পাগল সাহেব

পাগল সাহেব

বাগানের গাছপালায় বিকেল শেষ হয়ে আসছে দেখে এসডিও সাহেব একটু বিরক্ত হন। শ্রীনাথ হারামজাদা গেল কোথায়? বিকেল পড়ে গেল, এখনও আসছে না কেন? শ্মশানখোলায় গিয়ে একা একাই চিতায় ওঠল নাকি!

কারো ওপর রেগে গেলে সাহেব একটু ঘন ঘন সিগ্রেট খান। আর চা। খালি কাপেও অনেক সময় চুমুক দিয়ে ফেলেন। অন্যমনস্কতা। এই যেমন এখন। আনমনে হেঁটে হেঁটে টেবিলটার সামনে যান সাহেব। বিকেলবেলা, শীতকাল গরমকাল নেই সাহেবের একটু বাগানে বসার অভ্যেস বলে, বেতের গোলটেবিল আর একটা চেয়ার চিরকালের জন্য পাতা আছে বাগানে। বিকেলবেলা চাকর আবদুল কাদের চিনেমাটির কেটলি ভর্তি চা, একটা কাপ আর সিগ্রেট-ম্যাচ রেখে যায়। একা বাগানে, গাছপালার ছায়ায় ফুলের গন্ধে আর মফঃস্বল শহরের পুরোনো হাওয়ায় বসে চা খেতে, সিগ্রেট খেতে সাহেব খুব পছন্দ করেন। তার পরনে তখন আশি সুতোর মিহি লুঙি, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি।

এই দেখে প্রথম প্রথম স্ত্রী খুব আপত্তি করতেন। তুমি এই শহরের এসডিও। বড় সাহেব। সবাই তোমাকে চেনে, শ্রদ্ধাভক্তি করে। বিকেলবেলা তুমি যে লুঙিগেঞ্জি পরে বাগানে বস, বাড়ির পাশ দিয়ে সারা শহরের লোকজনের চলাচল, তারা দেখে কী ভাবে বলো তো!

 শুনে সাহেব তাঁর মোটা কাঁচের চশমা নাকের ওপর একটুখানি ঠেলে দেন। তারপর ডানদিকের জ্বতে ছোট বড় তিনটে গিঁট ফেলে বললেন, কী ভাবে?

স্ত্রী বুঝতে পারেন, সাহেব রেগে গেছেন। রেগে গেলে তার ডানদিকের জতে ছোট বড় তিনটে গিঁট পড়ে। গলার স্বর অচেনা হয়ে যায়।

স্ত্রী আর কথা বলেন না। সাহেব বললেন, যতক্ষণ কাছারিতে থাকি, আমি ততক্ষণ এসডিও। বাইরে আমি একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি। লোকের ভাবাভাবিতে আমার কিছু এসে যায় না। এসডিও হয়েছি বলে, নিজের বাড়িতেও কি আমি আমার প্রিয় অভ্যেসগুলো পালন করতে পারব না! তাছাড়া লুঙি পরে, বিকেলবেলা একা একা বাগানে বসে চা সিগ্রেট খাওয়ার সুখ আমি ছাড়া কে বোঝে।

 প্রথম প্রথম স্ত্রী দুএকদিন তার সঙ্গে বাগানে গিয়ে বসেছেন। কিন্তু বসেই টের পেয়েছেন সাহেব তার উপস্থিতি পছন্দ করেন না, কিন্তু সাহেব মুখে কিছুই বলেননি। মেয়েমানুষেরা চিরকালই মেয়েমানুষ বলে এসব ব্যাপার বুঝতে পারে। সাহেবের স্ত্রীও বুঝতে পেরেছিলেন। তারপর আর কখনো যাননি। বিকেলবেলা দোতলার রেলিঙে দাঁড়িয়ে মাঝেমধ্যে স্বামীকে দেখেন। একাকী বাগানে বসে আছে কিংবা পায়চারি করছে, চা সিগ্রেট খাচ্ছে। এতকালের চেনা লোকটাকে তখন যে কী অচেনা মনে হয়! এই লোকটাই তাঁর সন্তানের পিতা। বিকেলবেলা রেলিঙে দাঁড়িয়ে প্রায়ই তার এই কথাটা মনে হয়।

এই শহরে আসার কিছুদিন পরে, স্কুল থেকে ফিরে মেয়ে রাণী একদিন বলল, মা জানো বাবা কী করেছেন?

কী?

পেশকার সাহেব তাঁর মেয়েকে নাটকে পার্ট করতে দেবেন না বলে বাবা নাকি তাঁকে খুব বকেছেন। এই নিয়ে স্কুলের মেয়েরা, আপারা খুব হাসাহাসি করেছে আজ। দু একজনকে বলতে শুনলাম, এসডিও সাহেবের মাথায় ছিট আছে।

রাতেরবেলা কথাটা বলতেই এসডিও সাহেব রেগে গেলেন। ডানদিকের জাতে তিনটে গিঁট ফেলে বললেন, মেয়েটার পার্ট করার খুব ইচ্ছে, বুঝেছ। স্কুলে কয়েকবার করেছেও। একবার নাকি বেগম রোকেয়ার চরিত্রে চমৎকার পার্ট করেছিল। তাছাড়া নীলকণ্ঠবাবুরা এবার যে নাটকটা করছে, তার নায়িকার পার্ট ঐ মেয়ে ছাড়া আর কাউকে দিয়ে হবে না।

স্ত্রী গম্ভীর গলায় বললেন, হোক না হোক তাতে তোমার কী?

এ কথায় সাহেব ভীষণ অবাক হয়ে যান। কী বলছ, আমি তো নীলকণ্ঠবাবুদের উপদেষ্টা। ওদের নাটকটি যাতে ভালোভাবে হয়, তা আমি দেখব না! তাছাড়া মেয়েটার যদি উৎসাহ না থাকত তাহলে অন্য কথা। ওর ইচ্ছে তো ষোলোআনা। নীলকণ্ঠবাবু বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছে। বলেছে, বাবাকে বলবেন। কিন্তু পেশকার সাহেবকে বলায়, তিনি পারলে নীলকণ্ঠবাবুকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করেন। তখন বাধ্য হয়েই আমি—

এসডিও সাহেব একটু থামেন। তারপর কথা নেই বার্তা নেই হো হো করে হেসে ওঠেন। বুঝলে, পেশকার সাহেবকে কীরকম ম্যানেজ করলাম। লোকটার ঘুষফুষ খাওয়ার অভ্যেস। আমি এখানে আসার পরপরই কিছু কাগজপত্র হাতে এসেছে। প্রমাণাদি। সেগুলো হাতে নিয়ে ধীর গলায় বললাম, পেশকার সাহেব চাকরিটা করার ইচ্ছে থাকলে আজ থেকে মেয়েকে রিহার্সেলে পাঠিয়ে দেবেন।

 তারপর আবার সেই হাসি। প্রাণখোলা। দেখে স্ত্রী সেই মুহূর্তে আরেকবার ভেবেছেন, সত্যি কি এই লোকটা তার সন্তানের পিতা!

 সেই নাটকের টাকা-পয়সাও জোগাড় করে দিয়েছিলেন এসডিও সাহেব। কোর্ট থেকেই টাকা উঠেছিল বেশি। যাকে যাকে জামিন দিয়েছেন, তাদের উকিলদের বলেছেন, জামিন দিলাম। কিন্তু একটা কথা আছে আমার। নীলকণ্ঠবাবুদের নাটকে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা দেবেন।

সেই নাটক স্ত্রীকন্যা নিয়ে দেখতে গিয়েছিলেন এসডিও সাহেব। মফঃস্বল শহরের নাটক ইত্যাদি শুরু হয় রাত আটটার পর। চলে রাত একটা দুটো অব্দি। এই ব্যাপারটা স্ত্রীর খুব অপছন্দ। তিনি যেতে চাননি। বলেছিলেন, রাণীকে নিয়ে তুমি যাও।

শুনে সাহেবের ডান ভ্রূতে সেই তিনটে ছোটবড় গিঁট। দেখে স্ত্রী আর আপত্তি করেননি। কিন্তু এই লোকের সঙ্গে কে যায় নাটকফাটক দেখতে। মফঃস্বল শহরের ওই নাটক, ছেলেপানদের পার্ট, তাই দেখে কী খুশি সাহেব! তিন চারটে সিন রিপিট করিয়েছেন। নাটক চলছে, একটা সিন শেষ হয়েছে, সামনের সারি থেকে অমনি চেঁচিয়ে উঠলেন সাহেব, আহা এই সিনটা বড় চমৎকার হয়েছে। রিপিট করো।

 আবার শুরু হল পুরোনো সিন। এইভাবে তিন চারবার। দেখে পাবলিক তো বিরক্ত হয়েছেই, স্ত্রী কন্যাও কম হয়নি। কিন্তু কারও কিছু বলার নেই।

এই তো গেল এক উৎপাত। সবচে বাজে ব্যাপারটা ছিল, হাতে একটা বেত নিয়ে বসেছিলেন সাহেব। মঞ্চের সামনে, মেঝেতে বাচ্চাকাচ্চারা বসেছিল। অকারণে তারা তো চেঁচামেচি করবেই। আর তাতেই সাহেবের মাথা গরম। প্রায়ই বেত হাতে দাঁড়িয়ে পড়েন। দুচার ঘা লাগিয়ে দেন। তখন তাকে দেখায় পাঠশালার পণ্ডিত মশায়দের মতো। ওই শ্রেণীর লোকদের স্ত্রীর খুব অপছন্দ।

তারপরও মাসে মাসে নাটক হয় শহরে। সাহেব হলেন বড় উদ্যোক্তা। প্রায়ই রিহার্সেল দেখতে যান। চাঁদাফাদা তুলে দেন। আর নাটকের দিন তো তিনিই সব। কিন্তু স্ত্রী আর যান না। কোনও না কোনও অছিলায় বাড়ি থাকেন। কষ্টটা যায় রাণীর ওপর দিয়ে।

কিন্তু সবচে বাজে কাজটা সাহেব করলেন কিছুদিন আগে। শহরের কলেজে পড়া মুসলমান একটা ছেলের সঙ্গে কবিরাজ বেণীমাধববাবুর বড় মেয়ের প্রেম। শহরের সবাই জানে। কিন্তু হিন্দু মুসলমানের প্রেম, ব্যাপারটা কেউ ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু দুজনেই ডেসপারেট। বিয়ে করবেই।

এসব শুনে কবিরাজ মশাই দুতিনবার মেয়েকে কোলকাতা পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। বারবারই ছেলেটা তার দলবল নিয়ে স্টেশানে গিয়ে উপস্থিত হয়। উপায় না দেখে কবিরাজ মশায় কেস করেন।

একদিকে ছেলের বাপও খুব রেগে গেছে ছেলের ওপর। সে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করবে, কাছারিতে গেছে।

এসডিও সাহেব ঘটনাটা আগেই শুনেছিলেন। ছেলেটা নাটকফাটক করে। তার কাছে। গিয়ে কেঁদে পড়েছে, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না স্যার।

এসডিও সাহেব একদিন সকালে কাছারিতে গিয়েই কবিরাজ মশায় আর ছেলের বাপ দুজনকেই পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে এনেছেন। এনে সোজা হাজতে ভরেছেন। তারপর নিজে টাউন হলে কাজি ডাকিয়ে, শহরের আরো দুচারজন নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। মিষ্টি কেনার টাকা আর কাজির খরচ ছেলেটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নিশ্চিন্তে সব করো। দুজনকেই আমি হাজতে আটকে রেখেছি। বিয়ে শেষ হলেই ছাড়া পেয়ে যাবে। আমি বলে দিয়ে এসেছি।

সেই বিকেলে কী যে হৈ চৈ শহরে। ছেলে ছোঁকরারা সাহেবের খুব ভক্ত হয়ে গেল। শোনা যায়, ছেলের বাপ আর কবিরাজ মশায়কেও নাকি সেই বিয়ের মিষ্টি খাইয়ে ছেড়েছেন সাহেব। কিন্তু এসবের ফলে এসডিও সাহেবের বাসায় ছোট্ট একটা সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্ত্রী তার সঙ্গে কয়েকদিন কথা বলেন না।

 তিন চারদিন দেখে সাহেব একদিন নিজেই স্ত্রীকে বললেন, তুমি অযথা রাগ করে আছ। আমি কোনও অধর্ম করিনি, কোনও পাপ করিনি। সত্যিকারের প্রেমই তো বড় ধর্ম। ওরা দুজন দুজনকে ছাড়া বাঁচবে না। তোক হিন্দু মুসলমান। আমি দুজনকে মিলিয়ে দিয়েছি।

সেই সাহেব এখন এই শেষ বিকেলে অস্থিরভাবে বাগানে পায়চারি করছেন। পরনে আশি সুতোর মিহি লুঙি, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। হাতে সিগ্রেট জ্বলছে। আর ঘুরে ঘুরে চায়ের টেবিলের সামনে গিয়ে শ্রীনাথ রিকশাঅলার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আজ পূর্ণিমা। শ্রীনাথকে সকালবেলা বলে রেখেছেন, সন্ধ্যেবেলা তার রিকশা চড়ে শহরের বাইরে যাবেন পূর্ণিমা দেখতে। বহুকাল খোলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখা হয়নি তার।

 কিন্তু শ্রীনাথ হারামজাদা আসছে না কেন? সন্ধ্যে হয়ে এল!

সাহেব আবার একটা সিগ্রেট ধরান। কেটলি থেকে ঠাণ্ডা চা ঢালেন কাপে। তারপর পায়চারি করতে করতে কাপে চুমুক দেন।

তখন কোয়ার্টারের পেছনে মরা ব্রহ্মপুত্র তার ওপারে শস্যের যে উদার মাঠ, সেই জায়গাটা ভেঙেচুরে পূর্ণিমার চাঁদ আকাশে ওঠে আসে। ওঠেই লক্ষকোটি জ্যোত্সর রেখা পাঠিয়ে দেয় শহরের ওপর। মরা ব্রহ্মপুত্রের পুরোনো হাওয়াটা সেই মুহূর্তে একটুখানি জোরদার হয়। জ্যোৎস্নার রেখা বয়ে আনে এসডিও সাহেবের বাগানে। চা খেতে খেতে দৃশ্যই দেখেন সাহেব, দেখে মাথা খারাপ হয়ে যায় তার। এই রকম একটা। দৃশ্যই আজ শহরের বাইরে, ভোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। সকালবেলা শ্রীনাথকে বলে রেখেছিলেন।

কিন্তু শ্রীনাথ হারামজাদাটা এখনো আসছে না। সাহেব ঘন ঘন সিগ্রেটে টান দেন। প্রচণ্ড রেগে গেলে যা হয় তার।

 তখন নিঃশব্দে শ্রীনাথের রিকশা এসে দাঁড়িয়েছে বাগানের ওপারে। গাছপালার ফাঁক ফোকর দিয়ে বুড়ো শ্ৰীনাথকে দেখতে পান সাহেব। খালি গা, কোমরের তলায় কোরা ধুতিটা লুঙির মতো করে পরা। আর শ্রীনাথের কোমরে যে ময়লা গামছাটা দিনমান বাঁধা থাকে, সেটা এখন তার হাতে। শ্রীনাথ কি খুব ক্লান্ত! বহুদূর থেকে রিকশা চালিয়ে এসেছে!

গাছপালার আড়াল থেকে সাহেব দেখেন শ্রীনাথের বুকের হাড় শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে খেলা করছে। দাড়িগোঁফঅলা কালো মুখটা হা করে ব্রহ্মপুত্রের পুরোনো হাওয়া খাচ্ছে শ্রীনাথ। জলের মতো স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায়ও শ্রীনাথের চোখ দেখা যায় না। দু খাবলা অন্ধকার জমে আছে দুচোখে। হাওয়ায় বুড়ো শ্রীনাথের পাতলা চুল ফুরফুর করে ওড়ে। দেখে সাহেব তার যাবতীয় রাগের কথা ভুলে যান। পূর্ণিমা দেখতে যাবেন শ্রীনাথকে বলে রেখেছিলেন, ভুলে যান। মনে মনে এই মুহূর্তে সাহেব কেবল একটা কথাই বলেন, ভাই আমার ভাই।

তারপর আশি সুতোর মিহি লুঙি পরা, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, সাহেব গিয়ে দাঁড়ান শ্রীনাথের রিকশার সামনে। লুঙি গেঞ্জি পরে তিনি কখনো গেটের বাইরে যান না, একথা তাঁর মনে থাকে না।

সাহেবকে দেখেই সিট থেকে লাফিয়ে নেমেছে শ্রীনাথ। দেরি হইয়া গেছে সাব। ক্ষমা কইরেন। ম্যালা দূরে গেছিলাম।

সাহেবের ঠিকই সেই মুহূর্তে, পুর্ণিমা দেখতে যাবেন মনে পড়ে। কথা না বলে তিনি রিকশায় ওঠে বসেন।

গেঞ্জি গায়ে লুঙি পরা সাহেবকে রিকশায় ওঠতে দেখে শ্রীনাথ খুব অবাক। আগেই খানিকটা হয়েছিল। দেরি করেছে, সাহেব তাকে একটুও বকল না যে! আবার এখন যে খালি গায়েই রিকশায় ওঠে! তবুও শ্রীনাথের কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না। সিটে বসে জিজ্ঞেস করে, টাউনের বাইরে যামু সাব?

সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, যা।

তখন জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে শহর। রাস্তার আলোগুলো জ্যোৎস্নায় মার খেয়ে পিটপিট করে জ্বলছে। দেখে ভীষণ বিরক্ত হন সাহেব। মনে মনে ইলেকট্রিক সাপ্লাইয়ের লোকজনের ওপর বেজায় চটে যান তিনি। এই রকম জ্যোৎস্নায় ইলেকট্রিসিটির দরকার কী! কালই অর্ডার দিতে হবে পূর্ণিমা রাতে যেন শহরের রাস্তাঘাটে ইলেকট্রিসিটি না থাকে। অযথা অপচয়।

কিন্তু ততক্ষণ সারা শহরে খবর হয়ে গেছে, এসডিও সাহেব গেঞ্জি গায়ে রিকশা করে বেরিয়েছেন, রাস্তার দুপাশ থেকে বাড়িঘর থেকে, মুদিমনোহারি, পান-বিড়ি-সিগ্রেট চায়ের দোকান, ডিসপেনসারি, লাইব্রেরি থেকে লোকজন সব অবাক হয়ে এসডিও সাহেবকে দেখছে। কেউ কেউ সালাম দিচ্ছে। সাহেব এসবের কিছুই দেখছেন না। . সালাম নিচ্ছেন না। কেবল মোটা কাঁচের ভেতর থেকে চাঁদ দেখছেন, জ্যোৎস্না দেখছেন।

ব্যাপারটা খেয়াল করছিল শ্রীনাথ। সাহেবকে দেখে পাবলিক মজা পাচ্ছে। গেঞ্জি গায়ে, লুঙি পরা এসডিও সাহেব রিকশা চেপে শহরে বেরিয়েছেন এমন মজার দৃশ্য যেন জগতে আর নেই। কথাটা ভেবে শ্রীনাথ খুব বিরক্ত হয়। সওয়ারি হল গিয়ে দেবতা। দেবতাকে দেখে লোকে হাসাহাসি করবে শ্রীনাথ তা সয় কেমন করে। সারা দিনের ক্লান্ত শরীর। জোর বল নেই গায়ে। বয়স। রিকশা চালাতে পা টনটনায়, অবশ হয়ে আসে। তবুও প্রাণপণে হাওয়ার বেগে রিকশা চালায় শ্রীনাথ। পাপিষ্ঠদের চোখ থেকে যত দ্রুত নিকেশ হওয়া যায়।

মুন্সেফ কোর্ট ছাড়িয়ে একটা সিনেমা হল। সবে ইভিনিং শো শুরু হয়েছে। রিকশা হলের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, কথা নেই বার্তা নেই হৈচৈ করে যাবতীয় লোকজন হল ছেড়ে রাস্তায়।

শ্রীনাথ বুঝতে পারে, সিনেমার দৃশ্যের চেয়েও মজার দৃশ্য রাস্তায়, সেই দৃশ্য দেখতে লোকজন সব বেরিয়ে আসছে।

কিন্তু সাহেব কি এসবের কিছু খেয়াল করেন? করেন না। করে শ্রীনাথ। আর রাগে জ্বলে যায়। সওয়ারি হল দেবতা। দেবতার অপমান শ্ৰীনাথ সইতে পারে না। বুড়ো শরীরের যাবতীয় শক্তি দুপায়ে এনে রিকশা চালায়। মুহূর্তে পেরিয়ে যায় জায়গাটা।

শহরের শেষপ্রান্তে পাকা বড় রাস্তাটা যেখানে শেষ, সেখানে হাসপাতাল। রিকশা সেখানে আসতেই সাহেব আকাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে অবাক হয়ে হাসপাতাল বিল্ডিংটা দেখেন। শাদা বিল্ডিঙে জ্যোত্সা পড়ে কী যে একটা দৃশ্য! রূপকথার ঘুমন্ত রাজপুরী মনে হয়! ভেতরে কি সোনার কাঠি রুপোর কাঠি শিয়রে রাজকন্যা ঘুমিয়ে আছে! সাহেব ছেলেমানুষের মতো এই কথাটা ভাবেন। তারপরই চমকে ওঠেন। চিনতে পারেন, এটা হাসপাতাল। মনটা খারাপ হয়ে যায়। আহা, শরীরে অসুখ নিয়ে মানুষেরা শুয়ে আছে ওখানে! কষ্ট যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আছে। রোগকাতর মানুষের উদ্দেশ্যে যিশুখৃস্টের মতো অস্পষ্ট স্বরে সাহেব তারপর বললেন, ঈশ্বর উহাদের পরিত্রাণ করুন।

শ্রীনাথ বলল, এইবার কুন দিকে যামু সাব? পাকা রাস্তা তো এহেনেঐ শেষ!

জ্যোত্সায় সাহেব দেখেন বুড়ো শ্রীনাথ ক্লান্তিতে ভেঙেচুরে যাচ্ছে।

দুটো কথা সম্পূর্ণ করতে চারবার শ্বাস টেনেছে।

সাহেব বললেন, শহরের বাইরে যাওয়ার পথ নেইরে শ্রীনাথ?

আছে সাব। কাঁচা। ঝাঁকানি লাগব আপনের।

 লাগুক। তুই যা।

রিকশা থেকে নেমে আস্তেধীরে রিকশাটা হাতে টেনে নেয় শ্রীনাথ।

কাঁচা রাস্তায় নামায়। তারপর আবার রিকশায় ওঠে।

সাহেব দেখেন, শহরের বাইরে উদার শস্যের মাঠ প্রান্তর অব্দি। তাতে নিজের যাবতীয় জ্যোৎস্না ঢেলে দিয়েছে চাঁদ। আর চিরকালের পরোনো হাওয়াটা তো আছেই। এখন জ্যোত্সায় শস্যের মাঠে দুরন্ত শিশুর মতো লুটোপুটি খাচ্ছে।

সাহেব অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আহা!

শ্রীনাথ সে সময় খুকখুক করে খানিক কাশে। সাহেব শোনেন শ্রীনাথের গলায় সারা জীবনের ক্লান্তি। তারপর হঠাৎই চমকে ওঠেন তিনি। আহা, ভাই আমার ভাই। আমাকে এই এতদূর টেনে এনেছো। আমি মূঢ় তোমার কষ্ট বুঝিনি।

 তারপরই চেঁচিয়ে ওঠেন সাহেব। শ্রীনাথ তুই পেছনের সিটে যা।

শুনে শ্রীনাথ হাসে। কেন সাব?

তুই তো আমাকে অনেক দূর নিয়ে এলি, এবার আমি তোকে খানিক দূর নিই।

 শ্রীনাথ মূর্খ। প্যাচানো কথা বোঝে না। বলল, কী কন সাব?

তুই আরাম করে পেছনে বস। আমি রিকশা চালাই।

শুনে আঁতকে ওঠে শ্রীনাথ। হায় হায় কন কী সাব! আমার কুন দোষ অইছে! আস্তে চালাইছি! আপনে বহেন। দেহেন এহন কেমুন জোরে চালাই।

সাহেব হাসেন। না না ওসব কিছু না। তুই পেছনে বোস।

শ্রীনাথ কিছু বুঝতে পারে না। সিট থেকে নেমে কাচুমাচু হয়ে সাহেবের সামনে দাঁড়ায়।

সাব আমার অপরাধ অইছে? আপনে রাগ করেছেন?

আরে না পাগল। তুই বোস। আমি চালাই। তুই তো অনেকক্ষণ চালালি। তাছাড়া নিজে তো সারাজীবন মানুষ টেনে গেলি, আজ কেউ তোকে টানুক।

এবার কথাটা বোঝে শ্রীনাথ। বুঝে হা হা করে ওঠে। এইডা অয় না সাব। ভগবান মানুষরে এমুন কইরাঐ পয়দা করছে। কেঐ চিরদিন টাইন্না যায়, আর কেঐ যায় বইয়া আপনে বহেন।

 একথায় সাহেব একটু রেগে যান। গলা ভারি করে বলেন, শ্রীনাথ যা বলছি কর।

তারপর লুঙিটা হাটুর ওপর তুলে পরেন। চশমাটা খুলে দেন শ্রীনাথের হাতে। এটা চোখে পরে বোস। আর তোর গামছাটা দে আমাকে।

শ্রীনাথ কিছুই বুঝতে পারে না। বোকার মতো চশমাটা পরে। আর গামছাটা খুলে দেয় সাহেবের হাতেই। তারপর জবুথবু হয়ে পেছনের সিটে ওঠে বসে। সাহেবের পুরু কাঁচের চশমা তার চোখে। সেই চোখে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবকিছু অন্যরকম দেখে শ্রীনাথ।

 শ্রীনাথের গামছাটা শ্রীনাথের মতো করে কোমরে বাঁধে সাহেব। তারপর রিকশা চালাতে শুরু করেন। প্রথম কয়েকটি প্যাডেল মারতে তার একটু অসুবিধা হয়। হ্যাঁন্ডেল এদিক ওদিক ঘুরে যায়। তাই দেখে শ্রীনাথ হাসে। নামেন, পারবেন না সাব। যার কাম তারে করতে দেন। আমি রিকশায় বইয়া থাকুম আর আপনে রিকশা চালাইবেন, ভগবান সইব না।

সাহেব ততক্ষণে কায়দাটা শিখে ফেলেছেন। এখন আস্তেধীরে চালিয়ে যাচ্ছেন। চোখে তার চশমা নেই। চশমা ছাড়া পৃথিবীটা তিনি খুব অন্যরকম দেখেন। দুপাশে শস্যের মাঠ। তাতে নীল জ্যোৎস্না উপুড় হয়ে পড়েছে। আবহমান হাওয়াটা আছেই। শস্যচারা আর জ্যোৎস্নার উপর লুটোপুটি খাচ্ছে। এসবের মাঝমধ্যিখান দিয়া সাদা পথ। কোথায় কোন দূরে যে চলে গেছে। সেই পথে রিকশা চালান এসডিও সাহেব। পেছনের সিটে চশমা চোখে শ্রীনাথ। পৃথিবীটা সে এখন খুব অন্যরকম দেখছে।

সাহেব বললেন, শ্রীনাথ আজ তোর ভগবানের সঙ্গে দেখা করব।

চশমা পরা চোখে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে শ্রীনাথ। কথা বলে না। শস্যের মাঠে, আবহমান হাওয়ায় আর জ্যোৎস্নায় ভগবান যে কোথায় লুকিয়ে আছেন, দুজন মানুষের কেউ তা জানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *