রক্তসেচ

কী আমরা হারিয়েছিলাম সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
নিজ বাসভূমে?
কী আমরা হারিয়েছিলাম?
নৌকোর গলুইয়ের শান্তি, দোয়েলের সুরেলা দুলুনি,
ফসলের মাঠের সম্ভ্রম,
শহুরে পথের পবিত্রতা,
আর গাঙচিলের সৌন্দর্য
আর অভিসারের প্রহর,
কবিতার রাত,
দিগন্ত-ছোপানো
গোধূলির রঙ
-সবকিছু, হারিয়েছিলাম।
কখনও জানি না আগে, এত যীশু ছিলেন এখানে
আমাদের নগরে ও গ্রামে। সন্ধ্যার মতন কালো
ভীষণ মধ্যাহ্নে
আমরা কয়েক লক্ষ যেসাসকে হারিয়ে ফেলছি।

তখন প্রত্যহ মৃত্যু এসে বসতো আমাদের আর্ত ড্রইং রুমে,
সোফায় মাদুরে ফ্ল্যাটে কি পর্ণ কুটিরে
মাননীয় অতিথির মতো।
নির্জন পথের মোড়ে বাসস্টপে কিংবা গলির ভেতর
হঠাৎ এগিয়ে দিতো হাত, যেন বন্ধু বহুদিন পর
এসেছে নিদেশ থেকে অথবা বুকের ভেতরে নিপুণ
চালিয়ে বিশীর্ণ হাত দেখে নিতো হৃৎপিণ্ড কেমন
চলছে কি তালে।
যে পাখির ঝাঁক নামতো আমার উঠোনে,
হলো তারা নিরুদ্দেশ, যে-বেড়াল সবুর বিহনে
কুড়াতো আদর, খাদ্য আমার কন্যার
সেও তো উধাও হলো কে জানে কোথায়।
রক্তের মতন রক্ত বয়ে যেতে দেখে,
লাশের মতন লাশ পচে যেতে দেখে
হয়তো-বা শহরবিমুখ
হয়েছিলো ওরা।
জানতাম, সেই রক্ত বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ,
জানতাম, সেই লাশ বড়ো প্রতিশোধপরায়ণ।
আমরা সবাই সেই সন্ত্রস্ত বেলায়
বন্ধুর হাতেও হাত রাখতে পারিনি,
অথবা দু’চোখ ভরে পারিনি দেখতে কৃষ্ণচূড়া।
বুকের ভেতর
নিষিদ্ধ কবিতা গান নিয়ে হেঁটে গেছি
মাথা হেঁট করে,
আমার বাংলার মাটি করেছি চুম্বন মনে মনে।

টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ,
যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো,
নিয়াজির টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ,
ফরমান আলীর টাইয়ের নটে ঝুলন্ত তরুণী…
তুমি কি তাদের
কখনও করবে ক্ষমা?–সেদিন সমস্ত গাছপালা,
নদীনালা, ফুটপাত, এমনকি বন্য পশুপাখি
এই প্রশ্ন দিয়েছিলো ছুড়ে চরাচরে।
ভদ্র মহোদয়গণ, এই যে আমাকে দেখছেন
পরনে পাঞ্জাবি, চুল মসৃণ ওলটানো, এই আমার মধ্যেই
ছিলো বিস্ফোরণ,
আমার মধ্যেই
ট্যাংকের ঘর্ঘর
জননীর আর্তনাদ, পিতার স্তম্ভিত শোক, বিধবার ধু ধু
দৃষ্টি আর কর্দমাক্ত বুট, সৈনিকের কাটা হাত,
ভাঙা ব্রিজ, মুক্তিবাহিনীর জয়োল্লাস,
আমার মধ্যেই ছিলো সব।
তোমরা নিহত যারা তাদের উদ্দেশে আজ মর্শিয়ায়
কালো করবো না চতুর্দিক, কেঁদে ভাসাবো না বুক।
তোমরা তো স্তব
এখন, পবিত্র
স্তোত্র কণ্ঠে কণ্ঠে,
জীবিতের চেয়েও তোমরা বেশি জীবন্ত এখন। তোমাদের
রক্তসেচে আমাদের প্রত্যেকের গহন আড়ালে
জেগে থাকে একেকটি অনুপম ঘনিষ্ঠ গোলাপ।