১.২৬-৩০ রান্নাচালার পিছন দিককার গয়াগাছ

১.২৬

রান্নাচালার পিছন দিককার গয়াগাছ থেকে চি চি স্বরের করুণ একখান ডাক ভেসে এল। দুইবারের বার ডাকটা খেয়াল করল মরনি। চঞ্চল হল। কীয়ে ডাকে এমুন কইরা। সাপে ব্যাঙ ধরলো নি! এই বাড়িতে সাপ একখান আছে, শানকি। সাপের রাজা হল এই শানকি। গয়না (যাত্রীবাহী বড় নৌকা), গস্তিনাও (মালবাহী নৌকা) বাঁধবার কাছির মতন মোটা। পাঁচ ছয়হাত তরি লম্বা হয়। ধূসর বর্ণের দেহে গাঢ় কালো রঙের ডোরা। দেখতে রাজকীয়। এই সাপের মুখ দুইখান। মাথার কাছে আসল মুখখানা তো আছেই, লেজের। কাছে আছে ছোট্ট আরেকখান মুখ। দুইমুখ একত্র করে যদি কামড় দেয় কাউকে, সে যেই হোক, হাতি নাইলে মানুষ, ভবলীলা সাঙ্গ হতে সময় লাগবো না। তবে এই সাপ সাধারণত কামড়ায় না, গিরস্তের ক্ষতি করে না। যেটুকু করে সেটা ভাল কাজ। দয়া করে যে বাড়িতে বাস গাড়ে (বসবাস করা অর্থে) সেই বাড়ির ত্রিসীমানায় কোনও বিষধর সাপ থাকতে পারে না। যদি থাকে কখনও না কখনও শানকির সামনে তাকে পড়তেই হবে। আর পড়ছে তো মরছে। বিষধর সাপ দেখেই বড় মুখখানা হাঁ করবে শানকি। যদি তখন বিড়া বান্ধা (বৃত্তাকারে শরীর প্যাঁচিয়ে রাখা) থাকে, বিড়া খুলে টানটান করবে দেহখান আর বিষধর সাপ আপনা থেকেই নিজের লেজখান এনে ঢুকিয়ে দিবে শানকির হাঁ করা মুখে। শানকি আস্তে আস্তে গিলতে থাকবে। গিলতে গিলতে যখন মাথা তার মুখের কাছে আসবে তখন কট করে বিষধরে মাথাটা কেটে ফেলে দেবে।

শানকির চলাচলও রাজকীয়। ধীর স্থির। দিন দুপুরে বাড়ির উঠান পালানে চলে আসে কখনও, কখনও ঘরের খামের লগে প্যাঁচ দিয়া থাকে, গাছপালা ঝোপঝাড়ের ছায়ায় বিড়া বেন্ধে থাকে। মানুষজনের সামনে দিয়েই হয়তো মন্থর গতিতে চলতে শুরু করল। বাচবে কী মরবে তোয়াক্কা করল না। শানকি সাপ ভুলেও কোনও গিরস্তে কখনও মারবে না। তাতে দোষ (অকল্যাণ) হয়। বিষধর সাপে দংশে বিনাশ করবে চৌদ্দগোষ্ঠী। এসব জানে বলেই বোধহয় শানকির চরিত্র এমন। গৃহপালিত জীবের মতো আয়েশি ভঙ্গিতে বসবাস করে গিরস্ত বাড়িতে। যখন যেভাবে ইচ্ছা চলাচল করে।

কিন্তু শীত পড়ে গেছে এসময় তো গর্তের ওম, ছাই আর তুষ কুড়ার হাঁড়ি থেকে বের হবার কথা না শানকির! শীতকালটা সে অন্ধকার নির্জনে গভীর উষ্ণতায় কাটাবে। বের হয়ে আসবে ধরালিকালে। তারপর ছুলুম বদলে নতুন করে শুরু করবে জীবন। তাহলে এসময় কোন সাপে ধরল ব্যাঙ!

 মরনি চিন্তিত হল।

সে বসে আছে পাটাতন ঘরের সামনে যে দুইখান বাড়তি তক্তা দেওয়া সেই তক্তায়। গিরস্তের আয়েশের জন্য পাটাতন ঘরের সামনে এরকম এক দুইখান তক্তা দেওয়া থাকে। সংসারকর্মের ফাঁকে কয়েক দণ্ডের জন্যে এই তক্তায় বসে বাড়ির লোক। পান তামাক খায়। বাড়িতে হঠাৎ করে কোনও অতিথি এলেও এই তক্তাতেই বসে। কিন্তু মরনি আজ বসে আছে তার মনটা ভাল নাই বলে। ঘণ্টাখানিক আগে খবর পেয়েছে ছনুবুড়ি মারা গেছে। কাঁচা রসে মুড়ি ভিজিয়ে মাত্র সকালের নাস্তা তখন শেষ করেছে। মজনু, মরনি কিছু মুখেই দেয় নাই, পাশের বাড়ির ইন্নত এসে বলল, চাচী ও চাচী হোনছনি, চুন্নিবুড়ি বলে মইরা গেছে। এমতে মরে নাই, মাইট্টাতেল খাইয়া মরছে।

বলেই খিট খিট করে হাসল। ইন্নতের সেই হাসিতে গা জ্বলে গেল মরনির। একজন মানুষ মইরা গেছে ওইটা লইয়াও ঠাট্টা! আল্লার দুনিয়াতে যে কত পদের মানুষ আছে!

এই কথাটা ইন্নতকে সে বলেনি। বলেছে অন্যকথা। তুই হুনলি কই?

ইন্নত বলল, মরনের খবর এমতেঐ ভাইসসাহে। এক বাড়ির মানুষ মরলে তাগো চিইক্কর বাইক্কঐর হুইন্না বোজে লগের বাড়ির মাইনষে। তাগো কাছ থিকা হোনে আরেক বাড়ির মাইনষে, আবার তাগো কাছ থিকা হোনে আরেক বাড়ির মাইনষে, এমতে দেহা যায় পাঁচ মিনিটের মইদ্যে পুরা গেরাম হুইন্নালাইছে।

মজনুর দিকে তাকাল ইন্নত। ঐ মউজনা, যাবিনি? ল যাই, চুন্নিবুড়িরে শেষ দেহা দেইক্কাহি।

এবার আর ইন্নতের কথা সহ্য হল না মরমির। বেশ রাগল সে। ঝাঁঝাল গলায় বলল, চুন্নি চুন্নি করতাছস ক্যা? তগো কিছু কোনওদিন চুরি করতাছে? বাইচ্চা থাকতে যাঐ থাকুক মইরা যাওনের পর মানুষ আর চোর ধাউর থাকে না।

শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ইন্নত। মাথা দুলিয়ে বলল, দামী কথা কইছো চাচী, বহুত দামী কথা কইছো।

শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে মজনু তখন ঘর থেকে বেরিয়েছে। ইন্নত বলল, ল যাই।

তারপর থেকে ঘরের সামনের তক্তপায় বসেই আছে মরনি। একটুও লড়েচড়ে নাই। শুধুই মনে হয়েছে মৃত্যুর কথা। কত মানুষজন ছিল এক সময় চারপাশে, মৃত্যু কোথায় নিয়ে গেছে তাদের মৃত্যু এমন এক নিয়তি, মানুষের সাধ্য নাই তাকে ঠেকিয়ে রাখে। কত চেষ্টা কত রকমভাবে করে মানুষ, তবু ঠেকাতে পারে না মৃত্যু।

একে একে মরনির তারপর মা বাবার কথা মনে হয়েছে, বোনদের কথা মনে। হয়েছে, শেষ পর্যন্ত মনে হয়েছে এই বাড়ির সেই মানুষটার কথা। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে বেঁচেছিল এক সময়, মৃত্যু কেমন করে আলাদা করে দিয়েছে তাদের! ছনুবুড়ির মৃত্যুর কথা শুনে আজ সকালে সেই মানুষটার কথা তারপর থেকে মনে পড়ছে মরনির। কত সুখ দুঃখের স্মৃতি, কত আনন্দ বেদনার স্মৃতি রয়ে গেছে সেই মানুষ ঘিরে। যেন মরনির মন একখান কচি কলাপাতা, সেই কলাপাতায় ইরল চিরল দাগে লেখা ছিল প্রিয়তম সেই মানুষের কত কথা, বহু শীত বসন্তের হাওয়া দূর দূরান্ত থেকে বয়ে এনে সেই কলাপাতার ওপর ফেলে গেছে ধুলার ধূসর আস্তরণ, নিজে কিছুই টের পায়নি মরনি, স্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে গেছে সেই মানুষ। আজ অন্য এক মৃত্যু সংবাদ এল, যেন অনেকদিন পরে চারদিক থেকে ঝেপে এল বৃষ্টি। বৃষ্টি ধারায় কচি কলাপাতা ধুলামুক্ত হল, জেগে উঠল স্মৃতিলেখা। মরনি মগ্ন হয়েছিল সেই লেখায়। তখনই এক সময় রান্নাচালার পিছন দিককার গয়াগাছের কাছে ওই চি চি শব্দ। মগ্নতা ভেঙে গেল। মরনির। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তক্তা থেকে নামল। দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল রান্নাচালার পিছনে, গয়াগাছ তলায়।

কই গাছতলায় তো কিছু নাই! সাদা মাটির গাছতলা খা খা করতাছে।

দিশাহারা ভঙ্গিতে মরনি তারপর গাছটার দিকে তাকিয়েছে, তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে। গয়ার ডালে একটা দাঁড়কাক বসে আছে। দুইপায়ে খামছে ধরা একটা কুকরার ছাও (ছানা)। বড়সড় ছাও। দুইচারটা ঠোকর ছাওটাকে দিয়েছে দাঁড়কাক, তবে সুবিধা করতে পারছে না। ছাওটা তার ছোট্ট ডানা, মাথা ও পা দাপড়িয়ে চি চি ডাকে দিশাহারা করে তুলেছে দাঁড়কাকটাকে। কাকটা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জোর ঠোকরে ছাওটাকে কাবু করতে যেন সাহস পাচ্ছে না।

কয়েক পলক এই দৃশ্য দেখে বুক তোলপাড় করে উঠল মরনির। নিশ্চয় মা ভাই বোনদের লগে গিরস্তর উঠান পাথালে চড়তে বেরিয়েছিল ছাওটা। গাছের ডালে আততায়ী দাঁড়কাক ছিল ঘাপটি মেরে, সুযোগ বুঝে ছো মেরে তুলে এনেছে। চোখের পলকে চিরকালের তরে আলাদা করে দিয়েছে আপনজনদের থেকে। এও তো এক রকমের মৃত্যু। দাঁড়কাক নিয়েছে আজরাইলের ভূমিকা।

আর কিছু না ভেবে পায়ের কাছ থেকে চাকা (মাটির ঢেলা) তুলে কাকটার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে মরনি। ধুর কাওয়া ধুর, যা যা।

শিকার নিয়ে এমনিতেই বিব্রত ছিল কাক তার ওপর এই আক্রমণ, ভয়ে শিকার ফেলে কা কা রবে আকাশ পাথালে উড়াল দিয়েছে দাঁড়কাক আর মুরগির ছাওটা ধপ করে পড়েছে গাছতলায়। পড়ে উঠে যে দৌড় দিবে সেই ক্ষমতা ছিল না। ঠোকরে ঠোকরে বুকের কাছটায় বেশ একটা গর্ত করে দিয়েছে দাঁড়কাক। দুইহাতে ছাওটাকে তুলে উঠানে নিয়া আসছে মরনি। হলুদ বাটার সঙ্গে চুন মিশিয়ে অতি যত্নে যখন ছাওটার ক্ষতের ওপর লাগাচ্ছে, খয়েরি চাদর পরা একজন মানুষ এসে দাঁড়াল অদূরে। মানুষটাকে মরনি খেয়াল করল না। ছাওটার যত্ন শেষ করে, পলোতে আটকে উদাস হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইল। কেন যে তার তখন মজনুর কথা মনে পড়ল! কেন যে বুকটা হা হা করতে লাগল!

আস্তে করে গলা খাকারি দিল লোকটা। চমকে লোকটার মুখের দিকে তাকাল মরনি। কেডা, কেডা আপনে?

লোকটা কাঁচুমাচু গলায় বলল, এইডা নুরু হালদারের বাড়ি না?

মানুষটার যে নাম ছিল নুরু হালদার সেকথা যেন মনেই ছিল না মরনির। আজ অচেনা একজন মানুষের কথায় মনে পড়ল। বুকটা আবার তোলপাড় করে উঠল। বলল, হ। আপনে কে?

মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। আমারে কি তুমি আর অহন চিনবা! তয় তোমারে আমি দেইক্কাঐ চিনছি। কোনও কোনও মানুষ থাকে চেহারা তাগো সহজে বদলায় না। তোমার চেহারা অমুন। আঠরো উনিশ বচ্ছরেও বদলায় নাই। আগের লাহানঐ আছে।

লোকটাকে তবু চিনতে পারল না মরনি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

সে বলল, ভাল আছ বইন?

এবার বিব্রত হল মরনি। আছি ভালঐ তয় আপনেরে তো চিনতে পারি না।

দাঁড়িমোচে ভরা ভাঙাচোরা মুখে হাসল সে। কেমতে চিনবা! এতদিন বাদে দেখলা! আমার নাম আদিলউদ্দিন। বাড়ি কামাড়গাও।

হঠাৎ হঠাৎ কত যে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে মানুষের জীবনে! সময়ের চাপে কাছের মানুষ যায় পর হয়ে, বহুদূর পথ ঘুরে একদার আপনজন ফিরে আসে আপনজনের কাছে। তবে সময় অতিক্রম করে যত কাছেই আসুক তারা, সেই সময়ের দূরত্বটা অতিক্রম করতে পারে না। আদিলউদ্দিনকে চিনার পরও মরনি তা পারছিল না, আগের মতোই তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে।

আদিলউদ্দিন বলল, অহনও চিনো নাই বইন? আমি তোমার বইনজামাই। মজনুর বাপ।

মজনুর বাপ কথাটা শুনে কেঁপে উঠল মরনি। মনে হল এ কোনও মানুষ না, এ যেন এক আততায়ী দাঁড়কাক। হালদার বাড়ির আঙিনায় এসে ঘাপটি মেরে বসেছে, মা কুকরার মতো মজনুকে নিয়ে যখন ঘর থেকে বের হবে মরনি তখনই সাঁ করে এসে দুই পায়ের ধারাল নখে খামছে ধরবে মজনুকে। আকাশ পাথালে উড়াল দিয়ে মজনুকে নিয়ে চলে যাবে দূর অজানায়।

মুখখানা হাসি হাসি করে আদিলউদ্দিন বলল, তোমার বইনের নাম আছিল অজুফা, মজনুর জন্মের কয়দিন বাদেই চইলা গেল। মজনুরে কুলে লইয়া বইয়া রইছিলা তুমি। এই হগল তোমার মনে নাই বইন? ভুইল্লা গেছ?

ঝাঁঝাল গলায় মরনি বলল, বেবাক মনে আছে, কোনও কিছু ভুলি নাই। আপনের মনে না থাকতে পারে, আমার আছে।

পলোয় আটকানো ছাওটার দিকে তাকিয়ে রইল মরনি। এখনও কাত হয়ে পড়ে আছে। চোখ ঢুলু ঢুলু। ঘাড়টা জোর করে সোজা রাখতে চাইছে, পারছে না। প্রায়ই মাটিতে ঠেকে যাচ্ছে ঠোঁট। হলুদ চুন কতটা কাজ করতাছে কে জানে! বাঁচিয়ে রাখা যাবে তো ছাটাকে!

মরনির রাগি মুখ দেখে, ঝাঁঝাল গলা শুনে আদিলউদ্দিন একটু দমে গেছে। হাসি হাসি মুখ ম্লান হয়েছে। মরনি সেসব পাত্তা দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আপনের লগেঐ তাইলে মজনুর কাইল দেহা অইছিলো?

হ। তুমি বোজলা কেমতে?

মজনু আমারে কইছে।

কী কইছে?

মজনুরে দেইক্কা কেমুন করতাছেন আপনে, এই হগল।

চাদরটা ভাল করে গায়ে জড়াল আদিলউদ্দিন। উৎসাহি গলায় বলল, আর, আর কী কইলো? আমি যে অর বাপ এইডা তো আমি অরে কই নাই!

না, ওইডা জানে না।

তয়?

তয় আবার কী! আমারে কইলো এমুন এমুন ঘটনা। আপনেগো বাড়ি কামাড়গোও এইডা হুইন্না আমার ইট্টু চিন্তা লাগছিল। তয় বিশ্বাস অয় নাই। আপনে মাইট্টাল অইবেন ক্যা? আপনে তো ভাল গিরস্ত আছিলেন!

আদিলউদ্দিন আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ আছিলাম। অহনও আছি।

তয় মাইট্টাল অইতে আইছেন ক্যা?

কপালে টাইন্না আনছে।

কেমতে?

পরের ঘরে তিনডা পোলা আমার। মার লাহান অইছে তিনজনে। সাই (মহা) পাজি। বড়ডার বয়স ষোল্ল সতরো। জাগা জমিন খেতখোলা বেবাক বুইজ্জা লইছে। তিন ভাইয়ে মিল্লা চোয় (চষে)। আমারে কামলার লাহান খাডায়। কথা কইলে পোলাপানের মায় ওডে পিছা (ঝাড়) লইয়া। তিন পোলায় গরুর লাডি দিয়া বাইড়ায়। মাইর ধইর খাইয়াও রইছিলাম। যামু কই! শেষতরি আর পারলাম না। তিন চাইরদিন আগে এমুন বাইড়ান বাইড়াইলো, এই চাইদ্দরডা গায় আছিলো, এই লুঙ্গিডা ফিন্দন, ঘেড়ি ধাক্কাইতে ধাক্কাইতে তিন পোলায় বাইতথন বাইর কইরা দিল।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ধরে এল আদিলউদ্দিনের। তবে এসব পাত্তা দিল না মরনি। মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, তহন আরেক পোলার কথা মনে অইছে, না? তহন বাইর হইছেন আরেক পোলা বিচড়াইতে (খুঁজতে)!

মরনির কথায় একেবারেই কাতর হয়ে গেল আদিলউদ্দিন। চোখ ছলছল করে উঠল। না না পোলা বিচড়াইতে বাইর অই নাই। এই গেরামে আইছি মাইট্টাল অইতে। শইল্লে খাইটা যেই কয়দিন পারুম বাইচ্চা থাকুম। নিজের গেরামে, নিজের বাইত্তে, ঐ সংসারে আর ফিরত যামু না।

কথা বলতে বলতে পানিতে চোখ ভরে গেল মানুষটার। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে চাদরের খুঁটে চোখ মুছল সে। মুছতে মুছতে বলল, সত্য কথাডা তোমারে আমি কই বইন। এই গেরামে আহনের আগে তোমগো কথা আমার মনেই অয় নাই। মনে অইছে এহেনে আইয়া। কাইল বিয়ালে। মজনুর লগে কথা আমি ঠিক কইছি, তারে চিনছি, চিন্না বুকটা আমার ভাইঙ্গা গেছে, ইচ্ছা করলে তারে আমি বেবাক কথা কইতে পারতাম, নিজের পরিচয় দিতে পারতাম, দেই নাই। ক্যান দেই নাই জানো? পোলাপানের উপরে মন উইঠা গেছে আমার। খালি মনে অয় আমার কোনও পোলাপান নাই।

 চোখের পানি দরদর করে গাল বেয়ে পড়তে লাগল আদিলউদ্দিনের। কাঁদতে কাঁদতে গায়ের চাদর ফেলে দিল সে। বলল, দেহো বইন দেহো, পোলারা যদি এমতে পিডায়….।  

কথা শেষ করতে পারল না আদিলউদ্দিন, বুক ঠেলে ওঠা কান্না ঠেকাবার জন্য ছটফট করতে লাগল।

লাঠির বাড়িতে তার সারা শরীরে দড়ির মতন দাগ পড়েছে। সেই দাগ দেখে বুকটা হু হু করে উঠল মরনির। এই মানুষটার ওপর সতেরো আঠারো বছর ধরে যে রাগ জমেছিল সেই রাগ উধাও হয়ে গেল। গভীর আবেগে দুইহাতে মানুষটাকে সে জড়িয়ে ধরল। আহেন আপনে, আহেন। বহেন। বইয়া কথা কন।

ধরে ধরে আদিলউদ্দিনকে এনে পাটাতন ঘরের সামনের তক্তায় বসিয়ে দিল মরনি। পোলা অইয়া বাপরে মারে, কেমুন পোলা জন্ম দিছেন?

আদিলউদ্দিন কোনও কথা বলল না। চাদরের খুঁটে চোখ মুছতে লাগল।

মরনি বলল, একই বাপের পোলা একজন অয় ডাকাইত একজন অয় ফেরেস্তা। মজনুরে দেখলে, তার লগে কথা কইলে আপনে এইডা বুজবেন।

আদিলউদ্দিন বলল, এইডা আমি বুজছি বইন।

লগে লগে বুকটা ধ্বক করে উঠল মরনির। তবে কী মজনুর উপর দখল নিতে, সব খোঁজ খবর নিয়ে এই বাড়িতে এসেছে আদিলউদ্দিন! শুনেছে মজনু খলিফা হয়েছে। ভবিষ্যতে ভাল টাকা পয়সা রোজগার করবে। নিজের সংসারে আর ফিরতে পারবে না আদিলউদ্দিন, মজনুই হবে তার একমাত্র ভরসা, এই রকম চিন্তা! মজনুর কাঁধে চড়ে শেষ জীবনটা সে কাটিয়ে দিবে।

এই সব ভেবে ভিতরে ভিতরে খুবই রাগ হল মরনির। খানিক আগের মায়া মমতা হাওয়া হয়ে গেল। আহুজঘর থেকে যে ছেলেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, মরনি যাকে বুকে তুলে নিয়ে এসেছিল, এতগুলি বছর কেটে গেছে যে ছেলের কোনও খোঁজ নেয়নি বাপ, আজ তার অবস্থা ভাল দেখে তার কাঁধে এসে সওয়ার হবে, মরনি বেঁচে থাকতে কিছুতেই তা হতে দেবে না।

এই সব নিয়ে কথা বলবার জন্য তৈরি হল মরনি। লোকটাকে এখনই বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য তৈরি হল। তার আগেই আদিলউদ্দিন বলল, তুমি আমারে কী বোজতাছো কে জানে, তয় আমি কইলাম মজনুর লেইগা এই বাইত্তে আহি নাই। অর লেইগা আমি কোনওদিন কিছু করি নাই। বাপ অইয়াও বাপের দায়িত্ব পালন করি নাই। পোলায় জানেই না তার বাপ বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে। এতকাল পর অমুন পোলার সামনে আইয়া খাড়ন যায় না। পোলাগো কাছ থিকা বহুত অপমান জিন্দেগিতে অইছি, আর অইতে চাই না। আমার একটা পোলা অন্তত থাউক যার কাছ থিকা আমি কোনওদিন অপমান অমু না। দরকার অইলে সারাজীবন তারে বাপের পরিচয় দিমু না, তাও ভাল।

এ কথায় আগের রাগ ক্রোধ ভুলে গেল মরনি। মজনুকে নিয়ে অন্যরকম একটা অহংকার হল। গলায় জোর নিয়ে বলল, বাপেরে পিড়ান তো দূরের কথা, তারে অপমান কইরা কথা কওনের মতন পোলা মরনি বানায় নাই। বাপ যত ইচ্ছা খারাপ অইবো, পোলা খারাপ বানামু ক্যা!

একটু থেমে মরনি বলল, মজনুর লেইগা যহন আহেন নাই তাইলে এই বাইত্তে আহনের কাম আছিলো কী?

মরনির মুখের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় আদিলউদ্দিন বলল, আমি আইছি। একখান য়োড়ার লেইগা।

য়োড়ার লেইগা?

হ। য়োড়া ছাড়া মাইট্টাল অওন যাইবো না। য়োড়া কিননের পয়সা আমার কাছে নাই। একখান য়োড়া যদি দেও বইন, বড় উপকার অয়।

য়োড়া আপনেরে দিমুনে। কাম করবেন সড়কে, থাকবেন কই?

কইতে পারি না।

শীতের দিন যেহেনে ওহেনে তো পইড়াও থাকতে পারবেন না। কেতা (কাঁথা) কাপোড় আছেনি?

না, কিছু নাই।

তয়?

আদিলউদ্দিন কথা বলল না।

মরনি বলল, মজনু বাইত্তে থাকে না। ইচ্ছা করলে আমগো বাইত্তে আপনে থাকতে পারেন। তয় একখান কথা মানন লাগব। আপনে যে মজনুর বাপ এইডা মজনুরে কোনওদিন কইতে পারবেন না।

একথা শুনে মরনির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল আদিলউদ্দিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কমু না, কোনওদিনও মজনুরে কমু না, বাজান রে, আমি তর বাপ।

পলোর ভিতর মুরগির ছাওটা তখন কোনও রকমে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতাছে। উঠে এক সময় দাঁড়াবে ঠিকই, বেঁচেও যাবে কিন্তু তার চারপাশে থাকবে পলোর বেড়া। পলো তুলে নেওয়ার পর বেড়া একটু বড় হবে। এই বাড়ির উঠান পালানই হবে তখন আর একটা পলো। সেই পলোর বৃত্ত ভেঙে একমাত্র মৃত্যুই পারবে তাকে মুক্তি দিতে।

.

১.২৭

বারবাড়ির সামনে বিশাল একখান নাড়ার পালা। যে লম্বা বাঁশের চারপাশ ঘিরে ছোট ছোট আঁটি বেঁধে পালা দেওয়া হয়েছে সেই বাঁশের মাথায় ঘোর কালো বর্ণের। একখান হাড়ি বসান। হাড়ির সামনের দিকে খড়িমাটি দিয়ে আঁকা হয়েছে দুইখান চোখ। ফলে দূর থেকে নাড়ার পালাটাকে দেখায় পেটমোটা কাকতাড়ুয়ার মতো। কাক চিল, ইঁদুর বাদুর না, এই কাকতাড়ুয়াটি যেন মানুষকেই ভয় দেখায়। ম্যাটম্যাটা জ্যোৎস্না রাতে অচেনা পথিক যখন এই বাড়ির সামনে দিয়া যায়, হঠাৎ করে নাড়ার পালার দিকে তাকিয়ে কলিজা কেঁপে ওঠে তাদের। মনে হয় এটা নাড়ার পালা না, এটা তেনাদের একজন। পরহেজগার মানুষের বাড়ি দেখে বাড়ির ভিতর ঢুকতে পারছে না। বারবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে ভিতর বাড়ির দিকে। যেন বাড়ালেই সেই পা বেঁধে ফেলবে মান্নান মাওলানার বাড়ি বন্ধের দোয়া। সেই বন্ধন মুক্ত করবার সাধ্য তেনাদের নাই।

নাড়ার পালার পুর দক্ষিণ কোণে গরুর আধাল (গোয়ালঘর)। লম্বা মতন এক চালাটায় দামড়া দামড়ি (এঁড়ে বকনা) নিয়ে এগারোটা গরু। এই বাড়ির অনেকদিনের বাসিন্দা তারা, বাড়ির খুঁটিনাটি সবই জানে, তবু কোনও কোনও রাতে আধাল থেকে গলা বাড়িয়ে কেউ কেউ নাড়ার পালার দিকে তাকায়। তাকিয়ে লেজ খাড়া করে তারপর হাম্বা রবে গিরস্তকে সাবধান করে। যে রূপেই থাকে গৃহপালিত পশুরা নাকি এক পলক। দেখেই তেনাদের চিনতে পারে। চিনতে পারার লগে লগে ভয়ে লেজ খাড়া হয়ে যায় তাদের। হাম্বা রবে দশদিক মুখরিত করে। তেনাদের চিনতে যে গরুরাও ভুল করে মান্নান মাওলানার বাড়ির সামনের নাড়ার পালা তার প্রমাণ।

আজ সকালে এই নাড়ার পালার তলায় উদাস হয়ে বসে আছে আতাহার। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেরুয়া রঙের চাদর। এমন জবুথুবু হয়ে বসেছে, দেখে মনে হয় শীতে মরে যাচ্ছে, এখানে বসেছে রোদ পোহাবার জন্য। খানিক আগে ঘুম থেকে উঠেই এখানে। চলে এসেছে। চোখ দুইটা লাল টকটকা হয়ে আছে, যেন চোখ উঠেছে আতাহারের। বাড়ির গোমস্তা কাশেম টুকটাক কাজ করতাছে আথালে। ফুর্তিবাজ মানুষ কাশেম। কাজ করবার সময় মাঝারি স্বরে গান গাওয়ার অভ্যাস আছে। এখনও গান গাইছে সে।

আগে জানি না রে দয়াল
তর পিরিতে এ পরান যাবে

কাশেমের গান শুনে চোখ তুলে আথালের দিকে তাকাল আতাহার। খ্যারাখ্যারা গলায় ডাকল, ঐ কাইশ্যা।

গান থামিয়ে সাড়া দিল কাশেম। কন।

এমিহি আয়।

কাজ ফেলে একদৌড়ে নাড়ার পালার সামনে এসে দাঁড়াল কাশেম। ছেঁড়া লুঙ্গি হাঁটুর কাছ পর্যন্ত তুলে পরা। লুঙ্গির ওপর মাজায় গিঁট দিয়ে বান্ধা গামছা। ডান বাহুতে কালো কাইতানের (এক ধরনের মোটা সুতা) লগে বান্ধা রূপার বড় একখান মাদলি। এছাড়া শরীরে আর কিছু নাই কাশেমের। খালি গায়ের কাশেম দেখতে অদ্ভুত। গায়ের রঙ বাইল্লা (বেলে) মাছের মতো ফ্যাকাশে। বুকে পিঠে কোথাও একখান পশম নাই। ভাঙা মুখে, নাকের তলায় আছে গলাছিলা করার গর্দানের কাছে ভুল করে গজানো দুইচারটা পশমের মতন দুইচারটা মোচ, থুতনির কাছে আছে মোচের মতন কয়েকখান দাঁড়ি। দাঁড়িমোচের রঙ কাশেমের মাথার চুল মোচ ভুরু আর চোখের পাপড়ির মতোই লালচে ধরনের। এই দাঁড়িমোচ কাজির পাগলা বাজারে গিয়ে প্রায়ই কামিয়ে আসে সে। গায়ে পশম নাই, মুখে দাঁড়িমোচ নাই দেখে দুষ্টু লোকেরা কাশেমের নাম দিয়েছে মাকুন্দা কাশেম। এই নাম শুনে প্রথম প্রথম খুব ক্ষেপত কাশেম, আজকাল আর ক্ষেপে না। সয়ে গেছে।

আরেকখানা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার মুখের হাঁ বেশ বড়। হাসলে দুইকান তরি ছড়িয়ে যায় হাসি এবং প্রত্যেক কথায় হাসে কাশেম।

এই যেমন এখন, নাড়ার পালার তলায় বসা আতাহারের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।

লালচোখ তুলে কাশেমের দিকে তাকাল আতাহার। নাক ফুলিয়ে বলল, হাসছ ক্যা?

কাশেম লগে লগে বলল, কো, হাসি না তো!

বলেও হাঁ করা মুখ হাসি হাসি করে রাখল।

আতাহার বলল, মুক বন্দ কর।

প্রথমে একটা ঢোক গিলল কাশেম তারপর মুখ বন্ধ করল। দেখে খুশি হল আতাহার। গম্ভীর গলায় বলল, বাবায় কো?

পুবের ঘরে।

কী করে?

মউলকা (চাপটি। চল, খুদ সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে, সকালবেলা বেটে, পানি মিশিয়ে তরল করে মাটির খোলায় রুটির আকারে লেপটে দিতে হয়। ভাজা হলে খেতে বেশ স্বাদ) খায়।

মায় আইজ মউলকা বানাইছেনি? কীয়ের মউলকা?

খুদের।

কচ কী! কনটেকদার সাবে আছে বাইত্তে, বিয়ানে তারে খুদের মউলকা খাওয়ামুনি?

 তয় কী খাওয়াইবেন?

হেইডাই চিন্তা করতাছি।

খানিক চুপ করে কী ভাবল আতাহার তারপর বলল, তর কামকাইজ শেষ?

নিজের অজান্তেই হাসল কাশেম। আসল কাম শেষ। রইদ ওডনের আগেই বেবাকটি গাই চকে নিয়া গোছর (হাতখানেক লম্বা খুঁটিতে দড়ি বেঁধে, সেই দড়ির আরেক প্রান্ত গরুর পা, গলায় বেঁধে খুঁটিটা মাঠে পুতে দেওয়া। এই খুটি ওপড়ান বেশ কঠিন। দড়ি যতটা লম্বা সেই অনুযায়ি খুঁটির চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঘাস খেতে হয় গরু ছাগলের) দিয়াইছি। অহন আধাল সাফ করতাছি।

শেষ অইছে?

না। তয় পরে করলেও অইবো। আপনের কী কাম কন, কইরা দেই।

 কনটেকদার সাবে অহনতরি ঘুমাইতাছে। উইট্টা হাতমুখ ধুইবো, পায়খানায় যাইবো। তুই এক কাম কর, এক বালতি পানি আইন্না রাখ বাংলাঘরের সামনে আর পিতলের বড় বদনাডা। একহান তোয়াইল্লা রাকিছু জানলার লগে, সাবান রাকিছ। মেজবানের লেইগা যা যা করন লাগে আর কি, বুজলি না!

হ বুজছি।

তারপরই যেন আতাহারের চোখ দুইটা দেখতে পেল কাশেম। দেখে আঁতকে উঠল। ও মিয়াবাই চোক্কে কী অইছে আপনের চকু উদাইছেনি (উঠেছে কিনা)?

আতাহার গম্ভীর গলায় বলল, না।

তয় চক্কু দিহি পানিকাউর (পানকৌড়ির) চকুর লাহান অইয়া রইছে।

হারা রাইত অরঘুমা (নির্ঘুম) আছিলাম।  

ক্যা?

 মদ খাইছি।

কাশেম থতমত খেয়ে বলল, তোবা, তোবা।

লগে লগে খেঁকিয়ে উঠল আতাহার। ঐ বেডা তোবা তোবা করচ ক্যা? আমি যে মদ খাই তুই জানস না? আইজ থিকা খাইনি খাই তো ছোডকাল থিকা।

ধমক পেয়ে হাসল কাশেম। বিনীত গলায় বলল, হেইডা তো খানই।

তয়?

খাইলেও এই হগল কথা কইতে অয় না। আপনে একজন আলেমের পোলা।

আতাহার হাসল। আলেমের ঘরে জালেম অয়।

তোবা তোবা, এই হগল কী কইতাছেন মিয়াবাই। হুজুরে হোনলে জব কইরা হালাইবো।

থো ডো, জব কইরা হালাইবো! আমার বাপে আমার থিকাও বড় জালেম। তুই বুজবি না, আমি বুজি। অহন যা, যা যা কইলাম কইরা আয়। তারবাদে আমার মাথাডা ইট্টু বানাই দিবি। বেদনা করতাছে। মদ খাইয়া অরঘুমা আছিলাম তো, এর লেইগা।

আপনে অরঘুমা আছিলেন আর আপনের লগে বইয়া খাইলো কনটেকদার সাবে হেয় দিহি ঘুমাইতাছে?

হেয় আর আমি এক না। আমি ইট্টু বেশি খাই। কেঐ মদ খায় ঘুমানের লেইগা কেঐ খায় জাইগগা থাকনের লেইগা, প্যাচাইল পারনের লেইগা। আমি খাইয়া দাইয়া ইট্টু জাইগগা থাকি, ইট্টু প্যাচাইল পোচাইল পারি।

নিঃশব্দে হাসল আতাহার।

তাকে হাসতে দেখে কাশেমও হাসল। হ এইডা আইজ বোজলাম। এত প্যাচাইল আমার লগে কোনওদিন পারেন নাই আপনে। অহনতরি মনে অয় নিশা কাডে নাই আপনের।

আতাহার কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই হন হন করে হেঁটে মজনু এসে উঠল বাড়িতে। আতাহারের সামনে এসে দাঁড়াল। হুজুর বাইত্তে আছে না?

চোখ ঢুলু ঢুলু করে মজনুর দিকে তাকাল আতাহার। হুজুরডা জানি কেডা?

মজনু থতমত খেল তারপর হেসে ফেলল। ফাইজলামি কইরেন না দাদা। আছেনি কন, বহুত দরকার।

আছে।

কো?

নিজেকে দেখিয়ে আতাহার বলল, এই যে!

মজনু কথা বলবার আগেই কাশেম বলল, কী শুরু করলেন মিয়াবাই! মাইনষে কইবো কী!

কাশেমের দিকে তাকিয়ে মজনু বলল, হুজুর যুদি বাইত্তে থাকে তারে আপনে ইট্টু খবর দেন। কন ছনুবুড়ি মইরা গেছে তার জানাজা পড়তে যাওন লাগবো। আমি তারে নিতে আইছি।

হঠাৎ করে মৃত্যু সংবাদ আশা করেনি কেউ। কাশেম এবং আতাহার দুজনেই থতমত খেয়ে গেল। আতাহার তাকিয়ে রইল মজনুর মুখের দিকে আর কাশেম দিশাহারা গলায় বলল, কও কী! কুনসুম মরলো?

মজনু কথা বলবার আগেই খরমে চটর পটর শব্দ তুলে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন মান্নান মাওলানা। বিনীতভাবে তাকে সালাম দিল মজনু। আসোলামালাইকুম।

সালামের জবাব দিলেন না তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন, কেডা মরছে?

ছনুবুড়ি।

মান্নান মাওলানা ভুরু কুঁচকালেন। ঐ চুন্নি! ভাল অইছে। একটা খারাপ জিনিস গেছে।

এতক্ষণ ধরে বসে থাকা আতাহার উঠে দাঁড়িয়েছে কিন্তু মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না। যেন তাকালেই তার লালচোখ দেখে যা বোঝার বুঝে যাবেন বাবা। কথা বললে মুখের গন্ধে উদিস পেয়ে যাবেন তার নেশার কথা। কায়দা করে মুখ লুকিয়ে বাংলাঘরের দিকে চলে গেল আতাহার। যাওয়ার আগে ইশারা করে গেল কাশেমকে। সেই ইশারা পাত্তা দিল না কাশেম। হঠাৎ করেই বাড়ির নামার দিকে দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, ছনুবুজি মইরা গেছে, যাই তারে ইউ শেষ দেহা দেইক্কাহি।

কাশেমের দৌড় দেখে রাগে গা জ্বলে গেল আতাহারের। ঘরে মেজবান আছে, এখনই ঘুম ভাঙবে তার। তারপর কত কাজ, এসব এখন কে করবে!

দাঁতে দাঁত চেপে কাশেমকে একটা বকা দিল আতাহার। বাইত আহো বউয়ার পো, শেষ দেহা তোমারে দেহামু নে।

কিন্তু কাশেম আতাহার কারও দিকেই তখন মন নাই মান্নান মাওলানার। মজনুর দিকেও তাকালেন না তিনি। কোন ফাঁকে পানজাবির জেল থেকে ছোট্ট কাঁকুই বের করেছেন। এখন কাঁকুই দিয়ে দাঁড়ি আঁচড়াচ্ছেন। চোখে বদদৃষ্টি। সেই দৃষ্টি নাড়ার পালার দিকে ফেলে বললেন, কেমতে মরলো?

মজনু বিনীত গলায় ঘটনা বলল। শুনে শিয়ালের মতো খ্যাক করে উঠলেন তিনি। কী আত্মহত্যা করতাছে? মাইট্টাতেল খাইছে

মজনু বলল, মনে অয় ইচ্ছা কইরা খায় নাই। তিয়াস লাগছিল, পানি মনে কইরা খাইছে।

যেমতেই খাউক, খাইছে তো! এইডা আত্মহত্যাঐ। ঐ বাইত্তে আমি যামু না। একে চোর দুইয়ে আত্মহত্যা, এই রকম মুদ্দারের জানাজা অয় না।

কথাটা বুঝতে পারল না মজনু। অবাক হয়ে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকাল। তয়?

তয় আবার কী? জানাজা অইবো না।

জানাজা না অইলে মাডি দিবো কেমতে

মাডি দিবো না।

কন কী!

হ।

মুদ্দার লইয়া তইলে কী করবো?

কাথা কাপড়ে প্যাচাইয়া মড়কখোলায় (গৃহপালিত মৃত জীব যে স্থানে ফেলে) হালাইয়া দিবো! গরু বরকি (ছাগল) মরলে যেমতে হালায়! কাউয়া চিলে ঠোকরাইয়া ঠোকরাইয়া খাইবো, হকুনে খাইবো, শিয়াল কুত্তায়ও খাইতে পারে। আর নাইলে গাঙ্গে হালায় দিবো। মাছে খাইবো, কাউট্টা কাছিমে খাইবো। এই মুদ্দার মাডিতে লইবো না। গোড় দিলে হায় হায় রব করবো মাডি। যেই মাওলানা জানাজা পড়বো তার গুণা অইবো। সইত্তর হাজার বচ্ছর জ্বলন লাগবো দোজকের আশুনে। জাইন্না হুইন্না এই কাম আমি করতে পারুম না।

কোনও মুর্দারের যে মাটি হয় না, জানাজা হয় না একথা জীবনে প্রথম শুনল মজনু। আগামাথা কিছুই বুঝল না, আগের মতোই অবাক হয়ে মান্নান মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আড়চোখে মজনুকে একবার দেখে দাঁড়ি আঁচড়ানোর কাঁকুই জেবে রেখে অন্য জেব থেকে জামরুল রঙের তসবি বের করলেন মান্নান মাওলানা, তসবি জপতে জপতে কেরাতের সুরে বললেন, আল্লাপাক বলেছেন, হে আমার পেয়ারে বান্দা, হে মোমিন মোসলমান, তোমরা চুরি করিও না, জেনা করিও না। যুদি করো আমার কোনও মুসল্লি, কোনও পরহেজগার বান্দা তোমার জানাজা পড়াইবে না, জানাজায় শরিক হইবে না। আমার দুইন্নাইতে তোমার জইন্য কোনও কবর নাই আমার মাডি তোমারে জাগা দিবো না। ক সোবানাল্লা, সোবানাল্লা।

সোবাহানআল্লাহ বলল না মজনু। চিন্তিত গলায় বলল, মোতালেব কাকায় যে তাইলে কাফোন আনতে গেল, মতলা গেল বাঁশ কাটতে, আলফু গেল কবর খোদতে। হেরা কি এই হগল জানে না ?

না জানে না। নাদান, নাদান। আর মোতালেইব্বা তো দৌড়াইতাছে চুরি চামারি করনের লেইগা। কাফোনের কাপোড় থিকাও চুরি করবো।

একটু থেমে বললেন, আমি যা যা কইলাম তুই গিয়া আইজ্জারে এইডি ক। সাফ কথা অইলো অর মায় চোর আছিলো, চোরের জানাজা অইবো না, কবর অইবো না। লাশ মড়কখোলায় হালাইয়া দিতে ক, নাইলে গাঙ্গে। যা।

মজনু আর কথা বলল না। শুকনা, চিন্তিত মুখে মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে নেমে এল। আনমনা ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল যেসব কথা বলেছেন মান্নান মাওলানা এইগুলি ঠিক তো! নাকি কথার মধ্যে আছে অন্যরকমের চালাকি! ছনুবুড়িকে অপছন্দ করে বলে ইচ্ছা করেই কি তার জানাজা পড়াতে চাইছেন না মান্নান মাওলানা! কোনও দিনকার কোনও অপমানের শোধ কি এই ভাবে নিচ্ছেন ছনুবুড়ির ওপর! মুর্দারের ওপর কি শোধ নেওয়া যায়! মান্নান মাওলানা তো তাহলে মানুষ না। সাপ, কালজাইত সাপ। উড়ে এসে গায়ে পড়লে শুকনা পাতাকেও যে ছাড়ে না, ছোবল দেয়।

 কিছু না ভেবে মজনু তারপর খান বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। খান বাড়ির মসজিদের হুজুরকে গিয়ে খুলে বলবে সব। মান্নান মাওলানা যা যা বলেছেন ওসব ঠিক কিনা জানতে চাইবে। যদি ঠিক না হয় তাহলে কি তিনি পড়াবেন ছনুবুড়ির জানাজা!

.

১.২৮

নূরজাহান মধুর স্বরে ডাকল, মা হামিদা, ও মা হামিদা।

রান্নাচালায় বসে কাজিরভাত (বিক্রমপুর অঞ্চলের গৃহস্থ বাড়ির রান্নাঘরে চুলার পাড়ে মাটির একখানা হাড়ি রাখা থাকে। যখনই ভাত রান্না হয় তখনই সদ্য চুলায় বসান ভাতের হাঁড়ি থেকে হাতায় করে একহাতা চালপানি তুলে ওই হাঁড়িটায় রাখা হয়। এই ভাবে দিনে দিনে ভরে ওঠে হাঁড়ি। চালপানি পচে টক টক একটা গন্ধ বে য়। এই চালপানি দিয়ে যে ভাত রান্না করা হয় তাকে বলে কাজিরভাত। চালটাকে বলা হয় কাজিরচাল। এই চাল দিয়ে যাই তৈরি করা হয় তার সঙ্গে কাজি শব্দটা থাকে। যেমন কাজিরজাউ, কাজিরবউয়া, কাজিরপিঠা ইত্যাদি) রাঁধছে হামিদা। মাটির হাঁড়িতে ভাত বসিয়ে, লগে তিন চারটা গোলালু, শিংমাছের মতো রঙের একখান সরা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। এখনও বলক ওঠেনি ভাতে, চোকলা (খোসা) পার করে তাপ পৌঁছায়নি গোললালুতে। নাড়ার আগুনে মাত্র লাড়াচাড়া পড়েছে হাঁড়ির চাউলপানিতে। সেদিকে একেবারেই মন নাই হামিদার। সে জানে ভাত উতরালে (বলক দিয়ে ফেনা ওঠা) শো শো শব্দ হবে। হাঁড়ির ভিতর থেকে সরা ধাক্কাতে শুরু করবে ফুটন্তু চাউলপানি। হামিদা তাই ব্যস্ত হয়ে আছে পাটা পুতা (শিল নাড়া) নিয়ে। তার হাতের কাছে, চুলার মুখে রাখা আছে একপাঁজা নাড়া, চুলার দিকে না তাকিয়েই মাঝে মাঝে চুলার মুখে সেই নাড়া গুঁজে দিচ্ছে সে। পাটার এক পাশে দুই তিনটা ছোট্ট টিনের পট, টিন এলুমিনিয়ামের দুই তিনটা বাটি, মাটির দুইখান খোড়া। ভাত চড়াবার আগে কয়েকটা শুকনা মরিচ মাটির খোলায় টেলে একটা খোঁড়ায় রেখেছে। অন্য খোঁড়ায় একটু পানি। এখন একটা পট থেকে একমুঠ কালিজিরা নিয়ে পাটার ওপর রেখে, বড় একখান টালা মরিচ নিয়ে, মাটির গোড়া থেকে আঙুলের ডগায় করে কয়েক ফোঁটা পানি তুলে কালিজিরা আর মরিচের সঙ্গে মিশিয়ে তা দিয়ে বেটে মাত্র ভর্তা বানাতে যাবে, অদূরে বসা নূরজাহান তখনই এই ভাবে ডাকল। শুনে কাজ ভুলে ভুরু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকাল হামিদা। এইডা আবার কেমুন ডাক, আ?

নূরজাহান গম্ভীর মুখ করে বলল, ক্যা তোমার নাম হামিদা না?

হ ভাল নাম হামিদা। ডাক নাম হামি।

তয়?

তয় কী? মাইয়া অইয়া নাম ধইরা ডাকবিনি মারে?

নাম ধইরা ডাকি নাই তো!

তয় কী ধইরা ডাকছস?

তুমি হোন নাই কী ধইরা ডাকছি?

 হুনছি হুনছি। মা হামিদা।

মিষ্টি মুখখানা হাসিতে আরও মিষ্টি করে তুলল নূরজাহান। নামের আগে তো মা কইছি!

মেয়ের এরকম হাসিমুখ দেখে আশ্চর্য এক অনুভূতি হল হামিদার। চোখ নরম করে নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দুইহাতে পুতা ধরে কালিজিরা পিষতে লাগল। কালিজিরা আর টালা মরিচের ধকধকে গন্ধ উঠে ছড়িয়ে গেল চারদিকে। সেই গন্ধে আকুল হল নূরজাহান। মধুর গলায় আবার ডাকল, মা হামিদা।

এবার আর মেয়ের মুখের দিকে তাকাল না হামিদা। কালিজিরা ভর্তা বানাতে বানাতে বলল, আথকা (হঠাৎ) এমুন আল্লাদ অইলো ক্যা! কী চাস?

কিচ্ছু না।

তয়?

তোমারে এমতে ডাকতে বহুত ভাল লাগতাছে।

তুই একখান পাগল। এত ডাঙ্গর অইছস অহনতরি পোলাপাইন্নামি (ছেলেমানুষি, মেয়েমানুষি) গেল না। কবে যে যাইবো!

কোনওদিনও যাইবো না। আমি হারাজীবন এমুন থাকুম।

হারাজীবন এমুন থাকন যায় না মা।

ক্যা যায় না?

অহন বুজবি না। বিয়াশাদি অইলে বুজবি।

না আমি অহনঐ বুজতে চাই। তুমি আমারে বুজাও।

এবার একটু বিরক্ত হল হামিদা। জ্বালাইতাছস ক্যা? দেহচ না কত কাম আমার!

শিশুর মতো অবুঝ গলায় নূরজাহান বলল, কী কাম?

হামিদার ইচ্ছা হল ধমক দেয় মেয়েকে। ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়, না হলে উঠিয়ে দেয় এখান থেকে। তারপরই ভাবল সেটা ঠিক হবে না। ধমক খেলে রেগে যাবে নূরজাহান পাড়া বেডাতে বের হবে। দুপুরের আগে আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না তাকে। সারাটা বিয়ান না খেয়ে থাকবে। রসের প্রথম দিনে কেন অযথা কষ্ট দিবে মেয়েটাকে! তাছাড়া এত আদরের গলায় যখন ডাকছে, টুকটাক কথা বলে সময়টা ভালই কাটান যাবে। কাজের কাজও হবে মেয়েকেও আটকে রাখা যাবে বাড়িতে।

চোখ তুলে একবার নূরজাহানের দিকে তাকাল হামিদা। তারপর কালিজিরা বাটতে বাটতে বলল, শীতের পয়লা দিন আইজ। তর বাপে গেছে রস বেচতে। বিয়াইন্না রাইত্রে উইট্টা গেছে। ফিরা আইতে আইতে বেইল উইট্টা যাইবো। বাঘের লাহান খিদা লাগবো আইজ। হের লেইগা কাজিরভাত রানতাছি।

বাবায় কাজিরভাত রানতে কইয়া গেছে।

না কয় নাই। আমি নিজে থিকাঐ রানতাছি।

ক্যা?

তর বাপে কাজিরভাত পছন্দ করে। নানান পদের ভর্তা দিয়া কাজিরভাত খাইতে পারলে মন ভাল থাকে তার। আইজ পয়লা দিন তো, বহুত খাটনি যাইবো কামে। বাইত্তে আইয়া কাজিরভাত দেকলে খুশি অইবো। খাটনির কথা ভুইল্লা যাইবো।

কয় পদের ভর্তা বানাইবা?

তিন চাইর পদের।

কী কী?

চুলার হাড়িতে তখন বলক এসেছে। উতড়াতে শুরু করেছে ভাত। শো শো শব্দে নাচছে সরা। কালিজিরা ভর্তাটাও ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে। হাত দিয়ে কেচে পাটা থেকে ভর্তা তুলল হামিদা। টিনের একটা বাটিতে রাখল। লুছনি (যে ন্যাকড়া দিয়ে গরম হাড়ি কড়াই ধরতে হয়) দিয়ে ধরে সরা সরিয়ে নারকেলের আইচা দিয়ে তৈরি হাতায় হাঁড়ির ভাত দুই তিনবার উলট পালট করে দিল। একটা দুইটা ভাত দুই আঙুলের ডগায় নিয়ে টিপে দেখল ফুটেছে কি না। তারপর হাঁড়ির মুখে আবার সরার ঢাকনা দিয়ে বলল, এই যে কালিজিরা ভর্তা বানাইলাম, একপদ তো অইয়াই গেলো। ভাতের লগে গোলালু সিদ্দ দিছি। টালা মরিচ আর সউষ্যার (সরিষার) তেল দিয়া মইত্তা (মথে) আলুভর্তা বানামু। শেষমেষ বানামু চ্যাবা সুটকির (পুঁটি মাছের বিশেষ এক প্রকার সুটকি) ভর্তা।

এই তিনপদঐ?

হ।

ইলশা মাছের কানসা, ছোবা (ইলিশ মাছের কানকোর ভেতর যে লালচে জিনিসটা থাকে) এই হগলের ভর্তা বানাইবা না?

হামিদা হাসল। পামু কই?

নূরজাহান ঠোঁট উল্টে বলল, কাজিরভাতের লগে ইলশা মাছের কিছু একখান না থাকলে খাইয়া সাদ নাই। হয় কানসা ছোবার ভর্তা, নাইলে কড়কড়া ইলশা মাছ ভাজা, ইলশা মাছের আণ্ডা ভাজা, লুকা (নাড়িভুঁড়ি) ভাজা। ধ্যুৎ আউজকা কাজিরভাত খাইয়া সাদ পামু না।

হামিদা বুঝে গেল মেয়ের ইলিশ মাছ খাওয়ার সাধ হয়েছে। মাওয়ার বাজারে গেলেই পদ্মার তাজা ইলিশ, চকচকে সাদা রঙের উপর নীলচে আভা। গাছিকে বলতে হবে কাজিরভাত খেয়েই যেন বাজারে যায়। প্রথম দিনের রস বেচা পয়সায় যেন একখান ইলিশ মাছ কিনে আনে। মেয়ের সাধটা যেন পূরণ করে।

নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে হামিদা বলল, তর বাপে আহুক, তারে আমি কমুনে।

নূরজাহান অবাক হল। কী কইবা?

তুই যে ইলশা মাছ খাইতে চাইছস হেইডা। আইজ বাজারে পাডামুনে। আইজ ইলশা মাছ আইন্না খাওয়ামুনে তরে।

শুনে আবার মিষ্টি করে হাসল নূরজাহান। তুমি যে আমারে এত আদর করো এইডা কইলাম অনেক সময় বুজি না আমি।

ক্যা?

আদরের থিকা রাগ যে বেশি করো! কোনওহানে যাইতে দিতে চাও না। যাইতে চাইলে গাইল দেও, মারো। একদিন তো বাইন্দাও থুইছিলা। বাবায় আইয়া ছাড়ছে। তুমি আমার লগে এমুন করো ক্যা মা?

সরা সরিয়ে ভাতের হাঁড়িতে হাতা ঢুকাল হামিদা। আন্দাজ করে করে ভাতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সিদ্দ গোলআলু তুলতে লাগল : তুলে একটা খোড়ায় রাখতে রাখতে বলল, কেন যে করি হেইডা তুই বুজবি না।

নূরজাহান মুখ ঝামটাল। সব সময় এককথা কইবা না। বুজুম না ক্যা, আমি কি পোলাপান?

নূরজাহানের মুখ ঝামটা শুনে পলকের জন্য তার দিকে তাকাল হামিদা। তারপর দুইহাতে দুইটা লুছনি নিয়ে হাঁড়ির কানা ধরে নামিয়ে চুলার ওপাশে রাখা ছাই রঙের খাদায় ভাত ঠিকনা দিল। দিয়ে ধীর নরম গলায় বলল, তুই যে একখান মাইয়া, তুই যে ডাঙ্গর অইছস এইডা তুই বোজ?

বুজি।

ডাঙ্গর মাইয়াগো কী কী নিয়ম মাইন্না চলতে অয় বোজছ?

বুজি।

এবার মুখ ঘুরিয়ে নূরজাহানের চোখের দিকে তাকাল হামিদা। না বোজচ না।

কে কইছে বুজি না! তুমি আমারে বেবাক বুজাইছো না?

বেবাক না খালি একখান জিনিস বুজাইছি। মাইয়া মাইনষের শইল বড় ভেজাইল্লা জিনিস। নানান পদের ভেজাল আছে এই শইল্লে। হেই হগল ভেজালের একখান তরে বুজাইছি। যেইদিন বুজাইছি ঐদিন তুই ডাঙ্গর অইলি। আর ঐদিন থিকাঐ বিপদটা তর শুরু অইছে। 

কথাটার আগামাথা কিছুই বুঝল না নূরজাহান। বলল, কিয়ের বিপদ?

চুলায় মাটির খোলা বসাল হামিদা। টিনের ছোট্ট একখান পট থেকে চারটা চ্যাপা সুটকি বের করে তপ্ত খোলায় টালতে টলতে বলল, বিপদটার নাম অইলো পুরুষপোলা। একখান মাইয়া যহন ডাঙ্গর অয় আপনা বাপ ভাই ছাড়া দুইন্নাইর বেবাক পুরুষপোলাঐ তহন হেই মাইয়াডার মিহি কুদিষ্টি দিয়া চায়। নানান উছিলায় আতালি পাতালি কথা কইয়া, লোভ দেহাইয়া, ডর দেহাইয়া নাইলে জোর কইরা মাইয়াডার শইলডারে নষ্ট করতে চায়। আর মাইয়া মাইনষের শইল এমুন, একবার নষ্ট অইলো তো সব্বনাশ, বেবাক গেল। হেই শইল আর স্বামীরে দেওন যায় না। দিলে গুনা অয়, জনম ভইরা দোযকের আগুনে জ্বলতে অয়। হিন্দুরা যহন পূজা করে, দেবদেবীরে পূজা দেয়, তহন ফুল লাগে। তাজা ভাল ফুল। বাসি পচা ফুল অইলে পূজা অয় না। দেবতায় অদিশাপ দেয়। মাইয়ামানুষ অইল পূজার ফুলের লাহান। একবার বাসি অইয়া গেলে হেই ফুলে স্বামী দেবতার পূজা অয় না। ডাঙ্গর অওনের লগে লগে এর লেইগাঐ সাবদান অইতে অয় মাইয়ামাইনষের। আলায় বালায় (যত্রতত্র) ঘুইরা বেড়ান যায় না। কুনসুম কোন বিপদে পড়বো কে জানে!

মায়ের কথা শুনতে শুনতে চোখের উপর দুইজন মানুষের মুখ ভেসে উঠতে দেখল নূরজাহান, একজন আলী আমজাদ আরেকজন মজনু। আলী আমজাদের মুখ দেখে ভয়ে শরীরের খুব ভিতরে কেমন একটা কাঁপন লাগল আর মজনুর কথা ভেবে আশ্চর্য এক শিহরণে, আশ্চর্য এক লজ্জায় ডালিম ফুলের আভার মতো মুখখানা তার আলোকিত হল। হামিদা এসবের কিছুই খেয়াল করল না, আগের কথার রেশ ধরে বলল, এর লেইগাঐ তর লগে আমি অমুন করি। একলা একলা কোনওহানে যাইতে দিতে চাই না। তুই তো আমার কথা হোনচ না, এই না হোননের লেইগা একদিন বহুত কানবি। তয় কাইন্দাও হেদিন কোনও লাব অইবো না। যা খোয়াবি তা আর ফিরত পাবি না।

মজনুর কথা ভেবে অন্যরকম হয়ে যাওয়া মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নূরজাহান বলল, আইজ তোমার কথা আমি পুরাপুরি বোজলাম মা। এমুন কইরা তো তুমি আমারে কোনওদিন কও নাই, তাও কমবেশি এই হগল কইলাম আমি বুজি। বেডাগো মুখেরমিহি চাইলে বোজতে পারি, চকের মিহি চাইলে বোজতে পারি। তুমি আমারে এক্কেরে (একেবারে) পোলাপান মনে কইরো না।

বোজলে ভাল না বোজলে মরণ। আইজ তরে আমি বেবাক কথা খুইল্লা কইলাম। অহন তুই বাচবি না মরবি এইডা তর চিন্তা। মাইয়া ডাঙ্গর অইয়া গেলে বাপ মায় যত পাহারা দেউক, ঘরে আটকাইয়া রাখুক, পায়ে ছিকল বাইন্দা রাখুক, মাইয়ায় যুদি নিজে না চায় তাইলে হেয় ভাল থাকতে পারবো না। ভাল থাকনা নিজের কাছে।

একটু থেমে হামিদা বলল, তয় আমার শেষ কথাডা তুই মনে রাখিচ। স্বামীর ঘরে একদিন যাইতে অইবো, শইলডা বাচায় রাখিচ। নষ্ট শইল স্বামীরে দেওনের থিকা বড় গুনা এই দুইন্নাইতে নাই। ঐ গুনাডা কোনওদিন করিচ না।

ঠিক তখনই দবিরকে দেখা গেল খুবই ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভার কাঁধে বাড়ির দিকে আসছে। ভার কাঁধে থাকলে দবিরের হাঁটাচলা হয় পালকি কাঁধে থাকা বেহারাদের মতো। যেন হাঁটে না সে, দৌড়ায়। কিন্তু এখন তার হাঁটা একেবারেই ধীর, নরম। কী রকম এক বিষণ্ণতা যেন পা দুইটাকে তার চলতে দিতে চাইছে না। এতটা দূর থেকে তার মুখ চোখ পরিষ্কার দেয়া যায় না তবে বোঝা যায় মুখ ম্লান হয়ে আছে বিষণ্ণতায়, চোখ উদাস হয়ে আছে উদাসীনতায়।

দবিরকে প্রথম দেখল নূরজাহান। দেখে উৎফুল্ল গলায় বলল, মা ওমা, ঐত্তো বাবায় আইয়া পড়ছে।

হাতের কাজ ফেলে হামিদাও তাকাল মানুষটার দিকে। অবাক গলায় বলল, এত তাড়াতাড়ি আইলো কেমতে? যতড়ি গাছে হাড়ি পাতছে ঐড়ি নামাইয়া উড়াইয়া, গিরস্তের রস গিরস্তরে বুজাইয়া দিয়া নিজের ভাগের রস বেইচ্চা বাইত্তে আইতে তো আরও বেইল (বেলা) অওনের কথা!

নূরজাহান তখন তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। তাকিয়ে তার অবস্থাটা বুঝে গেল। মায়ের দিকে মুখ ফিরাল নূরজাহান। চিন্তিত গলায় বলল, দেহো মা, বাবারে জানি কেমুন দেহা যাইতাছে। মরার লাহান আটতাছে, চাইয়া রইছে অন্যমিহি। রসের ঠিল্লা দেইক্কা বুজা যায় ঠিল্লা খালি অয় নাই। রস না বেইচ্চা বাইত্তে আইলো ক্যা বাবায়?

নূরজাহানের কথা শুনে চিন্তিত হল হামিদা। চারপাশে ছড়ান ছিটান কাজের কথা ভুলে, খোলায় পুড়ছে চ্যাপা শুঁটকি, সেই সুটকির গন্ধ ভাসছে সারাবাড়িতে, সেসব ভুলে দূর থেকে হেঁটে আসা গাছির দিকে তাকিয়ে রইল সে।

নূরজাহান বলল, লও তো আউগগাইয়া গিয়া দেহি কী অইছে বাবার!

 লগে লগে উঠে দাঁড়াল হামিদা। ল।

দুইজন মানুষ তারপর বাড়িতে ওঠা নামার মুখে এসে দাঁড়াল। কাছাকাছি আসতেই দৌড়ে গিয়ে দবিরের একটা হাত ধরল নূরজাহান। ও বাবা, বাবা কী অইছে তোমার? কী অইছে? এত তাড়াতাড়ি ফিরত আইলা?

দবির কোনও কথা বলল না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। উঠানে এসে কাঁধের ভার নামাল বড়ঘরের ছনছায়। (চৌচালা দোচালা একচালা টিনের ঘরের চালা, ঘরের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে যেটুকু বেড়ে থাকে, ঘরের বাইরে যেটুকু জায়গার রোদ বৃষ্টি আটকে রাখে সেই জায়গাটাকে বলা হয় ছনছা। শব্দটা বোধহয় সানশেড থেকে এসেছে)। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসল পিড়ায়।

একটা রসের ঠিলার মুখ থেকে ঢাকনা সরিয়ে ঠিলার ভিতর উঁকি দিল নূরজাহান। ঠিলায় অর্ধেক পরিমান রস। দেখে চমকে উঠল সে। দবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, রস বেচো নাই বাবা?

দবির উদাস গলায় বলল, না।

 শুনে আঁতকে উঠল হামিদা। ক্যা?

পরে কমুনে। আগে মাইয়াডারে কও ইট্টু রস খাইতে, তুমিও ইট্টু খাও।

দুইতিন পলক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে রান্নাচালা থেকে টিনের একটা মগ নিয়ে এল নূরজাহান। নিজেই রস ঢালল মগে। মাত্র চুমুক দিতে যাবে, দবির মন খারাপ করা গলায় বলল, ছনুবুজিরে কইছিলাম বচ্ছরের পয়লা রসটা তারে খাওয়ামু। তারে না খাওয়াইয়া রস বেচুম না। গেছি খাওয়াইতে, গিয়া দেহি ছনুবুজি নাই। মইরা গেছে। মরণের সময় পানির তিয়াস লাগছিল। পানি মনে কইরা মাইট্টাতেল খাইয়া হালাইছে।

বাবার কথা শুনে দিশাহারা হয়ে গেল নূরজাহান। মুখের সামনে থেকে রসভর্তি মগ উঠানে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তারপর কোনওদিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো বাড়ির নামার দিকে ছুটে গেল।

.

১.২৯

হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিআল্লাহুআনহু হইতে বর্ণিত আছে, একদা হযরত রাসুলুল্লাহু আলায়হেওয়াসাল্লাম গাধায় আরোহণ করিয়া বনু নাজ্জারের একটি উদ্যানের নিকট দিয়া গমন করিতেছিলেন। আমরাও তাঁহার সঙ্গে ছিলাম। হঠাৎ গাধাটি ভীত হইয়া তাহাকে ফেলিয়া দিবার উপক্রম করিল। সেই স্থানে পাঁচ ছয়টি কবর ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, এই কবরের অধিবাসীদের সম্বন্ধে তোমরা কেহ কিছু জান কি না? একজন বলিল, আমি জানি। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কী অবস্থায় তাহাদের মৃত্যু হইয়াছে? সে বলিল, শিরকীর মধ্যে। তিনি বলিলেন, ইহাদের কবরে ভীষণ আযাব হইতেছে। তোমরা সহ্য করতে পারিবে না বলিয়া আশংকা থাকিলে আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করিতাম যে, আমি যেমন তাহাদের কবরের আযাব শুনিতে পাইতেছি তোমরা যেন সেইরূপ শুনিতে পাও।

 খান বাড়ির মসজিদের বারান্দার এককোণে, দেওয়ালে ঢেলান (হেলান দিয়ে বসে আছেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। অল্প দূরত্ব রেখে তার মুখোমুখি বসে আছে বড় মেন্দাবাড়ির লম্বা সোনা মিয়া। মাথায় সাদা টুপি সোনা মিয়ার, গায়ে গেরুয়া রঙের ধোয়া পানজাবি। বুক থেকে গলা তরি চারখান বোম পানজাবির। একটা বোম খসে গেছে। বাকি তিনটা যত্নে লাগান। পরনের লুঙ্গি বেগুনি রঙের। পানজাবিটা পুরানা হয়ে গেছে, দুই এক জায়গায় গেছে ফেঁসে। তবে পানজাবি লম্বা বলে লুঙ্গি পানজাবির আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে। পায়ে স্পঞ্জের একজোড়া স্যান্ডেল ছিল সোনা মিয়ার। স্যান্ডেল দুইটা খুলে একটার গায়ে আরেকটা লাগিয়ে বাঁ দিককার উরুর তলায় রেখেছে। জুতা স্যান্ডেল সবচেয়ে বেশি চুরি হয় মসজিদে। নামাজ পড়তে এসেও তাই নামাজের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে কেউ কেউ জুতা স্যান্ডেল নিয়ে। মসজিদে ঢোকার আগে বগলে চেপে যেখানে নামাজ পড়ে তার পাশেই রেখে দেয়। সালাম ফিরাবার সময় আড়চোখে দেখে নেয় জায়গা মতন আছে কি না জিনিস দুইটা, নাকি সেজদা দেওয়ার ফাঁকে চুরি হয়ে গেছে।

আল্লাহর ঘরে এসেও চুরি করে কোনও কোনও মানুষ। ছি!

তবে এখন চুরির ভয় নাই। এই সকালবেলা মসজিদের ধারে কাছে আসবে না কেউ। তবু সাবধানের মার নাই বলে স্যান্ডেল দুইটা ওইভাবে রেখেছে সোনা মিয়া, নয়তো মন দিয়ে মাওলানা সাহেবের কথা শোনা যেত না। মন পড়ে থাকত স্যান্ডেলের দিকে। বরাবরই মুখ নিখুঁত করে কামানোর অভ্যাস সোনা মিয়ার। কিছুদিন হল সেই অভ্যাস বাদ দিয়েছে। হঠাৎ করেই মন তার ধর্মের দিকে ঝুঁকেছে। মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব এই মসজিদের ইমাম হয়ে আসার পর, তাঁকে দেখে, তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর মনটা কী রকম যেন হয়ে গেছে। জীবনে আল্লাহ খোদার নাম নেয় নাই, মসজিদে ঢুকে নামাজ পড়ে নাই, সবাই পড়ে বলে ঈদের নামাজটা পড়েছে, তাও সব সময় না, বিশেষ করে কোরবানি ঈদের নামাজ। বাড়িতে গরু বরকি কোরবানি হবে বলে কোরবানি ঈদের সকাল থেকে গরু বরকি নিয়াই ব্যস্ত থাকত। সেই মানুষ হঠাৎ করে বদলে গেল! একজন মানুষ যে কত সহজে আরেকজন মানুষকে নিয়া আসতে পারে ধর্মের দিকে মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব আর সোনা মিয়া তার প্রমাণ। যে সোনা মিয়া মেতে থাকত গান বাজনা নিয়ে, গ্রামের মাতব্বরি সর্দারি, আমোদফুর্তি আর খেলাধুলা নিয়া, সেই সোনা মিয়া এখন সময়ে অসময়ে এসে মসজিদে বসে থাকে। ইমাম সাহেবের কাছ থেকে ধর্মের কথা শোনে। মুখ কামানো ছেড়ে দিয়েছে। নিখুঁত করে কামানো মুখ আর নাই। এখন শুধু মোচটা কামায়, গাল থুতনি কামায় না। সেখানে কাঁচাপাকা দাঁড়ি দিনকে দিন লম্বা হচ্ছে।

এই বয়সে দাঁড়ি পাকবার কথা না সোনা মিয়ার। কিন্তু বেশ কিছু পেকেছে। দাঁড়ি মোচ ঠিক মতো গজাবার আগ থেকেই ক্ষুর ব্লেড লাগিয়েছিল গালে, অতিরিক্ত চাছাচাছি করেছে, ফলে জাগ দিয়ে বিচ্চাকলা (বিচিকলা) পাকাবার মতো নিজেই নিজের দাঁড়ি মোচ পাকিয়ে ফেলেছে। তবে ওই নিয়া সোনা মিয়ার কোনও মাথাব্যথা নাই। সে এখন অন্যমানুষ। এই যে সকালবেলা ইমাম সাহেব কবর আযাবের কথা বলছেন সে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছে। শীত পড়ে গেছে। গায়ে পাতলা পানজাবি তবু শীত লাগছে। না। অবশ্য মসজিদের বারান্দা পুবদিকে বলে সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে সোনা মিয়ার পিঠে। সেই রোদে বেশ উষ্ণতা। শীত না টের পাওয়ার এটাও একটা কারণ।

মসজিদের বারান্দা ছাড়িয়ে খানিকটা খোলা জায়গা তারপর দুই পাশে ইট রঙের বেঞ্চ দেওয়া বাঁধান ঘাটলা। ঘাটলার অনেকগুলি সিঁড়ি নেমে গেছে পানির দিকে। পানির উপরেরগুলির খবর আছে, গনা যায়, তলারগুলির খবর নাই। পুকুরটা বেশ গভীর। পুকুরের দক্ষিণে মাঠ, এই মাঠের নাম খাইগো বাড়ির মাঠ। পশ্চিম দিকে মসজিদ, মসজিদের উত্তরে ঝাঁপড়ানো আমগাছের তলায় দোচালা লম্বা টিনের ঘরে প্রাইমারি স্কুল। খাইগো বাড়ির স্কুল। স্কুল ঘরটার সামনে সবুজ ঘাসের অনেকখানি খোলা জায়গা। তারপর ভিতরবাড়ি। দালান আছে, বড় বড় টিনের ঘর আছে। এলাকার সবচেয়ে বড় বাড়ি, সবচেয়ে বনেদী বাড়ি। বংশ পরম্পরায় চেয়ারম্যান হচ্ছে এই বাড়ির লোক। যে কোনও সরকারের আমলেই মন্ত্রী এমপি হচ্ছে। সারা বিক্রমপুরে এই বাড়ির নাম, সম্মান।

বাঁধান ঘাটলার পুবে আর উত্তরে আছে আরও দুইখান ঘাটলা। সেই ঘাটলা কাঠের। বাড়ির মেয়েরা ব্যবহার করে বলে ওই দুইটা ঘাটলার তিনপাশে পানিতে খুঁটি পুতে সুন্দর করে বেড়া দেওয়া হয়েছে। এই বেড়া দেখেও বাড়ির আভিজাত্য টের পাওয়া যায়।

আর আছে গাছপালা। বিশেষ করে পুকুরের পুবপারে বড় বড় আমগাছ, জাম বকুলগাছ। সকালবেলার রোদ বেশ খানিকক্ষণ আটকে রাখে এই সব গাছপালা।

আজও রেখেছিল। তবে বেলা হওয়ার পর আর পারেনি। ফলে সোনা মিয়ার পিঠে এসে পড়েছে রোদ, মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবের পায়ের কাছে এসে পড়েছে। দেওয়ালে ঢেলান দিয়ে আছেন বলে তার পবিত্র শরীরের অন্যত্র পৌঁছাতে পারেনি রোদ।

প্রাইমারি স্কুল বন্ধ বলে কোথাও কোনও শব্দ নাই। আমগাছের পাতার আড়ালে বসে ডাকছে একটা কাক। দুইটা ভাত শালিক চরছে বাঁধান ঘাটলার কাছে। শীত সকালের রোদে ঝকমক ঝকমক করতাছে চারদিক। এরকম পরিবেশে মসজিদের বারান্দায়, দেওয়ালে ঢেলান দিয়ে বসা মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেবকে ফেরেশতার মতো লাগে। এতক্ষণ কথা বলছিলেন তিনি, এখন চুপচাপ হয়ে আছেন। পরনে সাদা চেকলুঙ্গি আর পানজাবি, মাথায় সাদাটুপি, বুক পর্যন্ত নেমেছে শুভ্রদাঁড়ি। মুখখানাও মাওলানা সাহেবের ধবধবে ফর্সা। ছিটাফোঁটা চর্বিও যেন নাই গায়ে, একহারা গড়ন। কথা বলেন ধীর, নরম স্বরে। সেই স্বর শুনে মনেই হয় না এ কোনও মানুষের স্বর, মনে হয় সরাসরি আল্লাহতালার দরবার থেকে আসছে মানুষের জন্য কোনও বাণী।

এরকম মানুষকে কে না শ্রদ্ধা করবে! কে না চাইবে তার কথা শুনতে!

 কিন্তু তিনি এমন চুপচাপ হয়ে আছেন কেন? তিনি কেন কথা বলছেন না! সোনা মিয়া তো আসেই তার কথা শুনতে!

সোনা মিয়া আস্তে করে ডাকল, হুজুর।

মাওলানা সাহেব ধীর গলায় সাড়া দিলেন।

সোনা মিয়া অতিরিক্ত বিনয়ের গলায় বলল, অনেকদিন ধইরা ভাবতাছি আপনেরে দুই একখান কথা জিগামু। সাহস পাইতাছি না।

মাওলানা সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। পবিত্র মুখ উজ্জ্বল করে হাসলেন। কোনও অসুবিধা নেই। বলুন।

আপনে তো নোয়াখালীর লোক, এত সোন্দর কইরা কথা কন কেমতে?

মাওলানা সাহেব আবার হাসলেন। শিখে নিয়েছি। আমি যদি নোয়াখালীর ভাষায় কথা বলতাম আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারতেন?

জ্বে না হুজুর।

আমার কাজ হচ্ছে ইমামতি করা। মানুষকে আল্লাহ রাসুলের কথা বলা। আমার ভাষাই যদি লোকে বুঝতে না পারে তাহলে সেই কাজ আমি সুন্দরভাবে করব কী করে? আমি যখন নোয়াখালীতে ছিলাম, সেখানকার মসজিদে ইমামতি করেছি, তখন সেই অঞ্চলের ভাষায় কথা বলেছি। নোয়াখালীর বাইরে আসার পর থেকে এখন আপনার সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলছি এই ভাষায়ই কথা বলি। কারণ বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের ভাষা তো আমি জানি না। শুদ্ধ ভাষাটা জানি, এ ভাষায় কথা বললে সব লোকই তা বুঝবে।

সোনা মিয়া গদগদ গলায় বলল, ঠিক কইছেন হুজুর। আরেকখান কথা, আপনে যখন কোরান হাদিসের কথা কন তহন দেহি বইয়ে যেমুন লেখা থাকে অমুন কইরা কন, এইডার অর্থ কী?

ওভাবে বলতে আমার ভাল লাগে। মনে হয় যারা শুনছে তাদেরও শুনতে ভাল লাগছে।

সোনা মিয়া মাথা নাড়ল। জ্বে জ্বে। হোনতে ভাল্লাগে। কন, কবর আযাবের কথা আর কিছু কন হুজুর।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব আবার নড়েচড়ে বসলেন। অপার্থিব গলায় বলতে লাগলেন, তিরমিযী শরীফে হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহুআনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লেল্লাহুআলায়হেওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, মৃতকে কবরস্থ করিবার পর দুইজন কৃষ্ণকায় নীলচক্ষু বিশিষ্ট ফেরেশতা তাহার নিকট আগমন করেন। তাহাদের একজনের নাম মুনকির ও অন্যজনের নাম নাকীর। তাহারা জিজ্ঞাসা করিবেন, এই ব্যক্তি সম্পর্কে তুমি কী বল? মৃতব্যক্তি বলিবে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসুল। আমি সাক্ষ্য দিতেছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই এবং মুহাম্মদ সাল্লেল্লাহুআলায়হেওয়াসাল্লাম তাঁহার বান্দা ও রাসুল। ফেরেশতারা বলিবে, আমরা জানিতাম তুমি এই কথাই বলিবে। অতঃপর তাহার কবরকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে সত্তরগজ প্রশস্ত করিয়া দেওয়া হইবে। পরে তাহার কবরকে আলোকিত করিয়া দিয়া বলা হইবে এবার ঘুমাও। মৃত লোকটি বলিবে, আমার পরিবারের নিকট যাইয়া আমি তাহাদিগকে আমার বর্তমান অবস্থা জানাইতে চাই। ফেরশতাদ্বয় বলিবে, বাসর রাত্রির ন্যায় শয্যা গ্রহণ কর, যেখানে প্রিয়তম ছাড়া অন্যকেহ নিদ্রাভঙ্গ করিতে পারে না। রাসুলুল্লাহ বলেন, এই কবর হইতেই কিয়ামত দিবসে আল্লাহতাআলা তাহাকে উঠাইবেন। আর যদি মৃতব্যক্তি মুনাফিক হয়, সে ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে বলিবে, লোকেরা যাহা বলিত তাহা শুনিয়া আমিও তাহাদের ন্যায় বলিতাম, আমি জানি না ইনি কে। ফেরেশতাদ্বয় বলিবে, তুমি যে ইহা বলিবে তাহা আমরা পূর্বেই জানিতাম। অতঃপর কবরকে বলা হইবে, সংকুচিত হও। ফলে তাহা এমনভাবে সংকুচিত হইবে যে মৃতের মেরুদণ্ড চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যাইবে। এই কবর হইতে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাহাকে উখিত না করা পর্যন্ত সে এইভাবে আযাব পাইতে। থাকিব।

মাওলানা সাহেবের কথা শেষ হওয়ার বারান্দার অদূরে এসে দাঁড়াল মজনু। মসজিদের বারান্দায় মাওলানা সাহেবকে বসে থাকতে দেখবে ভাবেনি। সে একটু থতমত খেল, ব্ৰিত হল। মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এ বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল ঠিকই, মাওলানা সাহেবকে কী কী কথা বলবে তাও ভেবে রেখেছিল, এখন হঠাৎ করেই সবকিছু গুলিয়ে গেল। মাওলানা সাহেবকে যে সালাম দিতে হবে সেকথা পর্যন্ত মন হল না। ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মাওলানা সাহেবের সামনে যে আরেকজন মানুষ বসে আছে, মানুষটা যে মজনুর পরিচিত সেকথাও মনে হল না।

একপলক মজনুকে দেখেই মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তাকে সালাম দিলেন। আসোলামোআলাইকুম। কী চান বাবা?

মাওলানা সাহেব কাকে সালাম দিচ্ছেন দেখবার জন্যে পিছন দিকে মুখ ফিরাল সোনা মিয়া। মজনুকে দেখে খ্যাক খ্যাক করে উঠল। কী রে বেডা, এত বেদ্দপ অইছস ক্যা? হুজুরের সামনে আইয়া খাড়াইছস ছেলামালাইকুম দিলি না? উল্টা হুজুর তরে দিল!

মাওলানা সাহেব হাসিমুখে বললেন, তাতে কোনও অন্যায় হয়নি। সালাম যে কেউ যে কাউকে দিতে পারে, আগে পরের কোনও ব্যাপার নেই।

সোনা মিয়া রাগে গো গো করতে করতে বলল, না হুজর, এইডা ও ঠিক করে নাই। ঐ মউজনা, মাপ চা হুজরের কাছে। পাও ধইরা ক আমার ভুল অইয়া গেছে, আমারে আপনে মাপ কইরা দেন। তাড়াতাড়ি।

মজনুর ততক্ষণে গলা শুকিয়ে গেছে। মুখ গেছে ফ্যাকাশে হয়ে। বুকও দুরদুর করে কাঁপছে। এ কেমন ভুল সে করল আজ! এই ধরনের ভুল তো সে কখনও করেনি! আজ কেন এমন হল!

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তখন তীক্ষ্ণচোখে মজনুকে দেখছেন। সোনা মিয়াও দেখছে। তবে দুইজনের চোখ দুইরকম। একজন দেখছেন মজনুর মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া অন্যজন দেখছে বেয়াদবি। সে বলার পরও হুজুরের পা ধরে কেন মাফ চাইছে না মজনু!

সোনা মিয়া ভাবল বড় রকমের একটা ধমক দিবে মজনুকে। তার আগে মাওলানা সাহেব তাঁর মনোমুগ্ধকর কণ্ঠে বললেন, কী হয়েছে বাবা? আপনাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। আমার সামনে এসে বসুন। বলুন কী হয়েছে?

এবার মজনু একটু নড়েচড়ে উঠল। ঢোক গিলে কাতর গলায় বলল, একজন মানুষ ইন্তিকাল করছে হুজুর।

ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। তার দেখাদেখি সোনা মিয়াও বিড়বিড় করে পড়ল দোয়াটা। তবে খুবই দ্রুত পড়ল, পড়েই মজনুর দিকে তাকাল। কেডা ইন্তিকাল করতাছে।

ছনুবুড়ি।

আইজ্জার মায়?

হ।

কুনসুম?

রাইত্রে।

সকালবেলা মৃত্যু সংবাদ শুনে যতটা কাতর হওয়ার কথা সোনা মিয়ার ততটা সে হল না। নির্বিকার মুখে হুজুরের দিকে তাকাল।

ব্যাপারটা খেয়াল করেও সোনা মিয়াকে কিছু বললেন না মাওলানা সাহেব। মজনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার কাছে আপনি কী মনে করে আসছেন বাবা?

মৃত্যু সংবাদ দিয়ে ফেলার পর ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে মজনু। মাওলানা সাহেবকে সালাম না দিয়ে যে বেয়াদবি করেছে সেকথা না ভেবে বলল, জানাজাডা যদি আপনে পড়াইতেন।

মওলানা সাহেব কথা বলবার আগেই সোনা মিয়া বলল, ক্যা মন্নান মাওলানারে পাইলি না? হেয় বাইত্তে নাই?

আছে।

তয়?

ছনুবুড়ির জানাজা হেয় পড়াইবো না।

ক্যা?

আপনে তো বেবাকঐ জানেন। আমারে আর জিগান ক্যা?

প্রথমে সোনা মিয়ার দিকে তারপর মজনুর দিকে তাকিয়ে মাওলানা সাহেব অবাক গলায় বললো, কেন, জানাজা তিনি পড়াবেন না কেন?

সোনা মিয়া বলল, যেয় ইন্তিকাল করতাছে সেয় মানুষ ভাল আছিল না হুজুর। কেমন মানুষ ছিল? খারাপ।

কী রকম খারাপ?

মজনুর দিকে তাকিয়ে সোনা মিয়া বলল, ঐ মউজনা তুই ক। তুই আমার থিকা ভাল জানচ। ছনুবুড়ির বাড়ি তগো বাড়ি থিকা কাছে।

মজনু বলল, টুকটাক চুরি করতে হুজুর। তয় বেবাকঐ খাওনের জিনিস। মাইনষের ঝাকার কদু, কোমড়ডা। গাছের আমড়া, গয়াডা। পোলার সংসারে থাকতো, পোলারবউ খাওন দিতো না। এর লেইগাঐ অমুন করতো। আর দুই একওক্ত খাওনের লেইগা একজনের বদলাম আরেকজনের কাছে কইতো। বানাইয়া বানাইয়া কইতো, মিছাকথা কইতো। বহুত কুটনা আছিলো।

মাওলানা সাহেব বললেন, মান্নান মাওলানা সাহেব তাকে চিনতেন?

জ্বে হ চিনতো হুজুর। বহুত ভাল কইরা চিনতো।

সোনা মিয়া বলল, ছনুবুড়িরে দুই মেদিনমোন্ডলের বেবাকতেঐ চিনে।

কিন্তু মান্নান মাওলানা সাহেব তার জানাজা পড়াবেন না কেন? কী বললেন তিনি?

কইলো ছনুবুড়ি চোর আছিলো, চোগলখুরি করতাছে, চোর আর চোগলখোরের জানাজা অয় না। মাডি তারে নিবো না। এই রকম মুদ্দাররে গাঙ্গে ভাসাইয়া দিতে অয় যাতে কাউট্টা (কচ্ছপ) কাছিমে খাইতে পারে, নাইলে মড়কখোলায় হালাইয়া দিতে অয়, কাউয়া চিলে খাইবো, হিয়াল হকুনে খাইবো, কুত্তায় খাইবো।

মাওলানা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর ম্লান মুখে হাসলেন। কথাগুলো তিনি ঠিক বলেননি। নামাজে জানাজা পড়া ফরজে কেফায়াহ। অর্থাৎ কেহ জানাজার নামাজ আদায় না করিলে যাহারা মৃত্যুর সংবাদ পাইয়াছে সকলেই গোনাহগার হইবে। যে কোনও একজন জানাজার নামাজ পড়িলেই ফরজে কেফায়াহ আদায় হইয়া যাইবে। কোনও জানাজার নামাজের জন্য জামায়াত শর্ত বা ওয়াজিব নহে। লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া, কাক শকুনের খাওয়ার জন্য মড়কখোলায় ফেলে দেওয়ার কথা কোনও মুসলমান বলতে পারেন না। মাটি কোনও মানুষকে গ্রহণ করবে না, এ হয় না। এ ভুল কথা। মৃত্যুর পর মানুষের যাবতীয় বিচারের ভার আল্লাহপাকের ওপর। পবিত্র কোরআন শরীফে আছে আল্লাহ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন? আর কিয়ামতের দিন আমি ন্যায় বিচারের মানদণ্ড দাঁড় করাইব। সুতরাং কাহারও ওপর কোনও অবিচার করা হইবে না, আর যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও কাজ হয় তবু তাহা আমি উপস্থিত করিব; হিসাব গ্রহণ করিতে আমিই যথেষ্ট।

মাওলানা সাহেবের কোনও কোনও কথার অর্থ বুঝল না মজনু, সোনা মিয়াও পুরাপুরি বুঝল বলে মনে হল না, তবে তারা দুইজনেই মুগ্ধ হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মাওলানা সাহেব বললেন, তিরমিযী শরীফে আছে তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের সৎ কার্যগুলির কথা উল্লেখ কর এবং তাহাদের দুষ্কর্মগুলির কথা উল্লেখ করিও না।

মজনু এবং সোনা মিয়া দুইজনের দিকেই মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। মৃতব্যক্তি সম্পর্কে এই সব কথা আপনারা মনে রাখবেন। আরও দশজনকে বলবেন। তাহলে ভুল ফতোয়াদানকারীরা ফতোয়া দিতে সাহস পাবে না। আরও দুতিনটে হাদিস বলে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলব আমি। তার আগে, বাবা মজনু, আপনি আমাকে বলুন মৃতের গোসল দেওয়া হয়েছে, কাফন দেওয়া হয়েছে?

মজনু বলল, অহনও অয় নাই। তয় ব্যবস্তা অইতাছে।

তাহলে ঠিক আছে। কারণ জানাজা বিলম্ব করা মাকরূহ। যদি জুমআর দিন কাহারও ইন্তেকাল হয় তবে সম্ভব হইলে জুমআ’র পূর্বেই নামাজে জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করিবে। জুমআ’র সময় লোক সমাগম বেশি হইবে এই উদ্দেশ্যে জানাজা বিলম্ব করা মাকরূহ।

মাওলানা সাহেব একটু থামলেন, আকাশের দিকে তাকালেন, গাছপালা, পুকুরের পানি আর রোদের দিকে তাকালেন। যেন দুনিয়ার মালিক মহান আল্লাহপাককে চোখের দৃষ্টিতে অনুভব করলেন তিনি। তারপর যে কোনও মানুষ মুগ্ধ হতে পারে, আকৃষ্ট হতে পারে এমন গলায় বলতে লাগলেন, বুখারী শরীফে হযরত জাবির রাদিআল্লাহু আনহু হইতে বর্ণিত আছে, একবার আমাদের নিকট দিয়া একটি জানাজা অতিক্রম করিল। তাহা দেখিয়া হয়রত রাসুলুল্লাহ সাল্লেল্লাহুআলায়হেওয়াসাল্লাম উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তাহার সহিত আমরাও দাঁড়াইলাম। আমরা তাহাকে বলিলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ্! ইহা তো ইহুদীর লাশ। তিনি বলিলেন যখনই কোনও লাশ দেখিবে, উঠিয়া দাঁড়াইবে। কেন রাসুলুল্লাহ এমন করেছিলেন বলুন তো?

মজনু এবং সোনা মিয়া মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, কেউ কোনও জবাব দিতে পারল না।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব হাসিমুখে বললেন, অর্থাৎ মৃতব্যক্তি যেই হোক সে তো মানুষ! মানুষের লাশকে সম্মান দেখাতে হবে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে একজন লোক মসজিদে অবস্থান করিতেছিল। একদিনু রাসুলুল্লাহ তাহাকে না দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, সে কোথায়? সকলে উত্তর করিলেন, সে মারা গিয়াছে। তিনি বলিলেন, তোমরা আমাকে উহা জানাইলে না কেন? তাঁহারা বলিলেন, আমরা এটাকে সামান্য ব্যাপার বলিয়া মনে করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, তোমরা আমাকে কবরের নিকট লইয়া চল। অতঃপর তিনি সেখানে যাইয়া জানাজার নামাজ পড়িলেন। তিরমিযী শরীফে আছে, সেই শিশুর কোনও জানাজা নাই যে পর্যন্ত সে শ্বাস প্রশ্বাস না ফেলে এবং চিৎকার না করে এবং সে কাহারও উত্তরাধিকারী নহে এবং কেহ তাহার ওয়ারিশ নহে। এছাড়া প্রত্যেকের জানাজা হবে। মান্নান মাওলানা সাহেব ঠিক বলেননি। বুঝলাম যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন তিনি চোর ছিলেন। কী চুরি করতেন? খাদ্যদ্রব্য। পেটের দায়ে একজন অসহায় বয়স্কমানুষ এটা ওটা চুরি করে জীবনধারণ করতাছেন। আপনাদের কথা শুনে বোঝা গেল এলাকার কেউ তাঁকে দুচোখে দেখতে পারত না, শুধুমাত্র এই অপরাধের জন্য। তিনি মিথ্যা বলতেন, কূটনামো করতেন, সবকিছুর মূলে কিন্তু ওই এক সমস্যা। ক্ষুধা, বেঁচে থাকা। যে সমাজ এই ধরনের একজন অসহায় মানুষকে খেতে দিতে পারে না সেই সমাজের কোনও অধিকার নেই তার বিচার করার। তারপরও মৃত ব্যক্তির বিচার করার ক্ষমতা কোনও মানুষের নেই। মৃত্যুর পর যাবতীয় বিচারের ভার। আল্লাহতায়ালার ওপর।

একটু থেমে মাওলানা সাহেব বললেন, যদিও ইসলামী আইনে চুরির সর্বোচ্চ শাস্তি হাতকাটা, কিন্তু তা কখন কার্যকর হবে? এ প্রসঙ্গে বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে হযরত আয়শা রাদিআল্লাহুআনহু হতে বর্ণিত, একদা কোরায়েশ গোত্রের প্রসিদ্ধ মাখজুমী বংশের একজন মহিলা ফাতিমা বিনতে আসাদ ঘটনাচক্রে চুরি করিয়াছিল এবং তাহার মোকদ্দমা রাসুলুল্লার কাছে পেশ হইয়াছিল। এই অভিজাত বংশের মহিলাটির চুরির দায়ে হাতকাটা হইবে এই কথা ভাবিয়া তাহার স্বগোত্রের লোকেরা খুবই বিচলিত হইয়া পড়িল। ফলে তাহারা তাহার শাস্তি রহিত করিবার জন্যে রাসুলুল্লার প্রিয় ব্যক্তি হযরত উসামা রাদিআল্লাহুআনহুর দ্বারা সুপারিশ করাইলেন। এতে রাসলুল্লাহ খুবই অসন্তুষ্ট হইলেন এবং উপস্থিত সাহাবীদের উদ্দেশ্যে একখানা ভাষণ দিলেন। বলিলেন, শরীয়তের শাস্তি কার্যকরী করিবার ব্যাপারে এই ধরনের সুপারিশ বড়ই গর্হিত। ফাতিমা বিনতে আসাদ কেন যদি ফাতিমা বিনতে মুহাম্মদও এই কাজটি করিত তাহা হইলে অবশ্যই আমি তাহার হাত কাটিয়া দিতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন নয়, একেবারেই অন্যরকম। তাছাড়া যিনি চুরি করে জীবন ধারণ করেছিলেন তিনি মৃত।

মাওলানা সাহেব সোনা মিয়ার দিকে তাকালেন। চলুন বাবা, জানাজা পড়ে আসি।

মজনু বলল, আরেকখান কথা আছে হুজুর। না কইলে অন্যায় হইবো। মরণের আগে মাইট্টাতেল খাইছিলো ছনুবুড়ি।

মাওলানা সাহেব আর সোনা মিয়া দুজনেই চমকে উঠলেন।

সোনা মিয়া বলল, কচ কী!

মাওলানা সাহেব বললেন, আত্মহত্যা করেছে?

মজনু বলল, হেইডা আমি কেমতে কমু! তয় মাইনষে কইতাছে পানির তিয়াস লাগছিলো দেইখা পানি মনে কইরা খাইয়া হালাইছে।

ঘটনা বলল মজনু। শুনে মাওলানা সাহেব বললেন, হয়তো ভুল করেই মেটেতেল তিনি খেয়েছেন। আত্মহত্যা কি না আমরা কেউ তা জানি না। যদি আত্মহত্যা হয়ও, বিধান আছে যদি কেহ আত্মহত্যা করিয়া থাকে তবে তাহার গোসল ও নামাজে জানাজা উভয়ই আদায় করা হইবে। তবে রোজ কিয়ামতের দিন আত্মহত্যার শাস্তি বড় ভয়ংকর। বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে, ‘আত্মহত্যাকারী যেভাবে নিজের জীবন সংহার করে, কিয়ামতের দিন তাহাকে সেইভাবেই আযাব দেওয়া হইবে। যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক পাহাড়ের ওপর হইতে পতিত হইয়া আত্মহত্যা করে, তাহাকে দোযখের মধ্যে পাহাড়ের উপর হইতে পতিত করিয়া আযাব দেওয়া হইবে। যে ব্যক্তি বিষপান করিয়া আত্মহত্যা করে, দোযখের মধ্যে তাহাকে অনবরত বিষপান করাইয়া শাস্তি দেওয়া হইবে। যে ব্যক্তি অস্ত্রের সাহায্যে আত্মহত্যা করে, দোযখের মধ্যে তাহাকে পুনঃপুনঃ অন্ত্রের দ্বারা আঘাত করা হইবে।’ বুখারী শরীফে আরও আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লেল্লাহুআলায়হেওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন, এক ব্যক্তি স্বাভাবিক মৃত্যুর পূর্বে আত্মহত্যা করে। অতঃপর আল্লাহতায়ালার তরফ হইতে এরশাদ হইল, হে বান্দা! তুমি নিজের প্রাণ নিজে বিনাশ করিতে অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়াছিলে। অতএব আমি তোমার জন্য বেহেশত হারাম করিয়া দিলাম।

কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব। চলুন যাই।

 ভিতরে ভিতরে অদ্ভুত এক ভাল লাগায় তখন মন ভরে গেছে মজনুর। মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বুদ্ধি করে এখানে এসেছিল বলে এতকিছু জানা হল। ছনুবুড়ির জানাজা, দাফন এখন ঠিকঠাক মতোই হবে। আর নয়তো ভুল ধারণায় অবহেলা করা হত মানুষের লাশ।

মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব আর সোনা মিয়ার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে তাকাচ্ছিল মজনু। সূর্যের আলোয় শীতের আকাশ ভেসে যাচ্ছে, আল্লাহপাকের দুনিয়া ঝকমক ঝকমক করতাছে। গাছপালার বনে ঝিরিঝিরি হাওয়া, শূন্যে উড়ে যায় পাখি। পানির তলা থেকে শ্বাস ফেলতে ভেসে ওঠে মাছ, বিল বাওড়ের উর্বর মাটিতে অংকুরিত হয় শস্যের বীজ, নিরবধিকাল বয়ে যায়, বয়ে যায়। এই সুন্দর দুনিয়া ফেলে কেন যে মরে যায় মানুষ! কেন যে আল্লাহ জীবন দিয়ে পাঠান, কেন যে জীবন ফিরিয়ে নেন, সেই গভীর রহস্যের কথা মানুষ জানে না।

.

১.৩০

আথালের বাইরে মাটির ভুরার (ডিবি) ওপর চারটা গামলা বসান। একেক ভুরাতে একেকটা। ভুরার চারকোণায় চারটা মাঝারি ধরনের মোটা বাঁশের খুঁটি পোতা। খুঁটিগুলি গামলার মাথা ছাড়িয়ে বেশ খানিকদূর উঠেছে। মান্নান মাওলানার বাড়ি তিন শরিকের বড় গিরস্তবাড়ি। পুবে পশ্চিমে লম্বা বাড়ির পশ্চিমের অংশ মান্নান মাওলানার। এই দিকটা সড়কমুখি পড়েছে বলে মান্নান মাওলানার অংশর গুরুত্ব বেশি। বাইরে থেকে দেখে মনে হয় পুরা বাড়িটাই বুঝি মাওলানা সাহেবের। পিছন দিকে যে আরও দুই শরিকের ঘরদুয়ার বড়সড় উঠান পালান আছে, যারা না জানে তারা কেউ তা অনুমানও করে না। তবে সেই দুই শরিকের যার যার সীমানায় বাড়িতে ওঠা নামার রাস্তা আছে বলে মান্নান মাওলানার সীমানায় তাদের কাউকে প্রায় দেখাই যায় না। নিজেদের অংশে, নিজেদের ঘরদুয়ারে থেকেও তারা থাকে চোরের মতো। মান্নান মাওলানা আর তার ছেলে আতাহারের দাপটে টুশব্দ করে না। যেন বাড়িটা তাদের না, যেন মান্নান মাওলানার বাড়িতে আশ্রিত তারা। মান্নান মাওলানার চাকর বাকর। পান থেকে চুন খসলে তাদের কারও আর রক্ষা নাই।

ওই দুই শরিকের কেউ গ্রাম গিরস্থি করে না। একজনের দুইছেলে জাপানে থাকে। জাপানে এখন অঢেল পয়সা। মাসে এক দেড়লাখ টাকা রোজগার করে একেকজন। দেশে নিয়মিত টাকা পাঠায়। সেই টাকায় পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছে তাদের মা বাবা ভাইবোন। কিছুদিন ধরে শোনা যাচ্ছে দেশগ্রামে তারা থাকবেই না। বাড়িঘর যেভাবে আছে পড়ে থাকবে, গরিব আত্মীয়স্বজন কেউ এসে থাকবে, তারা চলে যাবে ঢাকায়। সেখানে যাত্রাবাড়ির ওদিকে জাপানি টাকায় জমি কেনা হয়েছে। সেই জমিতে বাড়িও নাকি উঠছে। বাড়ির কর্তা গনি মিয়া প্রায়ই ঢাকায় গিয়ে সেই বাড়ির তদারক করতাছে। এই তারা গ্রাম ছাড়ল বলে।

অন্য শরিকের নাম মন্তাজ। মন্তাজউদ্দিন। বাড়িতে সে থাকে না। ঢাকায় থেকে সদরঘাটে পুরানা কাপড়ের ব্যবসা করে। স্বাধীনতার আগে এক পাকিস্তানি পুরানা কাপড়ের ব্যবসায়ীর কর্মচারি ছিল। খুব বিশ্বাসী ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও হাতের তালুতে জান নিয়ে মালিকের কাজ করে গেছে। দেশ যখন স্বাধীন হয় হয়, পাকিস্তানিরা যখন বেদম লাথুথি খাওয়া কুত্তার মতো লেজ গুটিয়ে কেঁউ কেঁউ করে পালাচ্ছে তখন মন্তাজের মালিক দোকান আর গুদামের চাবি মন্তাজের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল। তুম হামারা বহুত পুরানা আদমি মন্তাজ, সামহালকে রাখখো।

সামলে মন্তাজ ঠিকই রেখেছিল, তবে মালিক হয়ে। সেই গুদামে একশো চল্লিশ গাইট (গাট) মাল ছিল। আর এতবড় দোকান। বছর ঘুরতে না ঘুরতে কোটিপতি হয়ে গেল মন্তাজ। ঢাকায় এখন দুইখান বাড়ি তার। একটা গেন্ডারিয়ায় আর একটা। ওয়ারিতে। একটা ছয়তালা, একটা চারতলা। পাঁচ ছয়টা নাকি গাড়ি। একেক ছেলেমেয়ের একেকটা। নিজের একটা, বউর একটা।

দেশগ্রামে মন্তাজ তেমন আসে না। সত্তর আশি বছর বয়সের বুড়া মা থাকে বাড়িতে। তার দেখাশোনা করে কোথাকার কোনও দূর সম্পর্কীয় অনাথ আত্মীয়া ফিরোজা। মোল সতের বছরের যুবতী মেয়ে।

মাকে মন্তাজ ঢাকায় নেয় না বউর ডরে। মন্তাজের বউ দুই চোখখে তার শাশুড়িকে দেখতে পারে না। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বার তিনেক ঘোরতর অসুখ হয়েছে মন্তাজের মায়ের। চিকিৎসার জন্য মাকে ঢাকায় নিয়ে গেছে ঠিকই মন্তাজ কিন্তু নিজের বাড়িতে রাখেনি, হাসপাতালে রেখে অসুখ সরিয়ে আবার বাড়িতে দিয়ে গেছে।

নিজে না এলেও মায়ের জন্যে কর্তব্য কাজ যা করার সবই করে মন্তাজ। দোকানের কর্মচারি পাঠিয়ে মায়ের খোঁজ খবর নেয়, টাকা পয়সা, অষুধ বিষুধ পাঠায়। ফল পাকুড় পাঠায়। পাটাতন ঘরের কেবিনের জানালার সামনে সারাদিন শুয়ে থাকে মন্তাজের মা আর বকর বকর করে। কী কথা যে বলে, কেন যে বলে কেউ তা জানে না! সংসার সামলায় ফিরোজা। বুড়ি বকর বকর করে আর ফিরোজা নিঃশব্দে কাজ করে।

দুই শরিকের কারোই গ্রাম গিরস্থি নাই বলে, খেতখোলার ঝামেলা নাই, গাই গরুর ঝামেলা নাই, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিমছাম উঠান পালান। গেরস্থি যা করার করেন মান্নান। মাওলানা। এত খেতখোলা তার, এতগুলি গাইগরু। বাড়িতে ভাত তরকারি যা রান্না হয় সেই ভাতের ফ্যানে, সেই সব তরকারির ছাল বাকলায় এতগুলি গাইগরুর জাবনা হয় না। তিনবেলা ভাত রান্না হয় বাড়িতে তবু চারটা গামলার দুইটাও পুরাপুরি ভরে না। এই একটা কারণে দুই শরিকের লগে একটু খাতির রাখতে হয়েছে মান্নান মাওলানার। গনি মিয়া আর মন্তাজের মায়ের সংসারে বলা আছে ফ্যান আর তরিতরকারির ছালবাকল। যেন বাড়ির বাইরে ফেলে না দেয় তারা। যেন মান্নান মাওলানার আথালের সামনে যে গামলাগুলি আছে সেই গামলায় ফেলে যায়। গাইগরুগুলো তাহলে ভাল খাওয়া দাওয়া করে রাতের ঘুমটা ভাল দিতে পারবে। ভাল খাওয়া, ভাল ঘুম হলে দুধেরগুলি দেদারসে দুধ দিবে সকালবেলা।

চলছেও সেইভাবেই। তিন শরিকের তিনবেলার দ্রব্যে প্রায় ভরে ওঠে চারখান জাবনার গামলা।

সন্ধ্যার আগে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরে গরুগুলি প্রথমে আথালে বাঁধে মাকুন্দা কাশেম। তারপর মাঝারি কণ্ঠে গান গাইতে গাইতে রান্নাঘরে ঢুকে দুইতিন ঠিলা পানি গরম করে। খৈল ভুষি এসব থাকে রান্নাঘরের এক কোণায়, বিশাল দুইখান হাড়িতে। পানি গরম হলে বালতিতে গরম পানি নিয়ে খৈল ভুষি মিশিয়ে দুইটা করে বালতি দুইহাতে ধরে জাবনার গামলায় এনে ঢেলে দেয়।

দিনভর জমা তরিতরকারির ছালবাকল আর ভাতের সাদাফ্যান মিলেমিশে গামলায় তখন অদ্ভুত একটা গন্ধ। গন্ধটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। খৈল ভুষি মিশানো গরম পানি বালতি বালতি পড়ার লগে লগে বদলে যায় সেই গন্ধ। গাইগরুদের ক্ষুধার উদ্রেক করে এমন একটা গন্ধ বেরয় তখন। গন্ধে গরুগুলি হঠাৎ করে যায় দিশাহারা হয়ে। আথালে বান্ধা গলার সামনে তাদের মোটা শক্ত একখান বাঁশ। আথালের এইমাথা থেকে ওইমাথা পর্যন্ত লম্বা। এই একটা বাঁশেই সার ধরে বান্ধা থাকে গরুগুলি। আথাল থেকে গলা বাড়িয়ে দুইটা করে গরু মুখ দিতে পারে একেকটা গামলায়, গামলাগুলি এভাবে রাখা হয়েছে। খৈল ভুষি মিশান গরমপানি গামলায় পড়বার লগে লগে গরুগুলি যায় পাগল হয়ে। দিশাহারা ভঙ্গিতে গামলায় মুখ দেয়, দিয়েই ছটফটা ভঙ্গিতে মুখ সরিয়ে নেয়। হঠাৎ করে গরম পানিতে মুখ দিলে তো এমন হবেই!

প্রতিদিন একই ভুল করে গরুগুলি। দেখে মাকু কাশেম খুব হাসে। বেশ একটা মজা পায়। মন মেজাজ ভাল থাকলে ঠাট্টা মশকরাও করে গরুদের লগে। হালার গরু কি আর এমতেই গৰু অইছে! রোজঐ মুক পোড়ে, রোজঐ মুক দেয়। মাইনষের লগে গরুর তাফাত অইলো এইডাঐ। মাইনষে এক ভুল বারবারে করে না। গরুরা করে।

আর মেজাজ খারাপ থাকলে মুখে যা আসে তাই বলে গরুদের সে বকাবাজি করে। তবে গরুরা ওসব পাত্তা দেয় না। তারা ব্যস্ত থাকে জাবনা নিয়া। কখন মুখ দেওয়ার মতন ঠাণ্ডা হবে জাবনা, কখন খাওয়া যাবে।

আজও তেমন ভঙ্গিতেই অপেক্ষা করতাছে গরুরা। কাশেমও তার কাজ নিয়ম মতনই করে যাচ্ছে। তবে অন্যান্য দিনের তুলনায় কাশেম আজ অন্যরকম। না গান গাইছে না গরুদের লগে ঠাট্টা মশকরা করতাছে, না বাবাজি করতাছে। চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। মান্নান মাওলানা ছিলেন বারবাড়ির দিকে। শীত বিকালের পশ্চিম আকাশে তাকিয়ে সূর্য ডোবার সময়টা দেখতে চাইছিলেন তিনি। খানিক আগে অজু করেছেন। এখনই আজান দেবেন। তারপর বাংলাঘরের চকির উপর, কান্দিপাড়ার ওদিককার কোনও এক মুরিদের সৌদি আরব থেকে এনে দেওয়া পবিত্র কাবা শরীফের চিত্র আঁকা লাল আর সবুজ রঙের। মিশেলে তৈরি মখমলের জায়নামাজে নামাজ পড়তে বসবেন। এ সময় মাথায় সাদা গোলটুপি থাকে তার, হাতে থাকে তসবি। আজান না দিয়ে এ সময় তিনি ভিতর বাড়ির দিকে আসেন না। আজ এলেন। কারণ বারবাড়ির সামনে, নাড়ারপালার সামনে দাঁড়ালেও আথালের দিকে মাকুন্দা কাশেমের সাড়া পান। হয় গান গায় কাশেম না হয় গরুদের লগে কথা বলে। আজ তার কিছুই হচ্ছে না দেখে অবাক হয়ে আথালের সামনে এলেন। পায়ে টায়ারের দোয়াল (বেল্ট) দেওয়া কাঠের খরম। হাঁটলে চটর পটর শব্দ হয়। এখনও হচ্ছিল। সেই শব্দ শুনেও গা করল না কাশেম, নিঃশব্দে নিজের কাজ করতে লাগল। জাবনা দেওয়া হয়ে গেছে, গরম পানির তেজও গেছে কমে। গরুরা মনের আনন্দে খচরমচর শব্দে খেয়ে যাচ্ছে। আথালের অদূরে বসে বড় একখান আইল্লায় (মাটির মালশা) নারিকেল ছোবড়ার আগুন ফুঁ দিয়ে দিয়ে জ্বালাচ্ছে কাশেম। ছোবড়া পুড়ে যখন লাল দগদগে হবে তখন ছিটিয়ে দিবে ধুপ। সাদা ধুমায় আচ্ছন্ন হবে চারদিক, সুন্দর গন্ধ উঠবে, সারাবাড়ি ভরে যাবে সেই গন্ধে।

তবে ধুপটা কাশেম গন্ধের জন্য জ্বালায় না। বহুত মশা হয়েছে বাড়িতে। বাড়ির লোকজনকে তো পায় না, তারা শোয় মশারির ভিতর, মশারা খায় কী! তারা সব এসে পড়ে গুরুগুলির উপর। অবলাজীব, রাতেরবেলা আর ঘুমাতে পারে না। লেজ ঝাপটা দিয়া শুধু মশা খেদায়। এজন্য ধুপ দেয় কাশেম। মোটা লুছনি দিয়ে আইল্লা ধরে আথালে ঢুকে একবার এই মাথায় যায় আরেকবার ওই মাথায়। সাদা ঘন ধুমায় চোখ একেবারেই অন্ধ হয়ে যায় তার। নিজেকেও তখন দেখতে পায় না কাশেম, গরুদেরও দেখতে পায় না। আন্দাজ করে করে হাঁটে। আর ধুপের ধুমায় বেদম আনন্দে ঝোপঝাড় আর কচুরিপানার অন্ধকার থেকে মাত্র বেরিয়ে আসা মশারা তখন গান না ধরে বেদিশা হয়ে পালায়। খুব সহজে এইমুখি আর হয় না। যে বাড়ির আথালে গরু আছে ঠিকই মাকুন্দা কাশেম নাই, ধুপ নাই, তারা তখন সেইমুখি হয়।

কাশেমের অদূরে দাঁড়িয়ে আজ সন্ধ্যায় কাশেমকে খেয়াল করলেন মান্নান মাওলানা। তারপর গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ঐ বেডা কী অইছে তর?

আইল্লায় ফুঁ দিতে দিতে কাশেম বলল, কী অইবো! কিছু অয় নাই।

তাইলে যে এত চুপচাপ!

মন ভাল না।

শুনে মান্নান মাওলানা খিক করে হাসলেন। তর আবার মনও আছেনি?

মুখ বন্ধ করে মাওলানা সাহেবের দিকে তাকাল কাশেম। করুণ মুখ করে বলল, হ ঠিক কইছেন। গরিব মাইনষের আবার মন থাকেনি! চাকর বাকরগো আবার মন থাকেনি!

কচ কী! আরে কচ কী তুই! এই পদের কথা কই হিগলি? এক্কেরে বাইসকোপের লাহান কথা!

আবার আইল্লায় ফুঁ দিতে লাগল কাশেম। ফুঁ দিতে দিতে বলল, আপনের আয়জানের সমায় অইয়া গেছে হুজুর। যান আয়জান দেন গা, নমজ পড়েন গা।

মান্নান মাওলানা খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন। আমি কী করুম না করুম হেইডা তর চিন্তা করনের কাম নাই। তর কী অইছে ক।

ছনুবুড়ির লাশ দেহনের পর থিকা মন ভাল না। খালি মউতের কথা মনে অয়।

ছনু নামটা শোনার লগে লগে একত্রে অনেকগুলি প্রশ্ন মনে উদয় হল মান্নান মাওলানার। সকালবেলা ছনুবুড়ির মৃত্যুর কথা শোনার পর হলদিয়া চলে গিয়েছিলেন। হলদিয়া বাজারের পুবদিকের এক বাড়িতে বড়মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সেই মেয়ের ঘরের মাজারো নাতির ফ্যারা (হাম) উঠছে। কাজির পাগলা বাজার থেকে নাতির জন্য গান্ধী ঘোষের রসগোল্লা নিয়ে গিয়েছিলেন। আথকা বাপকে দেখে মেয়ে আর জামাই দুইজনেই গেছে দিশাহারা হয়ে। ছেলের অসুখ ভুলে বাপ নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে একজন, শশুর নিয়ে ব্যস্ত হয়েছে একজন। মোরগ জবাই করে, চিনিগুড়া চাউলের পোলাও, ঘন দুধ, গান্ধী ঘোষের রসগোল্লা, বেদম একখান খাওয়া হয়েছে। সেই খাওয়া খেয়ে, দুপুরে ঘুম দিয়ে খানিক আগে বাড়ি ফিরেছেন মান্নান মাওলানা। ছনুবুড়ির লাশের কী হল সেসব আর জানা হয়নি। মজনুকে বলে দিয়েছিলেন ছনুবুড়ির জানাজা হবে না, মাটি হবে না। লাশটা ওরা কোথায় ফেলল!

মান্নান মাওলানা বললেন, ঐ কাইশ্যা, চুন্নির লাচ কী করতাছে রে? পদ্মায় নিয়া হালাইছে না মড়কখোলায়?

কাশেম যেন আকাশ থেকে পড়ল। গাঙ্গে হালাইবো ক্যা, মড়কখোলায় হালাইবো ক্যা?

তয় কী করতাছে?

গোড় দিছে।

কই?

গোরস্থানে।

কচ কী?

 হ।

জানাজা ছাড়াঐ গোড় দিছে?

জানাজা ছাড়া দিবো ক্যা? মানুষ মরণের পর যা যা করে ছনুবুড়িরেও তা তা কইরা গোড় দিছে।

জানাজা পড়াইলো কে?

খাইগো বাড়ির হুজুরে। মজনু গিয়া তারে ডাইক্কা লইয়াইছে। হুজুর নিজে বইয়া থাইক্কা বেবাক নিয়ম কানন কইয়া দিল। হুজুরের কথা মতন আলার মা বুজানে আরও দুই তিনজন মাইয়ালোক লইয়া ছনুবুড়িরে নাওয়াইলো, কাফোন ফিন্দাইলো। বাড়ির নামায় লাচ রাইক্কা জানাজা পরলো হুজুরে। তারবাদে নিজে লাচ কান্দেও লইলো। বড় মেন্দাবাড়ির লাম্বা সোনা মিয়ায় আছিলো তার লগে। ভাল মানুষ অইছিলো জানাজায়। আমিও গেছিলাম।

এমনিতেই তাঁর কথা অমান্য করে খান বাড়ির মসজিদের ইমামকে এনে জানাজা পড়ান হয়েছে ছনুবুড়ির, ইমাম সাহেব নিজে গেছেন গোরস্থানে, লাশ কাঁধে নিয়েছেন শুনে রাগে ভিতরে ভিতরে ফেটে যাচ্ছিলেন মান্নান মাওলানা। তার ওপর তার বাড়ির গোমস্তা গেছে সেই জানাজায়, এটা তিনি আর সহ্য করতে পারলেন না। হঠাৎ করেই কাশেমের কোকসা বরাবর জোরে একটা লাথথি মারলেন। আচমকা এমন লাথথি, হুড়মুড় করে আইল্লার ওপর পড়ল কাশেম। নিজের ফুঁ দিয়ে জ্বালানো আগুন মুখের একটা দিকে লাগল তার। লগে লগে বাবাগো বলে লাফিয়ে উঠল কাশেম। তার পা হাতে লেগে আইল্লার আগুন ছড়িয়ে পড়ল আধালের সামনের মাটিতে। মান্নান মাওলানা সেসব পাত্তা দিলেন না। পা থেকে পরম খুলে শরীরের সব শক্তি দিয়ে পিটাতে লাগলেন কাশেমকে। অবলা জীবের মতন মার খেতে খেতে, ঙো ঙো করে কাঁদতে কাঁদতে কাশেম তখন একটা কথাই বলছে, আমারে মারেন ক্যা, আমি কী করছি! ওরে বাবারে, ওরে বাবারে। মাইরা হালাইলোরে, আমারে মাইরা হালাইলো!

কাশেমকে সমানে পিটাচ্ছেন বলে কোন ফাঁকে মান্নান মাওলানার মাথার টুপি খুলে পড়ে গেছে মাটিতে, হাতের তসবি পড়ে গেছে সেসবের কোনও দিকেই তার খেয়াল নাই। কাশেমকে পিটাতে পিটাতে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি তখন বলছেন, চুতমারানির পো, কাম করো আমার বাইত্তে, খাও আমারডা, জানাজা পড়তে যাও আমার কথা ছাড়া! যেই জানাজা অইব না, যেই জানাজায় আমি যাই নাই ঐ জানাজায় আমার বাড়ির চাকর যায় কেমতে! তুই আমার বাইত থিকা বাইর অ শুয়োরেরবাচ্চা। তর লাহান বেঈমান আমি রাখুম না।

পিটাতে পিটাতে কাশেমকে তখন বারবাড়ির দিকে নিয়া আসছেন মান্নান মাওলানা। বাড়ির নামার দিককার রাস্তার মুখে এনে এমন একখান লাথি মারলেন, সেই লাথথিতে কাশেম গড়িয়ে পড়ল বাড়ির নামায়। তখনও গোঙাচ্ছে। নাকমুখ দিয়ে দরদর করে পড়ছে রক্ত। রক্তে কান্নায় মাকুন্দা মুখটা গেছে বীভৎস হয়ে। এই মুখের দিকে একবারও তাকালেন না মান্নান মাওলানা। আগের মতোই দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলেন, আমার বাইত্তে তর আর জাগা নাই। এই তরে বাইর করলাম, আমার বাইত্তে তুই আর ঢুকবি না। আমি সব দেকতে পারি, বেঈমান দেকতে পারি না।

খান বাড়ির মসজিদ থেকে তখন ভেসে আসছিল মাগরিবের আজান। সেই পবিত্র সুরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল একজন অসহায় মানুষের কান্না। পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছিল দিনশেষের অন্ধকার। দুনিয়াদারি মৌন হচ্ছিল গভীর বেদনায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *