১.০৬-১০ রান্নাচালার সামনে

১.০৬

রান্নাচালার সামনে আমকাঠের সিঁড়ি পেতে বসেছে মজনু। সকাল বেলার রোদ পাকা ডালিমের মতো ফেটে পড়েছে চারদিকে। এই রোদের একটা টুকরা ছিটকে এসে পড়েছে মজনুর ছোটখালা মরনির মুখের একপাশে। মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেছে তার। মজনু অপলক চোখে তাকিয়ে আছে খালার মুখের দিকে। দুনিয়াতে এই একটা মাত্র মুখ যে মুখের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারে সে। আর কিছুর দরকার হয় না।

মাটির খোলায় মরনি এখন চিতইপিঠা ভাজছে। চুলার ভিতর চুটপুট চুটপুট করে জ্বলছে নাড়ার আগুন। রোদ নাড়ার আগুন মিলেমিশে হেমন্ত সকালের শীতভাব বিদায় করে দিয়েছে। রান্নাচালার চারপাশে বেশ একটা আরামদায়ক ভাব। লগে আছে চিতইপিঠা ভাজার গন্ধ। সব মিলিয়ে ভারি সুন্দর পরিবেশ। এই পরিবেশের কিছুই উদিস পাচ্ছে না মজনু। সে তাকিয়ে আছে খালার মুখের দিকে।

খোলা থেকে লোহার চটায় যত্ন করে প্রথম পিঠাটা তুলল মরনি। হাতের কাছে রাখা ছোট্ট বেতের ডালায় পিঠা নিয়ে মজনুর দিকে এগিয়ে দিল। নে বাজান খা। চিতই। পিডা গরম গরম না খাইলে সাদ (স্বাদ) লাগে না।

কথা বলতে বলতে মজনুর দিকে তাকিয়েছে মরনি, তাকিয়ে দেখে মজনু একদৃষ্টে চোখে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। মরনি অবাক হল। কীরে, এমতে চাইয়া রইছস ক্যা?

মজনু চোখ নামাল, দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এমতেঐ। অনেকদিন তোমারে দেহি না তো, ইট্টু দেকলাম।

একথায় মরনির বুকের ভিতর উথাল দিয়ে ওঠে মায়ের আদর। সে যে মজনুর মা না, খালা একথা তার মনে থাকে না। ডানহাত বাড়িয়ে মা যেমন কখনও কখনও তার সন্তানকে আদর করে ঠিক সেই ভঙ্গিতে মজনুর গালে মুখে একটা হাত বুলাল। আমিও তো তরে দেহি না বাজান। আমিও তো তর মুখটা কতদিন দেহি না। তরে না দেইক্কা এতদিন আমি কোনওদিন থাকি নাই।

আমি থাকছি?

না তুইই বা থাকবি কই থিকা! তর মায় মইরা যাওনের পরঐত্তো তরে আমি কুলে কইরা লইয়াইলাম। তারপর থিকা তুই আমার পোলা। আইজ সতরো আঠরো বচ্ছর তরে আমি চোখখের আঐল (আড়াল) করি নাই।

একথায় অদ্ভুত এক অভিমানে বুক ভরে গেল মজনুর। মুখ গোমড়া করে বলল, তাইলে অহন করছো ক্যান? ক্যান আমারে খলিফা (দর্জি) কামে দিলা? ক্যান আমারে টাউনে পাডাইলা?

মরনি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। খাদা (মাটির যে পাত্র ভাতের ফ্যান ঢালার কাজে ব্যবহৃত হয়) থেকে পাতলা করে গোলানো চাউলবাটা নারকেলের আইচায় (মালা) তৈরি হাতায় পরিমাণ মতো তুলে যত্ন করে ঢালল গরম খোলায়। লগে লগে ফুলে ফেপে চিতইপিঠার আকার ধরল জিনিসটা। মজনুর মুখের দিকে আর তাকাল না মরনি। অসহায় গলায় বলল, না পাডাইয়া কী করুম ক! তুই বড় অইছস না? কাম কাইজ হিগবি না? নাইলে খাবি কী কইরা?

এতদিন খাইছি কী কইরা? তুমি কি আমারে কুনোদিন না খাওয়াইয়া রাখছো?

না রাখি নাই। নিজে না খাইয়া রইছি, তরে রাখি নাই। সংসারের অভাব তরে বোঝতে দেই নাই।

তারপরই মরনির খেয়াল হল ডালায় তোলা পিঠা ঠাণ্ডা হচ্ছে। মজনু এখনও মুখে দেয়নি। চঞ্চল হল সে। কীরে খাচ না? ঠাণ্ডা অইলে ভাল্লাগবো না। তাড়াতাড়ি খা। আরেকখান পিডা অইয়া গেল। কুনসুম (কোন সময়) খাবি?

ডালা থেকে পিঠা তুলে কামড় দিল মজনু। নিজে না খাইয়া থাইক্কা আমারে যে তুমি খাওয়াইতা এইডা কইলাম আমি জানতাম খালা।

মজনুর কথায় চমকে উঠল মরনি। কেমতে জানতি?

আমি দেকছি না। কোনও কোনওদিন দোফরে কোনও কোনওদিন রাইত্রে আমারে ভাত দিয়া তুমি সামনে বইয়া থাকতা। আমি জিগাইতাম, ও খালা তুমি খাইবা না? দোফর অইলে তুমি কইতা আমি অহনতরি (এখন পর্যন্ত) নাই (গোসল। স্নান) নাই। না নাইয়া ভাত খাওন যায়! তুই পোলাপান মানুষ, তর খিদা লাগছে না? তরে খাওয়াইয়া নাইতে যামু আমি, তারবাদে খামুনে। তুই খাইয়া ল। আমি কইলাম বোঝতাম, যেডু (যতটুকু) ভাত তুমি রানছো, অডু (অতটুকু) ভাতে আমগো দুইজনের অইবো না। নিজে না খাইয়া, আমি যেন রাইতে খাইতে পারি এর লেইগা দুইফইরা ভাত তুমি রাইক্কা দিতা।

মজনু আবার পিঠায় কামড় দিল। আরেকটা পিঠা তখনই খোলা থেকে নামাল মরনি। মজনু তা খেয়াল করল না। পিঠা মুখে বলে স্বর জড়িয়ে যাবে জেনেও বলল, রাইতে দেকতাম আমার ভাত শেষ তাও তুমি খাইতে বহো না। এইমিহি চাও, ঐমিহি চাও, টুকুর টাকুর কাম কর। আমি জিগাই, ও খালা ভাত খাও না ক্যা? তুমি কইতা, তুই খাইয়া হুইয়া পর। আমি খাইয়া দাইয়া থাল বাসন ধুইয়া হুমুনে। ঘুমা, তুই ঘুমা বাজান। আমি হুইয়া পরতাম তয় ঘুমাইতাম না। তুমি মনে করতা আমি ঘুমাইয়া গেছি। আমি কইলাম ঘুমাইতাম না। কুপির আলোয় তোমারে দেকতাম হইলদা রঙ্গের একখান মগে কইরা ঢুকুস ঢুকুস কইরা পানি খাও। তারবাদে কুপি নিবাইয়া আমার পাশে হুইয়া একখান নিয়াস (দীর্ঘশ্বাস) ছাড়তা। খালাগো, ঐ নিয়াসটা আমার বুকে আইয়া লাগতো। আমি বোজতাম হারাদিন তুমি না খাইয়া রইছো। দোফরে খাও নাই, রাইতে খাও নাই। ভাদ্দর আশ্বিন মাসে কয়দিন পর পরঐ ভাত খাওন লইয়া আমার লগে এমন চালাকি করতা তুমি।

খোলায় আবার পিঠা দিল মরনি। চালাকি না বাজান। আমি না খাইয়া রইছি দেকলে তুই খাইতে চাবি না, তর ভাত আমারে ভাগ কইরা দিবি। দোফরে ভাত খাইয়া পেড না ভরলে হারাডা বিয়াল তুই ছটফট ছটফট করবি, রাইতে পেড না ভরলে ঘুমাইতে পারবি না, এর লেইগা তরে বোজতে দিতাম না। ভাদ্দর আশ্বিন মাসে দেশ গেরামে আকাল লাগে। আমগো লাহান গরিব গিরস্ত ঘরের ধান চাউল ফুরাইয়া যায়। একটা দুইডা মাস বড় কষ্ট যায় গিরস্তের। কাতি আগন মাসে হেই কষ্ট আর থাকে না। তহন ধান কাডা লাগে। বাড়ির উডান কাডা ধানে ভইরা যায়, ডোল (গোলা) ভইরা যায়।

তারপরই মজনুকে আবার তাড়া দিল মরনি। কীরে এত আস্তে আস্তে খাইতাছস ক্যা? মাত্র একখান পিডা শেষ করছস!

মজনু বলল, এই পিডাডা তুমি খাও। পরেরডা আমি খামুনে।

আমি খামু না বাজান।

ক্যা?

পিডা অইবো সাত আষ্টখান। অহন যেই কয়ডা পারছ তুই খাবি, যেই কয়ডা থাকবো দোফরে খাবি।

দোফরে ভাত খামু না?

না। একখান কুকুরার ছাও (মুরগির বাচ্চা)বাইন্দা থুইছি। তর পিডা খাওয়া অইলে জব কইরা দিছ। ভাল কইরা কসাইয়া দিমু। গরম গরম কসাইন্না গোস্ত দিয়া চিতইপিডা তুই খুব পছন্দ করছ। তর আহনের কথা হুইন্না এই ছাওডা আমি ঠিক কইরা রাকছি। খা।

আগে কখনও এমন হত না। আগেও কোনও কোনওদিন এমন করেই কথা বলত মরনি। মজনু ছোট ছিল, সারাক্ষণ ছিল খালার আঁচলের তলায়, চোখের সামনে। খালা যে গভীর মমতার গলায় প্রতিটি কথা বলে মজনু কখনও তা খেয়াল করত না। চারমাস খালাকে ছেড়ে আছে। দূরে থাকার ফলে, এতদিন পর, কাল বিকালে ফিরে আসার পর খালার প্রতিটা কথায়, প্রতিটা আচরণে বুকের ভিতর কেমন করে উঠছে মজনুর, চোখ ছলছল করে উঠছে। এখনও উঠল। এই চোখ খালাকে সে দেখতে দিল না। অন্যদিকে মুখ ঘুরাল।

মরনি বলল, এই বচ্ছর ধানপান ভাল অয় নাই। যতদিন যাইতাছে খেতের ধান কমছে। তরে খলিফা কামে দিয়া ভালঐ করছি। নাইলে তিন ওক্ত (বেলা) তরে আমি কী খাওয়াইতাম? কেমনে বাচাইয়া রাখতাম তরে!

মজনু ভুলে গেল আগের দিনের মতো, ভাদ্র আশ্বিন মাসের অভাবী দিনের মতো আজ সকালেও নিজে না খেয়ে মজনু দুপুরে খাবে বলে চিতইপিঠা তুলে রাখছে খালা। পরের পিঠাটা খেতে খেতে সে বলল, ক্যা, নিজেগো জমিন নিজে চুইতাম (চাষ করতাম) আমি! বিলে চৌদ্দগণ্ডা জমিন আমগো। বর্গা না দিয়া নিজে চুইলে (চষলে) যেই ধান পাইতাম নিজেরা বচ্ছর খাইয়াও বেচতে পারতাম। হেই টেকায় তোমার একজোড়া কাপোড় অইতো। আর লুঙ্গি পিরন অইতো। মাছ তরকারির তো আকাল নাই দেশ গেরামে। খালে পুকঐরে ম্যালা মাছ। হেই মাছ ধরতাম আমি। খেতখোলা থিকা সেচিশাক, কলমিশাক টোকাইয়া আনতা তুমি। বাড়ির নামায় কদু কোমর বাইগন বিলাতিবাইগন (টমেটো) সব সময়ঐত্তো বোনো তুমি। ধান ওডনের পর সউষ্যা (সরিষা) বোনতাম যেতে। বচ্ছরের তেলডা অইয়া যাইতো। বাইত্তে চাইরখান খাজুরগাছ। গাছি মামায় গাছ ঝুইড়া যেই রস দেয়, বচ্ছরের মিডাই অইয়া যায়। কিননের মইদ্যে কিনতে অইতো খালি নুন। নুন বহুত হস্তা জিনিস। দুইজন মাইনষের কয় টেকার নুন লাগে বচ্ছরে?

মজনুর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল মরনি। গিরস্তালি করা বহুত কষ্টের বাজান। এত কষ্ট তুই করতে পারতি না।

ক্যান পারুম না? আমি বড় অইছি না?

কত বড় আর অইছস!

আঠরো বচ্ছর বয়স অইছে, কম মনে করোনি তুমি?

খোলা থেকে আরেকটা পিঠা নামাল মরনি। নীল রঙের ময়লা নোংরা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছল। চুলার পারে বসলে শীতকালেও মুখে গলায় ঘাম জমে। সেই ঘাম মুছল মরনি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। হ তর বয়স পুরা আঠরো বচ্ছর। কোন ফাঁকে যে দিন গেলগা উদিস পাইলাম না। আমার খালি মনে অয় এই তো হেদিনকার কথা। তর মার বিয়ার আষ্ট মাস পর আমার বিয়া অইলো। আমি খালি এই সংসারে আইছি, তর মার আহুজ পড়বো (বাচ্চা হবে)। তগো বাইত্তে গেলাম বুজির লগে থাকনের লেইগা। আহুজ পড়নের সমায় দেশ গেরামের বউঝিরা বাপের বাইত্তে আহে, মা বইনের কাছে থাকে। আমগো তো মা বাপ আছিলো না, ভাই আছিলো না। তিন বইন আমরা মামাগো সংসারে বড় অইছি। আমি যহন খুব ছোড তহন বড়বুজির বিয়া অইছে। জামাই থাকে ফরিদপুর। বড়বুজি ফরিদপুর গেল গা। পাঁচছয় বচ্ছরে একবার নাইওর আইতো। তর মায় মরণের আগে, আমার বিয়ার সমায় বড়বুজিরে শেষ দেখছি। তার বাদে হে আর আহে নাই। তর মার মরণের সমবাদ পাইয়াও আহে নাই।

কথা বলতে বলতে উদাস হয়ে গেল মরনি। খোলায় শেষ পিঠা বসিয়েছে। এখন পিঠার দিকেও খেয়াল নাই।

রান্নাচালার পিছনে ঝাপড়ানো একটা জামগাছ। সকালবেলার রোদে চকচক করছে জামপাতা। একটা টুনটুনি পাখি লাফাচ্ছে গাছের ডালে। এই ডাল থেকে ওই ডালে যায় টুনটুনি, ওই ডাল থেকে সেই ডালে। জামগাছটার দিকে তাকায় মরনি ঠিকই পাখিটা দেখেও দেখে না। মনের ভিতর অতীত দিনের স্মৃতি। চোখ জুড়ে অতীত দিনের প্রিয় মানুষের মুখ।

উদাসীন গলায় মরনি বলল, বড়বুজির চেহারাডাও অহন আর মনে নাই। তর মায় মইরা সইরা গেছে, বড়বুজি বাইচ্চা থাইক্কাও সইরা গেছে। হেয়ও অহন মরা। তিন বইন একলগে গলা প্যাচাপেচি কইরা বড় অইছিলাম, দিন গেল, তিনজন তিনমিহি সইরা গেলাম। একজন মইরা সরলো আর দুইজন বাইচ্চা। আতকা বড়বুজিরে দেকলে আমি মনে অয় হেরে অহন চিনতে পারুম না। হেয়ও চিনতে পারবো না আমারে। সমায় এমুন কইরা আপনা মাইনষেরে পর বানাইয়া দেয়, অচিন বানাইয়া দেয়!

তিনখান পিঠা খেয়ে টিনের গেলাসে ঢক ঢক করে এক গেলাস পানি খেল মজনু। শেষ পিঠাটা তখনই খোলা থেকে নামাল মরনি। দেখে মজনুর মনে পড়ল সকালবেলা এখনও কিছু মুখে দেয়নি খালা। পিঠা ভেজে তাকে খাওয়াচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে গল্প করছে। তিনখান পিঠা খেয়ে তার পেট ঢোল আর খালা এখনও খালি পেটে। ব্যস্ত গলায় মজনু বলল, তুমি দিহি কিছু খাইলা না?

মরনি হাসল। বিয়ানে আমার কিছু খাইতে ইচ্ছা করে না। খিদা লাগে না।

আমার লগে মিছাকথা কইয়ো না খালা। বিয়ানে মাইনষের খিদা না লাইগ্যা পারে?

পারে বাজান, পারে। বহুদিন পর ঘরের পোলা ঘরে ফিরা আইলে মার পেড এমতেঐ ভইরা থাকে। বিয়ানে দোফরে রাইত্রে কিছু না খাইলেও খিদা লাগে না। এতদিন পর তুই যে আমার সামনে বইয়া খাইলি এইয়া দেইক্কাই আমার খাওয়া অইয়া গেছে। পেড ভইরা গেছে।

মরনির কথা শুনে আবার চোখ ছলছল করে উঠল মজনুর। আবার অন্যদিকে মুখ ফিরাল সে। এই ফাঁকে চুলার জ্বাল নিভিয়ে জিনিসপত্র গোছগাছ করতে লাগল মরনি। পিঠাগুলি মাটির বাসনে রাখতে রাখতে বলল, আফাজদ্দি খলিফা মানুষ কেমুন?

মজনু কথা বলল না। খালার দিকে তাকালও না। যেমন অন্যদিকে তাকিয়েছিল তাকিয়ে রইল।

মরনি অবাক হল। মজনুর কাঁধের কাছে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে বলল, কী অইলো বাজান, কথা কচ না ক্যা? ব্যাজার অইছস ক্যা?

এবার খালার দিকে মুখ ফিরাল মজনু। ছলছল চোখে অবুঝ গলায় বলল, অমু না? ব্যাজার অমু না? অহনও কি ভাদ্দর আশ্বিন মাস? অহনও কি আমি ছোডঃ?

হায়রে পাগল পোলা, আমারে তুই কী করতে কচ?

আমার সামনে বইয়া পিডা খাইবা তুমি। অহনে খাইবা, দোফরে খাইবা। রাইত্রে আমার লগে বইয়া ভাত খাইবা। আমি যতদিন দেশে থাকুম আমার লগে বইয়াঐ তিন ওক্ত খাওন লাগবো তোমার। যুদি না খাও আমিও খামু না। আমি ঢাকা যামু গা।

মরনি কথা বলে না। অদ্ভুত চোখ করে মজনুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হাত বাড়িয়ে খালার একটা হাত ধরল মজনু। চাইর মাসে খলিফা কাম আমি ভালঐ হিগছি। হাতের কাম পুরাপুরি হিগছি, কাটিংও হিগছি কয়খান। ফিরা গিয়া মিশিনে বমু। আফাজ মামায় কইছিলো আর দুই মাস পর বাইত্তে যা, তহন তুই পুরা খলিফা অইয়া যাবি। অহন তো থাকন খাওন বাদ দিয়া দুইশো টেকা পাছ, দুই মাস বাদে পাবি চাইরশো। একবারে কিছু টেকা লইয়া খালার লগে দেহা করতে যাই। আমি কইলাম, না আমি অহন যামু। খালারে এতদিন না দেইক্কা আমি কোনওদিন থাকি নাই। মিশিনে বহনের আগে খালার মুখখানা ইট্টু দেইক্কাহি (দেখে আসি)।

মজনুর কথা শুনতে শুনতে শেষদিকে দিশাহারা হয়ে গেল মরনি। গভীর আনন্দের গলায় প্রায় চিৎকার করে উঠল। তর মায়না অইছে বাজান, অ্যা? দুইশো টেকা মায়না অইছে? কবে থিকা মায়না অইছে? কাইল বিয়ালে বাইত্তে আইলি, একটা রাইত গেল, তুই দিহি আমারে কিছু কইলি না?

মজনু নির্মল মুখ করে হাসল। তোমারে দেইক্কা আমার আর কিছু মনে আছিলো না খালা। সন্দা অইতে না অইতে ভাত খাইয়া তোমার কুলের কাছে হুইয়া ঘুমাইয়া গেলাম। হারা রাইত আর উদিস পাইলাম না। বিয়ানে উইট্টা মনে অইলো চাইর মাস বাদে ঘুমাইলাম। কাইল সন্দায় তোমার সামনে বইয়া ভাত খাইয়াও মনে অইলো চাইর মাস বাদে ভাত খাইলাম।

যে রকম আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়েছিল মরনির এখন ঠিক সেই ভঙ্গিতেই ম্লান হল। ক্যা রে বাজান? আফাজদ্দি খলিফা তরে হুইতে দেয় না, খাইতে দেয় না? এর লেইগা তুই এমন কাহিল হইয়া গেছচ, হুগাইয়া (শুকিয়ে) গেছচ!

কেডা কইলো আমি হুগাইছি! তোমার চোক্কে তো আমি সব সমায়ঐ হুগনা। হোনো, খলিফা কাম করতে অয় রাইত দোফর পইরযন্ত। রাইত দোফরে হুইয়া ওটতে অয় ফয়জরের আয়জানের লগে লগে। এক মাতারি (মহিলা) বাসা থিকা ভাত রাইন্দা আইন্না বেবাক কর্মচারিগো খাওয়ায়। গুড়াগাড়ি (ছোট ছোট) মাছ আর ডাইল। রান্দন যে মাইনষের এত খারাপ অইতে পারে, ইস কী কমু তোমারে! মুখে দেওন যায় না।

তাইলে ঐ মাতারির রান্দন খাচ ক্যা?

কী করুম, বেবাকতে খায়! আফাজ মামার ঠিক করা মাতারি, হে খাওনের টেকা দেয়, তার ইচ্ছায়ঐত্তো খাওন লাগবো! খলিফা কামে পয়লা পয়লা থাকন খাওন খারাপঐ অয়। ছোট্ট একখান ঘরে চিপাচিপি (গাদাগাদি) কইরা হুইতে অয় দশ বারোজন মাইনষের। ওমনে হুইলে ঘুম আহে, কও! তয় খলিফা অইতে পারলে আইজ কাইল লাব আছে। টাউনে বিরাট বিরাট গারমেন হইতাছে। তিন চাইর হাজার টেকা এহেকজন খলিফার মায়না। দুইয়েক বচ্ছর বাদে আমিও ঐরকম গারমেনে চাকরি লমু! তহন বড় খলিফা অইয়া যামু।

গারমেন কী রে বাজান?

জামা কাপোড়ের কারখানা। এইদেশ থিকা জামা কাপোড় বানাইয়া লন্ডন আমরিকায় পাড়ায়।

একটু থেমে মজনু বলল, গারমেনে চাকরি লইয়াঐ টাউনে একখান বাসা ভাড়া লমু। তোমারে লইয়া যামু। তহন তোমার আর এত কষ্ট করন লাগবো না। অহনও কোনও চিন্তা তুমি কইরো না। পয়লা তিনমাস পেডেভাতে কাম হিগছি। একমাস ধইরা দুইশো টেকা মায়না পাই। পনচাস টেকা আমার পকেট খরচার লেইগা রাইক্কা দেশশো টেকা কইরা মাসে তোমারে পাডামু। কহেক মাস বাদে যহন চাইরশো টেকা মায়না অইবো তহন পাডামু তিনশো কইরা। এইদিন থাকবো না খালা, দিন বদলাইবো।

কথা বলতে বলতে শার্টের বুক পকেট বরাবর একটা বোতাম খুলল মজনু, বুকে হাত দিল। মরনি অবাক হয়ে মজনুর দিকে তাকাল। কী অইলো বাজান, পিপড়ায় কামোড় দিছে?

মজনু হাসল। না, শাডের ভিতরে একখান জেব (পকেট) আছে। টেকা পয়সা হেই জেবে রাখি।

হাত বের করল মজনু। হাতে অনেকগুলি কড়কড়া দশ টাকার নোট। এত টাকা মজনুর হাতে দেখে অবাক হয়ে গেল মরনি। টাকার দিকে তাকিয়ে রইল।

মজনু বলল, আমার পয়লা মাসের মায়নার টেকা। লঞ্চ ভাড়া দিয়া একশো ষাইট টেকা আছে। নেও ধরো।

তখনও অবাক ভাব কাটেনি মরনির। ঘোর লাগা ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। কোন ফাঁকে চোখ ভরে গেছে পানিতে, টের পায়নি। গাল বেয়ে চোখের পানি নামল মরনির। তবু মুখখানা হাসিমাখা। একহাতে চোখের পানি মুছে টাকাটা সে একবার বুকে ছোঁয়ায়, একবার কপালে। মুখে কথা নাই।

খালার এই অবস্থা দেখে মুগ্ধ হল মজনু। বলল, চাইছিলাম শতেকখানি টেকা দিয়া তোমার লেইগা একখান কাপোড় কিন্না আনি। পরে মনে করলাম টেকাডাঐ আইন্না তোমার হাতে দেই। আমার পয়লা রুজি দেইক্কা খুশি অইবা তুমি। ও খালা, খুশি অও নাই, খুশি অও নাই তুমি?

আবার চোখ ভরে পানি এল মরনির। তবে মুখে আনন্দের হাসিখানা লেগেই আছে। ঠেলে ওঠা কান্না বুকে চেপে বলল, বহুত খুশি অইছি, বহুত খুশি অইছি বাজান। পোলার পয়লা রুজির টেকা হাতে লইছি, আমার থিকা সুখি মা আর কে আছে দুইন্নাইতে। এই টেকা থিকা পাচটেকার সিন্নি দিমু খাইগো বাড়ির মজজিদে (মসজিদ)। মুন্সি সাবরে দিয়া মলুদ শরিফ (মিলাদ) পড়ামু। আল্লায় যে আমার মনের আশা পূরণ করছে, আল্লার কাছে হাজার শুকরিয়া, লাক লাক শুকরিয়া।

একহাতে মজনুর মাথাটা বুকের কাছে টেনে আনল মরনি। তরে ছাইড়া থাকতে কেমুন কষ্ট যে আমার অয়, বাজানরে, আল্লা ছাড়া কেঐ জানে না। খাইতে বইলে মনে অয়, তুই ভাত খাইছসনি! ঘুমাইতে গেলে মনে হয়, তুই কেমতে হুইয়া রইছস, কেমতে ঘুমাইছস! আমার রাইত কাইট্টা যায় তর কথা চিন্তা কইরা। খালি মনে অয় আমার বুকের মানিক কই পইড়া রইছে আর আমি কই। তর কষ্টে আমার বুক ফাইট্টা যায় বাজান।

খালার বুকের কাছে মুখ রেখে মজনু বলল, আমারও তোমার মতনঐ অয় খালা। আমারও তোমার লেইগা মনডা কান্দে। তোমার মুকহান দেহনের লেইগা মন ছুইট্টা যায়।

তরে আমি খলিফা কামে ক্যান দিছি জানচ! ক্যান আমগো গেরামের আফাজদ্দি খলিফা দেশে আহনের পর তারে গিয়া কইছিলাম, আমার পোলাডারে আপনের কাছে লইয়া যান, অরে কাম হিগান, খলিফা বানান।

ক্যান কইছিলা খালা?

তর মায় মরণের পর থিকা তুই আমার কাছে। তরে আমি মাডিতে হোয়াই নাই পিপড়ার ডরে, মাথায় রাখি নাই উকুনের ডরে। তবে আমি রাখছি আমার বুকে। হেই বুকের ধন দূরে ঠেইল্লা দিলাম খালি একখান্ কথা চিন্তা কইরা। খেতখোলার কাম, গিরস্তালি তুই করতে পারবি না। তর শইল্লে কুলাইবো না। তুই এমুন একখান কাম হিগবি, জীবন ভইরা এমুন একখান কম করবি, যেই কাম সোন্দর কাম। হাত পায়ে প্যাককেদা লাগে না, কহর পড়ে না। যেই কাম ভাল কাপোড় জামা ফিন্দা করন যায়। যেই কাম অন্য মাইনষেরেও সোন্দর করে। অন্য মাইনষের শইল্লে বসন তুইল্লা দেয়। ঢাকা থিকা ভাল জামা কাপোড় ফিন্দা যে কোনও মানুষ ফিরত আইলে তারে দেইক্কা য্যান তর কথা মনে অয় আমার। য্যান মনে অয় এই জামা কাপোড় আমার মজনুর হাতে বানানো, আমার বাজানের হাতের পরশ আছে দেশের বেবাক সোন্দর সোন্দার জামা কাপোড়ে।

মজনু মুগ্ধ গলায় বলল, আমি তোমার মনের আশা পূরণ করুম খালা। দেইখো আমি ঠিকঐ বড় খলিফা অমু।

ডালা থেকে একটা পিঠা নিল মজনু। খালার মুখের সামনে ধরে বলল, অহন আমার হাত থিকা এই পিডাডা খাইবা। না খাইলে তোমার লগে আর কথা নাই। আইজ ঢাকা যামু গা।

টাকা হাতে ধরা মরনি অদ্ভুত চোখে মজনুর দিকে তাকাল, হাসিমুখে এক কামড় পিঠা খেল। তারপর ডানহাত বাড়িয়ে পিঠাটা নিল। দে বাজান, খাইতাছি।

মজনু বলল, খাইতে খাইতে আমার মার কথা কও খালা, বাপের কথা কও।

বাপের কথা কী হুনবি! মেউন্না (মেনিমুখো) পুরুষপোলা। তর মায় মরণের পর চল্লিশ দিনও গেল না, আরেকখান বিয়া করলো। তর মিহি (দিকে) ফিরাও চাইলো না।

কেমনে চাইবো, আমি তো তহন তোমার কাছে!

আমার কাছে থাকলেই কি পোলা দেকতে আহন যায় না?

আহে নাই?

না কোনওদিন আহে নাই। মাইনষের কাছে কইতো বউ মরছে, পোলাও মরছে। এর লেইগাঐত্তো তর বাপের মুখ তরে আমি কোনওদিন দেকতে দেই নাই। বাপ পোলা কেঐ কেঐরে চিনে না। নতুন সংসারে ম্যালা লোপান তার। আছে ভালঐ।

বাপের কথা বাদ দেও। মার কথা কও।

মরনি আরেক কামড় পিঠা খেল। তর মার আহুজ পড়বো, আমি গেছি বইনের কাছে থাকতে। তিনদিন আহুইজ্জা বেদনায় কষ্ট পাইলো বইনে। তারবাদে তুই অইলি। ভালয় ভালয়ই অইলি। মাত্র ছয়দিন, দোফর বেলা ছটফট করতে করতে মইরা গেল বইনে। আমার চোক্কের সামনে। আমি তরে কুলে লইয়া বইয়া রইছি, তুই বুজলিও না কারে তুই জীবনের তরে হারাইলি।

মজনু করুণ মুখে হাসল। আসলে হারাই নাই খালা। যে মরছে হে মরছে, আমি তো আমার মার কুলেই আছি। এই যে আমার মা।

বলেই খালার একটা হাত ছুঁয়ে দিল মজনু।

মরনি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক কইছস তর মা অমু দেইক্কাঐ আল্লায় আমারে পোলাপান দিলো না। তর রুজি খামু দেইকাঐ বস্বেরকালে (বয়সকাল) রাড়ি (বিধবা) অইলাম। বিলে চৌদ্দগণ্ডা জমিন, চাইর শরিকের বাড়িডার দক্ষিণ দিকে এডু জাগা, দুইখান ঘর, এই হগল রাইক্কা তর খালু মরলো। বাজানরে, দুইন্নাইতে তুই আর আমি ছাড়া আমগো কেঐ নাই।

জামগাছ থেকে টুনটুনিটা কখন উধাও হয়েছে, পাকা ডালিমের মতো রোদ কখন আরও উজ্জ্বল হয়েছে, দুইজন মানুষের কেউ তা খেয়াল করে না। তারা স্তব্ধ হয়ে থাকে গভীর কোনও দুঃখ বেদনায়।

.

১.০৭

ঘরের খাড়া পিড়ার (পৈঠা) সঙ্গে ঢেলান (হেলান) দিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে বালিকাচা। উঠানে বসে বালিকাচায় ঘষে ঘষে ছ্যানে ধার দিচ্ছে দবির। খালি গা, লুঙ্গি কাছা মারা দবিরের পিঠে এসে পড়েছে সকালবেলার রোদ। রোদেপোড়া পিঠ চকচক করছে।

দবিরের হাতের একপাশে পড়ে আছে ঠুলই অন্যপাশে মাটির মালশায় বালি। বালিটা ছাই রঙের। এটা মুড়ি ভাজার বালি। আরবছর (আগের বছর) শীতকালে মুড়ি ভাজার পর যত্ন করে বালিটা মাটির পুরানা ঠিলায় রেখে দিয়েছিল হামিদা।

হামিদার কাছে সংসারের ফেলনা জিনিসটাও দামি। কোনও কিছুই ফেলে না সে। যত্নে তুলে রাখে ঘরদুয়ারের কোথাও না কোথাও। কে জানে কখন দরকার পড়বে কোনটার। হাত বাড়িয়ে না পেলে জোগাড় করতে জান বের হয়ে যাবে। খাটনির খাটনি সময়ও নষ্ট।

মুড়ি ভাজার বালি জোগাড় করতে হয় পদ্মারপার থেকে। মাওয়া কুমারভোগ বরাবর পদ্মারতীরে এখন বিশাল বালিয়াড়ি। পদ্মা সরে যাচ্ছে দূরে। তীরে রেখে যাচ্ছে সাদাবালি। মুড়িভাজার জন্য গরিব গিরস্তরা এসব জায়গা থেকে বালি জোগাড় করে আনে।

কাঁচা বালিতে মুড়ি ভাল ভাজা হয় না। বালি আগুনে ভাজা ভাজা করে নিতে হয়। গরম হলে বালির তেজ বাড়ে। সামান্য নুন পানি মিশান চাউল খোলায় টেলে (সামান্য ভাজা অর্থে) যে হাঁড়িতে গরম করা হয় বালি সেই বালিতে চাউল ঢেলে দুইহাতের কায়দায় আড়াই তিন পাক ঘুরালেই চুরমুর চুরমুর করে ফুটে উঠবে শিউলি ফুলের মতো মুড়ি। ভাজা মুড়ির গন্ধে বিভোর হবে দশদিক।

একবার ব্যবহার করা বালি এজন্য রেখে দেয় গিরস্ত বউরা। হামিদাও রেখেছে। যদিও মুড়ি ভাজার চেয়ে দবির গাছির ছ্যানের ধার দেওয়ার জন্য বালিটা সংসারে বেশি দরকার। মুড়ি ভাজার বালিতে ধার বেশি হয়। পাঁচ আঙুলের একথাবা বালিকাচায় ছিটিয়ে ছ্যানের আগায় একহাত মাথায় একহাত, ঘষা দেওয়ার লগে লগে ঝকঝক করে উঠবে ছ্যান। পাঁচ সাত মিনিটের মাথায় এমন হবে ধার, খাজুরগাছের গলা বরাবর ছোঁয়ালেই কোন ফাঁকে উধাও হবে শক্ত বাকল, খাজুরের নরম অঙ্গ দেখা যাবে রসে চপচপ করছে। আস্তে করে কঞ্চির নল ছোঁয়ালে ঢুকে যাবে। টুপটুপ টুপটুপ করে রস এসে পড়বে হাঁড়িতে। রাত পোহাবার জাগেই হাঁড়ি ভরে যাবে রসে। গন্ধে ম ম করবে চারদিক।

ভারটা পড়ে আছে উঠানের মাঝ বরাবর। লগে ছয়সাতটা হাঁড়ি। হাঁড়িগুলি ছিল রান্নাচালার বাতার সঙ্গে ঝুলান। বড়ঘরের চৌকির তলারগুলি কাল বিকালে মিয়াদের ছাড়া বাড়িতে রেখে এসেছে দবির। আজ এইগুলি নামিয়েছে হালদার বাড়িতে নিয়ে যাবে বলে। হাঁড়ি আরও কিছু লাগবে। মঙ্গলবার গোয়ালিমান্দ্রার হাট থেকে কিনে আনবে। এইবছর হাওয়া যেমন ছাড়ছে, রস পড়বে জবরদস্ত। কষ্ট যতই হোক চারপাশের গ্রামের সবগুলি গাছই ধরার চেষ্টা করবে দবির। রস বেচে সংসারের চেহারা ঘুরাতে হবে। চাষের জমিন যেটুকু আছে, এক কানিও হবে না। নিজে চষেও বছরের ধান হয় না। গাছি না হলে তো, শীতকালে রসের কারবার করে আয় না করলে তো তিনজন মানুষের তিন ওক্তের খাওয়াই জুটত না। তার ওপর মেয়ে বড় হচ্ছে। দুইতিন বছরের মধ্যে বিয়াশাদি দিতে হবে। আজকাল মেয়ে বিয়া দেওয়ার অর্থ সর্বস্বান্ত হওয়া। জামাইরে এইটা দেও, ওইটা দেও। যৌতুক ছাড়া মেয়ের বিয়া দেওয়া যায় না। সোনাদানা তো আছেই, নগদ টাকাও দিতে হয়। দবির গাছির মতো মানুষ এসব পাবে কোথায়? এখন থেকে এসব বিষয়ে না ভাবলে মেয়ের বিয়ার সময় জমিন বিক্রি ছাড়া উপায় থাকবে না। ওইটুকু মাত্র জমিন মেয়ের পিছনে গেলে হামিদাকে নিয়ে খাবে কী! দুইজন মানুষের তো বাঁচতে হবে, নাকি!

ছ্যানে ধার দিতে দিতে এসব ভাবছে দবির। সময় যে অনেকটা কেটেছে খেয়াল করেনি। ছ্যান যে অতিরিক্ত ধার হয়েছে খেয়াল করেনি। ঘষেই যাচ্ছে, ঘষেই যাচ্ছে।

ব্যাপারটা খেয়াল করল নূরজাহান। রান্নাচালায় জলচৌকিতে বসার মতো করে বসেছে সে। টোপরে চাউলভাজা। রান্নাচালার ভিতর চুলার পারে বসে খানিক আগেই দুই খোলা মোটাচাউল ভেজেছে হামিদা। একখোলা দিয়েছে নূরজাহানকে, আরেক খোলার অর্ধেকটা নিজে নিয়েছে, অর্ধেকটা রেখেছে স্বামীর জন্য। কিন্তু স্বামীর দেখি ছ্যানে ধার দেওয়াই শেষ হয় না। কখন চাউলভাজা খাবে, কখন বাড়ি থেকে বের হবে!

একমুঠ চাউলভাজা মুখে দিয়ে স্বামীকে ডাকতে যাবে হামিদা তার আগেই নূরজাহান বলল, ও বাবা, কত ধার দেও? ছ্যান দেহি চকচক করছে!

নূরজাহানের কথায় বাস্তবে ফিরল দবির। আনমনা ভাব কেটে গেল। বালিকাচায় ছ্যান ঘষা বন্ধ করে আঙুলের ডগায় ধার দেখল। তারপর হাসিমুখে মেয়ের দিকে তাকাল। ইট্টু বেশি ধার দিলাম মা। ম্যালা গাছ ঝুড়ন লাগবো।

টোপর থেকে একমুঠ চাউলভাজা নিয়ে মুখে দিল নূরজাহান। জড়ান গলায় বলল, আইজ কোন বাড়ির গাছ ঝুড়বা?

হালদার বাড়ির।

হালদার বাইত্তে খাজুরগাছ কো?

আছে। মজনুগো সীমানায় চাইরখান খাজুরগাছ আছে।

মজনু নামটা শুনে ভারি একটা খুশির ভাব হল নূরজাহানের। উচ্ছল গলায় বলল, মজনু দাদায় বলে অহন টাউনে থাকে? আফাজদ্দি খলিফার কাছে খলিফাগিরি হিগে?

হ, আমিও হুনছি। তরে কইলো কে?

ডালায় করে চাউলভাজা এনে স্বামীর সামনে রাখল হামিদা। নূরজাহান কথা বলার আগেই বলল, অরে কি আর কোনও কিছু কওন লাগে! হারাদিন পাড়া বেড়ায়। এই বাইত্তে যায়, ওই বাইত্তে যায়, কোন বাইত্তে কী অইলো বেবাক অর জানা।

দবির তখন ছ্যান ভরেছে ঠুলইতে। ভারের দুই মাথায় ঝুলিয়েছে হাঁড়িগুলি। এখন ঠুলই মাজায় বেঁধে, কাঁধে কাছি ফেলে বাড়ি থেকে বের হলেই হয়। হামিদা যে তার সামনে চাউলভাজার ডালা রেখেছে সেদিকে খেয়ালই নাই।

ঘটনা বুঝে হামিদা বলল, খাওন লাগবো না?

দবির হাসিমুখে হামিদার দিকে তাকাল। রসের দিনে খাওন দাওনের কথা মনে থাকে না।

হামিদা বলল, মনে না থাকলেও খাওন লাগবো। নাইলে মরবা।

দবির ফুর্তির গলায় বলল, আরে না এত সকালে মরুম না। মাইয়ার বিয়া দেওন লাগবে না?

তারপর ডালা থেকে একমুঠ চাউলভাজা নিয়ে মুখে দিল।

নিজের বিয়ার কথা শুনে, বাবার ওই রকম ফুর্তির ভাব দেখে টোপর ভাল করে চেপে ধরে মা বাবার সামনে এগিয়ে এল নূরজাহান। চঞ্চল গলায় বলল, ভাল কথা কইছো বাবা। আমারে বিয়া দিয়া দেও।

মেয়ের কথা শুনে রেগে গেল হামিদা। নূরজাহানের মুখের দিকে তাকিয়ে ধমক দিল। চুপ কর খাচ্চরনি। এত বড় মাইয়া মা বাপের মুখের সামনে বিয়ার কথা কয়!

দবির কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই নূরজাহান বলল, কইলে কী অয়? বিয়া তো আমারে তোমরা দিবাই!

আবার ধমক দিতে চাইল হামিদা, তার আগেই দবির বলল, এমুন কইরো না মাইয়ার লগে। কইছে কইছে। পোলাপান মানুষ এই হুগল বোজেনি।

হামিদা আগের মতোই রুক্ষ গলায় বলল, কীয়ের পোলাপান মানুষ! বস কম অইছেনি তোমার মাইয়ার? দামড়ি (যৌবনবতী গাভী অর্থে) অইয়া গেছে অহনতরি কথাবার্তির ঠিক নাই। এই মাইয়ারে তুমি হামলাও গাছি। নাইলে কইলাম বিপাকে পড়বা।

কী বিপাকে পড়ম?

যেমনে পাড়া চড়ে কুনসুম কী অইয়া যাইবো উদিস পাইবা না।

দবির আবার চাউলভাজা মুখে দিল। মাইয়া হামলানের কাম বাপের না, মার। তুমি হামলাও না ক্যা?

হামিদা ঘাড় বেঁকা করে স্বামীর মুখের দিকে তাকাল। আমি কইলাম পারি।

পারলে হামলাও।

 তুমি কিছু কইবা না তো?

আমি কী কমু! মাইয়া আমারও যেমুন তোমারও অমুন।

কথাখান য্যান মনে থাকে।

 দবির হাসিমুখে বলল, থাকবো।

নূরজাহানের দিকে তাকাল হামিদা। কী কইছে তর বাপে হোনছস?

 নূরজাহান নির্বিকার গলায় বলল, হুনছি।

তারপর আবার চাউলভাজা মুখে দিল।

দবির ততক্ষণে মুখভরে চাউলভাজা নিয়ে নিজের ভাগেরটা খেয়ে শেষ করেছে। এখন রান্নাচালার ঠিলা থেকে টিনের মগে পানি ঢেলে খাচ্ছে। মা মেয়ের কথার দিকে খেয়াল নাই।

পানি খাওয়া শেষ করে ঠুলই মাজায় বাঁধল দবির। কাছি ফেলল এক কাঁধে আরেক কাঁধে তুলল ভার। উঠান পালান ভেঙে বাড়ির নামার দিকে হেঁটে যেতে যেতে নূরজাহানের দিকে তাকিয়ে হাসল। আইজ থিকা আমি কইলাম কিছু জানি না। তর মায় যা কইবো হেইডা অইবো।

কথাটা বুঝল না নূরজাহান। বাবার চলে যাওয়া পথের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে মায়ের দিকে মুখ ফিরাল। আরেক মুঠ চাউলভাজা দিল মুখে। চাবাতে চাবাতে (চিবাতে চিবাতে) বলল, কী কইবা কও!

হামিদা বলল, পরে কমুনে।

না অহনেই কও। পরে হোননের সময় পামু না।

ক্যা কই যাবি তুই?

হালদার বাড়ি যামু মজনু দাদার খবর লইতে। মজনু দাদায় খলিফা অইছে কিনা জানন লাগবো।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা গলায় হামিদা বলল, যাইতে পারবি না। আইজ থিকা ইচ্ছা মতন বাড়িত থন বাইর অইতে পারবি না। তুই ডাঙ্গর অইছস। আমার লগে থাইক্কা সংসারের কাম কাইজ হিগবি।

কথাটা বুঝতে পারল না নূরজাহান। অবাক চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

.

১.০৮

বাড়ি থেকে বের হবার সময় ছনুবুড়ি দেখতে পেল তার ছেলের বউ বানেছা এন্দাগেন্দা পোলাপান (ছোট ছোট ছেলেমেয়ে) নিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে বউয়া (তেল পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে তৈরি এক ধরনের ভাত। চাল ধুদ দুটো দিয়েই হয়) খাচ্ছে। বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে, এসময় বউয়া খেলে-দুপুরের ভাত বিকালে খেলেও অসুবিধা নাই। আর বিকালে ভাত খাওয়া মানে রাতে না খেলেও চলবে। গিরস্ত বাড়িতে যখন অভাব দেখা দেয় তখন অসময়ে বউয়া জাউ এসব খায় সংসারের লোকে।

তাহলে কি ছনুবুড়ির ছেলের সংসারে অভাব লেগেছে!

অভাব লাগবার কথা না। বুড়ির একমাত্র ছেলে আজিজ গাওয়ালি (ফেরি করা) করে। ভারে বসিয়ে কাঁসা পিতলের থালাবাসন, জগ গেলাস, কলসি পানদান নিয়ে দেশগ্রাম চষে বেড়ায়। নতুন একখান কাঁসা পিতলের থালা বদনা, পানের ডাবর, পানদান গিরস্ত বাড়ির বউঝিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিনিময়ে সেই বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে পুরানা কাঁসা পিতলের ভাঙাচোরা, বহুকাল ধরে ব্যবহার করা জিনিসপত্র। একখান নতুন জিনিসের বিনিময়ে আনবে দুই তিনখান পুরানা জিনিস। তারপর সপ্তাহে সপ্তাহে দিঘলী বাজারে গিয়ে ওজন দরে সেই সব জিনিস বিক্রি করে অর্ধেক টাকার জিনিস কিনবে অর্ধেক টাকা ধুতিতে (টাকা পয়সার থলে) ভরবে। ওই অর্ধেক টাকাই লাভ। তার উপর খেতখোলাও আছে আজিজের। ভালই আছে। আড়াই কানির মতো হবে। পুরা আড়াই কানিই পড়েছে ইরির চাষে। বর্গা দিয়েও ধান যা পাওয়া যায় বছর চলে আরামছে। যদিও আজিজের সংসার বড়। বিয়ার পরের বছর থেকে সেই যে পোলাপান হতে শুরু করেছে বউয়ের, এখনও থামেনি। বড় পোলার বয়স হয়েছে এগারো বারো বছর। এখনও পেট উঁচু হয়ে আছে বানেছার। সাতমাস চলছে। মাস। দুইয়েক পর একদিন ব্যথা উঠবে। আলার মা ধরণী এসে খালাস করে দিয়ে যাবে। পোলা না মাইয়া কী হল সেটা নিয়েও আগ্রহ থাকবে না সংসারের কারও। না আজিজের, না বানেছার। এমন কী পোলাপানগুলিও তাকিয়ে দেখবে না, ভাই হল তাদের, না বোন। যে যাকে নিয়ে আছে তারা।

আর ছনুবুড়ির তো কথাই নাই। সে এই সংসারে থেকেও নাই। বিয়া করে বানেছাকে যেদিন সংসারে আনল আজিজ তার পরদিন থেকেই সংসারের বাড়তি মানুষ ছনুবুড়ি। বাড়িতে বড়ঘর একটাই, সেই ঘর চলে গেল বউর দখলে। উত্তরের ভিটায় আছে মাথার ওপর টিনের দোচালা আর চারদিকে বুকার্বাশের (বাশ চিড়ে তার ভেতরকার সাদা নরম অংশ দিয়ে তৈরি) বেড়া, ঢেকিঘর। একপাশে বেলদারদের (নিচু ধরনের সম্প্রদায়) রোগা ঘোড়ার মতো তেঁতুল রঙের পুরানা ঢেঁকিটা ললাটে (ঢেকির মুখ যে গর্তে পড়ে) মুখ দিয়ে পড়ে আছে, আরেক পাশে ভুর (উই) দেওয়া আছে লাকড়ি খড়ি, এসবের মাঝখানে, লেপাপোছা একটুখানি জায়গা থাকার জন্য পেল ছনুবুড়ি। নিজের কথা বালিস নিয়ে তারপর থেকে ওখানেই শোয়।

দিন চলে যাচ্ছে।

ছেলের বউ হিসাবে বানেছা অতি খারাপ। সংসারে এসে ঢোকার পর থেকেই দুই চোখখে দেখতে পারে না হরিরে (শাশুড়িকে)। কী ভাল কথা কী মন্দ কথা, ছনুবুড়ির কথা শুনলেই ছনছন করে ওঠে। চোপা (মুখ) এত খারাপ, হরিরে কোন ভাষায় গালিগালাজ করা যায় তাও জানে না। মুখে যা আসে তাই বলে। সতীন পর্যন্ত।

প্রথম প্রথম এই নিয়ে ব্যাপক কাইজ্জাকিত্তন (ঝগড়াঝাটি) হয়েছে। বানেছা যেমন ছনুবুড়িও তেমন, হরি বউয়ের কাইজ্জাকিত্তনে পাড়ার মানুষ জড় হত। শেষদিকে যখন হাতও তুলতে শুরু করল বানেছা তখন উপায় না দেখে থেমে গেছে ছনুবুড়ি। হরি হয়ে বউর হাতে মার খাওয়া! ছি!

আর পেটের ছেলে আজিজ, সে এমন মেউন্না (মেনিমুখো), বউর উপর দিয়ে কথা বলার সাহস নাই। বউ অন্যায় করলেও দোষ সে মাকেই দেয়। এসব দেখে সংসার থেকে মন উঠে গেছে বুড়ির। তারপর থেকে সংসারে সে থেকেও নাই। বাড়িতে থাকলে নাতি নাতকুরদের হাত দিয়ে ভাত তরকারি পাঠায় বানেছা, ছনুবুড়ি খায়। কখনও যদি না পাঠায়, রাও (রা) করে না। পাড়া চড়ে ছোটখাট চুরি চামাড়ি করে, কৃটনামী করে টুকটাক খাদ্য যা জোগাড় করে তাতে নিজের পেট বুড়ির খালি থাকে না। সময় অসময়ের ক্ষুধাটা মিটাতে পারে।

তবে দেশ গ্রামের লোক ছনুবুড়ির আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে খুব হাসি মশকরা করে। এতবড় কূটনী হয়েও বউর কূটনামীর কাছে মার খেয়ে গেছে বুড়ি। কাইজ্জাকিত্তনে ছনুবুড়ির ছ্যানের মতন ধার, সেই ধার মার খেয়ে গেছে বানেছার কাছে। পারতিকে বউর সঙ্গে সে কথা বলে না। বউকে চোখের ওপর দেখেও না দেখার ভাব করে।

আজকের ব্যাপার অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই পেটভর্তি ক্ষুধা বুড়ির। সকালবেলা মুখে দেওয়া যায় এমন কোনও খাদ্য নিজের সংগ্রহে ছিল না। কাল দুপুরে জাহিদ খাঁর বাড়িতে ভাত খেয়েছে তারপর থেকে একটা বিকাল গেছে, পুরা একটা রাত তারপর এতটা বেলা, মানুষ বুড়া হলে কী হবে পেট কখনও বুড়া হয় না, ক্ষুধাটা বেদম লেগেছে ছনুবুড়ির। আর এসময় বাড়ির বউ পোলাপান নিয়ে বউয়া খাচ্ছে! যদিও ছেলের সংসারের অভাবের কথাটাও মনে হয়েছে ছনুবুড়ির, অন্যদিকে বউয়ার গন্ধে নিজের পেটের ক্ষুধাও লাফ দিয়ে উঠেছে।

ছনুবুড়ি এখন কী করে?

বউর সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে মনে নাই। আজ ভাবল নাতি নাতকুরদের মাধ্যমে বউর সঙ্গে ভালভালাই দুই একখান কথা বলে সংসারের অভাবের কথাটা জেনে নেবে আর নিজের জন্য একথাল বউয়াও জোগাড় করবে। কৃটনামী একটু করে দেখুক কাজে লাগলেও লাগতে পারে।

বড়ঘরের পিড়ায় বসল ছনুবুড়ি। ঘরের ভিতর গলা বাড়িয়ে মাজারো (মেজো) নাতিকে ডাকল। ও হামেদ, হামেদ, কী করো ভাই? বউয়া খাও?

সংসারে একমাত্র হামেদেরই একটু টান দাদীর জন্য আছে। সে বলল, হ।

কীয়ের বউয়া?

খুদের। খুদের বউয়া পাও ক্যা, ঘরে চাউল নাই।

হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা কাইজ্জার সুরে বলল, চোক্কে বলে দেহে না? তয় ঘরে বইয়া যে আমি পোলাপান লইয়া বউয়া খাই হেইডা দেহে কেমতে?

খোঁচাটা হজম করল ছনুবুড়ি। যেন বউর সঙ্গেই কথা বলছে এমন স্বরে বলল, কে কইছে চোক্কে দেহি না! অল্পবিস্তর দেহি।

বানেছা বলল, আইজ যে অহনতরি বাইত্তে। আইজ যে অহনতরি পাড়া বেড়াইতে বাইর অয় নাই?

বাইর অইতাছিলাম।

তয়?

ছনুবুড়ি বুঝে গেল বানেছার আওয়াজটা ভাল না। এখনই কাইজ্জাকিত্তন লাগাবে। বুড়ি আর বানেছার উদ্দেশ্যে কথা বলল না। হামেদকে বলল, ও হামেদ, আমারে ইট্টু বউয়া দে। বিয়ানে আমারও তো খিদা লাগে!

হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা তেড়ে উঠল। ইস একদিন পোলাপান লইয়া ইট্টু বউয়া খাইতে বইছি তাও মাগির সইজ্জ অয় না। অরে দেওন লাগবো এক থাল! এই মাগি, বাইর অইলি বাইত থন!

বানেছার কথা শুনে ছনুবুড়িও তেড়ে উঠতে গিয়েছিল, কী ভেবে সামলাল নিজেকে। গলা নরম করে সরাসরি বানেছাকে বলল, এমুন কইরো না বউ। কয়দিন পর আহুজ পড়বো, এই সমায় ময়মুরব্বিগ বড়দোয়া (বদদোয়া) লইতে অয় না। একবার আহুজ পড়ন আর একবার মউতের মুক থিকা ফিরত আহন এক কথা।

একথায়ও বানেছার মন গলল না। আগের মতোই রুক্ষ গলায় বলল, এত আল্লাদ দেহানের কাম নাই। মউতের মুখে আমি পোত্যেক বচ্ছরঐ যাই, আবার ফিরতও আহি। তোমার বড়দোয়ায় আমার কিচ্ছু অইবো না। হকুনের দোয়ায় গরু মরে না। তাইলে দুইন্নাইতে আর গরু থাকতো না। খালি হকুনঐ থাকতো।  

নয় দশ বছরের হামেদ তখন খাওয়া শেষ করেছে। ছেলেটা আমুদে স্বভাবের। এই বয়সেই বয়াতীদের গান শুনে সেই গান ভাল গাইতে পারে। কয়েকদিন আগে তালুকদার বাড়িতে গিয়ে খালেক না মালেক দেওয়ানের দেহতত্ত্বের গান শুনে আসছে। স্মরণশক্তি ভাল। একবার দুইবার শোনা গান একদম বয়াতীদের মতো করেই গায়। মা দাদীর কথা কাটাকাটির মধ্যেও গলা ছেড়ে গান শুরু করল সে।

মালো মা ঝিলো ঝি বইনলো বইন করলাম কী
রঙ্গে ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

নাতির গান শুনে ক্ষুধার কষ্ট আর বউর করা অপমানে বহুকাল পর বুকের অনেক ভিতর থেকে ছনুবুড়ির ঠেলে উঠল গভীর কষ্টের এক কান্না। পিড়ায় বসে এখন যদি কাঁদে ছনুবুড়ি ওই নিয়েও কথা বলবে বানেছা। হয়তো আরও অপমান করবে। অপমানের ভয়ে চোখে পানি নিয়েই উঠে দাঁড়াল ছনুবুড়ি। বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে লাগল। ঘরের ভিতর হামেদ তখন গাইছে,

নৌকার আগা করে টলমল
বাইন চুয়াইয়া ওঠে জল
 কত ভরা তল হইলো এই গাঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

.

১.০৯

শক্ত করে কুট্টির হাত ধরেছেন মিয়াবাড়ির কর্ত্রী রাজা মিয়ার মা। ধরে খুবই সাবধানে বড়ঘরের সিঁড়ি ভাঙছেন। একটা করে সিঁড়ি ভাঙছেন, একটু দাঁড়াচ্ছেন। দাঁড়িয়ে গাভীন গাইয়ের শ্বাস ফেলার মতো করে শ্বাস ফেলছেন। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় মানুষ না হয় ক্লান্ত হয়, নামার সময়ও যে হয়, তাও মাত্র চার পাঁচটা সিঁড়ি, কুট্টি ভাবতেই পারে না। মোডা অইলে যহন এতই কষ্ট তাইলে মোড়া অওনের কাম কী! কে কইছে এত মোডা অইতে!

শেষ সিঁড়ি ভেঙে মাটিতে পা দিলেন রাজা মিয়ার মা, স্বস্তির শব্দ করলেন। যেন পুলসুরাত পেরিয়ে আসছেন এমন আরামদায়ক ভাব। তারপরই কুট্টির মুখের দিকে তাকালেন, বাজখাঁই গলায় বললেন, জলচকি দিছস?

কুট্টি বলল, দিছি বুজান। জলচকি না দিয়া আপনেরে ঘর থিকা বাইর করুমনি? আমি জানি না উডানে নাইম্মা খাড়ইতে পারেন না আপনে! লগে লগে বহন লাগে। এর লেইগা আগেঐ জলচকি দিছি, তারবাদে আপনেরে ঘর থিকা বাইর করছি।

ভাল করছস। তায় আমি তো আইজ উডানে বহুম না।

বলেই কুট্টির কাঁধে কলাগাছের মতো একখানা হাত রাখলেন। শরীরের ভার খানিকটা ছেড়ে দিলেন। সেই ভারে কুট্টি একটু কুঁজা হল। বিশ একুশ বছরের কাহিল মেয়ে কুট্টি, তার পক্ষে এরকম একখানা দেহের একটুখানি ভারও বহন করা মুশকিল।

কুট্টির ইচ্ছা হল কথাটা বুজানকে বলে। কিন্তু বলার উপায় নাই। রাজা মিয়ার মার দেহ মেজাজ দুইটাই এক রকম। রাগ করতে পারেন এমন কোনও কথা মুখের উপর, আড়ালে আবডালে বললে, সেই কথা যদি তার কানে যায় তাহলে আর কথা নাই। লগে লগে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তার আগে যে গালিগালাজ করবেন সেই গালিগালাজ শুনে গর্তে গরম পানি ঢেলে দেওয়ার পর যেমন ছটফটা ভঙ্গিতে বের হয় সাপ তুরখুলা (এক ধরনের বড় পোকা) ঠিক তেমন করে কবর থেকে বের হবে কুট্টির সব মরা আত্মীয়। তাতে অবশ্য কুট্টির কিছু আসবে যাবে না কিন্তু এই বাড়ির বান্ধা কাজ হারালে কুট্টির কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। না খেয়ে মরণ। আর ক্ষুধার কষ্ট কী যেনতেন কষ্ট! সব কষ্ট সহ্য করা যায় ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করা যায় না। সেই কষ্টের চেয়ে এই ভার বহন করা হাজার গুণ ভাল।

কুঁজা শরীরেও মুখটা হাসি হাসি করল কুট্টি। বলল, আমি জানি আপনে আইজ কই বইবেন।

রাজা মিয়ার মাও হাসলেন। ক তো কো?

আমরুজ (জামরুল) তলায়।

হ ঠিকঐ কইছস।

এর লেইগা জলচকিডা আমরুজ তলায় দিছি।

এই বাড়ির রান্নাঘর উঠানের একেবারে মাঝখানে। দক্ষিণের ভিটায় দোতালা বিশাল একখানা টিনের ঘর। ঘরটার নিচের তলাও পাটাতন করা। দুইতলাতেই রেলিং দেওয়া বারান্দা। দূর থেকে গাছপালার মাথা ছাপিয়ে মিয়াবাড়ির দোতালা ঘর দেখা যায়।

বাড়ির পশ্চিম আর উত্তরের ভিটায় আছে আরও দুইখান পাটাতন ঘর। সারাবছর তালামারা থাকে ঘর দুইটা। এতদিন হল এই বাড়িতে আছে কুট্টি এক দুইবারের বেশি ঘর দুইটা খুলতে দেখে নাই। বন্ধই যদি থাকবো ঘর তাইলে রাখনের কাম কী?

তিনখান ঘরের প্রত্যেকটার থেকে পাঁচসাত কম করে জায়গা হবে বাদ দিয়ে পুবের ভিটায় রান্নাঘর। রান্নাঘর অবশ্য কায়দার। দেশ গ্রামের রান্নাঘরের লগে মিলে না। মাথার ওপর টিনের চালা নাই, টালির ছাদ দেওয়া।

এই রান্নাঘরের পিছনেই মাঝারি মাপের একটা জামরুল গাছ। বাড়ি এলে কোনও কোনও সময় জলচৌকি পেতে জামরুল তলায় বসে আরাম পান রাজা মিয়ার মা। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই দেহে তার গরম ভাব। দুই চারকদম হাঁটলেই ঘামে বজবজ করে শরীর। ভিতর থেকে ঠেলে বের হয় গরম। জামরুল তলায় বসলে গরম কমে। জায়গাটা সব সময়ই ঠান্ডা। জামরুলের পাতায় ঝিরিঝিরি হাওয়া সব সময়ই থাকে। আজ সকালে, বেশ খানিকটা বেলা হয়ে যাওয়ার পর কুট্টির কাঁধে ভর দিয়ে জামরুল তলার দিকেই যাচ্ছেন রাজা মিয়ার মা। গাভিন গাইয়ের মতন দেহ বলে তাঁর হাঁটাচলা খুবই ধীর। চোখের পলকে যাওয়া যায় এমন জায়গায় যেতেও সময় লাগে।

এখনও লাগছে।

তবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন রাজা মিয়ার মা। গলার আওয়াজও তার দেহ মেজাজের মতোই। ভালমন্দ যে কোনও কথা বললেই কলিজা কাঁপে। অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে থাকার পরও, এখনও কলিজা কাঁপছে কুট্টির। বুজান বাড়িতে এলে সারাক্ষণই আতঙ্কে থাকে সে। ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে কবে বাড়ি থেকে যাবেন তিনি, কবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে কুট্টি।

রাজা মিয়ার মা বাড়িতে না থাকলে বাড়ির মালিক কুট্টি। বড়বুজান আছেন, বাঁধা কামলা আছে আলফু। তাতে কিছু যায় আসে না। বড়বুজান বয়সের ভারে পঙ্গু। সারাক্ষণই শুয়ে আছেন বিছানায়। হাঁটাচলা করা তো দূরের কথা, বিছানায় উঠে বসতে পর্যন্ত পারেন না। কথা বলেন হাঁসের ছায়ের মতো চিঁচিঁ করে। আর আলফুকে তো মানুষই মনে হয় না কুট্টির। মনে হয় গাছপালা, মনে হয় ঝোপঝাড়, গিরস্ত বাড়ির সামনে নাড়ার পালা। জ্যাতা (জ্যান্ত) একজন মানুষকে যে কেন এমন মনে হয় কুট্টির! বোধহয় কথা আলফু বলে না বলে। বোধহয় ভালমন্দ সব ব্যাপারেই আলফু নির্বিকার বলে। মুখে ভাষা থাকার পরও আলফু বোবা বলে।

রাজা মিয়ার মা বললেন, বুদ্দিসুদ্দি তর ভালঐ কুট্টি, তারবাদেও সংসার করতে পারলি না ক্যা?

এমনিতেই বুজানের দেহের ভারে কুঁজা হয়ে গেছে কুট্টি, মনে মনে ভাবছে কখন ফুরাবে এইট্টুকু পথ, কখন বুজানকে জলচৌকিতে বসিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে সে, তার উপর আথকা এরকম একখানা কথা, তাও বাজখাঁই গলায়, কুট্টি ভড়কে গেল। কথাটা যেন বুঝতে পারল না এমন গলায় বলল, কী কইলেন বুজান?

এত কাছে থেকেও তার কথা কেন বুঝতে পারেনি কুট্টি এই ভেবে রাজা মিয়ার মা একটু রাগলেন। গলা চড়ল তাঁর। এই ছেমড়ি (ছুঁড়ি), কানে কম হোনচনি?

না।

তয়?

হুনছি ঠিকই।

কথার তাইলে জব দেচ না ক্যা?

ততক্ষণে জামরুল তলায় পৌঁছে গেছে তারা। জায়গা মত পেতে রাখা জলচৌকিতে রাজা মিয়ার মাকে ধরে বসাল কুট্টি। কুট্টির মতো তিন কুট্টি বসতে পারে যে চৌকিতে সেই চৌকিতে একা বসার পরও চৌকির চারদিক দিয়ে উপচে পড়লেন রাজা মিয়ার মা। ব্যাপারটা খেয়াল করল না কুট্টি। বুজানকে বসিয়ে দেওয়ার পরই ক্লান্তির শ্বাস ফেলল। হাসিমুখে বলল, এমতেই হতিনের সংসার তার মইদ্যে দেয় না ভাত। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না বুজান।

বাড়ির নামার দিকে অনেকগুলি আমগাছ নিবিড় হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে রাজা মিয়ার মা বললেন, বেডা করতো কী?

গিরস্তালী করতো। ছোড গিরস্ত। শিমইল্লা বাজারে মদিদোকানও আছিলো।

তয় তো অবস্তা ভাল। ভাত দিতে পারতো না ক্যা?

সংসারডা বড়। আগের ঘরের ছয়ডা পোলাপান। ভাই বেরাদর আছে চাইর পাঁচজন।

বেডার তো তাইলে বস (বয়স) অনেক।

কুট্টি হাসল। হ আমার বাপের বইস্যা।

এমুন বেডার লগে মা বাপে তরে বিয়া দিল ক্যা?

কী করবো! এতডি বইন আমরা! আমি বেবাকতের বড়। আমার বিয়া না অইলে অন্যডির বিয়া অয় না।

এর লেইগা হতিনের সংসারে মাইয়া দিবো?

কুট্টি কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর আনমনা হয়ে গেল।

রাজা মিয়ার মা বললেন, গরিব মাইনষের ঘরে মাইয়া না অওনঐ ভাল। তর অন্য বইনডির বিয়া অইছে?

দুইজনের অইছে।

আর আছে কয়জন?

অহনও দুইজন আছে।

 তর বাপে করে কী?

শীতের দিনে লেপ তোশকের কাম করে। খরালিকালে কামলা খাডে।

এতে সংসার চলে?

না চলে না।

তয়?

খাইয়া না খাইয়া বাইচ্চা আছে মানুষটি।

এতডি মাইয়া না অইয়া দুই একটা পোলা অইলে কাম অইতো। জুয়ান পোলা থাকলে রুজি কইরা সংসার চালাইতো।

পোলার আশায়ই বলে এতডি মাইয়া জন্ম দিছে আমার মা বাপে। বুজছে পোলা অইবো, অইছে মাইয়া।

একটু থেমে রাজা মিয়ার মা বললেন, তুই তগো বাইত্তে যাচ না?

না।

ক্যা?

মা বাপে আমারে দেকতে পারে না। বাইত্তে গেলে ধুর ধুর কইরা খেদাইয়া দেয়।

কচ কী?

হ।

ক্যা, এমুন করে ক্যা?

ঐ যে জামাই বাইত থিকা পলাইয়া আইয়া পড়ছি, এর লেইগা।

খাইতে পরতে না দিলে আবি না?

খাইতেও দিবো না পরতেও দিবো না, তার উপরে হতিনের সংসার। ওহেনে মানুষ থাকে কেমতে! একখান কাপোড়ে আমি বচ্ছর কাডাইতে পারি বুজান, হতিনের গনজনা সইজ্জ করতে পারি, স্বামী আমার লাগে না, খালি একখান জিনিসের কষ্ট আমার। খিদা। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না। পেড ভইরা খাওন পাইলে আমি আর কিছু চাই না। আমার মা বাপে এইডা বোজে না। হেরা মনে করে আমি তাগো মান ইজ্জত ধুলায় মিশাইয়া দিছি। কন তো বুজান, পেডে খিদা লইয়া মান ইজ্জত দেহন যায়নি!

কথা বলতে বলতে শেষ দিকে গলা বুজে এল কুট্টির। ঠিক তখনই ছনুবুড়িকে দেখা গেল মিয়াবাড়ির দিকে হেঁটে আসছে।

.

১.১০

মিয়াদের ভিটায় উঠেই জামরুল তলায় রাজা মিয়ার মাকে দেখতে পেল ছনুবুড়ি। দেখে মনের ভিতর অপূর্ব এক আনন্দ হল। নিজের বাড়িতে, নিজের বউর কাছে হওয়া খানিক আগের অপমান একদম ভুলে গেল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে কুঁজা শরীর সোজা করবার চেষ্টা করল। তারপর দ্রুত হেঁটে জামরুল তলায় এল। ফোকলা মুখখানা হাসি হাসি করে বলল, আরে বুজানে বাইত্তে আইছে নি? কবে আইলেন? চোক্কে আইজকাইল একফোডাও দেহি না, তাও দূর থিকা আপনেরে দেকছি। আদতে আপনেরে দেহি নাই বুজান, দেকলাম আপনেগো বাড়ির আমরুজ তলাডা জোছনা রাইতের লাহান ফকফক করতাছে। দিনে দোফরে জোছনা উটবো কেমতে! বোজলাম এইডা তো জোছনা না, এইডা তো আমার বুজানে। বুজানের শইল্লের রঙখান জোছনার লাহান। আন্দার ঘরে বইয়া থাকলেও ফকফইকা অইয়া যায়। কবে আইছেন বুজান?

গলা যতটা নরম করা যায় করলেন রাজা মিয়ার মা। পশশু দিন আইছি।

মাওয়ার লনচে?

হ। মাওয়ার লনচ ছাড়া আমু কেমতে ক? ছিন্নগরের লনচে আইলে এতদূর থিকা আমারে বাইত্তে আনবো কেডা?

রাজা মিয়ার মায়ের অদূরের মাটিতে বসল ছনুবুড়ি। ক্যা আলফু গিয়া আনবো! আপনে তো আইবেন পালকিতে কইরা!

এতদূর থিকা পালকিতে আইলে খরচা অনেক। মাওয়া থিকা আহন ভাল। তয় দিনডা পুরা লাইগ্যা যায়। বিয়ান ছয়ডার লনচে উটলে বিয়াল অইয়া যায়। ছিন্নগর দিয়া আইলে দুইফইরা ভাত বাইত্তে আইয়া খাওন যায়।

ভাতের কথা শুনে পেটের ভিতর ক্ষুধাটা ছনুবুড়ির মোচড় দিয়ে উঠল। বহু বহু বছরের পুরানা নাকে ভেসে এল গরম ভাপ ওঠা ভাতের গন্ধ। অহন যুদি একথাল ভাত পাওয়া যাইতো! লগে সালুন না অইলেও চলতো। খালি ইট্ট নুন, খালি একহান কাঁচা মরিচ।

নিজের অজান্তেই জিভ নাড়ল ছনুবুড়ি, ঢোক গিলল। রাজা মিয়ার মা এসব খেয়াল করলেন না। খেয়াল করল কুট্টি। জিজ্ঞাসা করতে চাইল, এমুন কইরা ঢোক গিললা ক্যা বুজি? খিদা লাগছেনি? বেইল অইছে, অহনতরি কিছু খাও নাই!

তার আগেই রাজা মিয়ার মা বললেন, রাস্তাডা অইয়া গেলে এই হগল যনতন্না আর থাকবো না।

ক্ষুধার জ্বালায় আনমনা হয়েছিল ছনুবুড়ি। কথাটা বুঝতে পারল না। বলল, কীয়ের যনতন্না বুজান?

এই যে ঢাকা থিকা লনচে কইরা বাইত্তে আহন! আমি মোডা মানুষ, একলা চলাফিরা করতে পারি না। ঢাকা থিকা চাকর লইয়াহি। বহুত খরচা পইড়া যায়। রাস্তা অইয়া গেলে পোলার গাড়ি লইয়া ভো কইরা আইয়া পড়ুম। এক দেড়ঘণ্টা লাগবে বাইত্তে আইতে। দরকার অইলে যেইদিন আমু হেইদিনই ফিরত যাইতে পারুম। রাজা মিয়ায় কইছে বড় সড়ক অইয়া যাওনের পর সড়ক থিকা গাড়ি আইতে পারে এমন একখান আলট (ছোট সড়ক) বাইন্দা দিব বাড়ি তরি (পর্যন্ত)। নিজেগো গাড়ি লইয়া তাইলে বাড়ির উডানে, এই আমরুজ তলায় আইয়া পড়তে পারুম। কুট্টি খালি আমারে ধইরা গাড়ি থিকা নামাইবো। আর কোনও মানুষজন লাগবে না। বুজানে যতদিন বাইচ্চা আছে হেরে তো না দেইক্কা পারুম না! এই বাড়িঘর, জাগাজমিন, খেতখোলা, গাছগাছলা এই হগল তো না দেইক্কা পারুম না!

রাজা মিয়ার মায়ের এত কথার একটা কথা কান্র লাগল ছনুবুড়ির। গাছগাছলা। লগে লগে আগের দিনকার কূটবুদ্ধিটা মাথায় এল। দবির গাছির মুখ ভেসে উঠল ছানিপড়া চোখে। বুদ্ধি খাটায়া যদি ভাল মানুষ সাজা যায় বুজানের কাছে তাহলে দুপুরের ভাত এই বাড়িতে খাওয়া যাবে। কোনও না কোনওভাবে বুজানকে খুশি করতে না পারলে ভাত তো দূরের কথা এক গেলাস পানি চাইলেও বুজান বলবেন, তরে অহন পানি দিব কেডা? পুকঐরে গিয়া খাইয়া আয়।

এত টাকা পয়সা থাকলে কী হবে, এত জায়গাজমিন, খেতখোলা থাকলে কী হবে রাজা মিয়ার মা দুনিয়ার কিরপিন (কৃপণ)। স্বার্থ আদায় না হলে কারও মুখের দিকে তাকান না।

ছনুবুড়ি মনে মনে বলল, স্বার্থঐত্তো, বড় স্বার্থ। প্যাঁচখান লাগাইয়া দেহি। কাম না অইয়া পারবো না।

গলা খাকারি দিয়ে কথা মাত্র শুরু করবে ছনুবুড়ি তার আগেই দোতালা ঘর থেকে খুনখুনা গলায় কুট্টিকে ডাকতে লাগলেন বড়বুজান। কুট্টি ও কুট্টি, কই গেলি রে? আমি পেশাব করুম। আমারে উডা। ডহি (এক প্রকারের হাঁড়ি) বাইর কর।

রাজা মিয়ার মা কান খাড়া করে বললেন, ঐ কুট্টি, বুজানে ডাক পারে। তাড়াতাড়ি যা।

মাত্র পা বাড়িয়েছে কুট্টি, বললেন, হোন, বুজানরে পেশাব করাইয়া ভাত চড়া। সালুন রানবি কী?

মাছ আছে।

কী মাছ

কই আছে, মজগুর (মাগুর) আছে। আপনে আইবেন হুইন্না পুকঐর থিকা ধইরা রাখছে আলফু। কোনডা রান্দুম?

মজগুর রান।

আইচ্ছা।

দ্রুত হেঁটে দোতালা ঘরের দিকে চলে গেল কুট্টি।

এই বাইত্তে আইজ মজগুর মাছ রানবো (রান্না)। গরম ভাতের লগে মজগুর মাছের তেলতেলা সুরা (ঝোল) একটা দুইটা টুকরা আর একথাল ভাত যুদি খাওন যায়! শীতের দিন আইতাছে। এই দিনের জিয়াইন্না (জিয়ল) মাছ বহুত সাদের অয়। ওই রকম মাছ দিয়া একথাল ভাত যুদি খাওন যায়!

মুখের ভিতর জিভটা আবার নড়ল ছনুবুড়ির। আবার একটা ঢোক গিলল সে। তারপর খুবই সরল ভঙ্গিতে কথা শুরু করল। একটা কামলায় আপনেগো অয় বুজান?

কথাটা বুঝতে পারলেন না রাজা মিয়ার মা। ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকালেন। ক্যা অইবো না ক্যা? কাম কাইজ তো আলফু ভালঐ করে।

হ তা তো করেঐ। তয় একলা মানুষ কয়মিহি খ্যাল (খেয়াল) রাকবো! বাড়িঘরের কাম, খেতখোলার কাম, ছাড়া বাইত্তে এতডি গাছগাছলা!

বাড়িঘরের কাম কিছু আছে, খেতখোলায় কোনও কামঐ নাই। অহন তো আর আগের দিন নাই, আমন আউসের চাষ দেশগেরামে অয়ঐ না। অয় খালি ইরি। আমগো বেবাক খেতেই ইরি অয়। তাও বর্গা দেওয়া। বর্গাদাররা ধান উডাইয়া অরদেক (অর্ধেক) ভাগ কইরা দেয়। বছরের খাওনডা রাইখা বাকিডা রাজা মিয়া বেইচ্চা হালায়। খেতখোলার মিহি আলফুর চাইতে অয় না। তয় গাছগাছলার মিহি চায়। ছাড়াবাড়ির মিহি চায়।

হ দোষ তো আলফুর না, দোষ অইলো দউবরার।

রাজা মিয়ার মা ভুরু কুঁচকে বললেন, কোন দউবরা? কিয়ের দোষ?

বুজানের আগ্রহ দেখে ছনুবুড়ি বুঝে গেল, কাজ হবে। পেটের ক্ষুধা পেটে চেপে কথা বলার ভঙ্গি আরও সরল করে ফেলল সে। মুখখানা এমন নিষ্পাপ করল যেন এই মুখে কোনও কালেই পড়েনি পাপের ছায়া।

ছনুবুড়ি বলল, ওই দ্যাহো, কথাডা আপনেরে তো কইয়া হালাইলাম। এইডা মনে অয় ঠিক অইলো না। কূটনামি বহুত খারাপ জিনিস।

রাজা মিয়ার মা গম্ভীর গলায় বললেন, কী কবি তাড়াতাড়ি ক ছনু। কূটনামি তর করন লাগবো না। আসল কথা ক।

হ আসল কথাঐ কমু। আপনে আমার থিকা অনেক ছোড তাও আপনেরে আমি বুজান কই। আপনে আমারে কন তুই কইরা। এতে ভাল লাগে আমার। আমি আপনেরে বহুত মাইন্য করি। আপনেরে যহন বুজান কইরা ডাক দেই মনে অয় আপনে আমার বড় বইন। আমি আপনের ছোডঃ।

এবার ছনুবুড়িকে জোরে একটা ধমক দিলেন রাজা মিয়ার মা। এত আল্লাইন্দা প্যাচাইল পারিছ না। আসল কথা ক।

এই ধমক একদমই কাবু করতে পারল না ছনুবুড়িকে। সে যা চাইছে কাজ সেই মতোই হচ্ছে। রাজা মিয়ার মা যত বেশি রাগবেন তার তত লাভ। কথা শেষ করে ভাতের কথাটা তুললেই হবে।

ছনুবুড়ি উদাসীনতার ভান করল। দউবরারে চিনলেন না? দবির গাছি। গাছ ঝুড়ে। পাড়া বেরাইন্না একখান মাইয়া আছে, নূরজাহান। খালি এই বাইত্তে যায় ঐ বাইত্তে যায়। ডাঙ্গর মাইয়া, বিয়া দিলে বচ্ছরও ঘোরব না, আহুজ পড়বো। নূরজাহানরে অহন খালি বড় সড়কে দেহি। মাইট্টাইলগো কনটেকদার আছে আলী আমজত, খালি হেই বেডার লগে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। কোনদিন হোনবেন পেটপোট বাজাইয়া হালাইছে।

এবার গলা আরেকটু চড়ালেন রাজা মিয়ার মা। তর এই বেশি প্যাচাইল পাড়নের সবাবটা গেল না ছনু। এক কথা যে কত রকমভাবে ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া কচ। দউবরা কী করছে, কীয়ের দোষ তাড়াতাড়ি ক আমারে।

আপনে তো বাইত্তে আইছেন পশশু দিন, দউবরা আপনের লগে দেহা করে নাই?

না।

কন কী?

আমি কি তর লগে মিছাকথা কইনি।

ছি ছি ছি ছি ছি আপনে মিছাকথা কইবেন ক্যা বুজান? আপনে কোনওদিন মিছা কথা কইছেন? তয় দউবরা আপনের লগে দেহা করলো না? এতবড় সাহস অর?

আরে কী করছে দউবরা?

কাইল বিয়ালে অবে দেখলাম আপনেগো ছাড়াবাইত্তে।

কচ কী! কী করে?

এ ছনুবুড়ি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আর কী করবো! অর যা কাম।

খাজুরগাছ ঝোড়ে?

হ।

আমার ছাড়াবাড়ির খাজুরগাছ?

হ।

আমার লগে দেহা না কইরা, আমার লগে কথা না কইয়া তো দউবরা কোনওদিন এমুন কাম করে না! জীবন ভইরা ও আমার গাছ ঝোড়ে! আমি বাইত্তে না থাকলে বুজানের লগে কথা কইয়া যায়। দউবরা তো ইবার আহে নাই! আইলে বুজানে আমারে কইতো!

না আহে নাই। দউবরা নিজ মুখে আমারে কইছে।

কী কইলো?

কইলো যেই কয়দিন পারি বুজানগো ইবার জানামু না। জানাইলেঐ অরদেক রস দেওন লাগবো। পয়লা কয়দিন রসের দাম যায় খুব। কয়ডা আলগা পয়সা কামাইয়া লই। তারবাদে জানামু।

রাজা মিয়ার মা আকাশের দিকে তাকালেন। শেষ হেমন্তের আকাশ প্রতিদিনকার মতো নতুন। দুপুরের মুখে মুখে দেশগ্রামের মাথার উপর রোদে ভেসে যাচ্ছে আকাশ। গাছগাছালির বন কাপিয়ে হাওয়া বইছে। রাজা মিয়ার মা সেই হাওয়া আঁচ করলেন। হাওয়ায় মৃদু শীতভাব। এসময় রস পড়বার কথা না। গাছেরা রসবতী হয়েছে ঠিকই তবে রস পড়বে আরও সাত আটদিন পর।

ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় রাজা মিয়ার মা বললেন, অহনতরি রস পড়নের কথা না। শীত পড়ে নাই, রস পড়বো কেমতে?

লগে লগে পরনের মাইট্টা (মেটে) রঙের ছেঁড়া কাপড় গায়ে জড়াবার চেষ্টা করল ছুনবুড়ি। কন কি শীত পড়ে নাই? শীতে বলে আমি মইরা যাই! আপনে মোডা মানুষ, বড়লোক, শইল্লের গরম আর টেকার গরম মিল্লা শীত আপনে উদিস পাইবেন কেমতে? হোনেন বুজান, আপনের ছাড়া বাড়ির বেবাকটি খাজুরগাছ কাইল হারাদিন ধইরা ঝোড়ছে দউবরা। আইজ বিয়ানে দউবরারে আমি দেকলাম রসের ভার কান্দে লইয়া হালদার বাইত মিহি যায়। রস কইলাম পড়তাছে। দউবরা কইলাম আপনের বাড়ির রস বেইচ্চা আলগা পয়সা কামাইতাছে।

শীত পড়ল কী পড়ল না, রস সত্য সত্যই পড়ল কী পড়ল না এবার আর ওসব ভাবলেন না রাজা মিয়ার মা। বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠলেন। এতবড় সাহস গোলামের পোর! আমারে না জিগাইয়া আমার গাছ ঝোড়ে! ঐ কুট্টি, আলফুরে ডাক দে। ক যেহেন থিকা পারে দউবরারে বিচরাইয়া লইয়াইতে।

বড়বুজানের কাজ সেরে অনেকক্ষণ হল রান্নাঘরে এসে ঢুকেছে কুট্টি। ভাত চড়িয়ে মাগুর মাছ কুটেছে। মাগুর মাছ না ঘষে খান সা বুজানে। এখন সেই মাছ ধারাল থানইটের ওপর ফেলে অতিযত্নে ঘষছে কুট্টি। ঘষে ঘষে খয়েরি রঙ সাদা করে ফেলছে। এই ফাঁকে বুজান এবং ছনুবুড়ির সব কথাই শুনেছে। শুনে ছনুবুড়ির ওপর বেদম রাগ হয়েছে। পরিষ্কার বুঝেছে দবির গাছির নামে মিছাকথা বলছে ছনুবুড়ি। নিশ্চয় কোনও মতলব আছে।

তবু বুজান যখন বলেছেন আলফুকে না ডেকে উপায় নাই।

কোটা মাছ মালশায় রাখল কুট্টি। ভারী একখানা সরা দিয়ে ঢাকল। তারপরই বিলাইটার (বিড়াল) কথা মনে হল। চারদিন হল বিয়াইছে (বাচ্চা দিয়েছে)। ফুটফুটা পাঁচটা বাচ্চা। দোতালার এককোণে ফেলে রাখা ভাঙা চাঙারিতে গিয়ে বসেছিল বাচ্চা দিতে, সেখান থেকে আর নামেনি। মেন্দাবাড়ির হোলাটার (হুলো) হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য তাদের ছেড়ে নড়ছে না। পাহারা দিচ্ছে। পাহারা দিতে দিতে না খেয়ে কাহিল হয়ে গেছে। বিলাইদের নিয়ম নীতি আজব। হোলা বিলাইরা নাকি এই রকম। কচিছানা খেয়ে ফেলে। মা বিলাইরা এজন্য ছানা পাহারা দেয়।

বাচ্চা দেওয়ার আগে হোলাটা দিনরাত এই বাড়িতে পড়ে থাকত। দুইটাতে কী ভাব তখন! সময় অসময় নাই রঙ ঢঙ করে। এখন সেই কর্মের ফসল একজনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য না খেয়ে মরে যাচ্ছে আরেকজন। দুনিয়াতে মা জীবদেরই কষ্ট বেশি। পুরুষদের কষ্ট নাই।

এসব ভেবে ফেলে আসা সংসারের কথা মনে হল কুট্টির। স্বামী পুরুষটার কথা মনে হল। তারপরই চমকাল কুট্টি। হোলাটা চারদিন ধরে প্রায়ই আসছে এই বাড়িতে।

নিজের ঔরসজাতদের সামনে ভিড়তে পারছে না মা বিলাইয়ের ভয়ে। এখন বাড়িতে ঢুকে যদি মাছের গন্ধ পায়, যদি রান্নাঘরে কাউকে না দেখে তাহলে মাছ কোথায় আছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। যে সরা দিয়ে মাছ ঢেকেছে কুট্টি ওই সরা থাবার ধাক্কায় ফেলে দিতে সময় লাগবে না তার। যদি মাছ সব হোলায় খেয়ে ফেলে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

সরার ওপর একটা থানইট চাপা দিল কুট্টি : সেই ফাঁকে শুনতে পেল জামরুল তলায় বসে মতলবের কথাটা বলছে ছনুবুড়ি। বুজান, এতদিন পর দেশে আইছেন আপনে, আপনেরে আমি বহুত মাইন্য করি, আইজ আপনে আমারে এক ওক্ত খাওয়ান। আপনেরা ধনী মানুষ, আমারে এক ওক্ত খাওয়াইলে আপনেগো ভাত কমবো না! আল্লায় দিলে আরও বাড়বে। খাইয়াইবেন বুজান?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *