প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.০৭ ঘুমটা ভাঙে নি

ভোরবেলা, তখনও ভাল করে ঘুমটা ভাঙে নি, আধো তরল তন্দ্রার ভেতর আছন্ন হয়ে আছে বিনু। সেই সময় স্তবপাঠের মতো একটানা সুরেলা আওয়াজ ভেসে এল।

কণ্ঠস্বরটা খুবই চেনা, কিন্তু কোথায় শুনেছে এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না বিনু। সুরটা খুব ভাল লাগছে। আস্তে আস্তে চোখ মেলল সে।

এখনও রোদ ওঠে নি। চারদিক আবছা আবছা অন্ধকার আলতোভাবে সব কিছুকে ছুঁয়ে আছে।

সময়টা দিনের কোন অংশ–ভোর না সন্ধে, ঠিক বুঝতে পারল না বিনু। পাশ ফিরতেই বড় একটা জানালা চোখে পড়ল। তার ভেতর দিয়ে উঠোন দেখতে পেল বিনু। উঠোন পেরিয়ে বাগান, বাগানের পর যা কিছু এই মুহূর্তে সমস্ত ঝাঁপসা, নিরবয়ব। উত্তর থেকে দক্ষিণ থেকে জোর বাতাস দিচ্ছে, উলটোপালটা হাওয়ায় বাগানের বড় বড় ঝুপসি গাছগুলো বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়াচ্ছে। আকাশের এ প্রান্তে সে প্রান্তে থোকা থোকা সাদা মেঘ রাজহাঁসের মত ধীর মন্থর গতিতে ভেসে চলেছে।

প্রথমটা বিনু বুঝেই উঠতে পারল না, সে এখন কোথায়। কলকাতায় যে বাড়িতে তারা থাকত তার পাশেই ছিল বড় বড় বাড়ি আর কিছু ঘিঞ্জি বস্তি। বস্তিগুলোর মাথায় টালি আর খাপরার ছাউনি। সকালবেলা চোখ মেললেই বিনুরা দেখতে পেত, বস্তিগুলো নিশ্চল ঢেউয়ের মতো দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে আছে। আর কানে আসত কদর্য চিৎকার। ভোর হতে না হতেই কুৎসিত কলহ শুরু হয়ে যেত, তার মেয়াদ মাঝরাত পর্যন্ত।

কিন্তু এখানে? স্তবপাঠের সেই মনোরম সুরেলা শব্দটা এখনও কানে আসছে। বিনুর মনে হল, এসব সত্যি নয়। কেউ যেন ঘুমঘোরে তাকে সুদুর মেঘময় আকাশের নিচে বাগান, গাছপালা, আবছা অন্ধকার আর স্তব উচ্চারণে গম্ভীর মধুর সুরের ভেতর ফেলে দিয়ে গেছে।

চিরদিন মা-বাবার কাছে শোবার অভ্যাস বিনুর। হঠাৎ তার খেয়াল হল, বিছানায় মাও নেই, বাবাও নেই। ধড়মড় করে উঠে বসল বিনু। তক্ষুনি চোখে পড়ে গেল, উঠোনের পুব দিকটা একেবারে খোলা, সেখানে যুক্তকরে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে স্তব পাঠ করছেন হেমনাথ। ‘জবাসকুসুম সঙ্কাশ’ ‘মহাদ্যুতিম’, দিবাকরম’ ইত্যাদি দু’চারটে শব্দ ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

হেমনাথকে দেখামাত্র বিদ্যুৎচমকের মতো সব মনে পড়ে গেল। কাল তারা রাজদিয়া এসেছে। স্নেহলতা-শিবানী যুগল-হিরণ-মজিদ মিঞা-পর পর অনেকগুলো মুখ ছবির মতো চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল। আর মনে পড়ল ঝিনুককে। দুঃখী মেয়েটার জন্য এক মুহূর্ত মনটা ভারী হয়ে রইল। এক মুহূর্ত। নদীর জলে উড়ন্ত পাখির ছায়ার মতো ঝিনুকের মুখ মনে পড়েই মিলিয়ে গেল।

আরও একটা কথা মনে পড়ল বিনুর। কাল রাত্রিতে সে দাদুর কাছে শুয়েছিল। যাই হোক, এখন কী করবে ভেবে উঠতে পারল না। একবার ইচ্ছে হল, হেমনাথের কাছে যায়। পরক্ষণেই মনে হল, এ সময় তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

শরতের এই ভোরের হাওয়া বেশ ঠান্ডা, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। পায়ের দিকে পাট করা একটা পাতলা চাদর ছিল, সেটা তুলে এনে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে বসে রইল বিনু।

একটু পর স্তবপাঠ শেষ হল। পুব দিকে তাকিয়ে আসন্ন সূর্যোদয়ের উদ্দেশে প্রণাম করে ফিরে এলেন হেমনাথ। বিনুকে বসে থাকতে দেখে ভারি খুশি। উচ্ছ্বসিত সুরে বললেন, দাদাভাই উঠে পড়েছ?

বিনু মাথা নাড়ল।

তুমি তো বেশ তাড়াতাড়ি ওঠো।

এত ভোরে অবশ্য কোনওদিনই ওঠে না বিনু। যেহেতু তাড়াতাড়ি ওঠাটা রীতিমতো গৌরবের ব্যাপার, আর হেমনাথ যখন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছেন, তখন এটা মেনে নেওয়া ভাল। বিনু এবারও মাথা নাড়ল। তারপর বলল, তুমি গানের মতো করে কী বলছিলে?

সূর্যস্তব করছিলাম।

ভারি সুন্দর তো।

সাগ্রহে হেমনাথ বললেন, তুমি শিখবে?

বিনু বলল, শিখব।

কাল থেকে এইরকম ভোরে উঠো, দু’জনে উঠোনের ওই কোণটায় গিয়ে দাঁড়াব। তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গে বলে যাবে। দু’দিনেই শিখে ফেলতে পারবে।

আচ্ছা– বলেই যেন জিভে কামড় খেল বিনু। আজকের মতো দু’একদিন নয়, কাল থেকে আবার রোজ নিয়মিত ভোরবেলায় উঠতে হবে। ঝোঁকের মাথায় রাজি হয়ে কী বিপদেই না পড়া গেল!

হেমনাথ বললেন, যাও দাদা, মুখ টুখ ধুয়ে নাও।

চাদর গায়ে বেরিয়ে এল বিনু। এর মধ্যে আলো ফুটে গেছে। ধানখেত আর বনানীর ওপারে দূর দিগন্তে সূর্যের ঝিকিমিকি টোপরটি আস্তে আস্তে দেখা দিতে শুরু করেছে।

বাইরে এসে বিনু দেখতে পেল, সবাই উঠে পড়েছে। সুধা সুনীতি অবনীমোহন সুরমা শিবানী স্নেহলতা, সব্বাই। স্নেহলতা তো এর ভেতর স্নানই চুকিয়ে ফেলেছেন। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে আবার দাদুর কাছে ফিরে এল বিনু।

কাল স্টিমারঘাট থেকে বাড়ি আসতে যা একটু সঙ্গ পেয়েছে বিনু, তারপর সারাটা দিন তো কেতুগঞ্জেই কাটিয়ে এলেন হেমনাথ। রাত্রিবেলা যখন ফিরলেন তখন মজিদ মিঞারা সঙ্গে রয়েছে। খাওয়া দাওয়া গল্পগুজবের পর অবশ্য হেমনাথকে একেবারে একলা পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু তখন অনেক রাত, আর বিনুর চোখও ঘুমে জড়িয়ে আসছিল।

বিনুর খুব ইচ্ছা, এই সকালবেলা দাদুর সঙ্গে বসে বসে অনেকক্ষণ গল্প করে, কিন্তু সে সুযোগ মিলল না। তার আগেই রান্নাঘরে ডাক পড়ল।

রান্নাঘরটা প্রকান্ড, রাঁধাবাড়া ছাড়াও অনায়াসে পনের কুড়ি জন লোক বসে খেতে পারে। সারি সারি পিঁড়ি পাতা ছিল। হেমনাথের সঙ্গে এ ঘরে এসে বিনু দেখতে পেল, ইতিমধ্যে অন্য সবাই এসে গেছে। তারা বসে পড়তেই স্নেহলতা আর শিবানী খেতে দিতে শুরু করলেন।

কাল রাত্তিরে প্রচুর মিষ্টি এনেছিল মজিদ মিঞারা। সকালে স্টিমারঘাট থেকে হেমনাথ যে রসগোল্লা আর কলা এনেছিলেন তার অনেকটাই থেকে গেছে। তা ছাড়া, স্নেহলতা গাওয়া ঘিয়ের লুচি তরকারি আর হালুয়া করেছেন।

খেতে খেতে হেমনাথ বললেন, মজিদ মিঞাকে কাল কিরকম দেখলে অবনী?

অবনীমোহন বললেন, চমৎকার। এমন সরল ভালমানুষ জীবনে আর কখনও দেখি নি। শুধু আমাদের দেখবার জন্যে রাত্তিরে কেউ এতখানি পথ আসতে পারে, নিজের চোখে না দেখলে কোনও দিন বিশ্বাস করতাম না।

গভীর আবেগের সুরে হেমনাথ বললেন, এখানকার প্রায় সব মানুষই ওই রকম। সরল, ভাল। কিন্তু খেপে গেলে রক্ষে নেই।

অবনীমোহন হাসলেন।

খানিক চুপ করে থেকে হেমনাথ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন, কাল সারাদিন কেতুগঞ্জেই কেটে গেছে। তোমাদের সঙ্গে বসে দু’টো কথা বলতে পারি নি। আজ আমি ফ্রি–একেবারে মুক্ত। চল–

স্নেহলতা নাক কুঁচকে কেমন করে যেন বললেন, তুমি মুক্ত! তবেই হয়েছে। দেখ, আবার কোন হাঙ্গামা এসে জোটে!

যাই জুটুক, আমি কোনও দিকে তাকাচ্ছি না। আজকের দিনটা নাতি-নাতনী-মেয়ে-জামাই নিয়ে হই হই করে কাটাব।

সঙ্কল্পটা ভালই।

হেমনাথ এবার অবনীমোহনকে বললেন, কাল সমস্ত দিন তো ঘরে বসে ছিলে। খাওয়াদাওয়া হলে চল একটু ঘুরে আসি। আমাদের রাজদিয়াটা তোমাদের দেখিয়ে আনি।

সাগ্রহে অবনীমোহন বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।

হেমনাথ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। হঠাৎ তার কী মনে পড়ে গেছে। বেশ ব্যস্তভাবেই বললেন, হই-হট্টগোলের ভেতর ঝিনুকের কথা খেয়াল ছিল না। সে কোথায়?

স্নেহলতা বললেন, ওর বাবা কাল নিয়ে গেছে।

ভবতোষ ঢাকা থেকে ফিরেছে তা হলে?

হ্যাঁ।

বৌমাকে রেখেই এল?

হ্যাঁ। স্নেহলতা বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়লেন। স্ত্রীর রেখে আসার কারণ হিসেবে ভবতোষ কাল যা যা বলে গিয়েছিলেন, সব জানালেন।

তিক্ত সুরে হেমনাথ বললেন, নিজেরা খাওয়াখাওয়ি করে মরছে। মাঝখান থেকে ঝিনুকটার জীবন নষ্ট হয়ে গেল।

কেউ আর কিছু বলল না। বিচিত্র কষ্টদায়ক নীরবতার মধ্যে সকলের খাওয়া শেষ হল। ঝিনুকের প্রসঙ্গ এলেই এ বাড়িতে ঘন হয়ে বিষাদের ছায়া নামে।

খাওয়ার পর হেমনাথ বললেন, চল অবনী, এবার বেরিয়ে পড়া যাক। তোরা কে কে যাবি? বিনুদাদা নিশ্চয়ই যাবে। সুধাদিদি সুনীতিদিদি, তোরা যাবি তো?

সুধা সুনীতি, দু’জনেই ঘাড় কাত করল, অর্থাৎ যাবে।

রমুর গিয়ে দরকার নেই। অনেকখানি হাঁটতে হবে। দুর্বল মানুষ। অত হাঁটাহাঁটি করলে শরীর খারাপ হবে। এক কাজ করলে হত, ভবতোষ কী লালমোহনের ফিটনখানা আগে থেকে চেয়ে রাখলে পারতাম। কাল মনে পড়ে নি। সে যাক গে, পরে গাড়ি ঠিক করে রমুকে একদিন ঘুরিয়ে আনব।

একসময় হেমনাথরা বেরিয়ে পড়লেন। উঠোন বাগান পেরিয়ে শহরগামী সেই পথটায় আসতেই মনে হল, আশ্বিনের এই চমৎকার উজ্জ্বল সকালটা সামনের দিকে অবিরত হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। এই পথটা ছাড়া রাজদিয়ার আর কিছুই মাথা তুলে নেই, প্রায় সবই জলের তলায় ডুবে আছে।

দু’ধারে কালকের সেই পরিচিত দৃশ্য। মাছরাঙা, বাঁশের সাঁকো, নিস্তরঙ্গ জল, মাঝে মাঝে ছাড়া ছাড়া বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাড়িঘর, গলানো গিনির মতো রোদ। কথা বলতে বলতে সেই কাঠের পুলটাও পেরিয়ে এল সবাই।

পথ নির্জন নয়। লোক চলাচলে বেশ সরগরমই বলা যায়। যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে, ডেকে ডেকে হেমনাথের সঙ্গে কথা বলছে। বিনুরা যে কলকাতা থেকে এসেছে, সে খবর রাজদিয়ার কারোর জানতে বোধ হয় বাকি নেই। বিনুরা কত দিন থাকবে, এতকাল কেন আসে নি, ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন করছে তারা। হেমনাথ উত্তর দিচ্ছেন, অবনীমোহনের সঙ্গে আলাপ টালাপও করিয়ে দিচ্ছেন।

নানা মানুষের কৌতূহল মেটাতে মেটাতে, নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে সবাইকে নিয়ে হেমনাথ যখন স্টিমারঘাটের কাছাকাছি পৌঁছলেন, পুব আকাশের ঢাল বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। হোগলা-ছাওয়া সেই মিষ্টির দোকানগুলো থেকে ডাকাডাকি শুরু হয়ে গেল, আসেন বড়কত্তা, ভাল মিঠাই আছে। মাইয়া-জামাই-নাতি-নাতনীগো লেইগা লইয়া যান।

মৃদু হেসে হেমনাথ জানালেন, আজ মিষ্টির দরকার নেই।

একটা ব্যাপার লক্ষ করেছে বিনু, বাড়ি থেকে স্টিমারঘাটে আসতে যত লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে সবাই হেমনাথকে বড়কত্তা’ বলেছে।

অবনীমোহন হাসতে হাসতে বললেন, আমরা এসেছি, একথা দেখছি সবাই জানে। দোকানদারদের কাছেও খবরটা পৌঁছে গেছে।

হেমনাথ হাসলেন, এখানকার মানুষ আমাকে খুব ভালবাসে, স্নেহ করে। আমার সংসারের খুঁটিনাটি সমস্ত খবর ওদের জানা।

হেমনাথের বাড়ি থেকে স্টিমারঘাট পর্যন্ত রাস্তাটা চেনা। পথটা ওখানেই শেষ নয়, স্টিমারঘাট ছুঁয়ে সেটা অর্ধবৃত্তের আকারে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে নিরুদ্দেশ হয়েছে। হেমনাথ বিনুদের নিয়ে সেদিকে চললেন।

ঘাড় ফিরিয়ে বিনু একবার দেখে নিল, কালকের সেই স্টিমারটা নেই। জেটির বাঁধন খুলে কখন কোথায় পাড়ি জমিয়েছে, কে জানে। খুব সম্ভব কলকাতায় চলে গেছে। তবে কালকের সেই শঙ্খচিলগুলো চোখে পড়ল, আকাশময় তারা চক্কর দিয়ে চলেছে।

স্টিমারঘাটের পর নৌকাঘাটটা কালই চোখে পড়েছিল। তারপর একটা বরফ-কল আর সারি সারি মাছের আড়ত। হেমনাথ জানালেন, এখান থেকে কাঠের পেটিতে পরত পরত বরফের ভেতর শুয়ে রোজ শত শত মণ মাছ কলকাতায় চালান যায়। আড়তগুলোর ঠিক তলাতেই নদী। বিনুরা দেখতে পেল অসংখ্য জেলে নৌকো আসছেই, আসছেই। এখানকার বাতাস আঁশটে গন্ধে ভারী আর নিশ্চল হয়ে আছে।

আড়তগুলোর দিকে মুখ ফিরিয়ে হেমনাথ চেঁচিয়ে বললেন, তাজা ইলিশ আছে?

তক্ষুণি সাড়া পাওয়া গেল, আছে বড়কত্তা।

দর কী?

দরের লেইগা আটকাইব না। কয়টা লাগব ক’ন।

দাম না বললে নেব না।

সব থিকা সেরাটা ট্যাকায় ছয়টা।

তিনটে রাখিস, যাবার সময় নিয়ে যাব।

আইচ্ছা।

কাল রসগোল্লার দাম শুনে অবাক হয়েছিলেন অবনীমোহন, আজও হলেন মাছের দর শুনে। তার বিস্ময়-মাখানো মুখের দিকে তাকিয়ে হেমনাথ বললেন, এ হল জলের দেশ। মাছ এখানে শস্তা তো হবেই। কলকাতায় চালান না গেলে টাকায় একশ’টা করে ইলিশ বিক্রি হত।

আড়ত পেরিয়ে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। হেমনাথের বাড়ির দিকে রাস্তাটা খানিক খোয়ায় ঢাকা, বাকিটা কৌলীন্য হারিয়ে সোজা মাটিতে নেমে গেছে। এদিকটা কিন্তু লাল সুরকিতে ছাওয়া।

তার একদিকে নদী, আরেক ধারে সারিবদ্ধ ঝাউগাছ। রাস্তাটা চলেছে তো চলেইছে।

সুধা বলল, কী চমৎকার জায়গা! আমরা কিন্তু এখানে রোজ বিকেলে বেড়াতে আসব দাদু–

হেমনাথ বললেন, বেশ তো।

ঝাউগাছ যেদিকে, সেদিকটাও মনোরম। বর্ষার জলে প্রায় সবটাই ডুবে আছে। তবু তারই ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলো পাকা বাড়ি চোখে পড়ল। শুধু তা-ই নয়, এস.ডি.ও’র বাংলো, দেওয়ানি আর ফৌজদারি আদালত, আর.এস.এন কোম্পানির অফিস, রেজিস্ট্রেশন অফিস, ল্যান্ড অ্যান্ড ল্যান্ড রেভেনিউ অফিস, মেয়েদের একটা হাইস্কুল, ছেলেদের দু’টো, এমনকি ডিগ্রি কলেজও রাজদিয়ার এই প্রান্তে ছড়িয়ে আছে। ওদিকের তুলনায় এদিকটা অনেক বেশি জমজমাট। জীবনের চেহারা এখানে অনেকখানি নিবিড়, ঘনবদ্ধ।

ওদিকটার মতো এখানেও হেমনাথ বড়কত্তা। কারও সঙ্গে দেখা হলেই বিনুদের সম্বন্ধে সেই এক প্রশ্ন, হেমনাথের সেই এক উত্তর। সকলের কৌতূহল মেটাতে মেটাতে তারা এগিয়ে চলেছেন।

অবনীমোহন বললেন, ওধারের তুলনায় এধারে লোজন বোধহয় বেশি।

তা একটু বেশি। হেমানাথ বলতে লাগলেন, তবে এখন যতটা দেখছ এতটা কিন্তু বছরের অন্য সময় থাকে না।

দু’চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন অবনীমোহন।

হেমনাথ এবার বুঝিয়ে বললেন। সমস্ত বছর রাজদিয়ায় বেশির ভাগ বাড়ি প্রায় ফাঁকাই পড়ে থাকে। দু’চারটে বুড়োবুড়ি আর জীবন থেকে বাতিল কিছু অথর্ব মানুষের মুখ তখন দেখা যায়। কেননা বাড়ির সক্ষম, সাবালক ছেলেরা সেসময় এখানে থাকে না, চাকরি বাকরি বা অন্য কোনও জীবিকার টানে তাদের কেউ তখন আসামে, কেউ ঢাকায়, কেউ কেউ হিল্লি-দিল্লিতেও। তবে সব চাইতে বেশি যেখানে তার নাম কলকাতা।

ছেলেরা বিদেশে চাকরি করবে, মেস কি হোটেলের ঝাল-মশলাওলা অখাদ্য খেয়ে অকালে পাকস্থলীটির স্বত্ব আমাশা কি অম্লশূলের হাতে তুলে দেবে, তা তো আর হয় না। কাজেই বাপ মা ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌমাটিকে সঙ্গে পাঠিয়ে দেন। ঘরের রান্না খেয়ে পেটটা অন্তত বাঁচুক, নাতি নাতনী হলে তাদের কাছেই থাকে। বাপ-মা অবশ্য ছেলেদের কাজের জায়গায় গিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তারা গেলে দেশের বাড়িঘর জমিজমা বাগানপুকুর দেখবে কে? যখের মতো পূর্বপুরুষের সম্পত্তি আগলে থাকবে কে?

সারা বছর রাজদিয়ায় ঢিমে তালের সুর লেগে থাকে। জীবন তখন মন্থর, ঘুমন্ত, নিষ্প্রভ। তিরতিরে স্রোতের মতো তাতে বেগ হয়তো থাকে, কিন্তু টের পাওয়া যায় না। তারপর আশ্বিন মাসটি যেই পড়ল, আকাশে বাতাসে ছুটির সানাইও বাজল, নদীর ধারে কাশফুলের বন ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল আর রোদের রংটি হয়ে গেল গলানো সোনার মতো। সেই সময় রাজদিয়ার গায়ে সোনার কাঠির ছোঁয়া লেগে যায়। জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঢলের মতো দূর দূরান্ত থেকে দুর্বার আকর্ষণে ছেলেরা ফিরে আসে। পূর্ব বাংলার এই তুচ্ছ নগণ্য শহরটা সারা বছর প্রবাসী সন্তানগুলির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। তাদের ফিরে পেয়ে খুশি আর ধরে না। রাজদিয়া জুড়ে তখন প্রমত্ত উৎসব শুরু হয়ে যায়। তারপর পুজো যেই শেষ হল, ছুটির মেয়াদ ফুরো, ধীরে ধীরে রাজদিয়াকে অপার শূন্যতার ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে একে একে সবাই গিয়ে স্টিমারে ওঠে। ওরা যেন মানস সরোবরের পরিযায়ী পাখি। শরতে আসে, শরৎ ফুরোলেই নিরুদ্দেশ।

রাজদিয়ার মোটামুটি একটা রূপরেখা পাওয়া গেল। হেমনাথ আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, বিনু আস্তে করে ডাকল, দাদু–

হেমনাথ ফিরে তাকালেন কী বলছ দাদাভাই?

বলবে কি বলবে না, খানিক ভেবে নিল বিনু। তারপর দ্বিধান্বিত সুরে জিজ্ঞেস করল, ঝিনুকদের বাড়ি কোথায়?

খানিকটা দূরে। ওই ওদিকে– সামনে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন হেমনাথ।

বিনু চুপ করে রইল।

হেমনাথ আবার বললেন, ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছ দাদাভাই। কাছাকাছি যখন এসেই পড়েছি, চল ওদের একটু খোঁজ নিয়ে যাই।

বিনুর খুব ইচ্ছা হচ্ছিল ঝিনুকদের বাড়ি যায়। ঝিনুক মাছের ভাগ নিয়ে, রসগোল্লার ভাগ নিয়ে, দাদু-দিদার আদরের ভাগ নিয়ে তার সঙ্গে হিংসে করেছিল–সে কথা মনে করে রাখে নি বিনু। তার যা মনে পড়ছিল সেটা হল ঝিনুকের দুঃখ।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝিনুকদের বাড়ি যাওয়া হল না। কয়েক পা যাবার পর হঠাৎ কে যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, হেমদাদা—হেমদাদা–

হেমনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, দেখাদেখি বিনুরাও থামল।

একটু দুরে ঝাউগাছের ফাঁকে হলুদ রঙের দোতলা বাড়ি। সামনের দিকে চমৎকার ফুলের বাগান, বাঁশের বেড়া দিয়ে বাগানখানি ঘেরা। যাতায়াতের জন্য কাঠের ছোট একটি গেট।

গেটের কাছে হেমনাথের সমবয়সী কি দু’চার বছরের ছোট একটি বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে ছিলেন। হেমনাথের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তিনি হাতছানি দিলেন।

পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন হেমনাথ, বিনুও সঙ্গে সঙ্গে গেল। অবনীমোহনরা অবশ্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

কাছে আসতেই উচ্ছ্বসিত খুশির গলায় বৃদ্ধ বললেন, শিশিররা এসেছে।

বৃদ্ধের উচ্ছ্বাস এবং আনন্দ হেমনাথের স্বরেও যেন উছলে পড়ল। বললেন, তাই নাকি? কবে?

পরশুর স্টিমারে।

কেমন আছে সব?

ভাল। বলতে বলতে সচেতন হলেন যেন বৃদ্ধ। বিনুর দিকে তাকিয়ে শুধোলেন, এটি কে হেমদাদা?

হেমনাথ বললেন, নাতি।

নাতি! বৃদ্ধ একটু যেন অবাকই হলেন।

হেমনাথ বললেন, হ্যাঁ, আমার ভাগনীর ছেলে। অবনীমোহনদের দেখিয়ে বললেন, ওই যে জামাই আর দুই নাতনী।

বৃদ্ধ এবার ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, ওদের ডাকো হেমদাদা। তুমি ডাকবে কেন, আমিই ডেকে আনছি। তিনি পা বাড়িয়ে দিলেন।

হেমনাথ বললেন, এখন থাক রামকেশব–

বৃদ্ধের নাম তা হলে রামকেশব। তিনি বললেন, তাই কখনও হয়, নাতি-নাতিনী-জামাই নিয়ে ঘরের দরজা পর্যন্ত আসবে, ভেতরে ঢুকবে না, প্রাণ থাকতে আমি তা হতে দেব না।

রামকেশব ছুটে গিয়ে অবনীমোহনদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। তারপর সাদরে সবাইকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রামকেশব হইচই বাধিয়ে দিলেন, কই গো, কোথায় গেলে সব–শিশির, বৌমা–দেখ দেখ, কাদের নিয়ে এসেছি।

একজন সধবা প্রৌঢ়া-কপালে ডগডগে সিঁদুরের টিপ, পিঠময় কাঁচাপাকা চুলের স্তূপ, পরনে খয়েরি-পাড় শাড়ি, স্নেহলতার সমবয়সীই হবেন–ডান পাশের একখানা ঘর থেকে বেরিয়ে রামকেশবের সঙ্গে নতুন মানুষ দেখে খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

রামকেশব বললেন, হেমদাদার ভাগনীজামাই আর নাতি-নাতনী

তাড়াতাড়ি কপাল পর্যন্ত ঘোমটা টেনে সস্নেহে, মৃদু স্বরে প্রৌঢ়া ডাকলেন, এস দাদা দিদিরা–

রামকেশব শুধোলেন, শিশির, বৌমা–ওরা সব কোথায়?

দক্ষিণের ঘরে।

একটু ভেবে রামকেশব বললেন, আমরা বরং দক্ষিণের ঘরেই যাই। তুমি এদের জন্যে– বলতে বলতে তিনি থেমে গেলেন।

ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন প্রৌঢ়া। অতিথিদের আপ্যায়নের কথা বলেছেন রামকেশব। তিনি বললেন, ঠিক আছে।

রামকেশবের সঙ্গে দক্ষিণের ঘরে এসে দেখা গেল, একটি সাতাশ আটাশ বছরের সুপুরুষ তরুণকে ঘিরে আসর বসেছে। লোকজন বেশি নেই, আধ-প্রৌঢ় একজন ভদ্রলোক, বছর বার’র একটি মেয়ে, সতের আঠার বছরের একটি তরুণী আর পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছরের এক মহিলা-সব মিলিয়ে পাঁচজন। মহিলা তরুণী এবং ছোট মেয়েটি এমন সাজগোজ আরা প্রসাধন করে বসে আছে যা চোখে বেঁধে। তাদের জামাকাপড় থেকে সেন্টের গন্ধ চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে।

তরুণটি হাত-পা-মাথা নেড়ে রোমাঞ্চকর কিছু বলছে, আর মুগ্ধ বিস্ময়ে সবাই শুনছে। রামকেশবরা ঘরে ঢুকতেই গল্প থেমে গেল।

আধা প্রৌঢ় সেই ভদ্রলোকটি তাড়াতাড়ি উঠে এসে হেমনাথকে প্রণাম করলেন।

হেমনাথ বললেন, কেমন আছিস শিশির?

ভাল। শিশির বললেন, আপনি ভাল আছেন তো? জ্যাঠাইমা কেমন আছেন?

আমরা গাঁইয়া মানুষ, কখনও খারাপ থাকি না। তোমরা শহরের লোক, পিপল অফ দি মেট্রোপলিস। তোমাদের আজ পেট ভুটভাট, কাল কান কটকট, পরশু বুক ধড়ফড়। আমাদের ওসব বালাই নেই। সে যাক, রামকেশবের কাছে শুনলাম, পরশু তোরা এসেছিস। কাল সারাটা দিন গেছে মাঝখানে, একবার আমাদের ওখানে যেতে পার নি?

অপরাধীর মতো মুখ করে শিশির বললেন, আজ যাব ভেবেছিলাম।

শিশিরের পর সেই মহিলাটি এসে প্রণাম করলেন। হেমনাথ বললেন, বেঁচে থাকো স্মৃতিরেখা। বলতে নেই, তোমার স্বাস্থ্য গেল বারের চাইতে অনেক ভাল হয়েছে। শিশিরটা তো চিরকালের খ্যাপা বাউল, সংসারের কোনও দিকে ওর খেয়াল নেই। যাক, তোমার দিকে ও এবার নজর দিয়েছে দেখছি।

জানা গেল, মহিলার নাম স্মৃতিরেখা এবং তিনি শিশিরের স্ত্রী।

স্মৃতিরেখার পর কম বয়সের মেয়েটি আর তরুণীটি এসে প্রণাম করল। দু’জনকে পায়ের কাছ থেকে তুলে হেমনাথ বললেন, আমার রুমাদিদি ঝুমাদিদি না?

রুমা ঝুমা দুজনেই মাথা নাড়ল। বোঝা যাচ্ছে, এ বাড়ির সবাইকেই চেনেন হেমনাথ। বললেন, তোমরা দু’জন। সুধা সুনীতিকে দেখিয়ে বললেন, আর ওরা দু’জন। এত বেগম নিয়ে কী যে করি! ভাবছি বাদশাদের মতো একটা হারেম খুলব।

সবাই মুখ টিপে হাসতে লাগল।

আবার কী বলতে যাচ্ছিলেন হেমনাথ, হঠাৎ তার নজর গিয়ে পড়ল সেই যুবকটির ওপর। বললেন, একে তো চিনতে পারলাম না রামকেশব।

রামকেশব বললেন, ও আনন্দ-শিশিরের শালা। কলকাতাতেই থাকে। গেল বছর ল’ পাস করেছে। ওর বাবার সঙ্গে কোর্টে যাচ্ছে। এখন ছুটি। তাই বৌমার সঙ্গে পুজোয় বেড়াতে এসেছে।

হেমনাথ বললেন, খুব ভাল।

এই সময় আনন্দ উঠে এসে হেমনাথকে প্রণাম করল। রামকেশব আনন্দর উদ্দেশে বললেন, ইনি শ্ৰীহেমনাথ মিত্র, গোটা রাজদিয়ার অভিভাবক বলতে পার।

আনন্দ চুপ করে থাকল।

রামকেশব এবার হেমনাথকে বললেন, জানো হেমদাদা, আমাদের আনন্দ বাবাজির খুব শিকারের শখ। অনেক বাঘ টাঘ মেরেছে।

তাই নাকি?

বিনু এর আগে শিকারি দেখে নি। চোখ বড় করে আনন্দর দিকে তাকিয়ে রইল। লক্ষ করল, সুনীতিও অবাক বিস্ময়ে আনন্দকে দেখছে। সুধা ওদিকটায় অবনীমোহনের আড়ালে বসে ছিল। সে আনন্দকে দেখছে কিনা, বুঝতে পারা গেল না।

হেমনাথ অবনীমোহনদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আলাপ টালাপ হলে বললেন, অনেক বেলা হল, এবার আমরা উঠি।

রামকেশব বললেন, তাই কখনও হয়! জামাই নিয়ে প্রথম দিন এলে, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে ছাড়তে পারি? শিশিরের মা তা হলে আমার গর্দান নিয়ে নেবে।

তবে আর কী করা, বসেই যাই।

একটু নীরবতা। তারপর স্মৃতিরেখার চোখে চোখ রেখে হেমনাথ বললেন, আমরা এসে তোমাদের জমাটি আসরটি নষ্ট করে দিলাম।

স্মৃতিরেখা বললেন, ও মা, সে কি কথা!

হেমনাথ বললেন, আনন্দ হাত-পা নেড়ে কী যেন বলছিল, তোমরা খুব মন দিয়ে শুনছিলে। আমার আসতেই বেচারি থেমে গেল। কী বলছিল আনন্দ?

সেই তরুণীটি, যার নাম রুমা, বলল, মামা সেবার সুন্দরবনে বাঘ মারতে গিয়েছিল। সেই গল্প করছিল।

হেমনাথ উৎসাহিত হলেন। আনন্দকে বললেন, আপত্তি না থাকে, আরেক বার বল না। আমরা একটু শুনি।

লাজুক হেসে আনন্দ বলল, আপনাদের কি ভাল লাগবে?

লাগবে, নিশ্চয়ই লাগবে। আমাদের খুব বেরসিক ভাবছ নাকি?

বাঘ শিকারের রোমাঞ্চকর গল্প আরম্ভ হল।

বিনু চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। মাঝে মাঝে লক্ষ করতে লাগল, সুনীতিও অপার বিস্ময় নিয়ে আনন্দর দিকে তাকিয়ে আছে।

গল্প শুনতে শুনতে হঠাৎ বিনুর মনে হল, কে যেন ফিসফিস করে ডাকছে, এই–এই

চোখ ফিরিয়ে বিনু দেখতে পেল, সেই ছোট মেয়েটা–যার নাম ঝুমা। গায়ের রংখানি শ্যামলা। নাক-মুখ-চোখ সেই ক্ষতিটুকু যোল আনার জায়গায় আঠার আনা পূরণ করে দিয়েছে। এমন নিখুঁত ধারাল গড়ন কদাচিৎ দেখা যায়। গায়ের হলুদ রঙের ফ্রক, মাথার গোলাপি রিবন কিংবা চোখে কাজলের টান ভারি চমৎকার মানিয়েছে।

বিনুর ধ্যানজ্ঞান এখন বাঘ শিকারের দিকে। অন্যমনস্কের মতো বলল, কী বলছ?

তুমি লুডো খেলতে পার?

পারি।

ক্যারম?

তাচ্ছিল্যের সুরে বিনু বলল, নিশ্চয়ই।

ঝুমা বলল, এয়ার গান চালিয়ে পাখি মারতে পার?

এবার বিনুকে একটু থতিয়ে যেতে হল।

ঝুমা বলল, তুমি পার না, আমি কিন্তু পারি।

যার মামা বাঘ মারতে পারে সে পাখি মারবে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। থতিয়ে যাওয়া। ভাবটা মুহূর্তে কাটিয়ে নিয়ে বিনু বলল, চেষ্টা করলে আমিও পারব।

তা তো জানিই। এমনভাবে ঝুমা বলল, যেন বিনুর কোনও কথা জানতে তার বাকি নেই। এইমাত্র যে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, সে কথা কে বলবে।

বিনু এবার কিছু বলল না।

ঝুমা ফের বলল, আমার একটা ক্যামেরা আছে, জানো। খুব ভাল ছবি ওঠে।

বিনুর কেন জানি এবার মনে হল, ঝুমাকে আর অবহেলা করা যায় না। আধখানা মন বাঘ শিকারের দিকে রেখে বাকি আধখানা মন দিয়ে ঝুমার কথা শুনছিল সে। এবার পুরোপুরি মনোযোগটা এদিকে সঁপে দিতে হল।

ঝুমা বলল, আমার সঙ্গে যাবে?

কোথায়?

ও ঘরে। পাশের ঘরের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দিল ঝুমা।

সেখানে কী?

লুডো ক্যারম এয়ার গান ক্যামেরা–সব আছে।

বাঘ শিকারের কাহিনী যত চমকপ্রদই হোক, বিনুকে ধরে রাখা আর সম্ভব হল না। ঝুমার সঙ্গে সে পাশের ঘরেই চলে যেত, কিন্তু বাধা পড়ল। সেই বর্ষীয়সী সধবা মহিলাটি খাবারের থালা সাজিয়ে ঘরে ঢুকলেন। অগত্যা রসগোল্লা সন্দেশেই মনোনিবেশ করতে হল।

খাওয়া হলে হেমনাথরা উঠে পড়লেন।

ঝুমা ফিসফিসিয়ে বলল, ক্যারম ট্যারম খেলা হল না। আমার এয়ার গান আর ক্যামেরাটা তোমায় দেখাতে পারলাম না। আরেক দিন আসবে কিন্তু–

ঝুমার দুর্লভ সম্পত্তিগুলো দেখা হল না বলে মন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিরস গলায় বিনু বলল, আচ্ছা।

রামকেশবরা হেমনাথকে বললেন, আবার ওদের নিয়ে এস হেমদাদা, ভাগনীকেও এনো৷

আচ্ছা। হেমনাথ বললেন, তোরাও যাস, সবাইকে নিয়ে যাবি।

.

আবার রাস্তা।

হেমনাথ এবং অবনীমোহন আগে আগে হাঁটছিলেন। সুধা সুনীতি আর বিনু একটু পেছনে। চলতে চলতে সুনীতি বললেন, আনন্দবাবু চমৎকার গল্প বলতে পারেন।

চোখ ঠোঁট কুঁচকে কেমন করে যেন হাসল সুধা, হুঁ।

আমার মনে হচ্ছিল, সত্যি সত্যি সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ দেখছি।

তাই নাকি!

কেন, তোর মনে হয় নি?

আমি তো গল্প শুনছিলাম না, তোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে ছিলি! সুনীতি অবাক।

হ্যাঁ। মাথাটা একেবারে ঘাড় পর্যন্ত হেলিয়ে দিল সুধা। ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল, তুই কী করছিলি জানিস দিদি?

ভয়ে ভয়ে সুনীতি শুধলো, কী করছিলাম?

গলার স্বর কাঁপয়ে কাঁপিয়ে সুধা বলল, একেবারে মুগ্ধ, মুগ্ধ হয়ে—

বিব্রত, বিপন্ন সুনীতি ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, তোকে আর ইয়ার্কি দিতে হবে না ফাজিল মেয়ে—

 হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, বড়কত্তা, বড়কত্তা বড়কত্তা—

নিশ্চয়ই হেমনাথ। সবাই চকিত হয়ে উঠল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *