০৭. রক্তমাংসের রহস্য

৭ রক্তমাংসের রহস্য

বিলু আপা তোমাকে মনে পড়ছে মেঘ উড়ছে দেখতে ইচ্ছে করছে কতোদিন তোমাকে দেখি না সরোবর দেখি না পদ্ম দেখি না তোমাকে দেখলে মাথা জুড়োতো এইসব দুঃস্বপ্ন ফুরোতো সামরিক আইন গণতন্ত্র দানব দেবী থাকতো না লাশ ফাস বদমাশ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ রাজাকার গাঁজাকার সাজাকার দালাল আমলা কামলা আলবদর। তালবাদর মন্ত্রী সান্ত্রী মাস্তান জেনারেল গেনারেল ভেনারেল থাকতো না বিলু আপা তুমি দক্ষিণ ঘরের পাশের পেয়ারাপাতার সুগন্ধ তুমি জোনাকিরা লেবুঝোঁপের ঘ্রাণ তোমার মুখ মনে হলে আমি পেয়ারাপাতার গন্ধ পাই গোড়ালেবুর গন্ধ পাই তোমার মুখ মনে হলে দেখি ডালিম ফুল ফুটছে উঠোন লাল হয়ে যাচ্ছে দইকুলি বসছে ঘুমিয়ে পড়ছে। আতার গন্ধ উঠছে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দুপুরবেলা লাল মোরগের শিখা জ্বলছে কুয়াশা। নামছে রোদ উঠছে বৃষ্টি হচ্ছে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হচ্ছে পশ্চিম পুকুরে কচুরিপানার ওপরে ডাহুক হাঁটছে। রাশেদ একটি বই পড়তে শুরু করেছিলো, অত্যন্ত জঘন্য বই, ওই বই পড়ার সময় এমন আবেগ ধাক্কা দেবে রাশেদ ভাবতে পারে নি; আবশ্য এমন বিষম। ব্যাপার তার ঘটে কখনো, দশ বছরে একআধবার, একবার একটা বিদঘুঁটে লোকের। জানাজায় দাঁড়িয়ে রাশেদের বারবার মনে পড়ছিলো একটি প্রেমের কবিতার পংক্তি, তার ভয় হচ্ছিলো সে হয়তো জোরে পংক্তিটি উচ্চারণ করে ফেলবে। রাশেদ দেখতে পাচ্ছে। বিলু আপা কাজ করছে, সে তো সারাদিনই কাজ করতো, তার কাজের শেষ ছিলো না, একটার পর একটা কাজ সৃষ্টি হয়ে উঠতো তার হাতে; বিলু আপার হাতে একটা কাজ শেষ হয়ে আসছে দেখে যখনই রাশেদ ভাবতো বিলু আপার হাতে আর কাজ নেই, তখনই অবাক হয়ে রাশেদ দেখতে আরেকটি কাজ সৃষ্টি হয়েছে তার হাতে। বিলু আপা পুকুর থেকে মাটির কলসি কাঁখে করে পানি আনতো, কী সুন্দর বেঁকে গিয়ে হাঁটতো, একটার পর একটা কলসি সাজিয়ে রাখতে কাঠের চকে, ফিটকিরি দিতো, ওই পানি খেতে জিভ জড়িয়ে যেতো রাশেদের। বিলু আপা এতো ঝকঝক করে বাসন মাজতে পারতো;-পশ্চিম পুকুরঘাটে বিলু আপা ছাই দিয়ে বাসন মাজতো, নারকেলের আঁশে ছাইমেখে ঘষতে থাকতো, তার হাতের আঙুল নাচের মুদ্রার মতো নাচতো, তার। আঙুলের ঘষায় সোনা হয়ে উঠতে পেতলের থালা গেলাশ বাটি, যা দাঁত দিয়ে কামড়াতে ইচ্ছে হতো রাশেদের। অন্য সবাই ভাত খেতে টিনের থালায়, বাবা আর রাশেদের জন্যে ছিলো পেতলের থালা গেলাশ; বিলু আপা পেতলের থালা আর গেলাশ মাজতে সম্ভবত পছন্দ করতো, অনেকক্ষণ ধরে মাজতো, তারপর ধোয়ার জন্যে। তলোয়ারের মতো থালা ঢুকিয়ে দিতে পানিতে, পানিতে একটা মধুর শব্দ উঠতো, পানির নিচে চাঁদের মতো জ্বলতো তার থালাটি, পাশের হেলেঞ্চার ছোট্ট চালিটি ঢেউ লেগে লেগে কাঁপতে থাকতো। বিলু আপার মাজা পেতলের থালার দিকে তাকিয়ে থাকতে কেমন একটা সুখ লাগতো রাশেদের, রক্তের ভেতরে সে একটা ঝলমলে। সোনালি আলোর নাচ অনুভব করতো।

রাশেদের পড়ার ঘর ঝেড়ে দিতে সাজিয়ে দিতে খুব সুখ লাগতো বিলু আপার। তার টেবিলের সামনের ঢেউটিনের বেড়ায় লাল নীল কাগজ লাগিয়ে দিয়েছিলো বিলু আপা, রাশেদ তাকালেই দেখতে লাল নীল ঢেউ, তার ওপর কাগজ কেটে বড়ো বড়ো ইংরেজি অক্ষরে লাগিয়ে দিয়েছিলো রাশেদের নাম, ইংরেজি অক্ষরে নিজের নাম দেখলে নিজেকে অন্য রকম মনে হতো, অনেক দূরে চলে গেছি মনে হতো, পাশে ইংলন্ডের রানির। একটা ছবি লাগিয়েছিলো রাশেদ, তার সাথে একটা লিকলিকে লোকের ছবিও ছিলো। রাশেদ নিজেই তো গুছিয়ে রাখতে তার পড়ার টেবিল, বিলু আপা তারপরও গোছাতো, মাঝেমাঝে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে রাশেদের বাঙলা বই খুলে অনেকক্ষণ ধরে পড়তো, নিশ্বাস ছেড়ে বলতো, তুই কী সুন্দর সুন্দর পড়া পড়িস। বিলু আপা প্রাইমারি ইস্কুলে যেতো, অনেক বছর ধরে যায় না, শাড়ি পরার পর থেকেই যায় না। বিলু আপার সইরাও যায় না; তারা সবাই শাড়ি পরে, কাজ করে, কুশিকাটা দিয়ে শেলাই করে, বালিশে আর রুমালে ফুল তোলে, আর সময় পেলে বাড়ির আমগাছের পাশে দাঁড়িয়ে, হেলান দিয়ে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা খুব দূরের দিকে তাকায়, যেনো খুব দূরে, দিগন্তের ওই পারে, আকাশের পশ্চিম উত্তর পুব দক্ষিণ পাশে, তাদের কেউ রয়েছে। খুব মজা করতে পারতো বিলু আপা। রাশেদ বায়না ধরেছিলো ঝাঁকিজালের; বাবা জালের কথা একদম সহ্য করতে পারেন না, রাশেদকে মাছ ধরতে হবে না, তাকে শুধু পড়তে হবে, কিন্তু জাল দিয়ে মাছ ধরতে ইচ্ছে করে রাশেদের। মাছ ধরার থেকে। মজার হচ্ছে জাল খ্যাও দেয়া, ডান হাতের কনুইয়ে জালের একগুচ্ছ আটকে রেখে ডান আর বাঁ হাত দিয়ে ফ্রকের মতো ধরে দুলে দুলে দূরে জাল ছড়িয়ে দেয়া। বিলু আপা চুপে চুপে একটি জাল বুনছিলো রাশেদের জন্যে। ভাদ্র মাসে বুনতে শুরু করেছিলো, সন্ধ্যায় ছোটোঘরে বসে বসে পাশের বাড়ির বউদের সাথে সইদের সাথে গল্প করতে করতে জাল বুনছিলো বিলু আপা। এক হাত বাড়লেই একটি করে আলতার দাগ দিচ্ছিলো, জালটিকে লালপেড়ে শাদা শাড়িপরা বউয়ের মতো দেখাচ্ছিলো। রাশেদ সন্ধ্যায় চিৎকার করে করে পড়তো, খুব ভালো লাগতো চিৎকার করে পড়তে, মাঝেমাঝে সে ছোটোঘরে গিয়ে দেখে আসতো কতোটুকু হলো জালটি। রাশেদের। পড়ার টেবিলে ছিলো পেতলের একটি উঁচু হারিকেন, তাতে ছিলো ধবধবে বাদুড়মার্কা চিমনি; চোখে তাপ লাগতো বলে রাশেদ চিমনিতে এক টুকরো কাগজ লাগিয়ে রাখতো। অন্ধকারে হারিকেনের আলো ধবধব করতো, চোখ এক সময় বই ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতো না। সে-সন্ধ্যায় যে রাশেদের জাল বোনা হয়ে গেছে, রাশেদ জানতো না, সে মন দিয়ে চিৎকার করে দুলে দুলে পড়ছিলো। এমন সময় সে পেছনে একটু শব্দ শুনতে পায়, এবং চোখ ফিরিয়ে একটা আকাশছোঁয়া ভূতবউ দেখে চিৎকার করে ওঠে। চেয়ার থেকে লাফিয়ে সে ভূতবউটিকে জড়িয়ে ধরে। তার চিৎকার শুনে। সবাই ছুটে এসে দেখতে পায় রাশেদ বিলু আপাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করছে। এমন ঘটবে বিলু আপা ভাবতেই পারে নি। সে-সন্ধ্যায় জাল বোনা হয়ে গেলে বিলু আপার। মন আনন্দে ভরে যায়, রাশেদকে চমকে দেয়ার জন্যে সে মাথার ওপর জাল পরে খিলখিল করে হাসতে হাসতে এসে রাশেদের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে রাশেদকে ডাকে। রাশেদ চোখ ফিরিয়ে দেখতে পায় ভূতবউ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে, তার মাথা ঘরের চাল পেরিয়ে গাছের মাথা পেরিয়ে আকাশে উঠে গেছে। চিৎকার করে সে জড়িয়ে ধরে বিলু আপাকে। বিলু আপা খুব বিব্রত হয়ে পড়েছিলো এতে, রাশেদও খুব লজ্জা পেয়েছিলো, আর রাশেদকে খেতে হয়েছিলো একবাটি নুনগোলানো পানি, এটাই ছিলো সবচেয়ে বিচ্ছিরি।

বিলু আপা, আর তার সইরা, পুষু আপা আর পারুল আপা, এতো মিষ্টি ছিলো! তাদের শাড়ি থেকে উঠতো এতো মিষ্টি গন্ধ, চুল থেকে উঠতো এতো মিষ্টি গন্ধ, তারা যেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করতো সেখানকার বাতাস গন্ধরাজ ফুলের গন্ধে ভরে যেতো। হাঁটলেই শরীর দুলতো তাদের, মনে হতো তাদের হাড় নেই, তাদের ভেতরে আছে। দুধের জমাট সর, অনেক মাখন আছে তাদের চামড়ার ভেতরে। তারা যখন বসে বসে গল্প করতো, তাদের ব্লাউজের নিচের প্রান্তের পরে মাংসের ঢেউ দেখা যেতো, ছুঁয়ে। দেখতে ইচ্ছে হতো রাশেদের; পুষু আপা রাশেদকে তার মাংসের ঢেউ ধরে দেখতে দিতো, রাশেদ দু-আঙুলে ওই ভাজ ধরে জোরে টান দিতো আর পুষু আপা চিৎকার করে উঠতো, তারপর খিলখিল করে হাসতো। মেয়েরা অদ্ভুত চিৎকার দিতে পারে, রাশেদ সেই তখনই বুঝেছিলো, কষ্টের সাথে সুখ মিশিয়ে তারা চিৎকার দিতে পারে। বিলু আপা, পুষু আপা, পারুল আপা কখনো বাড়ির বাইরে যেতো না; অনেক বছর আগে তারা বোর্ডইস্কুলে যেতো, ইস্কুলের জঙ্গলে ভরা মাঠে ছিয়া লো ছিয়া তোর মার বিয়া ধান নাই পান নাই চোতরাপাতা দিয়া বলে ঝড়ের মতো দৌড় দিয়ে খেলতো, রাশেদ তাদের দৌড়িয়ে ছুঁতে পারতো না, এখন মনে হয় তারা কেউ কখনো দৌড়োয় নি, তারা দৌড়োতে জানে না। তারা বাইরে যেতো না, বাইরে গেলে সাড়া পড়ে যেতো, কিন্তু সব সংবাদ তারা আগেই কী করে যেনো পেয়ে যেতো; তারা এমন অনেক সংবাদ পেতে, যা রাশেদ কখনোই পেতো না। বাতাস না পাখি যেনো তাদের জন্যে সংবাদ নিয়ে আসতো। একদিন রাশেদ তাদের ফিসফিস করে কী যেনো বলতে শোনে, রাশেদ শুধু রাবুর ‘মা’ কথাটি বুঝতে পারে, আর কিছু বুঝতে পারে না। রাশেদকে দেখে তারা চুপ হয়ে যায়। রাশেদ রাবুকে দেখেছে, রাবুর মাকে কখনো দেখে নি, ওদের বাড়িও কখনো যায় নি, বিলু আপা পুষু আপা পারুল আপাও কখনো যায় নি। ওদের বাড়িটা গ্রামের পশ্চিম পাশে-এতো পশ্চিম পাশে যে মনে হয় অন্য গ্রাম, চারপাশে ঘন জঙ্গল, অনেক সাপ আছে বলে শুনেছে রাশেদ। সেই রাবুর মাকে নিয়েও গল্প আছে বিলু আপাদের? আপাদের এক অভ্যাস, তারা নিজেদের মধ্যে খিলখিল করে হাসে, ফিসফিস করে কথা বলে, কিন্তু রাশেদ কাছে গেলেই তারা শুধু কাজের কথা বলে, রাশেদের পড়ার কথা জানতে চায়, ফিসফিস করে না খিলখিল করে না। তারা সব জানে শুধু জানে না রাশেদের ভালো লাগে তাদের খিলখিল তাদের ফিসফিস।

দু-দিন পর বিকেলবেলা আজিজ মাঝপুকুর থেকেই রাশেদকে ডাকতে থাকে, তার কোশানৌকাটি ভিড়োয় রাশেদদের উত্তরের ঘাটে, একটা খবর আছে বলে রাশেদকে তুলে নেয়। বছর দুয়েক বড়ো আজিজ তার থেকে, একই ক্লাশে পড়ে তারা, দু-এক বিষয়ে ফেল করে ওপরের ক্লাশে ওঠে আজিজ, কিন্তু তার জ্ঞানের শেষ নেই; বইয়ের বাইরে যতো জ্ঞান আছে সবই আছে তার, নতুন নতুন জ্ঞান সে নিয়মিত দেয়। রাশেদকে। ওই জ্ঞানে রাশেদ চঞ্চল বিহ্বল কাতর হয়ে ওঠে। এইটে ওঠার পর থেকেই রাশেদের চোখে সবচেয়ে বিস্ময়কর লাগছে মেয়েদের, মিশরের পিরামিড ব্যাবিলনের। শূন্যোদ্যান ওই বিস্ময়ের কাছে হাস্যকর, কিন্তু তা সে কাউকে বলতে পারছে না, আজিজ ওই বিস্ময়কে, কোনো কোনো বিকেল আর দুপুরবেলা, করে তুলছে আরো রহস্যময়, আরো চাঞ্চল্যকর, এমনকি ভয়াবহ। মেয়েদের বুক প্রথম কুলের মতো ওঠে, তারপর সফেদার মতো হয়, তারপর হয় কৎবেলের মতো, এ-জ্ঞান আজিজ তাকে দিয়েছিলো কিছু দিন আগে, রাশেদ কয়েক রাত সহজে ঘুমোতে পারে নি, সে চারদিকে দেখতে পাচ্ছিলো কুল সফেদা কৎবেলের বাগান, পৃথিবীটা ফলের বাগান হয়ে উঠেছিলো তার। চোখে। আজো নিশ্চয়ই আজিজ কোনো রহস্য খুলে দেবে তার সামনে, তার জন্যে মনে মনে সে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। চারপাশে ভাদ্রের ভরা জল, আজিজ নৌকো বেয়ে ঢুকছে। আমন ধানখেতের ভেতরে, সবুজ ঘাসফড়িং লাফিয়ে যাচ্ছে ধানের পাতা থেকে পাতায়, বিকেলের রোদ গলে পড়ছে। আজিজ রাবুর মার কথা বলে; শুনে রাশেদ চমকে ওঠে, দু-দিন আগে বিলু আপারা তো রাবুর মাকে নিয়েই কথা বলছিলো। তারাও কি সংবাদ পেয়ে গেছে, যা পেতে আজিজেরও দেরি হয়েছে দু-দিন? আজিজ বলে রাবুর মার পেট হয়েছে। এতে রাশেদ একটুও চমকে ওঠে না, পেট হওয়া কাকে বলে সে জানে; কথাটি শুনলে তার ঘেন্না লাগে, রাবুর মার কথা শুনেও তার ঘেন্না লাগলো, আজিজ আশা করেছিলো রাশেদ চমকে উঠবে। রাশেদ চমকে না ওঠায় আজিজ বিস্মিত হয়। রাশেদ বলে যে বিয়ে হলে পেট সব মেয়েরই হয়, রাবুর মার পেট হওয়া এমন কী সংবাদ, তাদের গ্রামের মেয়েদের তো বছর ভরেই পেট হচ্ছে। আজিজ হাঁ হাঁ করে ওঠে, রাশেদ যে আস্ত বোকা তাতে তার সন্দেহ থাকে না; আজিজ বলে, বিয়ে হলে পেট হয় ঠিকই, তবে স্বামী বাড়িতে থাকলে হয়, স্বামী বাড়ি না থাকলে হয় না। এটা এক বিস্ময়জাগানো নতুন জ্ঞান রাশেদের কাছে; সে মনে করতো বিয়ে হলেই মেয়েদের বছর বছর পেট হয়, কুমড়োর মতো পেট ফুলে ওঠে, কুৎসিত দেখাতে থাকে, তাদের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না। রাশেদের ভেতরে এক অস্থির ব্যাকুলতা দেখা দেয়, সে জানতে চায় স্বামী বাড়িতে থাকতে হবে কেনো? আজিজ অনেকক্ষণ ধরে, আস্তে আস্তে, ব্যাখ্যা করে; বলে, বিয়ে হলেই হয় না, স্বামীকে স্ত্রীর ভেতরে একটা কাজ করতে হয়, কাজের সময় স্ত্রীর পেটে স্বামীর ভেতর থেকে মণি ঢোকে, তবেই পেট হয়। কীভাবে ঘটনাটি ঘটে, তাও বর্ণনা করে আজিজ, তার হাতঠোঁটমুখ কাঁপতে থাকে, মোচড় দিয়ে উঠতে চায় রাশেদের শরীরটিও; সে বলে যে রাবুর বাবা দেশে থাকে না, দশ বছর ধরে দিনাজপুর থাকে, তাই অন্য কারো সাথে কাজের ফলে রাবুর মার পেট হয়েছে। ঠিকই রাবুর বাবা দেশে থাকে না, তবে রাশেদের মনে প্রশ্ন জাগে, রাবুর বাবা যদি দশ বছর আগে রাবুর মার পেটে মণি ঢুকিয়ে গিয়ে থাকে? কথাটি বলতেই আজিজ হাঁ হাঁ করে ওঠে আবার, বলে, দশ বছর আগে ঢোকালে হয় না, প্রত্যেকবার নতুন করে ঢোকাতে হয়। আজিজ বলে যে রাবুর বাবা দেশে আসে না, তার দিনাজপুরে আরেক বউ আছে; রাবুর মার সাথে বারেক স্যারের প্রেম, বারেক স্যার রাতে ওই বাড়িতেই থাকে, তাই পেট হয়েছে রাবুর মার। প্রেম শব্দ আরো দু-একবার শুনেছে রাশেদ, খুব ভণ্ডকথা এটা, শুনে রাশেদের শরীর কেঁপে ওঠে; ভাব হলেও চলতো, ভাব মনের ব্যাপার, কিন্তু প্রেম, এটা অত্যন্ত ভণ্ডকথা। ভাদ্রের বিকেলে রাশেদ একটা জ্ঞান লাভ করে, আদম যেমন লাভ করেছিলো; বই পড়ে যখন সে কোনো জ্ঞান লাভ করে তখন সে এমন থরথর করে। কাঁপে না, ভেতরটা এমন গনগন করে না, কিন্তু আজিজের জ্ঞান তাকে ভূমিকম্পের মতো কাঁপায়, যা চলতে থাকে কয়েক দিন ধরে। বাচ্চা কী করে হয় সে মাঝেমাঝেই। ভাবে, বুঝে উঠতে পারে না, কারো কাছে জিজ্ঞেসও করতে পারে না। আজিজই একবার। তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো স্বামীরা বউদের পেটে মণি ঢুকিয়ে দেয়, তাতে পেট হয়, বাচ্চা হয়। জিনিশটা কেমন রাশেদ জানে না, তবে খুব ঘেন্না লেগেছিলো তার, খুব নোংরা জিনিশ হবে বলে তার সন্দেহ হয়েছিলো। তার ধারণা হয়েছিলো বিয়ের পর স্বামীরা। বউদের পেট কানায় কানায় ওই নোংরায় ভরে দেয়, আর ওই নোংরা থেকে বছর বছর। বাচ্চা হয়।

রাশেদ জানে একজনের বউয়ের পেটে আরেকজনের, বা বিয়ে না করে, মণি। ঢোকানো বড় অপরাধ, জেনা,-আজিজই তাকে জেনা কথাটি শিখিয়েছিলো, ওই অপরাধের জন্যে পুরুষ আর মেয়েলোকটিকে পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে হয়। খুব ভয়। পেয়েছিলো রাশেদ, অনবরত পাথর ছোঁড়া দেখতে পেয়েছিলো চোখের সামনে। এটা। বড়ো কলঙ্ক; এমন কলঙ্ক হলে মুখ দেখানো যায় না, পুরুষেরা পালিয়ে আসাম ত্রিপুরা চলে যায়, মেয়েরা গলায় ফাঁসি দেয়, কলসি বেঁধে পানিতে ডুবে মরে, যেমন ফাঁসি দিয়ে মরেছিলো কেরানিবাবুর মেয়ে। রাশেদ কখনো তাকে সামনে থেকে দেখে নি, দূর থেকে দেখেছে, শুধু শুনেছে তার ফাঁসির কথা। তার অনেক বয়স হয়েছিলো, বিয়ে হয়। নি বলেই সে ফাঁসি দিয়ে মরেছে, এমন কথা শুনেছিলো রাশেদ; তবে রাশেদ বড়োদের ফিসফিস করে কথা বলাও শুনেছে। রাবুর মাও কি ফাঁসি দিয়ে মরবে? তবে কলঙ্ক থেকে, রাবুর মার ম’রে-যাওয়া থেকে, রাশেদকে বেশি পীড়িত করছে ওই ব্যাপারটি। আজিজ যেভাবে বর্ণনা করেছে তাতে তার জগত ঘিনঘিনে হয়ে উঠেছে, ভাদ্রের ধানখেত ভরা জল সোনালি রোদ নোংরায় ভরে যাচ্ছে। বিলু আপার বিয়ে হলেও কি অমন কাজ করবে সেই লোকটি, যাকে সে দুলাভাই বলবে, বিলু আপাও কি তার নিচে অমনভাবে শোবে, আর লোকটি, আজিজ যেমন বলেছে, সেভাবে কাজ করবে? না, না, বিলু আপা অমন কাজ করতে দেবে না, বিলু আপা কখনো অমন ময়লায় পেট ভরে তুলবে না। কিন্তু বিলু আপাও যদি অমন করে, বাধ্য হয় অমন করতে? কিছু দিন আগে রাশেদ এক খালাতো বোনের বিয়েতে গিয়েছিলো, একটা অসভ্য লোকের সাথে বিয়ে হয়েছে তার, লোকটাকে সে কিছুতেই দুলাভাই বলবে না, ডালিম গাছের নিচে লোকটা হ্যাঁজাক লাইট পাম্প করতে করতে রাশেদকে ফিসফিস করে বলেছিলো, বুঝলি তর আফারে এইভাবে। ঘেন্নায় লোকটার কাছ থেকে সরে গিয়েছিলো রাশেদ। আজিজ বলছে, বারেক স্যারের খুব বিপদ হতো, রাবুর মারও খুব বিপদ হতো, কিন্তু তারা খালাশ করে ফেলেছে ঢাকা গিয়ে, নইলে গ্রামের মানুষ তাদের ছাড়তো না। গ্রামের মানুষ একটা কিছু করবেই, তবে তাদের অসুবিধা হচ্ছে রাবুদের বাড়ির সাথে গ্রামের লোকদের কোনো সম্পর্কই নেই, আর বারেক স্যারও গ্রামের মানুষদের মূর্খ গাধা মনে করেন, তাদের সাথে কোনো কথাই বলেন না। কয়েক বছর আগে বারেক স্যার নাইনে বাঙলা পড়াতে গিয়ে বলেছিলেন ধর্মটর্ম সব বাজেকথা, ওইগুলো মানুষই বানিয়ে আল্লা ভগবান ঈশ্বরের নামে চালিয়ে দিয়েছে; তাতে পণ্ডিতবাবু কোনো রাগ করেন নি, বলেছিলেন কে জানে কোনটা সত্য, কিন্তু ছোটো মৌলভি সাব, যিনি চিৎকার না করে কথা বলতে। পারতেন না, কথা বলার সময় যার মুখ থেকে থুতু ছিটকে পড়তো, ক্ষেপে তাকে মোটা বাঁশের লাঠি দিয়ে মারতে গিয়েছিলেন, পারেন নি ছাত্ররা বাধা দিয়েছিলো বলে। এবার স্যারকে তারা একটা শিক্ষা দেবে, কীভাবে দেবে সেটা মাতবররা বুঝে উঠছে না। তারা ডাকলে বারেক স্যার আসবেন না, তাদের মূর্খ বলে গালি দেবেন, এটা তারা জানে; কিন্তু তাকে শাস্তি দিতেই হবে।

রাশেদ জানতে চায় রাবুর মার যে পেট হয়েছে, কেউ দেখেছে; আজিজ জানায় কেউ দেখে নি। তাহলে কি স্যারের শত্রুরা এটা বানিয়েছে তাঁকে বিপদে ফেলার জন্যে? রাশেদ আর আজিজ ঠিক করে উঠতে পারে না ঘটনাটি সত্য কী সত্য নয়। সত্য কী করে হবে, ওই বাড়িতে তো গ্রামের কেউ যায়ই না, তারাও যায় না কারো বাড়িতে, তাই কে দেখেছে রাবুর মায়ের পেট হয়েছে? আজিজ বলছে, স্যার ওই বাড়িতে যান, রাতেও থাকেন, তাই ঘটনা সত্য হতেও পারে। কিন্তু তিনি যে রাতে থাকেন, তা কেউ দেখেছে? তা দেখে নি, তবে তিনি বিকেলে ওই বাড়িতে যান, তাকে কেউ আর বেরিয়ে আসতে দেখে না, তাই মনে হয় তিনি রাতে থাকেন ওই বাড়িতে। পুরুষমানুষ আর। মেয়েমানুষ একলা থাকলে ওই কাজ না করে পারে না। আজিজ একটা বইয়ে পড়েছে পুরুষমানুষ আর মেয়েমানুষ একলা থাকলে শয়তান হাজির হয় মাঝখানে, শয়তান কানে কানে ওই কাজ করতে বলতে থাকে, শয়তান বলে ওই কাজ আঙুরের মতো মিষ্টি বেদানার মতো মিষ্টি শরাবের মতো মধুর, তখন আর তারা না করে থাকতে পারে না। রাশেদের তীব্র ইচ্ছে হয় ওই বইটি পড়ার। আঙুর বেদানা শরাব কোনোটিই তখনো রাশেদ দেখে নি, এগুলোর কথা শুনেছে, এগুলোর কথা শুনলেই কেমন যেনো লাগতে থাকে, আর আজ আঙর বেদানা শরাব তার রক্তকে খেজুররসের মতো জ্বাল দিতে। থাকে, রক্ত থেকে উঠতে থাকে তীব্র সুগন্ধ, এবং একটি বিষের স্রোতও তার রক্তের ভেতরে বইতে থাকে। রাশেদ বুঝতে পারছে সত্য বা মিথ্যে যা-ই হোক এবার লোকেরা একটা শাস্তি দেবে বারেক স্যারকে; তবে ওই শাস্তির থেকে তার ভেতরে অন্য এক আগুনের দাউদাউই সে বেশি টের পেতে থাকে। নতুন জ্ঞান তার রক্তে আগুন। জ্বেলে দিয়েছে। মাতবররা বিচার ডাকতে পছন্দ করে, বিচার করে সাধারণত জুতো মারে, সাধারণত ভুল লোককেই জুতো মারে; বিচারে ডেকে তারা যদি বারেক স্যারকে জুতো মারতে পারতো, খুব সুখ পেতো তারা; কিন্তু তারা জানে স্যার তাদের বিচারে আসবেনই না। তিনি তাদের মূর্খ মনে করেন গাধা মনে করেন; মাতবরদের জন্যে এটা খুব অপমানের, তারা সত্যিই মূর্খ আর গাধা বলেই হয়তো। কয়েক দিন পরই তারা। স্যারকে শাস্তিটা দেয়। স্যার নৌকো বেয়ে বিকেলবেলা রাবুদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলেন, তাঁর নৌকোটি যখন দক্ষিণের ধানখেতের কাছাকাছি আসে তখন দু-দিক থেকে দু-মাতবরের দু-চাকর লগি মেরে এসে তার নৌকোয় ঢু দেয়; বারেক স্যার তাদের ধমক দিলে তারা তাকে আক্রমণ করে, লগি দিয়ে বাড়ি মারতে থাকে, বারেক স্যার পানিতে পড়ে যান, তাঁর মাথা ফেটে রক্ত বেরোতে থাকে। চাকর দিয়ে বারেক স্যারকে পিটিয়েও হতাশ হয়ে পড়ে মাতবররা; তারা ভেবেছিলো মার খেয়ে বারেক মাস্টার নিশ্চয়ই চাকরদের বিচার চাইতে আসবে তাদের কাছে, তখন তারা আস্তে আস্তে তুলবে রাবুর মায়ের পেট হওয়ার কথাটি; কিন্তু বারেক স্যার কোনো অভিযোগ করেন। নি। রাশেদ আর আজিজ একবার গিয়েছিলো স্যারের কাছে, তিনি বলেছিলেন মূর্খ আর। গাধাদের নিয়ে তিনি ভাবেন না।

আজিজের দেয়া জ্ঞান রক্তে পরিণত হয়ে গেছে রাশেদের, সব সময়ই তা সে টের পাচ্ছে, রক্তকেও সে এতোটা টের পায় না, নিশ্বাসকেও পায় না। রাশেদ ইস্কুলে যাচ্ছে, বই পড়ছে, বিলু আপার মুখের দিকে আর ভালো করে তাকাতে পারছে না, পুষু আপার ব্লাউজের প্রান্তরে নিচের মাংসের ভাজ চোখে পড়তেই অন্ধের মতো চোখ বুজে। ফেলেছে। মাংসে সে কাঁপন বোধ করে চলছে যা আগে কখনো বোধ করে নি; একটা ঘোর, ঘুমের মতো, ঘুমের মধ্যে স্বপ্নের মতো, স্বপ্নের মধ্যে জেগে থাকার মতো, তাকে ঘিরে ফেলছে। একা থাকতে ভালো লাগছে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চোখের সামনে কী যেনো দেখতে পাচ্ছে সারাক্ষণ। কয়েক দিন পর বিকেলবেলা ইচ্ছে হলো নৌকো বেয়ে একটু বেরিয়ে আসতে; বড়ো নৌকোটি নিয়ে নান, তাদের চাকর, চলে গেছে দোয়াইর পাততে, বিকেলে এ-সময় নানু দোয়াইর পাততে যায়, ঘাসফড়িং গেঁথে চিংড়ি ধরার জন্যে ধানখেতের আলের মাঝখানে দোয়াইর পেতে আসে। কোনো কোনো দিন নিয়ে যায় রাশেদকেও, আজ নিয়ে গেলে তার রক্ত ঠাণ্ডা হতো। তার নিজেরও একটি ছোট্ট কোশানৌকো রয়েছে, রাশেদ সেটি ক’রে ইস্কুলে যায়, কিন্তু বেড়ানোর জন্যে কোশাটি খুব ভালো নয়। রাশেদ তবু বেরিয়ে পড়ে, চারদিকে পানি ফুলে ফুলে উঠছে, তার বৈঠার আঘাতে ঢেউ উঠছে পানিতে, ঢেউ দেখতে পুষু আপার ব্লাউজের প্রান্তের মাংসের ভাঁজের মতো, পানিতে প্রায় ডুবে আছে পাড়াগুলো, দূরে পুকুরপাড়ে হিজলগাছটি মাথা পর্যন্ত ডুবে গেছে। রাশেদ দূর থেকে দেখতে পায় হিজলের ডালপালার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে তাদের নৌকোটির গলুই, নানু হয়তো নৌকো লাগিয়ে মজা করে বিড়ি টানছে। নানু লুকিয়ে লুকিয়ে সতীলক্ষ্মী বিড়ি খায়, বিড়ির গন্ধটা রাশেদের বেশ লাগে। রাশেদ কোশানৌকোটি বেয়ে হিজলগাছের কাছে যায়, নৌকোর গলুই ধরে, ডালপালার ভেতরে নানুকে দেখে কেঁপে ওঠে। নানু লুঙ্গি অনেকটা খুলে ফেলেছে, বা হাত দিয়ে সে নৌকো ধরে আছে, তার চোখ বোজা, ডান হাত দিয়ে সে তার শিশ্ন নাড়ছে, জোরে জোরে নাড়ছে, জোরে জোরে নাড়ছে। রাশেদ স্তব্ধ হয়ে যায়, নানুকে ডাকতে ভুলে যায়, পাতার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে; নানু চোখ বুজে দ্রুত নাড়ছে, ভয়ঙ্কর সুখকর স্বপ্ন দেখছে, তার ভেতর থেকে মৌচাকের মধু আর জাতসাপের বিষ ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নানুর ভেতর তেকে শাদা লালা ফিনকি দিয়ে বেরোয়, তার শরীর বেঁকে বেঁকে যায়। ঘুমঘুম চোখ খুলে নানু রাশেদকে দেখে, সুখে অবসাদে সে ভরে আছে। রাশেদ দূর থেকে দেখে শাদা বস্তুটি, তার ঘেন্না লাগে, আজিজ এরই কথা বলেছিলো। নানু বলে, দাদা, আমার বিয়ার বয়স অইয়া গ্যাছে, আমি বিয়া করুম, বিয়া না করলে বাচুম না, দেহেন না খাণ্ডা খাণ্ডা মণি বাইরয়।। রাশেদের ঘেন্না লাগে; তার সব কিছু কাঁপতে থাকে, তার কোশাটি কাঁপতে থাকে, নিচে ভাদ্রের পানি কাঁপতে থাকে। ধীরে ধীরে কাঁপতে থাকে সারা গ্রামটি।

রাশেদ ফিরে এসেই পড়তে বসে, সে আর এসব ভাবতে চায় না, দেখতে চায় না, কেঁপে উঠতে চায় না। চিৎকার করে পড়ে, চিল্কারে যেনো তার মাংসের কাঁপন কমে; সে ইতিহাসের ভেতর ঢোকে, ভূগোল বইয়ে ভ্রমণ করতে থাকে মহাদেশ থেকে মহাদেশে, জ্যামিতির বৃত্ত ও ত্রিভূজের মধ্যে খোঁজে শীতলতা। এমন সময় বৃষ্টি নামে, টিনের চালে কোটি কোটি পরীর নূপুর বেজে ওঠে; পশ্চিম পাশের খেজুরগাছটি চালের ওপর ডানা ঝাঁপটাতে থাকে। নিবিড় বৃষ্টি নেমেছে, বাইরে কিছু দেখা যাচ্ছে না, মহাজগত ভরে একটানা কোমল মধুর অন্তরঙ্গ বৃষ্টির শব্দ বেজে চলছে। রাশেদকে বিলু আপা খাওয়ার জন্যে ডাকে, রাশেদ চুপচাপ কোনো কথা না বলে খায়, বাবা তাকে। পড়ার কথা জিজ্ঞেস করেন, রাশেদ জানায় ভালোই হচ্ছে, খাওয়ার পর আবার পড়তে বসে। বাইরে নিবিড় কালো বৃষ্টি, রাশেদ মনে মনে দেখতে পায় বৃষ্টিতে পুকুরপাড়ের। হিজলগাছটি ঘুমিয়ে পড়ছে, ধানের পাতা ভিজে ভিজে ভাড়ি হয়ে পানিতে লুটিয়ে পড়ছে, বৃষ্টির ফোঁটায় পানিতে শাদা শাদা ঝিলিক উঠছে। তার খুব ঘুম পায়, টেবিলে মাথা রেখে রাশেদ ঘুমিয়ে পড়ে একবার, কিছুক্ষণ পর মায়ের ডাকে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। সে গিয়ে শুয়ে পড়ে। তার শরীর এখন স্নিগ্ধ শীতল লাগছে, কথা জড়িয়ে সে শুয়ে। পড়ে। বাইরে ঘুমের মতো বৃষ্টির ঘুমের মতো শব্দ, রাশেদের মনে হয় সে মাটির মতো। গলে যাচ্ছে, বৃষ্টির পানিতে গড়িয়ে বয়ে চলছে পুকুরের দিকে, তার ত্বক গলছে, মাংস। গলছে, রক্ত গলছে, গলে গলে পুকুরের দিকে বয়ে চলছে। রাশেদ ঘুমিয়ে পড়ে। সে স্বপ্ন দেখে, যেমন স্বপ্ন আগে দেখে নি, এক স্বপ্নের মতো নারী যাকে সে কখনো দেখে নি যার রূপের মতো রূপ সে কখনো দেখে নি যার ঠোঁট ডালিম ফুলের মতো হিজল। ফুলের মতো রঙিন সে রাশেদের আঙুল নিয়ে খেলা করছে রাশেদ তার হাত নিয়ে খেলা করছে নারী রাশেদের গ্রীবায় হাত রাখছে রাশেদ তার গালে হাত রাখছে তার শাড়ি উড়ছে তার বুক ধবধব করছে রাশেদ হাত বাড়াচ্ছে আর তখন শরীর কেঁপে কেঁপে উঠে স্বপ্ন ভেঙে যায় স্বপ্ননারী শূন্যে মিলিয়ে যায়। চাপা হতাশার মধ্যে ঘুম ভেঙে যায় রাশেদের, তার শীত শীত লাগতে থাকে, ভিজে গেছে বলে তার বোধ হয়, সে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়, আঙুলে আঠা আঠা লাগে, ঘেন্নায় অবসাদে রাশেদ কুঁকড়ে ওঠে। পাশের বাড়ির জালালদি শেখ, যে রাশেদের বাবার থেকে দশ বছরের বড়ো হবে, রাশেদের বাবা যাকে চাচা বলে, গালাগাল করে চলছে তার স্ত্রীকে; প্রতিদিন সকালে দুপুরে সন্ধ্যায়ই সে গালাগাল করে, রাশেদ শুনতে পাচ্ছে পড়ার ঘর থেকে। রাশেদ ওই গালাগাল শুনে প্রতিবারই ভয় পায়, নিজের জন্যে নয়, জালালদি আর তার স্ত্রীর জন্যে, তবে সে দেখেছে আর কেউ ভয় পায় না। ভয়টা তার রক্তে কালো কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে। জালালদ্দি গলা ফাটিয়ে গালি দিচ্ছে যদিও তার গলায় জোর কম, চোতমারানির ঝি, তরে তালাক দেই, তর মারে তালাক দেই, তর মাইয়ারে তালাক দেই, তুই আমার বাড়ি থন বাইর অইয়া যা। জালালদ্দির মুখ থেকে ভণ্ডকথা ময়লার মতো উছলে পড়তে থাকে, গ্রামের অনেকেই ভণ্ডকথা বলে, বউকে গালি দেয়ার সময় তারা মুখে ফেনা তুলে। ফেলে, তবে তার মতো কেউ নয়। এসব গালাগাল রাশেদের মনে দলাপাকানো ঘেন্না। সৃষ্টি করে, আর তালাক কথাটি তাকে ভীত করে, তবে আর কাউকে করে বলে মনে হয় না; তালাক বললেই তো তালাক হয়ে যায় বলে সে শুনেছে, ওই পুরুষলোক আর মেয়েলোক আর এক সাথে থাকতে পারে না, থাকলে কবিরা গুনা হয়, তাদের দিকে পাথর ছুঁড়ে মারতে হয়, কিন্তু জালালদি আর তার বউর তালাক হচ্ছে না। তারা একসাথেই থাকছে। সে তার বউকেই শুধু তালাক দেয় না, দেয় শাশুড়ীকেও, ভয়ঙ্কর লাগে কথাটি, আরো কুৎসিত হচ্ছে সে তালাক দেয় তার নিজের মেয়েকেও। মেয়েকে কি তালাক দেয়া যায়, নিজের মেয়ে কি নিজের বউ হয়, নিজের মেয়ের সাথে কি সে। ঘুমোয়? ঘিনঘিনে লাগে রাশেদের। জালালদ্দি শেখের মেয়েটি রাশেদদের বাড়িতে এসে রান্নাঘরে বসে বিড়বিড় করতে থাকে, আমার জাউরা বাপটার মোখে কোনো ট্যাক্সো নাই। জালালদ্দির বউ গালি শুনে কথা বলে না, তবে একটু পরে জালালদ্দি যখন তাকে মারতে শুরু করে, তখন তার গলা শোনা যায়। জালালদ্দি লিকলিকে মানুষ, দিনভর কাশে, হয়তো যক্ষ্মা হয়েছে, নারাণগঞ্জের কারখানায় কাজ করে, বাড়ি আসে দু-তিন মাস পর পর। কয়েক বছর আগে আরেকটা বউ এনেছিলো সে, বেশ সুন্দর ছিলো। দেখতে, সবাই তাকে শহরনি বলতো, কসবিও বলতো। পাড়া বলতে রাশেদ বুঝতে তাদের গ্রামের পাড়াগুলোকেই, তবে শুনে শুনে রাশেদ বুঝে ফেলেছিলো আরেক ধরনের পাড়া আছে, সেগুলো শহরের পাড়া, যেখানে খারাপ মেয়েমানুষেরা থাকে, শহরনিও। খারাপ মেয়েমানুষ, জালালদি ওই পাড়া থেকে তাকে নিয়ে এসেছে। রাশেদের খারাপ। মনে হতো না তাকে, রাশেদকে সে আদর করতো, তার হাসিটাও সুন্দর ছিলো। কয়েক মাস পরেই সে চলে গিয়েছিলো, গ্রামের মানুষ তাকে তাড়িয়ে দেয় নি, জালালদ্দি তাকে এতো মারতো যে সে থাকতে পারে নি। জালালদ্দি তার বউকে মারতে শুরু করে, বউটি গাল সহ্য করলেও মার সহ্য করে না; সে চিৎকার করে ওঠে, ঢ্যামনার পো শরিলে হাত দিবি না, আমারে তালাক দিয়া তুই তর মার লগে হো গিয়া। জালালদি। তাকে মারতে চেষ্টা করে, পারে না, তার বউর শক্তি জালালদ্দির থেকে বেশি; বউ ঠেলা দিয়ে জালালদ্দিকে গোবরের ওপরে ফেলে দেয়। জালালদ্দি চিৎকার করতে করতে খসে-পড়া লুঙ্গি ধরে উঠে দাঁড়ায়, বকতে বকতে রাশেদদের বাড়ির দিকে আসতে থাকে। রাশেদ জানে জালালদ্দি তার পড়ার ঘরের জানালার পাশে এসে দাঁড়াবে, ছেঁড়া লুঙ্গির প্রান্ত দু-হাতে ধরে অনেকক্ষণ ধরে বিলের দিকে তাকিয়ে থাকবে, তার সাথে কথা বলবে। জালালদি তার সাথে কথা বলে স্নেহের সাথে, রাশেদকে ডাকে দাদা। বলে, রাশেদকে ছুঁয়ে দেখতে চায়; বলে, দাদা পড়ছ নি, পড়, পড়, বেশি কইর্যা পড়, বড় অইয়া তুমি জজ অইবা, আমারে তহন চাকর রাইক্ক। রাশেদের তখন খুব ভালো লাগে লোকটিকে, তার ভাঙা গাল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির দিকে তাকিয়ে মায়া হয়; রাশেদ জিজ্ঞেস করে, দাদা, আপনি এতো গালাগাল করেন কেনো? জালালদি লজ্জা পায়, বলে, দাদা, আমি কি মানুষ? রুজি করতে পারি না, বউরে খাওয়াইতে পারি না, মাইয়ারে কাপড় দিতে পারি না, খালি গাইল দিতে পারি। আইজ কি খামু তারও ঠিক নাই।

ভাত খুব মারাত্মক জিনিশ। ছোটোবেলা থেকেই রাশেদ দেখে আসছে ঘরে ঘরে ভাতের অভাব, তাদের গ্রামে পেট ভরে খেতে পায় এমন ঘরের সংখ্যা খুব কম, দশবারোটির বেশি হবে না; তাদের বাড়িরই অন্য তিন ঘরের লোকেরা ঠিকমতো খেতে পায় না। পশ্চিম ঘরের বউ-আম্মা আর তার শাশুড়ী প্রায় না খেয়েই থাকে। বউ-আম্মার স্বামী, রাশেদের চাচতো কাকা, বিয়ের পর বউ-আম্মাকে আর দাদীকে রেখে, পাঁচ-ছ বছর আগে, সেই যে আসাম গেছে দরজি না কিসের কাজে, আর আসে নি, কবে। আসবে কেউ জানে না, রাশেদ মাঝেমাঝে শুনতে পায় কামরূপ গেলে কেউ আর ফেরে না; বছরে দু-একবার টাকা পাঠায় লোকের সাথে, পঞ্চাশ ষাট টাকা, হাতে আসার সাথে সাথে খরচ হয়ে যায় বাকি শোধ করতে করতে, সব বাকি শোধও করতে পারে না। তারা খায় খুদের ভাত, সকালে খায় দুপুরে খায় রাতেও খায়, সকালে খেলে দুপুরে খায় না, দুপুরে খেলে রাতে খায় না। গ্রামের লোকেরা এ-সময় শাপলাই খায় বেশি, বউ-আম্মা শাপলাও পায় না, কে তাকে বিল থেকে শাপলা তুলে এনে দেবে? রাশেদ। আর নানু যেদিন শাপলা তুলতে যায়, বউ-আম্মার জন্যেও শাপলা তুলে আনে, তার জন্যে মোটা মোটা কয়েক আটি শাপলা তোলে, বউ-আম্মা সেগুলো ঘাটে ভিজিয়ে রাখে, যেদিন খুদও থাকে না সেদিন দুপুরে শাপলা রাঁধে। তার একটা জালি আছে, পুরোনো শাড়ি দিয়ে বানানো, সেটি দিয়ে সে গুড়োচিংড়ি আর তিনি ধরে। সন্ধ্যায় সে ঘাটে। জালি পাতে, জালিতে কুঁড়োর আধার দেয়, মাঝেমাঝে জালি তোলে, জালিতে যে-কটি গুড়োচিংড়ি আর তিনি ওঠে, সেগুলো জমিয়ে রাখে মাটির ঘটে। গুঁড়োচিংড়ির বড়া খায় দিনের পর দিন, শাপলা খায়, চালের ভাত সাত দিনে একদিনও খায় না, খুদের। ভাত খায়। জালালদ্দি শেখও তাই খায়, যদিও সে সন্ধ্যায় তামাক খেতে এসে বাবার সাথে গল্প করতে করতে বলে দুপুরে সে ইলিশ মাছ দিয়ে বোরো চালের ভাত খেয়েছে। মিষ্টি আলু পছন্দ করে রাশেদ, পোড়া মিষ্টি আলু খেতে খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে। ভালো লাগে বেশি পোড়া অংশ চিবোতে; তবে মিষ্টি আলু ভাত নয়। মিষ্টি আলু ভাত না হলেও ভাতের বদলে গ্রামের অনেকেই আলু খেয়ে থাকে। আলুর নৌকো এলে মা। রাশেদকে ডাকতে বলে, চার আনায় একধড়া আলু পাওয়া যায়, একধড়ার কম বেচে না। আলুঅলা, রাশেদের মা দু-তিন ধরা মিষ্টি আলু রাখে। জালালদ্দিও ঘাটে এসে দাঁড়ায়, আলুর মণ কতো জিজ্ঞেস করে, এক মণ আলু মাপতে বলে, আলুঅলা অবাক হয়; জালালদি বলে সে মণের নিচে আলু কেনে না, তবে আলু মাপতে শুরু করলেই সে আলুঅলাকে বলে সে আজ আলু কিনবে না, ঘরে কয়েক মণ আলু পড়ে আছে। বউ-আম্মাও ঘাটে এসে দাঁড়ায়, আলুর দিকে এমনভাবে তাকায় যেনো সে সোনার দিকে তাকিয়ে আছে। রাশেদের মা বলে, বউ, তুমিও একধড়া আলু রাক। মার কথা শুনে রাশেদের সুখ লাগে।

দুপুর হলে রাশেদদের বাড়িতে দাও তার ভাঙা, পেছন দিকে অর্ধেক খসেপড়া, নৌকোটি বেয়ে আসে, সে নৌকো সেঁচতে সেঁচতে আসে। তার নৌকোটির পেছনের দিকটা নেই, আর যতোটুকু আছে তার সবটা ভরেই ফুটো, সে আঠাল মাটি দিয়ে অসংখ্য ফুটো বন্ধ করেছে, কিন্তু নৌকোটির দিকে দিকে পানি উঠতে থাকে। সে নৌকোটি রাশেদদের ঘাটে ভিড়োয়, খেজুরগাছের সাথে বাধে, তবে বাড়ি ফেরার সময়। তাকে নৌকোটি উঠোতে হয় পানির নিচে থেকে। দাগু জোলা বা তাঁতী, তবে তাঁত নেই অনেক বছর; কামলা খাটে সে, রাশেদদের বাড়িতে বছর ভরেই খাটে, কিন্তু এ-সময়। কেউ কামলাও খাটায় না। দাগুর বাচ্চাও অনেকগুলো, সেদ্ধ শাপলা খেয়েই তারা বেঁচে আছে। দাগু আসে ফেনের জন্যে। গ্রামে ফেনও দুষ্প্রাপ্য, গ্রামে যেমন ভাতের গন্ধ পাওয়া যায় না তেমনি পাওয়া যায় না ফেনের গন্ধও। দাগু ফেনের দিকে যেমনভাবে তাকায় রাশেদের নেড়া কুকুরটিও তেমনভাবে তাকায় না; কুকুরটির ফেনের পাতিল থাকে খেজুরগাছের গোড়ায়, মা কুকুরটির পাতিলে ফেন ঢেলে দেয়, কুকুরটি দূরে শুয়ে শুয়ে দেখে, তার উঠতে ইচ্ছে হয় না, কিন্তু দার পাতিলে ফেন ঢালার সময় চকচক করে ওঠে দাগুর চোখমুখ। দাগু কুকুরের পাতিলটার দিকেও তাকায়, ওই ফেনটুকু। পেলে সে আরো খুশি হতো, কুকুরটি দাগুর পাতিলের দিকে একবারও তাকায় না। ফেন নিতে একা দাগুই আসে না, তার ভাই ছিটুও আসে, জালালদ্দির বউও আসে, কালার মাও আসে। যেদিন তারা সবাই আসে, তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকায় না, পারলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো একে অপরের ওপর, ঝাঁপিয়ে না পড়ে তারা বসে থাকে মুখ কালো করে। রাশেদের ক্ষুধা পায় রান্না শেষ হওয়ার আগেই, রান্নাঘরে এসে সে। উঁকি দেয়, ওই মুখগুলো দেখে তার আর ক্ষুধা থাকে না।

রাশেদকে ঘিরে আছে মানুষ গাছপালা পাখি পুকুর ধানখেত আকাশ মেঘ বৃষ্টি আর তার বইগুলো; সে অনুভব করছে মানুষ গাছপালা পুকুর পাখি ধানখেত আকাশ মেঘ। বৃষ্টি যেমন সত্য তেমনি আরেক সত্য আছে বইগুলোর মধ্যে, ওই সত্যই তাকে আকর্ষণ করছে বেশি। মানুষ সুন্দর, তবু মানুষ তার মনে ঘেন্না জাগাচ্ছে, কষ্ট জন্ম দিচ্ছে; মানুষকে সব সময় সুন্দর মনে হচ্ছে না তার, মানুষ খুব খারাপ হতে পারে, কুকুরের থেকেও খারাপ হতে পারে, মানুষের থেকে পালিয়ে যেতেই ইচ্ছে করছে তার। মাঝেমাঝে; আরো বেশি সুন্দর গাছপালা পুকুর পাখি মেঘ বৃষ্টি ধানখেত, এসব কষ্ট দেয় না, মনে ঘেন্না জাগায় না, চোখের সামনে উপহার দেয় সুন্দরের পর সুন্দর, কিন্তু তারা কথা বলে না, স্বপ্ন দেখে না, ভাবে না, দূরকে কাছে আনে না। বইগুলো চুপ করে থাকে, বইয়ের পাতা খুললে কোনো পাখি ডেকে ওঠে না কোনো ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় না কোনো মানুষের মুখ দেখা যায় না, তবু বইগুলোর ভেতরে যেনো সব আছে, মানুষ আছে গাছপালা নদী মেঘ বৃষ্টি আছে, এবং আরো এমন কিছু আছে যার কথা রাশেদ জানতো না এখনো জানে না, যার কথা তাদের গ্রামের মানুষ জানে না, যার কথা জানে না ওই হিজলগাছ, জানে না পশ্চিমের ঝোঁপের ডাহুক। বই রাশেদের সামনে খুলে ধরে। এক আশ্চর্য জগত, সে-জগতের ছন্দমিল তাকে কম্পিত করে, তার চিন্তা তাকে চিন্তিত করে, তার ভাবনা তাকে ভাবায়। রাশেদ তার বইগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার পড়ে, বাঙলা ইংরেজি অঙ্ক ভূগোল সবই তাকে আকর্ষণ করে, আলোড়িত করে; কিন্তু ক্লাশের বইগুলো পড়া হয়ে গেলে আর পড়ার কিছু থাকে না। ক্লাশের বইয়ের বাইরে যে বই আছে তা সে আগে জানতোই না, ইস্কুলের পাঠাগারে অনেক বই আছে কিন্তু। সেগুলো কেউ পড়ে না, কাউকে পড়তে দেয়া হয় না। ক্লাশের পাঠ্যবইয়ের বাইরের কোনো বই তাকে তার বাবা কখনো এনে দেন নি, তাদের গ্রামে কারো ঘরেই আর কোনো বই দেখে নি রাশেদ; তবে একদিন সে, সেভেনে পড়ার সময়, তাদের ঘরেরই একটি পুরোনো বাক্স খুলে অবাক হয়ে যায়; দেখতে পায় সিন্দুকটি ভরে আছে বই, অনেকগুলো পত্রিকা, পত্রিকা শব্দটি সে শেখে আরো পরে, রাশেদ সেগুলো পড়তে। থাকে, মুগ্ধ হতে থাকে, শিউরে উঠতে থাকে। একটি বই পড়ার চাঞ্চল্য সে কখনো ভুলবে না। বইটিতে নায়ক তার জুতো ফেলে যায়, নায়িকা তা সংগ্রহ করে রাখে। গোপনে; নায়িকার জ্বর হয়েছিলো বলে চুল কাটতে হয়েছিলো, সে-চুল সংগ্রহ করে। রাখে নায়ক; পড়তে পড়তে চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে সে। এমন বই সে আগে পড়ে নি, তবে বইটি শেষ করে উঠতে পারে নি রাশেদ। সে যখন চঞ্চল হয়ে উঠছিলো পড়তে। পড়তে, বাবা এসে দাঁড়ান টেবিলের পাশে, রেগে ওঠেন তার হাতে ওই বই দেখে, রাশেদের হাত থেকে তিনি নিয়ে যান বইটি। রাশেদ আর বইটি পড়তে পারে নি। ওই সব বই পড়তে নেই ছেলেদের, পড়লে ছেলেরা খারাপ হয়ে যায়, যেমন মেয়েদের সাথে কথা বলা খারাপ, মেয়েদের সাথে কথা বললে খারাপ হয়ে যায় ছেলেরা।

অমন খারাপ বই, যে-বই পড়তে তার খুব ইচ্ছে হয়, তেমন বই অনেক দিন আর পড়ে নি রাশেদ; অমন বই পাওয়াই যায় না, পেলেও ভয় লাগে, বাবা দেখে ফেললে। বিপদ হবে। দক্ষিণের বাড়ির রোকেয়ার বিয়ের ক-দিন পর রাশেদ গিয়েছিলো তাদের বাড়িতে, রোকেয়ার বরই রাশেদকে তাদের শোয়ার ছোট্ট ঘরটিতে নিয়ে গিয়েছিলো; রোকেয়া ক-দিনের মধ্যেই মোটা মোটা সুন্দর হয়েছে, বিয়ের পানি পড়লে নাকি এমন হয়, রাশেদ রোকেয়ার গালে কামড়ের দাগ দেখে তার মুখের দিকে তাকাতে পারে নি; তাই বসেই সে বালিশের পাশে রাখা বইটি হাতে তুলে নেয়। রোকেয়া চিৎকার করে তার হাত থেকে কেড়ে নেয় বইটি, বিয়ের আগে ওই বই পড়লে ছেলেরা খারাপ হয়ে যায় বলে সে বলে। রাশেদ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে, এরপর সে বই সম্পর্কে সাবধান হয়, মনে হতে থাকে খারাপ বইই চারপাশে বেশি। সে তাদের পুরোনো বাক্সে পাওয়া। পত্রিকাগুলো পড়ে বছরের পর বছর ধরে, একই লেখা পড়ে অনেক বার; সেগুলোতে শুধু পাকিস্থান পাকিস্থান কায়েদে আজম কায়েদে মিল্লাত মাদারে মিল্লাত মুসলমান। মুসলমান, পড়তে পড়তে তার ঘেন্না ধরে যায়। ওপরের ক্লাশের ছেলেদের থেকে বাঙলা বই এনেও সে পড়ে, খুব ভালো লাগে। ইস্কুলে দুটি দৈনিক পত্রিকা আসে, ছাত্ররা সেগুলো পড়তে পায় না, রাশেদ হরিপদ স্যারকে বলে সেগুলো এনে পড়ে। সে নিজে দুটি পত্রিকার গ্রাহক হয়, সেগুলো পনেরো দিন পর পর বেরোয়, বছরে দু-টাকা লাগে, এতো কম লাগে বলেই সে গ্রাহক হতে পেরেছে। পত্রিকা পাওয়ার জন্যে সে উদগ্রীব হয়ে থাকে, সব সময়ই পত্রিকা আসতে দেরি হয়; পত্রিকা পেলেই সে প্রথম ঘ্রাণ নেয় কাগজের, পত্রিকার কাগজের ঘ্রাণ চমকার লাগতে থাকে তার। রাশেদ বড়ো হয়ে বুঝতে পারে ওই সময় এতে ব্যাকুল হয়ে সে যা পড়তো, তার বেশির ভাগই পড়ার উপযুক্ত ছিলো না; সে তখন অনেক নিকৃষ্ট লেখকের লেখা পড়েছে, তাঁদেরই সে মনে করেছে বড়ো লেখক, কিন্তু তারা লেখকই নয়, যদিও তাদের লেখা বাঙলা বইতে আছে, তাদের লেখা পত্রিকায় ছাপা হয়। তবু তাঁরাই তার মন ভরে দিয়েছিলেন। রাশেদ বই পড়ে, এবং তার মনে একটা বোধ জন্ম নিতে থাকে যে যা কিছু লেখা হয় তা-ই সত্য। নয়, যা কিছু ভালো বলে মনে করা হয়, তা-ই ভালো নয়, যা-কিছু মানতে বলা হয়, তা-ই মানার যোগ্য নয়। সে অনেক কিছুই মানতে পারছে না। স্যাররা কথায় কথায় কায়েদে আজম বলেন, রাশেদ বলে মোহাম্মদ আলি জন্না। এক স্যার খুব রেগে যান। একবার, বলেন, মোহাম্মদ আলি জিন্না বলবা না, বলবা কায়েদে আজম, আমাদের। জাতির পিতা। চুক করে যায় রাশেদ। একবার হেডস্যার একটি পত্রিকা নিয়ে ক্লাশে ঢোকেন, পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তৃতা লিখে নিতে বলেন, বক্তৃতাটি মুখস্থ করতে বলেন। পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকা থেকে ফিরে সলিমুল্লা হলের ছাত্রদের সামনে একটি বক্তৃতা দেন, যাতে তিনি শূন্যের সাথে শূন্য আর এক যোগ করার। পার্থক্যের কথা বলেন; হেডস্যার বলেন যে বক্তৃতাটি পাকিস্থানের সব ছাত্রদের মুখস্থ। করতে হবে। রাশেদের খারাপ লাগে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা মুখস্থ করতে হবে কেননা? একবার পড়েই সে বক্তৃতাটি ফেলে দেয় খাতার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে। বক্তৃতাটি তাদের ক্লাশের সবাই মুখস্থ করে, এমনকি আজিজও গড়গড় করে ওটি বলে যায়, হেডস্যার রাশেদকে মুখস্থ বলতে বললে রাশেদ বলে একবার সে ওটি পড়েছে, কিন্তু মুখস্থ করার মতো মনে হয় নি। রাশেদের কথা শুনে ক্লাশের সবাই ভয় পায়, এখনি হেডস্যার হয়তো বেত আনতে বলবেন, কিন্তু হেডস্যার চুপ করে রাশেদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, স্যারের মুখ খুব স্নিগ্ধ দেখাতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *