জ্বিন

জ্বিন

বিকেলের দিকে বোঝা গেল সারেঙের অবস্থা খারাপ। আজ রাতেই কাবার হবে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ সেদ্ধ ডিমের মতো সাদাটে হয়ে গেছে। দাড়িগোঁফঅলা বিভৎস মুখটা হা করে ঘনঘন শ্বাস টানছে মানুষটা। জব নাই। সারেঙের বয়সী স্ত্রী ঘরের মধ্যে আছাড়পাছাড় খেয়ে চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। সেজাল খাঁরে খবর দে তরা। আমার কপাল বুজি পোড়ব। চৌকির ওপর বিবর্ণ মুখে বসে আছে গণি। সারেঙের শিয়রের কাছে ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে আছে তার বউ। নরম ভঙ্গিতে হাতপাখা নাড়ছে। শুকু ছিল পাটাতনের ওপর। সেখান থেকে জামা গায়ে নেমে এল। চৌকির ওপর বাবার আড়াআড়ি বিশাল দেহটা একবার দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, আমি যাইতাছি। ফকিররে লইয়ামু।

তারপর গলির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ইট্টু বাজারে যাও মিয়াভাই। যা যা লাগে লইয়া ভাবিরে কও, পুনু বুজিগ গাচ থনে ফুল লইয়াহুক।

শুকু তারপর বেরিয়ে গেল।

তখন নাবাল মাঠে বিকেল পড়ে যাচ্ছিল। শুকু মাঠে পৌঁছে খোলামেলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস টানে। পশ্চিমে তাকিয়ে দেখে, গ্রামসীমায় সূর্য গড়িয়ে পড়ছে।

শুকুর বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। সেজাল খাঁরে পাওয়া যাইব তো। যদি না পাওয়া যায়। কথাটা ভেবে শিউরে ওঠে শুকু। বাবার মরো মরো অবস্থা। আর ফকির সাবের খবরই নাই। হেই যে একদিন আইছিল, আর দেহা নাই।

এসব ভেবে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে ওঠে ছেলেটা। আইজ শালা ফকিররে যেহেন থনে পারি লইয়া আমু। নইলে বাবায় যুদি মইরা যায়। বাবার মৃত্যুর কথা। ভাবতে পারে না শুকু। বুকের ভিতর ধুগযুগ করে।

এখন ফাগুন মাস। ধানের চারায় সবুজতা নেমেছে। বিকেলটা কী চমৎকার ছড়ানো চারদিকে। শুকু এসব খেয়াল করে না। হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় মেদিনীমণ্ডল থেকে দোগাছী বহুদূর পথ। সামনে ধুধু বিস্তৃত মাঠ। কানি কানি ধানজমি, পাটজমি। পুবদিকে সড়ক সিতারামপুর হয়ে কাজিরপাগলা,তারপর গোয়ালীমান্দ্রা পর্যন্ত চলে গেছে। শুকু হাঁটতে থাকে। আজন্মের চেনা এই পথ কে যেন রাতারাতি টেনে অনেকটা লম্বা করে দিয়ে গেছে। পথ আর ফুরোয় না।

শুকুর খুব বাবার কথা মনে হচ্ছিল। বয়সকালে বিশালদেহী মানুষটা, চুলদাড়িতে কী যে সুন্দর ছিল দেখতে। মালটানা জাহাজের সারেঙ ছিল বাবা। থাকত কোলকাতায়। বছরে দুবছরে বাড়ি আসত। বর্ষাকালে টিপটিপ বৃষ্টির দিনে কেরায় নৌকায় বোঝাই মালপত্র নিয়ে বাড়ি আসত বাবা। শুকু সেই ছেলেবেলায় জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে ফেলত, দূরের বিলে কুয়াশার মতো বৃষ্টি সরিয়ে একটা কেরায় নৌকা এগিয়ে আসছে। এক সময় সেই নৌকাটি তাদের ঘাটে এসে ভিড়ত। তার ভিতর বাবাকে মহাপুরুষের মতো বসে থাকতে দেখে বাড়ির ভেতর উৎসব শুরু হয়ে যেত। রাত অনেকটা বেড়ে গেলেও মার রান্না শেষ হত না। বাবা বাড়ি এলে কত পদের রান্না যে করত মা! বুড়ি তখন মার কোলে।

দেখতে দেখতে বিকেল ফুরিয়ে আসে। অন্তরীক্ষ থেকে অন্ধকার নামে মাঠে। ধানি জমিতে ঝিঁঝি পোকারা ডাকতে শুরু করেছে। শুকু দুএকবার দোগাছীর দিকে তাকায়। গ্রামের গাছগাছালি এখন অন্ধকারের ভেতর। আকাশের তলা দিয়ে বাদুড় উড়ছে। এসবের ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুকুর কেবল বাবার কথা মনে হয়। এমন জোয়ান মর্দ মানুষটা দেখতে দেখতে কেমন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল। শুকুদের বড় ঘরটাই আসলে দোষী। ঐ ঘরে কেউ বেশিদিন টিকবে না। বুড়িটা জন্মের পর থেকে আতুর হয়ে আছে। ন-দশ বছরের মেয়ে, না পারে কথা বলতে না পারে হাঁটতে। সারাক্ষণ চৌকির উপর কুঁজো হয়ে বসে থাকে। বুড়ির জন্মের আগে ঘরের ভেতর অলৌকিক সব দৃশ্য দেখছিল মা। বুড়ি তখন পেটে। হাজামবাড়ি থেকে কোষা-নৌকোয় করে বাড়ি আসছিল মা। সন্ধ্যা হয় হয়। বড় পুকুরটার মাঝামাঝি আসতে কালো জলের তলা থেকে গভীর বুদবুদ তুলে কী যেন একটা জিনিস কোষার তলায় এসে ধাক্কা মারল। সেই ধাক্কায় ছোট্ট কোষা-নাও কাৎ হয়ে প্রায় ডুবুডুবু। আল্লাহ আল্লাহ করে কোনওরকমে ঘাটে এসে পৌঁছল মা। সেই রাতেই স্বপ্নে দেখল সাতটা কাঁসার ডেগ। হা করা মুখে চকচক করছে কাঁচা টাকা। সবচে বড় ডেগটার ভিতর থেকে মানুষের কথা বলার মতো কেউ বলে, নে, নে। মা স্বপ্নের ভিতরেই জানতে চাইল, তোমরা কোথায়?

পুকুরের উত্তর কোণে ছিলাম। সন্ধেবেলা তোর সঙ্গে চলে এসেছি। এখন তার ঘরের মধ্যিখানে ঘুণে খাওয়া খামটার তলায় আছি।

মা আবার জিজ্ঞেস করল, তোমাদের নিতে কী লাগে?

ডেগের ভিতর থেকে শব্দ আসে, জোড়া নারকেল, কমলা আর মাথায় সিঁদুর।

সকালবেলা ওঠেই সেজাল খাঁকে খবর দিল। তখন জাহাজে। মিয়াভাই সেজাল খাঁকে ডেকে আনল। মা সব খুলে বলল তাকে। সেজাল খাঁ বলল, বৈঠক দ্যান। সেই রাতেই বৈঠক দেয়া হল। বৈঠকে মহাজনরা বলল, ঘরে আছর হইছে। যা যা চাইছে তা হইল কপালের সিঁদুর মানে তোর মরদ। জোড়া নারকেল, তোর দুই ছেলে। আর কমলা হইল তোর কন্যা।

মা জানতে চাইল, কন্যা কই বাবা?

হইবো।

শুনে ফুঁপিয়ে ওঠেছিল। এখন তাইলে কী করমু বাবা?

ঘরের মধ্যিখানের খামটা উডাইয়া ফালা।

জাহাজে খবর পাঠানো হল। বাড়ি এসে সেই খামটা পাল্টে ফেলল বাবা। তার কদিন পরে বুড়ি জন্মায়। বুড়ি জন্মের পর মা ঘাটে গেলেই জলের তলায় সেই ডেগেরা এসে হাজির হত। আমাগ তুই ফিরাইয়া দিলি? তর কপাল পুড়ব।

মা তারপর বাড়ির কোথাও একাকী গেলেই সেই স্বর শুনত। রান্না করতে বসলে শুনত। আর রাতের বেলা তো কথাই নেই। কেবল সেই সাতটা ডেগ তার চোখের সীমায় এসে স্থির হয়ে থাকত। সেই অলৌকিক স্বর বাজত কানে। অথচ মার গায়ের পাশে শুয়ে বাবা এসবের কিছুই দেখত না। কিছুই শুনতে পেত না। মা ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে ওঠত ভয়ে, বাবাকে জড়িয়ে ধরত।

তারপর একসময় সেই ডেগেরা আর দেখা দিত না। অলৌকিক স্বরের কথাও আর শুনতে পেত না মা। অথচ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুড়িটা ক্রমশ পঙ্গু অথর্ব হয়ে যেতে লাগল।

.

সেজাল খাঁর উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রথমে গলা খাঁকারি দিল শুকু। তারপর বলল, ফকির সাব বাড়িতে আছেননি?

 সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে মেয়েমানুষের গলায় জবাব এল, আছে। মাজারে বাত্তি দেয়। শুকু উঠোনের কোণে জবাগাছের ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করে মশা, পায়ের কাছে কুনো ব্যাঙ লাফায়, ছুঁচো দৌড়ে পালায়। সে দাঁড়িয়ে থাকে। ফকির সাব তাহলে আছেন! কথাটা ভেবে বুকের ভিতর কীরকম সুখসুখ একটা অনুভূতি হয় শুকুর। সে জানে, সেজাল খাঁর ঘরে মাজার আছে। ঘরের পশ্চিম-উত্তর কোণে। ফকির রোজ সন্ধেবেলা মোমবাতি জ্বালায় আগরবাতি জ্বালায় সেই মাজারে। সেজদা দেয়ার ভঙ্গিতে সালাম করে আসলে মহাজনরা সবসময়েই আসাযাওয়া করে। পাকপবিত্র না থাকলে ক্ষেপে যায়। একবার কী দোষ পেয়ে তেঁতুল গাছ থেকে ফেলে দিয়েছিল ফকিরকে। পাঁজরের হাড় ভেঙে গিয়েছিল। তখন থেকে ফকির বড় সাবধান।

খানিক বাদে ফকিরকে দেখা গেল ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। দেখেই অন্ধকার ঠেলে তার কাছে এগিয়ে গেল শুকু। ফকির তীক্ষ্ণচোখে শুকুর দিকে তাকাল, কী খবর মিয়া?

ফকিরের ভাঙাচোরা বসন্তের দাগঅলা মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে শুকু বলল, বাবার অবস্থা ভালা না, আপনের ইট্টু যাওয়া লাগব।

ফকির একটু থেমে রইল। যেন বিশাল কোনও চিন্তাভাবনা চালাচ্ছে মাথার কোষে কোষে। তারপর ভারি গলায় বলল, ব্যবস্থা করছস?

হ মিয়াবাইরে কইয়া আইছি সব জোগাড় কইরা রাখতে।

খাড়াও, আইতাছি।

বলে ফকির আবার ঘরের ভিতর ঢোকে। লম্বা কোর্তা পরে বেরিয়ে আসতে আসতে কারো উদ্দেশ্যে বলে, মেদিনীমণ্ডল যাইতাছি। রাইতে আমুনা।

ততক্ষণে তেঁতুল গাছের ভিতর দিয়ে চাঁদ ওঠেছে। বাঁকা, ক্ষীণ চাঁদ। পাতলা জ্যোৎস্না পড়েছে আর ঝির ঝির করে একটা বাতাস দিচ্ছে। চরাচর জুড়ে আশ্চর্য মগ্নতা। দেখে শুকুর মনটা কেমন যেন ভালো হয়ে যায়। ফকিরের সঙ্গে পা চালিয়ে চালিয়ে হাঁটতে শুরু করে সে।

মাঠে নেমে বিড়ি ধরায় ফকির। ফোঁস ফোঁস টানে, ধোয়া ওড়ায়। শুকু দেখে ফকিরের বিড়ির মাথায় চন্দন বিচির মতো দগদগে আগুন টানে টানে ক্ষীণ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। আবছা জ্যোৎস্নায় ফকিরের চোয়াড়ে মুখটা অস্পষ্ট। শুধু বিড়ির টানে নাকের ডগাটা স্পষ্ট হচ্ছে।

শুকু তারপর শুধু মাঠের দিকে তাকায়। চাঁদ দেখে গ্রামের মাথার ওপর। তাদের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছে চাঁদ। বাতাস আছে। ঝিঁঝির ডাক আছে। এসবের ভিতর কেমন শীত শীত করে শুকুর, কেন যে!

 ফকির এবার আকাশের দিকে তাকাল। লক্ষ কোটি আলোকবর্ষের ওপারে কোনও নক্ষত্রের ক্ষীণ আলো প্রত্যক্ষ করল যেন। তারপর বলল, হঠাৎই বলল, বুজলা, এই রকম চাঁদনি রাইত আছিল। বাইতে মার দয়া। খালি আমি বাদে হগলতেরই ওঠছে। দুইজন চইলা গেছে। এমুন একখান অবস্থা, কানবারও পারি না। হায় হায়রে আবার। বাঙ্গিও বুনছিলাম হেইবার। হালায় অইছিলও। বেইনের লাহান অইছিল। রাইতে ক্ষেত পাহারা দিতে অয়। চরে থনে ছিপ নাও লইয়া চোর আহে। ভাও বুঝলে নাও ভইরা বাঙ্গি লইয়া যায়। মন ভালনা। অইলে কী অইব, চকে তো না যাইয়া পারুম না। ভাত খাওন লাগবো না।

থেমে বিড়ি ধরায় ফকির। বড় করে টান দেয়। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আবার পুরনো কথায় ফিরে যায়। রাইতে যাইতেছি খেত পাহারা দিতে। বুচছি বিয়াইনা রাইত। ফকফইক্কা জোছনা। কে জানে তখন নিশিরাইত। বাইতে অসুখ। আমার মন ভালনা, কেডা অত খ্যাল করে। যাইতে যাইতে হেই বিলের মধ্যিখানে ঠিক গোরস্তানডা বাঁয়ে রাইখ্যা দুই কদম গেছি। এমুন সময় দেহি তেনায় চলছেন। আমি হ্যাঁরে পিছে থনে দ্যাখতাছি। পাও দ্যাহা যায় না। খালি চুল। সাত আষ্ট হাত লম্বা তো অইবই। হেই চুল দিয়াই য্যান আটতাছে। আমার ডরভয় নাই। বাইতে অসুখ। তেনারে দেইক্কা মনে হইল কামেল দরবেশ অইবেন। পিছে থনে দৌড়াইয়া গিয়া প্যাচাইয়া ধরলাম। একটা ধাক্কা দিল, তিনচাইর কানি জমিনের হেইধার গিয়া পল্লাম। তয় দুখ পাইলাম না। উইট্টা আবার গিয়া দরলাম। তিনবার এইরকম আছার মারল। হ্যার বাদে মুখ গুরাইল। হায় হায়রে কী নুরানি চেহারা! য্যান পুনিমার চান। কইল, কি চাস? আমি কাইন্দা দিলাম। বাবা, আমার হগল গেছে। কইল, ঘর দুয়ার সাফসুতরা রাখিস, হাঁজের বেলায় যামু। আমি বাইতে আইয়া ঠিক কইরা রাকলাম। হাঁজের পর হেরা আইল সাতজন বুঝলা, সাতজন। কইল, ঘরে আসন দে। আর একজন নিতে আইছি।

হ্যার বাদে সব সাইরা যাইব। জিগাইলাম, বাবা আপনারা কারা? কইল জ্বিন ডাকিনি যুগিনি। আমি ডরাইয়া গ্যালাম। কইল, এমুন এমুন কইরা ডাগবি, আমু। পাইয়া গ্যালাম। বুঝলা, পাইয়া গেলাম। তয় হেই রাতেই আমার ছোড ভাইডা মইরা গেল। ওই যে কইছিল আর একজন নিমু। নিল।

শুকু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল, ফকির থামতেই চমকে ওঠল সে। ফকির আবার বিড়ি ধরিয়েছে। ফোঁস ফোঁস করে টানছে। শুকুর কেমন ভয় ভয় করে। তবু কথা না বললে ভয়টা বেড়ে যেতে পারে ভেবে বলল, অহন কি সাতজনই আছে?

ফকির লম্বা করে বিড়ি টান দেয়। গল গল করে ধোঁয়া ছাড়ে। না চাইরজন আছে। বড় মাহাজন আহে আমাবইশ্যা রাইতে। আর তিন জন তো নাইই। আসামের এক ফকিররে দিয়া দিছি। ইস হেগো কথা আর কইয়ো না। বড় বদরাগী আছিল। ইট্টু কিছুতেই ক্ষেইপপা যাইত। বেদম মাইরধইর করত আমারে। তয় আসামের হেই ফকিরও আমারে দিছে। বাওয়াণডা বান হিগাইছে, ফিরানি হিগাইছে।

 আজ যেন কথা বলার নেশা ধরে গেছে সেজাল খাঁর। চৌদ্দ পনের বছরের বয়েসী ছেলেটার কাছে তামাম জীবনটাই যেন খুলে বলবে। অথচ শুকু এসব শুনতে চায় না। তার ভয় ভয় করে। মনে অয় মানুষটা নিজেই জ্বিন! শুকু জ্বিনের গলা শুনেছে। সেজাল খাঁ আগেও অনেককবার জ্বিন নামিয়েছে তাদের ঘরে। বুড়ির জন্য। শুকু চোখ বুজে গভীর অন্ধকারে বাবার পাশে বসে থেকেছে। জ্বিনের একেক জন একেক স্বরে কথা বলে। শিকড়বাকড় ছুঁড়ে দেয়। দীর্ঘক্ষণ শ্বাস রেখে ফুঁ দেয়। এ ফুয়ে বালা মুসিবত কেটে যায়। সেই জ্বিনদের স্বরের সঙ্গে ফকিরের গলার স্বরের আশ্চর্য মিল। এসব ভেবে আজ কেমন ভয় পেয়ে যায় শুকু।

.

সেজাল খাঁকে নিয়ে শুকু যখন বাড়ি পৌঁছল তখন অপার্থিব নির্জনতা চারদিকে। বেশ খানিকটা রাত হয়েছে। আঙিনায় ওঠতেই ঘেয়ো কুকুরটা কেউ কেউ করে ছুটে এল। শুকু তীব্রস্বরে ধমক দিল কুকুরটাকে। শব্দ পেয়ে গণি বেরিয়ে এল কুপি হাতে। শুকু ঘরের ভিতর ঢুকে বদনায় করে জল নিয়ে এল। ফকিরের পায়ে সেই জল ঢেলে দিতে দিতে বলল, মিয়াবাই, সব আনছো তো?

গণি মৃদু স্বরে বলল, আনছি।

শুকু তারপর চিৎকার করে মাকে ডাকল। ভাবীকে ডাকল। খাওন-দাওন ঠিক কর। শুকুর চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ফকির বাধা দিয়ে বলল, আস্তেধীরে করুক। হপায় তো হাঁজ অইল। তারপর ঘরে এসে সারেঙের আড়াআড়ি শরীরটার পাশাপাশি বসে পড়ল। কুপি হাতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সারেঙকে। পাশে দাঁড়িয়ে মা, গণি, গণির বউ আর শুকু কী এক আশায় বুক বাঁধল।

ফকির মুখ ঘুরিয়ে বলল, আগে আল্লা, ভালা অইয়া যাইব। মাহাজনরা যা যা কয় খেয়াল কইরা রাইখেন। ডরের কিছু নাই।

ফকিরের কথায় একধরনের হতাশা টের পায় শুকু। হাবভাব অনিশ্চয়তার এক ছায়া দুলতে দেখে। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাল্টে যেতে থাকে শুকুর। বাবায় কি তয় বাঁচব না। কান্না পায় শুকুর। গলা ভিজে আসে তবু নিজেকে শক্ত করে বলল, ইট্টু ভালা কইরা দেখেন ফকির সাব। আমার বাজানের যেনো কুনো ক্ষতি না হয়।

ফকির মৃদু হাসে। ঘাবড়াইও না। মহাজনরা আহুক।

 গণি ছোট্ট জলচৌকির উপর ফুল সাজাতে বসে। ছোট্ট চোঙা খুলে বাতাশ ফুলের। রাখে পাশে। বাটিতে চাল ভরে আগরবাতি দাঁড় করায়। কুপির আঁচে মোমের তলা নরম করে জলচৌকির চারদিকে লাগিয়ে দেয়। গ্লাসে রাখে জল, দুধ।

ফকির তারপর ভাত খেতে বসে। গণির বউ ঘোমটার আড়াল থেকেই সাজিয়ে দিচ্ছে খাবার। গোটা গোটা চালের ভাত, বাটি বাটি তরকারি, শুকুও বসেছে পাশে। একবার চৌকির ওপর বাবার শরীরটার দিকে তাকিয়ে ভাতে ঝোল মাখে সে। মা এখন বাবার পাশে বসে আছে। বুড়িটা পাটাতনের ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে থাকলে শব্দ টব্দ করত। জড়ানো স্বরে কথা বলতে চাইত। মিয়াভাইটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। বাবার অসুখটা যেন তার উপর ভর করেছে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার চেহারা শুকু মনে মনে বলল, মিয়াভাইর কি অইল! এত ঘাবড়ানের কী অইছে ফকির যখন আইছে! আর কোনও ডর নাই। বাজানে ভালা হইয়া যাইব।

ভাতের নলা মুখে পুরে শুকু ফকিরের মুখের দিকে তাকায়। ফকির লোকটা ভাবির দিকে অমন করে তাকাচ্ছে কেন। শুকু হা করে ফকিরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। দেখে ফকির হেসে বলল, ও শুকু। ভাবিরে কও ঘোমটা হালাইতে। শরম কী। ভালা কইরা ইট্টু সুন্দর মুখখান দেহি। কথাটা ভালো লাগল না শুকুর। তবু অকারণে হাসল সেও ফকিরের কথা শুনে। চৌকির উপর বাবার পাশে বসা মা আর ভাত বাড়তে বসা ভাবি দুজনই ঘোমটার ভেতর জড়সড় হয়, শুকু বুঝতে পারে।

 গণি বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারে। কথা অন্যদিকে ঘোরায় সে। খাওনের কিছু নাই ফকির সাব। মনে কষ্ট নিয়েন না।

শুনে হাসে ফকির। আরে না না খাওনের মধ্যে কী!

তারপর ভাতগুলো নেড়েচড়ে বলল, কী চাই এইডা, সোনাদীগা? গণির বউ ঘোমটার আড়াল থেকে মৃদুস্বরে বলল, না সোনাদীগা একটু লম্বা অয়। এইডা লক্ষীদীঘা।

ফকির মুগ্ধ চোখে গণির বউয়ের মুখের দিকে তাকায়। কতা দেহি ময়না পাখির লাহান, কয়না ক্যা।

গণির বউ হাসে। কথা বলে না।

দরোজা ঠেলে হাজামবাড়ির ছেলে দুটো এল তখন। রবা, নবা। মানিকজোড় ফকিরকে সালাম দিয়ে দ্রুত হাতে তামাক সেজে ফেলে তার। ফকির মুখ মুছতে মুছতে বলল, টান টান। রবা নারকেলের হুঁকায় টেনে টেনে ধোঁয়া তোলে। শেষে বড় বড় কয়েকটা টান দিয়ে ফকিরের হাতে দেয়, ধরেন।

ফকির কপালে হাত ছুঁয়ে ছুঁকা ধরে তারপর টানতে থাকে। লোকটার সবকিছুতে কেমন গা ছাড়া ভাব। রোগী মরে যায়, অথচ সে নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের কাজকর্ম করে যাচ্ছে। দেখে শুকু ভেতরে ভারী বিরক্ত হয়। হালায় কেমুন ফকির! মানুষ মইরা যায় আর ওই হালায় তামুক খায়।

রবা বলল, হোনছেননি ফকিরসাব, আমিন মুন্সী কইলাম মইরা গেছে।

ফকির হুঁকা থামিয়ে বলল, কবে?

কাইল। নাইতে নামছিল। আর উডে না দেইক্কা হ্যার পোলায় নাইম্যা উডাইছে। দ্যাহে শ্যাষ অইয়া গেছে।

আহারে একটা ভালামানুষ গ্যাল।

রবা বলল, মুন্সী বলে কুরান শরিফের ভিতর টাকা পাইত।

হুনছি তো। হকালে উইট্যা কুরান শরীফ খেললেই পাঁচ টাকার একখান নোট পাইত। আপনেও বলে কী পাইছিলেন?

হেই কতা আর কইয়া কী অইবরে ভাই। কপাল দোষে হারাইছি।

ওদের কথা শুনতে শুনতে শুকু ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল। হাত পা নিসপিস করছে। তার চোখ ভেঙে আসছে ঘুমে। ফকির অহনও বইতাছে না ক্যা। ফকির বলল, মাহাজনরা কইল ঘরের উত্তর পশ্চিম কোণায় পাবি। কেঐরে কইতে পারবি না। পরদিন গুমথনে উইট্টা দেহি হেই জাগার মাডি আ কইরা রইছে। বিতরে চকচক করতাছে সোনা। আমার তহন উস গেন নাই, দেইক্কা মাতা গুইরা গ্যাছে। মনেই অইল না মাহাজনরা নিষেধ করছে কেউরে কইচ না। আমি বাড়ির হগলতরে ডাইক্কা আনলাম। দেহাইলাম। রইল না। রাইতে মাহাজনরা আইল। আমারে কয়, তৈতুইল গাছের নিচে যা। গ্যালাম। একটা থাবড় মারল, ঘুইরা পইড়া গ্যালাম। যহন উস অইল দেহি হকাল অইয়া গ্যাছে। আমার মুহের লৌ পইড়া মাডি ভিজ্জা গ্যাছে। থাবড়ের চোডে দুইডা দাঁত নাই। ক এমুন বেক্কেল অয় মাইনষে!

গণি ওঠে এসে ফকিরের পাশে বসল। হাত কচলাতে কচলাতে বলল, ফকিরসাব রাইত অনেক অইছে। হগলতে জিমাইতাছে। বহেন ইবার।

ফকির হুঁকা ছেড়ে সোজা হয়। রবা নবা তার দুপাশ থেকে সরে গিয়ে চৌকির গা ঘেঁষে বসে। শুকু চোখ ডলতে থাকে। ঘুম আসছে তার। তবু সোজা হয়ে বসে। কুপির আলোয় দেখে ভাবি পাটাতনের ওপর বুড়ির পাশে ছোট হয়ে শুয়ে। হাত পা মুখ সব শাড়িতে ঢাকা। মা তো সন্ধ্যে থেকেই বাবার পাশে বসা। এখন ঠায় বসে আছে। ক্লান্তি নাই। ফকির গলা খাকারি দিয়ে আসনের সামনে স্থির হয়ে বসে। বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে শুরু করল। ঘরের ভেতর কয়েকজন মানুষের শ্বাস ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। খুব খেয়াল করলে বাইরে প্রকাণ্ড পৃথিবীতে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। চরাচর বিশাল স্তব্ধতায় ডুবে গেছে। বাতাসের চলাচল বড় ক্ষীণ, টের পাওয়া যায় না।

ফকিরের ধ্যান ভাঙে অনেকক্ষণ পর। এবার নিয়মমতো সাবধানবাণী উচ্চারণ করে সে। কেঐ হাকিহুকি করিস না, আসাআসি করিস না। বায়ু ছাড়িচ না তাইলে কইলাম রখ্যা থাকব না। গণি আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এবার মোমবাতি জ্বালিয়ে কুপিটা ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিল সে। ঘরের ভেতর এখন নিঃঝুম শান্ত একটা ভাব। আগরবাতির ধোঁয়া আর তাজা ফুলের গন্ধ মিলেমিশে চমৎকার একটা সুবাস তৈরি করেছে। কীরকম পাকপবিত্র ভাব ধরেছে ঘরটা। শুকুর চোখের আলগা ঘুমটা লাগতে না লাগতেই কেটে গেছে।

ফকির প্রথমে গুনগুনিয়ে, পরে খোলামেলা সুরে দরুদ পড়তে আরম্ভ করে। তার সাথে রবা নবা আর সারেঙের দুই ছেলে গলা মেলায়। চৌকির ওপর সারেঙের ছেলেমেয়ের মাও গুনগুন করে। মোমের ম্লান আলোয় জবুথবু হয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর ছায়া লম্বা কিংবা তেরছা হয়ে টিনের বেড়ার ওপর ভৌতিক সব অবয়ব তৈরি করেছে। ক্রমশ উচ্চগ্রামে ওঠে লোকগুলোর স্বর। নেমে যায়। আবার ওঠে। আবার নামে। তারপর একসময় থেমে যায়। তখন আবার স্তব্ধতা। ফকিরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে টুকটুক করে পাঁচটা টোকা দেয় জলচৌকির আসনে। তারপর মুর্শিদী ধরে।

আমার এই আসরে আইস দয়ালচাঁন

আমার এই আসরে আইস মুর্শিদাচাঁন।

ফকিরের সাথে গলা মেলায় কেউ কেউ। গানের ফাঁকে চট করে থাপ্পড় মারে গায়ে, মশা তাড়ায়। বাইরে রাত ক্রমশ গভীর হতে থাকে।

একটানা অনেকক্ষণ চলে গান। তারপর থামে। ফকির বিড়বিড় করে আবার মন্ত্র পড়ে, টুকটুক করে আবার টোকা দেয়। দরোজা খুলে বাইরে যায় রবা নবা।

শুকুও যায়। উঠোনের কোণে বসে প্রশ্রাব করে। সেই ফাঁকে টের পায় বাইরে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। ঝাঁকড়া আমগাছটায় ঝুপসি অন্ধকার স্থির আছে। শুকুর কেমন ভয় ভয় করে। জ্বিনেরা এসে বসেনি তো ওখানে।

ঠাকুরবাড়ির উঁচু দেবদারু গাছে কোরলে বাগ মধ্যরাত ঘোষণা করে। অবিরাম ঝিঁঝি ডাকছে। চারদিকে শুক্লপক্ষের চাঁদ কখন নেমে গেছে একপাশে।

মাহজানরা এত দেরি করতাছে ক্যান আইজ! শুকুর আবার বাবার কথা মনে হয়। নড়াচড়া নেই মানুষটার। তয় কী?

ওরা ঘরে ফিরে আসার পর আবার মুর্শিদী ধরে ফকির।

তোমায় কোন্ বনে যাইয়া লাগুল পাব, দয়াল রে আমার।
কোন্ বনে যাইয়া লগুল পাব।

শুকুর চোখ ভার হয়ে আসে ঘুমে। গণির গায়ে ঢলে পড়ে সে। গণি ধাক্কা দেয়। সেই ধাক্কা খেয়ে আবার সোজা হয়ে বসে। আবার গান ধরে। গলা দিয়ে স্বর ওঠতে চায় না। তবু গায়।

নিদানকালে একবার দেখা দিও, দয়াল রে আমার।

ফকির তখন বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসে। সেই ফাঁকে রবা নবা ফিসফাস কথা শুরু করে। এইবার আইব র‍্যা। ফকির বাইরেন্থনে জ্বিনেগ লগে কতা কইয়াছে।

শুনে অকারণে রবা নবার ওপর রাগ করে শুকু, ঐ আজামের পোরা হাকিহুকি করস ক্যা। ফকির না না করছে। এমুন করলে আমাগ বাড়ি হুইতে আবি না।

রবা নবা হাসে।

শুকু তারপর গণিকে বলল, মিয়াবাই, অগ কথা হইতে না কর।

গণি পিনপিনে গলায় বলল ঐ ব্যাডারা, কতা কইস না।

ফকির এখন খুব গম্ভীর। গুম হয়ে আছে আসনের সামনে। মোমের আলোয় তার চোয়াড়ে মুখ অচেনা মনে হয়। আসনে পর পর তিনবার পাঁচটা করে টোকা মারে সে। তারপর দ্রুত ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দেয় মোমবাতিগুলো। অন্ধকারে একাকার হয়ে যায় ঘর। শুকু টের পায় তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা সশব্দে ধাক্কা মারছে। যেন প্রকাণ্ড একটা কালো বেড়াল লাফিয়ে নেমেছে ঘরের ভেতর। রক্তের চলাচলে একরকমের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। শুকু শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।

সবাই গুন গুন করে দরুদ পড়ছে, ঠিক তখনি টিনের বেড়ায় প্রচণ্ড শব্দ হল। যেন অমিত শক্তিধর, প্রকাণ্ড কোনও প্রাণী বেড়া ভেঙে প্রবেশ করছে ঘরের ভেতর। শুকু ভয়ে সিঁটকে যায়। গণির গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে। এত সাহসী রবা নবা পর্যন্ত সরে বসেছে।

তখন অলৌকিক স্বরে সালাম দেয় জ্বিনেরা। পরপর তিনবার, তিনরকম শব্দে। বোঝা যায়, তারা তিনজন এসেছে।

একজন বলল, ও গণি মিয়া, কী উঁইন্যে স্মরণ করছ বাঁবা।

গণি পিনপিনে গলায় বলল, কী কমু, আপনে তো হগলই জানেন বাবা।

আল্লা বুলো! তার পর দীর্ঘক্ষণ ধরে ফুঁ দেয়ার শব্দ। সেই ফুয়ে ঘরের ভেতর অদ্ভুত এক শীতলতা চলে আসে। দারুচিনি এলাচ আর কাঁচা লবঙ্গের গন্ধে মম করে চারদিক। হাঁত পতো। হাঁত পাঁতো গণি মিয়া।

অন্ধকারে হাত বাড়ায় গণি। শুকু পাশে বসে টের পায়, টুপ করে কিছু একটা খসে পড়েছে গণির হাতের ওপর। গণি আস্তে করে বলে, পাইচি বাবা।

আবার দীর্ঘক্ষণ ধরে সেই ফু। মিহি স্বরের কথায় আল্লা বুলো, আল্লা বুলো।

 তারপর অপেক্ষাকৃত স্পষ্ট স্বর: কাঁলো জীবের দুধ আর জোঁড়া পুঁল্প, বুচ্ছ, গৃহণ করাঁইবাঁ গৃহণ, আল্লা বুলো।

 অন্য একটি স্বরে বলল, কন্যা ও কন্যা কন্যাঁ কি চাও, চাঁও কি।

 শুকু বুঝতে পারে কথাটা মাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। মা একটু গলা খাঁকারি দিল। চৌকির ওপর বাবার পাশে বসেই ভেজা ভেজা স্বরে বলল, হ্যায় যেন ভাল হইয়া যায় বাবা।

আল্লা বোলো। আল্লা বোলো।

পাখির শিসের মতো শব্দে ফুঁ আসে আবার। ঘরের ভেতর মিঠে গন্ধ ভাসে। তঁয় যাঁই বাবারা, যাঁই কন্যা। আসঁসাঁলামালাইকুম।

তারপর টিনের বেড়ায় প্রচণ্ড শব্দ। ঘরের ভৌতিক পরিবেশ কেটে যায় মুহূর্তে।

তারপর কুপি জ্বালায় গণি। রবা নবা হাই তোলে। শুকু ওঠে দাঁড়ায়। ফকির তখন সেজদার ভঙ্গিতে আসনের সামনে পড়ে আছে। মাহাজনরা এসে ফকিরের পিঠে বসে কেউ, কেউ আসনে বসে। সেই বিপুল ভার বহন করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ফকির। আসনের ওপর রাখা গেলাসের জল ছিটিয়ে তবে তার জ্ঞান ফেরে।

কুপি জ্বেলে গণি প্রথমে আসন থেকে গেলাসের জল ছিটিয়ে দেয় ফকিরের গায়ে। রবা নবা দরোজা খুলে বাইরে গেছে। শুকু চৌকির ওপর বাবার পাশে ওঠে বসেছে। মা তেমনি একঠায় বসে আছে বাবার সামনে। কুপির আলোয় বড় বিষণ্ণ দেখায় তার মুখ।

ঠিক তখুনি হোস করে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে ফকির। তারপর ওঠে বসে। ওঠে প্রথমেই আসন হাতড়ে টাকা আড়াইটা কোর্তার পকেটে পুরলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, রবা, তামুক হাজা।

ওরা ফিরে এসেছে ততক্ষণে। রবা দুটো টিকা বের করে দিয়েছে নবার হাতে। পোড়া দে।

 নবা কুপির আগুনে চিমটা দিয়ে টিকা পোড়াচ্ছে।

গণি বলল, তেনারা আইজ তিনজন আইছিলেন।

ফকির জবাব দিল, হ।

রবা কল্কেতে টিকা ভরে ফুঁ দিতে দিতে বলল, কী নাম জানি তেনাগ?

ডাকিনি জুগিনী মধুমতি কণ্ঠমালা। আইজ কণ্ঠমালা আহে নাই। হেই জটঅলা। পা তমুক লম্বা জট। হাকরাইনের রাইতে আহে। জট দিয়া ঝারে।

ফকির কথা বলছে, বোটকা গন্ধ ওঠে ঘরের ভেতর। সেই গন্ধে নাক কেঁচকায় শুকু। বুড়ি পেচ্ছাব করে দিয়েছে। কী গন্ধ! সেয়ানা মেয়ের পেচ্ছাবে গন্ধ হবে না। যাক। ভালোই করেছে, এখন পেচ্ছাব করেছে। মাহাজনরা থাকলে করলেই হয়েছিল। ফকির এখন কথায় মশগুল। ওসব খেয়াল করার সময় নেই তার। গণি গেছে পুকুর ঘাটে। আসনের ফুল জলে ভাসিয়ে দিতে হয়। মাটিতে পড়লে গৃহস্থের অমঙ্গল।

রবা নবা অনর্গল বক বক কর যাচ্ছে ফকিরের সঙ্গে।

ফকির জিজ্ঞেস করল, তরা হেনে করস কী কী আজামের পোরা।

খেত খোত কোবাই। মাতবরের গাছ ফাড়ি।

বাপে কাম করে না।

করে। মাসে দুই মাসে এক আধটা। চোখে ছানি পইড়া গ্যাছে। মাইনষে নিতে চায় না। কান্দিপাড়ার খনকাররা কাম করইছিল। পোলাডার গাও আর হুগায় না। মাইনষে গাইল পারে।

শুকু ওসব খেয়াল করে না। ঘরের কোণে জালালী দুটো বকবকুম শুরু করেছে। কুকুরটা উঠোনে শুয়ে কুঁই কুঁই করছে। শুকুর বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। দুটো জালালী রোজ এসে বসত ঘরের চালে। বাবা দেখে বলল, আশ্রয় চায় সেদিনই একটা পুরনো টুকরি বেধে পশ্চিম কোণে, বারন্ত চালার সঙ্গে, জালালী দুটো বাসা নিল। ঘটনাটা ভাবতে অবাক লাগে। শুকুর বাবায় কি পশুপাখির ভাষাও বুঝত।

গণি ফিরে আসার পর ফকির বলল, দিয়াইছ?

হ।

গণি খোলা দরোজা বন্ধ করে না। বলল, ব্যাপারিগ গলার আওয়াজ পাইলাম। আডে যাইতাছে।

হকাল অইয়া গেছে। ঘুমাইবেন না?

ফকির মাথা নাড়ে। না, ঘুমান যাইব না। আডে যামু।

গণি তখন আসন থেকে বাতাসা নিয়ে বিলিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। রবা নবাকে দেয়, শুকুরকে দেয়, মাকে দেয়। নিজে বাকিটা রেখে দেয় বউর জন্যে। ফকির আসনের বাতাসা খায় না। মাহাজনদের নিষেধ।

ফকির তারপর হুঁকা টানতে টানতে বলল, গণি মিয়া, তোমার বাপেরে আসনের দুধ খাওয়াও। জব খুলব।

 ফকিরের কথায় ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যায় শুকুর। ফ্যাল ফ্যাল করে বাবার দিকে তাকায় সে।

বাবা কেমন টানটান হয়ে শুয়ে আছে।

গণি আসনের ওপর থেকে দুধের গেলাসটা নিয়ে মার হাতে দেয়। হাঁড়িপাতিল খুঁজে একটা চামচও দেয়। মা চামচে করে দুধ খাওয়াতে শুরু করে বাবাকে। গলায় পৌঁছায় না সেই দুধ। কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।

শুকু দেখে বাবা কেমন নিস্তেজ, ঠাণ্ডা মেরে আছে। চোখ বন্ধ, মাথা কাৎ হয়ে পড়েছে বালিশ থেকে। হাত-পা টান টান।

চৌকির ওপর থেকে মা গণিকে ডাকে। গণি তুই আইয়া ইট্টু আ করা তো তর বাপেরে, আমি পারি না। দুধ পইড়া যায়।

গণি চৌকির ওপর ওঠে বাবাকে হা করাতে ব্যস্ত হয়। কিন্তু বাবার মুখে হাত ছোঁয়াতেই চমকে ওঠে সে। মাছের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে শরীর। গণির মুখে কথা সরে না। বাবার গায়ের চাদর সরিয়ে দ্রুত বুকে পেটে হাত দেয় সে। মা ব্যগ্র কণ্ঠে বলে, কী, কীরে গণি?

বাইরে তখন অন্ধকার রাত ফিকে হয়ে আসছে। পাখপাখালির ডাকে পৃথিবী ক্রমশ জেগে ওঠেছে। শুকুর বুকের ভেতরটা ধুগবুগ করে। হৃৎপিণ্ডের শব্দ পাল্টে যেতে থাকে। ঠিক তখুনি ডুকরে কেঁদে ওঠে গণি। মা, মাগো, হ্যায় নাই মা, হ্যায় নাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *