মমিন সাধুর তুকতাক

মমিন সাধুর তুকতাক

গোয়ালীমান্দ্রার হাটে, বুড়ো বটের তলায় মমিন সাধুর আখড়া। মাথার ওপর চারখান ঢেউ টিন ফেলে, চারদিকে খলপার বেড়া মমিন সাধুর সংসার। সংসারে সাধুর এক বোন, ঝুমঝুমি। ডগমগ বয়েস তার। জোয়ারে খাল যেন। হাটাচলা যেন কার্তিকের কাশবন, বাতাসে নুইয়ে নুইয়ে পড়ে। হাসিতে যেন বর্ষার জলের শব্দ। কথা তো বলে যেন নির্জন দুপুরে দিকপ্রান্তর মুখরিত করে গান গায় কোন মোহন পাখি।

জগৎসংসারে ঐ একটি আপনজন সাধুর। কবে কোন বালক বয়সে তিন বছরের ন্যাংটো। বোন ঝুমঝুমিকে কাঁধে বসিয়ে পথে নেমেছিল সাধু এখন আর তা মনে নেই। দিন চলে গেছে।

সাধুর বয়স এখন ভাটির দিকে। ঝুমঝুমির বয়স যেন জোয়ারের শেষ বেলা। বোনটির বিয়ে দেবে না সাধু। বিয়ে দিলে ঝুমঝুমি যাবে পর হয়ে। সংসারে আপনজন কেউ থাকবে না সাধুর। আপনজন কেউ কাছাকাছি না থাকলে সাধুর তুকতাক নষ্ট হয়ে যাবে। না খেয়ে মরণ।

এই জন্যে ঝুমঝুমির বিয়ে দেয় না সাধু। দুঃখে ঝুমঝুমি সংসার বিরাগী। আলায় বালায় ঘুরে বেড়ায়। পরনে জংলি ছাপার শাড়ি। হাটখোলার পাশে শাড়ির আঁচলের মতো। খাল। খালের ওপারে নিবিড় গাছপালার জঙ্গল। খাল পেরিয়ে ঝুমঝুমি সেই জঙ্গলে যায়। বসে থাকে। বসে বসে বিয়ে না হওয়ার দুঃখে কাঁদে। গান গায় : রসিকা নাগর বন্ধু কথা কইয়া যাও।

 কিন্তু নাগর আসে না তার।

ঝুমঝুমির দুঃখে জঙ্গলের গাছপালা নিথর হয়ে থাকে। সাধু তখন আখড়ায় বসে গাঁজা টানে। গোয়ালীমান্দ্রার হাট বসে মঙ্গলবার। আগের দিন বিকেল থেকে প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত হাটুরেদের হল্লাচিল্লায় মুখরিত হয়ে থাকে হাটখোলা। দূর দুরান্ত থেকে মহাজনরা আসে, পাইকাররা আসে। মহাজনি নাও ডিঙি, নাও কেরায়া, নাও কোষা, কত পদের নাও যে আসে খালে, মানুষের মাথা মানুষে খায়। এলাহি কাণ্ড। আনাজপাতি, ধান, চাল, পাট, গরু, ছাগল, মুদি মনোহারি দোকান সবকিছু মিলিয়ে অদ্ভুত একটা গন্ধ থাকে হাটখোলায়। সঙ্গে মানুষের গায়ের গন্ধ। বাতাসটা ভারি হয়ে থাকে। দিনটা ঝুমঝুমির খুব আনন্দে কাটে। কত কিসিমের পুরুষ যে দেখে। দেখে কামভাব জাগে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে। ঝুমঝুমির সেই ছটফটানি কেউ টের পায় না। হাটুরেরা ফিরেও তাকায় না ঝুমঝুমির দিকে। সাধুর বোন। বদ চোখে তাকালে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে। সাধু খুব কামেলদার। মুখে যা বলে তাই ফলে।

হাটবার সাধুর কাজের আকাল নেই। বিয়ান রাতে ওঠে গেরুয়া বসন পড়ে। ঠায় বসে তিন ছিলিম গাঁজা টানে। গলায় পরে একশো এক পদের জীবের হাড় দিয়ে তৈরি মালা। তারপর হাতে লোহার দীর্ঘ চিমটা, সাধু বেরোয়। ঘুরে ঘুরে দোকানিদের কাছে যায়। মুখে কথা নেই, হাতের চিমটা বাজিয়ে ফুঁ দেয়। সেই ছুঁয়ে দোকানিদের বিক্রিবাটা ভালো হয়। বিনিময়ে সাধু গেরুয়া টোপর ভরে যায় আনাজপাতি, চাল, মাছ, আর নগদ পয়সায়। সেই আয়ে সাতদিন কাটে রাজার হালে। এ সব দেখে ভেতরে ভেতরে ফেঁসে ঝুমঝুমি। বুজরুকি, সব বুজরুকি। তারপর উদাস হয়ে খালের ওপারে খেয়াঘাটের সঙ্গে যে মুদিমনোহারির দোকান সেদিকে তাকিয়ে থাকে। একটা দুটো লোক দিনমান থাকে দোকানে। লোকগুলোকে দেখে আরাম পায় ঝুমঝুমি। ঠিক তখুনি হাট ছেড়ে আখড়ায় ফেরে সাধু। ঝুমঝুমি বসে থাকে ঘরের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে। ঘরে ঢুকে সাধু আনাজপাতি, চাল, ডাল সব রাখে আগলে। তারপর মনোযোগ দিয়ে পয়সা গুণতে বসে। আড়চোখে ঝুমঝুমি সব দেখে। কিন্তু কথা বলে না।

যেদিন আয়বরকত ভালো, সাধুর সেদিন খুব ফূর্তি। পয়সাপাতি ট্র্যাকে খুঁজে খালি গায়ে সাধু গিয়ে বসে বটতলায়। সেখানে চৌপ্রহর হোগলা পাতা, গেঁজেল সাকরেদরা বসে থাকে। অলস হাতে গাঁজা বানায়, টানে। নেশা হলে একটা-দুটো কথা বলে সাধু। চেঁচিয়ে ঝুমঝুমিকে ডাকে, ওলো ঝুমঝুমি ভাত চড়া।

আলগা চুলোয় ভাত চড়িয়ে ঠিলা কাঁধে ঝুমঝুমি যায় হালে পানি আনতে। যাওয়ার আগে সাধুকে গালাগাল করে যায়, তোমার ভাত রানতে রানতেই দিন যাইব আমার! নিজে একখান মাগ আনতে পার না! আমার সর্বনাশ করতাছ কেন?

নিজের বিয়ের কথা স্পষ্ট করে বলে না ঝুমঝুমি। হাজার হোক মেয়েমানুষ তো, মুখ ফোটে না। তবে বেঁকা কথায় সাধুকে বুঝায়। সাধু বুঝেও বুঝে না। গাঁজার নেশায় ঘ্যাক ঘ্যাক করে হাসে। তুই হইলি আমার লক্ষ্মী। আমার তন্ত্র। মাগ আনলে তন্ত্র নষ্ট অইব। শুনে সাকরেদরা মাথা নাড়ে।

এভাবে দিন যায়। বৈশাখ শেষ হয়ে জষ্ঠি মাস পড়ে। খালে নূতন জোয়ারের জল ফুলে ফুলে ওঠে। যখন তখন মহাজনি নাও যায়। হাটবার ছাড়াও জায়গাটার কোলাহল থাকে। ঝুমঝুমির মনে পুরনো ফূর্তিটা ফিরে আসে। হাটবার ছাড়া জায়গাটা বড় নিরালা। শূন্য চালাঘর আর বটের পাতায় বাতাসের শব্দ ছাড়া অন্য কোনও শব্দ থাকে না। শব্দহীনতা ঝুমঝুমির বড় কষ্ট। জষ্ঠির মাঝামাঝি একটা বেদের বহর এসে লাগে হাটখোলায়, সাধুর আখড়ার অদূরে। এক কুড়ি নাও। নাওয়ের ভেতর মানুষের ঘরবাড়ি। বহরটা এসে লাগে সন্ধ্যায়। সন্ধ্যেবেলাই সেদিন নিকষ অন্ধকার নেমেছিল চারদিকে। গাঁজা টেনে বুঁদ বঁধ হয়ে পড়েছিল সাধু। শুয়ে ছিল ঝুমঝুমিও। কিন্তু তার চোখে ঘুম ছিল না। রাতের বেলা সহজে ঘুম আসে না ঝুমঝুমির। শরীরের ভেতর। যৌবনের কষ্ট। মরদ চাই। বিছানা শুয়ে হাঁসফাঁস করে ঝুমঝুমি। এপাশওপাশ করে। বটের পাতা হাওয়ার চলাচল। হাটখোলার শূন্য চালাঘরে হাওয়ার চলাচল সব ছাপিয়ে ঝুমঝুমি শোনে খেয়াঘাটের কাছে জনমনিষ্যির কোলাহল। একটা কুকুর ঘেউ দিচ্ছে বারবার। এত রাইতে মানুষজন আইল কই থনে, কী বেত্তান্ত, এসব ভাবতে ভাবতে শরীরের ভেতর যৌবনের কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ঝুমঝুমি। পরদিন সকালবেলা দেখে খেয়াঘাটের কাছে বেদের বহর। খালভরা বেদের নাও। বুড়োবুড়ি, জোয়ানমরদ, পোলাপান মিলে ম্যালা লোকজন। খালপাড়ের মাটিতে নেমে ছুটোছুটি করছে পোলাপান। হাটখোলায় ওঠে হাঁটাহাঁটি করছে মরদরা। খালের ওপারে জঙ্গল থেকে পেশাব-পায়খানা সেরে ফিরছে বেদে-বেদেনিরা। একটা পাহাড়ি কুত্তা বেদের নাও থেকে নেমে খালপাড়ের বাইলামাটি শুকতে শুকতে ঘেউ দিচ্ছে। বটতলায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখে ঝুমঝুমি। তারপর খেয়াখাটের দিকে দৌড়ে যায়। আখড়ায় বসে ঝুমঝুমির ছুটে যাওয়া দেখে সাধুর বুকের ভেতরটা কেন জানি একটুখানি কেঁপে ওঠে। মনে হয়, এই যে ঝুমঝুমি দৌড়ে গেল আর কখনও ফিরে আসবে না।

 বেদের বহরটার কাছে গিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখে ঝুমঝুমি। নাওয়ের ভেতর মানুষের ঘরবাড়ি। সকালবেলাই নাওয়ের ভেতর আলগা চুলোর রান্না চড়িয়েছে বেদেনিরা। পোলাপান হৈ-চৈ করছে। মরদরা তামাক টানছে। একটা নাওয়ের গলুইয়ের কাছে তিনটে খাঁচায় পাহাড়ি ময়না ডাক আর কোড়া। একটা বেজি তুরতুর করে ঘুরছে একটা নাওয়ে। দুটো পালা ঘুঘু বসে আছে টিনের ছইয়ের ওপর। দেখে ভারি আমোদ পায় ঝুমঝুমি।

খানিক ঘুরাঘুরি করার পর বেদেবেদেনিদের কারো কারো সঙ্গে খাতির হয়ে যায় ঝুমঝুমির। সাহস করে ঝুমঝুমি একজনকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা কইথন আইছ গো?

মানুষটা কথা কয় টানা সুরে, কমলাঘাট। বুজলা কমলাঘাট থনে আইছি।

এহেনে কয়দিন থাকবা?

ম্যালাদিন। আমাগো ঠিক আছেনি। বাইদ্দানিরা চুড়ি বেচব আর রসবাত সারাইব। মরদরা যাইবে মা মনসার বাহন ধরতে।

 কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে মরদটা হা করে তাকায় ঝুমঝুমির দিকে। গতরটা তো ঝুমঝুমির জোয়ারের খাল। ঝুমঝুমি ব্লাউজ পরে না, ছায়া পরে না। হেলেদুলে হাঁটলে ভারি পাছা গস্তি নাওয়ের মতন দোল খায় তার, কচি তরমুজের মতন মাই শাড়ির ভেতর থেকে বারবার উঁকি ঝুঁকি দেয়।

মরদটা ঝুমঝুমির গতর দেখে। চোখ ইন্দুরের মতন কুতকুতে তার, শরীরখানা মোষের। মতন। ঝুমঝুমির সঙ্গে কথা বলতে বলতে খালফাড়ে নামে মরদটা। ঝুমঝুমি দেখে। একখানা পা খোঁড়া তার, হাঁটে একটু ত্যাড়া হয়ে।

কিন্তু মানুষটার চোখের দিকে তাকাতে পারে না কেন ঝুমঝুমি। গতরটা সিরসির করে কেন তার? বুকের ভেতরটা কাঁপে কেন?

আঁচলটা ভালো করে বুকে জড়িয়ে ঝুমঝুমি আখড়ায় ফেরে। কিন্তু মনটা পড়ে থাকে বেদের বহরে। কাজকামে মন বসে না তার। খেতে শুতে ভাল্লাগে না। শরীরের ভেতরটা সময় অসময়ে সিরসির করে ওঠে। মরদটা তার দিকে এমন করে তাকিয়ে ছিল কেন? কী আছে তার মনে! চোখে!

একটু বেলা হলে পর, আখড়ায় বসে ঝুমঝুমি দেখে মাথায় চুড়ির ঝাঁকা, কাঁধে রসবাত সারাইয়ের ঝোলা, মরদদের মাথায় সাপের আঁকা, বেদে-বেদেনিরা গাওয়ালে যাচ্ছে। ন্যাংড়া মানুষটা আছে খালপাড়ে দাঁড়িয়ে। সে যাবে না। সে নাওয়ে একলা থেকে কী করে!

ঝুমঝুমি কিছু বুঝতে পারে না। আখড়ায় বসে দেখে, বেদেনিরা হাটখোলা ছাড়িয়ে ওপাশের গ্রামে রাস্তায় নেমেছে। তাদের মৃদু কোলাহলের শব্দ পাওয়া যায়। এক বেদেনি হঠাৎ করে হাঁক দেয়, রস খোসাই, বাত খোসাই, দাঁতের পোকা খোসাই ই ই ই। আখড়ায় বসে ঝুমঝুমি সব শোনে, সব দেখে।

সাধু গেছে সীতারামপুর। ইব্রা জোলার যুবতী মাইয়ারে ভূতে ধরছে। সেই ভূত ছাড়াইতে গেছে সাধু। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ঝুমঝুমির কোনও কাজ নেই। মনটা পড়ে আছে বেদের বহরে। মানুষটা অমন করে তাকিয়েছিল কেন? ঝুমঝুমির শরীরের ভেতর অমন করে কেন? বুকের ভেতরটা কাঁপে কেন? বারবার কেন ছুটে যেতে ইচ্ছে করে মানুষটার কাছে?

দুপুরবেলা ঝুমঝুমি আবার খেয়াঘাটের দিকে যায়। মানুষটা একলা একলা আছে নাওয়ে। নিরালায় ঝুমঝুমি যায় কথা কইতে। পুরুষ মানুষের সঙ্গে গোপনে কথা কওয়া সে যে বড় সুখের।

 ঝুমঝুমি জানত না ওই নাওয়ে ওঁৎ পেতে আছে তার মরণ!

.

জন্মের পর রুস্তম দেখেছে একটা গঞ্জের হাট। ম্যালা মানুষজন, পাইকার মহাজন, চোর। ছেচড়। জগৎসংসারে রুস্তমকে লোকে বলত জাউরা রুস্তম। রুস্তম জাউরা কথার মানে বুঝত না। একগাল হেসে ভিখ মাগত।

গঞ্জের মানুষের দয়াধম্মে ছিল। আনিটা দোআনিটা রুস্তমকে তারা দিত। একটা পেট চলে যেত রুস্তমের। পয়সাটা জমত, খাওয়াটা হত দাকানিদের বাসিপচা খাবার খেয়ে। শোয়ার চিন্তা ছিল না রুস্তমের। গঞ্জের ফকিরফাঁকরার সঙ্গে খোলা চালাঘরে শুয়ে রাত কাটাত। বালক বয়সে রুস্তম দেখতে ছিল নধরকান্তি। গঞ্জের জোয়ান ভিক্ষুকরা রাতের বেলা আলাদা খাতির করত রুস্তমকে। নিজের ভাগের খাবারটা দিত, বিড়িটা সিগ্রেটটা দিত। কখনো আনিটা, দোআনিটা পর্যন্ত। বিনিময়ে রুস্তমকে সঙ্গে নিয়ে শোয়া। তারপর রাতের বেলা রুস্তমের শরীর ঘাঁটাঘাঁটি। সমকামে বালক বয়সেই রুস্তম বেশ পাকাপোক্ত হয়ে যায়।

তারপর যুবা বয়সে পা দিতে না দিতে পায় মেয়েমানুষের শরীরের স্বাদ। দুনিয়ার ম্যালা রহস্য জেনে গেল জাউরা রুস্তম।

ডান পাটা জন্ম থেকে খোঁড়া। ফলে যুবা বয়সে তাগড়া জোয়ান শরীরটা নিয়েও ভিখ মাগাটা ছাড়ল না রুস্তম। খোঁড়া পাটা সম্বল। লোকে পা দেখে পয়সা দেয়, দোকানিরা বাসিপচা খাবার দেয়। বিনা কাজে, বিনা পুঁজিতে পেট চলে যায় রুস্তমের।

ট্যাঁকে পয়সাটাও জমে। আজাইরা খাওন পাইলে গতর খাটায় কে!

 গঞ্জে মানুষ তাগড়া জোয়ান রুস্তমকে দেখে মাঝেমধ্যে জাউরার পো বলে গাল দিত। কাম কইরা খাইতে পারছ না? জুয়ান মরদ মানুষ, শরম লাগে না ভিক্কা করতে?

রুস্তম ডান পাটা দেখিয়ে বলত, পাওখানা যে ন্যাংড়া। কাম করুম কেমতে?

শুনে লোকে থেমে যেত।

আসলে খোঁড়া পায়ে কাজ করতে রুস্তমের অসুবিধা ছিল না। গায়ে ভূতের মতন তাকত। আড়াইমণি চালের বস্তা অনায়াসে পিঠে বয়ে নিতে পারত রুস্তম। নিত না। গতর খাটতে মন চায় না। অভ্যেস। সেই বয়সেই রাতেরবেলাটা বেদম ফূর্তিতে কাটত রুস্তমের। গঞ্জে বেবাক ফকিন্নি রুস্তমের ন্যাওটা। ছুঁড়ি থেকে বুড়ি পর্যন্ত। ফি রাতে দুতিনজনের বসন খুলত রুস্তম। বছর ঘুরতে না ঘুরতে প্রত্যেকের কোলে ছাও। গঞ্জের মানুষ টের পেত না। ফকিন্নিরাও মুখে রা করত না। ছাও কোলে ভিখ মাগার সুবিধে। ছাও হইল একখান পুঁজি। সব দেখে শুনে রুস্তম গোপনে খ্যাক খ্যাক করে হাসত।

গঞ্জের পূর্বদিকে, হাটখোলার শেষ প্রান্তে ছিল বেশ্যাপাড়া। একটা বয়সে রুস্তম পাড়ায় পড়ে থাকত। বাঁধা মেয়েমানুষ ছিল কজন। দিনমান তাদের ঘরে পড়ে থাকত। নেশাভাঙ করত। চরকির জুয়া বসিয়েছিল নিজে। দিনভর, রাতভর জুয়া খেলত। জুয়ায় আয়বরকত ভালো। মাস ছয়েকের মধ্যে চেহারাসুরৎ পাল্টে গেল রুস্তমের। জাউরা রুস্তম হয়ে গেল পাড়ার সরদার। বেশ্যাপাড়া রুস্তমের নামে কাঁপে। যে কোনও বেশ্যাঘরে রাত কাটাতে রুস্তমের পয়সা লাগে না। তয় গুণ একখান ছিল রুস্তমের। কথা বলত বাঘের গলায়। কলিজাখান ছিল পেটভরা। গলার জোরে সাহসের জোরে রুস্তমের কাছে পার পেত না কেউ। আর শরীর স্বাস্থ্যখান ছিল খোদাই ষাঁড়ের মতন। যেমন তেমন তিন মানুষের তাকত রাখত গায়ে। পাড়ার নূতন আমদানি বেশ্যারা রুস্তমের সঙ্গে এক রাত কাটিয়ে পরের রাতে খদ্দের নিতে পারত না ঘরে। গা গতরে এবং গোপন অঙ্গে ব্যথা হত তাদের।

বেশ্যাপাড়ায় রুস্তমের দিন কাটছিল রাজাবাদশার হালে। কিন্তু কপালের ফের, জুয়ার আসরে মাতবর চরের এক পেঁয়াজ রসুনের বেপারিকে গলা টিপে মেরে ফেলল রুস্তম। তারপর রাতারাতি গঞ্জ ছেড়ে হাওয়া। থানাপুলিশের ভয়ে জীবনটা পাল্টে গেল রুস্তমের। তারপর আজ সাত বছর বেদের বহরে পালিয়ে আছে রুস্তম। ভয়টা এখনও যায়নি। খুনের মামলার মেয়াদ নাকি বারো বছর থাকে। কথাটা কে জানে কার কাছে। শুনেছে রুস্তম। সত্যমিথ্যা জানে না। শুনে বিশ্বাস করেছে। বারো বছর পুরতে আর পাঁচ বছর। পাঁচ বছর পর রুস্তম বেদের বহর ছেড়ে যাবে। তারপর আবার সেই গঞ্জ। বেশ্যাপাড়ার সর্দারি, একেক রাতে একটি মেয়েমানুষের অঙ্গ।

বেদের বহরে মেয়েমানুষের অভাব। গোণা প্রতি মেয়েমানুষ। তার আবার একেকজনের সঙ্গে একেকজন ঘর করে। সময় সুযোগ বুঝে ভাও করা কঠিন। কৃচিৎ দু একজন হয়। তার জন্যে কতকাল অপেক্ষা। শরীরের ভেতরটা চৌপহর তাতিয়ে থাকে রুস্তমের। কোন গঞ্জে কিংবা হাটেবাজারে বহর থামলেই ইচ্ছে করে বেশ্যাপাড়া ছুটতে। ছোটা হয় না। মাথার উপর খুনের মামলা ঝুলছে। ভয়। কখন কোন পাড়া গিয়ে কার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, তারপর থানাপুলিশ। ফাঁসি।

 ভয়ে গুটিয়ে থাকে রুস্তম। দিনের বেলা বেদে-বেদেনিরা থাকে গাওয়ালে, সে থাকে নাও পাহারায়। নাও ছেড়ে ডাঙায় নামে না।

 কিন্তু রাতের বেলা রুস্তম রুস্তমই। বেদেনিরা গাওয়ালে গিয়ে স্বচ্ছল গেরস্তের ঘরদোর রেকি করে আসে। রাতের বেলা রুস্তম আর দুতিনজন তাগড়া জোয়ান বেদেনির পিছ পিছ যায় সিঁধ কাটতে। সাত বছরের চুরির পয়সা ম্যালা জমেছে রুস্তমের। এবার বহরটা ছাড়তে হয়। কিন্তু ছাড়ার আগে একটা মেয়েমানুষ চাই রুস্তমের। ডগমগ বয়েস। রুস্তমের ভার বইতে পারবে, এমন।

গোয়ালীমান্দ্রার খালে, এককুড়ি বেদের নাও দিনদুপুরে পাহারা দিতে দিতে রুস্তম এইসব ভাবে। ঠিক তখুনি গুটি গুটি পায়ে ঝুমঝুমি এসে দাঁড়ায় রুস্তমের নাওয়ের সামনে। দুপুরবেলা।

.

ঝুমঝুমি দেখে বহরটা নিটাল পড়ে আছে। জনমনিষ্যির সাড়া নেই। বেদে-বেদেনিরা সকালবেলা বেরিয়ে গেছে গাওয়ালে। বুকে দুধ খায় এমন বাচ্চাগুলোকে ঝোলায় বেঁধে পিঠে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছে। হাঁটাচলা করতে পারে এমনগুলো নাওয়েই থাকে। এখন নেই। কোথায় কোথায় ঘুরে বেরাচ্ছে, ডাংগুলি খেলছে কে জানে। সাপখোপের ভয় নেই, জলে ডুবে মরার ভয় নেই। জন্মেই সাপ আর জলের সঙ্গে গলাগলি।

 বহরটা নিটাল দেখে বুকের ভেতর শিরশির করে ঝুমঝুমির। নাওয়ের মানুষটা একলা আছে, ঝুমঝুমি জানে। সকালবেলা দেখেছে। বেদে-বেদেনিরা সব গাঁওয়ালে গেছে, সে আছে পাহারায়। একটা পা খোঁড়া, হাঁটা চলার অসুবিধে। নাও পাহারা দেয়া ছাড়া মানুষটার আর কাজ কী!

তয় শরীর স্বাস্থ্যখান মানুষটার খোদাই ষাড়ের মতন। মাথায় বাবরি চুল, মুখে বাকসা ঘাসের মতন দাড়ি-গোঁফ। চোখ দুইখানা ইঁদুরের চোখের মতন। কুকুৎ করে তাকালে বুকের ভেতর বান ডাকে। সকালবেলাই ঝুমঝুমি সব দেখেছে। দেখে আর আখড়ায় থাকতে পারেনি। ওই চোখে কী আছে! ঝুমঝুমির এমন পাগল পাগল লাগে কেন?

কোন মরদ কি কখনও এমন করে ঝুমঝুমির দিকে তাকিয়েছে!

কিন্তু মাইয়ামানুষ চিরকাল মাইয়ামানুষ। বহরটার কাছাকাছি এসে ঝুমঝুমির বুকের ভেতর দুনিয়ার শরম ঢুকে যায়। অকারণে বুকের আঁচল টানে, পাছায় হাত বুলিয়ে বসন ঠিকঠাক করে। আড়চোখে দেখে, নাওয়ের ভেতর বসে খালি গায়ে, লুঙিখান হাঁটুর ওপর তোলা, মানুষটা উদাস হয়ে বিড়ি টানছে। দেখে ঝুমঝুমি মাথা নিচু করে। একবার ইচ্ছে হয় দৌড়ে পালায়। কিন্তু খালপাড়ের বাইলামাটি যেন জোর করে পা আটকে রাখে তার। ঝুমঝুমি নড়তে পারে না।

 তখন চারদিকের পৃথিবীতে ছিল দুপুরের নির্জনতা। রোদ, হাওয়া। খালের জলে ছিল চোরাস্রোত। ওপারের গাছপালা থেকে উড়ে উড়ে আসছিল জলে রোদ আর হাওয়ার খেলা। বেদে নাওয়ের ছইয়ে বসা ঘুঘু ডাকছিল থেকে থেকে। ঘুঘুর ঘুঘ ঘুঘুর ঘুঘ।

.

নাওয়ের ভেতরে বসে রুস্তম দেখে সকালবেলার সেই মাইয়ামানুষটা। ডগমগ বয়স তার। শরীরখানা জোয়ারে খাল যেন।

দেখে রুস্তমের দম বন্ধ হয়ে আসে। গলা খাঁকারি দিয়ে কথা কয় রুস্তম, তুমি কেডা গো?

 ঝুমঝুমি মাটির দিকে তাকিয়ে বলে, সাদুর বইন।

কোন সাদু?

গোয়ালীমান্দ্রায় আবার সাদু কেডা! বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে ঝুমঝুমি। আমি মমিন সাদুর বইন গো!

শুনে রুস্তম হাসে। কোদালের মতো ময়লা নোংরা দাঁত মুখের ভেতর ঝিকিয়ে ওঠে। ও সাদুর বইন আস, নৌকায় আস।

না, নৌকায় আসুম না। মাইনষে দুন্নাম দিব।

মাইনষের দুন্নামে কী অইব, ভাতারে দুন্নাম না দিলেই অয়।

শুনে ঝুমঝুমি আবার হাসে। হেসে গড়িয়ে পড়ে।

 রুস্তম অবাক হয়ে বলে, হাস কেন?

তুমার কতা শুইনা হাসি।

খারাপ কতা কইলামনি?

ভাতারঐ নাই, দুন্নাম দিব কেডা?

শুনে রুস্তমের বুকের ভেতর খালের কোমল জল কলকল করে ওঠে।

মাইয়ামানুষটারে যদি ভাও করন যায়, তাইলে আইজ রাইতেই একখান নাও লইয়া ভাগুম। রুস্তম তারপর গলা নরম করে বলে, তয় ডর কী? আস নাওয়ে আস।

ঝুমঝুমি নাওয়ে পা দেয়। তার শরীরের ভারে নাওটা জলের ওপর নড়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে রুস্তমের বুকের ভেতরটাও।

নাওয়ে ঝুমঝুমি একটু গা বাঁচিয়ে বসে। তারপর রুস্তমের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমারে লইয়া নাও ছাইরা যাইবা নাতো?

বলে হাসে।

 রুস্তম দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, হেই কপাল আমার নাই। আমার লগেনি কোনও মাইয়া মানুষ ঘর ছাড়তে রাজি অইব।

 মাইয়া মানুষের রাজি অরাজি মুখে ফুডে না। মুক দেইক্কা বুঝতে অয়।

 এ কথায় জাউরা রুস্তমের বুকের ভেতরটা আবার কাঁপে।

সেই দুপুরে বেদে নাওয়ের ভেতর ঝুমঝুমি জীবনে প্রথম পুরুষ মানুষের শরীরের স্বাদ পায়। পেয়ে পাগল হয়ে যায়। পুরুষ মানুষের স্বাদ না পেলে নারী বৃথা, ঝুমঝুমি বুঝে যায়। আখড়ায় ফেরার সময় রুস্তমের গলায় জড়িয়ে বলে আসে, তুমি হজাগ থাইকো নিশিরাইতে আমু।

.

সাধু আখড়ায় ফেরে সন্ধ্যাবেলা। গেছল সীতারামপুর। ইব্রা জোলার যুবতী মাইয়ারে ধরছে ভূতে। ছাড়িয়ে এল। এসব কাজ ছেড়ে ফেরার পর সাধু খুব ফূর্তিতে থাকে। টাকে নগদ পয়সাটা থাকে। মাথায় থাকে গাঁজার নেশা। কখনো উপরি পায় বাগানের ফলপাকুর, আনাজপাতি, ছাগল কিংবা মুরগি। ইব্রা জোলার বাগানে আনাজপাতি ছিল না, ফলপাকুর ছিল। পালে ছিল না ছাগল মুরগি। মাঝারি আয়ের জোলা। তাঁত চলে সাতখান। কাপড় বুনে খায়। খুশি হয়ে ঝুমঝুমির জন্যে লালনীল ডোরা কাটা একখানা শাড়ি দিয়েছে।

শাড়িটা বগলে নিয়ে আখড়ায় ফিরে সাধু। ফিরে দেখে ঝুমঝুমি বটতলায় দাঁড়িয়ে, সন্ধ্যেবেলার হাওয়া খেলছে তার খোলা চুলে। ঝুমঝুমি একটু আনমনা। গুনগুন করে গান গাইছেঃ রসিকা নাগরবন্ধু কথা কইয়া যাও, একবার কইয়া যাও বন্ধু আমায় লইয়া যাও।

সাধু গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। ঝুমঝুমি টের পায় না। দেখে সাধু খুব অবাক। গাছ থেকে পাতা পড়ার শব্দেও চমকায় ঝুমঝুমি, আর একটা মানুষের পায়ের শব্দ পাচ্ছে না!

সাধুর বুকের ভেতরটা কী জানি কী আশঙ্কায় কাঁপে।

গলায় খাকারি দেয় সাধু। শুনে চমকে উঠে ঝুমঝুমি। তারপর হেসে বলে, কাম অইছে?

শুনে সাধু সব ভুলে যায়। শাড়িটা ঝুমঝুমির হাতে দিয়ে বলে, কাম অইব না। কছ কী! মমিন সাধু গেছে না!

ঝুমঝুমি তখন সন্ধ্যার আবছা আলোআঁধারিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে শাড়িটা।

সাধু বলল, পছন্দ অইছে?

হ, ভালো শাড়ি আনছ।

এ কথায় সাধুর ফূর্তিটা বাড়ে। আখড়ায় ফিরতে ফিরতে ভূত ছাড়ানোর গল্পটা ঝুমঝুমিকে বলে। ইব্রার মাইয়াডার জ্ঞানবুদ্দি ভালা না। কালী সন্ধ্যায় গেছে তেঁতইল তলায় পেসাপ করতে। ইব্রার তেঁতইল গাছটা দুষি। একজন আছে। ভাও মতন পাইছে মাইয়াডারে, আর ছারে নাই। ম্যালা তেক্ত করছে। পয়লা কয়, এক মোন মিষ্টি দে। আমি কইলাম, গরিব মানুষ, এত মিষ্টি দিব কেমনে? হোনে না। ম্যালা চেষ্টাচরিত্র কইরা শেষমেষ হুকনা মরিচ পোড়া দেওনের ডর দেহাইয়া সোয়াশের মিষ্টিতে রাজি করাইয়া ছাড়াইলাম। আমাবইশ্যার রাইতে তেঁতইল তলায় দেওন লাগব মিষ্টিডি।

ঝুমঝুমির কানে এসব কথা যাচ্ছিল না। ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে সে। কখন সাধু ঘুমোবে, কখন সে ওঠে যাবে রুস্তমের কাছে। নিশিরাতের কত দেরি!

আখড়ায় ঢুকে কুপি জ্বালিয়ে ঝুমঝুমি বলল, তুমি বাতপানি খাইয়া লইয়ো। আমার শইল ভালা না। আমি হুইয়া পড়লাম। ঘরের কোণে হোগলা পাতা। ঝুমঝুমি সেই হোগলার ওপর শুয়ে পড়ে। চোখ বুজে রুস্তমের কথা ভাবে। রুস্তম নৌকা নিয়ে বসে থাকবে। ঝুমঝুমি গেলেই চুপি চুপি খালের জলে নৌকা ভাসাবে।

সাধু বলল, তুই বাতপানি খাইছচ?

হ।

ঝুমঝুমি তারপর আবার রুস্তমের কথা ভাবতে থাকে। সাধু তখন আখড়ার মাঝ মধ্যিখানে কুপিখান রেখে গাঁজার ভাণ্ড নিয়ে বসেছে। ভূত ছাড়িয়ে ফেরার পর বেদম গাঁজা টানে সাধু। টেনে মরার মতো ঘুমোয়। এমন ঘুম, কানের কাছে ঢোলডগর বাজালেও জাগে না।

কথাটা ভেবে ঝুমঝুমির বুকে উথালপাতাল আনন্দ। নিশিরাতে সে রুস্তমের নাওয়ে গিয়ে চড়বে। সাধু টেরও পাবে না। কী সুখ, কী সুখ গো!

সুখের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে ঝুমঝুমি!

খালপাড়ে কুকুর ডেকে ওঠে মাঝরাতে। ঘুমের ভেতর থেকে শব্দটা পায় ঝুমঝুমি। তারপর ধড়ফড় করে ওঠে বসে। আখড়ার ভেতর তখন জ্বলছে কুপি। সেই আলোয় ঝুমঝুমি দেখে সাধু কুঁকড়েমুড়ে শুয়ে আছে ঝাপের সামনে। তার নাক ডাকার মৃদু শব্দ উঠছে থেকে থেকে। বেদম গাঁজা টেনেছে সাধু। নেশার ঘুম। সকালের আগে ভাঙবে না। ভেবে বুকের ভেতরটা খুশিতে নাচে ঝুমঝুমির। আস্তেধীরে সাজগোজ করতে বসে সে। সন্ধ্যেবেলায় পাওয়া নীল ডোরাকাটা শাড়িটা পরে। একটা মাত্র ব্লাউজ ঝুমঝুমির, একটা মাত্র ছায়া, সেগুলো পরে। সাধুকে লুকিয়ে হাট থেকে সস্তা স্নো কিনেছিল, পাউডার আলতা কিনেছিল। সাধুর ভয়ে কখনও ব্যবহার করা হয়নি। টিনের ফুলতোলা ছোট্ট বাক্সে তুলে রাখা হয়েছিল। এই রাতদুপুরে ঝুমঝুমি বাক্সটা খুলে মুখে স্নো পাউডার মাখে, পা রাঙা করে আলতায়। তারপর টিনের বাক্সটা বুকে চেপে পা টিপে টিপে ঝাঁপ খুলে বেরোয়।

 বাইরে বেরিয়েই মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়ায় ঝুমঝুমি। বুকের ভেতরটা উথালপাথাল

করে। নিকষ অন্ধকার চারদিকে। বটের পাতায় সড়সড় করে বইছে হাওয়া। এতকালের পুরনো সংসার ছেড়ে যাচ্ছে ঝুমঝুমি। কেন যে কান্না পায়!

খালপাড় এসে ঝুমঝুমি দেখে অন্ধকারে জোনাকির মতো জ্বলছে রুস্তমের বিড়ি। বহর থেকে একটু দূরে ছোট্ট একখান টানের ছইঅলা নাও নিয়ে অপেক্ষা করছে রুস্তম। কথাবার্তা না বলে ঝুমঝুমি সেই নাওয়ে গিয়ে ওঠে।

রুস্তম নাও ছেড়ে দেয়।

ভোররাতে চাঁদ উঠেছিল সেদিন।

 ধনুকের মতো বাঁকা চাঁদ। খালের কোমল জলে এসে পড়েছিল চাঁদ আর নক্ষত্রের ম্লান আলো। মিহিন একটা হাওয়া ছিল চরাচরে। আর ছিল নির্জনতা। সেই নির্জনতা ভেঙে দূরে বহুদূর থেকে থেকে ডাকছিল একটা রাতপাখি। পাখির ডাকের সঙ্গে মিলেমিশে রুস্তমের বৈঠা পড়ছিল খালের জলে।

 তার পায়ের কাছে বসে কী জানি কী সুখে কিংবা দুঃখে গুনগুন করে কাঁদছিল ঝুমঝুমি। ঝুমঝুমির এই কান্নার অর্থ পৃথিবীর কেউ বোঝে না।

.

ভোরবেলা ঘুমের ভেতর সাধুর বুকের ভেতরটা কাঁপে। ধড়ফড় করে ওঠে বসে সাধু। তারপর চমকে ওঠে। আখড়ার ঝাঁপ খোলা, আখড়ায় ঝুমঝুমি নেই। এত সকালে ঝুমঝুমির ঘুম ভাঙে না। হররোজ সাধুই ডেকে ডেকে ঘুম ভাঙায় ঝুমঝুমির। ওলো ঝুমঝুমি গা তোল, বেইল অইয়া গেছে।

আজ কী হল? এত সকালে ওঠে ঝুমঝুমি গেল কোথায়?

 সাধু আখড়া ছেড়ে বটতলায় যায়। ভাবে, ঘাট সারতে গেছে ঝুমঝুমি, এই এল।

 বটের গোড়ায় বসে থাকে সাধু। আর ঝুমঝুমির অপেক্ষা করে।

 দেখতে দেখতে বেলা ওঠে। পুব আকাশ লাল করে ওঠে পুরোনো সূর্য। রোদ লাফিয়ে নামে পৃথিবীতে। আর আসে হাওয়া। বটের পাতায় আর হাটখোলার শূন্য চালাঘরে খেলা করে যায়। একটা দুটো কাক, একটা দুটো শালিক হাটখোলার বিরান মাটিতে নেমে চরে।

ঝুমঝুমি ফেরে না। অপেক্ষায় থেকে থেকে সাধুর বুকের ভেতরটা কেবলই কাঁপে। বটতলায় দাঁড়িয়ে সাধু তারপর চেঁচিয়ে ডাকে, ওলো ঝুমঝুমি গেলি কই?

বিরান হাটখোলায় সাধুর ডাক ভেসে যায়। কেউ সাড়া দেয় না।

সাধু আবার ডাকে। আবার। তারপর পুরোনো হাটখোলাটা ঘুরে সাধু যায় খেয়াঘাটের দিকে। খেয়া পার হয়ে মনের দুঃখে ঝুমঝুমি ওপারের জঙ্গলে যায়। একা বসে থাকে। সাধু জানে। ঝুমঝুমি কি সেই জঙ্গলে গেছে।

 খেয়াঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সাধু দেখে, বেদেবেদেনিরা সব নাও ছেড়ে ডাঙায় নেমেছে। জটলা পাকিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছে একজন। কী হয়েছে, সাধু কিছু বুঝতে পারে না। জটলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কী অইছে গো, চিল্লাও ক্যান?

সাধুকে দেখে, মাথায় বাবরি চুল এক বেদে বলল, আমাদিগের একখানা নাও চুরি হইয়া গ্যাছে। বহরে ছিল এক মানুষ, রুস্তম তার নাম। একখানা পাও খোঁড়া, নাওখানা নিয়ে সে চম্পট দিয়েছে!

শুনে সাধুর বুকের ভেতরটা আবার কাঁপে। কেন যেন মনে হয় ঝুমঝুমিও বুঝি ঐ মানুষের সঙ্গে চম্পট দিয়েছে!

কথাটা ভেবে মুহূর্তে অবশ হয়ে যায় সাধুর শরীর। পা আটকে যায় মাটিতে, নড়াচড়ার শক্তি থাকে না।

বেদে-বেদেনিরা কোলাহল করে যায়। সাধুর কানে কোনও শব্দ ঢোকে না। সব্বোনাশ অইয়া গেছে। ঝুমঝুমি পালাইলে আমার তন্ত্র থাকব না। তুকতাক গেছে। না খাইয়া মরণ।

অবশ শরীরটা নিয়ে সাধু তবুও ঝুমঝুমিকে খোঁজে। খেয়ানৌকার মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, আমাগো ঝুমঝুমিরে দেখছ?

মাঝি মাথা নাড়ে।

ওপারে নেমে মুদিমনোহারি দোকানের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে, ঝুমঝুমিরে দেখছনি তোমরা?

লোকেরা মাথা নাড়ে।

সাধু তবুও ঝুমঝুমিকে খোঁজে। ওপারের জঙ্গল তন্ন তন্ন করে খোঁজে। নেই, ঝুমঝুমি কোথাও নেই।

দুপুরবেলা সাধু আবার বেদের বহরটার কাছে ফিরে আসে। বহরটা তখন নির্জন। বেদে বেদেনিরা গেছে গাঁওয়ালে। একটা দুটো পোলাপান বেদে নাও থেকে ঝুপঝাঁপ লাফিয়ে পড়ছে খালের জলে। তাদের চিৎকার হল্লাচিল্লা। সাধুর কানে কিছু ঢোকে না। খালপাড়ার সাদা মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদে সাধু। মেয়েমানুষের মতো কাঁদে। ঝুমঝুমি, ওলো ঝুমঝুমি, তুই কই চইলা গেলিরে, আমারে মাইরা থুইয়া গেলিরে।

তারপর দিনে দিনে গেঁজেল সাগরেদরাও সাধুকে ছেড়ে চলে যায়। দশ গেরামের লোক ব্যারামে আজাবে সাধুকে আর ডাকে না। হাটের দোকানিরা, পাইকারি মহাজনরা। সাধুকে দেখে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। চালডালটা দেয় না, আনাজপাতিটা দেয় না। লোকে টের পেয়ে গেছে সাধু সাচ্চা না। সাধুর সব বুজরুকি।

 সাধু এখন কী করে!

দিনমান আখড়ায় বসে থাকে। বসে বসে গাঁজা টানে। রাতদুপুরে আখড়া ছেড়ে বেরোয়। কোনও কোনও রাতে চাঁদ থাকে আকাশে। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যায় চরাচর। সেই জ্যোৎস্না ভেঙে সাধু যায় খালপাড়ে। বেদের বহরটা চলে গেছে। খালপাড়টা এখন শূন্য। নির্জনতায় হাহাকার করে। নিশিরাতে সাধু গিয়ে নির্জন খালপাড়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে। তারপর ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদে, রাতভর কাঁদে। ঝুমঝুমি নেই। সাধুর তন্ত্র। নষ্ট হয়ে গেছে। জগৎসংসারে কেউ জানে না, সাধু কার দুঃখে কাঁদে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *