প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.৩৭ ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে

ঝিনুক আর বিনুও সেদিকে তাকিয়ে ছিল। ঝিনুক হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে পড়ল, বাবা এসেছে, বাবা এসেছে–

একটু পর ফিটনটা উঠোনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। সত্যি সত্যি ভবতোষ এসেছেন, দরজা খুলে তিনি নেমে পড়লেন। ঝিনুক ছুটে গিয়ে তার কোলে চড়ে বসল।

স্নেহলতা বললেন, এস ভব–

পুজোর আগে কটা দিন ভবতোষের বাড়িতে রান্নাবান্নার লোক ছিল না, নিজেই বেঁধে খাচ্ছিলেন। স্নেহলতা রাগারাগি করতে এ বাড়ি এসে খেয়ে যেতেন। তখন পর পর কদিন ভবতোষকে দেখা গেছে। তারপর রান্নার লোক ফিরে এলে এ বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রায় কুড়ি বাইশ দিন পর আবার আজ এলেন।

পুবের ঘরে এনে ভবতোষকে বসালেন স্নেহলতা। ক্ষিপ্র হাতে হেরিকেন জ্বেলে গলা তুলে ডাকতে লাগলেন, সুধা-সুনীতি-রমু-শিগগির আয়, ভবতোষ এসেছে। অবনীকেও ডেকে নিয়ে আয়–

চারদিক থেকে ছোটাছুটি করে সুধা সুনীতিরা এসে পড়ল।

সবাই এলে স্নেহলতা বললেন, তুমি কেমন মানুষ ভব!

স্নেহলতা কী বলতে চান, বুঝতে না পেরে হকচকিয়ে গেলেন ভবতোষ।

আজ্ঞে—

সেই যে দশমীর দিন এলে, তারপর থেকে আর পাত্তাই নেই। ভেবেছিলাম লক্ষ্মীপুজোর দিন আসবে, তাও এলে না।

রোজই আসব ভাবি। আসি আসি করে আসা হচ্ছিল না।

কত রাজকার্য তোমার! এখন কলেজ ছুটি। কষ্ট করে হেঁটে আসতে হয় না। ঘোড়ার গাড়িতে উঠতে পারলেই হল। সেটুকুও পেরে ওঠ না?

ভবতোষ ম্লান হাসলেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানেন খুড়িমা?

কী?

কিছুই আজকাল ভাল লাগে না।

একটু নীরবতা। তারপর স্নেহলতা বললেন, বৌমার কোনও খবর আছে?

ভবতোষ ঘাড় কাত করলেন, আছে।

এ ঘরের সবাই উদগ্রীব হলেন। উৎসুক গলায় স্নেহলতা শুধোলেন, কী খবর?

ভবতোষ বললেন, ঝিনুকের মা লোক পাঠিয়েছে।

স্নেহলতার ভ্রূ কুঁচকে গেল। তীক্ষ্ণ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, হঠাৎ?

অনেক দিন মেয়েকে দেখে নি। তাই—

তাই কী?

একটু চুপ করে থেকে ভবতোষ বললেন, লোকটার সঙ্গে ঝিনুককে পাঠিয়ে দিতে বলেছে। বিদ্রুপের সুরে স্নেহলতা বললেন, পাঠিয়ে দিতে বলেছে। নবাব নন্দিনী নিজে আসতে পারেন নি?

নবাবনন্দিনী কে, বুঝতে পারলেন ভবতোষ। আবছা গলায় কী বললেন, বোঝা গেল না।

আগের সুরে স্নেহলতা আবার বললেন, সে এখান থেকে গেছে কতদিন?

মাস দেড়েকের মতো। আশ্বিনের দু’তারিখে তাকে ঢাকায় দিয়ে এসেছিলাম।

দেড় মাসের মধ্যে বুঝি ঝিনুকের কথা তার মনে পড়ে নি!

ভবতোষ উত্তর দিলেন না।

স্নেহলতা আবার বললেন, এতকাল পরে মেয়ের জন্যে তার সোহাগ উথলে উঠল যে?

ভবতোষ এবার চুপ। এ প্রশ্নের উত্তর তিনি কেমন করে দেবেন?

স্নেহলতা থামেন নি। ধীরে ধীরে তার কণ্ঠস্বর উঁচুতে উঠতে লাগল, আশ্চর্য মেয়েছেলে! ভগবান কী বস্তু দিয়ে যে গড়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গে না হয় বনে নি, কিন্তু মেয়েটা? দেড় মাস ওই দুধের শিশু ছেড়ে আছে। এতদিন যখন ছেড়ে থাকতে পেরেছে তখন আর নতুন সোহগে দরকার নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। একসময় খুব আস্তে ভবতোষ ডাকলেন, খুড়িমা—

স্নেহলতা তক্ষুনি সাড়া দিলেন।

বলি বলি করেও ইতস্তত করতে লাগলেন ভবতোষ। তারপর দ্বিধান্বিত সুরে শুধোলেন, আপনি কী বলেন?

কী ব্যাপারে?

ঝিনুককে ঢাকায় পাঠাব?

স্নেহলতা এমনিতে প্রিয়ভাষিণী, গলা উঁচুতে তুলে কখনও কথা বলেন না। স্বভাবখানি যেমন মধুর তেমনি স্নেহময় এবং আমোদপ্রিয়। কৌতুকের একটু ছোঁয়ায় এই বয়সেও তিনি সবার সঙ্গে তাল দিয়ে বেজে উঠতে পারেন। তিনি যে পথে হাঁটেন তার দু’ধারে যেন নিমেষে থোকায় থোকায় সুগন্ধময় ফুল ফুটে যায়।

আপন স্বভাবের কথা বুঝিবা মনে থাকল না। রাগের গলায় স্নেহলতা চেঁচিয়ে উঠলেন, না, কিছুতেই না। ঝিনুককে ঢাকায় পাঠাতে পারবে না।

স্নেহলতার এমন ক্রুদ্ধ ভীষণ চেহারা আগে আর কখনও দেখেন নি ভবতোষ। তিনি প্রায় বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। ভয়ে ভয়ে বললেন, কিন্তু—

কী?

ঝিনুককে যখন একবার দেখতে চেয়েছে–

ভবতোষ কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই চোখ পাকিয়ে সন্দিগ্ধ সুরে স্নেহলতা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার মতলবটা কী ভব?

কিছু হয়তো বলবার ছিল ভবতোষের, কিন্তু সাহসে কুললো না। স্নেহলতার মুখের দিকেও তিনি তাকিয়ে থাকতে পারছিলেন না। তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে দুরু দুরু বুকে বসে থাকলেন।

স্নেহলতা আবার বলে উঠলেন, তোমাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি, ঝিনুককে ঢাকায় পাঠানো চলবে না। নবাবের বেটির যদি মেয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়, এখানে এসে দেখে যেতে হবে। বুঝলে?

ভয়ে ভয়ে ঘাড় কাত করলেন ভবতোষ, আচ্ছা—

আর এর ফলও ভাল হবে না।

কিসের?

কিসের আবার, ঝিনুককে ঢাকায় পাঠানোর। স্নেহলতা বলতে লাগলেন, মাকে এখন দেখে না, সে একরকম ভাল। কিন্তু দু’চারদিনের জন্যে পাঠিয়ে যদি দাও, আসবার সময় মেয়ের মন খারাপ হয়ে যাবে। এখানে আসার পরও তার রেশ থেকে যাবে। না না, ঢাকায় পাঠিয়ে মেয়ের মন আমি নষ্ট হতে দেব না। তা ছাড়া–

ভবতোষ উন্মুখ হলেন। স্নেহলতা প্রশ্ন করলেন, ঝোঁকের মাথায় মেয়ে পাঠাতে তো চাইছ, কিন্তু অন্য দিকটা ভেবে

দেখেছ?

কোন দিকটা?

ঝিনুককে যদি ওরা ফেরত না পাঠায়?

এ ব্যাপারটা আগে ভাবেন নি ভবতোষ। ঈষৎ চকিত হয়ে বললেন, সে তো ঠিকই।

স্নেহলতা বললেন, মেয়ে ছাড়া তুমি বাঁচবে?

না, কক্ষণো না।

একটু চুপ। তারপর ভবতোষ মুখ তুলে স্নেহলতাকে দেখলেন। যেই চোখাচোখি হল অমনি চোখ নামিয়ে নিলেন। বারকতক এই রকম চলল।

স্নেহলতা লক্ষ করেছিলেন। বললেন, আমায় কিছু বলবে?

হ্যাঁ। আস্তে করে মাথা নাড়লেন ভবতোষ।

কী?

ভয়ে ভয়ে ভবতোষ বললেন, ঝিনুক তো অনেকদিন আপনার কাছে রইল। সেই পুজোর আগে থেকে আছে–

স্নেহলতার চোখ কুঁচকে গেল, তাতে কী হয়েছে?

কিছু না–

তবে ও কথা বললে যে?

তক্ষুনি উত্তর দিলেন না ভবতোষ। একটুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, অনেকদিন মেয়েটা আমার কাছ ছাড়া, একেবারে ভাল লাগছে না। ভাবছি–

কী?

আজ ওকে নিয়ে যাব। দিনতিনেক পর আমার কলেজ খুলবে। কলেজ খুললে তো নিজের কাছে রাখার অসুবিধে। এই তিনটে দিন ঝিনুক আমার কাছে থেকে আসুক।

স্নেহলতা জোরে জোরে মাথা নাড়লেন, না।

বিমূঢ়ের মতো ভবতোষ বললেন, কী?

ঝিনুক আজ যাবে না।

কেন।

তোমাকে তো সেই ছেলেবেলা থেকে দেখছি ভব, মানুষটা তুমি ভারি নরম। বাড়ি যেতে যেতে হয়তো মতি বদলে গেল। সেই লোকটা তোমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঝিনুককে ঢাকায় নিয়েও যেতে পারে। লোকটাকে বিদেয় করে মেয়ে নিয়ে যেও। তার আগে না।

অসহায়ের মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভবতোষ বললেন, তা হলে আর কি, এখন আমি যাই–

এখুনি যাবে? রাত্তিরে একেবারে খাওয়াদাওয়া করে যেও।

না খুড়িমা, আজ আর খাব না। বাড়িতে রান্নাবান্না করা আছে। এখানে খেয়ে গেলে সব নষ্ট হবে।

তা হলে বাড়িতেই খেও। স্নেহলতা হাসলেন।

এতক্ষণ স্নেহলতার সঙ্গেই কথা বলছিলেন ভবতোষ। ঘরে যে আরও মানুষ আছে সেদিকে লক্ষ ছিল না। এবার অবনীমোহনদের দিকে ফিরলেন তিনি। মৃদু হেসে বললেন, আমি কিন্তু খুড়িমার সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছি।

অবনীমোহন বললেন, দরকার থাকলে বলতে হবে বৈকি।

খানিক ভেবে ভবতোষ বললেন, আপনার সম্বন্ধে আমার কিছু অভিযোগ আছে–

অবনীমোহন চকিত হলেন, কী?

রাজদিয়ায় এতদিন কাটালেন, অথচ আমার বাড়িতে একবারও এলেন না–

সত্যি ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। এবার একদিন যাব।

যাবেন না, বুঝতেই পারছি। গেলে এতদিনে ঠিকই যেতেন। ভবতোষ বলতে লাগলেন, পুজো টুজো গেল। এবার তো কলকাতায় ফিরবেন। আমার ওখানে আর যাবেন কবে?

অবনীমোহন বললেন, কলকাতায় আমরা ফিরছি না।

সত্যি! ভবতোষ অবাক।

সত্যি। অবনীমোহন হাসলেন, এবার থেকে আমরা আপনাদের রাজদিয়ার বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি।

খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু–

কী?

আপনারা শহরের মানুষ, চিরকাল কলকাতায় থেকেছেন। এই ম্যাড়মেড়ে নিঝুম গ্রামদেশ কি বেশিদিন ভাল লাগবে?

ওধার থেকে সুরমা হঠাৎ বলে উঠলেন, বলা মুশকিল। তবে–

তবে কী?

মাথার ভেতর পোকাটা যতদিন কট কট করছে ততদিন এখানেই থাকবে। বলে কৌতুকময় চোখে স্বামীকে বিদ্ধ করলেন সুরমা।

সুরমার কথাগুলো ভাল করে বুঝতে পারেন নি ভবতোষ। কিছুটা বিমূঢ়ের মতো একবার তার দিকে, একবার অবনীমোহনের দিকে তাকাতে লাগলেন।

এই সময় হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল অবনীমোহনের। তাড়াতাড়ি ভবতোষের দিকে ফিরে বলে উঠলেন, আপনাকে পেয়ে ভালই হল। আচ্ছা–

কী?

আপনি তো এখানকার কলেজে অধ্যাপনা করেন?

হ্যাঁ।

একটু ব্যাপারে আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে ভাই—

ভবতোষ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

অবনীমোহন বললেন, এই আমার মেয়েদের ভর্তির ব্যাপারে। কাল কি পরশু মামাবাবুকে নিয়ে আপনার বাড়ি যাচ্ছি। তখন বলব।

আচ্ছা।

আরও কিছুক্ষণ গল্প টল্প করে ভবতোষ উঠে পড়লেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *