মহররমি প্রহর, স্মৃতির পুরাণ

কুকুরও কাঁদতে জানে, হাসতে জানে কি? ওরা খুব
কাঁদতে তখন,
কেমন পাশব কান্না, হয়তো আংশিক মানবিক।
দলে দলে ওরা
এপাড়া ওপাড়া
ঘুরে ঘুরে মহররমি প্রহর ছড়িয়ে দিতো মধ্যরাতে। তুমি
শুনতে কি সত্তার চৌকাঠ
আমূল নাড়িয়ে-দেয়া সেই আর্তনাদ?
শুনতে কি রাত্রিমাখা অসিত বালিশে
মাথা রেখে? ঘুমঘোরে একটি গেলাস
বারবার চেয়েছিলে ব্যাকুল ছোঁয়াতে ফাটাফুটা
ঠোঁটের জমিনে?

কে জানে কোত্থেকে
এক ভিড় ঘোড়া, হয়তোবা আকাশের মাঠ থেকে
হঠাৎ আসতো নেমে ঘুমন্ত শহরে
অগ্নিকণা ঝরাতে ঝরাতে। এক ভিড় রাগী ঘোড়া
ছাদের জঙ্গলে,
মসজিদের পুরুষ্ট গম্বুজে,
মঠের শিখরে,
গির্জের চূড়োয়,
চালের আড়তে,
কসাইখানায়
কেমন অদ্ভুত নাচে উঠতো মেতে, করতো তছনছ
ভাটপাড়া গ্রন্থাগার-তুমি সেই অশ্বক্ষুরধ্বনি
শুনতে কি পেয়েছো তখন?

অথচ সকালবেলা ক্রুদ্ধ ঘোটকের
কীর্তির কলুষ কোথায় যে
হতো অবলুপ্ত। পুনরায় শহরের
প্রতিটি বাগানে রাঙা আড্ডার ঝলক,
বুড়িগঙ্গা আকাশের চোখের তলায়
আপন রুপালি বুক করে উন্মোচন।
কখনও পথের ধারে কখনওবা সিঁড়ির অত্যস্ত নিরালায়
কথোপকথন, চতুর্দিকে
দুপুরের উৎফুল্ল ব্রোকেড।
তুমিও কি থাকতে ঠিক বিচূর্ণিত নিশীথের পরে?
প্রাতরাশ খাওয়ার সময়
খবর-কাগজ পাঠকালে
অথবা রিকশায় বসে কিংবা
দপ্তরের ঘর্মাক্ত প্রহরে
হতো না কি ভাবান্তর কোনো? লাগতো না-কি
ঘাড়ে পিঠে নিশাচর ঘোড়াদের বাষ্পময় কালো
নিঃশ্বাসের দাগ?

কখনও নিকটে গেলে সংলাপের লোভে
দিতে না বুঝতে কী যে তোলপাড় চলছে তোমার
বুকের টানেলে,
মগজের ট্রেঞ্চে। যেন তুমি পেয়ারা গাছের ছায়া,
সোমথ মাছের ঘাই, পানকৌড়ি, রঙিন তিজেল
কবেকার চারুহাসি একটি তোরঙ্গ নিয়ে খুব
সুখে আছো। করতলে নাচাতে রোদ্দুর
জোয়ান বেহারা, পালকি, রাতের কুটির,
গলির পুরনো বাতি, উড্ডীন পরীর
ছবিসহ বিশাল সাইনবোর্ড উই-খাওয়া পুতুলের চুল।

দ্যাখো কতো ফুটেছে গোলাপ চতুর্দিকে,
এত বেশি গোলাপ ফুটতে এ শহরে
কখনও দেখিনি আগে। দ্যাখো
আমি গোলাপের নিচে ডুবে যাচ্ছি, খুব
নিচে ডুবে যাচ্ছি বলে তুমি
বাইরে মেলে দিয়েছিলে দৃষ্টি স্বপ্নাতুর-
যেন
অদূরে কোথাও
গোলাপ উঠেছে ফুটে থরে থরে। তবে কি আমার
চশমার কাচ
শিগগিরই পাল্টাতে হবে? কই আমার চোখে তো পড়ে না
একটিও গোলাপ কাছে-দূরে।
দেখাতে চাইলে তুমি বিষণ্ন ইঙ্গিতে,
কোথায় কোথায় বলো কোথায় গোলাপ বলে আমি
বিষম চেঁচিয়ে উঠতাম, মনে পড়ে।

তোমার নিকটে গেলে হ্রলে-হ্রদে পদযুগ ডোবানোর
জলজ আনন্দ কিংবা ভোরবেলাকার
টিলায় অথবা
ডাগর নদীর তীরে সূর্যোদয় দেখবার খুশি
হরিণের মতো উঠতো নেচে আর পার্টি অফিসের
বারান্দায় ডাকতো কোকিল।

কোনো কোনো দিন
বিকেলে আলস্যময় হাত
দিতে মেলে শূন্যতার কাছে আর কোত্থেকে চকিতে
প্রজাপতি উড়ে এসে
তোমার হাতের মাঠে পেতো ঠাঁই, কী-যে করতো পান।
একটি কি দুটি করে অগণিত প্রজাপতি সুচারু নকশায়
তোমাকে ফেলতো ঢেকে, তারপরে দূরে
নিমেষে বিলীন-
যেন-বা তোমার প্রজা, ফুরফুরে সুখে বুঁদ
তুমি অধিপতি।
তখনো গোধূলিস্বরে বলতে তুমি করুণ প্রহরে-
‘যেখানে পাখির হাট বসে দু’বেলা, যেখানে
টিয়ের বুকের মতো জমজমাট ঘাসে
চিরুণি চালায় হাওয়া, খরগোশ নিত্য
করে আসা-যাওয়া, যেখানেই
আমাকে কবর দিও। যদি জমি হয় বৃক্ষহীন,
গোলাপের চারা দিও পুঁতে
শিয়রে আমার।‘ সারাক্ষণ
বলতে এমন ঢঙে কথা,
যেন হস্তধৃত চা’য়ের পেয়ালাটাই একমাত্র শ্রোতা
আমরা দেয়ালে কিংবা চেয়ার টেবিল।

মগজে তোমার
কল্পনার প্রচুর ফসল ফলতো বলে
গোধূলিরঙিন সেই ইচ্ছাটাকে তোমার উধাও
মনের ব্যাজার কোনো খেয়াল বলেই
ধরে নিয়েছিলাম সেদিন। কে জানতো
অচিরেই আমাদের দিনরাত্রি শুধু
ভীষণ ভাবতে হবে কবরের কথা।
কবরের কথা, মনে পড়ে,
তুমি বলেছিলে
এমন নিস্পৃহ সুরে, যেন
মৃত্যুতে যন্ত্রণা নেই কোনো, নেই কুশ্রীতা কিছুই।
যেন
মৃত্যুর মুহূর্তে মুখ বেঁকে যায় না বিচ্ছিরিভাবে,
ওঠে না গাঁজলা কষে, অস্থিমজ্জার সব
ডাইনীর পাচনের মতো
ওঠে না ঘুলিয়ে বারবার
বিকট আক্ষেপে। কী আশ্চর্য, সেদিন গোধূলিস্বরে
মৃত্যুকে আবৃত্তি করেছিলে তুমি কবিতার মতো!

প্রতিদিন ঘন ঘন দেখেছি কবর, এখনও তো
গণকবরের খাঁ-খাঁ প্রতিবেশ সত্তা জুড়ে রয়।
শরীরের নির্জন হারেমে
বেড়ে ওঠে বুনোঘাস। খানাখন্দ থেকে
বীভৎস বেরিয়ে-পড়া মৃত হাত-পা সর্বদা মগজে
সিঁদ কাটে, অকস্মাৎ দেয়
তুমুল ঝাঁকুনি। মৃত্যু নয়
নক্ষত্রের রাত,
বসন্ত বাহার,
চামেলির সুস্নিগ্ধ চমক।
বসে না পাখির হাট সেখানে কখনও, নেই কোনো
গোলাপের চারা। খানাখন্দে
নিরালা টিলায়, ট্রেঞ্চে, ড্রেনে
অথবা নালায়
তোমাকে পাইনি খুঁজে। তোমার কি সাজে
লুকোচুরি খেলা?

এই তো আসছে ওরা ভিনদেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে,
ভাসবে বিলের জলে, বিন্দু বিন্দু খুশি
হয়ে ওরা উড়বে আকাশে বাংলার-
তুমি দেখবে না? তোমার তো ছিলো সাধ
মানস হ্রদের কিংবা সাইবেরিয়ার
এইসব ডানা-অলা যাত্রীদের দিকে তাকানোর।

কেউ কেউ আজও
মহানন্দে বন্দুকের কালো নল আকাশের পথে
করে তাক, গুড় ম গুড় ম শব্দ পাখি তাড়ানোর
খেলা কখন যে হয়ে যায়
হায়, লোক তাড়ানোর ভয়ঙ্কর খেলা।