প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.৩৪ লক্ষ্মীপুজোর পরদিন

লক্ষ্মীপুজোর পরদিন বিনুদের কেতুগঞ্জে যেতে হল।

দুপুরবেলা খাওয়া দাওয়ার পর বিনুঝিনুক-অবনীমোহন-সুধা-সুনীতি-হেমনাথ আর সুরমা নৌকোয় উঠলেন। নৌকোটা বেয়ে যাবে যুগল আর করিম।

বিনুরা রাজদিয়া আসবার দিনটি থেকে মজিদ মিঞা কতবার যে হেমনাথের বাড়ি এসেছে তার হিসেব নেই। যতবার এসেছে ততবারই অবনীমোহনকে বলেছে, আমাগো বাড়িত কবে যাইবেন মিতা?

অবনীমোহন বলেছেন, শিগগিরই একদিন যাব।

যাব যাব করেও যাওয়া হচ্ছিল না, রোজই একটা না একটা বাধা এসে পড়ছিল। শেষ পর্যন্ত মজিদ মিঞা ক্ষোভে-দুঃখে রাজদিয়া আসা বন্ধই করে দিয়েছে। তার অভিমান ভাঙাবার জন্য আজ অবনীমোহনের না বেরিয়ে উপায় ছিল না।

.

চারদিকে অথৈ জলের মাঝখানে কেতুগঞ্জ গ্রামটা দ্বীপের মতো ভেসে আছে। মাইলের পর মাইল ধানবন, পদ্মবন, শাপলাবন আর জলমগ্ন প্রান্তর পেরিয়ে বিনুরা যখন সেখানে পৌঁছল, রোদের রং বদলে হলুদ হয়ে গেছে। হাওয়ায় টান ধরতে শুরু করেছে। সূর্যটা পশ্চিমের আকাশ বেয়ে অনেকখানি নেমে এসেছে। এখন বিকেল।

আগে থেকেই খবর দেওয়া ছিল। যুগলরা ঘাটে নৌকো ভেড়াতেই মজিদ মিঞা ছুটে এল। তার পেছনে নতুন জামা টামা পরা একদল ছেলেমেয়ে, নাক পর্যন্ত ঘোমটা টানা এক প্রৌঢ়া, চোদ্দ পনের বছরের এক কিশোরীও এসেছে। তাদের সঙ্গে এসেছে এক বৃদ্ধ, গায়ের চামড়া তার কোচকানো, চুল পাটের ফেঁসোর মতো, চোখে পুরু সরের মতো ছানি, ঠোঁট দুটি কিন্তু পানের রসে টুকটুকে যেন টিয়াপাখির ঠোঁট।

পরম সমাদরের গলায় মজিদ মিঞা বলল, আসেন আসেন। সুধা-সুনীতি-বিনুর দিকে তাকিয়ে বলল, আসো গো মায়েরা, বাবারা–

একে একে বিনুরা নৌকো থেকে নামল। সবার শেষে নামলেন অবনীমোহন। তার একখানা হাত ধরে মজিদ মিঞা বলল, আপনে না আইলে কিন্তু আমি আর যাইতাম না।

হাসতে হাসতে অবনীমোহন বললেন, তা তো জানি, সেই জন্যেই চলে এলাম।

বাড়ির দিকে যেতে যেতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল মজিদ মিঞা। নতুন জামা-পরা বাচ্চাগুলো তারই ছেলেমেয়ে। তাদের কারোর নাম রাশেদ, কারোর মতিয়া, কারোর ওসমান, কারোর কামরণ। বিনুরা আসবে বলেই তাদের সাজসজ্জার এমন ঘটা। নতুন জামা টামা পরে সেই সকাল থেকে বসে আছে।

ঘোমটা-ঢাকা প্রৌঢ়াটির নাম নছিরণ–মজিদ মিঞার বিবি। তার হাত দুটোই শুধু দেখা যাচ্ছে, তাতে রুপোর কঙ্কণ আর চুড়ি, কোমরে রুপোর ভারী গেট। বৃদ্ধটি মজিদ মিঞার মা। চোদ্দ পনের বছরের সেই কিশোরীটি তার মেয়ে, নাম রহিমা।

হঠাৎ কী মনে পড়তে অবনীমোহন তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আচ্ছা মিতা—

মজিদ মিঞা উন্মুখ হল, কী ক’ন?

আমরা যেদিন প্রথম রাজদিয়া আসি সেদিন শুনেছিলাম কার সঙ্গে যেন জমি নিয়ে আপনার ঝগড়া হয়েছে। মামাবাবু সে ঝগড়ার মীমাংসা করে দিয়েছিলেন। ঠিক হয়েছিল, যার সঙ্গে ঝগড়া তার ছেলের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে হবে। আপনার সেই মেয়ে কোনটি?

এই যে– বলে পেছন ফিরে মজিদ মিঞা ডাকতে লাগল, রহিমা কই রে, রহিমা—

সেই কিশোরীটি একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিল, ডাক শুনে সামনে এগিয়ে এল।

প্রথমটা রহিমাকে ভাল করে লক্ষ করে নি বিনু। এবার পরিপূর্ণ চোখে তাকাল। রহিমার গড়ন গোল গোল, গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতো, নাকটি একটু বোচাই হবে। চোখ দুটি ভারি সরল আর নিষ্পাপ। জগতের সব কিছুর দিকে তাকিয়ে সে দুটি যেন সর্বক্ষণ অবাক হয়ে আছে। নাকে তার সোনার বেশর, কানে কানফুল। হাতের সোনার চুড়ি গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে।

মজিদ মিঞা বলল, এই মাইয়ার লগে নবু শালার পোলার শাদি দিমু।

বিয়ের কথায় রহিমা ছুটে পালিয়ে গেল।

মজিদ মিঞা আবার বলল, শাদির সোময় আপনেরে আসতে হইব কিলাম। কথা দিছিলেন।

নিশ্চয়ই। আমার মনে আছে।

.

মজিদ মিঞার বাড়িখানা বেশ পরিচ্ছন্ন। ঢালা বড় একটা উঠোন ঘিরে ক’খানা বড় বড় তিরিশের বন্দ’র টিনের ঘর। উঠোনে মোটা মোটা আউশ ধান টাল হয়ে রয়েছে। রাজ্যের পায়রা আর শালিক এসে সোনার দানার মতো শস্য খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। দেখেই মনে হয় সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়ি।

বাড়ি এসে মজিদ মিঞা কী করবে, অবনীমোহনদের কোথায় বসাবে যেন ঠিক করে উঠতে পারল না। নিজেই ছুটে গিয়ে একখানা নকশা-করা চিকন্দি পেতে দিল। জলচৌকি আর হাতল ভাঙা খানকতক চেয়ার টেনে নিয়ে এল।

তারপর বাকি দিনটা শুধু গল্প, ঠাট্টা-ঠিসারা, হাসাহাসি। ফাঁকে ফাঁকে কতবার কত রকমের খাবার যে এল!

বিদের আসার খবর কেমন করে রটে গিয়েছিল। কেতুগঞ্জের মুসলমান পাড়া ভেঙে কত লোক যে তাদের দেখে গেল।

মজিদ মিঞার বাড়ি থেকে ছাড়া পেয়ে বিনুরা যখন রাজদিয়া ফিরল তখন নিশুতি রাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *