নিরন্নের কাল

নিরন্নের কাল

পাকা ধানে রং কেমুন অয় বুবু?

সোনার লাহান, গেণ্ডাফুলের পাপড়ির লাহান।

ঘেরান অল না?

অয় না আবার! সাই ঘেরাই অয়। কাতি আগন মাসে ধান পাকলে ঘেরানে দেশ গেরাম ভইরা যায়। রম রম করে। ধানের ঘেরানে দেশগেরামের মানুষ যায় জোয়াইরা মাছের লাহান পাগল অইয়া।

পাগল অইয়া কী করে?

দিনরাইত ধানক্ষেতে পইড়া থাকে। গান গায় আর ধান কাড়ে। গান গায় আর ধানের বোজা আইন্না বাড়ির উড়ানে হালায়। ছোড গিরস্তরা হারাদিন ধান কাইট্টা হাইঞ্জাবেলায় বোঝা বাইন্দা বাড়িতে আনে। তারবাদে বিয়াইন্না রাইতে উইট্টা হেই ধান পাড়ায়। দুইআতে দুই খান চিকন বাঁশের লাডি লইয়া, পায়ের নিচে ছোড ছোড ধানের আডি, নাইচ্চা নাইচ্চা ধান পাড়ায়। বেইল উটতে না উটতে ধান পাড়ান শেষ। আগইল ভইরা, ছালা ভাইরা হেই ধান ঘরে রাইখা আবার যায় ধানক্ষেতে। আগের দিনে ছোড গিরস্তগো ক্ষেতের ধানও একদিনে কাডা অইত না।

 আর বড় গিরস্তগো?

হেগ কতা আর কইস না। পুরা মাস লাইগা যাইত হেগ ধান কাড়া শেষ হইতে। শয়ে শয়ে মাইনষে কাইট্টাও মাসের আগে শেষ করতে পারত না। আর বড় গিরস্ত বাড়ির ধান তো মাইনষে পাড়াইয়া কুলাইতে পারত না গরু দিয়া মন দেওন লাগত।

তারবাদে?

তারবাদে হেই ধান ডোলে ভইরা গিরস্তরা হুইয়া বইয়া দিন কাডাইত গান গাইত আমোদ ফূর্তি করত আর তামুক টানত।

আমাগো ধানক্ষেত আছিল না বুবু? আমাগো কুনোদিন ধান অইত না?

অইত না আবার! কত ধান যে অইত! দীনুরে তুই কিচ্ছু দেখলি না। পোড়া কপাল লইয়া পয়দা হইছচ। তর জন্মের আগে, আমি তহন তর লাহান না, তর থিকা আরও ছোড অমু, কাউন্না বিলে ম্যালা ধানের জমিন আছিল বাজানের হেই জমিন আমি কুনদিন চোকে দেহি নাই বাজানের মুকে হুনছি। বাজানরে তখন দেকতাম বিয়াইন্না রাইতে ঘুম থিকা ওডে। উইট্টা এক বাসন পান্তা লইয়া বইত। হেয় পান্তা খাইত আর মায় নাইরকলের উক্কায় তামুক সাজত পান্তা খাইয়াই এক ছিলিম তামুক খাইত বাজানে। হেরবাদে মাজায় লাল গামছাখানা বাইন্দা ঘর থনে বাইর অইত যাইত বিলে। কাউন্না বিলে। যাওনের সময় মায় কইত, বেইল থাকতে আইয়া পইড় বুলবুলির বাপ। দেরি কইর না। বাজানে কইলাম আইত না। দোফরে সোনাদিগা চাউলের ভাত রাইন্দা, কাজলি মাছের ঝোল রাইন্দা মায় বইয়া থাকত। বাজানে হেই ভাত খাইত রাইত দোফরে আয়া।

কাজলি মাছ কেমুন বুবু?

হায়রে পোড়া কপাল। কাজলি মাছ তুই দেহচ নাই দীনু?

না বুবু।

কাজলি মাছ দেখতে পাবদা মাছের লাহান। তয় পাবদা মাছের লাহান বড় না চেপটা না। আরো ছোড আরো চিকন ফকফইক্কা সাদা। খাইতে বহুত স্বাদ! একখান মাছ দিয়া দুই বাসন ভাত খাইতে পারবি তুই।

এই কথা বলে বুলবুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলির চোখের ওপর ভেসে উঠল বাসন ভর্তি সাদা মুক্তোদানার মতো ফুরফুরে ভাত। বাটিভর্তি কাজলি মাছের ঝোল। রান্নাঘরে বসে বুলবুলি আর দীনু গাপুসগুপুস করে ভাত খাচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখতে দেখতে বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে ওঠল বুলবুলির। কতকাল অমন বাসনভর্তি ভাত দেখে না তারা! পেটপুরে ভাত খায় না! পেটপুরে ভাত খাওয়ার যে কী স্বাদ দীনু তা কোনওদিন জানলই না! জন্মে তো ধানের ক্ষেতই দেখল না। পাকা ধানের রং কেমন হয় জানলই না। অথচ দীনুর সাত আট বছর আগে জন্মে কত কী দেখেছে বুলবুলি! সুখের দিন ছিল তখন। বছরভর গোলা ভরা ধান থাকত বুলবুলিদের ঘরে। ঘরের কোণে বিশাল মটকা ভরা থাকত মণকে মণ সরু লালচে চাল। গোয়ালে ছিল দুধের গাই। ভোরবেলা দুধ দোয়ালে কাঁচা দুধের মিঠেল গন্ধে ভরে যেত বাড়ি। কী ঘন, কী স্বাদের দুধ। বাড়ির সঙ্গে ছোট্ট পুকুরটি ভরা থাকত মাছে। কই, শিং, শোল, গজার, মাগুর, ফলি,রয়না, কত পদের মাছ যে ছিল পুকুরে! এক দুবার ঝাঁকি জাল ফেললেই দুবেলার মাছের বন্দোবস্ত হয়ে যেত।

তখন কার্তিক-অঘ্রাণ মাসে খুব শীত পড়ত। একদিকে শীত আরেক দিকে পাকা ধানের ম ম করা গন্ধ। ভোরবেলা সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রোদের আঁচে গিয়ে বসলে কী যে আরাম হত! কী যে সুখের দিন মনে হত একেকটি দিনকে!

সেই সুখের দিন কি আর কখনও ফিরে আসবে!

দীনু বলল, বুবু খিদা লাগছে।

বুলবুলি একবার ভাইটির মুখের দিকে তাকাল। রোদে পোড়া ম্লান মুখে হাসল। খিদা লাগলে খিদার কথা মনে করতে অয়না মিয়াভাই।

বুবুর কথা শুনে দীনু খুবই অবাক হল। অনাহারী শীর্ণ চোখ তুলে বুলবুলির দিকে তাকাল। করুণ দুঃখী গলায় বলল, তয় কি করতে হয়?

বুলবুলির বুকের ভেতরটা আবার হু হু করে তার পেটেও তো খিদে। কেঁচোর দলার ওপর তীব্র রোদ পড়লে কেঁচোরা যেমন আকুলি-বিকুলি করে, বুলবুলির পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি তেমন করছে। তীব্র রোদের মতো রাক্ষুসে এক খিদে ঢুকে আছে পেটের ভেতর। এই খিদে তাড়াবার উপায় বুলবুলির নেই।

দীনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুলবুলি বলল, খিদা লাগলে খালি অন্য কথা মনে করতে অয়।

 শুনে দীনু বলল বুলবুলির মুখের দিকে তাকায় না, কথাও বলে না। ক্লান্ত পা ফেলে ফেলে দুঃখী ভঙ্গিতে হাঁটে।

মাঠময় এখন মেহেদি রঙের রোদ পড়ে আছে। শস্যহীন খাঁ খাঁ বিষণ্ণ মাঠ। তীব্র খরায় শস্যচারা ঘাস, আগাছা পুড়ে বিবর্ণ হলুদ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও নিশ্চিহ্ন। ঠনঠনে সাদা মাটি উজবুকের মতো পড়ে আছে। পাকা ধানের রং এবারও চোখে দেখবে না দেশ গেরামের মানুষ।

বুলবুলি বল, ল কামার বাড়ি যাই দীনু।

দীনু আনমনে বলল, ক্যা?

কামার বাড়ি গিয়া কচুর লতি তুইল্লা আনি।

পাওয়া যাইব?

যাইতে পারে।

মাইনষে তুইল্লা লইয়া যায় নাই।

বেবাক কি আর নিছে!

তারপর একটু থেমে বুলবুলি বলল, বিচরাইলে মনে অয় পাওয়া যাইব। ল।

দীনু ক্লান্ত এবং বিরক্তির গলায় বলল, আমার হাঁটতে ভাল্লাগে না।

ভাইটিকে বুলবুলি তারপর বেশ একটা লোভ দেখাল। কামার বাড়ি গয়া গাছ আছে দীনু।

ম্যালা গয়া গাছ আছে। ল যাই গয়া পাইলে দেখবি খাইতে কী আরাম!

বুলবুলির কথা শুনে দীনুর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে। হাছা?

হ।

তয় লও বুবু। তাড়াতাড়ি লও।

অল্পবয়সী অনাহারী মানুষ দুটো তারপর মাঠ ভেঙে হাঁটতে থাকে।

দীনু বলল, বুবু মায় আইব কুসুম?

বুলবুলি একবার আকাশের দিকে তাকাল। ভিক্কা কিছু পাইলেই আইয়া পড়ব।

বাজানে?

বাজানে তো টাউনে গেছে। টাউনে কামকাইজ করব, তারবাদে চাউলের বস্তা কান্দে লইয়া ফিরা আইব।

চালের কথা শুনে কী যে খুশি হয় দীনু। চোখ দুটো আবার চকচক করে তার। হাছা?

বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে বুলবুলির। ময়লা নোংরা ছেঁড়া আঁচলে ঘষে ঘষে মুখ মোছে সে। আকাশের দিকে তাকায়। রোদও ওঠেছে! বেজায় রোদ। আকাশ ঝিমঝিম করছে। রোদে। মাথার ঘিলু পর্যন্ত টলমল করে। এই রোদে মা বেরিয়েছে ভিখ মাগতে। এ গাঁ ও –গাঁ ঘুরছে দুমুঠো চালের আশায়। এক মালসা ফেনের আশায়। বাপটা ঘুরছে শহরে রাস্তায় রাস্তায় কাজ খুঁজছে।

মা বাবার কথা ভেবে কী রকম এক কষ্ট যে হয় বুলবুলির! পেটের খিদে মুহূর্তের জন্যে ভুলে থাকে সে।

দীনু বলল, এখখান কিচ্ছা কও বুবু।

বুলবুলি চমকে ওঠে। কী কমু?

কিচ্ছা। কিচ্ছা কইতে কইতে হাঁটলে পথ তাড়াতাড়ি ফুরাইব। কোন ফাঁকে কামার বাড়ি যামুগা উদিস পামু না।

কিয়ের কিচ্ছা কমু?

ধানের কিচ্ছা কও বুবু। মাছের কিচ্ছা কও।

দীনুর কথা শুনে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুলবুলি। চোখ তুলে আরেকবার তাকায়। আকাশের দিকে। সূর্যমাখা নাড়ার পারার মতো জ্বলছে। কী তেজ! শীতকালের মাঠে, তুলে নেয়া ফসলের মাঠে খড়নাড়া স্কুপ করে সন্ধেবেলা আগুন ধরিয়ে দিত কৃষাণরা, রাতভর জ্বলত সেই আগুন। রাতেরবেলা সেই আগুনের তাপে উষ্ণ হয়ে থাকত দেশ গেরাম। অঘ্রাণ মাসের বাঘা শীত টের পেত না লোকে। সূর্যের তেজখানা এখন মনে হচ্ছে তীব্র শীতের রাতে মাঠময় জ্বলা খড়নাড়া। রোধের তাপখানা খড়নাড়ার উত্তাপের মতন।

ঘামে ঘাড়গলা চুটপুট করছে বুলবুলির। আঁচলে ঘষে ঘষে আবার ঘাড়গলা মোছে সে। দীনুর মুখটাও মুছিয়ে দেয়। বড় মাতায়, বড় ভালোবাসায়।

শাড়িখানা ছিঁড়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে বুলবুলির। বাড়ন্ত শরীর এই শাড়িতে ঢাকা পড়ে না তবু যত্ন করে শরীরখানা ঢেকে রাখে বুলবুলি। পুরুষমানুষ দেখলে জড়োসড়ো হয়ে থাকে। মা শিখিয়েছে পুরুষজাত লোভীজাত। মেয়েমানুষের শরীর দেখলে মাথার ঘামে কুত্তা পাগল।

সামনে বিশাল একখানা মাঠ। শস্য নেই, ঘাস আগাছা নেই। মাঠের সাদা কঠিন মাটি চকচক করে। দুপুরবেলা দূর কোন প্রান্ত থেকে উড়ে আসে হু হু করা এক হাওয়া। রোদে সয়ে আসে বলে হাওয়ায় নেই শীতলতা। গা তো জুড়োয়ই না, উল্টো গরম। মাঠময় ঘুরে ঘুরে বয়ে যায় হাওয়াটি। ধুলোর চিকন একটি রেখা ওড়াউড়ি করে। দেখে কেমন আনমনা হয়ে যায় বুলবুলি। মাঠের ওপারে গাছপালায় অন্ধকার হয়ে থাকা কামার বাড়ি গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে ভাঙা দরদালান চোখে পড়ে। কামাররা এখানে কেউ নেই। পুরোনো পেশায় পেটের ভাত জোটে না দেখে গ্রাম ছেড়ে যার। যেদিকে সুবিধে চলে গেছে। বাড়িটা ছাড়া পড়ে আছে ম্যালা দিন। গাছপালা এবং আগাছায় জঙ্গল হয়ে আছে। জঙ্গলে কচুর লতি, মুখি এসব পাওয়া যায়। দেশগেরামের মানুষ সব লুটেপুটে নেয়। বুলবুলিও অনেকবার নিয়েছে। এখন আর পাওয়া যায় না। দেশে অনাহার। কচুর লতি, মুখি এ সব তো দূরের কথা, মাঠের পাশে অবহেলায় জন্মে থাকা সেচি শাকটা পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অনাহারী মানুষ সব তুলে নিচ্ছে।

বুলবুলি জানে কামার বাড়ির ঝোপজঙ্গল তন্ন তন্ন করেও কিছু পাওয়া যাবে না। তবু যাচ্ছে, দীনুর জন্যে যাচ্ছে।

দীনুটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। সকালবেলা মা ভিক্ষেয় বেরুতেই দীনু বলল, লও বুবু আমরাও যাই।

বুলবুলি ভিখ মাগতে যেতে পারে না। মার বারণ। বুলবুলির যে বয়স যে শরীর, ভিখ মাগতে গেলে বিপদে পড়বে। লোকে দুচার মুঠো চাল কিংবা আধলিটা সিকিটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে দরজা আটকাবে। পুরুষজাত লোভীজাত।

মার মুখে পুরুষমানুষের এই স্বভাবের কথা শুনে বুলবুলি খুব ভয় পেয়েছে। বুকের ভেতরটা কেঁপেছে তার। না খেয়ে মরে গেলেও ভিখ মাগতে যাবে না বুলবুলি।

কিন্তু দীনু এসব বোঝে না তার এসব বোঝার কথা নয়। এই বয়সী বালক মেয়েমানুষের শরীরের জন্যে পুরুষমানুষের লোভের কী বুঝবে!

সকালবেলা দীনু বলেছে, লও বুবু আমরাও যাই।

শুনে ম্লান মুখে হেসেছে বুলবুলি। কই?

খরাত করতে।

মাইনষে পোলাপানগো খরাত দেয় না।

ক্যা?

কী জানি।

শুনে চুপ করে গেছে দীনু। মুখে ভারি দুঃখের একটা ছায়া পড়েছে তার।

তারপরই দীনুকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে বুলবুলি। বেরিয়ে গ্রামের এদিকওদিক হেঁটে সময় কাটিয়েছে। তারপর দুপুরে মুখে মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মাঠের কিনারায়। দীনু বলল, কও না বুবু।

বুলবুলি চমকে ওঠল। কী কমু?

ধানের কিচ্ছা কও। ভাতের কিচ্ছা কও।

দুঃখী বিষণ্ণ চোখে একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায় বুলবুলি। ম্লান হাসে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাগো কাউন্না বিলের জমিনের ধান পাকত আগন মাসে। বাজানের মুখে হুনছি আগন মাসে বিলের কিনারে গিয়া খাড়াইলে দেহা যাইত চাইরদিকে খালি পাকা ধান, পাকা ধান। সোনার লাহান বরণ সেই ধানের। গেন্দাফুলের পাপড়ির লাহান বরণ। বিয়ানবেলা বিলে যহন রইদ পড়ত সেই রইদে বিলের পাকা ধান সোনার লাহান ঝকমক ঝকমক করত। বাতাস অইলে গাঙ্গের ঢেউয়ের লাহান দোল খাইত। বাজানে কইত বিলের কিনারে খাড়াইলে বুকটা তার ভইরা যায়। ফূর্তিতে আমুদে ভইরা যায়।

দীনু অবাক গলায় বলল, তারবাদে?

হেই পাকা ধান মুখে কইরা কাইটা নিত টিয়ায়, বাইয়ে। মাইট্টা ইন্দুরেও গদে ভইরা রাখত বচ্ছরের ধান। ধান কাডা অইয়া গেলে ইন্দুরের গদের ধান উড়াইয়া আনত গরিব মাইনষে। ইন্দুরের গদের ধানে তাগো দুই তিন মাসের খাওন অইয়া যাইত।

বুলবুলি একটু থামল। খিদেটা পেটের ভেতর এমন হয়েছে, কথা বলতে ইচ্ছে করে না। কীরকম এক ক্লান্তি, অবসাদ। কিন্তু দীনু আছে সঙ্গে। কথা তো বলতেই হবে। কথা। বলে খিদে ভুলিয়ে রাখতে হবে দীনুর।

বুলবুলি বলল, বুঝলি দীনু, মাইট্টা ইন্দুরের গদে আবার সাপ গিয়া থাকত। জাইত সাপ, দাঁড়াইস সাপ। ধানের লেইগা গদে হাত দিলে সাপে কাটত। হাজামবাড়ির মজিদরে তো সাপেই কাটছিল।

দীনু বলল, কেমনে! কেমনে সাপে কাটল!

গেছিল ইন্দুরের গদ থিকা ধান উডাইতে। একছালা উডাইছে এমুন সুময় উদ্দিস পাইল হাতের বুইড়া আঙ্গুলে খাজুর কাড়ার লাহান কী একটা জানি বিনদা গেল। কী বিষ! গদ থিকা হাত আর উডাইতে পারে নাই মজিদ। ইন্দুরের গদের মদ্যে হাতখানা রইল, মজিদ গেল মইরা।

সাপের গল্প ভালো লাগল না দীনুর। সে বলল অন্য কথা। আমাগো ডোল আছিল বুবু? বুলবুলি বলল, কচ কী! আছিল না!

কয়ডা?

চাইর পাঁচটা আছিল।

মলনের গরু আছিল?

না হেইডা আছিল না। বাজানে চউরা কামলা লইয়া ধান কাইট্টা আনত। আইন্না উডানে। হালাইত। বিয়াইন্না রাইতে কামলারা গান গাইত আর ধান পাড়াইত। ছোড গিরস্থগো ধান পাড়াইয়াই লয়।

কামলারা কী গান গাইত?

ওই যে হেই গানডা। সোনার ধান কাইট্টা আনো, গোলায় তোলো। গান হুনলে আমার আর ঘুম আইত না। জাইগা থাকতাম। একখান পিড়ি লইয়া দরজার সামনে বইয়া থাকতাম।

 চউরা কামলাগো ধান পাড়ান দেখতাম। গান হুনতাম।

চউরা কাগো কয় বুবু?

আগন মাসে পদ্মার চর থিকা শয়ে শয়ে মানুষ আইত দেশ গেরামে। হেগো কয় চউরা। আইত ধান কাটতে। যা ধান কাটত তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ পাইত হেরা। ধান কাটা শেষ অইলে হেই ধান বস্তায় ভইরা চউরারা চইলা যাইত। চউরারা বড় আমুদে মানুষ ভারি সোন্দর গান করত।

কোন ধানের চাউল ভালা বুবু?

সোনাদিগা ধান।

ভাতের স্বাদ কেমুন?

হেই কথা আর কইচ না ভাই!

তারপর একটু থেমে বুলবুলি বলল, কাঁচা নাইরকল খাইছচ?

দীনু বলল, না।

খাচ নাই! না খাইলে বুজবি কেমনে!

 তুমি কও।

কাঁচা নাইরকলের যেমুন স্বাদ অয় হেমুন স্বাধ অয় সোনাদিগার ভাতে। তরকারি ছাড়া দুই তিন বাসন ভাত খাইয়া হালান যায়।

শুনে পেটের ভেতর কেমন করে দীনুর! খিদেটা মনে হয় সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। গলাটা শুকিয়ে মাঠের বাঁজা মাটি হয়ে গেছে।

দীনু একটা ঢোক গিলল। এইবার মাছের কিচ্ছা কও বুবু। দুধের কিচ্ছা কও।

কথা বলতে আর ভালো লাগছে না বুলবুলির। খিদেয় শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে। হাঁটতে ভাল্লাগে না, কথা বলতে ভাল্লাগে না।

দীনুর ওপর কী রকম একটা বিরক্ত লাগছে। চারদিকের আলো হাওয়া মাটি কোনও কিছুই বাস্তব মনে হচ্ছে না। অতিরিক্ত খিদেয় নেশার মতো কী রকম একটা ঘোর তৈরি হয়েছে চোখে। তিনদিন কিছুই প্রায় খাওয়া হয়নি। পরশু দুপুরে ভিক্ষা মেগে একমুঠ চাল পেয়েছিল মা। সেই চালে জাউ বেঁধে খেয়েছে তিনজন মানুষ। তাতে পেটের এক কোণাও ভরেনি। তারপর থেকে টানা উপোস। শরীর থরথর করে কাঁপে বুলবুলির। পা চলতে চায় না।

কিন্তু এসব দীনুকে বুঝতে দেয়া যাবে না। সেইও তো বুলবুলির মতোই। অতটুকু ছেলে না খেয়ে কেমন করে যে এখনও বেঁচে আছে!

দীনুর মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা জ্বলে যায় বুলবুলির। মরা মাছের মতো ফ্যাকাসে। হয়ে গেছে দীনুর মুখ। হাঁটছে, যেন প্রচণ্ড মার খাওয়া এক কুকুরছানা।

দীনুকে দেখে ভেতরে ভেতরে নিজেকে গুছিয়ে নেয় বুলবুলি। ভাইটিকে তার মাছের গল্প বলে। দুধের গল্প বলে। এক দুর্দান্ত সুখের দিন এসে দাঁড়ায় বুলবুলির চোখের সামনে। বাইষ্যাকালে তো দেশ গেরাম পানিতে ডুইবা যায়। খাল দিয়া পদ্মার গাং থিকা ঘোলা পানি আইয়া তো দেশগেরাম ভাসাইয়া দেয়। পানি থাকে তিন মাস। হেই তিন মাস মাছের আকাল অইত না। কত পদের যে মাছ! বাড়ির ঘাডা থিকা জালি দিয়া ম্যালা মাছ ধরত বাজানে। পাবদা টেংরা চটাচটা পুডি রয়না টাকি বাইল্লা, খাও কত মাছ খাইবা। কাতিমাসে পানিতে টান ধরত। তখন দুনিয়া ভইরা যাইত মাছে। বশ্যি হালাইলেই মাছ। জাল হালাইলেই মাছ। ফলি কাউন্না মাগুর আইর বোয়াল। বাজানে এক বিয়াইল মাছ ধরলে হেই মাছ আমরা তিন চাইর দিনে খাইয়া ছাড়াইতে পারতাম না। আর জিউল মাছ তো আছিলই। জিওল মাছ কারে কয় জানসনি দীনু?

দীনু মাথা নাড়ল। না।

যেই হগল মাছ ঘোপায় পানি ভইরা রাখন যায় হেই মাছরে কয় জিওল মাছ। কই শিং মাগুর।

বুজছি

জিওল মাছ পাওয়া যাইত শীতের দিনে। কচুরির মইদ্যে, পানির মইদ্যে যেই হগল জাগায় জঙ্গল অয় হেই হগল জাগায় পাওয়া যায় জিওল মাছ। বাজানে ডুবাইয়া ডুবাইয়া ধরত।

শীতের দিনে আমরা খালি জিওল মাছ খাইতাম। কী স্বাদ যে আছিল হেই মাছে!

এতক্ষণে মাঠটা শেষ হয়। কামার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় বুলবুলি আর দীনু। ঝোপঝাড়ের ফাঁকফোকর দিয়ে সাপের মতো বাঁকা একটা পথ চলে গেছে বাড়ির ভেতর। ওরা দুজনে সেই পথে বাড়ির ভেতর ঢুকে যায়।

 কিন্তু পুরো বাড়িটা দুতিনবার চষেও কিছুই পায় না ওরা। না দু-একটা কচুর লতি, না এক আধখানা মুখি। দীনু পাগলের মতো পেয়ারা গাছগুলো দেখে। এক আধটা কড়া পেয়ারাও নেই।

 দীনু হতাশ গলায় বলল, কই লইয়াইলা বুবু। কিচ্ছু নাই তো!

বুলবুলি বলল, কী করুম ক। মাইনষে বেবাক কিছু খাইয়া হালাইছে।

তারপর হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনে দিকটায় চলে আসে ওরা। বাজারের দিককার বড় সড়কটা চলে গেছে কামার বাড়ির পেছন দিয়ে। সেখানে বাড়ির মুখে একটা দেবদারু গাছ। বহুকালের পুরোনো গাছ। মাথায় ঘন ডালপালা বলে দিনমান তলায় পড়ে থাকে মিঠেল একখানা ছায়া। ক্লান্ত বাজারীরা কখনও কখনও জিরোতে বসে দেবদারুতলায়। মাঠ ছাড়া দু-একটা গরুছাগল এসে অলস ভঙ্গিতে বসে জাবর কাটে। দেবদারুর ডালে বসে থাকে কাক, শালিক।

 দীনুকে নিয়ে দেবদারু তলায় চলে এল বুলবুলি। পা আর চলতে চাইছে না। একটু জিরোবে। কিন্তু দেবদারু তলায় একটি লোক বসে আছে। বসে আরামসে বিড়ি কুঁকছে। গায়ে নীল একখানা পিরান তার। সেই পিরানের ওপর গলার কাছে বাঁধা লাল টকটকে রুমাল।

বুলবুলি এবং দীনুর পায়ের শব্দে চমকে মুখ ফেরাল লোকটি। সঙ্গে সঙ্গে বুলবুলি দেখতে পেল মুখভর্তি কুৎসিত বসন্তের দাগ তার। রোদেপোড়া তামাটে চেহারা। মাথার কদমছাটি চুল আর মুখ দেখে বোঝা যায় বহুঘাটের জল খাওয়া লোক সে।

বুলবুলিকে দেখেই হা করে, কী রকম চোখে যেন তাকাল লোকটি। তাকিয়ে রইল। চোখে পলক পড়ে না। দেখে শরীরের খুব ভেতরে অদ্ভুত এক কাঁপন লাগল বুলবুলির। দরকার নেই তবু বুকে আঁচল টানল সে। কেমন জড়োসড়ো হয়ে গেলে।

লোকটির পায়ের কাছে খুবই অবহেলায় পড়ে আছে মুখ বাধা বিশাল ভারি একটি বস্তা। সেই বস্তা দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল বুলবুলির। লোকটির চোখে দেখে শরীরের খুব ভেতরে যে কাঁপনটা লেগেছিল মুহূর্তে কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল সেই কাঁপন।

বস্তার ভেতর কি আছে।

চাল!

বুলবুলির মতো দীনুও তাকিয়ে ছিল বস্তাটির দিকে। দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসল লোকটি। বলল, বস্তা ভরা চাউল, বাজলা। শিমইল্লা বাজার লুট অইল তো, এক বস্তা মাথায় লইয়া আইয়া পড়লাম।

শুনে অবাক হয়ে লোকটির মুখের দিকে তাকায় বুলবুলি। ভাবে, চাইব নাকি দুমুঠো চাল। এত বড় এক বস্তা চাল। চাইলে কি দুমুঠো দেবে না লোকটি!

বুলবুলির মুখ দেখে লোকটি কী বুঝল কে জানে, বুলবুলির সঙ্গে কোনও কথা বলল না সে। হাত ইশারায় দীনুকে ডাকল, আস, আমার কাছে আস খোকা।

 দীনু একবার বুলবুলির দিকে তাকাল। তারপর পায়ে পায়ে লোকটির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কি কন? তোমার নাম কি?

দীনু।

বইনের নাম?

বুলবুলি।

লোকটি আবার বুলবুলির দিকে তাকাল। হাসল। বাহবা, বুলবুলি। বুলবুলি পাখি। ভারি সোন্দর নাম!

সেই ফাঁকে বুলবুলি দেখতে পেল লোকটির মুখের দাঁত পোকায় খাওয়া। নোংরা। হাসলে কুৎসিত দেখায়।

লোকটি তখন পিরানের পকেট থেকে চকচকে একটা সিকি বের করেছে। করে দীনুর চোখের সামনে তুলে ধরেছে। এইডা নিবা দীনু। নেও। নিয়া সোজা বাজারে যাও বিসকুট খাইয়া আস। চোখের সামনে চার আনা পয়সা দেখে দীনু একদম পাগল হয়ে। যায়। চার আনায় অনেকগুলো বিসকুট পাওয়া যাবে। খেয়ে বাজারের চাপকল থেকে পানি খেলে পেট এমন ভরা ভরবে, চার দিন আর খিদে লাগবে না।

ছোঁ মেরে পয়সাটা নিল দীনু। তারপর বাজারের দিকে এমন একটা দৌড় দিল, বুলবুলি কিছু বলার আগেই বহুদূর চলে গেল।

দীনু চলে যেতেই বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলল লোকটি। তারপর বুলবুলির দিকে তাকিয়ে হাসল। বুলবুলি পাখি, চাইল নিবানি?

শুনে বুলবুলির অবস্থা হল দীনুর মতো। এমন একটা আনন্দের ঢেউ ওঠল শরীরে। চোখের ওপর বুলবুলি দেখতে পেল লোকটির দেয়া চালে হাঁড়িভরা ভাত রান্না হয়েছে। মুক্তোদানার মতো ফুরফুরে সাদা ভাত। মা সে আর দীনু বাসন ভর্তি করে ভাত খাচ্ছে। লোকটি ততক্ষণে ওঠে দাঁড়িয়েছে। বুলবুলির একটা হাত ধরেছে। দিমু ম্যালা চাইল দিমু। আস।

বুলবুলিকে জঙ্গলের দিকে টেনে নেয় লোকটি। বুলবুলি কথা বলে না। বাধা দেয় না। চোখ জুড়ে তার তখন বাসন ভর্তি ভাতের স্বপ্ন।

.

চড়ুই পাখির মতো লাফাতে লাফাতে ফিরে এল দীনু। বাজারের মুদি দোকান থেকে চার। আনার বিসকুট কিনে খেয়েছে। তারপর আজলা ভরে পানি খেয়েছে চাপকল থেকে। পেট একদম ভরে গেছে। পেট ভরা থাকলে মনে বেদম ফূর্তি আসে মানুষের। দীনু এখন তেমন স্ফুর্তিতে আছে।

 হাঁটুতে মাথা গুঁজে গাছতলায় বসেছিল বুলবুলি। আঁচলে দুআড়াইসের পরিমাণ চাল। চালটা বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রেখেছে সে।

 দীনুকে দেখেই ওঠে দাঁড়াল বুলবুলি। খিদের চেয়েও বড় কোনও যন্ত্রণায় তখন ধুকছে সে। চোখে মুখে অদ্ভুত এক কষ্টের ছাপ।

কিন্তু দীনু ওসব খেয়াল করে না। বুবুর আঁচলে চাল দেখে খুশিতে পাগল হয়ে যায় সে। উচ্ছ্বাসের গলায় বলল, হেয় তোমারে চাইল দিছে বুবু?

বুলবুলি ক্লান্ত গলায় বলল, হ.

ইস আইজ তাইলে পেড ভইরা ভাত খাওন যাইব।

হ। ল বাইত যাই।

ঠিক তখুনি দীনু দেখতে পেল বুলবুলির পেছন দিকে ছেঁড়াখোঁড়া মলিন শাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। দেখে চমকে উঠল সে। বুবু তোমার কাপড়ে দিহি রক্ত! এত রক্ত বাইর অইল কেমনে!

বুলবুলির বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। উদাস দুঃখি গলায় বলল, একবার ধান কাটতে গিয়া বাও হাতের লউঙ কাইট্টা হালাইছিল বাজানে। ম্যালা রক্ত বাইর অইছিল। দেইখা মায় কইল ধানক্ষেতে রক্ত দিয়া আইলানি। হুইনা বাজানে কইছিল, পেড ভইরা ভাত খাইতে অইলে রক্ত তো ইট্টু দেওন লাগবই। আমিও আইজ পেড ভইরা বাত খাইওনের লেইগা রক্ত দিছি। এইডি হেই রক্ত। বাজানে দিছিল লউঙ কাইট্টা আমি দিছি অন্য জিনিস কাইট্টা।

কথা বলতে বলতে জলে চোখ ভরে এল বুলবুলির।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *