প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
1 of 2

১.০২ স্টিমারঘাটের বাইরে

স্টিমারঘাটের বাইরে আসতেই বিনুরা দেখতে পেল, উঁচু রাস্তার ওপর পর পর দু’খানা ফিটন দাঁড়িয়ে। একটা গাড়ি বেশ নতুন, ঝকঝকে। যে ঘোড়াটা তাকে টানে সেটা চমৎকার। স্বাস্থ্যে আর লাবণ্যে ঝলমল করছে। ঘাড়ের কাছে কেশরগুলো সগর্বে ফুলে আছে। সারা গা বাদামি রঙের চকচকে চিকন লোমে ঢাকা, দেহ মসৃণ। মনে হয়, তেল গড়িয়ে পড়বে। ঘোড়াটা এত চঞ্চল আর সজীব যে এক মুহূর্ত স্থির হয়ে নেই। সমানে পা ঠুকে যাচ্ছে।

অন্য গাড়িটা অনেকদিনের পুরনো। ছাদ, কোচোয়ানের বসবার জায়গা, রেকাব প্রায় সবই ভেঙেচুরে গেছে। গাড়ির মতো তার বাহনটিরও দশা খুবই করুণ। কোমর নেই বললেই হয়। লোম। উঠে উঠে কত জায়গায় যে চামড়া বেরিয়ে পড়েছে! পাঁজরার হাড় একটা একটা করে গুনে নেওয়া। যায়। ঘোড়াটা এত বয়স্ক, নির্জীব আর অবসন্ন যে দাঁড়িয়ে থাকতেও তার বড়ই কষ্ট।

দুখানা গাড়িরই চালকের সিটে লোক বসে আছে। নতুন গাড়ির কোচোয়ানটি যুবক। ছিমছাম চেহারা, চুলের ছাঁট এবং লুঙ্গির নকশা বেশ বাহারি। দ্বিতীয় গাড়িটার জীর্ণতার সঙ্গে মিলিয়ে তার কোচোয়ান বেশ বুড়ো, রুগ্ণ। পরনে নোংরা লুঙ্গি, চিটচিটে গেঞ্জি, কাঁধে ময়লা গামছা।

হেমনাথ বললেন, মালপত্তর সব গাড়িতে তুলে দে।

কুলিরা সিটের ওপরেই দুমদাম বাক্স-প্যাঁটরা ফেলে ভাড়া মিটিয়ে নিয়ে জেটিঘাটের দিকে ছুটল।

হেমনাথ বললেন, ব্যাটারা কেমন ছড়িয়ে রেখে গেল দেখ। লোকে বসে কোথায়? বলে কোল থেকে ঝিনুককে নামিয়ে টানাটানি করে মালপত্র গোছগাছ করতে লাগলেন। অবনীমোহনও তার সঙ্গে হাত লাগালেন।

বাক্স টাক্স সাজিয়ে রাখতে রাখতে হেমনাথ বললেন, হিরণটাকে স্টিমারঘাটে আসতে বলেছিলাম। সে এলে এসব তার ঘাড়েই চাপানো যেত। বাবু বোধহয় আসার কথা ভুলেই গেছে।

সুরমা বললেন, হিরণ কে গো মামা?

দত্তবাড়ির দ্বারিক দত্তর নাতি।

সুরমা আর কিছু জিজেস করলেন না। দ্বারিক দত্তর নাতিকে চিনতে পারেলেন কিনা বোঝা গেল না।

লটবহর সাজানো হলে হেমনাথ বললেন, উঠে পড় সব, উঠে পড়—

নতুন গাড়িটা বেশ বড়সড়। ভেতরে অনেক জায়গা। সুরমা বিনু অবনীমোহন ঝিনুক আর হেমনাথ সেটায় উঠলেন। সুধা সুনীতি অন্যটায়।

গাড়িতে উঠবার পর ঝিনুক হেমনাথের কোলে বসল। তাকে নামাতে চেষ্টা করেও পারলেন না হেমনাথ। তাঁর ভাগ খুব সহজে, বিনা যুদ্ধে আর কাউকে ঝিনুক দেবে, এমন মনে হয় না। ফিটন চলতে শুরু করেছিল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে হেমনাথ চেঁচিয়ে বললেন, বাজারের কাছে গাড়িটা একটু থামাস রসুল–

ওপর থেকে পূর্ববঙ্গীয় টানে কোচোয়ানের গলা ভেসে এল, আইচ্ছা বড়কত্তা–

স্টিমার থেকে বিনুর চোখে পড়েছিল, নদীর ধারটা বাঁধের মতো উঁচু। তার ওপর দিয়ে খোয়া-বিছানো রাস্তা সোজা উত্তরে চলে গেছে। ফিটন দুটো সেই রাস্তা ধরে এখন ছুটছে।

খানিক যাবার পর সুরমার গলা শোনা গেল। আস্তে করে তিনি ডাকলেন, মামা—

হেমনাথ তক্ষুনি সাড়া দিলেন, কী বলছিস রমু?

বিয়ের আগে আমি যখন রাজদিয়া এসেছিলাম তখন তো তোমার ফিটন ছিল না।

না।

কবে কিনেছ?

পা দুটো থাকতে ফিটন কিনতে যাব কোন দুঃখে? হেমনাথ বলতে লাগলেন, তোর নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি চিরকালের পদাতিক। এখনও দিনে পাঁচ সাত মাইল না হাঁটলে পেটের ভাত হজম হয় না।

সুরমা বললেন, মনে থাকবে না? খুব আছে। গাড়িঘোড়া চড়া তোমার ধাতেই নেই। যদুর জানি, রাজদিয়াতে ভাড়ার গাড়ি পাওয়া যায় না। এই ফিটন দু’টো তবে

সুরমার কথার মধ্যে অনুচ্চারিত একটা প্রশ্ন ছিল। হেমনাথ বুঝলেন। বললেন, এ দুটো আমার। একটা ঝিনুকদের, আরেকটা লালমোহনের। তোরা আসবি বলে ওদের কাছ থেকে চেয়ে এনেছি।

লালমোহন!

হ্যাঁ রে–

কোন লালমোহন বল তো? হেমনাথের দিকে অনেকখানি ঝুঁকলেন সুরমা। তার চোখেমুখে, কণ্ঠস্বরে কৌতূহল।

তুই কি চিনবি? ওর আসল নাম তো লালমোহন না-ডেভিড লারমোর। এ দেশের লোক লারমোর উচ্চারণ করতে পারে না, বলে লালমোহন। ও আমার অনেক কালের বন্ধু।

চিনব না, বল কী! কী চমৎকার মানুষ লালমোহন মামা! বিয়ের আগে তোমার কাছে এসে কিছুদিন থেকে গেছি, তখন আলাপ হয়েছিল। একবার আলাপ হলে ওঁকে কি কেউ ভুলতে পারে।

সব সময় হাসিমুখ। কথা থেকে চাউনি থেকে, স্নেহ যেন ঝরে পড়ছে। সুরমা বললেন, উনি। রাজদিয়াতে আছেন?

হেমনাথ বললেন, আছে বৈকি। পঁচিশ বছর বয়েসে আয়াল্যান্ড থেকে এসেছিল, এখন ওর বয়েস পঁয়ষট্টি। চল্লিশ বছর ও ইস্টবেঙ্গলে কাটিয়ে দিল। এর ভেতর একবারও দেশে যায় নি।

অবনীমোহন এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। হঠাৎ বললেন, এ দেশকেই বোধ হয় নিজের দেশ করে নিয়েছেন।

হেমনাথ বললেন, ঠিক বলেছ। জন্মভূমির কথা ও একরকম ভুলেই গেছে। সেখানে আত্মীয়স্বজন কেউ আছে কিনা, লারমোর বলতে পারবে না। যৌবনে ক্রিশ্চানিটি প্ৰিচ করতে বাংলাদেশের এই প্রান্তে এসেছিল। কর্মভূমিই এখন ওর স্বদেশ। আয়ার্ল্যান্ডের চাইতেও ইস্টবেঙ্গল ওর কাছে অনেক বেশি আপন।

সুরমা বললেন, আমার কথা কি লালমোহন মামার মনে আছে?

খুব আছে। হেমনাথ বলতে লাগলেন, তোর কথা কত বলে। আসবি শুনে তো নেচে উঠেছিল।

স্টিমারঘাটে উনি এলেন না তো?

সুজনগঞ্জে আজ হাট আছে। ভোরবেলা উঠে সেখানে চলে গেছে। দেখিস, রাত্তিরে ফিরেই ছুটে আসবে।

সুরমা কী বলতে যাচ্ছিলেন, ফিটনটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওপর থেকে রসুল বলল, বাজার আইস্যা গ্যাছে বড় কত্তা।

হেমনাথ বললেন, তোরা একটু বস, এক্ষুনি আসছি। গাড়ির দরজা খুলে তিনি নেমে গেলেন। ঝিনুক সঙ্গ ছাড়ে নি। কোলে ঝুলতে ঝুলতে সেও গেল। জানালা দিয়ে বিনু দেখতে পেল, চেরা বাঁশ আর হোগলায় ছাওয়া সেই দোকানগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। স্টিমার থেকে বোঝা যায় নি, কাছে আসতে টের পাওয়া গেল, ওগুলো মিষ্টির দোকান। কাঁচের আলমারির ভেতর বড় বড় গামলাভর্তি রসগোল্লা আর প্রকান্ড পেতলের থালায় মাখা সন্দেশ স্থূপাকার হয়ে আছে। কয়েকটা দোকানে হলুদ রঙের অসংখ্য কলার ছড়া ঝুলছে।

একটু পর মস্ত মাটির হাঁড়ি আর কলার ছড়া হাতে ঝুলিয়ে হেমনাথ ফিরে এলেন। হাঁড়িটার মুখ কলাপাতা দিয়ে বাঁধা। নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন, আমাদের রাজদিয়া রসগোল্লার জন্যে ফেমাস। দাদাভাই আর দিদিভাইদের জন্যে নিয়ে এলাম।

অবনীমোহন হঠাৎ বললেন, কিরকম দর?

ছ’আনা সের।

মোটে!

বছরখানেক আগেও তিন আনা, চোদ্দ পয়সা ছিল। এখন তো দাম বেড়ে গেছে।

ছ’আনা রসগোল্লার সের! এখানে না এলে এত শস্তা কল্পনাও করতে পারতাম না।

হেমনাথ হাসলেন, একেই শস্তা বলছ! ফাস্ট গ্রেট ওয়ারের আগে এই রাজদিয়ার বাজারে তিন পয়সা সের রসগোল্লা কিনেছি। দেখতে দেখতে ক’বছরে তার দাম ছ’আনায় উঠেছে। আরেকটা লড়াই ভাল করে বাধলে দাম যে কোথায় চড়বে, কে জানে। বলতে বলতে হঠাৎ কী মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ, ভাল কথা–

অবনীমোহন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

হেমনাথ বললেন, ইউরোপে যুদ্ধ বেধেছে। খবরের কাগজে তার খবর পড়ছি। এদেশেও নাকি ছড়িয়ে পড়তে পারে।

অবনীমোহন কিছু বললেন না। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে উৎসুক সুরে হেমনাথ ডাকলেন, আচ্ছা অবনী—

আজ্ঞে– অবনীমোহন উন্মুখ হলেন।

আমরা তো পৃথিবীর শেষ মাথায় পড়ে আছি। বাইরের কোনও খবর এখানে এসে পৌঁছতে যুগ কেটে যায়। তোমরা খাস কলকাতায় থাকো। ওখানে যুদ্ধের হাওয়া টাওয়া কিরকম দেখে এলে?

এখনও তেমন কিছু না।

তবু?

হিটলার ওয়ার ডিক্লেয়ার করেছে। গোলমাল চলছে। সে সব ইউরোপে। আমার মনে হয়, এটা সময়িক। টেনশন খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

এটা উনিশ শ’ চল্লিশের অক্টোবর। এক বছর আগেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ইউরোপের বাতাসে এখন বারুদের গন্ধ। ট্যাঙ্ক আর অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফটের শব্দে আকাশ চৌচির হয়ে যাচ্ছে। সংশয়ে-উত্তেজনায়-মত্ততায় সুদূর সেই মহাদেশ ঢেউয়ের দোলায় দুলছে।

আর উনিশ শ’ চল্লিশের বাংলাদেশ এত স্নিগ্ধ, এত নিরুদ্বেগ যে মনেই হয় না, ইউরোপ মাত্র কয়েক হাজার মাইল দূরে আর সেটিকে ঘিরে একখানা আগুনের চাকা ঘুরে চলেছে। ইউরোপ বুঝি এই গ্রহের অংশ নয়। সৌরলোকের বাইরে কোনও অজানা, অনাবিষ্কৃত দেশ। বাংলাদেশের অগাধ শান্তি আর নিশ্চিন্ত জীবন যুদ্ধের আঁচে ঝলসে যাবে, এমন সম্ভাবনা এখনও দেখা যাচ্ছে না।

অন্যমনস্কের মতো হেমনাথ বললেন, আমার কিন্তু তা মনে হয় না অবনী–

কী মনে হয়? অবনীমোহন শুধোলেন।

এ লড়াই বহুদিন চলবে, অনেক লোক মরবে, নানা দেশ তছনছ হয়ে যাবে।

অবনীমোহন কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন।

হেমনাথ বললেন, তুমি হয়তো ভাবতে পার, আমার এরকম ধারণা কেন হল?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কেন জানো? ওই জার্মান জাতটার জন্যে। এমন আত্মাভিমানী জাত দুনিয়ায় আর আছে কিনা সন্দেহ। মর্যাদাবোধ তার অত্যন্ত প্রখর। ফার্স্ট গ্রেট ওয়ারের গ্লানি সে ভোলে নি। প্রতিহিংসা না মেটা পর্যন্ত জার্মানরা থামবে বলে মনে হয় না।

অবনীমোহন চুপ করে রইলেন। মুখ দেখে মনে হল, হেমনাথের ব্যাখ্যা তার খুব মনপূত হয় নি।

এই সময় কলার ছড়াটার দিকে আঙুল বাড়িয়ে সুরমা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ভারি চমৎকার তো। সেবার যখন তোমার কাছে এসেছিলাম, রোজ এই কলা কিনে আনতে না মামা?

তোর মনে আছে? হেমনাথ হাসলেন, আমি কিন্তু ভুলে গেছি রে—

বা রে, মনে থাকবে না! আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ নাকি? সুরমাও হাসলেন, এই কলাগুলোর কী যেন নাম?

অমৃতসাগর।

হ্যাঁ হ্যাঁ, অমৃতসাগর।

অবনীমোহন মুগ্ধ স্বরে বললেন, সুন্দর নাম তো।

হেমনাথ বললেন, নামেই শুধু নয়, গুণেও সুন্দর। যেমন মিষ্টি তেমনি স্বাদ। আর দামও বাড়ে নি। দশ বিশ বছর ধরে তিন পয়সা হালি।

বিনু জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। গাড়িতে উঠবার পর থেকে দাদু-মা-বাবা অনবরত কথা বলছেন। হিটলার-জার্মানি-লারমোর-ইউরোপ-অমৃতসাগর, টুকরো টুকরো অনেক শব্দ অসংলগ্ন ভাবে কানে আসছিল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে সে বলল, দাদু, হালি’ কাকে বলে? কথাটা তার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।

এক গন্ডা জিনিসকে আমরা এখানে হালি বলি।

ও। বিনু আবার জানালার বাইরে তাকাল।

ফিটন চলেছে তো চলেছেই। দেখতে দেখতে হোগলা-ছাওয়া সেই দোকান ঘরগুলো চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাস্তার একধারে ছিল সারি সারি দোকান, আরেক ধারে নদী। নদীটা এখনও সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। বিনু দেখতে পেল, দূরে জেটিঘাটে বিশাল রাজহাঁসের মতো তাদের সেই স্টিমারটা নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। উঁচু মাস্তুলটার মাথায় একটা শঙ্খচিল, চুপচাপ বসে। তাকে ঘিরে ছাইরঙের অচেনা কটা পাখি চক্কর দিচ্ছে। বিনুরা যত এগুচ্ছে, স্টিমারটা ততই পেছন দিকে সরে সরে যাচ্ছে।

এদিকে পুব আকাশের খাড়া পাড় বেয়ে সূর্যটা অনেকখানি ওপরে উঠে এসেছে। আশ্বিনের রোদ এখন বেশ ধারাল। আকাশের নীল এত ঝমঝকে যে সেদিকে চোখ পেতে রাখা যায় না। স্টিমারে থাকতে যে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘগুলোকে এদিকে ওদিকে জমে থাকতে দেখা গিয়েছিল, শরতের এলোমেলো বাতাস পেঁজা তুলোর মতো তাদের দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে। নিচে নদীটা সারা গায়ে সোনালি রোদের আদর মেখে টলমল করে চলেছে।

মুগ্ধ চোখে বিনু দেখছিল। জীবনে যত দৃশ্য সে দেখেছে, মনে মনে সেগুলোর সঙ্গে এই আকাশ আর দূরের ভারহীন মেঘদলের তুলনা করে নিচ্ছিল, কোনটা বেশি সুন্দর?

এক জায়গায় এসে দেখা গেল, সিধে চলতে চলতে রাস্তা হঠাৎ বাঁ দিকে ঘুরেছে। বাঁক ঘুরে ফিটনও সেদিকে চলতে লাগল। খানিক যাবার পর সঙ্গের সেই নদীটা আর নেই, গাছগাছালির

ওধারে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বাঁকের মুখ পর্যন্ত রাস্তাটা ছিল খোয়ায় ঢাকা। এখন খোয়া টোয়া নেই। কৌলীন্য হারিয়ে সোজা মাটিতে নেমে গেছে।

ঘোড়ার গলায় বোধ হয় ঘুন্টি বাঁধা আছে। চলার তালে তালে ঠুনঠুন শব্দ হচ্ছে।

নদী নেই। মাটির রাস্তায় খানিক যাবার পর দু’ধারে খাল পড়ল। বিনুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে দুটো যেন ছুটছে। মধ্যঋতু এই শরতে খালগুলো কানায় কানায় ভরা। তবে তাতে স্রোত নেই। নিস্তরঙ্গ স্থির জলে কোথাও কচুরিপানা, কোথাও নলখাগড়ার বন মাথা তুলে আছে। আর আছে ছোট ছোট নৌকো। মাঝে মাঝে এক-আধটা বাঁশের সাঁকো, মাছরাঙা আর বক চোখে পড়ছে। ফুলভর্তি হিজল গাছে শালিক বসে আছে অনেক।

খালের ওপাড়ে দূরে দূরে কিছু কিছু বাড়িঘর দেখা যায়। বেশির ভাগই টিনের চালের। কদাচিৎ দু’চারখানা পাকা বাড়ি। এই রাজদিয়াতে লোকালয়ের রূপ ঘনবদ্ধ নয়, দ্বীপের মতো ছড়ানো।

চারদিকে এত জল দেখতে দেখতে অনেক দিন আগে পড়া একটা শহরের কথা মনে পড়ে গেল বিনুর। সেখানে রাস্তার বদলে শুধু খাল। গাড়িঘোড়া নেই সেই মজার শহরটায়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে নৌকোই ভরসা। এই মুহূর্তে স্মৃতি তোলপাড় করেও শহরটার নাম কিছুতেই মনে করতে পারল না বিনু।

কখন যে ফিটন দুটো একটা বড় কাঠের পুলের ওপর এসে উঠেছে, খেয়াল নেই। হঠাৎ কে যেন জোরে চেঁচিয়ে উঠল, গাড়ি থামা রসুল, গাড়ি থামা–

গতি কমতে কমতে গাড়িটা পুলের মাঝামাঝি চলে এল।

এদিকে বিনু চমকে উঠেছিল। তাড়াতাড়ি জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতেই দেখতে পেল, কে একজন বড় বড় পা ফেলে তাদের ফিটনটার দিকে এগিয়ে আসছে। খুব সম্ভব সে-ই গাড়ি থামাতে বলেছে।

একটু পরেই ফিটনের জানালায় একটি মুখ দেখা গেল।

পাকা ভুরু কুঁচকে হেমনাথ বললেন, হিরণবাবু মনে হচ্ছে—

বিনুর মনে পড়ল, কিছুক্ষণ আগে জেটিঘাটে দাদুর মুখে ‘হিরণ’ নামটা শুনেছে। এই তবে হিরণ। কাছাকাছি আসতে তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বয়স তেইশ চব্বিশের মধ্যেই। এক কথায় পরিপূর্ণ যুবক। সিঁথি নেই। মাথার চুল এলোমেলোভাবে পেছনে উলটে দেওয়া। গায়ের রং কালোর দিকে, এটা খুঁত নয়। বরং কালো রঙে হিরণের ব্যক্তিত্ব আরো বেশি করে ফুটেছে। চোখদুটি ভাষাময়, উজ্জ্বল। পাতলা ঠোঁটের ওপর সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা। পায়ে নকশা করা স্যাণ্ডেল। পরনে পাটভাঙা ধবধবে পাজামা, আর দোমড়ানো মোড়ানো হাফ শার্ট। পোশাকের ব্যাপারে তো বটেই, নিজের সম্বন্ধেই হয়তো সে উদাসীন। তবু সব মিলিয়ে হিরণ বেশ সুপুরুষ। তার মধ্যে কোথায় যেন একটা আকর্ষণ আছে। প্রথম দেখায় অবশ্য স্পষ্ট করে সেটা বোঝা যায় না, তবে হালকাভাবে অনুভব করা যায়।

হেমনাথ এবার বললেন, এতক্ষণে আসার সময় হল?

চোখ নামিয়ে, ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে হিরণ বলল, একটু দেরি হয়ে গেল।

কোন দিন ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাটিতে হাজিরা দাও শুনি? চিরকালের তুমি লেট লতিফ।

না, মানে—

মানেটা আবার কী হে–

কাল সন্ধেবেলা জারি গান শুনতে গিয়েছিলাম। মাঝরাত্তিরে ফিরে এসে এমন ঘুমিয়েছি যে ভোরবেলায় উঠতে পারি নি।

হেমনাথ বললেন, কাল না হয় মাঝরাত্তিরে শুয়েছ। যেদিন সন্ধে রাত্তিরে শোও সেদিনও কি ভোরবেলা ওঠ? তেইশ চব্বিশ বছর তো বয়েস হল। সূর্যোদয়ের আগে ক’দিন উঠেছ বল তো?

সমানে ঘাড় চুলকেই যাচ্ছিল হিরণ। ভয়ে ভয়ে একবার চোখ তুলে ফিসফিসিয়ে বলল, একদিনও না। সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে ওঠা আমার কোষ্ঠীতে নেই।

হেমনাথ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে উঠলেন, এই–এতদিনে একটা সত্যি কথা বলেছিস হিরণ।

অবনীমোহন বিনু সুরমা, সবাই সকৌতুকে তাকিয়ে ছিলেন। হিরণ আর হেমনাথের ভেতর যে মজার ব্যাপারটা চলছে, বেশ উপভোগই করছিলেন বলা যায়। এবার তারা হেসে উঠলেন।

হাসি থামতে অবনীমোহনদের দেখিয়ে হিরণ বলল, ওঁদেরই তো আসবার কথা ছিল?

হেমনাথ মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। আয়, তোদের আলাপ-টালাপ করিয়ে দিই।

সুরমা বিনু আর অবনীমোহনের পরিচয় দিলেন হেমনাথ। হিরণ শুধলো, আপনাদের কী বলে ডাকব?

সস্নেহে সুরমা বললেন, তোমার যা ইচ্ছে।

আমার ইচ্ছে মাসিমা আর মেলোমশাই বলি।

বেশ তো।

হিরণ বলল, ফিটনে যা মালপত্র, ওঠাই মুশকিল। বাড়ি গিয়ে আপনাদের প্রণাম করব।

হাসিমুখে সুরমা বললেন, তাই করো, প্রণামটা পাওনা রইল।

হেমনাথ এবার সুরমার চোখে চোখ রেখে বললেন, এবার শ্রীমানের পরিচয় দিই।

সুরমা বললেন, ওর কথা তো তুমি আগেই বলেছ।

কতটুকু আর বলেছি! আমার বন্ধু দ্বারিক দত্তর নাতি তো?

হ্যাঁ।

ও তো সামান্য পরিচয়। হিরণ গেল বার ইকনমিকস অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড হয়েছে। এবছর এম. এ ফিফথ ইয়ার। হেমনাথের বলার ভঙ্গিতে গর্ব যেন মাখানো।

সুরমা আর অবনীমোহন সস্নেহে তাকিয়ে ছিলেন। এবার তাদের দৃষ্টিতে স্নেহের সঙ্গে আর কিছু মিশল। সুরমা বললেন, বাঃ বাঃ, এ তো গৌরবের কথা।

প্রশংসার কথায় মুখ লাল হয়ে উঠেছিল হিরণের। চোখ নামিয়ে লাজুক সুরে সে বলল, গৌরব টৌরব আবার কি।

হেমনাথ বললেন, হিরণচন্দরের সব চাইতে বড় পরিচয় যেটা তা হল ও আমার ফ্রেণ্ড, ফিলজফার অ্যাণ্ড মিসগাইড।

হিরণ চেঁচামেচি করে উঠল, আমি তোমার মিসগাইড দাদু! এভাবে আমার দুর্নাম রটিয়ে বেড়াচ্ছ!

আরও কত কি রটিয়ে বেড়াই একবার দ্যাখ না।

হিরণ কী বলতে যাচ্ছিল, হাতের ইঙ্গিতে তাকে থামালেন হেমনাথ। হাসতে হাসতে বললেন, ঝগড়াঝাটি পরে হবে। দুদিন দু’রাত জার্নি করে ওরা এসেছে, খুব ক্লান্ত। এখন বাড়ি যাওয়া দরকার।

হিরণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল, হ্যাঁ, সে তো ঠিকই।

হেমনাথ শুধালেন, তুই কি এখন বাড়ি ফিরবি হিরণ?

যা। ফিটনের ভেতরটা ভাল করে দেখে নিয়ে হেমনাথ বললেন, তাই তো, একটুও জায়গা নেই। তোকে কোথায় বসাই?

আমি হেঁটে যাচ্ছি, তোমরা চলে যাও।

এখান থেকে বাড়ি পাক্কা এক মাইল রাস্তা। হেঁটে যাবি? এই সময় অবনীমোহন বলে উঠলেন, পেছনের ফিটনটায় শুধু সুধা সুনীতি রয়েছে, ওখানে একজনের জায়গা হতে পারে।

হেমনাথ বললেন, তা হলে আমি ঝিনুককে নিয়ে সুধাদের কাছে চলে যাই, হিরণ বরং এখানে বসে যাক।

হেমনাথ হয়তো ভেবেছেন, দুটি তরুণীর সঙ্গে এক ফিটনে অনাত্মীয়, অপরিচিত একজন যুবককে তুলে দেওয়া ঠিক হবে না।

অবনীমোহন তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি কেন যাবেন? হিরণই ওই ফিটনে যাক। আমি ওকে দিয়ে আসছি। বলে দরজা খুলে নেমে পড়লেন।

অবনীমোহন মানুষটি চিরদিনই উদার, সংস্কারমুক্ত। ছেলেমেয়েদের তিনি নিজের ছাঁচে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। নিজের নিজের সম্মান আর মর্যাদা বাঁচিয়ে তারা মানুষের সঙ্গে মিশুক, এটাই তার কাম্য। চারদিকের দরজা জানালা খুলে দিয়ে বাইরের আলো বাতাস যতখানি পারে ভেতরে নিয়ে আসুক, অবনীমোহন তা-ই চান।

সুধাদের ফিটনটা পেছনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। অবনীমোহন হিরণকে সেখানে বসিয়ে একটু পর ফিরে এলেন। আবার ফিটন চলতে শুরু করল।

কিছুক্ষণ পর অবনীমোহন বললেন বেশ ছেলে।

হেমনাথ বললেন, কার কথা বলছ? হিরণের?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বেশ বললে যথেষ্ট বলা হয় না। এমন ছেলে আমাদের রাজদিয়াতে আর একটিও নেই।

রাস্তা যেখানে এসে ফুরিয়ে গেছে, রাজদিয়া শহরের সেটাই বোধ হয় শেষ বাড়ি। তারপর থেকে শুরু হয়েছে মাঠ। এই আশ্বিনে মাঠ না বলে তাকে সমুদ্র বলাই উচিত। অনেক, অনেক দূরে আকাশ যেখানে ধনুরেখায় দিগন্তে নেমে গেছে ততদূর পর্যন্ত গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষের বসতি, এমন কি এক টুকরো মাটির চিহ্নও নেই। শুধু জল আর জল। অথৈ, অগাধ জল। তার ওপর মেঘের মত ধানবন মাথা তুলে আছে।

বাড়িটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে, প্রায় সাত আট বিঘের মতো হবে। চারদিক ঘিরে পাঁচিল অবশ্য নেই। সামনের দিকে এক ধারে প্রকাণ্ড বাগান। সেখানে সবই চেনাজানা গাছের ভিড়। আম জাম লিচু জামরুল কাঁঠাল। আর রয়েছে দেশি ফুলেরা সন্ধ্যামালতী টগর গন্ধরাজ কঁঠালি চাপা। বাগানটা ঘন ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

একদিকে বাগান, আরেক দিকে দীঘির মতো বিশাল পুকুর। পুকুরটার আলাদা কোনও অস্তিত্ব এই মুহূর্তে নেই। মাঠের জলের সঙ্গে সেটা এখন একাকার।

রাস্তা পেছনে ফেলে ফিটন বাগানে ঢুকল। একধারে দুটি অল্পবয়সী কামলা স্থূপীকৃত পচা পাট থেকে শোলা আর আঁশ বার করে করে রাখছিল। পচা পাটের দুর্গন্ধে চারদিকের বাতাস আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে।

ফিটন দেখে কামলা দু’টো বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাল, আইস্যা গ্যাছে, আইস্যা গ্যাছে– বলেই উধ্বশ্বাসে ভেতরের দিকে ছুটল।

বাগান পেরিয়ে মস্ত উঠোন। কামলারা ভেতরে পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিটন উঠোনে এসে থামল।

উঠোনের একধারে রাসমঞ্চ, দোলমঞ্চ, তুলসীমঞ্চ। আরেক ধারে পর পর অনেকগুলো খড়ের পালা সাজানো। তিন দিক ঘিরে সারি সারি ঘর। পুরোপুরি পাকা বাড়ি নয়। মেঝে সিমেন্টের, ওপরে নকশা-করা টিনের চাল, কাঠের দেওয়ালে বড় বড় জানালা ফোঁটানো।

ফিটন দুটো থেমেছে কি থামে নি, সারা বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেল। সেই কামলা দু’টো তো চেঁচাচ্ছিলই, ভেতর থেকে আরও কয়েকজন প্রায় ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এল। সবাই মহিলা আর শিশু। বয়স্ক পুরুষ কিংবা যুবক তাদের ভেতর নেই।

একবারে সামনে যিনি তাঁর বয়স পঞ্চাশোর্ধ্বে। শ্যামাঙ্গীই বলা যায়। নাক মুখ তেমন ধারাল নয়, তবে চুল অজস্র। এর মধ্যেই স্নান সেরে নিয়েছেন, পিঠময় কাঁচাপাকা ভিজে চুল ছড়ানো, প্রান্তে একটি গিট বাঁধা। কপালে তামার পয়সার আকারে সিঁদুরের মস্ত টিপ, সিঁথিও ডগডগে। পরনে লাল নকশা-পাড় শাড়ি আর সাদা জামা। ঠোঁট দুটি টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো পানের রসে টুকটুকে।

আলাদা আলাদা করে দেখলে হাত-পা-নাক-চোখ তেমন কিছু নয়। তবে সব মিলিয়ে মহিলাকে ঘিরে কোথায় যেন অলৌকিকের ছোঁয়া আছে।

বর্ষীয়সী সধবা মহিলাটির গা ঘেঁষে একজন বিধবা দাঁড়িয়ে, দু’জনে সমবয়সিনীই হবেন। বিধবাটির চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা, পরনে ধবধবে সাদা থান আর সেমিজ। চেহারায় হেমনাথের পুরো আদলটিবসানো। খুব সম্ভব তার বোন টোন।

সধবা আর বিধবা এই দুই সমবয়সিনীর পেছনে যারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে, এক পলক তাকিয়েই অনুমান করা যায়, তারা এ বাড়ির আশ্রিত। হয়তো হেমনাথের সংসারে কাজকর্ম করে তাদের দিন চলে।

ফিটন থামতে প্রথমেই ঝিনুককে নিয়ে হেমনাথ নামলেন। মহিলা দুটির দিকে ফিরে উচ্ছ্বসিত সুরে বললেন, দেখ, কাদের এনেছি।

মহিলারা আরেকটু এগিয়ে এলেন। ততক্ষণে অবনীমোহন বিনু আর সুরমা নেমে পড়েছেন। সুরমা তাড়াতাড়ি ঝুঁকে মহিলা দুটিকে প্রণাম করলেন। বললেন, কেমন আছ মামী? কেমন আছ মাসি? কপালে সিঁদুর, পরনে লালপাড় শাড়ি মহিলাটি হেমনাথের স্ত্রী স্নেহলতা। বিধবা মহিলাটি তার বোন। নাম–শিবানী।

শিবানী আর স্নেহলতা দু’জনে চিবুক ছুঁয়ে সুরমাকে চুমু খেলেন। হেমনাথ যা বলেছিলেন এরাও তাই বললেন, আমরা তো ভালই আছি। কিন্তু তোর শরীরের একি হাল হয়েছে মা!

সুরমা হাসলেন, শরীরের কথা থাক। সব সময় ওই এ কী কথা শুনছি।

সুরমার পর অবনীমোহন আর বিনু গিয়ে প্রণাম করল। হেমনাথ তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।

স্নেহলতা স্বামীর দিকে এক পলক তাকিয়ে নিয়ে আস্তে করে ঝঙ্কার দিলেন, থাক, আর বলে দিতে হবে না। আমার জামাই, আমার নাতিকে যেন চিনতে পারি নি?

বিনুদের ফিটনের ঠিক পেছনেই সুধাদের ফিটনটা থেমেছিল। সুরমা গলা তুলে ডাকলেন, কি রে সুধা সুনীতি, তোরা দেখি গাড়িতেই বসে রইলি!

ডাকাডাকিতে সুধারা নামল। দেখা গেল, সুধা আর হিরণ খুব কথা বলছে। আর সুনীতি মুখ টিপে টিপে হাসছে। তিনজনের ভেতর হয়তো কোনও মজার আলোচনা চলছে।

হেমনাথ ভাবছিলেন, কাঠের পুলটা থেকে এ বাড়ি এক মাইলের মতো। ফিটন ছুটিয়ে আসতে কতক্ষণ আর লেগেছে! খুব বেশি হলে মিনিট দশ বার। কিন্তু এর ভেতরেই সুধা আর হিরণ কেমন আলাপ জমিয়ে নিয়েছে।

হেমনাথ সুধাকে বললেন, পড়েছিস তো হিরণের পাল্লায়। কী কথাটাই না বলতে পারে! সবসময় বকবকায়মান।

সুরমা বললেন, হিরণের দোষ দিচ্ছ মামা! তোমার ছোট নাতনীকে তো এখনও চেন নি। দিনরাত খালি কথা আর কথা। একটা কিছু পেল তো একেবারে কলের গান চলল, থামে আর না। ওর বকবকানিতে কানের পোকা নড়ে যায়।

হেমনাথ বললেন, ভালই হল। দু’টোর মিলবে বেশ।

কিছু না ভেবেই শেষ কথাগুলো বলেছেন হেমনাথ, তবু চকিতে হিরণ আর সুধা পরস্পরের দিকে একবার তাকাল, তারপর মুখ ফিরিয়ে নিঃশব্দে হাসল।

সুরমা বললেন, যাও, দিদাদের প্রণাম কর।

সুধা সুনীতি এগিয়ে গিয়ে স্নেহলতা আর শিবানীকে প্রণাম করল। তারা উঠে দাঁড়ালে সকৌতুক দৃষ্টিতে স্ত্রীকে বিদ্ধ করে হেমনাথ সহাস্যে বললেন, কিরকম দেখলে গিন্নী?

স্নেহলতা বুঝতে পারেন নি। বললেন, কী?

সুধা সুনীতিকে—

দু’জনেই সুধা।

তোমার কপাল কিন্তু পুড়ল।

ইঙ্গিতটা এবার বুঝতে পারলেন স্নেহলতা। হাসিমুখে বললেন, ভয় দেখাচ্ছ?

তুমিই বিবেচনা কর। হেমনাথ বললেন, ভাবছি তোমাকে বিদেয় করে এবার এই দু’জনকে রাজমহিষী করে নেব।

বিদেয় করবে কি? তার আগে আমিই পালিয়ে যাব। বলে বিনুর চোখে চোখ রাখলেন স্নেহলতা, কি দাদা, সুভদ্রাহরণ করতে পারবে তো?

ঠিক এই সময় হিরণ চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাইও–

কী হল রে? চমকে স্নেহলতা তাকালেন।

আমার সঙ্গে পালাবার প্ল্যান করেছিলে না সেদিন? আবার এর ভেতরে বিনুকে জুটিয়ে ফেললে?

সবাই হেসে উঠল।

হাসি থামলে শিবানী বললেন, আর উঠোনে না, ঘরে চল সব।

স্নেহলতা সস্নেহে ডাকলেন, এস ধনেরা, এস—

‘ধন’ বলে সম্বোধন করতে আগে আর কারোকে শোনে নি বিনু। ফিক করে হেসে ফেলল সে।

হেমনাথ সেই কামলা দুটোকে বললেন, যুগল করিম, গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে আন–

কামলা দু’জনের নাম জানা গেল। তবে কে যুগল আর কে করিম, বুঝতে পারল না বিনু।

স্নেহলতা সবাইকে নিয়ে ভেতর-বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন। দু’চার পা এগিয়েছিলেন, দুটো লোক প্রায় ছুটতে ছুটতে উঠোনে এসে পড়ল। হাঁপাতে হাঁপাতে ডাকল, বড়কত্তা

সবাই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। যে লোক দুটি ছুটে এসেছে তারা মধ্যবয়সী চাষী কি মাঝি শ্রেণীর মানুষ।

হেমনাথ বললেন, কী ব্যাপার রে?

দু’জনেই প্রায় একসঙ্গে বলল, মজিদ ভাই অহনই আপনেরে যাইতে কইছে। আমরা নাও লইয়া আইছি। চলেন–

কেন, কিছু জানিস?

চরবেউলা থিকা নবু গাজী আইছে যে।

হেমনাথ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, যাব। এখনই যেতে হবে। নৌকো কোথায় রেখেছিস?

আপনের পুকৈর ঘাটে।

পুকুরটা এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বাগানের ওধারে তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ভিড়ে ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে টুক করে একবার দেখে নিল বিনু। সত্যিই একটা ছইওলা নৌকো সেখানে বাঁধা আছে, হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে।

হেমনাথ এবার এদিকে ফিরে বললেন, রমু অবনী, আমাকে একবার বেরুতে হচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম করে খাওয়াদাওয়া সেরে নিও, আমার জন্যে বসে থেকো না। হিরণকে বললেন, তুই এখন আর বাড়ি যাস না, আমাদের এখানেই খাবি। কিছু দরকার টরকার হলে-বুঝলি না, আমি তো বাড়িতে থাকব না–

হিরণ বলল, বুঝেছি। গৃহস্বামীর অনুপস্থিতিতে তার দায়িত্বগুলো আমার ঘাড়ে চাপল, এই তো?

ঠিক।

অবনীমোহন বললেন, এখন কোথায় যাবেন মামাবাবু?

হেমনাথ জানালেন, কেতুগঞ্জ।

অবনীমোহন আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। মুখচোখ দেখে মনে হল, হেমনাথের কেতুগঞ্জ যাবার ব্যাপারে তার কৌতূহল আছে, হয়তো কিছু প্রশ্নও।

অবনীমোহনের মনের কথা বুঝিবা পড়তে পারলেন হেমনাথ। বললেন, কেতুগঞ্জের মজিদ মিঞা আমার ছোট ভাইয়ের মতো। এক কানি জমি নিয়ে ওর সঙ্গে চরবেহুলার নবু গাজীর দাঙ্গা হয়ে গেছে। দু’পক্ষে আট দশজন জখম হয়ে সদর হাসপাতালে পড়ে আছে। নবু গাজীর সঙ্গে যাতে মজিদের একটা মীমাংসা হয়, সে জন্যে আমি চেষ্টা করছিলাম। আচ্ছা, পরে এসে তোমাকে সব বলব।

হেমনাথ সেই মুসলমান মাঝি দুটির সঙ্গে চলে গেলেন।

অবনীমোহন বললেন, মামাবাবু তো বেশ ঝঞ্ঝাট পোয়াতে পারেন!

ওধার থেকে স্নেহলতা বললেন, এই একটা ঝঞ্জাট নাকি? সবে এসেছ। কদিন থাকলেই দেখতে পাবে কত ঝামেলা মাথায় নিয়ে বসে আছে তোমার মামাবাবু। রাত নেই, দিন নেই, এ আসছে ডাকতে, ও আসছে। এক দণ্ড যদি ঘরে স্থির হয়ে বসে!

বিনু কিছুই বোধহয় শুনতে পাচ্ছিল না। একদৃষ্টে পুকুরঘাটের দিকে তাকিয়ে ছিল। এতক্ষণে নৌকোটা ছেড়ে দিয়েছে, দেখতে দেখতে পুকুর পেরিয়ে ধানবনের কাছাকাছি চলে গেল সেটা।

বিনুর খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ভাসতে ভাসতে দাদুর সঙ্গে কেতুগঞ্জে যায়, আগে আর কখনও নৌকোয় চড়ে নি সে।

4 Comments
Collapse Comments

১.০১ কই?

Bangla Library (Administrator) April 4, 2020 at 3:49 pm

দুঃখিত, এবং ধন্যবাদ ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য। প্রথম অধ্যায় দেয়া হয়েছে – http://ebanglalibrary.com/95815/

১.০১ কি মিসিং হইছে নাকি ১.০২ থেকে শু? দয়া করে জানাবেন

Bangla Library (Administrator) April 4, 2020 at 3:49 pm

আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, সেই সাথে আপনাদেরকে ধন্যবাদ ভুলটি ধরিয়ে দেয়ার জন্য। প্রথম অধ্যায় দেয়া হয়েছে – http://ebanglalibrary.com/95815/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *