১৩. বর্তমানহীন ভবিষ্যহীন

১৩ বর্তমানহীন ভবিষ্যহীন

এক আদিম সমাজের মানুষ আমি, রাশেদ মনে মনে-না, তার সম্ভবত আর মন নেই, অন্য কিছু একটা আছে হয়তো, হয়তো তাও নেই, সেখানেই সে বলছে, আমি আদিম সমাজের মানুষ, হয়তো মানুষও নই, সভ্যতার সংবাদ আমি রাখি না, আমার গোত্র। রাখে না, আমার গোত্র আমাকে নির্দেশ দিচ্ছে তুমি সভ্যতার ভেতরে ঢুকবে না, বাইরে থাকবে সভ্যতার, থাকবে আদিম, আদিমতর, আদিমতম। পথের ওই ভিখিরিটি আদিম, সে আর কিছু জানে না তার ক্ষুধা ছাড়া, ক্ষুধার আগুন ছাড়া, কাম ছাড়া; উদ্দিন মোহাম্মদও তার মতোই আদিম, ক্ষুধা আর কাম ছাড়া সেও কিছু জানে না, তার ক্ষুধা। ভিখিরির ক্ষুধার থেকে অনেক বেশি, শুধু খাদ্যে তার ক্ষুধা মেটে না, তার কাম ভিখিরির কামের থেকেও ভয়ংকর, শুধু নারীতে তার কাম তৃপ্ত হয় না; তার মতোই ক্ষুধার্ত কামার্ত আমার গোত্রের সবাই; আদিম ওই রাজনীতিকেরা, যারা মানুষকে খুব। ভালোবাসে, জনগণের জন্যে যারা প্রাণ বিলিয়ে দিচ্ছে, বিলিয়ে দিতে চাইলেও দিতে পারছে না, কেনো তারা ক্ষমতা পায় নি; আদিম ওই সেনাপতি, আদিম ওই চিকিৎসক, আদিম ওই অধ্যাপক, আদিম ওই আমলা, আদিম ওই চোরাচালানি, আদিম ওই মৌলভিমোল্লা; এ-অরণ্যে আদিমতা ছাড়া আর কিছু নেই; উদ্দিন মোহাম্মদ এখানে দেখা দেবেই। উদ্দিন মোহাম্মদকে কে সৃষ্টি করেছে? আমরাই সৃষ্টি করেছি উদ্দিন। মোহাম্মদকে; উদ্দিন মোহাম্মদ দেখা দিয়েছে আমাদেরই দূষিত রক্তের ভেতর থেকে, উদ্দিন মোহাম্মদ প্রাদুর্ভূত হয়েছে আমাদেরই নষ্ট হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন থেকে, আমরা তা বুঝতে পারছি না; উদ্দিন মোহাম্মদ জেগে উঠেছে আমাদেরই অসুস্থ স্বপ্ন থেকে, উদ্দিন মোহাম্মদ বিকশিত হয়েছে আমাদেরই রুগ্ন নিশ্বাস থেকে, আমরা তা বুঝতে পারছি না; আমাদের পচন-লাগা মনের গভীরে আমরা তাকে ভালোবাসি, দূষিত রক্তের স্তরে স্তরে আমরা তাকে ভালোবাসি, আমরা তা বুঝতে পারছি না; সে চামড়ার ওপর হঠাৎ–গজিয়ে-ওঠা ফোড়া নয়, সে আমাদের দূষিত আত্মা। সে আমাদের সন্তান, সে! আমাদের পিতা, সে আমাদের পিতামহ; সে আমাদের পূর্বপুরুষ, সে আমাদের। উত্তরপুরুষ, সে আমরাই। উদ্দিন মোহাম্মদ একদিন মিশে যাবে, কিন্তু যাবে না, আবার দেখা দেবে, সে আছে আমাদের ময়লা রক্তের গভীরে, রুগ্ন স্বপ্নের গর্তে, নষ্ট কামনার খোড়লে খোড়লে। আমরা দূষিত মানুষ, আমরা দূষিত জাতি, আমরা দূষিত গোত্র। আমার গোত্রের অতীত নেই, বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎ নেই। আমি যখন অতীতের দিকে তাকাই কোনো গৌরব আমার আমাকে প্রদীপ্ত করে না, আমার পূর্বপুরুষ আমাকে। বিদেশির দাসে পরিণত করেছে; আমি যখন বর্তমানের দিকে তাকাই কোনো আলো আমাকে উজ্জ্বল করে না, আমার সমাজ আমাকে নষ্ট মানুষদের অধীন করেছে; আমি যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই কোনো সম্ভাবনা আমাকে পথ দেখায় না, সব সম্ভাবনাকে আমরা লুপ্ত করেছি। অশেষ অন্ধকারে শুধু দুটি জোনাকির জ্বলে ওঠা দেখি, আর কোনো শিখা দেখি না, শুধু অন্ধকার দেখি। আমার শ্রুতি ভরে আছে মিথ্যায়, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমার শ্রুতিতে জমেছে মিথ্যা; আমার রাজা আমাকে মিথ্যা শুনিয়েছে, আমার কবি আমাকে মিথ্যা শুনিয়েছে, আমার পুরোহিত আমার সামনে মিথ্যার পুথি মেলে ধরেছে, আমার পুস্তক আমাকে মিথ্যার পাঠ দিয়েছে। আমি মিথ্যা দ্বারা পরিবৃত হয়ে আছি। আমি মিথ্যার সন্তান, আমি জন্ম দিই মিথ্যা।

রাশেদ ঠিক করেছে সে কোনো প্রতিযোগিতায় যাবে না, সে প্রতিযোগিতার ইঁদুর হবে না, সে হবে ব্যর্থ, ব্যর্থ মানুষ, চারপাশের সফল মানুষদের মধ্যে সে থাকবে ব্যর্থ মানুষ, তাকে দেখে কেউ ঈর্ষা বোধ করবে না। তার পক্ষে ব্যর্থ হওয়ার উৎকৃষ্ট উপায় হচ্ছে একটি দুরূহ বই লেখা–দুরূহ বই, অত্যন্ত দুরূহ, যে-বই বাঙালি, বাঙালি। মুসলমান কখনো পড়বে না, যে-বই কারো কাজে লাগবে না; কিছুটা লিখেও ফেলেছে, কিন্তু এখন আর লেখার ইচ্ছে হয় না। কেনো হবে? সে কি বাঙালি নয়; সে কি বাঙালি মুসলমান নয়? বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমানের ব্যাধি কি থাকবে না তার মধ্যে? বাঙালি এবং বাঙালি মুসলমান গোত্রে জন্ম নিয়ে মহৎ কিছু করার বীজ কী করে থাকবে। তার মধ্যে? তার মধ্যে থাকবে শুধু নষ্ট হওয়ার বীজ, চারপাশ তাকে দেবে পতিত হওয়ার মন্ত্রণা। দুরূহ বই লেখার বদলে রাশেদ কয়েকটি রচনা লিখে ফেললো, ওগুলোকে সে রচনাই বলে, এমন সব বিষয়ে যেসব বিষয়ে সে কখনো লিখবে বলে ভাবে নি; রচনাগুলো অখ্যাত একটি সাপ্তাহিকে বেরোনোর পর রাশেদ বুঝতে পারলো কতোটা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে চারপাশে। প্রথম প্রথম অবশ্য তার ভালোই লাগছিলো; মাঝেমাঝেই একটি দুটি করে তরুণতরুণী আসছে তার কাছে, শুধু প্রশংসা করছে তার সাহসের, আর রাশেদ বিব্রত বোধ করছে এজন্যে যে সে আসলে কোনো কোনো সাহসই দেখায় নি, সাহস দেখানোর জন্যে সে লেখে নি ওই রচনাগুলো, সে লিখেছে কিছু সত্য প্রকাশ করার জন্যে। তাহলে কি ব্যর্থ হয়ে গেলো তার রচনাগুলো রচনাগুলোতে সত্য না দেখে তারা দেখছে সাহস। রাশেদ তাদের চোখেমুখে দেখতে পায় প্রচণ্ড ভীতি, ভয়ে কুঁকড়ে আছে তারা; সে যে তাদের মধ্যে এতোটা ভয় জাগিয়ে দিয়েছে, তাতে রাশেদেরই ভয় লাগে। এ-তরুণতরুণীরা অত্যন্ত সাহসী, বাস্তব সাহসের কোনো অভাব নেই তাদের, নিয়মিতই মিছিল করে তারা, গোলাগুলির মধ্যে পড়ে, মরতেও ভয় করে না, কিন্তু রাশেদ দেখতে পায় তাদের কল্পনোক ভরে আছে ভীতিতে। তারা সবাই প্রথমেই একটি প্রশ্ন করে রাশেদকে, যেনো এটাই চরম প্রশ্ন, এটা জানা হয়ে গেলে সব জানা হয়ে যায়, আর কিছু জানার বাকি থাকে না;-তারা জানতে চায়, আপনি কি নাস্তিক? রাশেদ যদি বলে গতকাল সে দুটি লোককে খুন করেছে, তিনটি তরুণীকে ধর্ষণ করার পর গলা কেটে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়েছে, তাহলেও তারা ততোটা ভয় পাবে না, যতোটা ভয় পাবে যদি সে বলে সে নাস্তিক। একটা অলৌকিক ভয়ে তারা কাঁপছে, ওই ভয় আদিম কাল থেকে মাটির ভেতর দিয়ে রসের মতো চলে এসেছে, শেকড় বেয়ে বেয়ে তাদের ভেতরে ঢুকেছে, সারাক্ষণ ওই ভয়ে কাঁপছে তারা। ওদের জন্যে মায়া হয় রাশেদের, সে সরাসরি উত্তর দেয় না, দিলে হয়তো ওরা সহ্য করতে পারবে না, চিৎকার করে দাপাতে দাপাতে তার সামনেই মারা যাবে। রাশেদের ছেলেবেলায় তো এতো ধর্ম ছিলো না, আল্লা তোতা তখন তাদের এতো ভয় দেখাতো না; এখন চারদিকে আল্লাই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে সজীব ব্যক্তিত্ব, এবং তার ভয়ে সবাই। কাঁপছে, যদিও সে নিজে কাউকে ভয় দেখাচ্ছে না। এর আগে এতো ভয়ংকরভাবে। কখনো আল্লা আত্মপ্রকাশ করে নি। পত্রিকা খুললে মনে হয় আল্লাই এখন রাজনীতি করছে, আল্লাই এখন রাষ্ট্র চালাচ্ছে, আল্লাই এখন বিমান উড়োচ্ছে, আল্লাই এখন সিনেমা হল উদ্বোধন করছে, এবং আল্লা সারাক্ষণ ভয় দেখাচ্ছে।

রাশেদ তাদের বলে য়ে সম্পূর্ণ আস্তিক বলে কিছু নেই, যারা আস্তিক, তারাও অন্য ধর্মের চোখে নাস্তিক; একজন ধার্মিক মুসলমানের চোখে একজন ধার্মিক হিন্দু নাস্তিক, একজন ধার্মিক হিন্দুর চোখে একজন ধার্মিক মুসলমান নাস্তিক, যদিও তারা নিজেদের আল্লা আর ভগবানে বিশ্বাস করে; আর ধর্মপ্রবর্তকেরাও এক অর্থে নাস্তিক, কেননা তারা সবাই পিতার ধর্ম ছেড়ে প্রস্তাব করেছে নতুন ধর্ম, নিজের ধর্ম। রাশেদের কথায় তার। সামনের তরুণ দুটি আর তরুণীটি কেঁপে ওঠে, যদিও তারা খুব প্রগতিশীল, তারা বিশ্বাস করে শ্রেণীসংগ্রামে, এবং সাহসী, মরতে তারা ভয় পায় না। রাশেদ বলে অনেক ধর্ম রয়েছে পৃথিবীতে, আছে নানা রকম স্রষ্টা; এতোগুলো ধর্ম আর এতোগুলো স্রষ্টা থাকার অর্থ সবই মানুষের কল্পনা, বেশ আদিম কল্পনা, এগুলো একে অন্যকে বাতিল করে দেয়। রাশেদ বলে, প্রত্যেক ধর্মের দুটি দিক রয়েছে, একটি বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব, আরেকটি সমাজ কীভাবে চলবে তার বিধান। প্রতিটি ধর্মেরই বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব ভুল, আর সমাজও ধর্মের পুরোনো বিধান অনুসারে আর চলতে পারে না, পৃথিবী অনেক বদলে গেছে, আরো অনেক বদলে যাবে। একটি তরুণ প্রায় কেঁদে ফেলে, তাহলে কি আল্লা। নেই? রাশেদ বলে, আল্লা এমন ব্যাপার যা প্রমাণ করা যায় না, অপ্রমাণও করা যায় না, অর্থাৎ স্রষ্টা অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার, বিজ্ঞান তার অস্তিত্বের কোনো প্রমাণ পায় নি, পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। একটি তরুণ বলে, তাহলে কি আমরা বিশ্বাস করবো না, বিশ্বাস বলে। কি কিছু থাকবে না? রাশেদ বলে, মানুষের সব বিশ্বাসই অপবিশ্বাস। আমরা যা কিছু। বিশ্বাস করে আসছি, তার অধিকাংশের মূলে সত্য নেই, আর কোনো বিশ্বাসই চিরন্তন নয়, বিশ্বাসের বদল ঘটে যুগে যুগে। তরুণীটি বলে, তাহলে কি নামাজরোজা করতে। হবে না? রাশেদ বলে, না, দরকার নেই। এ-তরুণতরুণীরা নামাজরোজা করে না, তবু তারা আঁৎকে ওঠে, চোখমুখ তাদের খসখসে হয়ে ওঠে। রাশেদ বলে, মনে করা যাক। একজন স্রষ্টা রয়েছে, সে মহাজগতের সব কিছু সৃষ্টি করেছে, তাহলেও তার উদ্দেশে। প্রার্থনার আনুষ্ঠানিকতা অপ্রয়োজনীয়। কারণ যে অনন্ত মহাজগত সৃষ্টি করতে পারে, সে নিশ্চয়ই হবে অত্যন্ত মহান, মানুষের মতো তুচ্ছ প্রাণীর তুচ্ছ প্রশংসা তার দরকার পড়তে পারে না। রাশেদ বলে, ব্ল্যাকবোর্ডে ছোটো একটি বিন্দু যতোটা ছোটো, মহাজগতে মানুষ ওই বিন্দুর থেকেও ছোটো, তুচ্ছ; এতো ছোটো তুচ্ছ মানুষের কথা স্রষ্টা সব সময় ভাববে, তার জন্যে স্বর্গনরক বানিয়ে রাখবে, এটা হাস্যকর চিন্তা। রাশেদ বলে, এ-দালানে কোথাও পিঁপড়ে নিশ্চয়ই রয়েছে, ওই পিঁপড়েগুলোর কথা আমরা কেউ ভাবছি না, পিঁপড়েগুলোর কোনো আচরণই আমাদের ভাবনার বিষয় নয়। পিঁপড়েগুলো। যদি মনে করে আমরা তাদের কথা সব সময় ভাবছি, তারা আমাদের স্তব করছে কিনা তার হিশেব রাখছি, তা যেমন হাস্যকর হবে, তারচেয়েও হাস্যকর মানুষের প্রার্থনা। কারণ স্রষ্টা থাকলে সে এতো মহান হবে যে তুচ্ছ মানুষের নিরর্থক স্তুতি সে কখনো। চাইবে না। অনন্ত মহাজগতে সূর্য একটি অত্যন্ত গরিব তুচ্ছ হলদে তারা, পৃথিবী ওই নক্ষত্রের একটি অত্যন্ত গরিব তুচ্ছ গ্রহ, আর মানুষ একটি বিন্দুর থেকেও তুচ্ছ। স্রষ্টা এতো তুচ্ছ বিন্দুর স্তুতির জন্যে কাতর হতে পারে না। প্রতিটি ধর্মের প্রার্থনার শ্লোকগুলো খুবই মলিন, স্রষ্টা সেগুলো শুনলে খুব খুশি হবে বলে মনে হয় না। একটি ছেলে বলে, আমার ভয় লাগছে, আমি ভয় পাচ্ছি, সে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। বাস্তব ভয়ের থেকে অনেক ভয়ংকর অলীক ভয়।

বাসায় টেলিফোন আনা ঠিক হয় নি, রাশেদ টেলিফোন তুলতেই ভয় পাচ্ছে। আজকাল; টেলিফোনের ভেতর দিয়ে দুপুর সন্ধ্যা মাঝরাতে তার ঘরের ভেতর ঢুকে। পড়ছে ঘাতকেরা, ছুরি হাতে লাফিয়ে দাঁড়াচ্ছে তার সামনে। টেলিফোন বাজার শব্দটা তার ভালো লাগে, বাজলেই গিয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, অপরপ্রান্তের যে-কাউকে তার প্রিয় মনে হয়, ধরেও ফেলে রাশেদ। গতকালও মাঝরাতে টেলিফোন বেজে উঠেছিলো, ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো রাশেদের, সে বুঝতে পারছিলো অন্যপ্রান্তে কোনো ঘাতক ছুরি হাতে। বসে আছে, এখন তাকে মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তার ঘাতকের। ঘাতক বলে, আচ্ছালামুআলাইকুম; রাশেদ বলে, রাশেদ বলছি। ঘাতক চিৎকার করে ওঠে, হারামজাদা, তুই ত আবার সালামের জবাব দ্যাছ না, অআলাইকুমসালাম ক, তর বাপে কি তরে একটুও আল্লারসুলের নাম শিখায় নাই? রাশেদ বলে, আপনি কে বলছেন; ঘাতক বলে, তর আজরাইল বলছি। ওই সব ল্যাখা ছাইরা দে, আল্লারে লইয়া তুই। মাথা ঘামাইছ না, লিস্টিতে তর নাম আছে। রাশেদ টেলিফোন রেখে দেয়, টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করে, বাজতে থাকে, বাজতে থাকে। মমতাজ আর মৃদু জেগে উঠেছে, দুজনই খুব ভয় পেয়ে গেছে; টেলিফোন বাজতে থাকে, বাজতে থাকে; এবার মমতাজ টেলিফোন ধরে জিজ্ঞেস করে, কে বলছেন; ঘাতক বলে, তর স্বামীর আজরাইল বলছি, তার বেশি দিন নাই, তর আরেকটা বিয়ার দিন কাছাইয়া আইছে। মমতাজ চিৎকার করে বদমাশ বদমাশ বলতে বলতে টেলিফোন রেখে দিয়ে কাঁপতে থাকে। মৃদু উঠে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। আবার বেজে ওঠে টেলিফোন, অনেকক্ষণ কেউ ধরে না তারা; এক সময় রাশেদ আবার তার ঘাতকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে, রাশেদ বলছি। ঘাতক বলে, তুই তৈরি হইয়া থাকিছ, বেশি দিন বাকি নাই। রাশেদ। বলে, আমি তৈরি, ইচ্ছে হলে আজ রাতেই আসতে পারেন। ঘাতক বলে, যেই রাতে। দরকার পড়ব সেই রাতেই আসব, চোখ বাইন্দা শুয়রের মত লইয়া আসব, যা কিছু দ্যাখতে চাই দ্যাইখ্যা ল। রাশেদ বলে, আপনাকে একবার দেখতে ইচ্ছে করে। ঘাতক বলে, চোখ উপড়াইয়া ফেলনের পর আমাকে দেখতে পাবি। ঘাতক টেলিফোন রেখে। দেয়, রাশেদ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে টেলিফোনের পাশে, নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় মমতাজ আর মৃদুর কাছে। সে মৃদুর গালে অনেকক্ষণ হাত রেখে বসে থাকে, আজ আর ঘুম হবে না, পাশের ঘরে গিয়ে সে একটি বই খুলে বসে।

সন্ধ্যার আগে রাশেদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে, কোনো রিকশা দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে, রিকশার জন্যে বড়ো রাস্তায় যেতে হবে, কী আশ্চর্য, পাশের গলি থেকে পাঁচ-ছজন ধার্মিক লোক বেরিয়ে এলেন;–তারা দ্রুত হাঁটছেন, তারাও হয়তো বড়ো। রাস্তায় যাবেন, বা খবর পেয়েছেন শহরের কোনো রাস্তায় ধর্ম বিপন্ন, বড়ো বড়ো জোব্বা পরেছেন তারা, তাদের মাথায় অদ্ভুত টুপি, গলায় নানা রকম চাদরগামছা, রাশেদের আগে আগে হাঁটছেন তারা, রাশেদকে হয়তো তারা দেখেনও নি। তাদের পোশাক আর হাঁটার গতিতেই রাশেদ ভয় পেয়ে যেতো, যদি তার বয়স হতো তেরো-চোদ্দো। তাঁদের দেখে তার বাল্যকাল আর এখনকার ধার্মিকদের মধ্যে একটা বড়ো পার্থক্য সে ওই মুহূর্তেই বোধ করে। আগে পথে কয়েকজন ধার্মিক লোক দেখলে বুকে সুখ লাগতো, মনে হতো তারা মসজিদে যাচ্ছেন বা ফিরছেন, এখন পথে কয়েকজন ধার্মিক লোককে একসাথে দেখলে বুক কেঁপে ওঠে, মনে হয় তারা কোথাও খুন করতে যাচ্ছে বা খুন করে ফিরলো। এঁরা কোথায় যাচ্ছেন, এতো তাড়াতাড়ি কেনো হাঁটছেন এঁরা; রাশেদ মুহর্তের জন্যে তেরো বছরের বালক হয়ে ওঠে, একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায়, একটা রিকশা ডেকে উঠে বসে। একটু দূরে যেতেই সন্ধ্যা নামার মতো হয়, চারদিকে অজস্র মাইকে আজান বেজে উঠতে থাকে। পুব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণে অজস্র মাইকে,-রাশেদের কাছে আজান মানেই হচ্ছে হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠের স্বরমালা, যা গাছের পাতার ভেতর দিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে অলৌকিক গানের মতো এসে। পৌঁছোতে তার কানে, সে কান পেতে থাকতো যার জন্যে;–আজ সন্ধ্যায় মাইকের শব্দে ভীত হয়ে ওঠে রাশেদ, উত্তর দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, দক্ষিণ দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, পশ্চিম দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়, পুব দিকের মাইকগুলো তাকে ভয় দেখায়। ঢাকা শহরের সব মাইক গম্বুজ ভেঙেচুরে ক্রুদ্ধ হয়ে বেরিয়ে পড়তে থাকে, তীব্র গতিতে উড়ে আসতে থাকে তার দিকে, প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে ওঠে আশমানজমিন, এসেই পেঁচিয়ে ধরে তার গলা; একটি, দুটি, তিনটি, চারটি,…হাজার হাজার, লাখ লাখ মাইক তার দিকে উড়ে আসছে, তাকে পেঁচিয়ে ধরছে, রাশেদ দম ফেলতে পারছে না। রাশেদ আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু অন্ধকার দেখতে পায়, কোনো চাঁদ দেখতে পায় না, তারা দেখতে পায় না; সে প্রাণপণে। হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠস্বর শোনার চেষ্টা করে, দেখার চেষ্টা করে হেডমৌলভি সাহেবের কণ্ঠ থেকে ওই স্বর বেরিয়ে গাছের পাতার সবুজের ভেতর দিয়ে জ্যোৎত্সার মতো গলে গলে আসছে তার দিকে, ওই স্বর কুয়াশায় ভিজে ভিজে জোনাকির মতো আসছে তার দিকে; কিন্তু রাশেদ তা দেখতে পায় না। রাশেদ দেখতে পায় সেই অদ্ভুত লোকগুলো তার দিকে ছুটে আসছে, জোব্বার ভেতর থেকে বের করে আনছে। তলোয়ার, রাশেদ ছুটতে গিয়ে ছুটতে পারছে না, প্রত্যেকটি পথ আর গলির মুখে তারা দাঁড়িয়ে আছে।

খাপ খাওয়াতে হবে রাশেদকে, সব কিছু মেনে নিতে হবে, ‘না’ বলার অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে, যে তাকে যে-পথ দেখায় সে-পথকেই পুণ্যপথ বলে মেনে নিয়ে সোজা চলতে হবে, সব কিছু বিশ্বাস করতে হবে, বুকে কোনো অবিশ্বাস রাখতে পারবে না, যেমন চারপাশে কেউ কোনো কিছু অবিশ্বাস করে না; উদ্দিন মোহাম্মদ যা বলে, তা মানতে হবে; যারা গণতন্ত্র আনবে, তাদের মানতে হবে; তাদের গণতন্ত্র বিভিন্ন রকম, উদ্দিন মোহাম্মদ যা করলে স্বৈরতন্ত্র হয় তারা তা করলে গণতন্ত্র হবে, রাশেদকে সেই গণতন্ত্র মানতে হবে; তারা যে-সব মহৎ ধ্রুবসত্যে পৌঁচেছে, সে-সব সত্য মুখস্থ করতে হবে, তাদের সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি করতে হবে। এজন্যেই আজকাল দিকে দিকে। আবৃত্তি শেখানো হচ্ছে। উদ্দিন মোহাম্মদকে সে মানতে পারে না, কোনো উদ্দিন মোহাম্মদকেই সে কোনোদিন মানতে পারে না; কিন্তু অন্যদের, যারা গণতন্ত্র আনবে, যারা সোনায় রুপোয় দেশ ভরে দেবে? রাশেদ নির্বোধ, নইলে নিশ্চয়ই বুঝতো অন্যের আবিষ্কৃত সত্যে বিশ্বাস আনাই সবচেয়ে নিরাপদ, এবং সুখকর, সংঘে যোগ দিলে তার। আর কিছু ভাবতে হবে না, সংঘই ভাববে তার জন্যে, তার দেখাশোনা করবে, সময় এলে, যদি তার সংঘের মিথ্যায় সাড়া দেয় জনগণ, তাহলে সে পুরস্কার পাবে, মূল্যবান ঝলোমলো সে-সব পুরস্কার। নির্বোধ রাশেদ, এসব বুঝতে পারছে না, সরল সঠিক পুণ্যপথে চলতে পারছে না; সে শুধু বিপজ্জনক পথে পা ফেলছে। সে অবিশ্বাস করছে। সব কিছু; সে জাতির পিতা মানছে না, ঘোষণাকারী মানছে না, বাঙালি মানছে না, মুসলমান মানছে না, ঐতিহ্য মানছে না, প্রথা মানছে না, সমাজতন্ত্র মানছে না, সংঘ মানছে না, কোনো ধ্রুবসত্যই মানছে না। সমাজের শত্রু হয়ে উঠছে সে দিন দিন; তাকে কী করে সহ্য করবে সমাজ? সে-দিন রাশেদ এক সংঘের সভায় একটি প্রবন্ধ পড়লো, বিপজ্জনক কোনো বিষয়ে নয়, নিরীহ একটি বিষয়ে, যদিও আজকাল আর কিছুই নিরীহ নয়, কবিতা সম্পর্কে। প্রথাগত অনেকগুলো ধারণা সে বাতিল করে দিলো, সে আশা। করেছিলো যারা আলোচনা করবে, তারা বিচার করবে তার মতগুলো; কিন্তু তারা উচ্চকণ্ঠে এমন সব চিৎকার দিতে লাগলো, যার সাথে কোনো সম্পর্ক নেই রাশেদের রচনার। এক আলোচক বলতে লাগলো, সে রাশেদের প্রবন্ধ পড়ে নি, এমনকি শোনেও নি, কেননা রাশেদ জাতির পিতা মানে না। যে জাতির পিতাকে মানে না, তার বাঙলাদেশে থাকার অধিকার নেই। রাশেদ বাঙলাদেশে থাকার অযোগ্য, তাকে দেশ। থেকে বিতাড়িত করতে হবে। আলোচক আরো উচ্চকণ্ঠে বলতে লাগলো সে শুনেছে যে রাশেদ মনে করে জাতির পিতাকে হত্যা করা দরকার ছিলো। রাশেদ আলোচনা শুনে, আলোচকদের মগজের অবস্থার কথা ভেবে, কৌতুক বোধ করছিলো, ভাবছিলো। ভালোচনার শেষে সে উত্তর দেবে। কে একজন মঞ্চে এসে রাশেদকে এক টুকরো। কাগজ দিলো, তাতে সে রাশেদকে অনুরোধ করেছে মঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে, লিখেছে, দয়া করে আপনি এখনি ওখান থেকে চলে আসুন, নইলে মঞ্চে আপনাকে খুন করা হতে পারে। সত্যিই কি এমন ঘটতে পারে, কবিতা সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখে কি। রাশেদ এভোটা অপরাধ করে ফেলেছে, তার দেশ কি এতোটা বর্বর হয়ে উঠেছে। রাশেদ মঞ্চ ছেড়ে উঠলো না। আলোচনার শেষে সে উত্তর দিতে চাইলো, তখনি মঞ্চে শুরু হলো কোলাহল, একের পর এক তাণ্ডবকারী উঠতে লাগলো মঞ্চে, তারা। মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নিলো, চিৎকার করে বলতে লাগলো রাশেদকে কিছুতেই উত্তর দিতে দেয়া হবে না। এপাশ ওপাশ থেকে তখন শ্লোগান উঠছে, রাশেদের বিপক্ষে, এবং বিস্ময়কর-রাশেদের পক্ষেও। রাশেদকে ঘিরে আছে তার অচেনা অনুরাগীরা, একটি। তরুণী আর একটি তরুণ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, আর রাশেদ তাকিয়ে আছে মত্ত তাণ্ডবকারীদের দিকে, দেখতে চেষ্টা করছে বাঙলার ভবিষ্যৎ।

সংঘ নয়, আর সংঘ নয়; রাশেদের পক্ষে কোনো সংঘে থাকা সম্ভব নয়, সংঘ তার জন্যে নয়; রাশেদ এখন পরিচ্ছন্নভাবে জানে কী উপাদানে তৈরি এই সব সংঘ, দল, সংস্থা। রাশেদকে থাকতে হবে একলা, নিঃসংঘ; হানাহানি চক্রান্ত করতে থাকবে। সংঘের অধিপতিরা, পদের জন্যে পাগল হয়ে থাকবে তারা, দরকার হলে পা ধরবে। দরকার হলে পিঠে ছুরি মারবে, হবে অন্তঃসারশূন্য, মাথা রাখবে শক্তিমানদের পায়ে, তখন রাশেদ একা লাথি মারবে–সমাজ, রাষ্ট্র, নেতা, প্রভু, প্রথা, অপবিশ্বাসের মুখে, এবং সৃষ্টি করে চলবে। তার আদিম গোত্র তাকে পুঁতে ফেলতে চাইবে, পারলে সুখী হবে; সে লাথি মারবে আর সৃষ্টি করতে থাকবে। শুধু লাথি নয়, সৃষ্টি, সৃষ্টির জন্যেই লাথি। কিন্তু আজ রাতে রাশেদ বাসায় থাকতে পারবে না, আরো কয়েক রাতই হয়তো থাকতে পারবে না, বিশেষ শাখা তার খোঁজ করছে, মমতাজ একাধিক টেলিফোন। পেয়েছে, যারা নাম বলে নি, শুধু বলেছে কয়েক রাত রাশেদের বাসায় থাকা ঠিক হবে না। রাশেদ কি বিশ্বাস করবে এ-টেলিফোনগুলো? তবে পরিস্থিতি বেশ খারাপ, ধরাধরি চলছে, তার চেনা আরো দু-তিনজনও বাসায় থাকবে না, তারাও সংবাদ পেয়েছে বিশেষ শাখা খোঁজ করছে তাদের, রাশেদের খোঁজও করতে পারে। আচ্ছা, তারা যদি মাঝরাতে এসে রাশেদকে ধরে, নিয়ে যায়, তাকে নিয়ে গিয়ে তারা কী করবে? সিলিংয়ে ঝুলিয়ে চাবুক মারবে, বিদ্যুতের খোঁচা দেবে, জিভে সুচ ঢুকিয়ে দেবে? রাশেদ যতোটা জানে এখনো দেশটা আর্জেন্টিনা হয়ে ওঠে নি, তাকে ধরে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে নিশ্চয়ই বঙ্গোপসাগরে ফেলে দিয়ে আসবে না। তবু তার বাসায় থাকা চলবে না, মমতাজই বেশি চাপ দিচ্ছে, রাশেদের কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু যেতে হবে। একটি তরুণ অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে রাশেদকে তাদের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে, রাশেদ খুব বিব্রত বোধ করছে, বাসা থেকে বেরোতে তার খারাপ লাগছে, এমনভাবে আগে সে। কখনো বেরোয় নি। বাঁচার জন্যে সে পালাচ্ছে? পালাতে তার ইচ্ছে করছে না। মৃদুর : মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে রাশেদের, মৃদুর কাছে বড়ো একটা। অপরাধ করে ফেলেছে এমন মনে হচ্ছে তার। মৃদুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেও বিব্রত বোধ করছে রাশেদ। বিব্রতভাবে রাশেদ বেরোলো তরুণটির সাথে, তার গাড়িতে উঠলো, মনে হলো গাড়িটি তাকে নিয়ে অন্ধকারের দিকে চলতে শুরু করলো।

দু-দিন পর ফিরে এসে রাশেদ প্রথম টেলিফোন ধরেই শুনলো, কী রে, আইজকাল বাসায় থাকছ না? রাশেদ জিজ্ঞেস করলো, কে বলছেন; ঘাতক বললো, নাম দিয়া কী হবে, আমি তর মত নামকরা মানুষ না, এইটা জানানের জন্য ফোন করলাম যে তর ভবিষ্যৎ খারাপ, আমার নেতার নামে তুই এইসব কী লিখছস? রাশেদ জিজ্ঞেস করলো, আপনার নেতা কে? ঘাতক বললো, আমার নেতা হারামজাদা তরও নেতা, সব বাঙলাদেশির নেতা, তুই ত আবার নেতা মানছ না, আমার নেতাই ত দেশটারে স্বাধীন করছে, আমার নেতাই ত বেতারে স্বাধীনতা ঘোষণা করছে, তুই শোন নাই, আমার নেতাই ত একনম্বর মুক্তিযোদ্ধা। রাশেদ বললো, নেতার প্রতি আপনার ভক্তি দেখে মুগ্ধ হলাম; ঘাতক বললো, হারামজাদা, তুই তার নামে এইসব কী লিখছস? রাশেদ বললো, আমি তো অনেক কিছুই লিখেছি। ঘাতক বললো, হারামজাদা, অই যে লিখছস একনম্বর মুক্তিযোদ্ধাই একনম্বর রাজাকার হয়ে উঠছিল, দেশটারে রাজাকারদের হাতে তুলে। দিয়েছিলো, রাজাকাররা তার নাম বড় বড় অক্ষরে লিখে রাখবে, তার সাথে উদ্দিন। মোহাম্মদের পার্থক্য নাই, এইসব হারামজাদা তুই কী লিখছস? রাশেদ বললো, আমি কি মিথ্যা লিখেছি? ঘাতক বললো, কথা কইছ না হারামজাদা, তর দুই হাত কাইট্টা ফালামু, অই হাত দিয়া কিছু লিখতে দিমু না। রাশেদ বললো, হাত কেটে ফেললে পা থাকবে, পা থাকলেই চলবে আমার। ঘাতক বললো, পা দিয়া তুই কী করবি? রাশেদ বললো, হাত দিয়ে লেখার থেকে পা দিয়ে লাথি মারাই বেশি দরকার এখন, পা দুটি। থাকলেই আমার চলবে, লাথি মারতে পারবো। ঘাতক বললো, তর পা দুইটাও থাকব না দেখিছ। রাশেদ টেলিফোন রেখে দেয়, আর ঘাতকের মুখোমুখি দাঁড়াতে তার ভালো লাগছে না, ইচ্ছে হচ্ছে কাল সে ঢাকা ছেড়ে চলে যাবে, আর ফিরে আসবে না; কিন্তু, সে কেনো এসেছিলো এ-শহরে? না এলে কি চলতো না তার? সে একটি বালককে। দেখতে পায়, সে বাড়ির উত্তর ধারে কদমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একটি দুইকুলি দেখছে, দইকুলির বুকের ধবধবে জ্যোৎস্নায় তার বুক ভরে গেছে, তার চোখের মণিতে। হলদেবেগুনির স্নিগ্ধ আলো হয়ে জ্বলছে পুকুরভরা কচুরি ফুল, সে দেখতে পাচ্ছে বালকটি পুকুরে লাফিয়ে নেমে সাঁতার কাটছে, ডুব দিচ্ছে, ফিরে এসে চুলে সরষের তেল মেখে। চুল আঁচড়াচ্ছে, নিজের মুখটি বারবার দেখছে একটি পুরোনো আয়নায়, মনে মনে আদর করছে মুখটিকে, বালক কাঁধে বই রেখে বাঁ হাত বাঁকিয়ে বইগুলো ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে ইস্কুলের দিকে। ওই বালকই কি সে, রাশেদ, যে আজ আক্রান্ত, তার কী দরকার ছিলো এই নষ্ট নগরে আসার? সে কি সুখী হতো না ওই পুকুর আর বিল আর দইকুলি আর। মেঘ আর কদমগাছের প্রতিবেশিতায়? তার তো আসার কথা ছিলো না, তার সাথের। কেউ তো আসে নি; আর এলোই যদি তাহলে কেনো সে মাথাটা নিচু করে এলো না, যেমন এসেছে অনেকে, যারা খুব ভালো আছে, সে কেনো ভালো থাকার কৌশল শিখলো না? সে কেনো দীক্ষা নিতে জানে না, সে কেনো থেকে যাচ্ছে অদীক্ষিত?

শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল, তোমাকে কেউ। ভালোবাসে না, যদিও রাস্তার মোড়ে মোড়ে মাইক্রোফোন লাগিয়ে চিৎকার করে ওরা তোমাকে প্রেমের কথা শোনায়, কিন্তু কেউ তোমাকে ভালোবাসে না, ভালোবাসা কাকে বলে তুমি জানো না, একনায়ক জননায়ক, গণনায়ক দেশনায়ক জননেতা দেশনেতা, সবাই তোমাকে সম্ভোগ করতে চায়, সবাই চুষে চুষে তোমার ঠোঁট ছিঁড়ে নিতে চায়, ওরা ছিঁড়ে ফেলেছে তোমার ওষ্ঠ, তোমার ওষ্ঠের দিকে তাকানো যায় না, সবাই চুষে চুষে তোমার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে নিতে চায়, কামড়ে স্তনের মাংস ছিঁড়ে নিতে চায়, তোমার স্তনের দিকে আজ আর তাকানো যায় না, কেউ তোমাকে ভালোবাসে না, তোমাকে কেউ ভালোবাসে না, তোমাকে ভালোবাসে না কেউ, উদ্দিন মোহাম্মদ তোমাকে নষ্ট করছে,জননেতারা তোমাকে ভ্রষ্ট করছে, তুমি ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত-ব্যবহৃত ব্যবহৃত-ব্যবহৃত হয়ে শুয়োরের মাংস হয়ে যাচ্ছো, শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল, আমার মা, প্রিয়তমা, হৃদয়ের বোন, উদ্দিন মোহাম্মদ তোমাকে ন্যাংটো করে চাবকাচ্ছে, তার চাবুকের শব্দে তুমি নাচছো ময়ুরের মতো, সে তোমার শরীরের আরো ঝিলিক দেখার জন্যে আরো চাবকাচ্ছে, তুমি নাচছো রক্তাক্ত ময়ুর, মোল্লারা তোমাকে বেশ্যা মনে করে তোমার সমস্ত ছিদ্রে গুঁজে দিতে চাইছে আলখাল্লা, তোমার কানে আউড়ে চলছে কলমা, তোমাকে বিবি করার জন্যে তারা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফুটো পয়সার দেনমোহর নিয়ে, তোমার জরায়ু ভরে তুলতে চাইছে মুসলেমিনে, আর। এ-রাস্তায় ওই রাস্তায় সেই রাস্তায় দলের পর দল তোমাকে শোনাচ্ছে প্রেমের বচন, এক দল তোমাকে ঢাকাই শাড়ি কিনে দিতে চাইলে আরেক দল চাইছে শাড়ি কিনে দিতে, একদল তোমাকে কাতানের লোভ দেখালে আরেকদল তোমাকে জামদানির লোভ। দেখাচ্ছে, কিন্তু তুমি ছেঁড়া শাড়ি পরে আছে; একদল তোমাকে কানপাশা কিনে দিতে চাইলে আরেকদল তোমাকে মাকড়ি কিনে দিতে চাইছে, কিন্তু তোমার কান খালি; একদল তোমার জন্যে রুপোর নাকছাবি গড়ে আনবে বললে আরেকদল গড়ে আনতে চাইছে সোনার নোক, কিন্তু তোমার নাক খালি; একদল তোমার জন্যে নকল সাতনরী কিনে আনলে আরেকদল তোমার জন্যে বানিয়ে আনছে নকল চন্দ্রহার, কিন্তু তোমার গলা খালি; একদল তোমার বাহুতে বাজুবন্ধ পরাতে চাইলে আরেকদল পরাতে চাইছে। কেয়ুর, কিন্তু তোমার হাত খালি; ওরা ভালোবাসে না তোমাকে, ওরা ভালোবাসার কথা জানে না, শুধু সম্ভোগ করতে জানে, ওরা কেউ কখনো তোমার মাটির সুগন্ধে মেঘের সুগন্ধে বুক ভরে নি, ওরা কখনো তোমার জ্যোৎস্নায় কবি হয় নি, ওদের বুক থেকে কবিতা ওঠে নি গান ওঠে নি, ওরা জ্যোৎস্নায় শুধু কামার্ত হয়েছে, ওরা শুধু খলনীতি জানে ওরা কৃষিকাজ জানে না। আমিও কি ভালবাসতে পেরেছি তোমাকে, আমিও কি কতোদিন তোমাকে মিথ্যা ভালোবাসা দিয়ে মথিত করি নি শুভ্র পদ্ম, শাদা শাপলা, লাল গোলাপ, ঘুমজড়ানো দোয়েল? তবে আমার ভালোবাসা মিথ্যে হলেও তা তোমার কোনো ক্ষতি করবে না, কিন্তু ওদের কামের পাশ থেকে তোমার মুক্তি নেই, ওদের কাম তোমাকে জীর্ণ করবে, তোমাকে নষ্ট করবে, তোমাকে ধ্বংস করবে, তোমার মুক্তি নেই।

রাশেদের এখন চারকোটি টাকা দরকার, তার নিজের জন্যে নয়, নিজের জন্যে এক টাকাও তার দরকার নয়, কিন্তু এখন তার চারকোটি টাকা দরকার; একটা আখাডামিকে দিতে হবে টাকাটা, রাশেদ একটা আস্ত হারামজাদা, সে ওই মহান আখাডামির মানসম্মানের মুখে মল মেখে দিয়েছে, টাকাটা আখাডামিকে দিলে তার মান ফিরে আসবে, টাকাটা দিয়ে তারা আখাডামির মুখের মল ঠিকঠাকমতো মুছে ফেলবে, তার মুখ আবার ঝলমল করবে। উদ্দিন মোহাম্মদের ভৃত্যরা বসে আছে ওখানে, তারা এবার রাশেদকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে। রাশেদ নাকি ওটাকে বলেছে গোশালা, শুধু বলে নি, লিখে দেখিয়েছে কীভাবে ওটা গোশালায় পরিণত হয়ে গেছে, আর তারা বুঝতে পেরেছে গোশালা অত্যন্ত নিন্দিত জিনিশ, তাতে আখাডামির মান একরত্তিও অবশিষ্ট নেই, ওই মান উদ্ধার করতে হবে, উদ্ধারের জন্যে চারকোটি টাকা দরকার, তাই তারা চারকোটি টাকার মামলা তৈরি করেছে রাশেদের নামে, রাশেদের তাই চারকোটি টাকা দরকার। টাকাটা তার থাকলে এখনি গিয়ে দিয়ে আসতো। তারা অকাট্য প্রমাণ দিয়েছে যে এখানে কোনো গোশালা নেই, পাঁচজন পণ্ডিত দিয়ে তারা গবেষণা করে যে-তথ্য পেয়েছে তাতে নিশ্চিতভাবে বলা চলে ওখানে পঞ্চাশ বছর পাঁচ মাস চার দিন ধরে কোনো গোশালা নেই, তাই ওটাকে গোশালা বলা চলে না; আর গোশালা যদিও বাঙালির একান্ত আপন জিনিশ, তার হৃদয়ের ধন, তবু ওটাকে গোশালা বলা চলে না, কেননা ওখানে শুধু গবেষণা হয়, গবেষণা শব্দটির মৌলিক অর্থ গরু খোঁজা হলেও এখন আর ওখানে গরু খোঁজা হয় না। গরু খুজবে কেনো, খোঁজার তো আর দরকার পড়ে না। রাশেদ খুব কৌতুক বোধ করলো, তার জাতির মগজের গন্ধে সে ভয় পেলো। তার চারকোটি টাকা দরকার। টাকায় কি সম্মান ফিরবে? রাশেদকে এবার ভিক্ষায় নামতে হবে, চারকোটি টাকা ভিক্ষা করে পেতে তার অন্তত এক হাজার বছর লাগবে, সে এক হাজার বছর ধরেই ভিক্ষে করবে, একটি একটি করে পয়সা জমিয়ে এক হাজার বছর পর গিয়ে তার দরোজায় দাঁড়িয়ে বলবে, আপনার সম্মান ফিরিয়ে দিলাম। কার কাছে সে হাত পাতবে? কোটি কোটি টাকা যারা চুরি করেছে, তাদের কাছে পাতবে না, ওরা খুব গরিব মানুষ, ওরা ঋণ করে ফতুর হয়ে গেছে, দেয়ার মতো একটা সিকিও ওদের নেই; রাশেদ ভাবছে ভিক্ষে করার জন্যে সে প্রথম হাত পাতবে ভিখিরিদের কাছেই;–গুলিস্থানের মোড়ে গিয়ে সে দাঁড়াবে, প্রথম যে-ভিখিরিটিকে দেখবে, তার সামনেই হাত বাড়িয়ে বলবে, একটা পয়সা দিন, আমি বড়োই গরিব, আপনার থেকেও গরিব, আমার চারকোটি টাকা লাগবে, আপনার তো কয়েক বছর ভিক্ষা করলেই চলবে, আমাকে ভিক্ষে করতে হবে এক হাজার বছর। ভিখিরিরা তাকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেবে না। না, রাশেদকে ভিক্ষে করতে হলো না, রাশেদের পক্ষে একটা উত্তর দেয়া হলো, আখাডামি এবার চুপ করে গেলো, আরো মান হারানোর ভয়ে খুব ভদ্র হয়ে উঠলো।

রাশেদ তুমি ভালো হয়ে যাও, কথা বলা বন্ধ করে দাও, বললে শুধু মধুর মধুর কথা বলো, যা অমৃত ঢেলে দেবে জাতির কানে; তুমি ভালো হয়ে যাও রাশেদ, কথা বলা বন্ধ করে দাও, কথার বদলে শ্লোগান বলল, তুমি অন্তত একজনের নামে শ্লোগান দাও; রাশেদ তুমি লেখাটেখা বন্ধ করে দাও, লিখলে শুধু মধুর মধুর লেখা লেখো, যা জাতির বুকে অমৃতের ঝরনা বইয়ে দেবে। তুমি রজ্জব আলির মতো কথা বলো, দেখো না তার কথায় কতো মধু, শুনলেই বুক জুড়িয়ে যায়; লিখলে তুমি জুলমত ব্যাপারির মতো। লেখো, দেখো না তার লেখায় কতো মজা, অধ্যাপিকা থেকে গৃহপরিচারিকা রাষ্ট্রপতি থেকে বেশ্যার উপপতি কেমন খলখল করে ওঠে। রাশেদ তুমি একটা মাজার বেছে নাও, মাজারের খাদেম হও, লাশের পুজারী হও, রাশেদ তুমি মান্য করতে শেখো, সেজদা করতে শেখো। তুমি কি বুঝতে পারছে না তোমার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার? সত্য কথা বলার কী দরকার তোমার, তোমাকে কে বলেছে মানুষ সত্য পছন্দ করে? তুমি মিথ্যা বলো, মিথ্যার মতো মধুর আর কিছু হয় না। তুমি কি বুঝতে পারছে না তোমার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে, তোমার কোনো দরকার নেই এ-জাতির, তোমার মতো কুলাঙ্গারকে সরিয়ে দিতে পারলে স্বস্তি পায় জাতি? রাশেদ বসে ছিলো তার . প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘরটিতে, দরোজায় হঠাৎ শব্দ হলো; সে বললো, ভেতরে আসুন; কিন্তু কেউ ভেতরে ঢুকলো না। রাশেদ আবার বললো, ভেতরে আসুন, কেউ এলো না। রাশেদ নিজে দরোজা খুলতে গিয়ে খুব অবাক হলো যে দরোজাটি খুলছে না। সে বুঝতে পারলো বাইরে থেকে কেউ তার দরোজাটি এইমাত্র আটকে দিয়ে গেলো। তবু ভালো, ঘরে ঢুকে লোকটি তার ওপর ছুরি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নি, শুধু দরোজাটা আটকে দিয়ে গেছে, অন্য কোনো দিন হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়তে আসবে, তবু তো তা আজ নয়। লোকটি/ছেলেটি দেখতে কেমন হবে? রাশেদ তার মুখটি ভাবার চেষ্টা করলো, কোনো মুখ তার চোখে ভেসে উঠলো না, শুধু শূন্যতা ভেসে উঠলো চোখে। এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতরে একটি লোক আছে, যে এইমাত্র তার দরোজা বাইর থেকে আটকে দিয়ে গেছে, তার মনে এখন অনেক মজা, কেউ তার আঙুল ছুঁয়েও বুঝতে পারবে না ওই আঙুল একটা বড়ো কাজ করে গেছে, হয়তো আরো বড়ো:কাজের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। দরোজাটি খুলতে তার কষ্ট হবে, জানালা দিয়ে কাউকে ডাকতে হবে, যাকে ডাকবে সেও রাশেদকে সন্দেহের চোখে দেখবে, রাশেদ নিশ্চয়ই খুব খারাপ, নইলে কেউ তার দরোজা বাইর থেকে আটকাবে কেনো? রাশেদ ভেতর থেকে দরোজাটি। আটকে দিলো, তার মনে হলো যে-ঘর বাইর থেকে আটকানো সেটা ভেতর থেকে আটকে রাখা আরো ভালো। রাশেদ তার চেয়ারে বসলো, মনে হলো সে এ-মুহূর্তে বন্দী, ইচ্ছে করলেই বেরোতে পারবে না। তখন সে কারো অলৌকিক কণ্ঠস্বর শুনতে–পেলো;-তার আলমারির পেছনে একটি শালিক বাসা বেঁধেছে, শালিকটির মুখ সে কখনো দেখে নি, সে-শালিকটি তার সাথে কথা বলতে চাইছে। শালিকটির কথার। কোনো শেষ নেই, কিটিরিটিকিরিকিটিকিটিটিকিরি করে সে কথা বলে চলছে, রাশেদ উঠে গিয়ে উঁকি দিয়ে শালিকটির মুখ দেখলো, শালিকটি তার দিকে একটি বালিকার মতো তাকিয়ে আছে, ভালোবাসি বলার আবেগ রাশেদের বুকে কাঁপতে লাগলো, তবে সে বলতে পারলো না, কিন্তু শালিক যেনো বলে চলছে ভালোবাসি ভালোবাসি। ভালোবাসি, তার স্বরে রাশেদের মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে যেতে থাকে বাল্যকালের মেঘ, টেবিলের ওপর দুলতে থাকে একটা পেয়ারার ডাল, একটি বালিকা পেছন থেকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে শিউরে দেয় তাকে। রাশেদ ঘাসের ওপর শিশিরের ওপর খালি পায়ে। হাঁটতে থাকে, বন্দী করে কেউ তাকে বন্দী করে রাখতে পারে না। দরোজার পর দরোজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাশেদের সামনে, পথের পর পথ মুছে যাচ্ছে তার সম্মুখ থেকে, ইচ্ছে করলেই সে ঢুকতে পারতো ওই সব দরোজা দিয়ে, চলতে পারতো ওই সব পথে, রাশেদ প্রত্যাখ্যান করেছে ওই সব দরোজা আর পথ; তার আর ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল নেই, যতোটুকু মাটিতে সে দাঁড়িয়ে থাকে বা বসে থাকে যতোটুকু আসবাবের ওপর যেনো শুধু সেটুকুই তার দেশ, ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল হচ্ছে উদ্দিন মোহাম্মদের, আর অন্যদের। তার জন্যে আর বাস্তব নেই, আছে শুধু স্বপ্ন; স্বপ্নে সে দেশটাকে দেখে, দেখতে পায় দেশটা মরে যাচ্ছে ওই নদীটির মতো, পদ্মার মতো, তাদের পুকুরপাড়ের হিজল গাছটির মতো। রাশেদ শুধু মৃত্যুর স্বপ্ন দেখতে। পায়;–সে সাঁতার কাটছে পুকুরে, ডুব দিতে গিয়ে দেখে পুকুরে পানি নেই, পুকুরটি মরে গেছে, সে পড়ে আছে কাদার ভেতরে; বিলে, কুমড়ো ভিটের পাশে, একটা। শাপলাকে সে দুলতে দেখে, কাছে গিয়েই দেখে তার পাপড়িগুলো বালুপের মধ্যে উড়ছে, বিল মরুভূমি হয়ে গেছে; সে জ্যোৎস্নায় চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখে চাঁদটি মরে গেছে, তার শরীর থেকে অন্ধকার ঝরে পড়ছে। সম্পূর্ণ অন্ধকার নেমে আসার আগে। রাশেদের ইচ্ছে হচ্ছে সেই দুরূহ বইটি ধরতে, যেটি কেউ পড়বে না, যেটির কোনো। দরকার নেই কারো, তবু সে লিখছে সেটি। একটু সুখও পাচ্ছে বুকে, তার প্রথম বই বেরিয়েছে এবার, তা চোখের আড়ালে পড়ে থাকে নি; প্রশংসা যা পাচ্ছে বইটি তার চেয়ে বেশি পাচ্ছে নিন্দা,–বাসায় তার টেলিফোনের সংখ্যা বেড়ে গেছে, তিরস্কার ভোগ করছে সে নিয়মিত, তবু নিন্দাই এখানে ক-জনের ভাগ্যে জোটে। রাশেদ সেদিন এক। উৎসবে গৈছে, তার মনে হচ্ছে যাদের সে দেখতে চায় না তাদের দেখতে গেছে সেখানে, তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অনেকে, উদ্দিন মোহাম্মদের তিনটি বুড়ো অনুরাগী তাকে দেখে পড়েই যাচ্ছিলো, তবে জড়িয়ে ধরছে কেউ কেউ তাকে; তাদের আলিঙ্গন থেকে রসের মতো সুখ ঢুকছে তার ভেতরে। দুটি তরুণী দুটি তরুণ তাকে ঘিরে আছে সব সময়, তাহলে রাশেদ একলা নয়, তার সাথে কেউ কেউ আছে। তারা গিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বসলো। তরুণী দুটির মুখ থেকে জ্যোৎস্না ঝরছে টেবিলের ওপর, তাদের মুখে আজ পূর্ণিমা, তাতে ঝলমল করছে তার বইটি। তখন সেখানে ঢুকলো কয়েকটি যুবক, এসেই ঘিরে ফেললো টেবিলটি; তারা চিৎকার করে বলতে লাগলো, তোমার বই পড়ার জন্য নয় পোড়ানোর জন্য, এই সব আমরা চাই না, তোমাকেও একদিন। পুড়িয়ে ফেলা হবে। তারা টেবিল থেকে রাশেদের বইটি তুলে নিলো, আগুন লাগিয়ে দিলো বইটিতে, তার বই দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো। যুবকেরা জ্বলন্ত বইটি তার। সামনে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো;–রাশেদ দেখতে পেলো তার বইয়ের পাতা পুড়ছে, ছাই হচ্ছে, তার সাথে পুড়ছে ছাই হচ্ছে ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইল–পুড়ছে গাছের পাতা, নদী, মেঘ, বাতাস, ধানখেত, লাঙ্গল, সড়ক, গ্রাম, শহর, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে একটি জাতি, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার বর্তমান, পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে যাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *