রাজার চিঠি

রাজার চিঠি

প্রাতঃকালে ঘুম ভেঙে রাজা দেখেন জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে এসে পড়েছে ডিমের কুসুমের মতো গাঢ় রোদ। মিহিন একটা হাওয়া এসে খেলা করছে রোদের সঙ্গে। জানালার পাশে বাগানে ফুটেছে অজস্র ফুল। হাওয়ায় ফুলের মৃদু সুবাস।

রাজার ঘুম ভাঙে একটু বেলাবেলি। আজ বহুকাল পর তার ঘুম ভেঙেছে সকাল সকাল। ঘুম ভাঙার পরই রাজার আজ মনে পড়েছে প্রাতঃকালীন পৃথিবী খুব সুন্দর। এই রোদ এই হাওয়া বহুকাল তিনি দেখেননি।

রাজা যখন এসব ভাবছেন ঠিক তখুনি তার জানালায় উড়ে এসে বসে অচেনা সোনালি বর্ণের এক পাখি। ছোট্ট ভারী সুন্দর পাখি। কী যে মিষ্টি সুরে ডেকে যায় পাখিটি। সেই ডাকে রাজার বুকের ভেতরটা তোলপাড় করে। মনে পড়ে বহুকাল রাজ্য চালিয়ে তিনি ক্লান্ত। চারপাশের সুন্দর পৃথিবী কতকাল তার দেখা হয়নি। কতোকাল তিনি ভেতরে ভেতরে উতলা হয়েছিলেন। এরকম একটা পাখির সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা ছিল। রাজ্য চালাতে চালাতে রাজা সব ভুলে গিয়েছিলেন।

রাজা তারপর তাকিয়ে তাকিয়ে পাখিটা দেখেন। ছোট্ট সোনালি বর্ণের পাখি মিষ্টি সুরে ডাকে, ডেকে যায়। সেই ডাকে রাজা ভুলে যান এক্ষুনি তার বিচারকক্ষে যাওয়ার কথা। প্রজারা সব উন্মুখ হয়ে আছে। দর্শনপ্রার্থীরা আছে প্রাসাদের বাইরে। বহু দূরদূরান্ত থেকে আসে লোক। সাহায্য চাইতে, রাজাকে দুচোখ ভরে দেখতে। আজ সকালে রাজার ওসব মনে থাকে না। বিভোর হয়ে তিনি সোনালি বর্ণের সেই পাখির সঙ্গে কথা বলেন, ও পাখি তুই কেমন আছিস, ভালো তো?

এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পাখিটা হঠাৎ করে উড়াল দেয়। দেখে রাজা পাগলের মতো ছুটে যান জানালায়। কী হল, পাখিটা উড়ে গেল কেন? তা হলে কি আমার রাজ্যে প্রজারা সুখে নেই। পাখিটা আমাকে সেই খবর দিতে এসেছিল?

কথাটা ভেবে রাজা ভেতরে ভেতরে উতলা হয়ে পড়েন। প্রজারা তো কেউ আমাকে কখনো তাদের অভাব অভিযোগের কথা বলেনি। দুঃখকষ্টের কথা বলেনি। আমি আমার কর্তব্যে অবহেলা করেছি। মন্ত্রিপরিষদ আমার চারপাশ ঘিরে রেখেছে। প্রাসাদের বাইরে আমাকে কখনো নিয়ে যায়নি। তাহলে কি ওরা জানে আমার রাজ্যের কোথাও চলছে দুর্দিন, কোথাও খরা, অনাবৃষ্টি! শস্যচারা পুড়ে গেছে! অনাহারে দিন কাটাচ্ছে প্রজারা! আমাকে জানতে দেয়া হয়নি।

এসব ভাবতে ভাবতে রাজা দেখেন ছোট্ট সেই পাখি নগর পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে দূরে নদীর দিকে। নদী পেরিয়ে কোন দূরে যাবে পাখি! রাজা মনে মনে বললেন, আমিও যাব, আমিও যাব।

 তারপর তিনি হেঁকে উঠেন, কে আছিস?

সেই হাঁক রাজপ্রাসাদের ধ্বনি প্রতিধ্বনি তোলে। সঙ্গে সঙ্গে দোরগোড়ায় কুর্নিশ করে দাঁড়ায় নফর।

রাজা বলেন, আমি একজন নগণ্য রাজকর্মচারীর বেশে রাজ্য দেখতে বেরুব। কেউ আমাকে দেখে যেন বুঝতে না পারে স্বয়ং রাজাই বেরিয়েছেন রাজ্য দেখতে। ব্যবস্থা কর।

জো হুকুম, বলে নফর প্রস্থান করে।

রাজা রাজ্য দেখতে বেরুবেন এ কথা মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় রাজমহলে। খবর পেয়ে ছুটে আসে মন্ত্রিপরিষদ। আসেন রাণী, ছোট রাজকুমার।

মহারাজ। মন্ত্রীরা উন্মুখ হয়ে রাজার মুখপানে তাকায়।

রাজা ততক্ষণে রাজকীয় পোশাক পাল্টে নিয়েছেন। পরিধান করেছেন একজন নগণ্য রাজকর্মচারীর পোশাক। মুখমণ্ডলে জড়িয়ে নিয়েছেন শ্বেতশুভ্র একখণ্ড বস্ত্র। রাজাকে আর রাজা বলে চেনা যায় না।

রাজা বললেন, আপনারাও চলুন। কিন্তু প্রত্যেকেই সাধারণ রাজকর্মচারীর বেশে। আপনাদের দেখে প্রজাকুল যেন বুঝতে না পারে, চিনতে না পারে।

মন্ত্রিপরিষদ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। রাণী বললেন, একি কথা মহারাজ?

রাজার কোনওদিকে খেয়াল নেই। জানালার পথে বাইরের পৃথিবী দেখছিলেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন, প্রিয়তমা, আমি আর কতকাল অন্ধ হয়ে থাকব?

ছোটকুমার এসে রাজার হাত ধরেন, পিতা আমিও যাব।

 রাজা মুখ ঘুরিয়ে পুত্রের দিকে তাকান, দক্ষিণহস্ত রাখেন পুত্রের মাথায়, সে বড় দুঃখের পথ পুত্র, সে বড় দূরের পথ। তোমাকে আমি কোথায় নিয়ে যাব?

বালক কুমার দুহাতে অশ্রুমোচন করে।

প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে রাজা টের পান প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। গ্রামপ্রান্তর থেকে রোদের হলকা আসছে নগরের দিকে। হাওয়ায় বেড়ালের লোমের মতো উষ্ণতা। চারদিকে অচেনা এক রুক্ষতা খানিক হাঁটার পরই টের পেতে থাকেন রাজা। বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কাপে। রাজধানীর ভেতরেই কোথায় যেন সংগোপনে ঘটছে এক ধরনের হাহাকার। মানুষ কাঁদছে।

 রাজা কোনো বাহন নেননি। মন্ত্রিপরিষদ চলেছে তার সঙ্গে। প্রত্যেকেরই খুব সাধারণ বেশ। নগণ্য রাজকর্মচারী বৈ আর কিছুই মনে হয় না তাদের। মুখমণ্ডলে প্রত্যেকেরই ফিনফিনে শ্বেতশুভ্র বসন। রাজা ছাড়া অন্য সবাই কিঞ্চিৎ বিরক্ত। পায়ে হাঁটার অভ্যেস নেই কারও। চলাচলের জন্য রয়েছে বাহন। অশ্ব। কিছুই সঙ্গে নেননি রাজা। পায়ে হেঁটে রাজ্য দেখবেন।

নগরের মাঝামাঝি এসে রাজা দেখেন পথের দুপাশে সার বেঁধে বসে আছে ভিখারি। পুরুষ রমণী বালক বৃদ্ধা। পাংশুটে অনাহার চেহারা। কতোকাল পেটপুরে খাওয়া হয়নি। তাদের। দেখে রাজার বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। আমার রাজ্যে লোকে ভিক্ষে করছে, অনাহারে আছে। আর আমি প্রাসাদে বসে রাজকীয় খাবার গ্রহণ করছি। এ দৃশ্য দেখার আগে আমার মৃত্যু হয়নি কেন?

 মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, আমার রাজ্যে প্রজারা ভিক্ষে করছে, অনাহারে আছে, একথা আমাকে জানানো হয়নি কেন?

মন্ত্রিপরিষদ পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। তারপর প্রধান ব্যক্তিটি বলে, মহারাজ এরা অন্য রাজ্যের লোক। সেখানে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। খাদ্যের আশায় এরা আমাদের। রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

ততক্ষণে রাজা ও মন্ত্রিপরিষদের চারপাশ ঘিরে ভিখিরি মিছিল। শীর্ণ হাত বাড়িয়েছে প্রত্যেকে। দেখে রাজার বুকের ভেতর মোচড়ায়। সঙ্গে কিছুই আনেননি তিনি। না অর্থ না মুক্তোহার। রাজা কি এদের ফিরিয়ে দেবেন! রাজা কিছু ভেবে পান না।

 মন্ত্রিপরিষদ দূর দূর করে তখন ভিখিরির তাড়াচ্ছে। সে দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, হোক এরা পাশের রাজ্যের। আমার অতিথি। আমার রাজ্যে কোনও ভিখিরি থাকবে না, অনাহারী থাকবে না। এদের খাদ্য এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করুন।

মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, জো হুকুম জাহাপনা।

রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

 রাজা যখন নদীতীরে এসে পৌঁছুলেন তখন মধ্যাহ্ন। রোদে পুড়ে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তাঁর। মন্ত্রিপরিষদ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। রাজার এই আকস্মাৎ রাজ্য দেখতে বেরুনো তারা পছন্দ করছে না। রাজা কখনও এরকম খেয়ালি কাজ করেননি। এতকাল রাজ্য চালাচ্ছেন, কখনো মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে তিনি কোনো কাজ করেননি। মন্ত্রিপরিষদ যা বুঝিয়েছেন তাই সত্য বলে বুঝে নিয়েছেন। এই প্রথম রাজা নিজের ইচ্ছে একটা কাজ করছেন। রাজ্য দেখতে বেরিয়েছেন। তার আগে মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেননি। তাদেরকে জানাননি আমি রাজ্য দেখতে বেরুব। আমার প্রজারা কেমন আছে, আমি জানতে চাই।

এ কি তাহলে রাজার বিদ্রোহ!

মন্ত্রিপরিষদ এতকাল রাজাকে যে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছে, আপনার রাজ্যে কেউ দুঃখে নেই, অনাহারে নেই, আপনার রাজ্যে একজনও ভিখিরি নেই, রাজ্যে শস্য ফলছে প্রচুর, প্রজারা আপনার গুণগানে মুগ্ধ, এইসব মিথ্যের কি আজ অবসান হবে?

এইসব ভেবে মন্ত্রিপরিষদ আতঙ্কিত, ভীত। রাজা আজ স্বচক্ষে সব দেখবেন। জেনে যাবেন তার রাজ্যে কেউ সুখে নেই, অনাহারে থাকে প্রজাকুল, পথেঘাটে ভিখিরির মিছিল, অনাচার হাহাকার রাজ্যময়। রাজার গুণগান গাওয়ার মতো একটি প্রজাও নেই রাজ্যে। আর এসবের জন্যে দায়ী মন্ত্রিপরিষদ।

পরস্পর পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মন্ত্রিপরিষদ যখন এসব ভাবছে রাজা তখন উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে। কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে শীর্ণ খালের মতো নদী। ওপারের গ্রামপ্রান্তর মধ্যাহ্নের রোদে রুক্ষ হয়ে আছে। এপারে কোনো ছায়া নেই, হাওয়া নেই চরাচরে। দু একটা পাখি ডানায় রোদ ভেঙে উড়ে যায় ওপারের দিকে।

রাজা বললেন, আমি ওপারে যাব।

 মন্ত্রিপরিষদ আবার পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। প্রধান ব্যক্তিটি বলে, মহারাজ আপনার কষ্ট হবে।

 রাজা বলেন, আমি যাব।

তারপর খেয়াঘাটের দিকে হাঁটতে থাকেন রাজা। কেন যে তার মনে হয় আমার রাজ্যে কেউ সুখে নেই। প্রজাকুল অনাহারে আছে, ভিখিরিতে ভরে গেছে রাজ্য, অত্যাচার অনাচারে প্রজাকুলের জীবন বিপন্ন। রাজ্যের ভেতরে শুরু হয়েছে দুর্দিন, খরা। মন্ত্রিপরিষদ এতকাল আমাকে ভুল জীবনের ভেতর রেখেছে। ভুল স্বর্গে বন্দী করে রেখেছে। আমি অন্ধ ছিলাম, আমি অন্ধ ছিলাম।

 ওপারে এসে রাজা দেখেন দুপাশে শস্যের মাঠ তার মধ্যিখান দিয়ে রমণীর সিঁথির মতো চিরল মেঠো পথ। মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে সেই মেঠো পথে হাঁটতে শুরু করেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে রাজা উদাস বিষণ্ণ চোখে দুপাশের শস্যমাঠের দিকে তাকাচ্ছিলেন। মাঠে শস্য নেই, রোদে পুড়ে কাক হয়ে গেছে সব। দু একজন কৃষক তবুও সেই মাঠে শস্য ফলানোর চেষ্টা করছে। তাদের আদুল গা রোদে পুড়ে কুচকুচে কালো। রাখাল বালক বসে আছে বৃক্ষের ছায়ায়। শস্যমাঠ এখন গোচারণ ভূমি।

দেখে রাজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, এখানে ফসল ফলেনি কেন?

মন্ত্রিপরিষদ পুনরায় পরস্পর পরস্পরের মুখপানে তাকায়। তারপর রাজ্যে কৃষি বিষয়ক মন্ত্রি বলেন, মহারাজ এই অঞ্চলে প্রচণ্ড খরা শুরু হয়েছে, বৃষ্টি নেই। শস্যচারা বৃষ্টি না পেয়ে রোদে পুড়ে খাক হয়েছে, বৃষ্টি নেই।

রাজা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, নদী থেকে জল তোলার ব্যবস্থা হয়নি কেন?

মন্ত্রিটি কথা বলে না।

রাজা বললেন, এই অঞ্চলে নিশ্চয় তাহলে প্রজারা অনাহারে আছে।

মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, না মহারাজ সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি, করব।

কী ব্যবস্থা?

 রাজভাণ্ডার থেকে খাদ্য সরবরাহ করেছি। প্রয়োজনে আরো করব।

এই কথা আমাকে জানানো হয়নি কেন?

মন্ত্রিপরিষদ কথা বলে না।

শস্যের মাঠ শেষ হতেই একখানা গ্রাম। দূর থেকে সুন্দরী রমণীর ভ্রূরেখার মতোন কালো দেখাচ্ছিল। কাছাকাছি আসতে দেখা গেল গ্রামটি আসলে রুক্ষ। রোদে পুড়ে গাছপালা সব ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। হাওয়ায় শাদা ধুলো উড়ছে। গাছপালার আড়ালে গরিব প্রজাদের কুট্টির নজরে আসে। কোথাও কোনও জনমনিষ্যির সাড়া নেই। শিশু কাঁদে না, বালক ছুটোছুটি করে না, রমণীরা জল নিতে যায় না পুকুরে। একটা পাখিও ডাকে না কোথাও।

রাজার অনেকক্ষণ ধরে জলতেষ্টা পেয়েছে। গ্রামের ভেতর ঢুকে কোথাও কোনো জনমনিষ্যির সাড়া না পেয়ে জলতেষ্টার কথা ভুলে যাচ্ছিলেন রাজা।

একখানা কুট্টিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাজা বললেন, এই গাঁয়ে কি প্রজা নেই?

মন্ত্রিপরিষদ একসঙ্গে বলল, নিশ্চয় আছে মহারাজ।

সাড়া নেই কেন?

আহার শেষে নিশ্চয় সুখনিদ্রায় মগ্ন তারা।

 ঠিক এসময় সামনের একখানা ক্ষুদ্র কুট্টির থেকে খুক খুক করে শ্লেষ্ম জড়ানো গলায় কেশে উঠল কেউ। মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে রাজা এসে দাঁড়ালেন সেই কুট্টিরের সম্মুখে। কে। আছ, পথিককে জল দাও। ভেতরে কোনও সাড়া নেই।

 রাজা আবার বললেন, কে আছ, ক্লান্ত পথিককে জল দাও।

 খানিকপর একবৃদ্ধ হাতে জলের ঘট, ক্লান্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে এসে দাঁড়াল রাজার সম্মুখে। জলগ্রহণের আগে রাজা বৃদ্ধকে লক্ষ্য করেন। নিম্নাঙ্গে একটুকরো বস্ত্র জড়ানো, আদুল গা। পাংশুটে মুখে দীর্ঘকালের অনাহার ছায়া ফেলছে।

 রাজা বললেন, কুট্টিরে আর কেউ নেই?

না।

কোথায় গেছে?

নগরে।

কথা বলতে বৃদ্ধের কষ্ট হয়। চোয়ালে মুখ হাঁ করে শ্বাস টানছে সে। পা টলমল করছে, স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

রাজা বললেন, নগরে গেছে কেন?

ভিক্ষা করতে।

কথাটা বলে বৃদ্ধ হাত-পা দুমড়ে মাটিতে বসে পড়ে। রাজা ততক্ষণে জলপান শেষ করেছেন। ঘটিটি মাটিতে রেখে তিনিও বসেন বৃদ্ধের পাশে। মন্ত্রিপরিষদ ঘিরে আছে চারপাশ। রাজা খেয়াল করেন না।

বৃদ্ধ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আপনারা কারা?

পথিক। বহুদূরের পথিক।

শুনে বৃদ্ধ কপাল চাপড়ায়। আহা পথিককে শুধু জল দিলাম। ক্ষমা করবেন হুজুর। ঘরে একবিন্দু অন্ন নেই। চারদিন অনাহারে আছি। সইতে না পেরে গ্রাম ছেড়ে সবাই চলে গেছে নগরে। আমার চলাচলের ক্ষমতা নেই তাই পড়ে আছি।

কতোকাল হয় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে এখানে?

সে বহুকাল হুজুর। মানুষ মরে উজাড় হয়ে গেছে। যারা দুচারজন আছে তারা নগরে ভিক্ষা করে বেড়ায়।

 তোমাদের গাঁয়ে রাজভাণ্ডারের খাদ্যদ্রব্য এসে পৌঁছয়নি?

না হুজুর। একি সেই রাজার রাজ্য, প্রজারা অনাহারে আছে দেখে রাজভাণ্ডার খুলে দেবে!

এ কথায় রাজার বুক কাঁপিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বৃদ্ধের মাথায় দক্ষিণহস্ত রেখে রাজা বলেন, অপেক্ষায় থেকো তোমার কাছে রাজার চিঠি আসবে।

.

অপরাহ্নে রাজা ফিরে আসেন নদীতীরে। বৃদ্ধের কুট্টির থেকে বেরিয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে একটিও কথা বলেননি। এই দীর্ঘক্ষণ ধরে তিনি তাঁর রাজ্যের দুর্দিনের কথা ভেবেছেন। বারবার বুকের ভেতর মুচড়ে উঠেছে তাঁর। কান্না পেয়েছে। তিনি জেনে গেছেন মন্ত্রিপরিষদ তাঁর রাজ্য ছারখার করে দিয়েছে। রাজভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছে নিজেরা লুটেপুটে। আর রাজাকে রেখেছিল মিথ্যে একটা প্রবোধের ভেতর। ভুল জীবনে, ভুল স্বর্গে। এ জীবন রাজা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যে কোনো দুঃখী প্রজা থাকবে না, অনাহারী প্রজা থাকবে না।

এ আমি কী করেছি, এ আমি কী করেছি! রাজা ভাবলেন। আমি এতকাল অন্ধ ছিলাম কেন! আমি আমার দায়িত্বে অবহেলা করেছি। প্রাসাদে বসে রাজকীয় জীবন কাটিয়েছি। কেন প্রজাদের দ্বারে দ্বারে সাধারণ মানুষের মতো যাইনি, কেন জানতে চাইনি তাদের দুঃখের কথা, অভাব অভিযোগের কথা!

নদীতীরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাজা ভাবলেন, আমাকে আবার শুরু করতে হবে। প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

নদীতে পারাপারের কোনো নৌকো ছিলো না। অন্ধকার হয়ে আসছে চারদিক। এই প্রথম দীর্ঘক্ষণ পর রাজা মন্ত্রিপরিষদের দিকে তাকিয়ে বললেন, নগরে যাব কেমন করে?

মন্ত্রিপরিষদ কথা বলে না। ক্ষুধায় ক্লান্তিতে তারা খুবই কাতর। ভেতরে ভেতরে রাজার ওপর প্রচণ্ড রাগ তাদের। তাদের সব মিথ্যে প্রবোধ রাজা আজ ধরে ফেলেছেন।

 এ সময় মাঝ নদীতে ছোট একখানা জেলে নৌকো দেখা গেল। নদীতে জাল ফেলে বসে আছে শীর্ণ অনাহারী পাংশু চেহারার এক জেলে।

 মন্ত্রিপরিষদ চিৎকার করে জেলেকে ডাকে।

 খানিক পর জাল তুলে তীরে এসে নৌকো ভিড়ায় জেলে। রাজা বললেন, ভাই জেলে আমরা নগণ্য রাজকর্মচারী। নগরে যাব।

জেলেটি বিনীত গলায় বলল, আসুন হুজুরগণ।

মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে রাজা নৌকোয় চড়লেন।

রাজা বসেছিলেন জেলের পায়ের কাছে। অন্ধকারে জেলেটির মুখ ভালো করে দেখা যায় না। ধীরমন্থর গতিতে নৌকো বাইছে জেলে। রাজা বুঝতে পারেন জেলেটি মধ্যবয়সী। এবং ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে কাতর।

রাজা বললেন, নদীতে মাছ কেমন?

 জেলেটি খুক খুক করে বার দুয়েক কাশে। তারপর শ্বাস টেনে টেনে বলে, দুদিন ধরে জাল বাইছি। একটাও মাছ পাইনি হুজুর। একা মানুষ জাল টানা বড় কষ্টের। সংসারে কে কে আছে তোমার?

 কেউ নেই হুজুর। একটা ছেলে ছিল। রাজার জন্যে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। একথায় রাজা ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠেন। তবুও শীতল কণ্ঠে বলেন, রাজার লোক তোমার খোঁজখবর করেনি?

না হুজুর।

রাজভাণ্ডার থেকে মৃত যোদ্ধাদের আত্মীয়-পরিজনের জন্যে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা তুমি পাওনি?

না হুজুর! আমি কেন, কেউ পায়নি। আমাদের রাজা কি আর প্রজাদের কথা ভাবেন। তাহলে রাজ্যের অর্ধেক লোক কি আর অনাহারে মরত!

রাজা আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

নৌকো তখন ওপারে এসে ভিড়েছে। নেমে যাওয়ার আগে জেলেটির হাত ধরে রাজা বললেন, অপেক্ষায় থেকো, তোমার কাছে রাজার চিঠি আসবে।

তারপর পুনরায় রাজা মনে মনে বললেন, আমাকে আবার শুরু করতে হবে। প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।

সেদিনই রাত্রির মধ্যযামে ক্রুদ্ধ মন্ত্রিপরিষদের হাতে রাজা নিহত হন। এক বৃদ্ধকে এক জেলেকে রাজা কথা দিয়েছিলেন, অপেক্ষায় থেকো, তোমাদের কাছে রাজার চিঠি আসবে।

তারা আর কতকাল অপেক্ষায় থাকবে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *