খরা কিংবা বৃষ্টির পরে

খরা কিংবা বৃষ্টির পরে

তারপর একদিন বৃষ্টি নামল। বিকেলবেলা। দুপুরের পর সারা আকাশ জন্ডিস রোগীর চোখের রঙ ধারণ করেছিল। মাটি থেকে আকাশসীমা পর্যন্ত জমেছিল কুয়াশার মতো পাতলা ধুলার একটা রেখা। গাছের পাতায় কাঁপন তোলার মতো হাওয়া ছিল না। কোথাও। দেশজুড়ে চলছে প্রচণ্ড খরা। শীতকাল শেষ হতে না হতেই শুরু হয়েছে। এখন জুন মাস যায়, তবুও প্রতিদিন সূর্যের তেজ বেড়ে চলেছে। গুলি খাওয়া বাঘের মতো রোদ গোত্তা খেয়ে বেড়ায় সারা দেশে। উত্তরবঙ্গে মাইল মাইল শস্যের মাঠ রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে আসছে খরায় শস্যনাশের খবর। খবরের কাগজগুলো হুমড়ি খেয়ে লিড হেডিঙে ছেপে দিচ্ছে সেই খবর। দেখে দেশবাসীর মাথায় প্রতিদিন একটু একটু করে ঢুকে যাচ্ছে তীব্র রোদ। উষ্ণতায় হাঁসফাঁস করছে মানুষ। তবু বেঁচে থাকার নেশায় দিগ্বিদিক ছুটছে।

সকালবেলা অফিসে এসে আলাউদ্দিন আলী (৩১) প্রথমে খানিক জিরিয়ে নিয়েছে। গেণ্ডারিয়া থেকে প্রতিদিন হেঁটে আসে মতিঝিলে। তার অফিসে। একটা প্রাইভেট ফার্মের কেরানি আলাউদ্দিন আলী। মাইনে ছশো চল্লিশ টাকা। সকাল নটায় বাড়ি থেকে বেরোয় সে। তারপর টানা চল্লিশ মিনিট, নামাপাড়া হয়ে, পুরোনো রেললাইনের নিচে যে প্রাচীন ধোলাইখাল, রাস্তা শর্টকাট করে সেখানে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে ধান্দাবাজ মানুষ, পেরিয়ে যেতে আসতে দশ পয়সা করে লাগে, বিশ পয়সা খরচ করে আলাউদ্দিন আলী অফিসে যায়, ফিরে আসে। অফিসের গেটে এসে, সেখানে ডালা নিয়ে বসে এক পানবিড়িঅলা, দশ পয়সায় একটা পান কিনে মুখে দেয় আলাউদ্দিন আলী। চারতলার সিঁড়ি ভেঙে যখন অফিসে নিজের টেবিলে এসে বসে, দশটা বাজতে তখন বিশ মিনিট। পান চিবোতে চিবোতে ওই বিশটা মিনিট রেস্ট আলাউদ্দিন আলীর। সাড়ে চার বছর এই নিয়মে অফিস করেছে সে। সিগারেট খায় না আলাউদ্দিন আলী, চা খায় না। দুপুরের আহার চারখানা আটা রুটি আর সবজি। বউ তৈরি করে দেয়। বাড়ি থেকে ছোট্ট টিফিন বক্সে ভরে নিয়ে আসে। দুপুরবেলা আয়েশ করে খায়। তারপর পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তুলে পিয়ন দিয়ে আনায় একটা পান। দশ পয়সা। মোট চল্লিশ পয়সা সারা দিনের খরচ আলাউদ্দিন আলীর। ছশো চল্লিশ টাকা মাস মাইনে, দুজন মানুষের খাই খরচা সাধ আহ্লাদ এবং বাড়িভাড়া দিয়ে চল্লিশ পয়সার বেশি নিজের জন্য একটা খরচ কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব!

আলাউদ্দিন আলী থাকে ডিস্টিলারি রোডে। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেললাইনের পাশে গেণ্ডারিয়ায় যে বাঁধানো পুকুর তার উত্তর গলির মুখে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির নিচের তলায় মাঝারি সাইজের একটা রুম, এক চিলতে বারান্দা, বারান্দায় রান্নার ব্যবস্থা, তারপর পাঁচ কদম খোলা জায়গা, গেটের সঙ্গে ছোট্ট বাথরুম। আলাউদ্দিন আলীর সংসার। সংসারে বউ সুফিয়া, আর কেউ নেই। মা বাপ গত হয়েছেন অনেককাল। বড় দুবোন বিয়ে হয়ে চলে গেছে। এখন স্বামীর সংসার সামলায় একজন রায়ের বাজারে আরেকজন নোয়াব গঞ্জে। বছরে দু বছরে এক আধবার বোনদের সঙ্গে, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের সঙ্গে দেখা হয় আলাউদ্দিন আলীর।

আর একটা ছোট ভাই ছিল। কামালউদ্দিন। চৌষট্টি সালের রায়টের সময় তাঁতীবাজার এলাকায় থাকত আলাউদ্দিন আলীরা। রায়ট করতে এসে এক রাতে আগুন দিল লোক। আগুন দেখে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়েছিল সবাই। তারপর যে যেদিকে পারে ছুট।

কামালউদ্দিন তখন আট ন বছরের। সেই যে বাড়ি থেকে ছুটে বেরুল, আর ফিরল না। তারপর কতদিন গেল রাত গেল। মা মরেছিল আগেই। কামাল কামাল করে বাপটাও গেল। কিন্তু কামাল ফিরল না।

এখন মাঝে মাঝে মনটা খারাপ থাকলে কামালউদ্দিনের কথা মনে পড়ে আলাউদ্দিন আলীর। সংসারে এখন আপন বলতে কেউ নেই আলাউদ্দিন আলীর। শুধু বউটা। মেয়ে মানুষ দিয়ে কী হয়! বোঝে শুধু খাওয়াটা আর শোয়াটা। ভাইটা থাকলে আপদে-বিপদে পাশে এসে দাঁড়াত! আহারে কামালটা বেঁচে আছে কি মরে গেছে কে জানে।

কিন্তু সময়ে অসময়ে আলাউদ্দিন আলীর মনে হয় ভাইটা তার বেঁচে আছে। একদিন ঠিকঠাক করে আসবে। কামালউদ্দিনের সঙ্গে একদিন না একদিন তার দেখা হবেই।

আজ সকালে নাশতাটা খেয়ে মুখে পান পুরে আলাউদ্দিন আলী যখন বেরুবে, হাতে রুটি ভাজির টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে সুফিয়া বলল, কাল রেশন তুলতে হবে। ঘরে কিন্তু টাকা-পয়সা নেই।

শুনে আলাউদ্দিন আলীর মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। সকালবেলাই শুরু হয়েছে। প্রচণ্ড গরম। ছশো চল্লিশ টাকা মাইনের কেরানির ঘরে তো আর ফ্যান থাকে না! জামা কাপড় পরে ঘামছিল আলাউদ্দিন আলী। রেশন তোলার কথাটা শুনে গরমটা আরো বেড়ে যায় তার। তবু চৌকির ওপর খানিক বসে পান চিবোয় সে। সুফিয়াকে দেখে পেটের কাপড় পিঠের কাপড় সরিয়ে খসখস করে পেট পিঠ চুলকাচ্ছে। পেটটা দিন দিন উঁচু হচ্ছে। চারমাস চলছে সুফিয়ার। কথাটা মনে হতে মাথার ভিতরটা চক্কর খায় আলাউদ্দিন আলীর। আর পাঁচ ছয় মাস বাদেই সংসারে আসবে একটা নতুন মানুষ। ঝামেলা পোহাতে যাবে একগাদা টাকা। তারপর দিনদিন খরচ বাড়বে। বাড়তি টাকাটা আসবে কোত্থেকে! এখনই মাসের শেষ দিকে এডভান্স নিয়ে রেশন তুলতে হয়, বাজার করতে হয়।

বাজারটা সপ্তাহে একদিন, রোববার নিজে করে আলাউদ্দিন আলী। সারা সপ্তাহেরটা। মাছমাংস তো কপালে জোটে না। আলুভর্তা, ডাল আর ভাজিভুজি। তবু মাসের শেষটা আর চলে না। আড়াই শো টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাকি তিনশো নব্বই টাকায় দুজন মানুষের সংসার কি চলতে চায়! সুফিয়াটা ভালো মেয়ে বলে এসব নিয়ে কখন কথা বলে না। টেনেটুনে সংসারটা ঠিকই চালিয়ে নেয়। বাড়িঅলার চাকর ছেলেটাকে পটিয়ে পাটিয়ে সপ্তাহের রেশনটা তুলিয়ে নেয়।

 সুখে-দুঃখে দিন চলে যাচ্ছিল ঠিকই। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে কখন কোনও আবদার করেনি সুফিয়া। শখ করে কোনও জিনিসের বায়না ধরেনি। ঘুরতে নিয়ে যেতে বলেনি, সিনেমা দেখাতে বলেনি। আলাউদ্দিন আলীর সংসারে এসেই বুঝে গিয়েছিল এটা একটা জেলখানা, আমোদ-আহ্লাদ কিংবা শখ করার জায়গা নয়। জীবনটা মেনে নিয়েছিল সুফিয়া। তবু মেয়েমানুষ চিরকালই মেয়েমানুষ, সন্তান না চেয়ে কি পারে! প্রথম থেকেই একটা সন্তানের বায়না ধরেছিল সুফিয়া। সব বুঝেও। পৃথিবীতে আল্লাহ কোনও মানুষ পাঠালে তার অন্নের সংস্থান করেই পাঠান, এসব বুঝিয়েছে আলাউদ্দিন আলীকে।

পুরুষমানুষ কি এসব সহজে বোঝে! তবু ব্যাপারটা অনেক কাল ঠেকিয়ে রেখেছিল। শেষপর্যন্ত পারেনি।

ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে সকালবেলা আলাউদ্দিন আলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। তারপর সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছে আজ এডভান্স নেব।

 শুনে মৃদু হেসেছে। তারপর পেটপিঠ চুলকাতে লেগে গেছে সে।

সুফিয়ার শরীর ভরে গেছে ঘামাচিতে। নাকের তলায় সকালবেলাই জমে গেছে ঘাম। ইস কী যে গরম এবছর। তবু সুফিয়ার মুখে সকালবেলা আলাউদ্দিন আলী দেখেছে এক ধরনের প্রশান্তি। গরম ঘামাচি দারিদ্র? সব ছাপিয়ে সন্তান আসছে এক সুখেই কি বিভোর হয়ে থাকে সুফিয়া?

তারপর সুফিয়ার জন্য কী যে এক মায়ায় বুক ভরে গেছে তার। এই সময়ে মেয়েদের ভালো খাওয়াদাওয়া দরকার, পুরোপুরি বিশ্রামের দরকার। সুফিয়া এসবের কিছুই পাচ্ছে না। তার ওপর শরীর ভরে গেছে ঘামাচিতে। কী যে শুরু হল এবছর! এত গরমে মানুষ বাঁচবে কেমন করে!

 রোদে পুড়ে ঘামে হাঁসফাঁস করতে করতে আলাউদ্দিন আলী যখন অফিসে পৌঁছে দশটা বাজতে তখন পনের মিনিট বাকি। এই প্রথম পাঁচ মিনিট লেট হল আলাউদ্দিন আলীর। আর আজ বহুদিন বাদে অফিসের সামনের দোকানটা থেকে পান খেতে ভুলে গিয়েছিল আলাউদ্দিন আলী।

 সে কি কোনও ঘোরের মধ্যে চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে এল আজ!

অফিসে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে ইলেকট্রিসিটি নেই। কলিগরা যে যার টেবিলে বসে ঘামছে। দু-একজন শার্টের সব বোতাম খুলে জানালার সব পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাইরের পৃথিবীতে কোথাও কি হাওয়া আছে! কদিন ধরেই এরকম হচ্ছে। যখন তখন ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। নাগাড়ে চার পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। খরায় জল নেমে গেছে নিচে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটেছে। কী যে হবে!

 নিজের টেবিলে বসে হা করে শ্বাস টানে আলাউদ্দিন আলী। তারপর ক্যাশিয়ার বিপিন বাবুর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিপিনবাবু পাতলা পাঞ্জাবি পরা, চশমা চোখে মাথা নিচু করে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। আলাউদ্দিন আলী ডাকল, বাবু।

বিপিনবাবু মুখ তোলেন। তারপর মোটা লেন্সের ভেতর থেকে সোজা আলাউদ্দিন আলীর মুখে। কী ব্যাপার আলাউদ্দিন সাহেব? আলাউদ্দিন আলী কথা বলে না। কাঁচুমাচু করে। বিপিনবাবু হেসে বললেন, কত?

শখানেক।

ছুটির সময় নিয়ে যেয়েন।

শুনে আলাউদ্দিন আলী খুব খুশি। হে হে করে একটু হেসে বলল, পেপারের একটা পাতা দিন না। পড়ি।

বিপিন বাবু মাঝের একটা পাতা খুলে দিলেন।

নিজের টেবিলে এসে কাগজটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে আলাউদ্দিন আলী। এক জায়গায় বক্স করা ছোট্ট একটা খবর পড়ে মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় তার। উত্তরবঙ্গের জনৈক সত্তর বছর বয়স্ক বৃদ্ধ, খরায় বৃষ্টির অভাবে মাইল মাইল শস্যের মাঠ ছারখার হয়ে যাচ্ছে দেখে খালি গায়ে গিয়ে বিলের জমিতে গিয়ে বসেছেন। তারপর বৃষ্টির জন্যে আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছেন। নাগাড়ে তিনদিন জমিতে বসেছিলেন তিনি। প্রার্থনার ভঙ্গিতে তোলা ছিল দুহাত।

তিনদিন অন্নজল স্পর্শ করেননি। তবু বৃষ্টি হয়নি। চারদিনের দিন সকালবেলা সংসারের অন্যান্য লোক যখন তাকে ফিরিয়ে আনতে গেছে তখন তিনি মৃত।

একটি লোকের জীবন নিয়েও আল্লাহ বৃষ্টি দেননি। কথাটা ভেবে কেন যে আলাউদ্দিন আলীর মনে হয় পৃথিবীতে কোনও কালেই বুঝি আর বৃষ্টি হবে না। উষ্ণতায় মারা যাবে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ।

সারাদিন মনটা খারাপ হয়ে থাকে। অফিসে তেমন কাজকাম ছিল না। তবু সময়টা কেটে গেছে।

 বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরিয়ে আলাউদ্দিন আলী দেখে রোদ নেই। আকাশ জন্ডিস রোগীর চোখের মতো। মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত কুয়াশার মতো জমে আছে পাতলা ধুলোর রেখা। এক বিন্দু হাওয়া নেই। মাটির চুলো থেকে আগুন তুলে নেয়ার পরও যেমন উষ্ণতা থাকে, তেমনি উষ্ণতা চারদিকে। তবুও আলাউদ্দিন আলীর মনে একটা ফূর্তির ভাব। একশো টাকা এডভান্স পাওয়া গেছে। টাকাপয়সা পকেটে থাকলে হাজার দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও নিম্নবিত্ত মানুষের মনে আলাদা একটা সুখ থাকে। আলাউদ্দিন আলী এখন সেই সুখে বিভোর।

টিকাটুলীর মোড়ে এসে আলাউদ্দিন আলীর মনে পড়ল সকালবেলা অফিসের সামনে দোকান থেকে পানটা আজ খাওয়া হয়নি। মনে পড়তেই পানের নেশাটা চড়ে যায়। একটা স্টেশনারি দোকান থেকে পান নিয়ে যখন মুখে পোরে তখন সুফিয়ার কথা মনে পড়ে তার। ঘামাচিতে শরীর ভরে গেছে সুফিয়ার। যে হারে গরম বাড়ছে প্রতিদিন তাতে ঘামাচি কমার কোনও সম্ভাবনা নেই। এই সময় মেয়েদের একটা ভালো। খাওয়াদাওয়া দরকার, আরামআয়েশের দরকার। কোনওটাই পায় না সুফিয়া। বরঞ্চ বাড়তি কষ্ট পাচ্ছে ঘামাচির। এইট্টুকু কষ্ট থেকে যদি সুফিয়াকে না বাঁচাতে পারি তো আমি কেমন স্বামী। কথাটা ভেবে ঘামাচি মারার মোক্ষম ওষুধ, মাইসেল পাউডার পৌনে সাত টাকা দিয়ে একটা কিনে ফেলল আলাউদ্দিন আলী। তাতে মনে একটা পরিতৃপ্তি আসে তার। পাউডারের টিন হাতে পান চিবোতে চিবোতে, জন্ডিস রোগীর চোখের মতো আকাশের তলা দিয়ে হেঁটে হেঁটে পাঁচ বছরের পুরোনো সংসারে ফিরে এল। আলাউদ্দিন আলী। বিকেলবেলা।

বারান্দায় বসে পেটপিঠের কাপড় সরিয়ে ঘামাছি মারছিল সুফিয়া। গায়ে ব্লাউজ নেই। বলে ভারি বুক ইতিউতি উঁকি দিচ্ছিল। সে সবের খেয়াল ছিল না তার।

সুফিয়া মগ্ন হয়ে ঘামাচি মারছে দেখে আলাউদ্দিন আলী একটু গলা খাঁকারি দিল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে শরীরে আঁচল টেনে দেয় সুফিয়া। তারপর আলাউদ্দিন আলীকে দেখে হেসে ফেলে। ও তুমি, আমি ভাবলাম কে না কে?

একথায় বহুকাল বাদে বউর সঙ্গে একটু ঠাট্টা করে আলাউদ্দিন আলী। অন্য কেউ আসে নাকি?

যা।

তারপর আলাউদ্দিন আলীর হাতে পাউডারের টিন দেখে লাফিয়ে ওঠে সুফিয়া। থাবা দিয়ে টিনটা নিয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার জন্যে এনেছ?

তো কার জন্যে! আমার কি আর দু-একটা বউ আছে?

কত দাম?

পৌণে সাত টাকা।

এই এতগুলো টাকা খরচ না করলেই পারতে!

আলাউদ্দিন আলী কথা বলে না। ঘরে ঢুকে জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে সুফিয়ার চেহারায় আলাদা একটা লাবণ্য খেলা করছে দেখে পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলে। ভেতরে ভেতরে সুফিয়া যে প্রচণ্ড খুশি হয়েছে, বুঝতে দেরি হয় না তার।

অফিসের জামাকাপড় সদরঘাটের নিকসন মার্কেট থেকে অতি সস্তায় কেনা সাহেবদের পুরোনো শার্টপ্যান্ট খুলে খালি গায়ে, লুঙ্গি পরে ছোট বারান্দায় এসে বসে আলাউদ্দিন আলী। শরীরে ঘাম শুকিয়ে গিয়ে লবণ হয়ে গেছে দেখে সুফিয়া ভাঙা তালপাতায় তাকে বাতাস করছিল। তখনি একবার বিদ্যুৎ চমকে ওঠে আকাশে। বহুকাল বাদে, যেন এই প্রথম পৃথিবীতে মেঘ ডাকছে, এমন করে, দশদিক মুখরিত করে মেঘ ডেকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সুফিয়া বলল, আয় আয়।

 আলাউদ্দিন আলী আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বৃষ্টি হলে দুনিয়াটা ঠাণ্ডা হয়, মানুষ বেঁচে যায়।

একথার পরপরই শুরু হয় দমকা শুকনো বাতাস। রাজ্যের ধুলোবালি উড়ে আসে আলাউদ্দিন আলীর ছোট্ট ঘরে। ধুলোর দাপটে অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। সুফিয়া ছুটে গিয়ে ঘরের জানালা বন্ধ করে। তারপর ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বেলে দেয়।

তখুনি বাতাসের সঙ্গে কেঁপে আসে বৃষ্টি। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকায়, মেঘ ডাকে। আলাউদ্দিন আলী বসেছিল বারান্দায়, বৃষ্টিতে হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে যেতে থাকে। বৃষ্টি দেখে সবচেয়ে খুশি হয়েছে সুফিয়া। দৌড়ে ছোট্ট উঠোনে নেমে যায় সে। তারপর বুক পিঠের কাপড় ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।

সুফিয়াকে এখন বাচ্চা মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। আলাউদ্দিন আলী তাকিয়ে দেখে।

 স্বামীর সামনে মেয়েদের কোনও লজ্জা থাকে না। কী রকম অবলীলায় বুকের পিঠের কাপড় ফেলে দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে সুফিয়া!

আলাউদ্দিন আলী বলল, বেশি ভেজাভেজি কোরো না। জ্বরজারি হবে। এসময় অসুখ বিসুখ খারাপ। বাচ্চার প্রবলেম হতে পারে। সুফিয়া হাসতে হাসতে বলে, তুমি অত ভেব না গো। কিছু হবে না। বছরের প্রথম বৃষ্টিতে ভিজলে ঘামাচি সব মরবে।

আহা, তাহলে পাউডারটা কেন কিনলাম।

আফসোস হচ্ছে?

পৌণে সাতটা টাকা!

মনে কর আমার জন্যে গচ্চা দিলে। বলেই সুফিয়া খুব হাসে। কখনও তো আমার জন্যে তোমার তেমন খরচা হয়নি। এবার একটু না হয় হল।

শুনে আলাউদ্দিন আলীর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে। খরচটা কি হত না, সামর্থ থাকলে ঠিকই হত। কিন্তু কথাটা বলা হয় না।

অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে, শাড়িছায়া পাল্টে, ঘরের ভেতর ষাট পাওয়ারের আলোর তলায় দাঁড়িয়ে শরীরে পরম যত্নে মাইসেল পাউডার মাখছিল তখুনি লাইট চলে যায়। মুহূর্তে মৃত্যুর মতো গভীর অন্ধকার নেমে আসে। থেকে থেকে মেঘ ডাকছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আলাউদ্দিন আলী কাত হয়ে শুয়েছিল চৌকির ওপর। আলো চলে যেতেই ধড়ফড় করে ওঠে। ম্যাচ কোথায়? হারিকেন জ্বাল।

সুফিয়া বলল, ব্যস্ত হয়ো না। আমি দেখছি।

তারপর হাতড়ে হাতড়ে ম্যাচ বের করে সুফিয়া। হারিকেন জ্বেলে দেয়।

হারিকেনের আলোয় খাওয়াদাওয়া যখন শেষ করেছে দুজন, তখন আলো ফেরেনি।

সাড়ে আটটা নটা বাজে। আলাউদ্দিন আলী বলল, চল শুয়ে পড়ি। গরমে কতকাল ঘুমুতে পারিনি। আজ শান্তিতে ঘুমুব।

 হারিকেন নিবু নিবু করে সুফিয়া যখন বিছানায় গেছে, বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে, দমকা হাওয়াটা একদম নেই। বৃষ্টির পরে পৃথিবী এখন শীতল। সুফিয়া বিছানায় শুয়ে আলাউদ্দিন আলীর বুকে পিঠে নরম হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। তখন আলাউদ্দিন আলীর মনে পড়ে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে করতে উত্তরবঙ্গে শস্যের মাঠে বলে মারা গেছেন এক বৃদ্ধ। অতঃপর বৃষ্টি হল বৃদ্ধের প্রার্থনা সফল হল, বৃদ্ধ দেখে যেতে পারলেন না।

একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে আলাউদ্দিন আলীর। তখুনি গলির মুখে লোকজনের হল্লাচিল্লার শব্দ পাওয়া যায়। প্রথমে খেয়াল করে না আলাউদ্দিন আলী। সুফিয়া বলল কী হল? এত হইচই?

 আলাউদ্দিন আলী কান পেতে শব্দটা শোনে। তারপর বলে, বুঝতে পারছি না। বেরিয়ে দেখে আসব?

না, এই অন্ধকারে বেরুতে হবে না।

 হল্লাচিল্লাটা তখন আরও বেড়েছে। অনেক লোকজন একত্রে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে। গলির একেবারে মুখে। কী ব্যাপার?

আলাউদ্দিন আলী জোর করে বিছানা ছাড়ে। তারপর খালি গায়ে, লুঙ্গি পরা অবস্থায় হারিকেনটা নিয়ে ঘর থেকে বেরোয়। দেখে আসি। এখুনি চলে আসব।

সুফিয়া বলল, দেরি কোরোনা। অন্ধকারে আমার ভয় করবে।

গলির মুখে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে লোকজন জটলা করে দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। সেখানে কাত হয়ে পড়ে আছে একটা লাইটপোস্ট। লাইটপোস্টের তলায় একটা রিকশা। লোকজনের হাতে হারিকেন জ্বলছে। হারিকেনের আলোয় দেখা যায় রাস্তায় ভিড়ের মাঝমধ্যিখানে লুঙ্গি কাছামারা, খালি গা জোয়ান মর্দ এক যুবক উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আলাউদ্দিন আলী কিছু বুঝতে না পেরে একজনকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ভাই?

 ঝড়বৃষ্টি দেখে রিকশা রেখে লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়েছিল লোকটা। কী দুর্ভাগ্য দেখুন, লাইটপোস্টটা কাত হয়ে পড়ল বুকের ওপর।

মারা গেছে?

হ্যাঁ, বোধ হয় সঙ্গে সঙ্গেই।

শুনে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে আলাউদ্দিন আলীর। চৌষট্টির রায়টে হারিয়ে যাওয়া কামালউদ্দিনের কথা মনে পড়ে। তারপর ভিড় ঠেলে যুবকের লাশের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উপুড় হয়ে পড়ে আছে। মুখ দেখার উপায় নেই। শুধু কুচকুচে কালো পিঠটা দেখা যায়। পিঠভর্তি ঘামাচি। বছরের প্রথম বৃষ্টি পেয়ে, ঘামাচি মারার লোভেই কি সে রিকশা নিয়ে লাইটপোস্টের তলায় বসেছিল। যুবক কি জানত গোপনে তার আজরাইল এসে বসে আছে ওই লাইটপোস্টে।

 হারিকেন হাতে ফিরে আসতে আসতে আলাউদ্দিন আলী মনে মনে বলল, ভাই আমার ভাই। কথাটি কি সে এই যুবক না চৌষট্টির রায়টে হারিয়ে যাওয়া ভাই কামালউদ্দিনের উদ্দেশে বলল, বুঝতে পারে না।

ঘরে এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে বহুকাল বাদে ঠাণ্ডা পেয়ে নিঃসাড়ে ঘুমুচ্ছে সুফিয়া। বউটাকে আর ডাকে না সে। হারিকেন নিবু নিবু করে তার পাশে শুয়ে পড়ে। কিন্তু শুয়ে না পড়ে এতকাল বাদে ঠাণ্ডা রাত পেয়েও ঘুম আসে না তার। হারিয়ে যাওয়া ভাইটার কথা মনে পড়ে। আর চোখের ওপর বারবার ভেসে ওঠে উপুড় হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা। রিকশাঅলা যুবকের লাশ। কামালউদ্দিন নয় তো!

ঘুম আসে না আলাউদ্দিন আলীর। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে না ঘুম না জাগরণ এমন। একটা অবস্থায় সুফিয়ার পাশে পড়ে থাকে সে। ভোররাতে একটু তন্দ্রামতন এসেছিল। হঠাৎ সুফিয়ার চিৎকারে লাফিয়ে ওঠে আলাউদ্দিন আলী। দেখে ঘরে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলছে। বিকেলবেলাটা ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়েছিল। সুইচ অফ করা হয়নি বলে লাইটটা ইলেকট্রিসিটি ফিরে পেয়ে আপনা আপনি জ্বলে ওঠেছে। আর সেই আলোয় মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করছে সুফিয়া। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে।

 প্রথমে আলাউদ্দিন আলী কিছুই বুঝতে পারে না। ভ্যাবলার মতন খানিক বসে থাকে চৌকির ওপর। তারপর লাফিয়ে নেমে সুফিয়াকে জড়িয়ে ধরে। কী হয়েছে?

সুফিয়া কথা বলতে পারে না। গোঙায়। ব্যথায় মুখ দিয়ে ফেনা ওঠছে তার। নিম্নাঙ্গ ভেসে যাচ্ছে রক্তে, মেঝে ভেসে যাচ্ছে।

 আলাউদ্দিন আলী কী করবে বুঝতে পারে না। বারান্দায় ছুটে এসে দোতলায় লোকদের ডাকে। একটু আসুন তো দয়া করে। আমার ভারি বিপদ।

মিনিট পাঁচেক পর বাড়িঅলা সাদেক সাহেব আর তার স্ত্রী নেমে আসেন। সাদেক সাহেবের স্ত্রী সুফিয়াকে এক পলক দেখেই বললেন, আলী সাহেব ডাক্তার ডেকে আনুন। আপনার স্ত্রীর এবরসন হয়ে গেছে। শুনে মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় আলাউদ্দিন। আলীর। নিজেকে নিজেই মিনিট দুয়েক চিনতে পারে না সে।

কিন্তু এই ভোররাতে আলাউদ্দিন আলী কোন ডাক্তারের কাছে যাবে, খানিক বুঝতে পারে না। এক সময় মনে পড়ে সাবেক শরাফতগঞ্জ লেইনে মফিজ ডাক্তারের বাসা। বাসাটা চেনা আছে। ডেকে, হাতে পায়ে ধরে ডাক্তারকে আনা যাবে। মফিজ ডাক্তার ভালো লোক।

হাতে ডাক্তার সাহেবের ব্যাগ, পেছনে মফিজ ডাক্তার আলাউদ্দিন আলী যখন ফিরছে, তখন ভোরবেলার পবিত্র আলো ফুটে ওঠেছে চারদিকে। কাল সন্ধ্যার ঝড়বৃষ্টির ফলে ভেজা একটা ভাব চারদিকে। ধুলোবালির চিহ্ন নেই।

বাঁধানো পুকুরটার কাছাকাছি এসে আলাউদ্দিন আলী দেখে পুকুরের চারদিকে লোকজনের ভিড়। দেখে আলাউদ্দিন আলী একটু অবাক হয়। হাতে ডাক্তারের ব্যাগ পিছনে মফিজ ডাক্তার, সুফিয়ার এবরসন হয়ে গেছে, সব ভুলে আলাউদ্দিন আলী পুকুরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন দৃশ্যটা চোখে পড়ে তার। হাতমুখ বাঁধা এক যুবতীর লাশ ভাসছে পুকুরে। মুখটা কাপড় দিয়ে বাধা বলে চেহারা বোঝা যায় না। হাত দুটো বাঁধা বুকের কাছে। শরীরে কাপড় নেই। সাদা শরীরটা জলের ওপর স্থির হয়ে আছে। লোকে বলাবলি করছে, রেপ কেস। রেপ করে, হাত মুখ বেঁধে পুকুরে। ফেলে দিয়ে গেছে। থানায় খবর দেয়া উচিত।

আলাউদ্দিন আলী পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে সব শোনে, সব দেখে। বহুদিন খরার পরে কাল বৃষ্টি হয়েছিল। লাইটপোস্ট চাপা পড়ে গলির মুখে পড়েছিল এক যুবক। হলেও সে তার হারিয়ে যাওয়া ভাই হতে পারে। ভোররাতে সুফিয়ার এবরসন হয়ে গেল। এখন ধর্ষিতা যুবতীর লাশ ভাসছে পুকুরে। এসবের মানে কী?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *