সোনাদাস বাউলের কথকতা

সোনাদাস বাউলের কথকতা

সোনাদাস থাকে বাজারের পেছন দিকে, গগনবাবুর ধানচালের আড়তে। আড়তের। ভেতর ধানচালের বস্তাগুলোর আড়ালে এক চিলতে ঠাণ্ডা মাটি। দুটো আড়াইমণি বস্তা। কেটে সোনাদাস সেখানে বিছানা পেতেছে। মাথার কাছে স্কুলবাড়ির দুখানা থান ইট। ইট দুখানা চুরি করেছিল সোনাদাস। সে গেল বছরের কথা।

গেল বছর বর্ষায় হাজারমণি গস্তি নাও ভরে স্কুলবাড়ির ইট এল ফতুল্লা থেকে। কদিন খুব ইট টানল কামলারা। থাক করে রাখল স্কুলবাড়ির মাঠে। বর্ষা যেতে না যেতেই গাঁথনি শুরু হল স্কুলের। এখন পেল্লায় একখানা দালান ওঠেছে মাঠের উত্তরে। পোলাপান বইখাতা বগলে নিয়ে সেই স্কুলে পড়তে যায়।

সোনাদাস ইট দুখানা চুরি করেছিল স্কুলবাড়ির মাঠ থেকে। থাক করে রাখা ছিল। এক সন্ধ্যায় ঘোড়দৌড় থেকে ফেরার পথে ভাও বুঝে দুবগলে দুখানা বাছা ইট নিয়ে আড়তে ফিরল। গগনবাবু তখন গদিতে হারিকেন জ্বালিয়ে বসে বিড়ি টানছেন। বেঞ্চিতে দুতিনজন বেপারি বসা। ভাটির নাও এসেছে ঘাটে। সেই নাওয়ের বেপারিরা এসেছে গগনবাবুর কাছে। পড়তা পড়লে মাল কিনবেন গগনবাবু। দরদাম করছেন। ধানের দাম খুব চড়া সেবার। বেপারিরা মুখ ভার করে রেখেছে। গগনবাবুর দিকে তাকায় না।

তবে গগনবাবু ঘাঘু লোক। মুখে মধুমাখা মানুষটার। বাজারের আর তিনজন আড়তদারের তুলনায় গগনবাবু বরাবরই সস্তায় মাল কেনেন। বেপারিদের বিড়িটা সিগারেটটা খাওয়াবেন। ধুম খাতির হয়ে যাবে চোখের নিমিষে। দরদাম তো পরের কথা। আগে খাতির। ইয়ার দোস্তি। বাজারের সেরা মাছ কিনে খাওয়াবেন বেপারিদের। এসব নিয়ে অন্য আড়তদাররা অবশ্য কম কথা বলে না। কম টিটকিরি মারে না। গগনবাবু গায়ে মাখেন না। লোকের কথায় কী আসে যায়। কথা তো লোকে বলবেই! লোকের কাজই তো কথা বলা।

 গগনবাবু নিজের কাজ করে যান। ব্যবসাদার মানুষ, ব্যবসা করে যান। ফলে বেদম টাকা আসে। আড়ত ভরা থাকে ধানচালে। বস্তার পর বস্তা। লোহার সিন্দুকে টাকার বাণ্ডিল সাজিয়ে ওমা মুরগির মতন বসে থাকেন গগনবাবু। আর বছর বছর টাকা পাচার করেন কোলকাতায়। সেখানে গগনবাবুর সংসার। ছেলেমেয়েরা আছে, মা-বাপ আছে, স্ত্রী আছে। তিনতলা বাড়ি কিনেছে। একদিন গগনবাবুও নাকি সব ছেড়েছুড়ে সেখানে চলে যাবেন।

তখন সোনাদাসের উপায় হবে কী!

সোনাদাস একদিন কথাটা তুলেছিল, কর্তায় বলে কইলকাত্তা চইলা যাইবেন? শুনে গগনবাবু বিড়ি টানতে টানতে বললেন, তরে কইল কেডা?

বাজারের মাইনষে কয়।

 মাইনষে তো কত কিছুই কয়।

গগনবাবু হাসলেন। হাসিটা ভারী সুন্দর মানুষটার। তিন কুড়ির ওপর বয়স। একটাও দাঁত পড়েনি এখন। রোজ নিমের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন। হাসলে ঝিলিক দেয় দাঁত। মাথায় চকচকে টাক গগনবাবুর। অল্প কিছু চুল আছে। কাশফুলের মতো শাদা আর পাতলা। নদীর হাওয়ায় ফুর ফুর করে ওড়ে। গায়ের রঙটাও বেশ ঘষামাজা গগনবাবুর। শরীর থলথলে মোটা। সাদা ধুতি আর হাতাঅলা গেঞ্জি পরে থাকেন। গলায় পৈতে।

গগনবাবু বনেদি ঘরের মানুষ। চক্রবর্তী। গগনবাবুদের বাড়ি ছিল মালখানগর। মালখানগর খুবই বিখ্যাত জায়গা। বিক্রমপুরের সব বনেদি হিন্দুদের বাস ছিল মালখানগরে। বোসের বাড়ি, প্রবাদ আছে ঐ বাড়িতে বাহান্নটা গলি ছিল। পার্টিশানের পর বোসরা চলে গেল হিন্দুস্থান। গগনবাবুদের বাড়ি ছিল বোসের বাড়ির কাছেই। পার্টিশানের পর ছেলেমেয়ে, বউ সব কোলকাতা পাঠিয়ে দিলেন গগনবাবু। নিজে পড়ে রইলেন এদেশে। লৌহজং বাজারে পৈতৃক আড়ত। ধানচালের কারবার। বেদম টাকা পয়সা ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। এখন লোকে বলে, গোছগাছ করে গগনবাবুও একদিন চলে যাবেন। এদেশে পড়ে থাকা অবস্থাপন্ন হিন্দুদের এটাই নাকি নিয়ম।

 কথাটা গগনবাবু স্বীকার করেন না। বলেন, এদেশ ছাইড়া আমি যামু না। জন্মাইছি এই দেশে, বড় অইছি এই দেশে, এইডা আমার দেশ। এই দেশ ছাইড়া আমি যামু ক্যা! যামু না। বড় মায়া লাগে।

সোনাদাস জানে মুখে মধুমাখা মানুষটার। কথায় দুনিয়া জয় করেন। গগনবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলে কোনও বেপারির আর ক্ষমতা নেই অন্য কোনও আড়তদারের কাছে মাল বেচে। পয়সার জন্যে সব করতে পারেন গগনবাবু! জানে, সোনাদাস সব জানে। কিন্তু জেনে হবে কী! সোনাদাস কাউকে বলে না। চেপে থাকে। বলে লাভটা কী! গগনবাবু চটে যাবেন। গগনবাবু চটে গেলে সোনাদাসের থাকার জায়গাটা যাবে, অভাবের দিনে চালটা নগদ পয়সাটা যাবে। সোনাদাসের উপায় হবে কী? গগনবাবু দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে সোনাদাসের মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না। বুড়ো বয়সে সোনাদাস যাবে কোথায়। নইলে এই আড়তের ভেতর কম কীর্তিকলাপ তো ঘটে না!

সোনাদাস সব দেখে, চোখ খুলে দেখে। কান খুলে শোনে। আর চুপচাপ বিড়ি টানে। দেখেও না দেখার ভান করে, শুনেও না শোনার ভান করে। সোনাদাসের কোন উপায় নেই। গেল বর্ষায় ধান নিয়ে এল ভাটির এক বেপারি। চেহারাসুরৎ ডাকাতের মতো। গগনবাবুর পুরনো লোক। সোনাদাস আগেও দুএকবার মানুষটাকে দেখেছে। ঠোঁটের ওপর পাকানো গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখ দুটি বেড়ালের চোখের মতো কুকুতে। হলে হবে কী, ভারি ধার চোখে। কারো দিকে ভালো করে তাকালে বুক কেঁপে যাবে সেই মানুষের।

লোকটা এল এক সন্ধ্যায়। সেদিন সকাল থেকে ধুম বৃষ্টি। দোকানিরা দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে বিকেলবেলাই। দুএকটা মুদিমনোহারি দোকানে টিমটিম করে হারিকেন জ্বলছিল। সন্ধ্যার মুখেই খাওয়াদাওয়া সেরে ফেলেছিল সোনাদাস। বসে বসে বিড়ি টানছিল। গদিতে বসে লাল রঙের একখানা খেরো খাতা খুলে গগনবাবু মনোযোগ দিয়ে হিসেব লিখছেন। গায়ে পঞ্চাশ বছরের পুরনো একখানা শাল। বৃষ্টিতে দুনিয়া ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। থেকে থেকে দমকা একটা বাতাসও দিচ্ছে। টিনের ঘরটার ফাঁকফোকর দিয়ে হুহু করে আসছে বাতাস। সোনাদাস শীত টের পাচ্ছিল। এ সময় এল মানুষটা। বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁক দিল, বাবু আছেননি? গগনবাবু খাতা থেকে মুখ না তুলেই বললেন, কেডা?

বেপারি!

গগনবাবু খাতাপত্র বন্ধ করে বললেন, আসেন।

লোকটা কাঠের ভেজানো দরোজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই দুহাত বুকের কাছে তুলে যাত্রাদলের নায়কের মতো বলল, নমস্কার দাদা।

ততক্ষণে গগনবাবু পারলে লাফিয়ে ওঠেন। আরে কী সৌভাগ্যি! আসেন আসেন। দুহাতে গদির শাদা ফরাশ ঝাড়তে লাগলেন গগনবাবু। বসেন বেপারি, বসেন।

লোকটা বিনীতভাবে বসল। ঘরের চারদিকে বেড়ালের মতো ঝকঝকে চোখ তুলে একবার তাকাল। সোনাদাস ছিল ধানচালের বস্তার আড়ালে, নিজের ছালার বিছানায়, ঝোপঝাড়ের মতন হাটু গুঁজে বসে। জায়গাটায় অন্ধকার থক থক করছে। অদূরে গগনবাবুর গদিতে টিমটিম একখানা হারিকেন জ্বলছিল। তার মৃদু একটা আলো ছড়িয়ে আছে খানিকটা জায়গা জুড়ে। কিন্তু সোনাদাসের বিছানা অব্দি আলো পৌঁছায়নি।

 অন্ধকারের আড়াল থেকে গলা বাড়িয়ে লোকটাকে একবার দেখে সোনাদাস। বিড়ি শেষ হয়ে আসছিল। সুখটান দিয়ে বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিড়ির শেষাংশ গলিয়ে দিল সোনাদাস। তখনই গগনবাবু ডাকলেন তাকে। সোনা, এদিকে আয়। বেপারিরে চা খাওয়া।

সোনাদাস আড়মোড় ভেঙে ওঠল। অনেককালের পুরনো, ছেঁড়াখোঁড়া একখানা চাদর ছিল, শীতকালে গায়ে দেয়। মাথার কাছেই চাদরটা থাকে, টেনে নিল সোনাদাস। তারপর আস্তেধীরে গগনবাবুর গদির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা তখন খুবই আয়েশ করে বসেছে। গদিতে একেবারে পা তুলে। খুব নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করছিল। সোনাদাসকে দেখে থেমে গেল। গগনবাবু বললেন, মাইনকারে ক, দুইকাপ ফাসকেলাস চা দিতে।

 দরোজার আড়াল থেকে বৃষ্টির জোর দেখে সোনাদাস। ধুমসে পড়ছে। এসময় মাইনকা কি দোকান খুলে বসে আছে। থাকলেই বা ফায়দা কী। খদ্দের পাবে কোথায়।

সোনাদাস বলল, মাইনকার দোকান মনে অয় বন্ধ কর্তা।

শুনে বেপারি লোকটা বলল, থাউক, চা লাগব না।

গগনবাবু হা হা করে ওঠলেন, মাইনকারে গিয়া ডাইকা ওঠা, আমার কথা ক।

সোনাদাস আর কথা বলে না, অন্ধকারে বৃষ্টির মধ্যে নেমে যায়। বৃষ্টির সঙ্গে হাওয়াটা ছিল। সরাসরি পদ্মা থেকে আসছে। কী ঠাণ্ডা! চাদর ফুটো করে সোনাদাসের শরীরের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। বৃষ্টি তো আছেই। সোনাদাস একখান আড়াইমণি খালি বস্তা ডোঙা নাওয়ের মতন করে বৃষ্টিবাদলায় ব্যবহার করে। বেরুনোর সময় মনে করে, সেটা মাথায় দিয়েছিল, তবু বৃষ্টির ছাঁট মুখে লাগছিল সোনাদাসের।

মাইনকা কিন্তু জেগেই ছিল। দোকানের একটা ঝাঁপ আলগা করে হারিকেনের আলোয় ক্যাশবাক্স খুলে বসেছে। পয়সাপাতির হিশেব করছে। বাজারের একটা নেড়িকুত্তা টিনের ছনছার তলায় কুণ্ডলি পাকিয়ে বৃষ্টি থেকে গা বাঁচাচ্ছে। সোনাদাসের পায়ের শব্দ পেয়েও মাথা তুলল না।

 সোনাদাসকে দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল মাইনকা, কী খবর বাউল দাদা?

 সোনাদাস বলল, কর্তায় দুই কাপ চা দিতে কইছে।

এত রাইতে কর্তার ঘরে আবার কেডা আইল?

সোনাদাস বলল, বেপারি আইছে।

মাইনকা গেলাসে চটপট চা তৈরি করে ফেলল। কালাকুষ্টি একখানা চামচ দিয়ে ফটাফট নেড়েচেড়ে সোনাদাসের হাতে দিল। বলল, কাপ দুইখান কাইল বিয়ানে দিলেই অইব বাউল দাদা।

 আইচ্ছা দিমুনে।

সোনাদাস চা নিয়ে পায়ে পায়ে আড়তে ফিরে আসে।

চা খেতে খেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিচু গলায় কী কী সব আলাপ করেন গগনবাবু। লোকটা বার তিনেক গলা খুলে হাসে। তারপর বলল, তাড়াতাড়ি পাড়ান। রাইত অইতাছে। বিষ্টিবাদলার দিন।

গগনবাবু বললেন, পাডাই আর একটু নিটাল হোক। যাইতে আইতে সময় লাগব না!

তা লাগব।

গগনবাবু আবার সোনাদাসকে ডাকেন, সোনা আর একটা কাম করতে অয় যে।

বাবুর ফুটফরমাস খাটতে সোনাদাস তো মুখিয়ে থাকে। ঝড়বাদলা যতই হোক, রাতবিরাত যতই হোক, গগনবাবুর কাজ করতে সোনাদাসের কোনও ক্লান্তি নেই।

সোনাদাস বলল, কন।

বাবু গদি থেকে নেমে এলেন। বেপারি লোকটা তখন সিগ্রেট ধরিয়েছে।

বাবু ফিসফিসে গলায় বললেন, আলতারে আনতে পারবি?

সোনাদাস মুহূর্তমাত্র দেরি করল না। খুবই সরল গলায় বলল, আপনে কইলে পারুম না হেমুন কাম আছে!

বাবু খুশি হন, তয় যা। কবি, হারা রাইত থাকতে অইব।

কই থাকব?

 তর বিছানায়।

 কয়জন?

বেপারি একলাই।

গগনবাবু একটা দশ টাকার নোট গুঁজে দেন সোনাদাসের হাতে।

এইডা আগাম দিলাম। নাইলে তো আবার আইতে চাইব না! মাগির তো আইজকাল দাম বাইড়া গেছে!

টাকাটা হাতে নিয়ে বেরোয় সোনাদাস। বৃষ্টিটা তখন একটু কমে এসেছে। বড় ফোঁটাগুলো নেই। ঝির ঝির করে, ধুলো জমে থাকা উঠোন ঝাড় দেয়ার আগে বাড়ির বউঝিরা নরম হাতে কখনও কখনও যেমন জল ছিটায়, তেমন করে বৃষ্টিটাও যেন ছিটিয়ে দিচ্ছে কেউ। বাতাসটা আছে। কনকনে ঠাণ্ডা। গায়ের নুনছাল ফুটো করে ভেতরে ঢুকে যায়।

শীত করে, বড় শীত করে সোনাদাসের। কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকারে পথ ঠাওর করে হাঁটে সে। মাথায় ডোঙা নাওয়ের মতন বস্তাটা আছে, গায়ে আছে চাদরখানা। তবু বৃষ্টি মানে না, শীত মানে না। হলে হবে কি, গগনবাবু বলেছেন, না গিয়ে উপায় কী! সোনাদাস হাঁটে। অন্ধকারে পথ ঠাওর করে হাঁটে।

আজ রাতের ঘুমটা মাটি। সারারাত কেচ্ছাকেলেঙ্কারি হবে আড়তে, সোনাদাসের বিছানায়। গগনবাবু অবশ্য ওসবে নেই। বয়স হয়েছে, কাম মরেছে বহুকাল আগে। বেপারির কাছ থেকে সস্তায় মালটা নেবেন। কিন্তু সোনাদাসের লাভটা কী?

আছে, লাভ সোনাদাসেরও আছে। গগনবাবু তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, থাকার জায়গা দিয়েছেন। ফুটফরমাস খাটলে চালটা পয়সাটাও দেন। সুযোগ পেলে সোনাদাস চুরি চামারিও করে কিছু। গগনবাবু টের পান না। হাজার হাজার মণ চাল থাকে গদিতে। কোণাকানছি কুড়িয়েই চলে যায় সোনাদাসের। একলা মানুষ, বয়েস হয়েছে, কাজকাম নেই, এককালে বাজারে বাজারে গান গেয়ে ভিখ মাগত। নামের সঙ্গে বাউল যোগ হল, দিন চলে যেত। এখন বয়েস ভাটির দিকে, গলা দিয়ে সুর ওঠে না। গান শুনে লোকে ভিখ দেয় না। হাসে। গালাগাল করে।

আলতাদের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল সোনাদাসের। তক্তি বিস্কুটের মতো দশ টাকার একখানা নোট দিয়েছেন বাবু। একদম মুরমুরে। নোটটা জামার বুক পকেটে রেখেছে সোনাদাস। এই টাকাটা আলতাকে দিতে হবে। না দিলে হয় না।

সোনাদাসের মাথায় মাকড়শার মতো জাল বিস্তার করে বুদ্ধি। আলতাকে পায়েহাতে ধরে নিয়ে যাবে সোনাদাস। বাবু আগাম টাকা দিয়েছেন একথা আলতাকে বলবেই না। সকালে ফেরার সময় তো আরো টাকা দেবেন গগনবাবু। কমপক্ষে দশ টাকা দেবেন। তাতেই খুশি হয়ে যাবে আলতা, টু শব্দটা করবে না। বুঝতেই পারবে না আগাম আরো দশ টাকা দিয়েছিলেন বাবু। টাকাটা সোনাদাস হজম করে ফেলেছে।

খুশিমনে বিড়ি বের করে সোনাদাস দেশলাই জ্বেলে কায়দা করে ধরায়। যদি ধরা পড়েই যায়, তখন দেখা যাবে। বাবুকে বলবে, আলতা আগাম চায়নি। আলতাকে বলবে, টাকাটা যে জেবে রাখছি ভুইলাই গেছিলাম।

আর যদি ধরা না পড়ে।

এই অব্দি ভেবে চাদরের তলা দিয়ে জামার বুক পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা একবার ছুঁয়ে দেখে সোনাদাস। হাতটা গরম হয়ে যায়। টাকা বড় গরম জিনিস। আগুনের মতন।

সোনাদাস হাঁটতে থাকে। খুশিমনে হাঁটতে থাকে।

.

আলতাদের বাড়িটা গ্রামের মুখেই। হাটের ধারে। বাড়ি বলতে একটা মাত্র ছনের ঘর, গোটাকয় কলাগাছ আর চার কদম খোলা জায়গা। সংসারে আলতা আর বুড়ি মা ছাড়া আর কেউ নেই। কচি বয়সে মাতবর চরের এক চউরা লাঠিয়ালের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আলতার। পদ্মায় নতুন চর জাগলে মহাজনদের হয়ে চর দখল নিতে যেত। চর দখল নিতে গিয়েই মরল। আলতার তখন গা গতরে ভরা যৌবন, পদ্মার জোয়ারের মতন। কী করবে, খসম হারিয়ে মেয়েমানুষটা গেল বেশ্যা হয়ে। একদিকে পেটের দায়, অন্যদিকে শরীরের। এখন দিনের বেলা এ বাড়ি ও বাড়ি দাসীবান্দির কাজ করে, আর রাতের বেলা করে বেশ্যাগিরি। বাজারের কোন না কোন ঘরে রাত কাটে আলতার। ভগবান বড় সহায় আলতার। পেটটা দিয়েছে বাজা করে। নইলে বছর বছর বিয়াত, শরীরখানা যেত ধেরধের হয়ে। লোকে নগদ পয়সা দিয়ে আলতার সঙ্গে শুত না। আলতার কথা সব জানে সোনাদাস। একদিন দুঃখের কথা সব সোনাদাসকে বলেছিল আলতা। সোনাদাসের কী করার আছে, সেও তো জনম দুঃখী। জন্মের পর আপন বলতে কাউকে দেখেনি। দেখেছে এই বাজারটা। বাজারটাই তার একমাত্র আপনজন। হাঁটতে হাঁটতে, এসব ভাবতে ভাবতে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল সোনাদাসের।

আলতাদের বাড়ি ওঠে আবার একটা বিড়ি ধরাল সোনাদাস। নগদ দশ টাকা কামাই, খেলা কথা না। সেই সুখে সোনাদাস আজ রাতভর বিড়ি টানবে। ঘুমটা তো মাটি হবেই, বিড়ি খাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে!

উঠোনে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানতে লাগল সোনাদাস। ঘরের ভেতর থেকে কোনও শব্দ আসে কিনা শোনার চেষ্টা করল। মাঝেমধ্যে বুড়ি মাকে অন্য বাড়িতে থাকতে পাঠায় আলতা। খদ্দের নিয়ে ঘরে শোয়। যেসব খদ্দেরের মেয়েমানুষ নিয়ে শোয়ার জায়গা নেই তাদের জন্যে এই ব্যবস্থা। ওরকম হলে পয়সা বেশি নেয় আলতা।

না, আজ ঘরে তেমন কেউ নেই আলতার। থাকলে কথাবার্তার আওয়াজ পাওয়া যেত। মেয়েমানুষের সঙ্গে শুয়ে সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে না কেউ।

তবু খানিকক্ষণ কান পেতে রাখে সোনাদাস। ছাপড়া ঘরের পেছনে কলাপাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। অবিরাম ডাকছে ঝিঁঝি পোকা। নাবালের দিকে ব্যাঙের ডাকও শোনা যায়।

নিশ্চিত হয়ে গলা খাকারি দিল সোনাদাস। আলতা জেগেই ছিল, সোনাদাস ডাকার আগেই ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ দিল, কেডা?

আমি, সোনাদাস। ঘুমাইছচনি আলতা?

না, কির লেইগা?

ওঠ। বাজারে যাইতে অইব।

কার ঘরে?

গগনবাবুর আড়তে। নতুন বেপারি আইছে। ভালা টেকা দিব তরে।

টাকার আওয়াজটা সোনাদাস দিল বানিয়ে। লোভ না দেখালে আলতা যদি বৃষ্টিবাদলের রাতে ঘর থেকে না বেরুতে চায়! তা হলে দশটা টাকা।

কিন্তু সোনাদাসকে খুশি করে ওঠল আলতা। নিচু স্বরে বুড়ি মার সঙ্গে গোটা দুই কথা বলল, তারপর বেরিয়ে এল। সোনাদাস টের পেল ঠিক সেই মুহূর্তে বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা দশ টাকা কামাই করার সুখে কুনোব্যাঙের মতো লাফাচ্ছে। বাইরে এসে আলতা বলল, বেপারি আইছে কইথন?

সোনাদাস খুশিমনে বিড়ি টানতে টানতে আলতার সঙ্গে হাঁটে।

অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না, তবু দুটো মানুষ কী সুখে যে হাটে!

হালটে ওঠে আলতা বলল, শীত করতাছে বাউলদাদা।

সোনাদাস বলল, আমার গায়ের কাপড়টা নিবি?

শুনে খিল খিল করে হেসে ওঠল আলতা, আমারে যে গায়ের কাপড় দিবা বাউলদাদা, তোমার শীত লাগব না?

লাগুক।

না থাউক, তুমি বড় মানুষ। শীতে কষ্ট পাওনের কাম নাই! আমারে একখান বিড়ি দেও।

 অন্য সময় হলে সোনাদাস দিত না। আজ মন ভালো। নগদ দশ টাকা রোজগার হয়েছে। সেও আলতার জন্যেই। সেই আলতাকে একটা বিড়ি দিলে কী এমন ক্ষতি! দেয়, সোনাদাস একটা বিড়ি বের করে দেয় আলতাকে।

 আলতা বলল, ধরাইয়া দেও।

সোনাদাস ধরিয়ে দেয়। তখন কাছে কোথায় একটা রাতপাখি ডেকে ওঠে। আর দূরে বাজারের দিকে ঘেউ দেয় একটা কুকুর।

বিড়ি টানতে টানতে আলতা বলল, কথাবার্তা কও বাউলদাদা, চুপচাপ আটতে ভাল্লাগে না।

সোনাদাস বলল, কি কমু ক?

একটা কিচ্ছা কও।

আমি কিচ্ছা জানি না বইন।

 তয় তোমার নিজের কথা কও।

আমার নিজের আবার কি কথা?

কত কথা থাকে না মাইনষের। সুখের কথা, দুঃখের কথা।

আমার সুখও নাই, দুঃখও নাই।

 সুখ দুঃকু ছাড়া মানুষ আছেনি?

আছে।

কেডা আছে কও তো!

 সোনাদাস হেসে বলল, এই যে আমি আছি।

বিড়িতে টান দিয়ে আলতা বলল, ধুৎ। বিতলামি কইর না বাউল দাদা কও।

কি কমু?

তুমি বিয়া কর নাই ক্যা? বলে আলতা আবার হাসে।

 হাসতেও পারে মাগি। সোনাদাসের একটু রাগ হয়। কিন্তু রাগটা চেপে রাখে। আলতার সঙ্গে রাগারাগি করলে লোকসান। বাবুকে যদি বলে দেয়!

আলতা বলল, কী অইল, কথা কওনা ক্যা? আমি কইলাম তাইলে যামু না!

আলতার কথা শুনে ভয় পায় সোনাদাস। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কেমনে বিয়া করুম। আমারে মাইয়া দিব কেডা?

ক্যা! মাইয়া দিব না ক্যা!

কেমনে দিব ক। কী আছে আমার!

তোমার কোনও পিরিতের মাইয়ামানুষ আছিল না?

না। আমার লগে পিরিত করব কেডা? দুনিয়ায় কেউ নাই আমার। মা নাই, বাপ নাই। জন্মাইয়া চক্ষে কেউরে দেহি নাই। ফকিরফাঁকরা মানুষ, ভিখ চাইয়া খাইতাম। বুড়াকালে ভিখ মাইনষে দেয় না। বাবু দয়া না কললে মইরা পইড়া থাকতাম বাজারে। আলতা তারপর আর কোন কথা বলেনি।

সে রাতটার কথা এখনও মনে আছে সোনাদাসের। বেপারি লোকটা সারারাত আলতাকে নিয়ে তার বিছানায়। আর বাজারের নেড়ি কুত্তাটার সঙ্গে সুলতানের দোকানের সামনে, চারখানা বাঁশের খুঁটির ওপর বিঘত পরিমাণ চওড়া তক্তা ফেলে যে বেঞ্চ পাতা হয়েছে সেই বেঞ্চে বসে থাকল সোনাদাস। বসে বসে বিড়ি টানল। ওদিকে বৃষ্টিবাদলায়, অন্ধকারে গগনবাবুর গদিতে রাতভর বেপারির নাও থেকে বস্তা বস্তা ধান তুলল মাল্লারা। রাতের বেলা গদিতে কখনো মাল তোলেনি গগনবাবু। সেবার তুলেছিল কেন? পরদিন গগনবাবু বলেছিল, রাইতে গদিতে মাল ওঠাইছি কেউরে কইছনা সোনা। চব্বিশ ঘন্টায় নগদ কুড়ি টাকা কামাই! সোনাদাসের বড় সুখের দিন ছিল সেটা।

বলেনি, কথাটা কাউকে বলেনি সোনাদাস। অনেককাল পর শুনেছিল, চোরাই মাল ছিল ওগুলো। মাঝিমাল্লা আর মহাজনকে খুন করে হাজারমণি নাওটা নিয়ে ভেগে এসেছিল ওই বিলাইচোখো লোকটা! কিন্তু গগনবাবুর কিছু হয়নি। দুদিনের মধ্যে মাল বেচা শেষ। কত কামিয়েছিলেন সেবার কে জানে।

মনে আছে, সোনাদাসের সব মনে আছে। কিন্তু সোনাদাস এসব কথা কাউকে বলে না। বললে লোকসান, গগনবাবু তাড়িয়ে দেবেন। তখন সোনাদাস এই বুড়ো বয়সে কোথায় যাবে! কার কাছে যাবে! তার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

সন্ধেবেলা একদিন পেল্লায় চাঁদ ওঠল আকাশে। সোনাদাস ছিল নদীর পারে। আকাশে চাঁদ দেখে গদিতে ফিরল। আজ বুঝি পূর্ণিমা। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে দুনিয়া। দেশে এই বুড়ো বয়সেও সোনাদাসের বেশ একটা আমোদ লাগে। খুশিমনে, বিড়ি টানতে টানতে গদিতে ফেরে সোনাদাস। ফিরেই একটা নতুন কথা শোনে।

গগনবাবু বিষণ্ণ ভঙ্গিতে বসেছিলেন গদিতে। ধুতি আর কোরা গেঞ্জি পরা। সামনে হারিকেনটা টিম টিম করে জ্বলছে।

সোনাদাসকে দেখেই ডাকলেন বাবু। আয় সোনা কথা আছে।

সোনাদাস অবাক হয়ে গদির কাছে এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে।

বাবু একটু গলা খাকারি দিলেন। তারপর বললেন,আমি কাইলই যাইতাছিগা সোনা। সোনাদাস অবাক হয়ে বলল, কই?

জানছ না?

না, আমি তো কিছু জানি না।

কইলকাত্তা যাইতাছিগা।

শুনে আকাশ থেকে পড়ল সোনাদাস। বোকার মতো বলল, আপনের আড়ত? গদি? গদি বেইচা ফালাইছি।

তারপর সোনাদাসের মুখে খানিকক্ষণ কোনও কথা নেই। এক পলক আড়তের দিকে তাকাল সোনাদাস। তাকিয়ে দেখতে পেল গদিরঘরটা অমাবশ্যা রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেছে। কিন্তু আজ পূর্ণিমা, বাইরে মন ভালো করা অদ্ভুত জ্যোৎস্না। সোনাদাস সব ভুলে গেল।

গগনবাবু বললেন, তগো লেইগা বড় মায়া অয়! এহেনে হারাজীবন কাটাইলাম, যাইতে কি মন চায়। কী করুম? বুড়া অইয়া গেছি। কুনসুম মইরা যামু। এহেনে মরলে মুখে আগুন দেওনের মানুষ নাই। পোলাপানের কাছে গিয়াই মরি।

 তারপর আর কোনও কথা বলে না গগনবাবু, সোনাদাসও না। টিমটিমে হারিকেনটা মাঝমধ্যিখানে বসে জ্বলে যায়।

খানিকপর ওঠে সোনাদাস। গগনবাবু বললেন, কই যাছ?

সোনাদাস কীরকম এক দুঃখী গলায় বলল, আইতাছি।

বাইরে এসে সোনাদাস টের পায় বুকের ভেতরটা কেমন করছে। এই বুড়ো বয়সে। কাঁদবে নাকি সোনাদাস! চিৎকার করে কপাল চাপড়ে কাঁদবে খানিকক্ষণ!

 কাঁদলে লোকে হাসবে।

একটা বিড়ি ধরিয়ে বাজারের পেছন দিকটায় যায় সোনাদাস।

বাজারের পেছনে বিশাল মাঠ। মাঠের পর ধানী বিল মাইল মাইল জায়গা নিয়ে পড়ে আছে। বহুদূরে গ্রামপ্রান্তর। গ্রামের মাথায় ফুটে আছে চাঁদ। জ্যোৎস্নায় ঝিমঝিম করছে চারদিক।

সোনাদাস ক্লান্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাঠ ভেঙে হেঁটে যায়। কোথায় যায়, কে জানে! এত বড় পৃথিবীতে সোনাদাসের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *