মহাভারতের মহারণ্যে – ২.০২

মহাভারতের মহারণ্যে – ২.২

খাণ্ডবদাহন পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ এবং অর্জুন শিল্পকর্ম বিশারদ ময়দানবের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। একদিন ময়দানব এসে তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাতে যুধিষ্ঠিরের জন্য একটি উৎকৃষ্ট সভা নির্মাণ করে দেবার অভিলাষ জানালো। এ কথায় দুজনেই প্রীত হয়ে সম্মতি জানালে, ময়দানব বহু পরিশ্রম করে এমন একটি সভাস্থল নির্মাণ করলো যে-সভা ভূমণ্ডলে আর কারো নেই। নিজের কোনো যোগ্যতা না থাকলেও, ঈশ্বর যাকে সমস্ত রকম সুখ সম্মান আহ্লাদ দিতে ইচ্ছে করেন, সে অবশ্যই ভাগ্যবান। তাঁর আর কোনো পুরস্কারের প্রয়োজন হয় না। অবিশ্রান্ত ভাগ্যই তাঁকে সমস্তরকম সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে ঘিরে রাখে। যুধিষ্ঠির সেই অলৌকিক অসাধারণ ভাগ্য নিয়েই জন্মেছিলেন। ভ্রাতাদের প্রসাদেই তিনি সব কিছুর অধিকর্তা। অতএব ময়দানবের তৈরি তুলনাহীন সভাটিতেও তিনিই বসবার অধিকারী হলেন। বিদুরের বুদ্ধিতে পা ফেলে ফেলে চলে, ব্যাসদেবের সহায়তায়, অৰ্জুনের বীরত্বে, ভীমের বলে, আজ তিনি অদ্বিতীয়া রূপবতী পত্নীর পতি হয়ে যেন যাদুবলে এমন একটি রাজ্যের এমন এক আশ্চর্য সভার সর্বাধিপতি। অথচ এতো কিছু পাবার জন্য একটি আঙুলও তাঁকে নাঁড়তে হয়নি।

অনুপার্জিত ক্ষমতায় পার্থিব সুখসমৃদ্ধির তুঙ্গে উঠে যুধিষ্ঠিরের লোভ আরো উর্ধ্বগামী হলো। মনে মনে তাঁর সম্রাট হবার বাসনা উদিত হলো। ক্রমে ক্রমে সেই ইচ্ছা তাঁকে অস্থির করে তুললো। রাজসূয় যজ্ঞ করবার বাসনায় তিনি যৎপরোনাস্তি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মন্ত্রিগণ ও অনুজদের আহবান করে বললেন সেকথা। পরামর্শ করবার জন্য কৃষ্ণকেও দূত পাঠিয়ে আনয়ন করলেন। কৃষ্ণ যথাসম্ভব শীঘ্র এসে উপস্থিত হলেন। যখন শুনলেন যুধিষ্ঠির রাজসূর যজ্ঞ করবার জন্য লালায়িত হয়েছেন, ভিতরে ভিতরে সম্ভবত তাঁর মন আনন্দে কম্পমান হলো। বোধহয় তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে হলো যা তিনি চেয়েছেন এঁদের সঙ্গে বন্ধুতার বিনিময়ে, সেই সুযোগ সমুপস্থিত। বললেন, ‘একটা কথা, যজ্ঞ যদি নির্বিঘ্নে সমাপন করতে চান, তা হলে আপনার প্রথম কর্তব্য হবে জরাসন্ধকে নিধন করা।’

যুধিষ্ঠির অনুজদের দিকে তাকালেন। সাধ-আকাঙ্ক্ষা যুধিষ্ঠিরের, যাঁরা মেটাবেন তাঁরা ভ্রাতারাই। তিনি যে অযোগ্য তা তিনি জানেন। এ পর্যন্ত যা হয়েছে বা যা হতে পেরেছে সব কিছুর জন্য তো ভ্রাতাদের অনুকম্পাই তাঁর সম্বল। ভ্রাতারা কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘মহীপতি জরাসন্ধ স্বীয় বাহুবলে সমস্ত ভূপতিগণকে পরাজিত করে, তাদের দ্বারা পূজিত হয়ে, অখণ্ড ভূমন্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করেছে। তাঁকে পরাজিত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।”

তৎক্ষণাৎ যুধিষ্ঠির ভয় পেলেন। বললেন, ‘হায় হায়! আমি তো তোমারই বাহুবল আশ্রয় করে আছি। যখন তুমিই জরাসন্ধকে ভয় করো, তখন আমি নিজেকে কী করে বলবান মনে করবো?’ এই পঞ্চভ্রাতা এতোদিন বিদুরের চাতুর্যে ও ব্যাসদেবের সহায়তায় এইখানে এসে পৌঁছেছেন। এর মধ্যে জতুগৃহে অগ্নি প্রজ্বলিত করে কতোগুলো ঘুমন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা ব্যতীত তাদের নিজেদের অন্য কোনো কৃতিত্ব মাহাত্ম্য বা বীরত্বের কোনো প্রমাণ ছিলো না। একমাত্র অর্জুনের লক্ষ্যভেদটাই উল্লেখযোগ্য। সেখানেও তিনি অদ্বিতীয় নন। অর্জুনের পূর্বে সেটা কর্ণই করেছিলেন।

যুধিষ্ঠিরের ভীতি দেখে কৃষ্ণ যে বিষয়ে অতি দক্ষ, নিভৃতে সেই পরামর্শটি দিলেন। বললেন, ‘একটা উপায় আছে, যদি আজ্ঞা করেন তো বলি।‘

যুধিষ্ঠির উৎসুক হলেন। কৃষ্ণ বললেন, ‘দেখুন, আমি নীতিজ্ঞ, ভীমসেন বলবান, এবং অর্জুন আমাদের রক্ষক। অতএব, তিন অগ্নি একত্র হয়ে যেমন যজ্ঞ সম্পন্ন করে, তেমনই আমরা তিনজন একত্র হয়ে জরাসন্ধের বধসাধন করবো। আমরা তিনজন নির্জনে আক্রমণ করলে জরাসন্ধ নিশ্চয়ই একজনের সঙ্গে সংগ্রাম করবে। সে অবমাননা, লোভ ও বাহুবীর্যে উত্তেজিত হয়ে ভীমের সঙ্গে যুদ্ধ করবে সন্দেহ নেই। তখনি ভীমসেন তাঁকে সংহার করতে পারবে।’

কী অন্যায়! এর নাম কি বীরত্ব? কিন্তু এঁরাই মহাভারতের শ্রেষ্ঠ বীর বলে বর্ণিত। কোনো রাজা বা রাজপুত্র কখনো এভাবে শক্রসংহার করে না, তাতে তাদের অপমান হয়। এবং কৃষ্ণও জানেন জরাসন্ধও করবেন না। ধর্মত দুর্যোধনও এই ধরনের কর্ম কখনও ভাবতে পারবেন না। কিন্তু যিনি মহাত্মা ধর্মাতা যুধিষ্ঠির, তিনি এই প্রস্তাবে ভীষণ খুশি হলেন। লুকিয়ে কোনো অন্তঃপুরে ঢুকে, তাঁর আতিথ্যে সামাদৃত হয়ে, সহসা সেই মানুষকে তাঁর অসতর্ক মুহূর্তে খুন করার মধ্যে যে যথেষ্ঠ পরাজয় আছে, অন্যায় আছে, অধর্ম আছে, একবারও সে কথা তাঁর মনে হলো না। যে কোনো বীরের পক্ষে সেই অপমান মৃত্যুর অধিক। মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের মন কিন্তু এই প্রস্তাব অসততার চূড়ান্ত বলে বর্জন করলো না।

আর এদিকে অর্জুনের মতো একজন মহাবীরের কাছেও সেই প্রস্তাব কাপুরুষতার নামান্তর হিশেবে গণ্য হলো না। ইতিহাস যাঁকে ধর্মের ধ্বজা বলে চিহ্নিত করেছে এবং যাঁকে বীরত্বের শেষ সীমা বলে প্রচার করেছে, তাদের দুজনের একজনও এই বুদ্ধিকে কুবুদ্ধি বলে বর্জন করলেন না। বীরশ্ৰেষ্ঠ অৰ্জুন ও মহাবীর ভীম চুপ করে রইলেন, শ্রেষ্ঠ ধাৰ্মিক যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তুমি প্রজ্ঞা নীতি বল ক্রিয়া ও উপায় সম্পন্ন। অতএব ভীম ও অর্জুন কার্যসিদ্ধির জন্য তোমাকেই অনুসরণ করুন।’

যিনি প্রকৃত বীর তিনি যে কখনোই বীরত্বকে অবমাননা করেন না, কৃষ্ণ সেটা জানেন। সেটা তাঁদের পক্ষে অপমান, আমর্যাদা, এবং অধৰ্ম। নচেৎ, কীরূপে জ্ঞাত হলেন যে নিরুপায় লোকটিকে তিনজনে আক্রমণ করলেও তিনি সর্বাপেক্ষা যিনি বলবান তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ করবেন? একজন বীরশ্রেষ্ঠর পক্ষে সেটাই তাঁর যোগ্যতাঁর সম্মান এবং প্রমাণ। সারা মহাভারত ভর্তি কোটি কোটি অক্ষরের প্রকাশ্যে যাঁকে সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হিশেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেই অর্জুন কিন্তু যুদ্ধের সময় প্রকৃতপক্ষে কোনো বড়ো যোদ্ধার সঙ্গেই শঠতা ব্যতীত বীরত্বের প্রমাণ দেননি। আর যিনি ধর্মাত মহাত্মা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির, তিনি নিজে অক্ষম হয়েও, অপরের পারঙ্গমতাঁর সাহায্যে তাঁর নিজের লোভ চরিতার্থের জন্য যে কোনো পাপকর্মে অন্যদের লিপ্ত হতে দিতে মুহুর্তমাত্র দ্বিধা করেননি। যে কৰ্ম করতে কর্ণ এবং দুর্যোধন ঘৃণা বোধ করতেন, লজ্জা বোধ করতেন, এঁরা সেটা অনায়াসে করেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *