১২. ভাল্লুক উল্লুক রজ্জব আলি আক্কাস আলি

১২ ভাল্লুক উল্লুক রজ্জব আলি আক্কাস আলি

একটা ভাল্লুক, আবর্জনার বাক্স খুলেই দেখতে পেলো রাশেদ, পদধুলি নিতে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের; ভাল্লুকটি কিছু দেখতে পায় কিনা বোঝা যাচ্ছে না, তবে উদ্দিন মোহাম্মদের সুবর্ণপদতল যে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ছানিপড়া চোখে বোঝা যাচ্ছে, শক্তিশালী পদতল দেখতে সে ভুল করে না বলেই মনে হচ্ছে, ভাল্লুকটি পদতলই দেখতে চায়, যেমন ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের পল্লী জুড়ে অসংখ্য উলুক ভাল্লুক বেবুন বাঁদর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে উদ্দিন মোহাম্মদের বুটপদ্মের দিকে। ভাল্লুকটি দোয়া করতে এসেছে উদ্দিনকে, তার দোয়া ছাড়া সম্ভবত উদ্দিনের চলছে না, ভাল্লুকটি বারবার জড়িয়ে ধরতে চাইছে উদ্দিন মোহাম্মদকে, একবার কেঁপে কেঁপে উঠে জড়িয়ে ধরেই। ফেললো, ধরতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলো, উদ্দিন মোহাম্মদ জড়িয়ে ধরে একটা বিপজ্জনক দুর্ঘটনার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে, উদ্দিন মোহাম্মদের বাহুর মধ্যে সে খুব শান্তি পাচ্ছে, পায়ে পড়লে আরো শান্তি পেতো, আল্লার কাছে কামনা করছে সে উদ্দিনের দীর্ঘ জীবন, বলছে উদ্দিন মোহাম্মদের মতো মহান রাষ্ট্রপতি পেয়ে ধন্য হয়েছে দেশ, সে শত শত বছর বেঁচে আছে শুধু উদ্দিন মোহাম্মদের মতো মহান নরপতিকে দেখার জন্যে। উদ্দিন মোহাম্মদ যে ভাল্লুকটির থেকে উৎকৃষ্ট, তাতে সন্দেহ নেই। ভাল্লুকটি অর্জন করেছে এক বড়ো কৃতিত্ব, সে ৫০৫ বছর ধরে বেঁচে আছে, হয়তো আরো ৫০৫ বছর বাঁচবে, তারপরও হয়তো ৫০৫ বছর বাঁচবে; যেখানে শিশুরা জন্মেই মরে যায়, মরাই যেখানে স্বাভাবিকতা, যুবকেরা যেখানে যৌবন পেরোতে পারছে না, সেখানে ৫০৫ বছর বাঁচা বিভীষিকাপূর্ণ কৃতিত্ব, সকলের বয়স খেয়ে সে বেঁচে আছে; এ-কৃতিত্বের জন্যে। দেশ পাগল হয়ে আছে ভাল্লুকটিকে নিয়ে। আগে ভাল্লুকটি দাবি করতো তার বয়স ৫১০ বছর, বাবর আর আকবরকে ন্যাংটো দেখেছে, বখতিয়ার খিলজিকে অল্পের জন্যে দেখে নি, সেজন্যে তার বুকে অনেক কষ্ট, দেখতে পেলে খিলজির ঘোড়ার জন্যে ঘাস নিয়ে হাজির হতো, চণ্ডীদাস তাকে পদাবলি গেয়ে শোনাতো; কয়েক বছর আগে এক মেধাবী সেবক তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে ৫১০ বছর বাঁচা কোনো কৃতিত্ব নয়, কৃতিত্ব হচ্ছে ৫০০ বছর  বাঁচা, ৫০০ বছর বাচলে আয়োজন করা যায় হীরকোত্তম জয়ন্তী; তখন সে। ঘোষণা করে তার পিতার স্বহস্তলিখিত আদিঠিকুজিটি তার হাতে এসেছে, তার সূর্য চন্দ্র গ্রহগুলো নির্ভুলভাবে যোগ করে দেখা যাচ্ছে তার বয়স ৫০০ বছর। তখন সমগ্র জাতির মধ্যে সাড়া পড়ে যায়, তার হীরকোত্তম জয়ন্তী পালনের জন্যে পাগল হয়ে ওঠে বাঙালি অর্থাৎ মুসলমান বাঙালি, সে-পাগলামো আজো কমে নি। সে জাতির মহত্তম। ভাল্লুক, তাকে নিয়ে জাতির গৌরবের অন্ত নেই। জাতিটি শুধু সংবাদ নিয়ে দেখছে না ৫০০ বছর ধরে সে কী করেছে, কী করেছে তার প্রিয় রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময়, জিন্না যখন বলেছিলো উর্দু আর উর্দুই হবে পাকিস্থানের রাষ্ট্রভাষা, তখন ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছিলো, আর ভাল্লুকটি তিরস্কার করেছিলো ছাত্রদের, বলেছিলো কায়েদে আজমের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে, ছাত্ররা বেয়াদব। ভাগ্য ভালো, তার জাতির মাথার সে-অংশটি অসুস্থ, যার কাজ তথ্য ধারণ করে রাখা। সে-ভাল্লুকটি পদধুলি নিতে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের, ৫০০ বছর ধরে যে-আবর্জনা সে জড়ো করেছে, তার। একটি স্কুপ উপহার হিশেবে নিয়ে এসেছে উদ্দিন মোহাম্মদের জন্যে; উদ্দিন মোহাম্মদও ধন্য হ’তে জানে, সে উপহার পেয়ে ধন্য হচ্ছে এমন একটি অভিনয় করছে, ওই উপহারের বিনিময়ে উদ্দিন মোহাম্মদ ভাল্লুকটি কয়েক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার নির্দেশ দিচ্ছে। পদতলে চুমো খেয়ে মুদ্রা অর্জনের জন্যেই ভাল্লুকটি এসেছে বুঝতে পারছে রাশেদ। রাশেদের ঘেন্না লাগছে, না তার ঘেন্না লাগছে না, তার খুব ভালো লাগছে, এসব দেখতে দেখতে তার অনুভূতিপুঞ্জ সাভারের মোষের ঘাড়ের মতো হয়ে গেছে; ঘেন্না লাগছে না, তার বমি পাচ্ছে। সে কি আবর্জনার বাক্সটিকে উপহার দেবে তার হলদে বমিটুকু? তার। জাতির গৌরব পদতল চাটছে উদ্দিন মোহাম্মদের, পদতল চাটার দৃশ্য ঘুরে ফিরে দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে, রাশেদের মনে হচ্ছে সে নিজেই পদতল চাটছে উদ্দিন মোহাম্মদের।

জাতির গৌরব কর্তৃক শয়তানের পদতল চাটার দৃশ্য দেখা এটাই প্রথম আর শেষ নয় রাশেদের, বাঙলার গৌরবগুলো বদমাশ হতে পারে শয়তানের থেকেও; এমন আরো অনেক দেখেছে রাশেদ, তাতে তার বুক ভরে আছে, বেঁচে থাকলে আরো দেখবে, তার বুক উপচে পড়বে। রাশেদের এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে সে-চমৎকার উলুকটিকে, জাতির। বিবেক হয়ে উঠেছিলো যে, মুখ খুললেই যে গলগল করে বলতো ছাগল মানে শিং নিচু করা, সেই উলুকটির সাথে এই ভাল্লুকটিকে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে রাশেদের; ছাগল মানে শিং নিচু না করা-তার কথাটি মনে দাগ কেটেছিলো ছাগলসম্প্রদায়ের, তারা মুখ ফাঁক করলেই জিভের তলা থেকে বেরিয়ে পড়তে ছাগল মানে শিং নিচু না করা, এবং তারা কখনো শিং নিচু করতে চাইতো না, যদিও কখনো খুঁজে দেখতো না। তাদের মস্তকে আদৌ কোনো শিং আছে কিনা। উলুকটি তখন বিবেক হয়ে ওঠে নি, একবার তাকে দেখতে গিয়েছিলো রাশেদ, গিয়ে দেখতে পেয়েছিলো একটা অন্ধকার ঘরে পরিত্যক্ত পশুর মতো পড়ে আছে, বেশি দিন বাঁচবে না, রাশেদকে দেখে সে খুব খুশি হয়েছিলো, অনেক দিন কেউ তার খোঁজ করে নি, কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে। কাঁদছিলো সে। কিছু দিন পরেই সে বিবেক হিশেবে দেখা দিতে থাকে। বাঙালি একটি বিবেক পেয়ে ধন্য বোধ করে, অনেক বছর দেশ থেকে যাত্রা উঠে গেছে বলে বিবেক সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না ছাগলসম্প্রদায়ের, কিন্তু এ যখন চিৎকার করে। ওঠে ছাগল মানে শিং নিচু না করা, তখন তারা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। পরাধীন। বাঙালি একদিন স্বাধীন হয়, কী বিস্ময়!-আর ওই বিবেকটির চাঞ্চল্যকর বিকাশ ঘটতে থাকে, বিবেকের কথা বলতে বলতে সে ছাগলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বড়ো বড়ো পদের ওপর বসতে থাকে, এবং অভ্যাসবশত পথেঘাটে ডেকে যেতে থাকে তার শেষ। কথা-ছাগল মানে শিং নিচু না করা। রাশেদ তার বিকাশ দেখে শিং নিচু না করে মাথা নত করেছে মনে মনে, তবে একটা সন্দেহ তার কাটে নি। রাশেদ ছেলেবেলায় বিবেকের লেখা একটা বাজে বই পড়েছিলো, জিন্নাকে নিয়ে লেখা বই, সে অবশ্য জিন্না বলে নি, বলেছে কায়েদে আজম, যাতে জিন্নার প্রতি ভক্তিতে সে ছিলো গদগদ, জিন্না তার কাছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, আর পাকিস্থান এক মহান দেশ, যার জন্যে সে জান কোরবান। করতে ছিলো প্রস্তুত। কয়েক বছরের মধ্যেই জাতির বিবেকটি ক্লান্ত হয়ে পড়ে বিবেকের ভারে, শিং উঁচু রাখতে ভুলে যায়, তার শিং খসে পড়ে; দেশে একটি একনায়ক বালক দেখা দিলে বালকটির পায়ে বিবেকটি মাথা রেখে জীবনকে সফল করে তোলে। বিবেক বাঁদর হয়ে ওঠে একনায়কের, বাঁদরামো করতে থাকে সমস্ত চৌরাস্তায়, শরীর ফুলে উঠতে থাকে, ছাগল মানে শিং নিচু না করার কথা তার আর মনে থাকে না। একনায়ক বালকটি একদিন লাথি মেরে ফেলে দেয় তাকে, সেই শোকে বিবেক মারা যায়, নিশ্চয়ই সে যেখান থেকে এসেছিলো সেখানে ফিরে গেছে। এখন দেখা দিয়েছে ভাল্লুকটি, ভাল্লুক যেখানে গৌরব সেখানে উদ্দিন মোহাম্মদ দেখা দেবেই। রাশেদ খোঁচা দিয়ে বাক্সটি বন্ধ করে দেয়।

ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের গ্রাম উপচে পড়ছে সর্বজনপ্রিয় ও সর্বজনশ্রদ্ধেয়তে, রাশেদ তুমি কখনো তা হতে পারবে না, রাশেদ পরিহাস করছে নিজেকে, তুমি যা। করছে তাতে জীবনটা তোমার শেয়ালের খাদ্য হবে, মরার পর শেয়ালও খাবে না, এবং ভাবছে সর্বজনপ্রিয়শ্রদ্ধেয় রজ্জব আলির কথা, রজ্জব আলিকে খুব শ্রদ্ধা করে রাশেদ, কে তাকে শ্রদ্ধা করে না? রজ্জব আলিও প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতির গৌরব হয়ে ওঠার, বঙ্গোপসাগরে গ্রামটা ডুবে না গেলে একদিনই হয়ে উঠবেই, ৩৫ বছর ৫ মাসেই সে সর্বজনশ্রদ্ধেয় হয়ে উঠেছে, যেমন পাণ্ডিত্য তেমনি তার চরিত্র তেমনি তার পাঞ্জাবি, শহিদ মিনারে তাকে পাওয়া যাচ্ছে সকালবিকেল, শুধু সন্ধ্যার পর পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ বলতে পারে না সন্ধ্যা হলে কোথায় যায়। রজ্জব আলির কোনো দুর্নাম হয় না, ভূমণ্ডলের একক রাজহংস রজ্জব আলি, কাদায় সন্ধ্যাভর ডুবসাঁতার কাটার পরও তার পালকগুলো শুভ্র থাকে। কিছু দিন আগে উদ্দিন মোহাম্মদের প্রতিনিধি হয়ে পশ্চিমে ঘুরে এসেছে, এসেই শহিদ মিনারে গেছে, সবাই তাকে পেয়ে ধন্য হয়েছে। সে যে খুব বিদ্রোহী রাশেদ তাতে কোনো সন্দেহ পোষে না, কিছু দিন আগেই তার বিদ্রোহের একটা জ্বলন্ত উদাহরণ দেখতে পেয়েছে জাতি। উদ্দিন মোহাম্মদ আরো দশটা সর্বজনশ্রদ্ধেয়র সাথে তাকে একটা পদক দিয়েছে, পদকের ঘোষণা শুনেই সর্বজনশ্রদ্ধেয়দের পেছনের অস্থি বেঁকে গেছে, বাঁকে নি শুধু রজ্জব আলির। উদ্দিন মোহাম্মদ পদক বিলোনোর জন্যে আয়োজন করেছে জাতীয় অনুষ্ঠানের, তারারা আড়ম্বর অত্যন্ত ভালোবাসে, দিকে দিকে সাড়া পড়ে গেছে, অন্যান্য উজবুকগুলো তাদের শ্রেষ্ঠ পাঞ্জাবি স্যুট আচকান পরে গিয়ে উঠেছে সেখানে, রজ্জব আলি যায় নি, উদ্দিন মোহাম্মদের হাত থেকে সে পদক নিতে পারে না, সে বিদ্রোহ করেছে, সে পদক নেয়ার জন্যে পাঠিয়েছে তার সহধর্মিণীকে। রজ্জব আলি পদকমন্ত্রীকে জানিয়েছে সে অসুস্থ বলে উপস্থিত থাকতে পারছে না, এটা রজ্জব আলির এক মারাত্মক বিদ্রোহ, সে বিদ্রোহ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে, সে উদ্দিন মোহাম্মদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না, তার মেরুদণ্ড বেঁকে গেলেও ভাঙবে না। সহধর্মিণীটিকে সে পাঠিয়েছে, সহধর্মিণীর আবার সম্মান কী, সম্মান বিসর্জন দেয়ার পরই তো মেয়েলোক সহধর্মিণীর মর্যাদা পায়, তাকে যেখানে ইচ্ছে পাঠানো যায়, উদ্দিন মোহাম্মদের কাছেও পাঠানো যায়, সহধর্মিণীর ধর্মই হচ্ছে নিজেকে অপমানিত করে পরমগুরুর গৌরব বাড়ানো। রাশেদ আবার টেলিভিশনটা খোলে, আরো দু-একটি। উলুকভাল্লুক দেখতে ইচ্ছে করছে আজ সন্ধ্যায়, সে একটা ভড়কে দেখতে পায়, এটা এখন বাজারের শ্রেষ্ঠ ভাঁড়, অন্যান্য ভাঁড়রা হার মেনে আত্মহত্যার কথা ভাবছে, সে গান গেয়ে চলছে উদ্দিন মোহাম্মদের। দু-দিন পর একটা হরতাল ডাকা হয়েছে, ঘন ঘন হরতাল হচ্ছে আজকাল, সে ভার নিয়েছে হরতাল থামানোর, একপাল মেয়েকে নিয়ে সে নাচছে, নেচে নেচে দেখাচ্ছে হরতাল হ’লে রিকশাঅলার কতো কষ্ট, ভিখিরির কতত। কষ্ট, গরিবের কতো কষ্ট, কষ্টে তার বুক চৌচির হয়ে যাচ্ছে, আর দশটা কম্পিউটার চিৎকাৎ করে দেখাচ্ছে হরতালে দেশের একদিনের ক্ষতি ৮৬৯৮৭৬৮৯৭৬৫৪৩২৫৬৭৮ কোটি টাকা। ভাঁড়টা চার বছর আগে বন্দনা গাইতে আরেকটি একনায়কের, তখনো ছিলো সে ভাড়োত্তম, একনায়কটি নিয়তির দিকে এগিয়ে গেলে, একনায়কটির একটা। ছেঁড়া ময়লা আন্ডারওঅ্যার নিয়ে সে হাজির হয় টেলিভিশনে, আন্ডারওঅ্যার জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে মুখে বুলিয়ে চুমো খেয়ে একঘণ্টা ধরে কাঁদে, আরো ঘণ্টাতিনেক সময় তার। কান্নার জন্যে বরাদ্দ ছিলো, কিন্তু এক ঘণ্টায়ই সে শহরের সব গ্লিসারিনের বোতল। নিঃশেষ করে ফেলে, তাই এক ঘণ্টায়ই অনুষ্ঠান শেষ করতে বাধ্য হয়। তার কান্না দেখে দেশজুড়ে দর্শকরা হেসে লুটিয়ে পড়েছিলো, দেশবাসীর হাসার শব্দ উঠছিলো দিগদিগন্ত থেকে, চট্টগ্রামের হাস্যরোল দিনাজপুরের যশোরের অট্টরোল সিলেটে বিক্রমপুরের হাস্যলহরী চুয়াডাঙ্গায় শোনা গিয়েছিলো। এর আগে সে এতো এবং এমন লোক হাসাতে পারে নি, সে-দিনই সে জাতিকে উপহার দিয়েছিলো তার সর্বোত্তম ভাঁড়ামো, জনগণ তাকে ভাড়োত্তম উপাধি দিয়েছিলো, এবং জনগণের অনুরোধে তার সে-কৌতুকানুষ্ঠান দেখানো হয়েছিলো ছ-মাস ধরে। রাশেদ ভাঁড়টিকে দেখে মজা। পাচ্ছে, একই সন্ধ্যায় একটি ভাল্লুক ও একটি ভাড়োত্তম দেখে বুকে তার খুব উল্লাস হচ্ছে।

এ-বাক্স, আবর্জনার বাক্সটিই এখন বাঙলাদেশ, ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল বিশ ইঞ্চিতে পরিণত এখন, এ-বাক্স এখন বহুগুণে সত্য বাঙলাদেশের থেকে, এ-বাক্স বাস্তবতার থেকে অনেক বেশি বাস্তব। কিছু আর সত্য নয়, যা এ-বাক্সে আবর্জনারূপে জমে না, আর তাই প্রতিভা যা এ-বাক্স থেকে বিচ্ছুরিত হয়। সত্য হচ্ছে, ভাঁড়টি যেমন। বলে গেলো, দু-দিন পর হরতাল হবে না, হরতালের হওয়ার কোনো সাধ্য নেই, বাক্সের বাইরের কোনো সত্যই সত্য নয়, রাশেদ জানে দু-দিন পর দেখা যাবে দেশজুড়ে হরতাল হ’লেও দেশজুড়ে হরতাল হয় নি। আর প্রতিভা হচ্ছেন ওই অধ্যাপক আক্কাস আলি, যিনি চক্রবরফক্কর পরে ‘আলতুফালতু’ নামের মাখাজিন উপস্থাপন করছেন, বারবার ওপরের ঠোঁটের থুতু চাটছেন নিচের ঠোঁট দিয়ে, আর নিচের ঠোঁটের থুতু চাটছেন ওপরের ঠোঁট দিয়ে, চাটার ভঙ্গিটি তার অপূর্ব ঠোঁট দুটি একটু দীর্ঘ বলেই, তিনি এখন নাচের ভেতর দিয়ে গান আর গানের অভ্যন্তর দিয়ে যে-নাচটি পরিবেশিত হবে, তার ভূমিকা পেশ করছেন, দর্শকদের তালি বাজাতে বলছেন, তবে গোঁফে এক টুকরো থুতু আটকে তাঁকে বিব্রত করে তুলছে, তিনি তাঁর বাক্যগুলোকে যথেষ্ট চিবোতে পারছেন না, তাই সুস্বাদু লাগছে না। অধ্যাপক আক্কাস বইটই পড়ছেন না আজকাল, লেখার চেষ্টা করেছিলেন শুভবিবাহের আগে, আর লিখতে পারেন নি-একটা তিনবছুরে বই ছাড়া; তিনি প্রতিভা, যেহেতু তিনি বাক্সে আলতুফালতু করেন। আগের একনায়কটি তার ঠোঁট চাটা পছন্দ করতো না, আশ্চর্য, একনায়কদেরও রুচিবোধ থাকে, তাই তিনি বহিষ্কৃত। হয়েছিলেন বাক্স থেকে, তাতে আক্কাস আলির একটা ছোটোখাটো স্ট্রোক হয়েছিলো, উদ্দিন মোহাম্মদ আসার পর তিনি আবার প্রতিভা বিকাশ করে চলছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়টির জন্যে মায়া হয় রাশেদের, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি গৌরব বোধ করে আক্কাস আলিকে নিয়ে, বইটই সবাই লিখতে পারে, আলতুফালতু করতে পারেন শুধু অধ্যাপক আক্কাস আলি। আক্কাস আলি এখন একটি বালিকার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, ঢলঢল করছে বালিকাটি, আক্কাস আলি একটু বেশি করে ঠোঁট চাটছেন, তিনি বালিকার প্রতিভা বর্ণনা করছেন, শুনে মুগ্ধ হচ্ছে রাশেদ, চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ছে তার রক্তমাংসে, রাশেদ বালিকাটিকে চিনতে পারছে, দু-দিন আগে তিনঘণ্টা ধরে রাশেদ তো। এ-প্রতিভাময়ীরই সোনালি জীবনের রুপোলি পুরাণ আর নীল কথকতা পাঠ করেছে। রাশেদ সেদিন ঘরে ফিরে শুনতে পায় মমতাজ মৃদুকে কী যেনো পড়ে শোনাচ্ছে, সম্ভবত রূপকথা শোনাচ্ছে, মৃদু আজকাল দিনরাত গল্প শুনতে চায়, ওর জন্যে একটি শাহেরজাদি দরকার, রাশেদের রূপকথার সব মজুত ফুরিয়ে গেছে, নিশ্চয়ই মমতাজের সংগ্রহও নিঃশেষ, তাই পত্রিকা থেকেই পড়ে শোনাচ্ছে, মৃদু মনপ্রাণ দিয়ে শুনছে সে-রূপকথা। মমতাজ পড়ছে, আকবর তার তন্বী লাস্যময়ী নববধুকে নিয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে, মাত্র তিন মাস হলো বিয়ে হয়েছে তাদের, পাজেরো চালাচ্ছে কোটিপতি আকবর নিজে, পাশে তার রূপসী যৌবনবতী বধু লায়লা। লায়লার চুল উড়ছে, তার চোখে। সাগরের স্বপ্ন, প্রেমের স্বপ্ন, এমন সময় আকবর তার পাজেরো থামায় নির্জন রাস্তার পাশে। তখন আকাশে চাঁদ উঠেছে, চাঁদের আলোতে লায়লা হয়ে উঠেছে আরো রূপসী, চাঁদের আলোর মতোই তার শরীরে যৌবনের জোয়ার। আকবর একটা কোকের বোতল তুলে হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাত করলো লায়লার মাথায়, লায়লা লুটিয়ে পড়লো, একটি ছুরি ঢুকিয়ে দিলো আকবর লায়লার পেটে। রাশেদ থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিলো রূপকথা, মৃদু কি আজকাল এ-রূপকথাই শুনছে? নতুন রূপকথা জন্ম নিচ্ছে দেশজুড়ে, যা অনেক বেশি শিহরণজাগানো লালকমল নীলকমল তুষারকন্যার থেকে। মমতাজ একটু থামতেই মৃদু বলছে, আরো পড়ো আম্মা, আরো পড়ো, তার রক্তে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে, নীলকমল লালকমল তাকে এতোটা উত্তেজিত করে নি; মমতাজ পড়ছে, আজরাত ভোর হওয়ার। আগে পাষণ্ড আকবরের ফাঁসি হবে, সকাল থেকেই তাকে তৈরি করা হচ্ছে ফাঁসির জন্যে। দেশ ভরে খোঁজার পর একজন জল্লাদ পাওয়া গেছে, জল্লাদ পাকা কলা দিয়ে বারবার ফাঁসির রশি মেজে রশিটিকে পিচ্ছিল করেছে, আজো সে রশির গায়ে পাকা। কলা মাখবে, আকবরকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে কী খেতে চায়, আকবর বলেছে সে সিগারেট খেতে চায়, কাকে দেখতে চায়, আকবর বলেছে সে তার উপপত্নী নুরজাহানকে দেখতে চায়। রাশেদ মমতাজকে ডাকে; পড়া রেখে মমতাজ মাথা তুললে মৃদু উত্তেজিত হয়ে বলে, আরো পড়ো আম্মা, আরো পড়ো আম্মা, আরো শুনতে ইচ্ছে। করছে। ভয় পেয়ে রাশেদ তাকায় মৃদুর দিকে; মৃদু কাঁপছে, নতুন কালের রূপকথা তাকে উত্তেজিত করে তুলেছে, তার স্বপ্নকে তোলপাড় করে চলছে এই সময়ের নায়ক।

দুপুরের খাওয়ার পর রাশেদ চিৎ হয়ে শুয়ে ওই পত্রিকাটি খুলে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে মৃদুর থেকেও; এতো দিন পর পড়ার মতো একটা জিনিশ সে পেয়ে গেছে, এর পর সে এসবই পড়বে, বালিকা আর বালিকা, লাস্য হাস্য যৌবন নিতম্ব ওষ্ঠ স্তন জংঘা জঘনবতী কিশোরীরা পাতার পর পাতা, রঙিন শাদা কালো বালিকা লাল নীল সবুজ হলুদ বালিকা কালো নীল সবুজ বালিকা রঙিন শাদা কালো লাল নীল সবুজ হলুদ। বালিকাদের সময় চলছে এখন, যুবতী কেউ চাইছে না, বালিকা চাইছে সবাই, আরো বালিকা। এই বালিকার বাহু তুলনাহীন। ওই বালিকার নিতম্ব অতুলনীয়। ওই বালিকার বক্ষ অনির্বচনীয়। আক্কাস আলির বালিকাটিও আছে এর মধ্যে, বড়ো বেশিই আছে, তার সব কিছু উপচে পড়ছে, মাধ্যমিক পেরোয় নি, হয়তো আর পেরোরে না, কিন্তু উপচে পড়ছে সম্মুখ পেছন ওপর নিচ, সে–ইংরেজি বাঙলা মিলিয়ে মিশিয়ে বলছে জীবন অ্যাকটা স্বপ্ন, রঙিন ড্রিম, সে নায়িকা হতে চায়, নায়িকা না হলে সে বাঁচবে না, তাই সে মডেলিং করছে, পাঁচটা ছবিতে সই করেছে এরই মাঝে। অভিনয় হচ্ছে আর্ট, আর্ট হচ্ছে। তার জীবন। বালিকা চমৎকার চমৎকার কথা বলেছে, সে খুব ধার্মিক, সময় পেলেই। নামাজ পড়ে, ‘দাউদাউ দিল’, যার ইংরেজি নাম ‘ফায়ারিং হার্ট’, ছবিটার শুভমহরতের পরই সে আজমিরশরিফ যাবে, হজ করারও তার খুব ইচ্ছে আছে। সে খুব ভালো মেয়ে, প্রেম করে না, বিয়ের আগে প্রেম করাকে সে খারাপ মনে করে, বিয়ের পর স্বামীর সাথে প্রেম করবে, স্বামীর পায়ের নিচেই তার বেহেস্ত সে বিশ্বাস করে; সে সেক্স পছন্দ করে না, তবে আর্টের দরকারে যদি সেক্স করতে হয়, কাপড় খুলতে হয়, সে সেক্স করবে, কাপড় খুলবে, কেননা সবার ওপরে আর্ট, আর্টের দাবি সে পূরণ করবে, আর্টের দাবি পূরণ না করা পাপ। বালিকা অনেক কিছু জানে, এও নিশ্চয়ই জানে একটি আর্টের নাম প্রযোজক, আরেকটি আর্টের নাম পরিচালক, সে কি ওই আর্টগণের দাবিও মেটাবে? বোধ হয় এরই মাঝে মিটিয়েছে, নইলে মাধ্যমিকেই এতো উপচোচ্ছে কীভাবে? সাক্ষা কারগ্রহণকারী তার কাছে জানতে চেয়েছে তার প্রিয় উক্তি কী, সে বলছে, তার প্রিয়। উক্তি শেক্সপিয়রের ‘নো দাইসেল্ফ’ (যেমন মুদ্রিত), তার প্রিয় উপন্যাস শেক্সপিয়রের ‘ওআর অ্যান্ড পিস’ (যেমন মুদ্রিত), বালিকা ইংরেজি সাহিত্য ছাড়া সম্ভবত আর কোনো সাহিত্য পড়ে নি। সে বলছে সত্যজিৎ তার কাছে গডের মতো, গডের থেকেও বড়ো, ইচ্ছে হয় তার কাছে গিয়ে বলে, আমার সব কিছু আপনি নিন, কিন্তু বালিকা পথের পাঁচালীর লেখকের নাম মনে করতে পারছে না, তার মনে হচ্ছে ওই স্টোরিটা রবীন্দ্রনাথ ল্যাখছে, রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো স্টোরি লিখতে পারতেন। আক্কাস আলি শক্ত দাঁত দিয়ে। মটরের মতো চিবোচ্ছেন বাঙলা শব্দগুলো, বালিকাটিকেও চিবোচ্ছেন মনে হচ্ছে, বলছেন বাঙলার বালিকাদের হতে হবে এ-রূপসী লাস্যময়ী বালিকার মতো, তার মতো রূপে ঝলসে দিতে হবে আকাশমাটি, তার পথেই এগিয়ে যেতে হবে বালিকাদের, জয়। করতে হবে সব রকমের পর্দা, এখন একটি রাজ্যই জয় করার উপযুক্ত, সেটি হচ্ছে পর্দা, সেটি জয় করতে হবে, জয় করতে হবে সকলের স্বপ্ন। বাঙলাদেশ তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে;–আক্কাস আলি সম্ভবত বালিকাদের অন্য কোনো অঙ্গের কথা বলতে চাইছিলেন, এ-বালিকার একটি অঙ্গের ওপর বেড়ালের মতো আক্কাস আলির চোখ। পড়ে আছে, কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের দেশে বলতে পারছেন না, প্রকাশ্যে এখানে মুখের দিকেই তাকাতে হয়, গোপনে অন্যান্য অঙ্গের দিকে। বালিকারা অবশ্য এগিয়ে যাচ্ছে,। মডেল/হিরোইন/বাইজি জন্ম নিচ্ছে ঘরে ঘরে; জনকজননীরা কন্যা জন্ম দিয়ে আর স্থির থাকতে পারছে না, মাটিতে পুঁতে ফেলছে না, ঘরে একটা মডেল/হিরোইন/বাইজি সৃষ্টি ও নির্মাণের জন্যে দিকে দিকে ছুটছে। কয়েক দিন ধরে শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে শিল্পকলার ধুম লেগেছে, আমিরাত থেকে এক মহান আমির বাঙালি/বাঙলাদেশি শিল্পকলা খেতে এসেছেন, বোম্বাই শিল্পকলা খেতে খেতে তার অরুচি ধরে গেছে, শিল্পকলা অ্যাকাডেমি তাকে শিল্পশবরিকলা খাওয়াচ্ছে। সন্ধ্যার পর তাঁর নাচঘরে নর্তকীদের পায়ে তিনি বেঁধে দিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা, একরাতে কয়েক লাখ, টাকার থলে পায়ে বেঁধে নেচে চলছে বাঙলাদেশি শিল্পকলারা, তিনি খাচ্ছেন, আর পাগল হয়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমির পরিচালক, শুতে যাওয়ার পরও তিনি শিল্পকলাগণের জননীদের টেলিফোন পাচ্ছেন, কাতরভাবে জননীরা আবেদন করছে, এক রাতের জন্যে আমার মেয়েকে একটা চান্স দিন। বয়স থাকলে কন্যাদের হটিয়ে দিয়ে জননীরাই এক রাতের জন্যে একটা চান্স নিতো, তা হচ্ছে না, আমির পাকাপচা কলা খেতে পছন্দ করেন না।

আক্কাস আলির ‘আলতুফালতু’তে এখন কথা বলছেন’ ঐশী উচ্চারণ করে চলছেন, দোনাগাজি, দেশের মুখ্য মহামহোপাধ্যায়; কবিও, সমালোচকও, এবং সব কিছু। পাকিস্থানের জন্যে বদ্ধপাগল ছিলেন তিনি একদা, বলেছিলেন পাকিস্থানের জন্যে বাঙালি মুসলমান বাঙলা ভাষা বাদ দিতে রাজি, বাঙলা মুসলমানের ভাষা নয়; আর একাত্তরে চাপে পড়ে পালিয়েছিলেন দেশ থেকে, ফিরেছিলেন বড়ো একটা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে, দেশে থাকলে হতেন আলবদরদের প্রধান, সেই তিনি মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ফিরে একটির পর একটি পুরস্কার নিয়েছিলেন, আর পঁচাত্তরের পর ইঁদুর পুনরায় ইঁদুর হয়েছেন। আগের একনায়ক বালকটির পা ধরে একটা বড়ো পদ পেয়েছিলেন, পরে বালকটি তাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলো, সে-শোকে মুহ্যমান ছিলেন কয়েক বছর, এখন দেখা দিয়েছেন আবার, উদ্দিন মোহাম্মদের পদচুম্বন করে পদকের পর পদক পাচ্ছেন, সেই দোনাগাজি সন্ধ্যাভাষায় উচ্চারণ করে চলছেন তার মন্ত্র;-তিনি কথা বলেন না, উচ্চারণ করেন, অনবরত উচ্চারণ করেন, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তার উচ্চারণ শোনে, রাশেদও শুনছে, তার মগজের ভেতর দিয়ে একটা পিচ্ছিল সাপ এঁকেবেঁকে চলছে। তিনি তাঁর গাভীতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন, যদিও আক্কাস আলি তাকে তার গরুতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি গাভীতত্ত্ব ব্যাখ্যা করছেন, যেহেতু গরুর থেকে গাভী অনেক বেশি। নন্দনতত্ত্বসম্মত; দোনাগাজি বলছেন, গাভী হচ্ছে অন্ধকারে অনবরত উচ্চারণ, গাভী হচ্ছে একটি নির্মাণ, ওই নির্মাণকে আমরা সতত আবিষ্কার করি উচ্চারণের মধ্যে, যেমন। আমরা অন্ধকারে তমালকে আবিষ্কার করি দ্বিদল ফুলকে আবিষ্কার করি, তাকে নির্মাণ করি আত্মার মধ্যে যেমন করেছেন দান্তে এবং বাল্মীকি, তেমনি গাভী হচ্ছে অন্ধকারে আত্মার অনবরত উচ্চারণ অনবরত আবিষ্কার। রাশেদের ইচ্ছে করছে ওর মুখমণ্ডলে, ঘন বিকশিত শত্রুতে, গাভীর পেছন দিক থেকে সারবস্তু আবিষ্কার করে এনে মেখে দিতে। পল্লীটি ভরে গেছে এসব প্রাণীতে, ভাল্লুক উল্লুক রজ্জব আলি আক্কাস আলি ভাড়োত্তম দোনাগাজিতে, রাশেদ তুমি কোন দিকে যাবে? রাশেদ কি মজনুর পথে নেমে যাবে, মজনুর মতো খুঁজে চলবে সত্যকে, খাঁটিকে, পথে যা-ই পাবে, তা-ই ঘষেই দেখবে। জিনিশটি খাঁটি কিনা? মাঝেমাঝে রাশেদের কি মনে হচ্ছে না সে মজনু হয়ে উঠছে, এর চেয়ে মজনু হয়ে যাওয়াই ভালো?

মজনু বিশ্বাস করতো, স্বপ্ন দেখতে দেশটা স্বপ্নের দেশ হয়ে উঠবে; স্বপ্নটা তার ব্যক্তিগত ছিলো, এবং যাদের সে বিশ্বাস করতো তাদের থেকেও পেয়েছিলো অনেকখানি; বিশ্বাস ছিলো তার গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা প্রগতি নেতায় কবিতায়, এবং আরো অনেক কিছুতে; গত বছর হঠাৎ তার সমস্ত বিশ্বাস ভেঙে যায়, সে চারদিকে মলের মতো ছড়ানো মিথ্যা দেখতে পায়। সবই তার মনে হতে থাকে মিথ্যা, তার প্রাথমিক বিদ্যালয় উদ্দিন মোহাম্মদ নেতা নেত্রী গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র স্বাধীনতা প্রগতি সবই তার কাছে মিথ্যা বলে প্রতিভাত হতে থাকে, সত্য আর খাঁটিকে পাওয়ার জন্যে সে পথে নেমে যায়। চারপাশে যা কিছু চলছে, তা মুকুটখচিত শয়তান ছাড়া কারো পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব, মজনু শয়তান হয়ে উঠতে পারে নি, সে পথে নেমে গেছে; তার কাছে ওই উদ্দীন মোহাম্মদ যেমন প্রচণ্ড মিথ্যা, তারাখচিত সেনাপতিরা যেমন মিথ্যা, তেমনি মিথ্যা ওই নেতানেত্রী, মিছিল, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মঞ্চ; সে সব কিছুর ভেতরে ঢুকে। দেখেছে বাইরের ঝলমলে মুখোশ পেরিয়ে গেলে মিথ্যাই শুধু প্রকট হয়ে দেখা দেয়। তারপর থেকেই সে সত্য খুঁজতে থাকে। তার আর গৃহ দরকার পড়ে না, দরকার পড়ে শয্যা, পরিচ্ছন্ন অটুট বস্ত্রের দরকার হয় না, গাল কামাতে হয় না, বালিকাদের দেখে সে ব্ৰিত বোধ করে না, মিছিলেও যায় না। চারপাশের মিথ্যার বাস্তবতা পেরিয়ে ঢুকেছে সে সত্যের বাস্তবতায়; সে নিজের মনে একলা হাঁটে, সত্যকে পেতে চাই, খাঁটি তুমি কোথায়–ধরনের উক্তি করতে করতে শহরের পথে পথে হাঁটে, ইচ্ছে হলে সত্যের খোঁজে বড়ো বড়ো ভবনেও ঢুকে পড়ে। প্রথম দিকে তার অবস্থা দেখে পরিচিতরা ব্যর্থ হয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করতো সামনে গিয়ে, একটি ঘটনার পর এখন আর পরিচিত। কেউ সে-সাহস পোষণ করে না। তাকে দেখলে উজ্জ্বল মিথ্যারা দূর থেকে দূরে ছুটতে থাকে। মজনু সেদিন তার সত্যের খোঁজে মিরপুর সড়ক থেকে একটি গলির ভেতর। দিয়ে ঢুকে আরেকটি গলির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে হাতির সড়ক ধরে হাঁটছিলো, তার সমাজগণতন্ত্রপরায়ণ নেতা পাজেরো চালিয়ে যাচ্ছিলেন কোথাও বা আসছিলেন উত্তরপাড়া থেকে, তিনি মজনুকে দেখে করুণা বোধ করেন, কয়েক দিন পরেই মন্ত্রী হওয়ার একটা তীব্র সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তাঁর, পাজেরো থামিয়ে দলবল নিয়ে তিনি। নেমে আসেন। তিনি মজনুকে নিয়ে যেতে চান, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেবেন; কিন্তু মজনু হঠাৎ তাকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে তার মুখমণ্ডল ভরে ঘষতে থাকে। ঘষার ফলে নেতার মুখমণ্ডলের মসৃণ চামড়া উঠে যায়, সঙ্গীরা নেতাকে উদ্ধার করার আপ্রাণ চেষ্টা করে; কিন্তু মজনু তাকে ছাড়ে না, সে বুড়ো আঙুল দিয়ে নেতার মুখমণ্ডল ঘষতে থাকে, নেতার বাইরের চামড়া পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে সে সত্যটাকে দেখতে চায়। নেতা মাসখানেক ধরে একটা সুন্দর মুখ প্রস্তুত। করছিলেন, উপপত্নীদের কাছ থেকে বারবার জেনে নিচ্ছিলেন মুখটি কেমন দেখাচ্ছে, ঢাকার রঙিন বাক্সে কেমন দেখাবে, মজনুর ঘষায় তাঁর মুখমণ্ডলের সত্য বেরিয়ে পড়ায়। তার শপথগ্রহণের দিন পিছিয়ে যায়, তিনি সকালে এক উপপত্নীর বক্ষে বিকেলে আরেক উপপত্নীর বুকে শুয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করতে থাকেন। মজনু বাইরের কোনো কিছুর সত্যেই বিশ্বাসী নয়, ভেতরের সত্যই তার কাছে সত্য, আর তার বুড়ো আঙুলও ভয়ানক প্রখর, তাই পরিচিতরা তাকে এড়িয়ে চলে আজকাল, তারা সত্যের পরীক্ষা দিতে চায় না। মজনুর পায়ের নিচে যে-ইটের টুকরোটি পড়ে, যদি তার ইচ্ছে হয় সেটির সত্য উদঘাটনের, মজনু সেটি হাতে তুলে নেয়, ডান আঙুলে ঘষতে থাকে, টুকরোটি এক সময় শূন্যে মিলিয়ে যায়; মজনু বলে, মিথ্যা। সংবাদপত্র পেলেই সে ঘষতে থাকে, ইটের টুকরোর থেকে অনেক বেশি মিথ্যা সংবাদপত্রগুলো, স্তম্ভে স্তম্ভে চিৎকার করছে মিথ্যা, তাই অল্প সময়ের মধ্যেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়; মজনু বলে, মিথ্যা।

মজনু এক সুন্দর বিকেলবেলা হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগের মোড়ে পৌঁছে, এবং দক্ষিণ দিকে মুখ ফিরিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ায়; দু-হাত উডডীন, ও চিৎকার করে সে। সবাইকে গাড়ি থামাতে বলে, মুহূর্তে সেখানে টয়োটা ডাটসান সুজিকি পাজেরো ওয়াগন স্টারলেট হারলট বারলটের ভিড় পুঞ্জিত হয়ে ওঠে, নতুন কোনো সামরিক বিধি ঘোষিত হয়েছে ভেবে ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীরা চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। সরণীটি ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীদের নিজস্ব, গরুত্বহীন প্রাণীরা এ-সরণীতে চলতে পারে না, এ-সরণীতে চলতে পারা গৌরবের ব্যাপার, নিউইঅর্ক থেকে ফিরে গ্রাম্য বাঙালিরা। যেমন কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন রাস্তার গল্প করে, এ-সরণীতে চলতে পেরেও অধিকাংশ শূদ্র বাঙালি তার গল্প করে, স্ত্রী, সন্তান, সহকর্মী, শ্বশুরের কাছে, এমনকি গৃহপরিচারিকার কাছেও। যে-ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীরা নিয়মিত চলেন এ-সরণীতে, তাঁরা দ্রুতগতিশীল, গন্তব্যে তাদের পৌঁছোতে হয় স্বল্পতম সময়ে, লইলে বিপর্যয় ঘটতে। পারে; এমন ঘটনার সাথে তাদের এর আগে পরিচয় ঘটে নি, তারা কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নি তাদের নিজস্ব সরণীতে কেউ দু-হাত তুলে তাঁদের গাড়ি থামাতে পারে। মজনু একটি ঝকঝকে গাড়ির সামনে গিয়ে সালাম দেয়, সালাম পেলে ভারিগুরুত্বপূর্ণরা খুব বোধ করেন, গাড়ি থেকে একজন ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন, মজনু আবার। তাকে সালাম দেয়, তাতে গুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি আরো গুরুত্ব বোধ করেন। মজনু হঠাৎ তার মুখমণ্ডল চেপে ধরে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে একবার ঘষা দেয়, ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি খুব বিস্মিত হন, মুখমণ্ডল তার আগুনের মতো জ্বলে উঠলেও তিনি গুরুত্বসহকারে মজনুকে জিজ্ঞেস করেন, এ আপনি কী করছেন? মজনু বলে, মিথ্যা, পচা পাটের গন্ধই সত্য। ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি আরো বিস্মিত হয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়েন; মজনু আরেকটি গাড়ির সামনে গিয়ে সালাম দেয়, আরেকটি ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন। মজনু তার মুখমণ্ডলেও ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষা দেয়, ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণীটি বিস্মিত হয়ে বলেন, এ কী অসভ্যতা। মজনু বলে, মিথ্যা, আউশধানই সত্য। মজনু আরেকটি গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়, আরেকজন ভারিগুরুত্বপূর্ণপ্রাণী বেরিয়ে আসেন; মজনু তাকে জলমলে টাই ধরে ঘষা দেয়, তার এক ঘষায় টাইয়ের মাঝখানে আগুন ধরে যায়। মজনু বলে, মিথ্যা, গামছাই সত্য। মাঝেমাঝেই মজনু এভাবে সভ্য সুন্দর মানুষদের বিব্রত করে তোলে, মজনু চারদিকে কোথাও কোনো সত্য খুঁজে পায় না। মজনু অনেক সময় বিশাল বিশাল বস্তুদেরও মুঠোতে ফেলে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘষে, কী ঘষছে কেউ দেখতে পায় না, শুধু মজনুই দেখতে পায়, এবং দেখে যে ওই সবই মিথ্যা। সংসদ, বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, সেনানিবাস সব কিছুকেই ঘষে ঘষে শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে মজনু বলে, মিথ্যা। রাশেদ কি নেমে যাবে মজনুর পথে, দেখতে চেষ্টা করবে সব কিছুর অন্তর্নিহিত সত্য?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *