প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.১৮ লারমোর বললেন

লারমোর বললেন, কোন গহরালি রে? ওঠ-ওঠ—

সঙ্গের মুসলমান মাঝি দুটো একসঙ্গে বলে উঠল, চরবেউলার গহুরা—

তোরাবালি মন্ডলের ছেলে?

হ।

গহরালি পা জড়িয়ে পড়েই ছিল। লারমোর ব্যস্তভাবে বললেন, পা ছাড় গহর। ওঠ– বলে কাধ ধরে তুলবার জন্য ঝুঁকলেন।

গহরালি উঠল না। পায়ের কাছে জোর করে পড়েই থাকল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, আগে কথা দ্যান, বাজানেরে  বাঁচাইবেন, নাইলে উঠুম না। পায়ে মাথা কুটুম। বলে সত্যি সত্যি লারমোরের পায়ে মাথা ঠুকতে লাগল।

লারমোর অত্যন্ত বিব্রতভাবে বললেন, কী হয়েছে তোর বাজানের?

দুই দিন ধইরা গলা দিয়া খালি লৌ উঠতে আছে। হুশ-জ্ঞান কিছু নাই।

এক মুহূর্ত কী ভেবে লারমোর বললেন, আমার পা ধরে পড়ে থাকলে তো বাপের রোগ সারবে না। উঠে দাঁড়া। হেমনাথের দিকে ফিরে বললেন, তোমাদের সঙ্গে এখন আর যাওয়া হল না হেম। গহরদের সঙ্গে চরবেহুলা ছুটতে হবে।

হেমনাথ মৃদু হাসলেন, সে আমি বুঝেছি।

লারমোর বললেন, বৌঠাকরুনকে বুঝিয়ে বলল, আজ আর তার হাতের রান্না খাওয়া হল না। ফিরে এসে খাব।

হাতজোড় করে হেমনাথ বললেন, মাপ কর ভাই। তোমার বৌঠাকরুনের ব্যাপারে আমি নেই। শুধু শুধু গলা বাড়িয়ে কোপ খেতে যাব কোন সাহসে? ফিরে এসে তুমিই বুঝিয়ে বলল।

সবাই হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে লারমোর বললেন, আচ্ছা তাই হবে। খুব বন্ধু হয়েছিলে! বিপদে পড়লে, উদ্ধার করতে পার না!

হেমনাথ হাসলেন। বললেন, ফিরছ কবে?

চার পাঁচ দিনের আগে নিশ্চয়ই না। দেরিও হতে পারে। চরবেহুলায় যেতেই তো লাগবে একদিন, ফিরতে আরেক দিন। দুটো দিন পথেই কাটবে। তারপর তোরাবালির অবস্থা বুঝে বেশিদিন থাকা-না-থাকা নির্ভর করছে।

তা বটে। যেতে যখন হবে, আর দেরি করো না।

এদিকে গহরালি পা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। লারমোর তাকে বললেন, তোদের সঙ্গে নৌকো আছে?

আছে।

ভালই হয়েছে। ওই বাক্স দুটো নিয়ে চল– যে বাক্স দু’টোয় ওষুধপত্তর ইঞ্জেকশন স্টেথেসকোপ ইত্যাদি আছে তা দেখিয়ে দিলেন লারমোর।

গহরালিরা বাক্স মাথায় তুলে নিল।

লারমোর হেমনাথদের দিকে তাকিয়ে বললেন, চলি হেম, চলোম অবনী, চলি রে দাদাভাই–

অবনীমোহন বললেন, আসুন।

হেমনাথ বললেন, এস। সাবধানমতো থেকো। বেশি অনিয়ম টনিয়ম করো না। তোমার তো আবার নিজের সম্বন্ধে খেয়াল কম।

বিনু কিছু বলল না।

নীরব হেসে গহরালিদের সঙ্গে মাঝিঘাটের দূর প্রান্তে চলে গেলেন লারমোর।

কোথায় চরবেহুলা, কে বলবে। চর শব্দটা বিনুর অজানা নয়। চারদিকে অসীম অথৈ জলের মাঝখানে উন্মনা ভূঁইচাপাটির মতো চরবেহুলা কোথায় ফুটে আছে, বিনু জানে না।

লারমার বলেছিলেন, পুরো একটি দিন লাগে সেখানে যেতে। তার মানে আসছে কাল সন্ধেবেলা তিনি চরবেহুলা পৌঁছবেন। বিনু কোনওদিন চর দেখে নি। নদীর মাঝমধ্যিখানে উখিত এক টুকরো ভূমির জন্য সে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। লারমোর অবশ্য সঙ্গে নিতেন না, অবনীমোহন আর হেমনাথও যেতে দিতেন না, তবু চরবেহুলায় যাবার জন্য একবার বায়না ধরলে হত।

আগেই ঠিক করা ছিল, যুগল আর সেই মাঝি দু’টো অর্থাৎ তিনজন তিনখানা নৌকো বাইবে।

যুগল একটা নৌকোয় উঠে পড়েছিল। লারমোরের নৌকোর সেই মাঝি দুটো পাড়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে। তাদের দিকে তাকিয়ে হেমনাথ বলে উঠলেন, আর দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে? নৌকোয় উঠে আলো জ্বাল।

মাঝি দুটো দুই নৌকোয় উঠে হেরিকেন জ্বালল। হেমনাথরা উঠতে যাবেন, সেই সময় একটা ডাক দূর থেকে ভেসে এল, হেইহেই মাঝি-ই-ই-ই–

হেমনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দেখাদেখি অবনীমোহন আর বিনুও দাঁড়াল।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ছুটতে ছুটতে যারা সামনে এসে পড়ল, তাদের সঙ্গে যে আরেক বার দেখা হয়ে যাবে, বিনু কল্পনাই করতে পারে নি। সেই লোকটা, দুপুর বেলা বটগাছের কাছে দাঁড়িয়ে যে ঢেঁড়া দিয়েছিল সে আর দামড়া মোষের মতো তার দুই বাবরিওলা ঢাকী এসেছে। ঢাকী দু’টো এখন খালি গায়ে নেই, লম্বা ঝুলের কুর্তামতো হাফশার্ট পরেছে। অবাক বিস্ময়ে বিনু তাদের দিকে তাকিয়ে থাকল।

দেখা গেল, তালগাছের মতো ঢ্যাঙা চেহারার ঢেঁড়াদার লোকটা হেমনাথকে চেনে। সে বলল, হ্যামকত্তায় নিকি? আন্ধারে দূর থনে ঠাওর করতে পারি নাই। বলে ঝুঁকে হেমনাথকে প্রণাম করল। দেখাদেখি বাবরিওলা দু’টোও তার পা ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়ে উঠে দাঁড়াল।

হেমনাথ বললেন, হরিন্দ যে, কী ব্যাপার?

লোকটার নাম তা হলে হরিন্দ। সে একবার যা বলল, সংক্ষেপে এইরকম। তাদের নিজেদের নৌকো নেই, অথচ নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। হেমনাথকে পেয়ে ভালই হয়েছে। হরিন্দদের ইচ্ছা হেমনাথের নৌকোয় যায়।

হরি বলল, দয়া কইরা আপনেগো লগে যদি আমাগো নেন—

তোমরা যাবে কোথায়?

অহন যামু ইসলামপুর।

ইসলামপুর তো উত্তরে, আমরা যাব পশ্চিমে।

হরিন্দ বলল, পথে অন্য নাও ধইরা নিমু। সুজনগুঞ্জ থনে সিধা ইসলামপুরের নাও পাইলাম না।

হেমনাথ বললেন, তা হলে ওঠ।

সবাই উঠলে হেমনাথ আবার বললেন, দেখ বাপু, আমার নৌকোয় যাবে তাতে আপত্তি নেই। তবে একটা কথা–

ক’ন হ্যামকত্তা—

আমার একজন মোটে মাঝি। একা মানুষের পক্ষে এত লোক নিয়ে নৌকো বাওয়া তো সম্ভব নয়। তোমাদেরও বৈঠা ধরতে হবে।

হরিন্দ তৎক্ষণাৎ বলে উঠল, হ হ, হেই কথা আর কইতে। বলেই জোড়া বাবরিওলার দিকে ফিরল, কাগা বগা, তরা গিয়া হালে ব।

জোড়া মোষের মতো ওই ঢাকী দু’টোর নাম তা হলে কাগা আর বগা! অদ্ভুত নাম। বিনু এমনিতেই অবাক হয়ে ছিল, তার বিস্ময় আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

ঢাক নামিয়ে কাগা বগার একজন বৈঠা নিয়ে বসল সামনের গলুইতে, আরেকজন পেছনে। সেই মাঝিটাকে কিছুই করতে দিল না।

মাঝিটা বলল, আমারে আইলসা (অলস) বানাইয়া রাখবা নিকি?

কাগা বগা একসঙ্গে বলল, বইয়া বইয়া অহন তুমি তামুক খাও। আমরা চইলা গ্যালে নাও বাইও।

দ্যাখো দেখি কান্ড! অকম্মা হইয়া বইয়া থাকতে ভালা লাগে!

একসময় নৌকো চলতে শুরু করল।

ছইয়ের তলায় হেরিকেনের আলো ঘিরে এখন বসে আছে চারজন। বিনু হরিন্দ অবনীমোহন এবং হেমনাথ। দুই তাগড়া জোয়ান বৈঠা বাইছে। নৌকো যেন জলের ওপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ে চলেছে।

হেমনাথ বললেন, এবার অনেক দিন পর এদিকে এলে হরিন্দ।

আইজ্ঞা– হরিন্দ মাথা নাড়ল।

ঢ়েঁড়া দিয়েছ শুনলাম।

আইজ্ঞা, আপনে ঢেরার জাগায় যান নাই?

না। একটা কাজে আটকে গিয়েছিলাম। তা কী ঢেঁড়া দিলে?

কী ঢেঁড়া দিয়েছে, বিশদভাবে বলল হরিন্দ। শুনে মৃদু হাসলেন হেমনাথ। তাঁর চোখেমুখে কৌতুকের ছটা খেলতে লাগল।

একটু নীরবতা। তারপর হেমনাথ বললেন, কত বছর ধরে ঢেঁড়া দিচ্ছ যেন?

তা আইজ্ঞা বিশ পঁচিশ বচ্ছর তো হইবই।

জীবনটা ঢেঁড়া দিয়ে দিয়েই কাটিয়ে দিলে!

তা একরকম দিলাম হ্যামকত্তা– হরি হাসল, ঢেরা দেওয়ার কামটা আমার জবর ভালা লাগে। এক মাইনষের কথা কত মাইনষেরে শুনাইতে পারি। এক দ্যাশের বাত্তা মুখে কইরা কত দ্যাশে লইয়া যাই। কী ভালা যে লাগে!

হরিন্দর চোখ চকচক করতে লাগল। উত্তেজনায় খাড়া হয়ে বসল সে।

এতে রোজগার কিরকম হয়?

ওই একরকম।

সংসার-টংসার চলে তো?

চলে আর কই। ঢাকীগো দিয়া থুইয়া তেমুন কিছুই আর থাকে না। বাপের আমলের কয়েক কানি ধান জমিন আছে, তাই রক্ষা। নাইলে গুষ্টি সুদ্ধা না খাইয়া মরতে হইত। বলে একটু থামল হরিন্দ। পরক্ষণেই আবার শুরু করে দিল, তয় যে এই আকাম কইরা বেড়াই, নিশা (নেশা) হ্যামকত্তা, নিশা। পাও পাইতা বইসা দুই দণ্ড যে জিরামু, চাষবাস-সোংসার দেখুম–ভালা লাগে না, ভালা লাগে না। কিসে জানি হগল সোময় আমারে ছুটাইয়া নিয়া বেড়ায়। ঘরে বইতে দ্যায় না।

হেমনাথ বললেন, তোমার বাড়ি তো ফরিদপুর?

হ। ঘাড় কাত করল হরিন্দ, পালং থানা, গেরামের নাম ভোজেশ্বর। কবে কইছিলাম, আপনের মনে আছে দেখি!

তা আছে। হেমনাথ হাসলেন, বাড়ির খবর কী? সবাই ভাল তো?

বিব্রত মুখে হরি বলল, বাড়ির খবর জিগাইলে লজ্জা পামু হ্যামকত্তা।

কেন হে?

ছয় মাস বাড়ি ছাড়া। ভাল মোন্দ কিছু জানি না।

বড় তাজ্জবের মানুষ তুমি!

এই কথাখান আমার সম্পক্কে হগলেই কয়।

হেমনাথ শুধোলেন, কবে দেশে ফিরছ?

হরিন্দ জানাল, হে তো কইতে পারুম না। ঢেরা দিতে দিতে যদিন ফরিদপুর যাওন হয়, একবার বাড়িত যাইতেও পারি।

হেমনাথ এবার অন্য প্রসঙ্গ পাড়লেন, তোমরা তো এখন ইসলামপুর চললে?

আইজ্ঞা—

কাল ইসলামপুরের হাট আছে। সেখানে ঢেঁড়া দেবে বুঝি?

আইজ্ঞা। হেইহান থিকা যামু হাসাড়া, হেরপর রসুইনা, হেরপর গিরিগুঞ্জ। এই রাইজ্যে যেইহানে যত হাটগুঞ্জ আছে, ঘুইরা ঘুইরা ঢেরা দিতে হইব।

কী যেন ভেবে নিয়ে হেমনাথ বললেন, কতকাল তোমাকে দেখছি। পরের নৌকোয় ঘুরে ঘুরেই ঢেঁড়া দিয়ে বেড়ালে। নিজের নৌকো নিশ্চয়ই এখনও তোমার হয়নি?

হইল আর কই! তমস্ত জনমে কুনোদিন বিশ পঞ্চাশ ট্যাকা একলগে করতে পারি নাই। নাও হইব কই থিকা? পনের টাকার কমে কি নাও হয় হ্যামকত্তা?

তা তো বটেই। হেমনাথ আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন।

বড় বড় চোখ মেলে বিনু হরিন্দর দিকে তাকিয়ে ছিল। তার বিস্ময় আর কাটছে না। এই অবারিত জলের দেশে যুগযুগান্ত ধরে দিগ্বিদিকে পাড়ি দিয়ে চলেছে লোকটা, অথচ তার নিজস্ব একটা নৌকোও নেই। হেমনাথ যাবেন পশ্চিমে–সেই রাজদিয়াতে, হরিরা যাবে উত্তরে। তার বিশ্বাস, রাস্তায় উত্তরগামী একটা নৌকো পেয়ে যাবেই, তাতে করে ইসলামপুর চলে যেতে পারবে।

যদি পথে নৌকো না মেলে? তবে তো ইসলামপুরে যেতে পারবে না হরিন্দ। ভাবতে গিয়ে মনে মনে চঞ্চল হয়ে উঠল বিনু।

এদিকে যার সম্বন্ধে বিনুর এত অস্থিরতা তার কিন্তু কোনওরকম দুর্ভাবনাই নেই। এত অনিশ্চয়তা, তবু পরম নিশ্চিন্তে হেমনাথের সঙ্গে কেমন গল্প জুড়ে দিয়েছে হরিন্দ।

হরিন্দ বলছে, আমার কথাই খালি জিগাইতে আছেন, আপনের কথা কিছুই জানা হইল না। মা-ঠাইরেন ক্যামন আছেন?

হেমনাথ বললেন, ভালই।

আবার কী বলতে গিয়ে চনমনে চোখে ছইয়ের বাইরে সীমাহীন জলের দিকে তাকাল হরিন্দ। নৌকোটা এর ভেতরে সুজনগঞ্জের হাট পেছনে ফেলে অনেক দূরে চলে এসেছে। যেদিক চোখ যায়, গাঢ় অন্ধকার জল আর আকাশকে একাকার করে রেখেছে। নৌকোটা এখন কোথায়, নদীতে অথবা আশ্বিনের জলেভোবা প্রান্তরে–কে বলবে। নদী, জলপূর্ণ মাঠ ঘাট, শস্যক্ষেত্র কিংবা আকাশকে এখন আর আলাদা করে বুঝবার উপায় নেই।

তবে মাথার ওপর অগণিত স্থির আলোর বিন্দু দেখে টের পাওয়া যায় ওখানে আকাশ আর ওগুলো তারা। নিচেও চোখ পাতলে দূরে দূরে আলোর সঞ্চরণ চোখে পড়ে। বিনু জানে ওগুলো নৌকো-কোনওটা একমাল্লাই, কোনওটা কোষা, কোনওটা বা মহাজনী।

বাইরের অফুরন্ত জলের দিকে একবার তাকিয়ে হরিল কাগা বগার উদ্দেশে বলল, হুশ রাখিস শুয়োরেরা। বাত্তি দেখলে খোঁজ লইস ইসলামপুরের নাও কিনা।

কাগা বগা সমস্বরে বলল, আইচ্ছা।

চোখ দুটো আবার ছইয়ের ভেতরে নিয়ে এল হরিন্দ। বলল, যে কথা কইতে আছিলাম, মা ঠাইরেন তাইলে ভালা আছেন।

হ্যাঁ। হেমনাথ ঘাড় কাত করলেন।

হেইবার, বড় তুফানের সোময় আপনেগো বাড়িত গেছিলাম। মা-ঠাইরনের হাতের ভাত-ব্যন্নন খাইয়া আইছিলাম। য্যান অমত্ত (অমৃত)। অখনও মুখে লাইগা আছে। কতবার ভাবছি আরেক দিন গিয়া মা-ঠাইরেনের হাতের পাক খাইয়া আসুম।

আজই চল না।

না হ্যামকত্তা, আইজ না। অন্য দিন যামু।

হরি বলবার পর কাগা বগা নৌকো বাইতে বাইতে মাঝে মাঝে চিৎকার করছিল, মাঝি হে এ-এ-এ–

দূর দিগন্ত থেকে সাড়া ভেসে আসছিল, কিবা কও-ও-ও-ও–

নাও যায় কই?

সবুইড্যার চরে।

কখনও উত্তর আসছিল, রসুলপুর। কেউ বা বলছিল, নবাবগঞ্জ। কেউ বলছিল, নারাণগুঞ্জ।

এদিকে ছইয়ের ভেতর হেমনাথ তখন হরিন্দকে বলছেন, অন্য দিন আর গেছ! দেড় বছর পর সুজনগঞ্জে এলে। আবার ক’বছর পর এদিকে আসবে তার কি কিছু ঠিক আছে?

এই সময় কাগা বগার চিৎকার আবার শোনা গেল, মাঝি হে-এ-এ-এ-এ—

হাওয়ার স্রোতে ভাসতে ভাসতে উত্তর এল, কিবা কও-ও-ও-ও–

কাগো নাও?

বেবাইজাগো (বেবাজিয়াদের)।

যায় কই?

ইসলামপুর।

ছইয়ের ভেতর হরিন্দ বোধ হয় কান খাড়া করেই ছিল। ইসলামপুরের নামটা শুনতেই হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে চলে গেল। তারপর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, নাও থামাও বেবাইজারা। আলোর একটা বিন্দু দেখিয়ে কাগা বগাকে বলল, উইদিকে বা (বেয়ে যা)।

হেমনাথ বললেন, আজ ইসলামপুর না গেলে চলত না?

হরি বলল, আইজ না গ্যালে কাইলের হাট ধরতে পারুম না। ইসলামপুরের হাট আবার মাসে দুই বার। কাইলের হাট না পাইলে আবার পনর দিনের ধাক্কা।

তা হলে যাও।

আলোর বিন্দুটা যত দূরে মনে হয়েছিল, আসলে কিন্তু তত দূরে না। একটু পরেই কাগা বগা একটা নৌকোর গায়ে এসে নৌকো ভেড়াল। কাছাকাছি আসতে টের পাওয়া গেল নৌকোটা বিশাল। একটাই না, পর পর অনেকগুলো। সব মিলিয়ে বিরাট এক বহর।

বড় নৌকোটা থেকে কে যেন বলল, নাও থামাইতে কইলেন ক্যান?

হরিন বলল, তোমরা ইসলামপুর যাইবা তো। আমরাও যামু। আমাগো যদি ইট্টু লইয়া যাও।

নিয্যস নিমু, আসেন।

হরিন্দ এবার হেমনাথের দিকে ফিরে বলল, যাই হ্যামকত্তা—

এস। হেমনাথ বলতে লাগলেন, সময় করে একবার আমাদের বাড়ি যেও।

যামু। হেমনাথকে প্রণাম করে জোড়া বাবরিওলাকে নিয়ে বেবাইজা’দের নৌকোয় গিয়ে উঠল হরিন্দ।

কাগা বগা চলে গেছে। কাজেই সেই মাঝিটা বৈঠা নিয়ে হালে বসল। এতক্ষণ আয়েশ করে তামাক টানছিল সে।

দেখতে দেখতে বেবাজিয়াদের নৌকোগুলো গাঢ় অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

একসময় অবনীমোহন বললেন, অদ্ভুত মানুষ তো!

হেমনাথ হাসলেন, হ্যাঁ—

হঠাৎ বিনু বলে উঠল, দাদু, বেবাইজা কাকে বলে?

অবনীমোহনও তাড়াতাড়ি বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, বেবাইজা কী?

হেমনাথ বললেন, শব্দটা বেবাইজা না, বেবাজিয়া। মানে বেদে। জিপসি।

বিনু বই-পড়া বিদ্যে থেকে বলল, জিপসিরা তো হেঁটে হেঁটে বেড়ায়, তাঁবুতে থাকে। নৌকোয় করে ঘোরে নাকি?

দাদাভাই, এ দেশটা তো জলের দেশ। এখানে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াবে কোথায়? তাই নৌকোয় করে ঘুরতে হয়।

বিনু আর কিছু বলল না। বার বার তার মনে হতে লাগল, হরিন্দ আর কাগা বগার মতো সে-ও যদি বেদেদের নৌকোয় নদীতে নদীতে ঘুরে বেড়াতে পারত!

অন্ধকারে আশ্বিনের পরিপূর্ণ নদী অথবা জলে-ভরা প্রান্তরের ওপর দিয়ে নৌকো চলেছে। এখন কত রাত, কে জানে। একটানা জলের আঘাতে নৌকোর তলায় ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে।

এখন বেশ হাওয়া দিয়েছে। জলের মাঝখানে বাতাস বেশ ঠাণ্ডা, গায়ে লেগে শিরশির করছে।

সেই সকাল থেকে ঘোরের ভেতর যেন ছুটছিল বিনু। চান নেই, ভাত খাওয়া নেই, বিশ্রাম নেই। বারো বছরের জীবনে গোটা একটা দিন এভাবে আর কখনও ছোটাছুটি করে বেড়ায় নি সে।

অনেক আগেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বিনু। কিন্তু পাখি, যুগলের সেই বোন, সাঁকোর বাঁশে বসে কালো ছেলেদের বড়শি বাওয়া, সুজনগঞ্জের হাট, ঢেঁড়া-দেওয়া, লারমোরের রোগী দেখা, বুধাই পাল, হরিন্দ, দামড়া মোষের মতো তার দুই ঢাকী, মিষ্টির দোকানে বসে ধবধবে মাঠা খাওয়া, বেবাজিয়াদের বহর–অসংখ্য মানুষ আর অগণিত ঘটনা ক্লান্তির কথা তাকে বুঝতে দেয় নি। এক উত্তেজনা থেকে আরেক উত্তেজনা, এক কৌতূহল থেকে আরেক কৌতূহল তাকে অবিরাম ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। চোখ টান করে অপার বিস্ময়ে সে শুধু দেখে গেছে, কান পেতে শুনে গেছে।

হরিন্দরা বেবজিয়াদের নৌকোয় উঠবার পর আর বসে থাকতে পারল না বিনু। হাজারো বিস্ময় যে ক্লান্তিকে দূরে ঠেলে রেখেছিল, এবার তারা লম্বা লম্বা পা ফেলে তাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করল। হাত-পা যেন আলগা হয়ে যেতে লাগল বিনুর। জলের একটানা ছপছপানি শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ল সে।

ঘুমের ভেতরেই বিনু টের পেল, বাড়ি ফিরেছে। ঘুমোতে ঘুমোতেই দাদুর সঙ্গে বসে খেল। খেতে খেতে দু’একবার ঝিনুকের নাম কানে এল। তখুনি তার মনে পড়ে গেল, সকালবেলা যখন সুজনগঞ্জের হাটে যায়, ঘোড়ার গাড়ি করে ঝিনুককে আসতে দেখেছে। ঘুম চোখেই আলোর ছোটাছুটি দেখল সে, স্নেহলতা-শিবানী সুরমা আর সুধা-সুনীতির গলা শুনতে পেল। ওরা কী বলছে তা অবশ্য বুঝতে পারল না।

তারপর রাত্রিবেলা হেমনাথের কাছে শুয়ে তার বুকে হাত রাখতেই বিনু টের পেল, একটা চুড়ি পরা ছোট হাত তার হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে।

গভীর ঘুমে ডুবে যেতে যেতে বিনুর মনে হল, কচি হাতখানা ঝিনুকের। হেমনাথের ভাগ নিয়ে ঘুমের ভেতরই কি মেয়েটা হিংসে শুরু করে দিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *