প্রস্তুতিপর্ব

প্রস্তুতিপর্ব

নদীর দিকে তাকিয়ে বাচ্চু খুব উদাস গলায় বলল, ইলশা মাছের জন্মবেত্তান্ত লইয়া কিছু কন নিতাই দাদা।

বুড়ো নেতাইচরণ ঠাকুরদার আমলের আলোয়ানখান অকারণে কাঁধের ওপর একটু জড়িয়ে বলল, বিড়ি ধরাও। বিড়ি না খাইলে কথা আহেনি।

বিড়ি আছে তিনখান। ইসাব কইরা না খাইলে টাইম যাইব কেমনে!

বুড়ো নেতাইচরণ ফোকলা মুখে একটু হাসে। পোকায় খাওয়া ভাঙাচোরা দাঁত নেতাইচরণের। জন্মের পর ভুলেও কখনও দাঁত মাজেনি। হলুদ ছোপ ধরা দাঁতে কথা বলতে শুরু করলেই নেতাইচরণের মুখ থেকে মানুষের বাহ্যির গন্ধ ভুরভুর করে বেরোয়। এই জন্যে বাচ্চুরা নেতাইচরণের গা বাঁচিয়ে বসে। মুখের সামনে ঘেঁষে না ভুলেও।

 মুখখান নেতাইচরণের, শালা আস্ত একখান খোলা পায়খানা। বাতাস দিলে গুয়ের গন্ধ ছোটে।

খোকা বলল, ইবার পদ্মায় ম্যালা ইলিশ পরছে। দেহচ না কত নাও।

 চারজন একসঙ্গে তারপর নদীর দিকে তাকায়। মাঝনদীতে পালতোলা জেলে নাও শয়ে শয়। হাওয়ার টানে ভাটির দিকে ছুটছে। দেখে বাচ্চু আবার বলল, নেতাই দাদা ইলশা মাছের জন্ম বেত্তান্তডা—

পুরনোকালের চোখ দুটো নদীর দিক থেকে ফিরিয়ে নেতাইচরণ ফোকলা মুখে আবার একটু হাসে। আলোয়ানখান কাঁধের ওপর আবার একটু জড়ায়। বিড়ি না অইলে, বুঝলা না!

দুলাল বলল, বাচ্চু বিড়ি বাইর কর।

দুলালের দিকে তাকিয়ে বাচ্চু একটুখানি চোখ টেপে। দেখে দুলাল বোঝে, বাচ্চু এখন বিড়ি বের করবে না। নেতাই দাদাকে অন্য কথায় ভুলাতে হবে।

দুলাল বলল, নেতাই দাদা আপনে সব সময় আলোয়ানখান পইরা থাকেন কেন?

শুনে নেতাইচরণ আবার হাসে। বড় মায়ায় আলোয়ানখান কাঁধে জড়ায়। আলোয়ানখানের বয়েস জানো?

তিনজন একসঙ্গে বলল, না।

সঙ্গে সঙ্গে নেতাইচরণের শাদাকালো দাড়ি গোঁফঅলা বিভৎস মুখটা গর্বে উজ্জ্বল হয়ে যায়। পাটের আঁশের মতো লম্বা চুল নদীর মগ্ন হাওয়ায় উড়ছে, চোখে স্বপ্নের ছোঁয়া। নেতাইচরণকে এখন বহুদূরের মানুষ মনে হয়। অচেনা। বাছুরা এটাই চাইছিল। এখন নেতাইচরণ সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন হয়ে যাবে। বিড়ির কথা ভুলে যাবে। তারপর শুরু করবে। আলোয়ানের গল্প। বহুবার শোনা গল্পটাই বাচ্চুরা এখন মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকবে। যেন জীবনে এই প্রথম শুনছে।

নেতাইচরণ বলল, আলোয়ানখানের বয়েস হইল সাড়ে পাঁচ কুড়ি। আমার ঠাকুরদাদারে দিছিল, ভাইগ্যকুলের কুণ্ডেগ নাম হুনছ? তিনজন একসঙ্গে বললো, হ।

নেতাইচরণ খুশি হয়ে বলল, বিক্রমপুরের বেবাক মাইনষে হেগো নাম জানে। না জাইন্নানি পারে, কও? হেরা আছিল বিক্রমপুরের সেরা ধনী। বাইশখান আছিল ইস্টিমার। ঢাকা থনে গোয়ালন্দ যাইত, গোয়ালন্দ থনে যাইত কইলকাত্তা। এই গাঙ দিয়া যাইত। বিয়ান রাইতে যাইত মিসটেইম আর দুইফরে মেইল।

খোকা বলল, মিসটেইম কি?

শুনে দুলাল ধমকে উঠে, ঐ বেডা এতো প্যাচাইল পারচ ক্যা?

নেতাইচরণ ফোকলা মুখে হাসে। বিয়ান রাইতে যেই ইস্টিমারখান যাইত হেইডারে কইত মিসটেইম। আর দুইফরে যাইত হেইডা অইল গিয়া মেইল।

খোকা বলল, বুজছি বুজছি। কন তারবাদে।

আহা হেইদিন আর নাই। দিগলী তহন বিরাট বন্দর। বিয়ান রাইতে মিসটেইম ফিরত। জাউল্লারা নাও বোঝাই ইলশামাচ উডাইত ইস্টিমারে। হেই মাচ যাইত গোয়ালন্দ কইলকাত্তা। আর এই মাওয়ার ঘাট দিয়া যাওনের সময় মিসটেইমখান কী সোন্দর একখান আওয়াজ দিত। ভোঁ ও ও ও

মুখখান চোক্কা করে হুবহু ইস্টিমারের সিটি বাজিয়ে দেয় নেতাইচরণ। শুনে বাচ্চুরা তিনজন হেসে ফেলে।

কিন্তু নেতাইচরণ ওসব খেয়াল করে না। অবাক হয়ে বলে, ছোডকালে তোমরা মেইল মিসটেইম দেহ নাই, আওয়াজ হোনো নাই। ঠিক এইরকম আওয়াজ করত।

বাচ্চু বলল, ছোডকালে তো পদ্মায় আমরা কুনও ইস্টিমার দেহি নাই। খালি লঞ্চ দেকছি।

 অহনও যেমন লঞ্চ আগে ঠিক অমনুনঐ আছিল। খালি এই জেটিখান আছিল না। গাঙের পার আছিল মাঝগাঙে। লঞ্চ আইসা চটান মাটিতে সিঁড়ি নামাইত।

দুলাল বলল, গাঙের ভাঙনে কলম আমাগো একটা উপকার অইছে।

খোকা বলল, কী?

এইডা বুজচ না! গাঙে না ভাঙলে গবম্যান্ট এই মাওয়ার ঘাটে জেটি দিতনি! জেটি না থাকলে আমরা বইতাম কই!

নেতাইচরণ মুগ্ধ গলায় বলল, এইডা হাচা কতা।

বাচ্চু বলল, এই হগল বাদ দেন। আলোয়ানের গল্পখান কন নেতাই দাদা।

হ হ। আমার ঠাকুরদাদায় আছিল কুণ্ডেগ বাড়ির বান্দা নাপিত। রোজ বিয়ানে যাইয়া বড় কত্তারে পেন্নাম করত। তারবাদে মুখ বানাইত, চারি কাইট্টা দিত। কত্তায় সাতদিনে একদিন চুল ছাটাইত। কইলকাত্তা চইলা যাওনের সময় কত্তায় খুশি অইয়া ঠাকুরদাদারে আমার এই আলোয়ানখান দিয়া গেল। এইডা কলম ইন্দুস্থান পাকিস্তান অওনের বহুত আগের ঘটনা। পাকিস্তান অইল আমার আমলে। আমার পিতামাতা বেবাক তহন সগগে। বলেই নেতাইচরণ বিনীত দুহাত নমস্কারের ভঙ্গিতে কপালে ঠেকাল। ব্যাপারটা। বাছুরা জানে। মা বাপের উদ্দেশ্যে কথা বললেই নেতাইচরণ এই ভাবটা করে। শ্রদ্ধা। খোকা বলল, আপনের আমলে তাইলে দুইবার দেশ সাদিন অইতে দেকলেন?

হ হ পাকিস্তান অইতে দেকলাম তারবাদে দেকলাম বাংলাদেশ অইতে। তয় হোনো আলোয়ানখান ঠাকুরদাদায় মইরা যাওনের সময় দিয়া গেল আমার বাপরে।

খোকা বাধা দিলে বলল, আপনের আর কুন কাকা জ্যাঠা আছিল না?

শুনে দুলাল ধমকে ওঠে, তুই বড় বাজে প্যাঁচাইল পারচ খোকা। দাদারে গল্পডা কইতে দে। নেতাইচরণ বলল, তুমরা তো কিছু জানো না। আমাগো বংশে কলম একটা কইরাঐ পোলা অয়। আমি আমার বাপের এক পোলা, বাপ আছিল ঠাকুরদাদার একপোলা, ঠাকুরদাদায় আছিল তার বাপের এক পোলা, এইভাবে চৌদ্দপুরুষ। খোকা বলল, আপনে বিয়া করলেও আপনের এক পোলা অইত?

হ। এর লেইগাইতো বিয়া করলাম না। এক পোলা থাকনের বিরাট দুঃখু জগতে। মা বাপ মইরা গেলে আপনজন থাকে না। ভাই বেরাদর হইল গিয়া মাইনষের জোরবল। জোরবল না থাকলে জগতে বাইচ্চা লাভ নাই। আমারে দেহ না জগতে আপন কেঐ নাই। এই দুঃখু তুমরা বুজবা না। আমার পোলা অইলে আমি মইরা যাওনের পর হেয়ও একলা অইয়া যাইত। একলা থাকনের দুঃখু বুজি দেইখাঐ তো বিয়া করি নাই।

দুলাল বললো, তয় আলোয়ানখান আপনের বাপে দিয়া গেল আপনেরে?

হ। আমারে ছাড়া আর কারে দিব!

খোকা বলল, আপনের অহন বয়েস কত নেতাই দাদা?

কথাটা শুনে বাচ্চু খর চোখে খোকার দিকে তাকায়। নেতাইচরণের পুরো গল্প ওদের জানা। তবুও পুরোনো প্যাচাল খোকা যে কেন তোলে!

নেতাইচরণ বলল, আমার বয়েস হইল গিয়া আড়াই কুড়ি।

এই বয়েসে আপনে বুড়া অইয়া গেলেন?

সব ভগমানের কিরপা। বুড়া অওনঐ ভালা। জুয়ান মদ্দ থাকনের ম্যালা জ্বালা।

দুলাল বলল, এই একখান কতার লাহান কথা কইছেন। আমাগো দেকলেন না! জুয়ান মদ্দ মানুষ দেইখাঐত এই হগল করতাছি। দেশ সাদিন করনের লেইগা পাকিস্তানী মেলেটারি খেদানোর লেইগা যুইদ্ধ করলাম। দেশ সাদিন করলাম। যুইদ্ধ খতম। আমরা বেবাকতে গেলাম আজাইর অইয়া। কামকাইজ নাই, টেকাপয়সা নাই। যুইদ্ধের সময় মাইনষে কী খাতির কুরত্ব। যেহেনে যাইতাম থাকন খাওন ফিরি, টেকাপয়সা নেও কত লাগব। এই মাওয়ার বাজারে আইলে দোকানদাররা বিড়িসিগ্রেটের প্যাকেট দিত, চা মিষ্টি খাওয়াইত। বেবাক মাগনা। মুক্তিবাহিনী কুনো কথা কইলে কুন হালায় রাও করে! আর অহন দেহেন যুইদ্ধ খতম, দেশ সাদিন অইল, আমাগো বাল দিয়াও পোছে না কেঐ। মা বাপে বকা দেয়, মাইনষে চোখ তারা কইরা চায়। কুনহানে আমাগো জাগা নাই। এর লেইগাঐ তো এই জেটিতে আইসা বইসা থাকি। খালি আপনে ছাড়া কেঐর লগে আমাগো খাতির নাই।

কথা শেষ করে দুলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

খোকা বাচ্চু দুজনেরই চেহারা এখন অন্যরকম। গম্ভীর। কেবল নেতাইচরণ ওদের দুঃখ কষ্টের ব্যাপারটা বোঝে না বলে গায়ের আলোয়ানখানার গর্বে বাপদাদার গর্বে হাসিখুশি মুখে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়ি খাওয়ার কথা একদম মনে নেই তার।

ঠিক এই সময় বাচ্চু গম্ভীর মুখে লুঙির কোড় থেকে বিড়ি বের করে একটা। তারপর ম্যাচ বের করে বিড়ি ধরায়। দেখে বুড়ো নেতাইচরণসহ বাকি দুজন বহুকালের অনাহারীর মতো হা করে বাচ্চুর বিড়িটার দিকে তাকায়। বাচ্চু ওসব খেয়াল করে না। বিড়ির ধোয়া নদীর হাওয়ায় ভাসতে থাকে।

খোকা বলল, দুইটান কইরা দেইস বাচ্চু।

বাচ্চু বলল, দুইটান কইরা অইব না। এক দেড়টান কইরা অইব বেবাকতের। দিতাছি। বলেই বিড়িটা দিল দুলালের হাতে। দুলালও কোনওদিক না তাকিয়ে পরপর দুটো টান দেয় বিড়িতে। তারপর দেয় খোকার হাতে।

নেতাইচরণ তখন হা করে বিড়িটা দেখছে। কেউ দুটানের বেশি দিলেই হা হা করে উঠবে। বিড়ির বেজায় লোভ নেতাইচরণের।

দুলাল বলল, বুজলেন নেতাই দাদা জুয়ানমদ্দ মাইনষের আর একখান দোষ অইল মাইয়া মাইনষের। আমাগো রতনারে দেখলেন না! মুক্তিবাহিনীর কমণ্ডার আছিল। চেরম্যান সাবের মাইয়া আলতার লগে পিরিত। হেই মায়ায় চেরম্যান সাবরে মারল না রতনা। আমাগও মারতে দিল না। নাইলে আপনেঐ কন মুক্তিবাহিনীর আমলে চেরম্যান সাব কী কামডা করল। শান্তিবাহিনী বানাইল, মেলেটারিগ লগে বাও দিয়া কত কিছু করল। গেরামের নিরীহ মানুষটিরে কম জ্বালাইছে! বাচ্চুর বাপরে ধমকাধমকি করছে, তুমার পোলায় কই গেছে কও আমারে নাইলে আমি মেলেটারিগ খবর দিমু। আমার বড় ভাইরে খোকার বাপরে বেবাকতেরে হালায় অপমান করছে। রতনার বাপরে তো হাজার মাইনষের সামনে এই মাওয়ার বাজারে খাড়াইয়া শুয়ারের বাচ্চা বাইনচোত কইয়া বকল। বুড়া মানুষ দেইকা আত উডায় নাই। হেই চেরম্যান সাবরে রতনা কিছু কইল না। দেশ সাদিন অওনের আগে আগে আমরা যহন গৈরামে আইলাম, রতনা হইল গিয়া আমাগ কমণ্ডার, আমাগ ইচ্ছাই আছিল গেরামে আইয়া পয়লাঐ চেরম্যান সাবের লাশখান পদ্মায় ভাসামু। চিডি আর কাফোনের কাপড় পাডাইলাম। চেরম্যান সাবের মাইয়া আলতা বুইজ্জা গেলো এইডা কাগ কাম। গোপনে কারে দিয়া যেন রতনারে খবর পাডাইল। রাইত দুইফরে রতনা গেল আলতার লগে দেহা করতে। আমাগ কিছু কইল। না। পরদিন বিয়ানে কয়, আমার কথা ছাড়া চেরম্যান সাবের বাড়ির সামনে যাবি না কেঐ। আমরা তহন বুজলাম রতনার পায়ে আতে দইরা কান্দাকাডি করছে আলতা। মাইনষে কয় না মাইয়ামাইনষে যোল্লোকলা জানে। আলতার লগে অইল রতনার পিরিত। মন গলতে কতক্ষুণ লাগে!

বাচ্চু বলল, আমি তহনঐ কইছিলাম কামডা ভাল করলি না রতনা। মাইয়া মাইনষের লাইগা দেশের শত্রুরে বাঁচাইয়া দিলি। বুজবি একদিন, ভাও মতন পাইলে এই চেরম্যান সাবেঐ তরে খাইব। অহনে বুজবি না।

দুলাল বলল, কয়দিন বাদে দেশ গেল সাদিন অইয়া। তহন আমরা রাজাকার শান্তিবাহিনীর মানুষ খুঁইজা বেড়াই। রতনাও আমাগ লগে। এই গেরামে ঐ গেরামে যাই, চেরম্যান সাবের বাইত যাই না। চোক্কের সামনে এত বড় শত্রু তারে কিছু কইতে পারি না। রতনা না কইলে আমরা কেমনে কই! নাইলে আপনেঐ কন নেতাই দাদা, চেরম্যান কম জ্বালাইছে মাইনষেরে! নেতাইচরণ তখন বিড়ির পাছা বড় মায়ায় টানছে। দুলালের কথায় থতমত খেয়ে বিড়িটুকু ছুঁড়ে ফেলে নদীর জলে। তারপর খসখসে গলায় বার দুয়েক খাকারি দেয়। কও কি, জ্বালায় না আবার! আমার কতাডা চিন্তা কর। জগতে কেঐ নাই, বাড়িঘর নাই। কুত্তার লাহান মাওয়ার বাজারে ছনছায় পইড়া থাকি। মাইনষে জুডা আইষ্টা দেয় খাই, একটা দুইডা পয়সা দেয়, বিড়িডা দেয় খাই। নাপতালি ছাইড়া দিছি কুনকালে। নাপতালি কির লেইগা ছারলাম হেডা তো আবার তুমরা জানো না। একদিন বিয়ানরাইতে দেহি মুচিপাড়ার কিষ্ণ মুরতি আমার মাতার সামনে আইয়া খাড়াইছে। আমি হের মিহি চাইতেঐ কয় নেতাই, মাইনষের চুলদাড়ি আমি দিছি। হেই জিনিশ তুই কাডচ কা!

গুম থিকা উইঠা আমি এই আলোয়ানখান গায়ে দিয়া বাইর অইলাম। কিষ্ণ কইছে, খুর কেচি ধরন ছাইড়া দিলাম। বাইত আর গেলাম না। বাজারে থাকি বাজারে গুমাই। কেঐ কিছু দিলে খাই, নাইলে খাই না। এই রকম মানুষ অইলাম গিয়া আমি। মেলেটারিগ আমলে আমারে একদিন ধরল চেয়ারম্যান সাবে। আমি বইয়া রইছি কাসেমের দোকানের সামনে। বিয়ানবেলা। হেইকালে চেরম্যান সাব আইল বাজারে। ম্যালা মানুষজন লগে। চেরম্যান সাবেরে দেইখা আমি উইঠা খারাইছি। পেন্নাম কত্তা। চেরম্যান সাব কয় কী জানোনি! ঐ নাস্তার পো, নাপ্তালি করচ না ক্যা? হুইন্যা আমার বুকটা কাইপা উঠল। ঢোক গিল্লা কইলাম, কিষ্ণ সপ্নে একদিন কইল, বুজলেন না কত্তা। হুইন্না চেরম্যান এক ধমক লাগাইল, বানরামি পাইছ হালার পো। বুজরকি চোদাও আমার লগে। কাইল থনে যুদি দেহি তুই খুর কেচি না দরচ তাইলে বুজবি মজা। মেলিটারিগ খবর দিমু। ইন্দু পাইলে মেলিটারি সাবেরা কতা কইব না, পুটকি দিয়া গুলি হান্দাইব। হুইন্যা আমার জানডা পানি অইয়া গেল। হেইদিনঐ গেরাম ছাইরা পালাইলাম। গেলাম গা সোনারং। হেই মুন্সিগঞ্জের সামনে। আহা কী কষ্টডা করলাম তারবাদে। অচিন দেশ মাইনষে চিনে না। তিন চাইরদিন বাদে একদিন খাওন জুটত। ভিক্কা কইরা। তারবাদে হুনলাম দেশ সাদিন অইছে। বেবাক মেলেটারি পলাইছে। আবার গেরামে আইলাম। তারপর থনে তো তোমায় লগেই। কিন্তু চেরম্যান সাবেরে তো দেহি আগের লাইনঐ আছে। অহনে দেখলেও কত্তা কইয়া পেন্নাম দিতে হয়।

দুলাল বলল, বেবাকঐ রতনা হালার লেইগা। পিরিত চোদাইলা, অহন বোজ শালা। জেলের ভাত খাইতাছ। চেরম্যান যতদিন বাইচা আছে জেল থনে আর বাইর অওন লাগব না।

বাচ্চু বলল, একটা জিনিস দেকলি দুলাল। সাদিন অইল একবছর কাটল না, চেরম্যান কইলাম আগের লাহান ক্ষমতা পাইয়া গেছে। আওয়ামী লীগের নেতাগ লগে খাতির। আমাগ বালও মনে করে না অহন। সাদিনের পরপর কী খাতির করত আমাগ। বাজান ছাড়া কতা কইত না।

খোকা বলল, বেবাক অইল অস্ত্রের গুণ। বুঝলি না! অস্ত্র জমা দেওনের পর থনেঐ কলম চেরম্যান সাব আমাগ আর চিনে না।

হ নাইলে কি আর রতনারে জেলে দিতে পারে! লাশ হালাইয়া দিতাম না হালার।

নেতাইচরণ বলল, একটা কতা আমি বুঝলাম না। রতনারে চেরম্যান সাব জেলে দিল।

ক্যা? দুলাল বলল, এইডা তো পানির লাহান সোজা। রতনা সামনে থাকলে আলতারে বিয়া দিতে পারব না। দেখলেন না জেলে যাওনের পরঐ আলতার বিয়া অইয়া গেল।

হ, বুজছি। তয় রতনা এত চালাক ছেইলা, হেরে পুলিশে ধরে কেমনে!

রাইত কইরা রতনা গেছিল আলতার লগে দেহা করতে। চেরম্যান সাব কেমনে জানি খবর পাইছে রাইত বিরাইত রতনা যায় আলতার লগে দেখা করতে। হেয় করছে কি, থানাথ থনে একজন দারোগা আর দুইজন পুলিশ আইন্না বাংলা ঘরে বহাইয়া রাখছে। রতনা যাওনের লগে লগে চোর কইয়া ধরছে। তারবাদে হেই রাইতেঐ চালান দিছে। থানায়। থানাথ থনে মুন্সিগুইঞ্জ জেলে।

তুমরা রতনের লগে দেখা কর নাই।

হ, খবর পাইয়া পরদিন বিয়ানেঐ আমরা তিনজন গেছি থানায়। গিয়া দেহি রতনার বাপ-চাচারাও গেছে। রতনা বাপ-চাচার লগে একটাও কথা কইল না। আমাগ তিন জনরে কইল, দেশ সাদিন করলা ঠিকঐ, মায়া কইরা শক্রডিরে ছাইড়া দিলাম। মহা ভুল করলাম রে। তয় তরা একখান কাম করিচ। অহনে কেঐর কিছু কইচ না। কইয়া পারবিও না। শত্রুরা অহনে শক্তিশালী অইতাছে। আরো অইব। আবার আমাগ একখান যুইদ্ধ করতে অইব। কবে ছাড়া পামু জানি না। তয় তরা আমার লেইগা দেরি করি। এইবারের যুইদ্ধ আরো বড় অইব। একটা শরেও আমরা আর ছারুম না।

বুড়ো নেতাইচরণ দেখে তিনটি যুবকের মুখে এখন ক্রোধ জ্বলছে! চোয়াল শক্ত হয়ে। গেছে, চোখ খাখা। নদীর হাওয়ায় লম্বা চুল উড়ছে সবার। কেউ খেয়াল করে না। কেবল বাচ্চু ছেলেটা আনমনে লুঙির কোড় থেকে বিড়ি বের করে ধরায়। দেখে নেতাইচরণ সব ভুলে বিড়ির দিকে তাকিয়ে থাকে। বাহ্যির গন্ধ ভরা মুখটা হা করে একটা শ্বাস ফেলে। তাতে নদীর মোলায়েম হাওয়া একটু ভারি হয়ে যায়।

খোকা বলল, রতনার বাপ-চাচারা কি করে! রতনার জামিনের তদবির করে না!

দুলাল বলল, করতাছে। হপ্তায় হপ্তায় মুন্সিগুইঞ্জ যায়। কাম অয়না। চেরম্যান সাবে। পুলিশ দারোগা ম্যালা পয়সা খাওয়াইছে। এর লেইগ্যাঐ তো রতনার বাপে গেছিল চেরম্যান সাবের কাছে।

নেতাইচরণ এসবের কিছুই শুনছে না। তার চোখ বাচ্চুর হাতের দিকে। বিড়ি জ্বলছে। নেতাইচরণের টানা বিড়ি মুখে দেবে না ওরা। নেতাইচরণ টানলে বিড়ির পাছায় বড় বদগন্ধ হয়। এই কথাটা একদম মনে থাকে না বাচ্চুর।

খোকা বলল, চেরম্যান সাবে কী কইল?

সাফ কতা কইয়া দিছে, আমি কিছু করতে পারুম না। আমার কাছে আইয়া কাম অইব না।

শুনে বাচ্চু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ঠিক সেই সময় দূরে একটা লঞ্চের মৃদু ভটভট শব্দ শোনা যায়।

খোকা বলল, আমি ইট্টু মুইত্তা আহিরে। লঞ্চ আইয়া পড়লে মানুষজন থাকব। মুততে দেরি অইয়া যাইব। বলে থোকা উঠে গেল জেটির পেছন দিকে। তারপর ঘোলা জলে নিজের স্বচ্ছ জল ছাড়তে শুরু করে। সেই শব্দে বাছুর কেন যে স্কুলে একটা ভাব সম্প্রসারণের লাইন মনে আসে। লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।

কথাটা ভেবে বাচ্চু একটু হাসে। তারপর গম্ভীর হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা দেশটাকে যা দিল, স্বাধীনতা, তা কি তাহলে একবিন্দু শিশিরের মতো মূল্যহীন। আসুক রতন, ফাইনাল যুদ্ধটা করে আমরা এবার দেশকে বলব, নাও স্বাধীনতা। এ শিশির বিন্দুর মতো মূল্যহীন নয়। এ এক অমূল্য সম্পদ।

লঞ্চটা জেটিতে লাগার সঙ্গে সঙ্গে খোকা ফিরে এল। ততক্ষণে ছোটখাটো একটা ভিড় লেগে গেছে নির্জন জেটিতে। নদীতীরের চায়ের দোকানের জন্য পাঁচ-ছয় অভাজন যাত্রী নেমে এল জেটিতে। মাথায় বগলে বোচকাঁচকি। কেউ যাবে ফরিদপুরে, কেউ যাবে ভাগ্যকুল বাজার। জেটির গায়ে লেগে থেকে লঞ্চটা এখন রাগী খোদাই ষাঁড়ের মতন গোঁ গোঁ করছে। আর তীব্র একটা ঢেউ দিচ্ছে জলে। তাতে ছোট্টা লোহার জেটিটা পুঁটি মাছের মতো লাফালাফি করছে। চারজন মানুষ সেই জেটিতে বসে দোলনায় চড়ার মতো দোল খায়।

বাচ্চু তাকিয়েছিল লঞ্চের দিকে। লঞ্চের ছাদে ম্যালা লোজন, মালপত্র। সেসবের ভেতর থেকে মাত্র তিনজন যাত্রী নামল।

সারাদিন তিনবার লঞ্চ ভিড়ে মাওয়ার ঘাটে। সকালবেলা, দুপুরের পর, আর শেষটা সন্ধের আগে আগে। তিনটে লঞ্চই জেটিতে বসে বসে দেখে বাচ্চুরা। সকালবেলা আসে দশটা এগারটার দিকে। সেটা চলে গেলে দুপুরেরটার অপেক্ষা। সেটা চলে গেলে সন্ধেরটার।

রতন এই লঞ্চে করে ফিরে আসবে একদিন। বাছুরা কি রতনের অপেক্ষায় বসে থাকে! রতন ফিরে এলে একটা কাজ পাওয়া যাবে। জেটিতে অপেক্ষা করতে হবে না। জীবনটা অন্যরকম হয়ে যাবে তাদের।

 দুলাল বলল, ঐ দেক রতনার বাপে।

 শুনে নেতাইচরণসহ তিনজন লোক চমকে ওঠে। বাচ্চু দেখে, লুঙি আর ফতুয়া পরা রতনার বুড়ো বাপ নদীর হাওয়া বাঁচিয়ে বিড়ি ধরাচ্ছে। কাঁধে পুরনো কালের একটা চাদর, বগলে তালি মারা ছাতা। মুন্সিগঞ্জ থেকে রতনার কেসের তদবির করে ফিরল। মুখটা এত শুকনো লোকটার, দেখে বাচ্চুরা বুঝে যায়, রতনার কোনও গতি হয়নি।

দুলাল বলল, ল রতনার বাপের লগে কতা কয়াহি।

তারপর তিনজন একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। ওদের দেখাদেখি বুড়ো নেতাইচরণও। কাঁধে আলোয়ানখানা জড়িয়ে সেও যায়।

লঞ্চটা তখন চার পাঁচজন যাত্রী তুলে নিয়ে উজান ঠেলতে আরম্ভ করেছে। তার উতাল পাতাল ঢেউয়ে জেটিটা এখন নাচছে।

ওরা চারজন আস্তেধীরে রতনার বাপের চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায়। বুড়ো নেতাইচরণ একটু দূরে। তারপর কিছু বলার আগেই রতনার বাপ দুঃখী গলায় বলল, কিছু অইল না বাজানরা। উকিল মুক্তার লাগাইছি। ম্যালা টাকা-পয়সা খরচ করতাছি। কিছু তো অইতাছে না। আবার আগামী সপ্তায় মুন্সিগঞ্জ যাইতে অইব।

 শুনে কেউ কোনও কথা বলে না। উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে।

রতনার বুড়ো বাপ আস্তেধীরে নদীর খাড়া পাড় ভেঙে উপরে উঠে যায়।

 বাচ্চু বলল, ল বাইত যাইগা! আইজ আমার ভাল্লাগতাছে না!

খোকা বলল, বাইত গিয়া কী করুম?

এহেনে বইয়াই আইজ আর কী অইব! খবর তো পাইলামঐ।

দুলাল বলল, টাইম কান লাগব না! বাইত গিয়া কী অইব! তাইলে তরা বয় আমি যাই।

 বাচ্চুর মুখে ভেঙে পড়ার চিহ্ন। বাছুটা বড় অস্থির স্বভাবের। অপেক্ষা সইতে পারে না। নেতাইচরণ বলল, ইলশামাছের জন্মবেত্তান্ত হুনবা কইলা।

 আরেকদিন। আইজ মন ভালা না।

সবাই বোঝে রতনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বাচ্চু।

বাচ্চু তারপর ভাঙাচোরা মানুষের মতন জেটি থেকে নামে। তার দেখাদেখি খোকা দুলাল।

 বুড়ো নেতাইচরণও।

.

নদীর খাড়া পাড় ভাঙার পর পাঁচ সাতকানি বাজা জমি। সাদা বেলে মাটি বুকে উজবুকের মতন পড়ে আছে জমিটা। খানে খানে শেয়ালকাঁটার ঝোপ। তারপর বাজার খোলার মাছচালা, দোকানপাট।

বাজার খোলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে দুলাল বলল, বাচ্চু তুই এত অস্থির অচ ক্যান। তুই লেখাপড়া জানা পোলা, তুই আমগ সাহস দিবি। অহন দেহি তুইঐ বেশি মন খারাপ করচ।

 শুনে বাচ্চু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কথা বলে না।

দুলাল বলল, আরো খারাপ টাইম অইল আমাগ সামনে। আইজ অউক কাইল অউক রতনা একদিন ফিরা আইব। রতনারে কোন হালা বাইন্দা রাখে! তয় রতনা ফিরা আহনের পর কী অইব চিন্তা কর। অস্ত্রপাতি কিছু নাই আমাগ। রতনা ফিরা আহনের পর অস্ত্র জোগাড় করতে অইব। তারবাদে অইল গিয়া খেলা।

বুড়ো নেতাইচরণ ছিল পেছনে। হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে পড়েছে। বয়সের ভার। পেছন থেকেই গলা খাকারি দেয় নেতাইচরণ। দুবার। তারপর ফ্যাসফ্যাসা গলায় বলে, আমার বয়স অইল আড়াই কুড়ি। এই বয়সে দুইখান সাদিনতা দেখলাম। তারকথা শেষ করার আগেই দুলাল বলল, আরেকখানও দেখবেন। দেরী করেন, রতনা ফিরে আসুক। যুইদ্ধ কারে কয়, সাদিনতা কারে কয় দেখবেন ইবার। আগের দুইখান যুইদ্ধ অইছে বাইরের শত্রুর লগে, এইবারের যুইদ্ধখান অইব ঘরের শত্রুর লগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *