরম করবে তার।

তছির মা তারপর বাড়ির দিকে পা বাড়াল। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে গেল, জাহন্নামে যা মাগি! মর গা।

এসব কথা গায়েই মাখল না তছি। মুঠায় ধরা টাকা শাড়ির আঁচলে গিটটু (গিট) দিয়ে বাঁধল। তারপর গভীর আনন্দে ফেটে পড়া মুখে সড়কের পুব দিককার নামায় নেমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। রিকশাঅলা তাকে ডাকল। এই যে, হোনো হোনো। এইমিহি আহো।

তছি থামল। কীর লেইগা?

হাতের বিড়ি শেষ হয়ে আসছিল। ফুক ফুক করে বিড়িতে শেষ দুইটা টান দিল লোকটা তারপর নিজের বসার সিট থেকে পা নামিয়ে লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামল। তার আগে বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলেছে। তছির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আহো। কথার কাম আছে।

এবার লোকটার সামনে এসে দাঁড়াল তছি, রিকশার সামনে এসে দাঁড়াল। তাড়াতাড়ি কন। আমার কাম আছে।

লোকটা হাসল। কী কাম?

তছি বিরক্ত হল। মারে যে কইলাম হোনেন নাই আপনে?

হুনছি। তুমি মুরলিভাজা কিনতে সীতারামপুর যাইবা।

তয়?

 ঐডা তোমার মা?

 হ।

 কোন বাড়ি তোমগো?

হাত তুলে নিজেদের বাড়ি দেখল তছি। ঐ বাড়ি।

তছির হাত অনুসরণ করে বাড়ি দেখল লোকটা। মুখ এখনও হাসি হাসি তার। বলল, তুমি যে কইছিলা রিশকায় চড়বা?

হ কইছিলাম। অহন চড়ুম না।

ক্যা?

আমার কাম আছে।

কাম তো সীতারামপুর যাওন, মুরলিভাজা কিনন।

হ। 

সীতারামপুর রিশকা যায় না।

হ যায় না।

সাবধানী চোখে চারদিকে একবার তাকাল লোকটা। গলা নিচু করে বলল, সীতারামপুর তোমার যাওনের কাম নাই। তুমি আমার লগে লও।

কই যামু আপনের লগে?

তছির গলা চড়া। শুনে লোকটা একটু ভড়কাল। সাবধানী চোখে আবার চারদিকে তাকাল। আগের মতোই নিচু গলায় বলল, আস্তে কথা কও।

লগে লগে গলা একেবারেই নিচু করে ফেলল তছি। আইচ্ছা।

আমি কই কী, তুমি আমার লগে কোলাপাড়া বাজারে লও। আমার রিশকায় বহো, তোমারে আমি লইয়া যাই। এককামে দুইকাম অইবনে তোমার। রিশকায় চড়নও অইলো, মুরলিভাজা খাওনও অইলো। কোলাপাড়া বাজারে বহুত ভাল মুরলিভাজা পাওয়া যায়। লাল টুকটুইক্কা। আমি কিন্না দিমুনে তোমারে। তোমার টেকা ভাঙ্গন লাগবো না।

রিকশাআলার কথা শুনে চোখ দুইটা চকচক করে উঠল তছির। সত্যঐ?

হ।

তারপরই মুখে দুশ্চিন্তার একটা ছায়া পড়ল তছির। কোলাপাড়া থিকা আহুম নে কেমতে? আমি তো কোনওদিন ঐমিহি যাই নাই।

রিকশাঅলা বলল, আমি তোমারে রিশকায় কইরা দিয়া যামুনে।

সত্যঐ?

হ।

এবার হাসল তছি। আপনে বহুত ভাল মানুষ রিশকাআলা ভাই। নাম কী আপনের?

রোস্তম।

বাড়ি কোন গেরামে।

উত্তর বাকশা (পাইকসা)।

একটু থেমে রুস্তম বলল, এত প্যাচাইলের কাম নাই। তাড়াতাড়ি লও। তোমারে আবার দিয়া যাওন লাগবো। হারাদিন যাইবো গা নে।

দ্রুত হাতে রিকশার হুড তুলল রুস্তম। অকারণেই দুই তিনটা থাবড় দিল সিটে। কাঁধে ফেলা গামছা শক্ত করে মাজায় বাঁধতে বাঁধতে বলল, ওডো। তাড়াতাড়ি ওডো।

লাফ দিয়া রিকশায় উঠল, তছি। গভীর আনন্দে মুখখানা যেন ফেটে পড়ছে। সেই মুখের দিকে একবার তাকিয়ে রুস্তম বলল, আঁচল দিয়া মুখখানা ঢাইকা লও। এই গেরামের মাইনষে যেন তোমারে দেইক্কা না চিনতে পারে।

তছি অবাক হল। ক্যা?

দেকলে তোমারে যুদি আমার লগে না যাইতে দেয়, তোমার মা ভাইগো যুদি গিয়া কইয়া দেয় তাইলে একখান ভেজাল লাইগো যাইবো। তয় বেশিক্ষুণ মুখ ঢাইক্কা বইয়া থাকন লাগবো না, দোকাছির (দোগাছি) সামনে গিয়া খুইল্লা হালাইলেঐ অইবো। ঐমিহি তোমারে কেঐ চিনবো না।

ভাল কথা কইছেন। গেরামের কেঐ দেকলে আপনের লগে আমারে যাইতে দিব না।

বেশ যত্নে মাথায় ঘোমটা দিল তছি, আঁচল টেনে নাকের ডগা পর্যন্ত ঢাকল, অচেনা মানুষ হয়ে গেল। গ্রামের কেউ তছিকে দেখে এখন চিনতেই পারবে না। জীবনে মাথায় কখনও ঘোমটা দেয়নি তছি, মুখ ঢাকেনি আঁচলে। দেশ গ্রামের নরম সরম বউর ভঙ্গিতে রিকশায় বসেছে তছি, এই ভঙ্গিতে বসার মেয়ে সে না। তছি এখন একেবারেই বদলে যাওয়া তছি।

একবার তছিদের বাড়ির দিকে তাকাল রুস্তম তারপর তাকাল তছির দিকে। তছি বলল, লন, তাড়াতাড়ি লন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *