দেশভাগের পর

দেশভাগের পর

কালরাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখেছি। নিরেট অন্ধকারে কোথায় কোনও এক ঘরে শুয়ে আছি। বাইরে নিঝুম বৃষ্টি। কতকাল ধরে যে এরকম বৃষ্টি হচ্ছে কে জানে! বৃষ্টির তোড়ে হঠাৎই ঘরের একটা দরজা খুলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিভেজা হাওয়ায় দমবন্ধ ভাবটা কাটে আমার। বৃষ্টির ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছে দেখতে পাই। বুক ভরে শ্বাস টানি। ওঠে দরোজাটা, যে বন্ধ করব শক্তি পাই না। বৃষ্টিজলে ঘর ভিজে যায় আর আমি অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখি। তখন কে একজন, ধপধপে সাদা থান পরা, মাথায় ঘোমটা, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করতে চায়। পারে না। বৃষ্টির ভেতর আবছা সেই নারীমূর্তি, কে, এত কষ্ট করেও আমার ঘরের দরজা বন্ধ করতে চাইছে।

 স্বপ্নের ভেতরই অবাক হই। খেয়াল করে সেই নারীমূর্তি চেনার চেষ্টা করি। একটু যেন চেনা চেনা মুখটা। কে? দুতিনবার চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি। জবাব আসে না। উঠে দরোজার কাছে গিয়ে দেখি বৃষ্টিতে সাদা থান পরে, মাথায় ঘোমটা, কমললতা দাঁড়িয়ে। আমাকে ওঠে আসতে দেখেই করুণ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বৃষ্টির অভ্যন্তরে মিলিয়ে যায়। আমি পেছন থেকে চিৎকার করে ডাকি, কমল, কমললতা। সে শোনে না। মিলিয়ে যায়।

ঘুম ভেঙে আমি তারপর অনেকক্ষণ কিছু ভাবতে পারিনি। ঘুমিয়ে আছি না জেগে, বুঝতেই অনেকটা সময় কেটে যায়।

বয়েস হলে কী এরকম হয়! মত্যু ঘনিয়ে এলে কী এরকম হয়! কালরাতে কমলকে স্বপ্ন দেখার পরপরই ঘুম ভেঙে গেছে। জেগেও অনেকক্ষণ ধরে তারপর কমলকেই দেখেছি। স্বপ্নের মতো জাগরণেও কমল বারবার আমার চোখের ওপর দিয়ে, শাদা থান পরে, মাথায় ঘোমটা করুণ, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেঁটে গেছে। বৃষ্টি হচ্ছিল, বৃষ্টিজলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছিল। কমল বাইরে দাঁড়িয়ে দরজাটা বারবার টেনে বন্ধ করতে চাইছিল। কী অর্থ এসবের! বুঝতে পারি না কিছু। তবে স্বপ্ন দেখার পর থেকে কমলকে আর ভুলতে পারছি না। কমল আমার চোখ থেকে আর সরে না। কতদিন পর যে স্বপ্ন দেখলাম কমলকে!

বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারিনি। এমনিতেই ভালো ঘুম আজকাল হয় না। রাতেরবেলা হাঁসফাঁস করি, এপাশ ওপাশ করি, ওঠে জল খাই। ঘুম কী আসে! আগে ঘুম না এলে কুপি জ্বালিয়ে রামায়ণ পড়তাম। টুকটাক কাজও করেছি অনেক রাত জেগে। কখনও ওষুধের আলমারি খুলে গোছগাছ করেছি, চেয়ার টেবিল ঝেড়েমুছে রেখেছি। বহুকাল এসব আর করা হয় না। চোখে ভালো দেখতে পাই না। কানেও শুনি কম। রাতেরবেলা তাই বড় বেশি অসহায় লাগে। নিঝুম হয়ে পড়ে থাকি। অন্ধকার ডাক্তারখানায় শুয়ে নিজের ভেতরের কত ছবি যে দেখতে পাই, কত কথা যে শুনতে পাই! বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না। কতকাল ধরে যে এইরকম একলা হয়ে আছি! এভাবে জীবন কাটে মানুষের, নির্বান্ধব অবস্থায়!

ডাক্তারবাবু চলে গেলেন সেও এক বছর। কথা ছিল গুছিয়ে গাছিয়ে আমিও চলে যাব। একটা বছর কেটে গেল, কিছুই গোছান হয়নি। আজকাল মনে হয় একটা বছর কী একটা পুরো জীবনেও বুঝি গোছান হবে না আমার। চতুর সময় কেবল পিছলে যাবে।

ডাক্তারবাবু বলেছিলেন দোকানটা বিক্রি করে দেবেন। দিয়ে একবারেই নমস্কার। আমি হতে দিইনি। এত পাষাণ হই কী করে! বললাম, আপনে যান গিয়া কর্তা। আমি আর কয়দিন থাইকা আসি। আমি গরিব মানুষ, আমারে মারব কেডা? ভগবান আছেন। তিনিই দেখবেন। আমার কথা শুনে মানুষটা খুব কাঁদলেন। যেতে কী চান! সারাজীবন যে মাটিতে কাটালেন তাকে ছেড়ে যেতে চায় কে!

কিন্তু না গিয়েই বা উপায় কী! দেশ কি আর দেশ আছে! মানুষ কি আর মানুষ আছে! গত বছরই তো বর্ষাকালে মনীন্দ্র খুন হল। বাবু তো ভয়ে মরেন। একদিন চুপি চুপি। বললেন, উমা রে আর বুঝি থাকন গেল না। মোল্ল সতরডা বচ্ছর তো কাডাইলাম। শেষকালে কি মাইনষের হাতে মরুম! শেষকালে নি খুন হইয়া যামু!

আমি বললাম, কাম নাই কর্তা। চইলা যান। এখনে থাইকা কষ্টই বা করবেন ক্যা? শেষ। বয়েসে একটু আরাম করেন গা। মাইয়ারা আছে, বউমারা আছে তারা যত্নআদি করবো। যান গা।

 বাবু অনেকক্ষণ কথা বলেননি। থম ধরে রইলেন। তারপর চারদিকে একবার তাকিয়ে বললেন, বড় মায়া হয়রে। এই মাডি মানুষ ছাইড়া যামু!

বাবুর চেহারা তখন বিবেকানন্দের মতো ভারী দেখাচ্ছিল। দেখে চোখ ছলছল করে আমার। আমি কিছু বলতে পারিনি!

এক সন্ধ্যায় তারপর মাওয়ার ঘাটে গিয়ে চুপি চুপি বাবুকে লঞ্চে চড়িয়ে দিলাম। মতলেব মুদি, গান্ধি ময়রা ওরা বারবার জিজ্ঞেস করেছে, ডাক্তারবাবু কই যাইতাছেন?

বাবু জবাব দিতে পারেননি। আমি মিথ্যে বলেছি সবার কাছে। বাবু একটু কামে ঢাকা যাইতেছেন। তিন চাইরদিন পর আইসা পরবেন।

বাঁধা রোগীদের কাছ থেকে বাবু বিদায় নিয়েছিলেন অন্যভাবে। কাকে কী বলেছেন আমি সব শুনিনি। তো যাওয়ার কদিন আগ থেকেই আমাকে বারবার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কাকে কোন ওষুধ নিয়মিত দিতে হবে, কোন রোগের কী সাধারণ চিকিৎসা। আমি ওসবে মনোযোগ দিইনি। একটা জীবন কাটল বাবুর কম্পাউণ্ডারি করে, বুঝব না কোন রোগের কী চিকিৎসা! বাবুর কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কমল বেঁচে থাকতে কমল, সে মারা যাওয়ার পর এই জলধর ডাক্তার, আমরা দুজনে দুজনার ছায়ার মতো ছিলাম। তাই ডাক্তার বাবু চলে যাওয়ার পর আমি দ্বিতীয়বারের মত একলা হয়ে গেলাম। বাবু অবশ্য বারবার বলেছেন, এখানে থাইকা কাম নাই। তুইও ল আমার লগে। টেকা পয়সা দিয়া কী হইবো!

আমিই জোরাজুরি করে থেকেছি। বলেছি, আপনে যান কর্তা। সবকিছু বেইচ্যা কিছু পয়সা কড়ি হাতে লইয়াই আমি আমু। আমার কোনও ডর নাই। আর দুইজন একলগে গেলে মাইনষে সন্দ করবো। আপদ-বিপদও হইতে পারে।

কথাটার গুরুত্ব দিয়েছিলেন বাবু।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি তখন বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছি। জানের ভয় কার না আছে। বারবার ইচ্ছে হয়েছে বাবুর সঙ্গেই চলে যাই। কলকাতা গেলে অসুবিধা কী! একটা মাত্র পেট, চলে যাবেই। তাছাড়া বাবু তো আছেনই। বাবুর ছেলেরাও শুনেছি বড় বড় সব চাকুরে। কলকাতায় রাজরাজরার মতো বাড়ি। চাকর-বাকরের অভাব নেই। গাড়ি ঘোড়ার অভাব নেই। আমিও তাদের সংসারেই একটা কোনও কাজটাজ নিয়ে থেকে যাব।

আমরা বংশানুক্রমে বাবুদের বাড়িতেই কাজ করে আসছি। আমার পিতা, পিতামহ। তখন কাজিরপাগলায় বিশাল জমিদারি ছিল বাবুদের। বাবুর পিতা বুড়ো চক্রবর্তী মহাশয়ের আমলে সেই জমিদারি প্রায় শেষ ধাপে এসে দাঁড়িয়েছিল। বুড়ো চক্রবর্তীর সংসারে ছিল ওই এক মাতৃহীন সন্তান, জলধর। আমার প্রথম যৌবনে দেখেছি কলকাতায় থেকে ডাক্তারি পড়ছেন জলধরবাবু। সপ্তায় সপ্তায় তাঁর চিঠি আসে। সেই চিঠি পেয়ে বুড়ো মানুষটার কী উচ্ছ্বাস! শীতের সকালে আঙিনার রোদে বসে হবু ডাক্তার ছেলের চিঠি পড়েত পড়তে সকাল যে কখন দুপুর হয়ে যেত মানুষটা খেয়াল করতেন না। কখনও বাড়ির চাকর ঠাকুরদের ডেকে ডেকেও চিঠি পড়ে শোনাতেন। জমিদারির কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তখন। কিন্তু চাকরবাকরের কমতি ছিল না সংসারে। আমার বাবা সারাক্ষণ বুড়ো মানুষটার তদারকিতে থাকতেন। মা থাকতেন ঘরকন্নার কাজে। আমার বোন দুটোর বিয়েথা হয়ে গিয়েছিল অনেক আগে। আমি তখন হাইস্কুলের একেক ক্লাশে তিনচার বছর ধরে পড়ি। তবু ক্লাশ সিক্সের ওপর যাওয়া হয়নি। ততদিনে জলধরবাবু কলকাতা থেকে ডাক্তার হয়ে এলেন। আহা কী সুন্দর দেখতে ছিলেন মানুষটা তখন। ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প শুনতাম, ডালিমকুমারের গল্প। সেই রূপকথার ডালিমকুমার হয়ে জলধরবাবু কাজির পাগলা এলেন। বয়সে আমারচে তেমন। বড় হবেন না। তবু ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাবুকে আমি বেশ সমীহ করে চলতে লাগলাম।

বাবুর ইচ্ছে ছিল কলকাতায় থেকেই ডাক্তারি করবেন। বুড়ো চক্রবর্তী রাজি হলেন না। চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি, এলাকার তাবৎ লোকজনই একদা চক্রবর্তীদের প্রজা ছিল। বাবুকে চক্রবর্তীদের বনেদিয়ানা বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই কাজির পাগলা গ্রামে থেকে ডাক্তারি করতে হবে। বিদেশ বিভুয় থাকলে লোকে চক্রবর্তীদের ভুলে যাবে। বুড়ো চক্রবর্তী বেঁচে থাকতে তা হবে না। তিনি সইতে পারবেন না।

তো ডাক্তারবাবুও মানুষ বটে একখানা। অত বড় মানুষটা, অত শিক্ষিত, বাপের কথা অমান্য করলেন? করলেন না। জীবনটা এই কাজির পাগলা বাজারেই কাটিয়ে দিলেন। ওদিকে নিজের ছেলেগুলোকে দেখ, লেখাপড়া শিখে যে যার মতো বিদেশ বিভুঁয়ে চলে গেল। আবার বলে কিনা ওটাই তাদের দেশ!

এই কথাটা নিয়ে বাবু বড় দুঃখ করতেন। ছেলেমেয়েদের চিঠিপত্র পেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, পয়দা হইলি এই দেশে, অহন কচ কিনা এইডা তগ দেশ না! হায়রে আহাম্মকের দল!

চিঠিতে বাবুকে কলকাতা চলে যাওয়ার কথা লিখত ছেলেরা। তখনই বাবু এসব কথা বলতেন। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ কইরা দেশটারে নাইলে দুইভাগ করলই, কিন্তু আমি যে এই মাটিতে জন্মাইলাম, এইডা তো মিথ্যা কথা না! হায়রে, লেখাপড়া শিখা এইডাও তরা অস্বীকার করতে চাস!

পার্টিশানের পর থেকেই ছেলেরা খুব তাগিদ দিচ্ছিল, এবার চলে এস বাবা। এখন আর ওদেশে পড়ে থাকার মানে হয় না!

কথাটা শুনলেই বাবুর মাথায় রক্ত চড়ে যেত। একাকী বিড়বিড় করতেন সারাক্ষণ। এদেশ ওদেশ কী, পুরাটাই তো এক দেশ, এক মাটি। মাটির বাস নিয়া দেখিচ হারামজাদারা, সব একই বাসের। নাকে বাতাস টাইনা দেখিচ, একই স্বাদের।

সেই মানুষকেও দেশ ছাড়তে হল। জানের ভয় আছে না! কী যে শুরু হল দেশে, মানুষ মানুষকে মারতে চায়। ডাক্তার বাবু চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে, তখন বর্ষাকাল, মনীন্দ্র খুন হল। রাতেরবেলা অন্ধকার জংলা বাড়িতে মানুষটার গলা কেটে রেখে গেল কারা।

এরপর প্রাণে জল থাকে কার! বছর দুয়েক ধরেই তো এরকম শুরু হয়েছে। মুসলমানরা সব মারমুখো হয়ে আছে। চারদিকেই হিন্দু খেদাও ভাব। মনীন্দ্রকে তো খুনই করল। আহা অমন একটা মানুষ!

অবশ্য মনীন্দ্রেরও দোষ ছিল। বড় মেয়েমানুষ ঘেঁষা ছিল মানুষটার স্ববাব। পাশের মুসলমান বাড়ির তিনটি মেয়ে বড় হয়েছিল মনীন্দ্রর হাতের ওপর দিয়ে। একটার বিয়ে থা হয়ে গেলে, পরদেশে চলে গেলে, পরেরটা আসত মনীন্দ্রর কাছে। শোনা যায় একদা যার সঙ্গে মিলমিশ ছিল মনীন্দ্রর, গোপন সম্পর্ক ছিল, তার তিনটি মেয়ের সঙ্গেই পরবর্তী সময়ে সম্পর্ক হয় মনীন্দ্রের।

তো মানুষটা বেজায় চালাক চতুর ছিল। কবিরাজ মানুষ তো! তার ওপ টোটকা ফোটকা জানত। ভূতের আছর ছাড়াতে পারত, মা শেতলার চিকিৎসা সারা বিক্রমপুরে মনীন্দ্রের মতো কেউ জানত না। পচে গেছে এমন রোগীকেও ভাল করেছে মনীন্দ্র। প্রয়োজনে। জিভ দিয়ে কুকুরের মতে নাকি চেটেও নিত মা শেতলার দয়া।

মানুষটা বোধহয় বশীকরণ মন্ত্রও জানত। নইলে এত মেয়েমানুষই বা আসত কেন তার কাছে! কী ছিল মনীন্দ্রর! বাঁশের মতন লম্বা টিংটিঙে শরীর, ধারাল নাক মুখ। বয়স্ক। মনীন্দ্রর কথা ভাবলে অবাক হয়ে যাই আমি। এ কী করে সম্ভব! তার ওপর কোনও মেয়ে কখনও পোয়াতীও হত না! আশ্চর্য!

লোকমুখে পরে শুনেছি, মনীন্দ্র খুন হওয়ার পেছনে মেয়েমানুষ কেলেঙ্কারি ছিল। পাশের বাড়ির সব শেষ মেয়েটির আর বিয়ে হচ্ছিল না। মুসল্লী ঘরের মেয়ে, পাঁচওয়াক্ত নামাজ কালাম হয় যে বাড়িতে, সে বাড়ির মেয়ে কতকাল আবিয়াত থাকবে? বুড়ো মৌলভী বাবা জানপ্রাণ দিয়ে পাত্র দেখছিলেন। দুএকজন পাচ্ছিলেনও। কিন্তু কেমন করে যেন ভেঙে যাচ্ছিল সব বিয়ে। মেয়েটি যে দেখতে খারাপ তাও নয়। চলনসই। চিঠিপত্র লিখতে পারে, কোরান শরীফ পড়তে পারে, জাতবংশ ভাল, সচ্ছল গেরস্থ ঘর, তবু বিয়ে হচ্ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছিল এতে মনীন্দ্রের হাত আছে। বাড়ির শেষ মেয়ে চলে গেলে মনীন্দ্রর উপায় হবে কী? এসব ভেবে বিয়ে বেঁধে রেখেছিল মনীন্দ্র।

ওদিকে বিয়ে হচ্ছিল না বলে মেয়েটির যে কোনও দুঃখ আছে তা নয়। সে বেশ হাসিখুশি থাকে সারাক্ষণ। ছুটোছুটি করে, অকারণে হাসে, আমোদ করে। মা বাবা মেয়ের এ অবস্থা দেখে ভাবনায় থই পায় না। অবশ্য এ বাড়ির প্রতিটি মেয়ের সঙ্গেই যে মনীন্দ্রর ভাবসাব, কথাটা সবাই জানে। গ্রামের লোকজনও।

তো সেই মেয়েটি নাকি রোজই মাঝরাতে মনীন্দ্রের জঙ্গুলে বাড়িতে চলে যেত। সারারাত বুড়োভাম মনীন্দ্রর সঙ্গে কাটিয়ে বিয়ানরাতে বাড়ি ফিরত।

দিন যাচ্ছিল এই ভাবে। কিছুকাল পর কেমন করে যেন বিয়ে ঠিক হয়ে যায় মেয়েটির! দামলার ওদিকে। দিনক্ষণ দেখে বিয়েও হয়। কিন্তু মেয়েটির স্বামী কালক্রমে ব্যাপারটি টের পেয়ে যায়। পাজিপাজরা মানুষ। এককালে ডাকাতের সর্দার ছিল। সেই বোধহয় এক নিঝুম বর্ষার রাতে দলবল নিয়ে এসে মনীন্দ্রকে খুন করে যায়।

ত্রাসটা শুরু হয় তারপর থেকে। কোনও কোনও মুসলমান অকারণেই হিন্দুদেরকে বকাঝকা করে, লুঠতরাজ করে। মাওয়ার ওদিকে, মুচিপাড়ায় নারীধর্ষণও হয় কয়েকবার।

 ডাক্তারবাবুরই বা দোষ কী? পরিচিত মানুষজন সব পাল্টে গেলে সেখানে কি আর কেউ থাকতে পারে! জানের মায়া বড় মায়া।

ডাক্তারবাবু চলে গেলেন। এক বিষণ্ণ সন্ধ্যায় মাওয়ার ঘাটে বাবুকে লঞ্চে চড়িয়ে দিলাম। গোয়ালন্দ হয়ে কলকাতা চলে যাবেন।

তারপর থেকে আমি একা। একটা জীবন কাটল এই মানুষটার সঙ্গে। জাতে বামুন। আমরাও। আমার বাবা বাবুদের বাড়ির ঠাকুর ছিল। বুড়ো চক্রবর্তী মহাশয় মারা যাওয়ার পর, আমার বাবা মারা যাওয়ার পর, সেই ঠাকুরগিরি চলে এল আমার হাতে। বাবু তখন ডাক্তারখানা খুলে পুরোদস্তুর ডাক্তার। বিয়ে থা করে নিয়েছেন। বৌদি কামারখাড়ার মুখার্জী বাড়ির মেয়ে। রোদে দাঁড়ালে মোমের মতন গলে যান এইরকম নরম, সুন্দর দেখতে।

আমার ঘরেও কমল চলে এসেছে ততদিন। বাবু বললেন, উমা তুই আমার কম্পাউন্ডারি কর। বাড়ির রান্নাবান্না করবে কমল।

আমি রাজি হয়ে গেলাম। লেখাপড়া শিখেছিলাম ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। বাবু বললেন, তুই পারবি। এইভাবে দিন গেল। বাবুর ছেলেপুলের যখন যুবক বয়েস, তখন সারা দেশে বেনিয়া তাড়ানোর হিড়িক। বেনিয়ার বাচ্চারা একদিন পাততাড়ি গোটাল।

পার্টিশানের বছর বৌদি তার ছোট মেয়েটিকে সঙ্গে করে কলকাতা চলে গেলেন। বড়গুলো তো আগে থেকেই কলকাতায়। কিন্তু ডাক্তারবাবু গেলেন না। জমিজিরাত, বাড়িঘর এসবের বন্দোবস্ত করে আসছেন, কথা রইল।

কিন্তু আর যাওয়া হল না বাবুর। আজ যাচ্ছি কাল যাচ্ছি করে ষোল সতেরটা বছর কাটিয়ে দিলেন।

কিন্তু মানুষটা বড় গোছান স্বভাবের ছিলেন। আর কী ধীর স্থির! ভেতরে ভেতরে জমিজিরাত সব বিক্রি করে ফেললেন। বাড়িটাও। দাম পেলেন ভালো। ডামাডোলের মধ্যে বিক্রি করলে তো কিছুই পেতেন না! তবে টাকা-পয়সা সব পাঠিয়ে দিলেন কলকাতায়। এখানে রাখলেন না। সেই টাকায় তিনমহলা বাড়ি হল কলকাতায়। বৌদির ভাইয়েরা সব ব্যবস্থা করলেন। তারা কলকতার জাদরেল লোক।

এসব দেখে আমার মনে হয়েছে, ডাক্তারবাবুও বোধহয় ভেতরে ভেতরে ঠিক করে রেখেছেন একদিন তিনিও চলে যাবেন। কিংবা দূরদর্শী লোক তো, জেনে গিয়েছেলেন এদেশ একদিন ছাড়তে হবে।

 আবার ভাবি, তাহলে অতগুলো বছরই বা কাটালেন কেন এখানে! অনেক আগেই তো চলে যেতে পারতেন! যাওয়ার সময় অত কান্নাকাটিই বা করলেন কেন!

বুঝি না। মাথার ভেতরে অন্ধকার ঢুকে যায়। মানুষের মন, ভগবানও তার থই পান না। আমার বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কমললতার কথা মনে হয়। কালরাতে কমলকে স্বপ্ন দেখলাম, কতদিন পর! বৃষ্টি জলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছিল, কমল বাইরে থেকে টেনে দরজাটা বন্ধ করতে চাইছিল। কী মানে এসবের!

তারপর রাত থাকতেই ওঠে পরেছি। ঘরের ভেতরে তখন জমে আছে পাতলা অন্ধকার। দরজা জানালা খুলে দেয়ার পরও সেই অন্ধকার কাটে না। বাইরে ভাতের ফ্যানের মতো আলো ফুটছে। এসব আমি স্পষ্ট দেখতে পাই না। তবে আলো আঁধারের পার্থক্যটা বুঝতে পারি।

দরজা খুলতেই মিহি একটা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। উদোম গায়ে শোয়ার অভ্যেস আমার। বাতাসে ক্ষীণ একটু শীতলতা ছিল। শরীর কেঁপে ওঠে, রোম দাঁড়িয়ে যায়। ফারুন শেষ হয়ে এল। এখনও শীতের টানটা রয়ে গেছে। আমি ওষুধ-আলমারির আড়াল থেকে ঝাড়ু বের করে ঘর ঝাঁট দিই। এমন কোনও ময়লা পড়ে না, তবু দিই। অভ্যেস। চিরকাল দিয়ে আসছি। ডাক্তারবাবু শিখিয়েছেলেন নোংরা থেকে মানুষের সব অসুখবিসুখের জন্ম।

ঘর ঝাট দিতে দিতে মনে হয় দূর দিয়ে কেউ যেন হেঁটে যায়। স্পষ্ট দেখতে পাই না, বুঝতে পরি, কোনও মানুষ। হয়তো রুহিতনের ঘরে রাত কাটিয়ে লোকজন জেগে ওঠার আগেই সরে পড়ছে।

আমি চোখ তুলে মানুষটাকে চেনার চেষ্ট করি। পারি না। বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। চোখ দুটো একেবারেই গেছে।

তারপর সারাঘরে গঙ্গাজল ছিটাতে ছিটাতে মনে হয় এসময় তো কাকপক্ষি ডাকার কথা! ডাক বোধহয়। আমি শুনতে পাই না। বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। দিন ফুরিয়ে এল। কবে যে ডাক পড়বে!

সকালের দিকে দুএকজন বাঁধা রোগী আসে। বয়সী মানুষ সব। ওষুধপত্র নেয় আনা দুআনার। মাথা ধরার বড়ি, পেট ব্যথার বড়ি, এইসব। তাছাড়া দোকানে ওষুধপত্র বলতে গেলে নেই। খালি হয়ে গেছে। তবু রোগী আসে। আড্ডা দিতেই আসে। গল্পগাছা করে চলে যায়। নিয়মিত। মাঝেমধ্যে খুবই বিরক্ত হই। মানুষগুলো গল্প করে তো করেই যায়, ওঠতে চায় না। বেলা বাড়ে। তবু রাগ করতে পারি না। ডাক্তারবাবু বলতেন, রোগী হচ্ছে দেবতা। খারাপ ব্যবহার করিস না।

কথাটা মনের ভেতরে বাঁধা। সয়ে যাই।

সকালবেলা নুন চা খাওয়ার অভ্যেস আমার। বাবুরও ছিল। দার্জিলিং থেকে খাঁটি চা পাতা আসত। গরম জলে কয়েক রোয়া নুন মিশিয়ে, কটা পাতা মিশিয়ে গেলাস ভরে সেই চা খেতেন বাবু। পরে আমারও অভ্যেস হয়ে যায়।

রোগীরা সব ভাঙা বেঞ্চিতে বসে গল্প করতে শুরু করে আর আমি কেরোসিনের চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে আসি। বাড়তি থাকলে দুএকজনকে খাইয়েও দিই।

বেলা বাড়ার পর, রোগীরা চলে যাওয়ার পর, ভাত চড়িয়ে চান করতে যাই। এসে সালুন। রান্না। একটু ভাজি, একআধটু ভর্তা, এই তো খাওয়া। দিন আর যেতে চায় না। রোগীও আসে কম। ডাক্তারবাবু নেই, আমার কাছে আসবে কী! ওষুধও তো শেষ। হয়ে এল। বাবু চলে যাওয়ার পর আমি আর মাল তুলিনি ঘরে। ওষুধের আলমারি দুটো দিনকে দিন খালি হয়ে যাচ্ছে। মাল তুলে কী হবে! কদিন পর চলেই তো যাব। বাবুই বলে দিয়ে গেছেন এসব। মাল যা আছে বেইচ্চা শেষ কর। ফাঁক বুইজ্জা সামানপত্র বেচবি, তারপর সোজা কইলকাত্তা। বড় রকমের কোনও ঝুঁকি নিবি না।

আমিও সেই মতো কাজ করেছি। এখন দোকান খালি। হাতে পয়সাও জমেছে বেশ। তবু কী যেন বাকি থেকে যাচ্ছে।

কাল রাতে কমলকে স্বপ্ন দেখার পর থেকে মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। ডাক্তার বাবুর কথা বারবার মনে হয়েছে। কমল মারা যাওয়ার পর তিনিই তো আমার একমাত্র আপনজন ছিলেন।

সকালবেলা ওঠে ঘর ঝাঁট দিয়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে শেষ করতে করতে একটু বেলা হয়ে গেছে। বাবুয়ার চায়ের দোকানে একজন দুজন খদ্দের লাগতে শুরু করেছে তখন। মতলেব রমেশরাও বোধহয় দোকান খুলে বসেছে। মাছও বোধহয় আসতে শুরু করেছে বাজারে। আনাজপাতিও। বাজারটা এবার জমবে। অনেকদিন পর নিত্যকার এই জীবন। সকাল থেকেই আমার আজ খারাপ লাগতে শুরু করে। ডাক্তারবাবুর হাতাওয়ালা চেয়ারটা মুছে রাখতে রাখতে কেন যেন জলে চোখ ভরে আসে! যেন বা ডাক্তারবাবুকেই ছুঁয়ে দিলাম এরকম মনে হয়।

বাবু চলে যাওয়ার পর চেয়ারটা আমার হয়ে গেছে। কিন্তু আমি ভুলেও কখন বসিনি। বাবু চলে গেছেন কথাটা বারবার ভুলে যাই। কখনও আনমনে খালি চেয়ারটার দিকে। তাকালে মনে হয় ডাক্তারবাবু বুঝি কলে গেছেন। এক্ষুনি ফিরে এসে চেয়ারটায় বসবেন। গলা খাকারি দিয়ে, কপালের ঘাম আঙুলে মুছে বলবেন, উমা জল খাওয়া রে! মানুষ চলে যায়, রেখে যায় হরেক রকমের চিহ্ন। সারাটা ঘর জুড়ে বাবুর কত রকমের যে চিহ্ন ছড়ান! বিছানাপত্র, কাঁসার থালা গ্লাস, বইলাঅলা খড়ম, একখানা ছেঁড়া পানজাবি, খান দুয়েক মিহি শান্তিপুরি ধুতি। এইসব দেখে আমার বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে।

কেরোসিনের চুলোয় চায়ের জল চাপিয়ে বসে থাকি। ওঠে আলমারির সামনের দিকটায় গিয়ে বসব ইচ্ছে করে না। চায়ের জল বলকায়, আমি উদাস চোখে পেছনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। চোখে ভালো দেখতে পাই না, তবু বাইরে যে রোদ উঠেছে বুঝতে পারি। পায়ের কাছে তুরতুর করে কী! বাইত্তা? ম্যালা ইঁদুর বাইত্তা হয়েছে ঘরটায়। চোখে ভালো দেখতে পাই না, কানেও হালকা শব্দটব্দ ঢোকে না, তবু মনে হয়। ঘরের ভেতর অবিরাম খুঁটখাট শব্দ হচ্ছে। ইঁদুরে সব কেটেকুটে বিনাশ করছে। পুবদিকের পাটাতনে বুঝি উঁই ধরেছে। দেখতে কী পাই! কাল সন্ধ্যায় গায়ে পিরপির করেছিল অসংখ্য পোকা। বুঝতে পেরেছি উঁই! ঘরের ভেতর সংগোপনে চলছে ক্ষয়কৰ্ম। কানে শুনতে পাই না, দেখতে পাই না চোখে, তবু একাগ্রতায় থাকলে মাথার ভেতর মিহিন একটা ক্ষয়ের শব্দ ধরা পড়ে।

গ্লাসে চা ঢেলে নিয়েছি, তখন বাইরে থেকে কে একজন ডাকল, ঘরে আছেননি? কর্তা? চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, কেডা?

আমি ছিরিপদ।

আস।

 শ্রীপদ ঘরে ঢোকে। তার পদভারে। পাটাতন ঘরের শিরায় মুদু একটা কাঁপন লাগে। শব্দটব্দ হয় বোধহয়। শুনতে পাই না। ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে সব।

চা শেষ করে সামনের ঘরে আসি। খবর কি ছিরিপদ?

শ্রীপদ বসেছিল বেঞ্চে। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ফিসফিসে গলায় বলল, খবর হুনছেন নি কত্তা? রায়ট লাগবো বলে?

শুনে আপাদমস্তক কেঁপে উঠি। খানিক কিছু বুঝতে পারি না। বুকের ভেতর কেমন একটা কাঁপন লেগে থাকে। ঢোক গিলে বলি, কই হুনলা?

রতনা গোয়াইলা কইলো। ঢাকা গেছিলো দুদ সাপলাই দিতে। হুইনা আইছে।

বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে আমার। ভগবান জানে কী হইবো! সাবধানে থাইকো ছিরিপদ।

 হ। ডরডা তো আমাগঐ। আপনের কী কত্তা! আপনে কইলকাত্তা যানগা। আমাগ নাইলে যাওনের জাগা নাই, আপনের তো আছে! যান গা।

একথার পর কী বলব! আনমনে বাইরে তাকিয়ে থাকি। বুকটা কাঁপে। শেষ বয়সে মানুষের হাতে মরব! ভগবান, কী যে শুরু হল দেশে!

দুপুরবেলা খালে স্নান করতে গিয়ে বনগোটা গাছের তলায় বাতাসে কী একটা উড়তে দেখি। লম্বা দড়ির মতো, শাদা। বাতাসে একবার এদিক যায়, একবার ওদিক। ছোটখাটো জিনিস হলে চোখে পড়ত না। অনেকক্ষণ খেয়াল করে বুঝতে পারি, সাপের খোলস। বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। এসবই অশুভ চিহ্ন। মন খারাপ হয়ে যায়। কাছে কোথাও একটা সাপ আছে। শীতকাল চলে গেল, এখন গর্ত থেকে বেরুবে। আর যে রকম জঙ্গুলে জায়গা, সাপ তো থাকবেই!

 ভয়ে ভয়ে স্নান সেরে আসি।

খালে জল কমে গেছে। কোমর সমানও হয় না। ফাগুন মাসেই খরা শুরু হয়েছে এবার। ধানিমাঠ বুঝি শুকিয়ে ফুটিফাটা। খালে পাম্পমেশিন লাগিয়েছে লোকে, দোন। লাগিয়েছে। সব জল এখন ওঠে যাচ্ছে বোরোধানের মাঠে। কষ্টে কষ্টে স্নান করতে হয়। উঠে কাপড় ছাড়তে ছাড়তে ঘোলা চোখে চারদিকটা দেখি। বাঁদিকে ভাঙা দরদালান আছে। গাছপালার চাপে চোখে পড়ে না কিংবা আমি দেখতেই পাই না। ওই দরদালানেই নাকি ঘর বেঁধেছে রুহিতন। মেয়েটার কথা ভেবে আর একবার বুকের অনেক ভেতরে মৃদু কাঁপন টের পাই। সাপখোপের ভয় নেই রুহিতনের!

স্নান সেরে ফিরে আসতে আসতে আর একবার সাপের খোলসটা দেখ। বনগোটা গারছের তলায় উদাস হয়ে পড়ে আছে। এখন একটু একটু বাতাসও আছে। ভেজা। শরীরে টের পাই দখিন থেকে বইছে। বাতাসে খোলসটা নড়াচড়া করে, ফরফর শব্দ করে। স্পষ্ট দেখতে পাই না, শুনতে পাই না। আমার বুঝি দিন ফুরিয়ে এল। গুছিয়ে গাছিয়ে কর্তার কাছে চলে যাওয়া বুঝি আর হল না।

খেতে বসে ডাক্তারবাবুর কথা মনে হয়। কলকাতায় এখন বেদম সুখে আছেন মানুষটা। চিঠিপত্রও লেখেন না আজকাল। প্রথম প্রথম লিখতেন। কত কথা যে লিখতেন! দিনে দিনে সিই চিঠি কমে এখন প্রায় বন্ধের মুখে। আগে বাবুর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম। সেই অপেক্ষা শষ হয়ে গেছে। আজকাল মনে হয়, ডাক্তারবাবুর পুরো ব্যাপারটাই ছিল লোক দেখানো। ছেলেদের চিঠি পেয়ে গালাগাল দেয়া, দেশ ছাড়ার কথা উঠলে রেগে যাওয়া, এমনকি চলে যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে মেয়েমানুষের মতো কান্না, সবই। এখন মনে হয় মানুষটা বোধহয় জেনে গিয়েছিলেন এদেশে থাকা যাবে না, কিংবা এটা পরদেশ। কষ্টেসিষ্টে চেপে থেকে যা-কিছু হাতিয়ে নেওয়া যায় তাই লাভ।

তবু দোকানটার কোনও বিধিব্যবস্থা করে যেতে পারেননি। পারলে বুঝি বেচে দিয়ে যেতেন। না পেরে আমার জন্য রেখে গেলেন। কিন্তু মানুষটা বোধহয় জানতেন আমি সারা জীবনেও দোকানটার কোনও ব্যবস্থা করতে পারব না। গুছিয়ে গাছিয়ে চলে যাওয়া কোনও দিনও হবে না আমার। ডাক্তার মানুষ তো, শেষ জীবনে বুঝি শরীরের রোগের সঙ্গে সঙ্গে মনুষের মনের রোগ, সরলতা জটিলতাও ধরতে শিখে গিয়েছিলেন। এসব ভাবলে জলে চোখ ভরে আসে আমার। সংসারে কেউ কারও নায়। মানুষ আসলে একা।

.

ছেলেবেলায় এক উদাস বাউল একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে যেত, গাওয়ালেতে আইলারে মন। গানটার সঠিক অর্থ সেই বয়সে বুঝতে পারত না উমাচরণ। এই শেষ বয়েসে আজকাল একাকী নির্জনে মাঝেমধ্যে সুদূর শৈশবের সেই বাউল তার বিষণ্ণ একতারা বাজিয়ে মাথার ভেতরে গান গেয়ে যায়। গাওয়ালেতে আইলারে মন।

এখন গানের অর্থটা একটু একটু বুঝতে পারে উমাচরণ। পৃথিবীতে বাণিজ্য করতেই তো আসে মানুষ। বাণিজ্য শেষ হলে যে অচিনদেশ থেকে আসে আবার সেই অচিনদেশেই ফিরে যায়। মাঝখানে পড়ে থাকে অদ্ভুত এক মায়া। সেই মায়ার নাম জীবন।

বয়স হয়ে গেলে কি মৃত্যু ছায়ার মতো অনুসরণ করে মানুষকে! আজকাল এসব মনে হয় উমাচরণের। কাল রাতে কমলকে স্বপ্নে দেখার পর থেকে বারবারই মনে হচ্ছে, গাওয়াল বুঝি শেষ হয়ে এল তার। এবার ফিরতে হবে।

উমাচরণের ভালো লাগে না কিছু। দরজার সামনে জলচৌকিতে বসে নারকেলের হুঁকায় গুরুক গুরুক করে তামাক টানে। বাইরে রোদের দুপুর ফুরিয়ে গেছে। বাজারে। লোকজনের সাড়াশব্দ কম। দখিনা হাওয়া বইছে। এই সময় মন উদাস হয়ে যায় কেন উমাচরণের!

তখুনি এল রুহিতন। বাবাজী।

উমাচরণ নড়েচড়ে ওঠল। তামাক টানা বন্ধ করে বলল, কেডারে, রুহি?

হ।

উমাচরণ ঘোলা চোখে রুহিতনকে চেনার চেষ্টা করে। ভগবান, চক্ষু দুইডায় যে কী হইল, মানুষজনও চিনতে পানি না।

রুহিতন কথা বলল না। উমাচরণের পাশে পাটাতনের ওপর বসে পড়ল। তারপর আঁচলে আঙুলে জড়াতে জড়াতে বলল, হেয় আমারে লইয়া যাইতে চায়।

 কে?

জোকার মানুষটা।

কই লইয় যাইতে চায়?

হেয় যেহেনে যাইবো। কয় আমারে ঘর দিবো।

রুহিতনের কথা শুনে উমাচরণ একটু চুপ করে রইল। তারপর হুঁকা নামিয়ে রেখে বলল, তুই কি কচ, যাবিনি?

হেইডা জিগাইতেই তো আপনের কাছে আইলাম।

উমাচরণের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। রুহিতনের জন্য অদ্ভুত এক টান আছে তার। মেয়েটি বোকা। ভালোমন্দ অনেক কিছুই বোঝে না। বোঝে কেবল খাওয়াটা আর শোয়াটা। এই খাওয়া শোয়া বুঝতে গিয়েই বেশ্যা হয়ে গেল।

উমাচরণের সব মনে আছে।

রুহিতনের তখন দশ এগার বছর বয়েস। কোত্থেকে যে কাজিরপাগলা বাজারে এসে জুটল কে জানে! গায়ে ছেঁড়াখোঁড়া ন্যাকরা জড়ান, দুর্গন্ধ ময়লা, এটোকাটা খায়। রাতেরবেলা বাজারের গলিঘুচিতে পড়ে থাকে। উমাচরণের তখন মধ্য বয়স। ডাক্তার বাবুর মাথায় সাদা টাক মাত্র পড়তে শুরু করেছে।

রুহিতন সারা বাজর ঘুরে বেড়ায়, উমাচরণ দেখে। এঁটোকাটা খায়, দেখে। সময়ে একআধটা পয়সাও দিয়েছে সে। বাসিপচা খাবারও দিয়েছে। মেয়েটির চেহারায় কী যেন একটা ছিল। উমাচরণ খেয়াল করে দেখেছে, বড় সরলতা মাখা মুখ। বোকাসোকা। ড্যাবড্যাবা চোখে তাকালে মায়া হয়।

একদিন খুব সকাল সকাল ঘুম ভেঙেছে উমাচরণের। তখন কানে ভাল শুনতে পায় সে, চোখও চলে টর্চ লাইটের মতো। ঘুমের ভেতর উমাচরণের মনে হয়েছিল ছাইছে ঘিরের পেছনে বসে কে যেন গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে। প্রথমে উমাচরণ ভেবেছে কানের ভুল কিংবা স্বপ্নের ভেতর হচ্ছে শব্দটা। পরে স্পষ্ট হয়েছে। উমাচরণ বাইরে এসে দেখে ঘরের পিছনে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে রুহিতন। সারারাত ঘুমোয়নি বোঝা যায়। চোখমুখ বসা। হাঁটুতে মাথা গুঁজে মিহি সুরে কাঁদছে।

 উমাচরণ কাছে গিয়ে এক ধমক লাগিয়েছে, এই ছেমরি কান্দস ক্যা?

 রুহিতন কথা বলে না, কাঁদে। কেঁদেই চলে।

উমাচরণ তারপর আর রেগে গেছে। ঘরের ভেতর ডাক্তারবাবু ঘুমোচ্ছেন। জেগে গেলে রাগ করবেন।

উমাচরণ মেয়েটির হাত ধরে টেনে তুলেছে। আঐলে [ আড়ালে ] যা। বাবু জাগলে মুক্তি [ এক ধরনের কিল ] দেবে।

.

কিন্তু মেয়েটিকে টেনে তুলেই অবাক হয়েছে উমাচরণ। নিম্নাঙ্গে চাপ চাপ রক্ত শুকিয়ে আছে। দুএক ফোঁটা তাজা রক্তও দেখতে পায় উমাচরণ। প্রথমে ভাবে মেয়েটি বুঝি ঋতুমতি হয়েছে।

 কিন্তু ওসব হলে কান্নার কী আছে!

চকিতে অন্য একটা ব্যাপার তারপর মনে হয়েছে উমাচরণের। মনে হয়ে শিউরে উঠেছে সে। নিচু গলায় রুহিতনকে তারপর জিজ্ঞেস করেছে, কী হইছে ক আমারে? সহজে কথা বলেনি রুহিতন। উমাচরণ জোরাজুরি করায় অনেকক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, রাইতে কেডা জানি আমারে….।

বাকি কথা উমাচরণ বুঝে নিয়েছিল। বুঝে ঘৃণায় দুঃখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর গোপনে চিকিৎসা করে সারিয়ে তুলেছিল রুহিতনকে।

কিন্তু সারিয়ে তুলেই বা কী হবে। রুহিতন ততদিনে নিজের শরীর চিনে গেছে। তার ওপর বাজারের দামড়াগুলো আধলিটা সিকিটা ধরিয়ে দেয়।

রুহিতন বেশ্যা হয়ে গেল।

ওদিকে উমাচরণের বড় মায়া পড়ে গেল মেয়েটির ওপর। সময়ে অসময়ে রুহিতন তারপর থেকে উমাচরণের কাছে আসে। বাবাজী বলে ডাকে। আর ঐ ডাকে কিযে মায়া, উমাচরণ মেয়েটিকে নিজের বাইরে ভাবতে পারে না। হোক না বেশ্যা, মানুষতো!

তার আর কমলের মেয়েটি বেঁচে থাকলে তো রুহিতনের বয়সীই হত!

আবার কমললতার কথা মনে হয় উমাচরণের। মেয়েটির কথা মনে হয়।

উমাচরণ আনমনা হয়ে গেছে দেখে রুহিতন ডাকে, বাবাজী।

উমাচরণ চমকে ওঠে। নারকেলের কাটা শব্দ করে গড়িয়ে পড়তে চায়। রুহিতন খপ করে ধরে ফেলে। তারপর কাটা হাতে নিয়ে যেন নিজের ঘর এরকম অবলীলায় উমাচরণে ঘরের ভেতরে চলে যায়। সযত্নে জায়গামতো রেখে ফিরে আসে।

রুহিতন এসে আগের জায়গায় বসার পর উমাচরণ একটু গলা খাঁকারি দেয়। তারপর বলে, মাইনষেরে অত একিন [ বিশ্বাস করুন ভালো না রুহি। এহেনে আছচ দশজনে। তরে চিনে, কিছু হইলে হগলেই দেখব। পরদেশে নিয়া মানুষটা যুদি তরে হালাইয়া দেয়, তখন কী করবি! দেখব কেডা তরে!

 রুহিতন কথা বলে না। উমাচরণ খুব জোরে জোরে কথা বলছে দেখে একটু হাসে। রুহিতনের সেই হাসি উমাচরণ খেয়াল করে না। বলে, মহারাজা তো মানুষ খারাপ না। বাইরে থিকা তো ভালই দেখা যায়। তয় কওন যায় না কার ভিতরে কী আছে।

আবার একটু থামে উমাচরণ। তারপর বলে, তুইই বুইজ্জা দেক রুহি। যা ভাল মনে হয় কর।

রুহিতন তবু কথা বলে না। খানিক বসে থাকে তারপর ওঠে চলে যায়। ছানিপড়া চোখে উমাচরণ দেখে স্বপ্নের মতন কুয়াশার ভেতর রুহিতনের ছায়া মিলিয়ে যাচ্ছে। দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে উমাচরণের।

রুহিতনও এখান থেকে চলে যেতে চায়! মহারাজার সঙ্গে! মহারাজা সার্কাসের জোকার। কেমন মানুষ কে জানে। একদিন উমাচরণ জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি হিন্দু না মুসলমান? মহারাজা বলেছে, জানি না।

মা বাপের বুঝি ঠিক নেই। রুহিতনেরও তাই। দুজনে মিলত ভালই, কিন্তু সব জেনেশুনে একটি বেশ্যা মেয়েকে যে বিয়ে করতে চায়, তার ভেতর নিশ্চয়ই কোনও চালাকি আছে। বিদেশ বিভুয়ে নিয়ে ব্যবসা করাবে মেয়েটিকে দিয়ে। তারপর বয়েস হয়ে গেলে, মূল্যহীন হয়ে গেলে, খেদিয়ে দেবে।

এসব ভেবে কষ্ট হয় উমাচরণের। রুহিতন তার চোখর ওপর বড় হল। বেশ্যাগিরি করে বেঁচেবর্তে আছে ভালো মতোই। দেশ গেরামের ব্যাপার, এভাবেই চলে যেতে পারবে। কষ্ট হবে না। ভগবান বড় সদয় রুহিতনের ওপর। পেটটা বাঁজা করে দিয়েছে। বেঁচে থাকতে ঝামেলা নেই রুহিতনের।

রুহিতনকে দুতিনবার বাজার থেকে তাড়িয়ে দেবার চেষ্টা হয়েছে। গ্রামের মাথা মাথা লোকগুলোও ওঠে পড়ে লেগেছিল মেয়েটির পেছনে। ওঠতি বয়েসী পোলাপান সব নাকি খারাপ হয়ে যাচ্ছে রুহিতনের জন্য। উমাচরণ প্রায় হাতে পায়ে ধরে ঠেকিয়েছিল লোকগুলোকে। তখন রুহিতনকে দেখলেই তার নিজের মেয়ে গৌরীর কথা মনে পড়ত। কিন্তু রুহিতনটা বোকার হদ্দ। নইলে এতদিনে বিস্তর পয়সা করতে পারত। ভদ্রানতিও আছে ছেমড়ির! হাতে পয়সা থাকলে লাখ টাকায়ও খদ্দের নেবে না ঘরে।

কথাটা ভেবে হেসে ফেলে উমাচরণ। ঈশ্বরের পৃথিবীতে কত কিসিমের মানুষ যে আছে! ছেলেবেলায় দেখ একটা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে উমাচরণের। তার বাবা প্রথম জীবনে। বাড়ি থেকে পালিয়ে জাহাজে চাকরি নিয়েছিল। খালাসির চাকরি। তখন বৃটিশদের। রাজত্ব। তাদেরই জাহাজ। নামটা আজও স্পষ্ট মনে আছে উমাচরণ্রর। জনার্দন। উমাচরণ ছেলেবেলায় সেই জাহাজের গল্প শুনত বাবার কাছে। কত দ্বীপ দ্বীপান্তরে ঘুরেছে বাবা তার গল্প। সেই গল্প শুনতে শুনতে উমাচরণ রোজ রাতেই দ্বীপ দ্বীপান্তরের স্বপ্ন দেখত তখন। কখনও দেখত একটা অতিকায় জাহাজ আর ধু ধু নীল সমুদ্র। অগাধ জলরাশি বুকে ধরে পড়ে আছে সমুদ্র। দূরে আকশ নেমে এসেছে সমুদ্রে। জাহাজটা সেই আকাশসীমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

ছেলেবেলায় স্বপ্নটা শুধুমাত্র স্বপ্নই ছিল। কোনও অর্থ ছিল না স্বপ্নের। এই শেষ বয়েসে এখন সেই স্বপ্নটির কথা মনে হলে কখনও কখনও ভীষণভাবে চমকে ওঠে উমাচরণ। স্বপ্নটা বড় অর্থময় হয়ে যায় আজকাল। মনে হয় মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে কোথায় যেন স্বপ্নটার বড় মিল!

 সন্ধ্যের দিকে বাজারটা আবার জমে ওঠে। সার্কাস পার্টিটার জন্যে। পার্টিটা চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। উমাচরণ শুনেছে দুচার দিনের মধ্যেই ওঠে যাবে। এজন্যে ভিড়ভাট্টা একটু বেশি। সন্ধ্যেবেলা হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে বটতলা। মাইকে গান বাজনা হয়, কখনও মোটা গলায় হয় ঘোষণা। ঘরে বসে বয়রা হয়ে আসছে। এই রকম কানে সেই বিশাল শব্দকে ক্ষীণ করে শোনে উমাচরণ। তার ভাল্লাগে না। একাকী বিড়বিড় করে মানুষটা। কী যে বলে নিজেই শুনতে পায় না। তবু বলে। বয়েস হয়ে গেলে কত রকমের উপসর্গ যে দেখা দেয় মানুষের!

 ঘরের ছাইছে একটা তুলসী গাছ আছে। সেখানে মাটির ধূপতিতে সন্ধ্যেবেলা ধূপ দেয় উমাচরণ। আর বিড়বিড় করে কমলকে ডাকে, কমল, কমললতা, আমার। আর ভাল্লাগে না গো। আমার আর বাঁইচা থাকতে ভাল্লাগে না। তুমি আমারে নিয়া যাও।

ঘরে এসেও সেই একই ব্যাপার। খালি গায়ে ঘনায়মান অন্ধকারে কিছুই ঠাওর পায় না উমাচরণ। খুঁজে পেতে কুপি জ্বালায়। গাছার [কুপিদানি] ওপর সেই ম্লান কুপি জ্বালিয়ে রেখে কষ্টেশিষ্টে হাত পা ধোয়। তারপর ক্লান্ত হয়ে চৌকির ওপর বসে থাকে।

এই চৌকিতে ডাক্তারবাবু শুতেন। এখন উমাচরণ শোয়। বাবুর এই একটা জিনিসই ব্যবহার করে সে। না করে উপায় নেই। পাটাতনে শুলে ফাঁকফোকর দিয়ে শীত ওঠে। বুড়ো শরীরে ঠান্ডা সহ্য হয় না। বুকে বসে যায়।

 কুপির আলোয় ঘরের ভেতর ভৌতিক ছায়া নড়াচড়া করে। বটতলায় লোকজনের হল্লা, মাইকে গানবাজনার শব্দ, উমাচরণের কানে যাবতীয় শব্দই ক্ষীণ হয়ে যায়। চৌকিতে বসে ডাক্তারবাবুর কথা ভাবে সে, কমললতার কথা ভাবে। তার একটা মেয়ে ছিল, গৌরী, চার বছর বয়সে পরীর মতন মেয়েটি বাবুদের দিঘিতে ডুবে মরল। সেই শোক সামলাতে না সামলাতে কমলও গেলে। আজ কত বছর উমাচরণ বড় একলা হয়ে আছে। উমাচরণের এখন কেউ নেই। এসব ভাবলে কান্না পায়। ছানিপড়া চোখে জল আসে। বেঁচে থাকতে ভাল্লাগে না।

তবু কী যেন এক আশায় আছে উমাচরণ। দোকানের সব ওষুধপত্র বিক্রি হয়ে গেছে। ছয়শো তিরিশ টাকা জমেছে হাতে। আর কিছু খুচরো। আলমারি দুটো আর অন্যান্য আসবাব ফাঁক বুঝে বেচে দিলেই খারিজ। একদিন ভোর ভোর মাওয়ার ঘাটে গিয়ে লঞ্চে চড়বে। তারপর কলকাতা।

তখন মন আবার আস্তেধীরে ভালো হয়ে যায় উমাচরণের। ছেলেবেলার সেই জাহাজের স্বপ্নটা দেখে জেগে জেগে। একটা অতিকায় জাহাজ আর নীল ধু ধু সমুদ্র। অগাধ জলরাশি বুকে ধরে পড়ে আছে। দূরে আকাশ এসে নেমেছে সমুদ্রে। সেই কেন্দ্রবিন্দুর দিকে নিঃশব্দে এগুচ্ছে জাহাজ।

তারপর সেই ভর সন্ধ্যেবেলাই উমাচরণ ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে দেয়। মানুষ আর মানুষ নেই। শুয়োর হয়ে গেছে সব। চোর হ্যাঁচরে ভরে গেছে দেশ। উমচরণ ভয়ে ভয়ে থাকে। দরজা-জানালা বন্ধ করে নিঃশব্দে চৌকির তলা থেকে টিনের বাক্সটা বের করে। কোমরের কাছে ধুতির ভেতর থেকে সুতোয় বাঁধা চাবি বের করে। বাক্সটা খোলে। তালা খুলতে একটু কষ্ট হয়, সময় লাগে। তবু বড় যত্নে তালাটা খোলে উমাচরণ। বাক্সের ভেতর থেকে আবদ্ধ বাতাস ন্যাপথলিনের গন্ধ নিয়ে লাফিয়ে ওঠে। ডাক্তারবাবুর কিছু পুরনো ধুতি পাঞ্জাবি ভঁই করে রাখা বাক্সে। এসবের তলা থেকে হাতড়ে হাতড়ে একটা ওষুধের কৌটো বের করে উমাচরণ। তারপর অকারণেই ঘরের ভেতরটা দেখে নেয়। চোখ চলে না, তবু দেখে। কাজটা যে সে করছে কেউ দেখছে। কিনা। পায়ের কাছ দিয়ে বাইত্তা দৌড়ে যায়। গলা চড়িয়ে ধুর ধুর করে উমাচরণ। পাটাতনে শব্দ করে। তারপর কৌটোটা খুলে জিভে আঙুল ভিজিয়ে অনেকক্ষণ ধরে টাকাটা গুণে দেখে। ঠিকঠাকই থাকে সব। তবু রোজ একবার করে গুণে দেখে উমাচরণ। কেন যেন মনে হয়, একদিন দেখবে বাক্সটার তালা ভাঙা, ভেতরের জিনিসপত্র ওলটপালট হয়ে আছে, টাকার কৌটোটা নেই।

উমাচরণ ভয়ে ভয়ে থাকে। কে জানে কখন কী অঘটন ঘটবে! কাল রাতে কমলকে স্বপ্নে দেখেছে। বৃষ্টির জলের ঝাপটায় ঘর ভিজে যাচ্ছে, বাইরে থেকে দরজাটা টেনে বন্ধ করতে চাইছে কমললতা, পারছে না। দুপুরবেলা খালপাড়ে স্নান করতে গিয়ে বনগোটাগাছের তলায় ছানিপরা চোখেও সাপের খোলস পড়ে থাকতে দেখল। হাওয়ায় এদিক ওদিক উড়ছে। এসবই অশুভ চিহ্ন। বড় ভয় করে উমাচরণের। অনুক্ষণ মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করে বিপদ তাড়ায় সে, আলায় বালায় [বিপদ আপদ] দূর হ, দূর হ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *