গ্রাম মানুষের কথকতা

গ্রাম মানুষের কথকতা

মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণের নামায় এলোমেলোভাবে ছড়ান আটখানা খেজুর গাছ। ভরা বর্ষায় গাছগুলোর কোমর অব্দি ওঠে জল। কোনও কোনও বর্ষায় কোমর ছাড়িয়ে বুক ছুঁই ছুঁই।

 এবারের বর্ষা তেমন ছিল না। গাছগুলোর কোমর ছুঁয়েই নেমে গেছে। ফলে প্রায় প্রতিটি গাছেরই কোমরের কাছে স্বচ্ছল গেরস্ত বউর কোমরের বিছের মতো লেগে আছে বর্ষাজলের দাগ। বয়সের ভারে নৌকোর মতো বাঁকা হয়েছে যে গাছটি বর্ষাজল তার পিঠ ছুঁয়েছিল। সারা বর্ষা পিঠ ছুঁয়ে থাকা জল মনোহর একটি দাগ ফেলে গেছে পিঠে। এই গাছটির সামনে দাঁড়িয়ে গভীর আনন্দে একটি শ্বাস ফেলল দবির গাছি। বহুকাল পর প্রিয় মানুষের মুখ দেখলে যেমন হয়, বুকের ভেতর ঠিক তেমন এক অনুভূতি হল তার। ভারের দুদিকে ঝুলছে দশ বারোটা হাঁড়ি। সাবধানে ভারটা গাছতলায় নামাল সে। তারপর শিশুর মতো উজ্জ্বল হয়ে গেল। একবার এই গাছটির গায়ে পিঠে হাত বুলোয় আরেকবার ওই গাছটির। পাগলের মতো বিড়বিড় করে বলে, মা মাগো, মা সগল কেমুন আছ তোমরা? শইল ভালো তো? কেউর কোনও ব্যারাম আজাব নাই তো, বালামসিবত নাই তো?

উত্তুরে হাওয়ায় শন শন করে খেজুরডগা। সেই শব্দে দবির গাছি শোনে গাছেরা তার কথার পিঠে কথা বলছে। ভালো আছি বাজান, ভালো আছি। ব্যারাম আজাব নাই, বালা মসিবত নাই।

বর্ষা নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খেজুরতলায় জন্মেছে টিয়েপাখি রঙের বাকসা ঘাস। কার্তিকের কোনও এক সময় সাতদিনের জন্য নামে যে বৃষ্টি, লোকে বলে কাইত্তানি, এবারের কাইত্তানির ধারায় রাতারাতি ডাগর হয়েছে বাকসা ঘাস। এখন মানুষের গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো লম্বা।

এইঘাস ছেঁয়ে আছে মরা খেজুর ডগায়। গাছের মাথায় মরে যাওয়ার পর আপনাআপনি ঝরে পড়েছে তলায়। পাতাগুলো খড়খড়ে শুকনো কিন্তু কাঁটাগুলো শুকিয়ে যাওয়ার পরও কাঁটা। টেটার নালের মতো কটমটে চোখে তাকিয়ে আছে। যেন তাদের আওতায় এলেই কারও আর রক্ষা নেই। খেজুরতলায় পা ফেললেই সেই পা ফুটো করে শরীরে ঢুকবে তারা, ঢুকেই অদৃশ্য হয়ে যাবে। বাড়ি ফিরে কাঁটাফোঁটা জায়গায় কাঁথা সেলাবার উঁচ দিয়ে যতই ঘাঁটাঘাঁটি করুক, খেজুর কাঁটার তীক্ষ্ণ ডগাটির কোনও হদিস মিলবে না। সে মিশে যাবে রক্তে। রক্তবাহী রগ ধরে সারা শরীর ঘুরে বেড়াবে। দেড় দুমাস পর বুক কিংবা পিঠ ফুটো করে বেরুবার চেষ্টা করবে। প্রচণ্ড ব্যথায় মানুষের তখন মরণদশা। কেউ কেউ মরেও।

সীতারামপুরের পুষ্প ঠাকরনের একমাত্র ছেলে মরেছিল খেজুর কাঁটায়। বেজায় দুরন্ত স্বভাবের ছেলে ছিল। শীতের রাতে ইয়ার দোস্তদের নিয়ে রস চুরি করতে গেছে কুমারভোগ। টর্চ মেরে মেরে এগাছ থেকে হাড়ি নামায়, ওগাছ থেকে নামায়। তারপর গাছতলায় দাঁড়িয়েই হাঁড়িতে চুমুক। কারও কিছু হল না, ফেরার সময় ঠাকরনের ছেলের ডানপায়ে ফুটল কাঁটা। এক দুদিন একটু ব্যথা হল পায়ে। ঠাকরন নিজে উঁচ দিয়ে ঘাটাঘাটি করল ছেলের পা। কাঁটার হদিস পেল না। চার পাঁচদিনের মাথায় মা ছেলে দুজনেই ভুলে গেল কাঁটার কথা।

ঠিক দেড়মাস পর এক সকালে পিঠের ব্যথায় চিৎকার শুরু করল ঠাকরনের ছেলে। কোন ফাঁকে সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে তার। না নড়তে পারে না বিছানায় ওঠে বসতে পারে। শবরী কলা রঙের মুখখানা ছেলের সরপুটির পিত্তির মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠাকরন কিছু বুঝতে পারে না, দিশেহারা হয়ে ডাক্তার কবরেজ ডাকে, ফকিরফাঁকরা ডাকে। হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, পানিপড়া, তাবিচকবচ, আয়ুর্বেদি আর কত পদের যে টোটকা, কিছুতেই কিছু হল না। পাঁচদিন ধরে ব্যথায় কাতরাল ছেলেটি তারপর বিয়ান রাতের দিকে মারা গেল। পিঠের যেখানটায় ব্যথা হচ্ছিল সেই জায়গাটি ছেলের তখন থকথক করছে। দেখেই বোঝা যায় চামড়ার তলার মাংসে পচন ধরেছে। লাশ নাড়াচাড়ার সময় বোধহয় চাপ পড়েছিল, চামড়া ফেটে গদ গদ করে। বেরুল রোয়াইল ফলের মতো পুঁজ। সেই পুঁজের অন্তরালে দেখা গেল মাথা উঁচিয়ে আছে একখানা খেজুরকাঁটা।

এ অনেককাল আগের কথা। তারপর থেকে এ তল্লাটে রস চুরি হয় না। লোকে মনে করে খেজুরগাছ হচ্ছে মা জননী। মা যেমন বুকের দুধ শুধুমাত্র তার সন্তানের জন্য লুকিয়ে রাখে, খেজুরগাছ ঠিক তেমন করে তার রস লুকিয়ে রাখে গাছির জন্য। গাছি ছাড়া অন্য কেউ এসে বুকে মুখ দিলে কাঁটার আঘাতে মা জননী তাকে বিক্ষত করেন, জান সংহার করেন। নইলে এই যে এতকালের পুরনো গাছি দবির, বয়স হল দুকুড়ির কাছাকাছি, গাছ ঝুরছে বালক বয়স থেকে, কই তার পায়ে তো কখনও কাঁটা ফুটল না! গাছ ঝুরতে ওঠে কাঁটার একটি খোঁচাও তো সে কখনও খায়নি! এসব ভেবে নৌকোর মতো বাঁকা হয়ে থাকা গাছটির পায়ের কাছে খুবই বিনীত ভঙ্গিতে দুহাত ছোঁয়াল দবির গাছি। তিনবার সালাম করল গাছটিকে। বহুকাল পর মায়ের কাছে ফিরে আসা আদুরে ছেলে যেমন করে ঠিক তেমন আকুলি বিকুলি ভঙ্গিতে গাছটিকে তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরল। বিড়বিড় করে বলল, মা মাগো, আমার মিহি (দিকে) ইট্টু নজর রাইখো মা। গরিব পোলাডার মিহি নজর রাইখো। এই দুইন্নাইতে তোমরা ছাড়া আমার মিহি চাওনের আর আছে কে! তোমরা দয়া না করলে বাচুম কেমনে! আমি তো বছর ভর তোমগ আশায় থাকি! তোমগ দয়ায় দুই তিনটা মাস সুখে কাটে। আর বছর ভালোই দয়া করছিলা। এইবারও তাই কইরো মা। মাইয়া লইয়া, মাইয়ার মারে লইয়া বছর যেন খাইয়াপইরা কাটাইতে পারি।

.

ছনুবুড়ির স্বভাব হচ্ছে দিনমান টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর টুকটাক চুরি করা, মিথ্যে বলা। কুটনামিতে তার কোনও তুলনা নেই। বয়স কত হয়েছে কে জানে! শরীরটা কঞ্চির পলকা ছিপঅলা বড়শিতে বড় মাছ ধরলে টেনে তোলার সময় যেমন বেঁকে যায় তেমন করে বেঁকে গেছে। যেন এই শরীরটা তার পলকা কঞ্চির ছিপ, মাটির অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বয়স নামের অদৃশ্য শক্তিশালী এক মাছ এই ছিপে গাঁথা পড়েছে, মাছ তাকে টানছে, টেনে বাঁকা করে ফেলছে। কোন ফাঁকে যে ভেঙে পড়বে ছিপ কেউ জানে না। যুদ্ধটা চলছে। এই যুদ্ধের ফাঁকেই নিজের মতো করে জীবনটা চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি। এগ্রাম সেগ্রাম ঘুরছে, এবাড়ি ওবাড়ি ঘুরছে, চুরি করছে, মিথ্যে বলছে। এর কথা ওকে, ওর কথা তাকে, ছনুবুড়ি আছে বেশ। মাথায় পাটের আঁশের মতো সামান্য কিছু চুল, মুখে একটিও দাঁত নেই, একেবারেই ফোকলা, শরীরের চামড়া তীব্র খরায় শুকিয়ে যাওয়া ডোবানালার মাটির মতো, পরনে এটেল মাটি রঙের একখানা থান, হাতে বাঁশের একখানা লাঠি আর দুচোখে ছানি নিয়ে কেমন করে যে এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ছনুবুড়ি, ভাবলে তাজ্জব লাগে।

আজ দুপুরে সড়কের ওপাশে, পুবপাড়ার জাহিদ খাঁর বাড়ি গিয়েছিল ছনুবুড়ি। জাহিদ খাঁর ছেলের বউদের অনুনয় করে দুপুরের ভাতটা সেই বাড়িতেই খেয়েছে। খেয়ে ফেরার সময় ছানিপড়া চোখেই দেখতে পেয়েছে বাড়ির পেছন দিককার সবজি বাগানে বেগুন ফলেছে, টমেটো ফলেছে। এখনও তেমন ডাগর হয়নি বেগুন, টমেটোগুলো ঘাসের মতো সবুজ, লাল হতে দিন দশ বারো লাগবে। কিন্তু চুরির লোভটা সামলাতে পারেনি সে। বার দুতিনেক এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক টুক করে দুতিনটে বেগুন ছিঁড়েছে, চার পাঁচটা টমেটো ছিঁড়েছে। তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে পথে নেমেছে।

সার্থকভাবে চুরি করার পর মনে বেজায় একখানা স্ফুর্তি থাকে ছনুবুড়ির। এমনিতেই দুপুরের খাওয়াটা হয়েছে ভালো, ঢেকিছাটা লক্ষ্মীদিঘা চালের ভাত আর খলিসা মাছের। ঝোল, তার ওপর অমন সার্থক চুরি, ছনুবুড়ির স্বভাব জেনেও বাড়ির কেউ টের পায়নি, পথে নেমে বুড়ি একেবারে আহ্লাদে আটখানা। বেগুন টমেটো টোপরে (কোচর) নিয়ে যক্ষের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছে বুকের কাছে আর হাঁটছে খুব দ্রুত। সার্থকভাবে চুরি করে বেরিয়ে আসার পর এই বয়সেও ছনুবুড়ি হাঁটে একেবারে হুঁড়ির মতো। বয়স নামের শক্তিশালী মাছটা টেনে তখন তাকে খুব একটা কাবু করতে পারে না।

আজও পারেনি। দ্রুত হেঁটে প্রথমে ছনুবুড়ি গেছে হাজাম বাড়ি। সেই বাড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খেয়েছে। টোপরের বেগুন টমেটো একহাতে আঁকড়ে ধরা বুকের কাছে অন্যহাতে নারকেলের ছোট্ট হুঁকা। গুরগুর গুরগুর করে যখন তামাক খাচ্ছে। হাজাম বাড়ির মুরব্বি সংসার। আলী হাজামের সেজো মেয়ে তছি বুকের কাছে আঁকড়ে ধরা টোপরটা দেখে ফেলল। তছি হচ্ছে জন্মপাগল। মাথা ঠিক নেই তার, কথাবার্তার ঠিক নেই। যুবতী বয়স তছির কিন্তু চালচলন শিশুর মতো। ফলে তছির নাম পড়েছে তছি পাগলনি।

ছনুবুড়ির টোপরের দিকে তাকিয়ে তছি পাগলনি বলল, ও মামানি টুপরে কী তোমার? সংসার আলী হাজামের ছেলেমেয়েরা ছনুবুড়িকে ডাকে বুজি, তছি পাগলনি ডাকে মামানি। এই মামানি ডাকটা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায় বুড়ির। কোথায় বুজি কোথায় মামানি! আত্মীয় অনাত্মীয় যে কাউকে বুজি ডাকা যায় কিন্তু মামানি ডাকা যায় না। মামানি ডাক শুনলেই মনে হয় হাজামরা ছনুবুড়ির আত্মীয়। হাজামরা হচ্ছে ছোট জাত, অচ্ছুত। তারা কেমন করে ছনুবুড়ির আত্মীয় হয়! গ্রামের লোকে শুনলে বলবে কী! ছনুবুড়ির শ্বশুরপক্ষকে হাজাম ভাববে না তো! আজকালকার লোকেও মানুষের অতীত, নিয়ে কম ঘাটায় না। যা নয় তাই খুঁচিয়ে বের করা স্বভাবের মানুষের কি আকাল আছে গ্রামে!

এসব ভেবে রেগে গেল বুড়ি। তছি যে জন্মপাগল ভুলে গেল। হুঁকা নামিয়ে খেকুড়ে গলায় বলল, ঐ ছেমড়ি তুই আমারে মামানি কচ কেন লো? আমি তর কেমুন মামানি? সঙ্গে সঙ্গে ছনুবুড়ির সামনে, মাটিতে শিশুর মতো লেছড়ে-পেছড়ে বসল তছি। মাথাভর্তি উকুন তার, সারাক্ষণ মাথা চুলকোচ্ছে। এখনও চুলকোল। চুলকোতে। চুলকোতে বলল, কেমুন মামানি জানি না। টুপরে কী লও? কই থিকা চুরি করলা?.. একে মামানি ডাক তার ওপর অমন মুখের ওপর চুরির অপবাদ, মাথা একেবারে বিগড়ে গেল বুড়ির। হাতের লাঠি নিয়ে তড়বড় করে উঠে দাঁড়াল সে। গলা তিন চারগুণ চড়িয়ে ফেলল। আমি চোর? আমি চুরি করি, আ! হাজাম জাতের মুখে এতবড় কথা?

ছনুবুড়ির রাগ চিৎকার একদম পাত্তা দিল না তছি। বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে হি হি করে একটু হাসল। তারপর মাথা চুলকোতে চুলকোতে নির্বিকার গলায় বলল, তুমি তো চোরই মামানি। মেন্দা বাড়ির ঝাঁকা থিকা হেদিনও তো তোমারে কহি (এক ধরনের সবজি চুরি করতে দেখলাম। আইজ কী চুরি করছ? দেহি টুপরে কী?

এবার চুরির কথা আর পাত্তা দিল না বুড়ি। আবার মামানি নিয়ে পড়ল। ইচ্ছা কইরা মামানি কও আমারে। আত্মীয় বানাইছ, হাজাম বানাইছ আমারে! ওই মাগি আমি কি হাজাম জাতের বউঝি যে আমারে তুই মামানি কচ!

তছির বড়ভাই গোবেচারা ধরনের আবদুল তার বউ আর তছির মা তিনজনেই তখন বুড়িকে থামাবার চেষ্টা করছে। অর কথায় আপনে চেইত্তেন না বুজি। ও তো পাগল, কী থুইয়া কী কয়!

কিয়ের পাগল, কিয়ের পাগল ও? ভেক ধরছে। অরে আমি দেখছি না তারিক্কার লগে ইরফাইন্নার ছাপড়ায় ঢোকতে। পাগল অইলে এই হগল বোজেনি?

এ কথায় তছির মা ভাই একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেল। ভাইর বউ মুচকি হেসে মাথায় প্রথমে ঘোমটা টানল তারপর পশ্চিমের ছাপড়ায় গিয়ে ঢুকল।

তছি ততক্ষণে বুঝে গেছে তার নামে বদকথা বলছে ছনুবুড়ি। লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়াল সে। পাগল বলে কথার পিঠে কথা বলতে শেখেনি সে, এক কথা শুনে বলে অন্য কথা। এখনও তাই করল। ঝগড়ারত বেড়ালের মতো মুখ খিঁচিয়ে বলল, ঐ বুড়ি কুটনি, চুন্নিবুড়ি, মামানি ডাকলে শইল জ্বলে, না? হাজামরা মানুষ না! ছোড জাত? তয় এই ছোড জাতের বাইত আহ ক্যা? তাগ বাইত তামুক খাওনের সুময় মনে থাকে না তারা হাজাম! হাজামরা যেই উক্কায় তামুক খায় হেই উক্কায় মুখ দেও কেমনে? হাজামগ থালে বইয়া দেহি কতদিন ভাত খাইয়া গেছ! বাইরে অও আমগ বাইত থন। বাইর অও। আর কুনওদিন যদি এই বাইত্তে তোমারে দেহি টেংরি ভাইঙ্গা হালামু।

তছির মারমুখো ভঙ্গি দেখে ছনুবুড়ি দমে গেছে। মুখে কথা আটকে গেছে তার। গো গো করতে করতে হাজাম বাড়ি থেকে নেমেছে সে। দক্ষিণের মাঠ ভেঙে হাঁটতে শুরু করছে। এখন শেষ বিকেল। এসময় বাড়ি ফেরা উচিত। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনালে হাঁটা চলায় অসুবিধা। ছানিপড়া চোখে এমনিতেই ঝাপসা লাগে পৃথিবী। তার ওপর যদি হয়। অন্ধকার, পথ চলতে আছাড় উষ্টা খাবে ছনুবুড়ি। এই বয়সে আতুড় লুলা হয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নেই। ঘরে বসে জীবন কাটাবার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।

এসব ভেবে দ্রুত পা চালাচ্ছে বুড়ি, মিয়াদের ছাড়া বাড়ির দক্ষিণে এসেছে, বাড়ির সীমানা ছাড়িয়ে যে লম্বা টোসখোলা ঝোপ সেই ঝোপের এপাশ থেকে হেলেপড়া খেজুর গাছটির পায়ের কাছে ছানিপড়া চোখেও একটি লোককে বসে থাকতে দেখল। দেখে থমকে দাঁড়াল। গলা টানা দিয়ে বলল, কেডারে খাজুর তলায়?

খেজুরতলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া এল। আমি।

 আমি কে?

মানুষটি ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। হাসি হাসি মুখ করে আমুদে গলায় বলল, কও তো কেডা?

বয়সী মাথাটা সামান্য কাঁপাল ছনুবুড়ি। গলা চিনা চিনা লাগে!

তারপরই শিশুর মতো উজ্জ্বল হল সে। চিনছি। দউবরা। ঐ দউবরা খাজুর তলায় কী করচ তুই? গাছ ঝুরছ?

 দবির গাছি বলল, না অহনও ঝুরি না। জিনিসপত্র লইয়া বাইর হইছি। আইজ ঘুইরা ঘাইরা গাছ দেখতাছি। কাইল পশশু রুম। তুমি আইলা কই থিকা?

জাহিদ খাঁর বাড়ি দাওত খাইতে গেছিলাম।

কেডা দাওত দিল তোমারে?

জাহিদ খাঁর বড় পোলায়। পোলার বউডা এত ভালো, দুই একদিন পর পর ঐ দাওত দিয়া খাওয়ায় আমারে। কয় আমারে বলে অর মার মতন লাগে।

ছনুবুড়ির কথা শুনে নিঃশব্দে হাসল দবির গাছি। কী খাওয়াইল?

ভাত আর চাইর পাঁচ পদের মাছ। ইলসা, টাটকিনি, গজার। বাইং মাছও আছিল। আমি খাই নাই। শেষমেষ দিল দুদ আর খাজুরা মিডাই (খেজুর গুড়)।

অহন খাজুরা মিডাই পাইল কই?

আর বছরেরডা মুড়ির জেরে (টিনে) রাইক্কা দিছিল।

তারপর দবির গাছিকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বলল, বউ এত ভালো বুঝলি দউবরা, গাছের বাইগন, বিলাতি বাইগন (টমেটো) অহনও ডাঙ্গর অয় নাই হেইডিও কতডি ছিড়া আমার টুপরে দিয়া দিল। কইল বাইত লইয়া যান। হাজাম বাড়ি গেছি। তামুক খাইতে আমার টুপুর দেইখা তছি পাগলনি কয় কি, কী চুরি করলা! ক, আমি বলে চোর!

ছনুবুড়ির স্বভাব জানার পরও তছির ওপর একটু রাগল দবির গাছি। বলল, বাদ দেও পাগল ছাগলের কথা। অর কথায় কী যায় আহে।

ছনুবুড়ি খুশি হয়ে বলল, হ অর কথায় কী যায় আহে। তয় তুই একখান কাম করিচ বাজান, পয়লা দিনের রস আমারে ইট্টু খাওয়াইচ।

খাওয়ামুনে। তয় দুই চাইরদিন দেরি হইব।

ক্যা, দেরি হইব ক্যা?

গাছ ঝুইরা ঠিলা পাততে সময় লাগব না! উততইরা বাতাসটা আইজ খালি ছাড়ছে। আইজ থিকা রস আইছে গাছে। বেবাক কিছু ভাও করতে দুই তিনদিন লাগব। পয়লা দিনের রস খাওয়ামুনে তোমারে, চিন্তা কইর না। অহন খালি দেহ উততইরা বাতাসটা কেমনে ছাড়ছে! এইবারের রস দেখবা কেমুন মিডা অয়!

বিকেল শেষের হা হা করা উত্তুরে হাওয়ায় ছনুবুড়ির পাটের আঁশের মতো চুল তখন ফুর ফুর করে উড়ছে। এ হাওয়ায় মনে কোনও পাপ থাকে না মানুষের, কুটনামো থাকে না কিন্তু ছনুবুড়ির মনে সামান্য কূটবুদ্ধি খেলা করতে লাগল।

.

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় ছনুবুড়ি দেখতে পেল তার ছেলের বউ বানেছা এলাগেন্দা পোলাপান (ছোট ছোট ছেলেমেয়ে) নিয়ে ঘরের মেঝেতে বসে বউয়া (তেল এবং পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে তৈরি এক ধরনের ভাত, চাল এবং খুদ কুটো দিয়েই হয়।) খাচ্ছে। বেশ খানিকটা বেলা হয়েছে, এসময় বউয়া খেলে দুপুরের ভাত বিকেলে খেলেও অসুবিধা নেই। আর বিকেলে ভাত খাওয়া মানে রাতে না খেলেও চলবে। গেরস্ত বাড়িতে যখন অভাব দেখা দেয় তখন অসময়ে বউয়া কিংবা জাউ খায় সংসারের লোকে।

তাহলে কি ছনুবুড়ির ছেলের সংসারে অভাব লেগেছে!

অভাব তো লাগবার কথা নয়। বুড়ির একমাত্র ছেলে আজিজ গাঁওয়াল (ফিরি করা) করে। ভারে বসিয়ে কাঁসা পেতলের থালাবাসন, জগ গেলাস, কলশি পানদান নিয়ে দেশ গ্রাম চষে ফেরে। নতুন একখানা কাঁসাপেতলের থালা কিংবা বদনা, পানের ডাবর কিংবা পানদান গেরস্ত বাড়ির বউঝিদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিনিময়ে সেইবাড়ি থেকে নিয়ে আসবে পুরনো কাঁসা পেতলের ভাঙাচোরা কিংবা বহুকাল ধরে ব্যবহার করা জিনিসপত্র। একখানা নতুন জিনিসের বিনিময়ে আনবে দুতিনখানা পুরনো জিনিস। তারপর সপ্তাহে সপ্তাহে লৌহজং বাজারে গিয়ে ওজনদরে সেইসব জিনিস বিক্রি করে অর্ধেক টাকার জিনিস কিনবে অর্ধেক টাকা কোঁচড়ে গুজবে। ওই অর্ধেক টাকাই মুনাফা। তার ওপর খেতখোলাও আছে আজিজের। ভালোই আছে। আড়াই কানির মতো হবে। পুরো আড়াই কানিই পড়েছে ইরির আওতায়। বর্গা দিয়েও ধান যা পাওয়া যায় বছর চলে স্বাচ্ছন্দে। যদিও আজিজের সংসারটা বড়। বিয়ের পর বছর থেকে সেই যে পোলাপান হতে শুরু করেছে বউয়ের, এখনও থামেনি। বড় পোলার বয়স হয়েছে এগার বার বছর। এখনও দেখ পেট উঁচু হয়ে আছে বানেছার। সাত মাস চলছে। মাস দুয়েক পর কোনও একদিন ব্যথা উঠবে। আলার মা ধরণী এসে খালাস করে দিয়ে যাবে। পোলা না মাইয়া কী হল সে নিয়েও আগ্রহ থাকবে না সংসারের কারও। না আজিজের, না বানেছার। এমন কী পোলাপানগুলোও তাকিয়ে দেখবে না, ভাই হল। তাদের, না বোন। যে যাকে নিয়ে আছে তারা।

আর ছনুবুড়ির তো কথাই নেই। সে তো এই সংসারে থেকেও নেই। বিয়ে করে বানেছাকে যেদিন সংসারে আনল আজিজ তার পরদিন থেকেই সংসারের বাড়তি মানুষ হয়ে গেল ছনুবুড়ি। বাড়িতে বড়ঘর একটিই, সেই ঘরটি চলে গেল ছেলে বউর দখলে। উত্তরের ভিটেয় আছে মাথার ওপর টিনের দোচালা আর চারদিকে বুকাবাঁশের (বাঁশ চিড়ে তার তেরকার সাদা নরম অংশ দিয়ে তৈরি) বেড়া, ঢেঁকিঘর। একপাশে বেলদারদের (নিচু ধরনের এক সম্প্রদায়) রোগা ঘোড়ার মতো কালো রঙের বহুকালের। পুরনো ঢেঁকিটা লোটে (ঢেকির মুখ যে গর্তে পড়ে) মুখ দিয়ে পড়ে আছে, আরেক পাশে উঁই হয়ে আছে লাকড়িখড়ি, এসবের মাঝমধ্যিখানে, লেপাপোছা সামান্য জায়গা থাকার জন্য পেল ছনুবুড়ি। নিজের কাঁথা বালিশ নিয়ে ছনুবুড়ি তারপর থেকে ওখানেই শোয়।

দিন চলে যাচ্ছে।

কিন্তু ছেলের বউ হিসেবে বানেছা খুব খারাপ। সংসারে এসে ঢোকার পর থেকেই দু চোখে দেখতে পারে না শাশুড়ীকে। কি ভালো কথা কি মন্দ কথা, ছনুবুড়ির কথা শুনলেই ছনছন করে ওঠে। চোপা (মুখ) এত খারাপ, শাশুড়িকে কী ভাষায় গালাগাল করা যায় তাও জানে না। মুখে যা আসে তাই বলে। এমন কি সতীন পর্যন্ত।

প্রথম প্রথম এই নিয়ে কেচ্ছাকেলেংকারি হয়েছে সংসারে। বানেছা যেমন ছনুবুড়িও তেমন, বউ শাশুড়ির কাইজ্জা কিত্তনে পাড়ার মানুষ জড় হত। শেষদিকে যখন হাতটাতও তুলতে শুরু করল বানেছা, তখন উপায়অন্ত না দেখে থেমে গেছে ছনুবুড়ি। শাশুড়ি হয়ে বউর হাতে মার খাওয়া! ছি!

আর পেটের ছেলে আজিজ, সে এমন মেউন্না, বউর ওপর দিয়ে কথা বলার মুরোদ নেই। বউ অন্যায় করলেও দোষ সে মাকেই দেয়। এসব দেখে সংসারের ওপর থেকে মন উঠে গেছে বুড়ির। তারপর থেকে সংসারে সে থেকেও নেই। বাড়ি থাকলে নাতিনাতকুরদের হাত দিয়ে ভাততরকারি পাঠায় বানেছা, ছনুবুড়ি খায়। কখনও যদি না পাঠায় সে নিয়ে রা কাড়ে না। কারণ পাড়া চড়ে ছোটখাট চুরিচামারি করে, কুটনামি করে টুকটাক খাদ্য যা জোগাড় করে সে তাতে নিজের পেটটা বুড়ির খালি থাকে না। সময় অসময়ের খিদেটা মারতে পারে।

তবে দেশগেরামের লোক ছনুবুড়ির আড়ালে আবডালে তাকে নিয়ে খুব হাসিমশকরা করে। এতবড় কূটনি হয়েও ছেলেবউর কুটনামির কাছে মার খেয়ে গেছে বুড়ি। কাইজ্জা কিত্তনে ছনুবুড়ির বেজায় ধার, সেই ধার মার খেয়ে গেছে বানেছার কাছে। পারতিকে বউর সঙ্গে সে কথা বলে না। বউকে চোখের ওপর দেখেও কথা বলে না, না দেখার ভান করে।

কিন্তু আজকের ব্যাপারটি অন্যরকম। আজ সকাল থেকেই পেটভর্তি খিদে বুড়ির। সকালবেলা মুখে দেয়া যায় এমন কোনও খাদ্য নিজের সংগ্রহে ছিল না। কাল দুপুরে জাহিদ খাঁর বাড়ি ভাত খেয়েছে তারপর থেকে একটা বিকেল গেছে, পুরো একটা রাত তারপর এতটা বেলা, মানুষ বুড়ো হলে কী হবে পেট কখনও বুড়ো হয় না, খিদেটা বেজায় লেগেছে ছনুবুড়ির। আর এসময় বাড়ির বউ পোলাপান নিয়ে বউয়া খাচ্ছে। যদিও ছেলের সংসারের অভাবের কথাটাও মনে হয়েছে ছনুবুড়ির, একাধারে বউয়ার। গন্ধে নিজের পেটের খিদেটাও জাগা দিয়ে উঠেছে।

 ছনুবুড়ি এখন কী করে!

ছেলেবউর সঙ্গে শেষ কবে কথা হয়েছে মনে নেই বুড়ির। আজ বুড়ি ভাবল নাতি নাতকুরদের মাধ্যমে বউর সঙ্গে ভালোভালোই দুএকখানা কথা বলে সংসারের অভাবের কথাটা জেনে নেবে এবং নিজের জন্য একথালা বউয়াও জোগাড় করবে। কুটনামি একটু করে দেখুক কাজে লাগলেও লাগতে পারে।

বড় ঘরের পিড়ায় বসল ছনুবুড়ি। ঘরের ভেতর গলা বাড়িয়ে মেজ নাতিটাকে ডাকল। ও হামেদ, হামেদ কী কর ভাই? বউয়া খাও?

সংসারে একমাত্র হামেদেরই সামান্য টান দাদির জন্য আছে। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ।

কিয়ের বউয়া?

খুদের।

খুদের বউয়া খাও ক্যান, ঘরে কি চাউল নাই?

 হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, চোক্কে বলে দেহে না, তয় ঘরে বইয়া যে আমি পোলাপান লইয়া বউয়া খাই হেইডা দেহে কেমতে?

খোঁচাটা সঙ্গে সঙ্গে হজম করল ছনুবুড়ি। যেন বউর সঙ্গেই কথা বলছে এমন স্বরে বলল, কে কইছে চোক্কে দেহি না! অল্পবিস্তর দেহি।

সঙ্গে সঙ্গে বানেছা বলল, আইজ যে অহনতরি বাইত্তে? আইজ যে অহনতরি পাড়া বেড়াইতে বাইর অয় নাই?

বাইর অইতাছিলাম।

তয়?

ছনুবুড়ি বুঝে গেল বানেছার আওয়াজটা ভালো না। এখুনি কাইজ্জা কিত্তন লাগাবে সে। বুড়ি আর বানেছার উদ্দেশ্যে কথা বলল না। হামেদকে বলল, ও হামেদ, আমারে ইট্টু বউয়া দে। বিয়াইন্নাবেলা আমারও তো খিদা লাগে!

হামেদ কথা বলবার আগেই বানেছা একেবারে তেড়ে উঠল। ইস একদিন পোলাপান লইয়া ইট্টু বউয়া খাইতে বইছি তাও মাগির সইজ্জ অয় না। অরে দেওন লাগব এক থাল! এই বুড়ি, বাইর অইলি বাড়িত থন!

বানেছার কথা শুনে ছনুবুড়িও তেড়ে উঠতে গিয়েছিল, কী ভেবে সামলাল নিজেকে। গলা নরম করে সরাসরি বানেছাকে বলল, এমুন কইর না বউ। কয়দিন পর আহুজ পড়ব, এই সমায় ময়মুরব্বিগ বদদোয়া লইতে অয় না। একবার আহুজ পড়ন আর একবার মউতের মুক থিকা ফিরত আহন এক কথা।

একথায়ও বানেছার মন গলল না। আগের মতোই রুক্ষ্ম গলায় সে বলল, এত আল্লাদ দেহানের কাম নাই। মউতের মুখে আমি পেত্যেক বচ্ছরঐ যাই, আবার ফিরতও আহি। তোমার বদদোয়ায় আমার কিচ্ছু অইব না। হকুনের দোয়ায় গরু মরে না। তাইলে দুইন্নাইতে আর গরু থাকত না। খালি হকুনঐ থাকত।

আজিজের মেজছেলে ন-দশ বছরের হামেদ তখন খাওয়া শেষ করেছে। এই ছেলেটি বেশ আমুদে স্বভাবের। এই বয়সেই বয়াতিদের গান শুনে সেইগান গলায় তুলে ফেলে। কয়েকদিন আগে তালুকদার বাড়ি গিয়ে খালেক কিংবা মালেক দেওয়ানের দেহতত্ত্বের গান শুনে এসেছে। স্মরণশক্তি ভালো ছেলেটির। একবার দুবার শোনা গান অবিকল বয়াতিদের মতো করে গাইতে পারে। মা দাদীর কথা কাটাকাটির মধ্যেও গলা ছেড়ে গান জুড়ে দিল সে।

মা লো মা ঝি লো ঝি বইন লো বইন করলাম কী
রঙ্গে ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

নাতির গান শুনে খিদের কষ্ট এবং ছেলেবউর করা অপমানে বহুকাল পর বুকের অনেক ভেতর থেকে ছনুবুড়ির ঠেলে উঠল গভীর কষ্টের এক কান্না। এঘরের পিড়ায় বসে এখন যদি কাঁদে ছনুবুড়ি ওই নিয়েও কথা বলবে বানেছা। হয়ত আরও অপমান করবে তাকে। এই অপমানের ভয়ে চোখে জল নিয়েই উঠে দাঁড়াল ছনুবুড়ি। বাড়ির নামার দিকে হাঁটতে লাগল। ঘরের ভেতর হামেদ তখন গাইছে,

নৌকার আগা করে টলমল
বাইন চুয়াইয়া ওঠে জল।
কত ভরা তল হইল এই গাঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে।

.

বেশ শক্ত করে কুট্টির হাত ধরেছেন মিয়া বাড়ির কত্রী রাজা মিয়ার মা। ধরে খুবই সাবধানে বড় ঘরের সিঁড়ি ভাঙছেন। একটি করে সিঁড়ি ভাঙছেন, কয়েক মুহূর্ত করে দাঁড়াচ্ছেন। দাঁড়িয়ে গাভীন গাইয়ের শ্বাস ফেলার মতো করে শ্বাস ফেলছেন। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় মানুষ না হয় ক্লান্ত হয় নামার সময়ও যে হয়, তাও মাত্র চার পাঁচটা সিঁড়ি, কুট্টি ভাবতেই পারে না। মোটা হলে যখন এতই কষ্ট তাহলে মোটা হওয়ার দরকার কী! কে বলেছে এত মোটা হতে!

শেষ সিঁড়িটা ভেঙে মাটিতে পা দিলেন রাজা মিয়ার মা, ভারি স্বস্তির একখানা শব্দ করলেন। যেন পুলসুরাত পেরিয়ে এসেছেন এমন আরামদায়ক একখানা ভাব। তারপরই কুট্টির মুখের দিকে তাকালেন, বাজখাই গলায় বললেন, জলচকি দিছস?

কুট্টি সঙ্গে সঙ্গে বলল, দিছি বুজান।

তারপর রাজা মিয়ার মার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। জলচকি না দিয়া আপনেরে ঘর থিকা বাইর করুমনি? আমি জানি না উডানে নাইম্মা খাড়াইতে পারেন না আপনে! লগে লগে বহন লাগে। এর লেইগা আগেই জলচকি দিছি, তারবাদে আপনেরে ঘর থিকা বাইর করছি।

 ভালো করছস। তয় আমি তো আইজ উডানে বহুম না।

বলেই কুট্টির কাঁধে কলাগাছের মতো একখানা হাত রাখলেন রাজা মিয়ার মা। শরীরের ভার খানিকটা ছেড়ে দিলেন। সেই ভারে কুট্টি একটু কুঁজো হয়ে গেল। বিশ একুশ বছরের রোগা পটকা মেয়ে কুট্টি তার পক্ষে এরকম একখানা দেহের সামান্য ভারও বহন করা সম্ভব নয়।

কুট্টির ইচ্ছে হল কথাটা বুজানকে বলে। কিন্তু বলার জো নেই। রাজা মিয়ার মার দেহ এবং মেজাজ দুটোই এক রকম। রাগ করতে পারেন এমন কোনও কথা মুখের ওপর। কিংবা আড়ালে আবডালে বললে, সেকথা যদি তাঁর কানে যায় তাহলে আর কথা নেই। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের করে দেবেন। তার আগে যে গালাগালখানা করবেন সেই গালাগাল শুনে গর্তে গরম জল ঢেলে দেয়ার পর যেমন ছটফটে ভঙ্গিতে বেরয় সাপ কিংবা তুরখুলা (এক ধরনের বড় পোকা) ঠিক তেমন করে কবর থেকে বেরুবে কুট্টির যত মৃত আত্মীয়। তাতে অবশ্য কুট্টির কিছু আসবে যাবে না কিন্তু এই বাড়ির বাঁধা কাজ হারালে কুট্টির কোথাও দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না। না খেয়ে মরণ। আর খিদের কষ্ট কী যেন তেন কষ্ট! সব কষ্ট সহ্য করা যায় খিদের কষ্ট সহ্য করা যায় না। সেই কষ্টের চে এই ভার বহন করা কোটি গুণ ভালো।

কুঁজো শরীরেও মুখটি হাসি হাসি করল কুট্টি। বলল, আমি জানি আপনে আইজ কই বইবেন।

রাজা মিয়ার মাও হাসলেন। ক তো কো?

 আমরুজ (জামরুল) তলায়।

 হ ঠিক কইছস।

এর লেইগা জলচকিডা আমরুজ তলায়ঐ দিছি।

 এই বাড়ির রান্নাঘরটি উঠোনের একেবারে মাঝখানে। দক্ষিণের ভিটেয় দোতলা বিশাল একখানা টিনের ঘর। ঘরটির নিচের তলাও পাটাতন করা। দক্ষিণমুখো বাড়ির পুকুর বরাবর একতলা দোতলা। দুতলাতেই রেলিং দেয়া বারান্দা। বেশ দূর থেকে গাছপালার মাথা ছাপিয়ে মিয়া বাড়ির দোতলা ঘরটি দেখা যায়।

বাড়ির পশ্চিম এবং উত্তরের ভিটেয় আছে আরও দুখানা পাটাতন ঘর। বছরভর তালামারা থাকে ঘর দুটো। এতদিন হল এই বাড়িতে আছে কুট্টি এক দুবারের বেশি। ঘর দুটো খুলতে দেখেনি। বন্ধই যদি থাকবে ঘর দুটো তাহলে রাখবার দরকার কী!

তিনখানা ঘরের প্রত্যেকটির থেকে পাঁচ সাত কদম করে জায়গা হবে বাদ দিয়ে পুবের ভিটেয় রান্নাঘর। রান্নাঘরখানির অবশ্য কায়দা বেশ। দেশগেরামের রান্নাঘরের সঙ্গে মেলে না। মাথার ওপর টিনের চালা নেই, টালির ছাদ দেয়া।

 এই রান্নাঘরটির পেছনেই মাঝারি ধরনের একটি জামরুল গাছ। বাড়ি এলে কোনও কোনও সময় জলচৌকি পেতে এই জামরুল তলায় বসে বড় আরাম পান রাজা মিয়ার মা। শীতকাল, গরমকাল সব সময়ই দেহে তাঁর গরম ভাব। দুচার কদম হাঁটলেই ঘামে জবজব করে শরীর। ভেতর থেকে ঠেলে বেরয় উষ্ণতা। জামরুল তলায় বসলে এই উষ্ণতা কমে। জায়গাটা সব সময়ই শীতল। জামরুলের পাতায় ঝিরিঝিরি হাওয়াটা সব সময়ই খেলে। আজ সকালে, বেশ খানিকটা বেলা হয়ে যাওয়ার পর কুট্টির কাঁধে ভর দিয়ে এই জামরুল তলার দিকেই যাচ্ছেন রাজা মিয়ার মা। অতিকায় দেহধারী বলে তাঁর হাঁটাচলা খুবই ধীর। চোখের পলকে পৌঁছনো যায় এমন জাগায় পৌঁছুতেও তাঁর সময় লাগে বেশ খানিকটা।

 এখনও লাগছে।

 তবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছেন রাজা মিয়ার মা। গলার আওয়াজও তাঁর দেহ এবং মেজাজের মতোই। ভালোমন্দ যে কোনও কথা বললেই পিলে চমকায়। বেশ অনেকদিন ধরে এই বাড়িতে থাকার পরও, এখনও কেমন পিলে চমকাচ্ছে কুট্টির। বুজান বাড়ি এলে অবশ্য সারাক্ষণই এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে থাকে সে। ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা করে কবে বাড়ি থেকে যাবেন তিনি। কবে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে কুট্টি।

রাজা মিয়ার মা বাড়ি না থাকলে এই বিশাল বাড়িটির মালিক কুট্টি। বড় বুজান অবশ্য আছেন বাড়িতে, বাঁধা কামলা আছে আলফু। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। বড় বুজান বয়সের ভারে পঙ্গু। সারাক্ষণই শুয়ে আছেন বিছানায়। হাঁটাচলা করা তো দূরের কথা, বিছানায় উঠে বসতে পর্যন্ত পারেন না। কথা বলেন হাঁসের ছায়ের মতো চিচি করে। আর আলফুকে তো মানুষই মনে হয় না কুট্টির। মনে হয় গাছপালা, মনে হয় ঝোপঝাড় কিংবা গেরস্তদের বার বাড়ির সামনে নিথর হয়ে থাকা নাড়ার পালা। জলজ্যান্ত একজন মানুষকে যে কেন এমন মনে হয় কুট্টির! বোধহয় কথা আলফু বলে না বলে। বোধহয় ভালোমন্দ সব ব্যাপারেই আলফু সমান নির্বিকার বলে। মুখে ভাষা থাকার পরও আলফু বোবা বলে। রাজা মিয়ার মা বললেন, বুদ্দিসুদ্দি তো তর ভালঐ কুট্টি, তারবাদেও জামাইর ঘর করতে পারলি না ক্যা?

এমনিতেই বুজানের দেহের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে কুট্টি, মনে মনে ভাবছে কখন ফুরবে এইট্টুকু পথ, কখন বুজানকে জলচৌকিতে বসিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে সে, তার ওপর আচমকা এরকম একখানা কথা, তাও ওরকম বাজখাই গলায়, কুট্টি বেশ ভড়কে গেল। কথাটা যেন বুঝতে পারল না সে এমন গলায় বলল, কী কইলেন বুজান?

 এত কাছে থেকেও তাঁর কথা কেন বুঝতে পারেনি কুট্টি এই ভেবে রাজা মিয়ার মা সামান্য রাগলেন। গলা একটু চড়ল তাঁর। এই ছেমড়ি (ছুড়ি) কানে কম হোনচনি?

কুট্টি সঙ্গে সঙ্গে বলল, না।

তয়?

হুনছি ঠিকঐ।

কথার তাইলে জব দেচ না ক্যা?

ততক্ষণে জামরুল তলায় পৌঁছে গেছে তারা। জামরুল তলায় পেতে রাখা বেশ বড় আকারের জলচৌকিতে রাজা মিয়ার মাকে ধরে বসাল কুট্টি। কুট্টির মতো তিন কুট্টি অনায়াসে বসতে পারে যে চৌকিতে সেই চৌকিতে একা বসার পরও চৌকির চারদিক দিয়ে উপচে পড়লেন রাজা মিয়ার মা। ব্যাপারটা খেয়াল করল না কুট্টি। বুজানকে বসিয়ে দেয়ার পরই ক্লান্তির একটা শ্বাস ফেলল। তারপর হাসিমুখে বলল, এমতেই হতিনের সংসার তার মইদ্যে দেয় না ভাত। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না বুজান।

বাড়ির নামার দিকে অনেকগুলো আমগাছ নিবিড় হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে রাজা মিয়ার মা বললেন, বেডা করত কী?

গিরস্তালি করত। ছোড গিরস্ত। তয় শিমইল্লা বাজারে একখান মুদি দোকান আছিল।

তয় তো অবস্তা ভালো। ভাত দিতে পারত না ক্যা?

 সংসার বড়। আগের ঘরের ছয়ডা পোলাপান। ভাই বেরাদর আছে চাইর পাঁচজন।

বেডার তো তাইলে বয়স অনেক।

কুট্টি হাসল। হ আমার বাপের বইস্যা।

এমুন বেড়ার লগে বাপে তরে বিয়া দিল ক্যা?

কী করব! এতডি বইন আমরা! আমি বেবাকতের বড়। আমার বিয়া না অইলে অন্যডির বিয়া অয় না।

এর লেইগা হতিনের সংসারে মাইয়া দিব?

কুট্টি কথা বলল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তারপর আনমনা হয়ে গেল।

রাজা মিয়ার মা বললেন, গরিব মাইনষের ঘরে মাইয়া না অওনঐ ভাল। তর অন্য বইনডির বিয়া অইছে?

দুইজনের অইছে।

আর আছে কয়জন?

অহনও দুইজন আছে।

 তর বাপে করে কী?

শীতের দিনে লেপ তোশকের কাম করে। খরালিকালে কামলা খাডে।

এতে সংসার চলে?

না চলে না।

তয়?

খাইয়া না খাইয়া বাইচ্চা আছে মানুষটি।

এতডি মাইয়া না অইয়া দুই একটা পোলা অইলে কাম অইতো। জুয়ান পোলা থাকলে রুজি কইরা সংসার চালাইতো।

পোলার আশায়ই বলে এতডি মাইয়া জন্ম দিছে আমার মা বাপে। বুজছে পোলা অইবো, অইছে মাইয়া।

একটু থেমে রাজা মিয়ার মা বললেন, তুই তগো বাইত্তে যাচ না?

না।

ক্যা?

মা বাপে আমারে দেকতে পারে না। বাইত্তে গেলে ধুর ধুর কইরা খেদাইয়া দেয়।

কচ কী?

হ।

ক্যা, এমুন করে ক্যা?

ঐ যে জামাই বাইত থিকা পলাইয়া আইয়া পড়ছি, এর লেইগা।

খাইতে পরতে না দিলে আবি না?

খাইতেও দিবো না পরতেও দিবো না, তার উপরে হতিনের সংসার। ওহেনে মানুষ থাকে কেমতে! একখান কাপোড়ে আমি বচ্ছর কাডাইতে পারি বুজান, হতিনের গনজনা সইজ্জ করতে পারি, স্বামী আমার লাগে না, খালি একখান জিনিসের কষ্ট আমার। খিদা। খিদার কষ্ট আমি সইজ্জ করতে পারি না। পেড ভইরা খাওন পাইলে আমি আর কিছু চাই না। আমার মা বাপে এইডা বোজে না। হেরা মনে করে আমি তাগো মান ইজ্জত ধুলায় মিশাইয়া দিছি। কন তো বুজান, পেডে খিদা লইয়া মান ইজ্জত দেহন যায়নি!

কথা বলতে বলতে শেষ দিকে গলা বুজে এল কুট্টির। ঠিক তখনই ছনুবুড়িকে দেখা গেল মিয়াবাড়ির দিকে হেঁটে আসছে।

.

মিয়াদের ভিটায় উঠেই জামরুল তলায় রাজা মিয়ার মাকে দেখতে পেল ছনুবুড়ি। দেখে মনের ভিতর অপূর্ব এক আনন্দ হল। নিজের বাড়িতে, নিজের বউর কাছে হওয়া খানিক আগের অপমান একদম ভুলে গেল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে কুঁজা শরীর সোজা করবার চেষ্টা করল। তারপর দ্রুত হেঁটে জামরুল তলায় এল। ফোকলা মুখখানা হাসি হাসি করে বলল, আরে বুজানে বাইত্তে আইছে নি? কবে আইলেন? চোক্কে আইজকাইল একফোডাও দেহি না, তাও দূর থিকা আপনেরে দেকছি। আদতে আপনেরে দেহি নাই বুজান, দেকলাম আপনেগো বাড়ির আমরুজ তলাডা জোছনা রাইতের লাহান ফকফক করতাছে। দিনে দোফরে জোছনা উটবো কেমতে! বোজলাম এইডা তো জোছনা না, এইডা তো আমার বুজানে। বুজানের শইল্লের রঙখান জোছনার লাহান। আন্দার ঘরে বইয়া থাকলেও ফকফইকা অইয়া যায়। কবে আইছেন বুজান?

গলা যতটা নরম করা যায় করলেন রাজা মিয়ার মা। পশশু দিন আইছি।

মাওয়ার লনচে?

হ। মাওয়ার লনচ ছাড়া আমু কেমতে ক? ছিন্নগরের লনচে আইলে এতদূর থিকা আমারে বাইত্তে আনবো কেডা?

রাজা মিয়ার মায়ের অদূরের মাটিতে বসল ছনুবুড়ি। ক্যা আলফু গিয়া আনবো! আপনে তো আইবেন পালকিতে কইরা!

এতদূর থিকা পালকিতে আইলে খরচা অনেক। মাওয়া থিকা আহন ভাল। তয় দিনডা পুরা লাইগ্যা যায়। বিয়ান ছয়ডার লনচে উটলে বিয়াল অইয়া যায়। ছিন্নগর দিয়া আইলে দুইফইরা ভাত বাইত্তে আইয়া খাওন যায়।

ভাতের কথা শুনে পেটের ভিতর ক্ষুধাটা ছনুবুড়ির মোচড় দিয়ে উঠল। বহু বহু বছরের পুরানা নাকে ভেসে এল গরম ভাপ ওঠা ভাতের গন্ধ। অহন যুদি একথাল ভাত পাওয়া যাইতো! লগে সালুন না অইলেও চলতো। খালি ইট্টু নুন, খালি একহান কাঁচা মরিচ।

নিজের অজান্তেই জিভ নাড়ল ছনুবুড়ি, ঢোক গিলল। রাজা মিয়ার মা এসব খেয়াল করলেন না। খেয়াল করল কুট্টি। জিজ্ঞাসা করতে চাইল, এমুন কইরা ঢোক গিললা ক্যা বুজি? খিদা লাগছেনি? বেইল অইছে, অহনতরি কিছু খাও নাই!

তার আগেই রাজা মিয়ার মা বললেন, রাস্তাডা অইয়া গেলে এই হগল যনতন্না আর থাকবো না।

ক্ষুধার জ্বালায় আনমনা হয়েছিল ছনুবুড়ি। কথাটা বুঝতে পারল না। বলল, কীয়ের যনতন্না বুজান?

এই যে ঢাকা থিকা লনচে কইরা বাইত্তে আহন! আমি মোডা মানুষ, একলা চলাফিরা করতে পারি না। ঢাকা থিকা চাকর লইয়াহি। বহুত খরচা পইড়া যায়। রাস্তা অইয়া গেলে পোলার গাড়ি লইয়া ভো কইরা আইয়া পড়ুম। এক দেড়ঘণ্টা লাগবে বাইত্তে আইতে। দরকার অইলে যেইদিন আমু হেইদিনই ফিরত যাইতে পারুম। রাজা মিয়ায় কইছে বড় সড়ক অইয়া যাওনের পর সড়ক থিকা গাড়ি আইতে পারে এমন একখান আলট (ছোট সড়ক) বাইন্দা দিব বাড়ি তরি (পর্যন্ত)। নিজেগো গাড়ি লইয়া তাইলে বাড়ির উডানে, এই আমরুজ তলায় আইয়া পড়তে পারুম। কুট্টি খালি আমারে ধইরা গাড়ি থিকা নামাইবো। আর কোনও মানুষজন লাগবে না। বুজানে যতদিন বাইচ্চা আছে হেরে তো না দেইক্কা পারুম না! এই বাড়িঘর, জাগাজমিন, খেতখোলা, গাছগাছলা এই হগল তো না দেইক্কা পারুম না!

রাজা মিয়ার মায়ের এত কথার একটা কথা কান্র লাগল ছনুবুড়ির। গাছগাছলা। লগে লগে আগের দিনকার কূটবুদ্ধিটা মাথায় এল। দবির গাছির মুখ ভেসে উঠল ছানিপড়া চোখে। বুদ্ধি খাটায়া যদি ভাল মানুষ সাজা যায় বুজানের কাছে তাহলে দুপুরের ভাত এই বাড়িতে খাওয়া যাবে। কোনও না কোনওভাবে বুজানকে খুশি করতে না পারলে ভাত তো দূরের কথা এক গেলাস পানি চাইলেও বুজান বলবেন, তরে অহন পানি দিব কেডা? পুকঐরে গিয়া খাইয়া আয়।

এত টাকা পয়সা থাকলে কী হবে, এত জায়গাজমিন, খেতখোলা থাকলে কী হবে রাজা মিয়ার মা দুনিয়ার কিরপিন (কৃপণ)। স্বার্থ আদায় না হলে কারও মুখের দিকে তাকান না।

ছনুবুড়ি মনে মনে বলল, স্বার্থঐত্তো, বড় স্বার্থ। প্যাঁচখান লাগাইয়া দেহি। কাম না অইয়া পারবো না।

গলা খাকারি দিয়ে কথা মাত্র শুরু করবে ছনুবুড়ি তার আগেই দোতালা ঘর থেকে খুনখুনা গলায় কুট্টিকে ডাকতে লাগলেন বড়বুজান। কুট্টি ও কুট্টি, কই গেলি রে? আমি পেশাব করুম। আমারে উডা। ডহি (এক প্রকারের হাঁড়ি) বাইর কর।

রাজা মিয়ার মা কান খাড়া করে বললেন, ঐ কুট্টি, বুজানে ডাক পারে। তাড়াতাড়ি যা।

মাত্র পা বাড়িয়েছে কুট্টি, বললেন, হোন, বুজানরে পেশাব করাইয়া ভাত চড়া। সালুন রানবি কী?

মাছ আছে।

কী মাছ

কই আছে, মজগুর (মাগুর) আছে। আপনে আইবেন হুইন্না পুকঐর থিকা ধইরা রাখছে আলফু। কোনডা রান্দুম?

মজগুর রান।

আইচ্ছা।

দ্রুত হেঁটে দোতালা ঘরের দিকে চলে গেল কুট্টি।

এই বাইত্তে আইজ মজগুর মাছ রানবো (রান্না)। গরম ভাতের লগে মজগুর মাছের তেলতেলা সুরা (ঝোল) একটা দুইটা টুকরা আর একথাল ভাত যুদি খাওন যায়! শীতের দিন আইতাছে। এই দিনের জিয়াইন্না (জিয়ল) মাছ বহুত সাদের অয়। ওই রকম মাছ দিয়া একথাল ভাত যুদি খাওন যায়!

মুখের ভিতর জিভটা আবার নড়ল ছনুবুড়ির। আবার একটা ঢোক গিলল সে। তারপর খুবই সরল ভঙ্গিতে কথা শুরু করল। একটা কামলায় আপনেগো অয় বুজান?

কথাটা বুঝতে পারলেন না রাজা মিয়ার মা। ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকালেন। ক্যা অইবো না ক্যা? কাম কাইজ তো আলফু ভালঐ করে।

হ তা তো করেঐ। তয় একলা মানুষ কয়মিহি খ্যাল (খেয়াল) রাকবো! বাড়িঘরের কাম, খেতখোলার কাম, ছাড়া বাইত্তে এতডি গাছগাছলা!

বাড়িঘরের কাম কিছু আছে, খেতখোলায় কোনও কামঐ নাই। অহন তো আর আগের দিন নাই, আমন আউসের চাষ দেশগেরামে অয়ঐ না। অয় খালি ইরি। আমগো বেবাক খেতেই ইরি অয়। তাও বর্গা দেওয়া। বর্গাদাররা ধান উডাইয়া অরদেক (অর্ধেক) ভাগ কইরা দেয়। বছরের খাওনডা রাইখা বাকিডা রাজা মিয়া বেইচ্চা হালায়। খেতখোলার মিহি আলফুর চাইতে অয় না। তয় গাছগাছলার মিহি চায়। ছাড়াবাড়ির মিহি চায়।

হ দোষ তো আলফুর না, দোষ অইলো দউবরার।

রাজা মিয়ার মা ভুরু কুঁচকে বললেন, কোন দউবরা? কিয়ের দোষ?

বুজানের আগ্রহ দেখে ছনুবুড়ি বুঝে গেল, কাজ হবে। পেটের ক্ষুধা পেটে চেপে কথা বলার ভঙ্গি আরও সরল করে ফেলল সে। মুখখানা এমন নিষ্পাপ করল যেন এই মুখে কোনও কালেই পড়েনি পাপের ছায়া।

ছনুবুড়ি বলল, ওই দ্যাহো, কথাডা আপনেরে তো কইয়া হালাইলাম। এইডা মনে অয় ঠিক অইলো না। কূটনামি বহুত খারাপ জিনিস।

রাজা মিয়ার মা গম্ভীর গলায় বললেন, কী কবি তাড়াতাড়ি ক ছনু। কূটনামি তর করন লাগবো না। আসল কথা ক।

হ আসল কথাঐ কমু। আপনে আমার থিকা অনেক ছোড তাও আপনেরে আমি বুজান কই। আপনে আমারে কন তুই কইরা। এতে ভাল লাগে আমার। আমি আপনেরে বহুত মাইন্য করি। আপনেরে যহন বুজান কইরা ডাক দেই মনে অয় আপনে আমার বড় বইন। আমি আপনের ছোডঃ।

এবার ছনুবুড়িকে জোরে একটা ধমক দিলেন রাজা মিয়ার মা। এত আল্লাইন্দা প্যাচাইল পারিছ না। আসল কথা ক।

এই ধমক একদমই কাবু করতে পারল না ছনুবুড়িকে। সে যা চাইছে কাজ সেই মতোই হচ্ছে। রাজা মিয়ার মা যত বেশি রাগবেন তার তত লাভ। কথা শেষ করে ভাতের কথাটা তুললেই হবে।

ছনুবুড়ি উদাসীনতার ভান করল। দউবরারে চিনলেন না? দবির গাছি। গাছ ঝুড়ে। পাড়া বেরাইন্না একখান মাইয়া আছে, নূরজাহান। খালি এই বাইত্তে যায় ঐ বাইত্তে যায়। ডাঙ্গর মাইয়া, বিয়া দিলে বচ্ছরও ঘোরব না, আহুজ পড়বো। নূরজাহানরে অহন খালি বড় সড়কে দেহি। মাইট্টাইলগো কনটেকদার আছে আলী আমজত, খালি হেই বেডার লগে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। কোনদিন হোনবেন পেটপোট বাজাইয়া হালাইছে।

এবার গলা আরেকটু চড়ালেন রাজা মিয়ার মা। তর এই বেশি প্যাচাইল পাড়নের সবাবটা গেল না ছনু। এক কথা যে কত রকমভাবে ঘুরাইয়া প্যাচাইয়া কচ। দউবরা কী করছে, কীয়ের দোষ তাড়াতাড়ি ক আমারে।

আপনে তো বাইত্তে আইছেন পশশু দিন, দউবরা আপনের লগে দেহা করে নাই?

না।

কন কী?

আমি কি তর লগে মিছাকথা কইনি।

ছি ছি ছি ছি ছি আপনে মিছাকথা কইবেন ক্যা বুজান? আপনে কোনওদিন মিছা কথা কইছেন? তয় দউবরা আপনের লগে দেহা করলো না? এতবড় সাহস অর?

আরে কী করছে দউবরা?

কাইল বিয়ালে অবে দেখলাম আপনেগো ছাড়াবাইত্তে।

কচ কী! কী করে?

এ ছনুবুড়ি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, আর কী করবো! অর যা কাম।

খাজুরগাছ ঝোড়ে?

হ।

আমার ছাড়াবাড়ির খাজুরগাছ?

হ।

আমার লগে দেহা না কইরা, আমার লগে কথা না কইয়া তো দউবরা কোনওদিন এমুন কাম করে না! জীবন ভইরা ও আমার গাছ ঝোড়ে! আমি বাইত্তে না থাকলে বুজানের লগে কথা কইয়া যায়। দউবরা তো ইবার আহে নাই! আইলে বুজানে আমারে কইতো!

না আহে নাই। দউবরা নিজ মুখে আমারে কইছে।

কী কইলো?

কইলো যেই কয়দিন পারি বুজানগো ইবার জানামু না। জানাইলেঐ অরদেক রস দেওন লাগবো। পয়লা কয়দিন রসের দাম যায় খুব। কয়ডা আলগা পয়সা কামাইয়া লই। তারবাদে জানামু।

রাজা মিয়ার মা আকাশের দিকে তাকালেন। শেষ হেমন্তের আকাশ প্রতিদিনকার মতো নতুন। দুপুরের মুখে মুখে দেশগ্রামের মাথার উপর রোদে ভেসে যাচ্ছে আকাশ। গাছগাছালির বন কাপিয়ে হাওয়া বইছে। রাজা মিয়ার মা সেই হাওয়া আঁচ করলেন। হাওয়ায় মৃদু শীতভাব। এসময় রস পড়বার কথা না। গাছেরা রসবতী হয়েছে ঠিকই তবে রস পড়বে আরও সাত আটদিন পর।

ছনুবুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত গলায় রাজা মিয়ার মা বললেন, অহনতরি রস পড়নের কথা না। শীত পড়ে নাই, রস পড়বো কেমতে?

লগে লগে পরনের মাইট্টা (মেটে) রঙের ছেঁড়া কাপড় গায়ে জড়াবার চেষ্টা করল ছুনবুড়ি। কন কি শীত পড়ে নাই? শীতে বলে আমি মইরা যাই! আপনে মোডা মানুষ, বড়লোক, শইল্লের গরম আর টেকার গরম মিল্লা শীত আপনে উদিস পাইবেন কেমতে? হোনেন বুজান, আপনের ছাড়া বাড়ির বেবাকটি খাজুরগাছ কাইল হারাদিন ধইরা ঝোড়ছে দউবরা। আইজ বিয়ানে দউবরারে আমি দেকলাম রসের ভার কান্দে লইয়া হালদার বাইত মিহি যায়। রস কইলাম পড়তাছে। দউবরা কইলাম আপনের বাড়ির রস বেইচ্চা আলগা পয়সা কামাইতাছে।

শীত পড়ল কী পড়ল না, রস সত্য সত্যই পড়ল কী পড়ল না এবার আর ওসব ভাবলেন না রাজা মিয়ার মা। বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠলেন। এতবড় সাহস গোলামের পোর! আমারে না জিগাইয়া আমার গাছ ঝোড়ে! ঐ কুট্টি, আলফুরে ডাক দে। ক যেহেন থিকা পারে দউবরারে বিচরাইয়া লইয়াইতে।

বড়বুজানের কাজ সেরে অনেকক্ষণ হল রান্নাঘরে এসে ঢুকেছে কুট্টি। ভাত চড়িয়ে মাগুর মাছ কুটেছে। মাগুর মাছ না ঘষে খান সা বুজানে। এখন সেই মাছ ধারাল থানইটের ওপর ফেলে অতিযত্নে ঘষছে কুট্টি। ঘষে ঘষে খয়েরি রঙ সাদা করে ফেলছে। এই ফাঁকে বুজান এবং ছনুবুড়ির সব কথাই শুনেছে। শুনে ছনুবুড়ির ওপর বেদম রাগ হয়েছে। পরিষ্কার বুঝেছে দবির গাছির নামে মিছাকথা বলছে ছনুবুড়ি। নিশ্চয় কোনও মতলব আছে।

তবু বুজান যখন বলেছেন আলফুকে না ডেকে উপায় নাই।

কোটা মাছ মালশায় রাখল কুট্টি। ভারী একখানা সরা দিয়ে ঢাকল। তারপরই বিলাইটার (বিড়াল) কথা মনে হল। চারদিন হল বিয়াইছে (বাচ্চা দিয়েছে)। ফুটফুটা পাঁচটা বাচ্চা। দোতালার এককোণে ফেলে রাখা ভাঙা চাঙারিতে গিয়ে বসেছিল বাচ্চা দিতে, সেখান থেকে আর নামেনি। মেন্দাবাড়ির হোলাটার (হুলো) হাত থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করার জন্য তাদের ছেড়ে নড়ছে না। পাহারা দিচ্ছে। পাহারা দিতে দিতে না খেয়ে কাহিল হয়ে গেছে। বিলাইদের নিয়ম নীতি আজব। হোলা বিলাইরা নাকি এই রকম। কচিছানা খেয়ে ফেলে। মা বিলাইরা এজন্য ছানা পাহারা দেয়।

বাচ্চা দেওয়ার আগে হোলাটা দিনরাত এই বাড়িতে পড়ে থাকত। দুইটাতে কী ভাব তখন! সময় অসময় নাই রঙ ঢঙ করে। এখন সেই কর্মের ফসল একজনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য না খেয়ে মরে যাচ্ছে আরেকজন। দুনিয়াতে মা জীবদেরই কষ্ট বেশি। পুরুষদের কষ্ট নাই।

এসব ভেবে ফেলে আসা সংসারের কথা মনে হল কুট্টির। স্বামী পুরুষটার কথা মনে হল। তারপরই চমকাল কুট্টি। হোলাটা চারদিন ধরে প্রায়ই আসছে এই বাড়িতে।

নিজের ঔরসজাতদের সামনে ভিড়তে পারছে না মা বিলাইয়ের ভয়ে। এখন বাড়িতে ঢুকে যদি মাছের গন্ধ পায়, যদি রান্নাঘরে কাউকে না দেখে তাহলে মাছ কোথায় আছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে। যে সরা দিয়ে মাছ ঢেকেছে কুট্টি ওই সরা থাবার ধাক্কায় ফেলে দিতে সময় লাগবে না তার। যদি মাছ সব হোলায় খেয়ে ফেলে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

সরার ওপর একটা থানইট চাপা দিল কুট্টি : সেই ফাঁকে শুনতে পেল জামরুল তলায় বসে মতলবের কথাটা বলছে ছনুবুড়ি। বুজান, এতদিন পর দেশে আইছেন আপনে, আপনেরে আমি বহুত মাইন্য করি, আইজ আপনে আমারে এক ওক্ত খাওয়ান। আপনেরা ধনী মানুষ, আমারে এক ওক্ত খাওয়াইলে আপনেগো ভাত কমবো না! আল্লায় দিলে আরও বাড়বে। খাইয়াইবেন বুজান?

.

পশ্চিম উত্তরের ভিটার পাটাতন ঘর দুইটার মাঝখান দিয়ে পথ। সেই পথে খানিক দূর আগালে দুই তিনটা বাঁশঝাড়, তিন চারটা আম আর একটা কদমগাছ। সারাদিন আবছা মতন অন্ধকার জায়গাটা। পাটাতন ঘরের চালা আর গাছপালার মাথা ডিঙিয়ে রোদ এসে কখনও এখানকার মাটিতে পড়তে পারে না। যদিও বা পড়ে দুই এক টুকরা, বাঁশঝাড় তলায় জমে থাকা শুকনা বাঁশপাতার উপর রোদের টুকরাগুলিকে দেখা যায় মাটির নতুন হাঁড়ির ভাঙা চারার মতো। রাজা মিয়ার মা যেদিন বাড়িতে এলেন সেদিন থেকে এদিকটায় কাজ করছে আলফু।

বাঁশঝাড় ছাড়িয়ে দূরে, বাড়ির নামার দিকে পায়খানা ঘর। বিক্রমপুর অঞ্চলের বাড়িগুলি তৈরি হয় বাড়ির চারদিক থেকে মাটি তুলে উঁচু ভিটা তৈরি করে তার ওপর। এই ভিটার ওপর আবার ভিটা করে তৈরি হয় ঘর। যদি পাটাতন ঘর হয় তাহলে ভিটা করবার দরকার হয় না। বাড়ির যেদিকটা সবচাইতে দরকারি, বাড়ি থেকে বের হবার জন্য দরকার, সেদিকটাকে বলা হয় বারবাড়ি। বাড়ি তৈরির সময় বারবাড়ির দিক থেকে মাটি তোলার পরও বের হবার সময় খানিকটা নিচের দিকে নামতে হয়, ওঠার সময় ও উঠতে হয় কয়েক কদম। বর্ষাকালে চকমাঠ ভরে পানি যখন বাড়ির ভিটার সমান উঁচু হয়ে ওঠে তখন বাড়িগুলিকে দেখা যায় ছাড়া ছাড়া দ্বীপের মতন। এক বাড়ির লগে। আরেক বাড়ির যোগাযোগের উপায় ডিঙিনৌকা, কোষা নৌকা।

বনেদি বাড়িগুলির পায়খানা ঘর থাকে বাড়ির সবচাইতে কম দরকারি, জঙ্গলা মতন দিকটায়। ঘরদুয়ারের পিছনে, অনেকটা দূর এগিয়ে একেবারে নামার দিকে। গাছপালার আড়ালে এমনভাবে থাকবে ঘরখানা যেন দূর থেকে না দেখা যায়।

এই অঞ্চলের মানুষের রুচির পরীক্ষা হয় পায়খানা ঘর দেখে। মেয়ের বিয়ার সম্বন্ধ আসলে পাত্রপক্ষের কোনও না কোনও মুরব্বি কোনও না কোনও অছিলায় বাড়ির ওই ঘরখানা একবার ঘুরে আসবেন। ওই ঘর দেখে বাড়ির মানুষ আর মেয়ের রুচি বিচার করবেন। এইসব কারণে বড় গিরস্ত আর টাকা পয়সাআলা লোকের বাড়ির পায়খানা ঘরখানা হয় দেখবার মতন। ভাঙনের দিকে চারখানা শালকাঠের মোটা খাম (থাম) পুতে বাড়ির ভিটা বরাবর টংঘরের মতো করে তৈরি করা হবে ঘরখানা। কড়ুই কাঠ দিয়ে পাটাতন করা হবে। মাথার ওপর ঢেউটিনের দো কিংবা একচালা। চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। কখনও কখনও বেড়া চালা রং করা হয়। খামগুলি পোতবার আগে আলকাতরা, মাইট্টাতেলের (মেটেতেল) পোচ দেওয়া হয়। তাতে কাঠে সহজে ঘুণ ধরে না।

বাড়ির ভিটা থেকে পায়খানা ঘরে যাওয়ার জন্য থাকে লঞ্চ স্টিমারে চড়ার সিঁড়ির মতো সিঁড়ি। সিঁড়ির দুইপাশে, পুলের দুইপাশে যেমন থাকে রেলিং, তেমন রেলিং। বাড়ির বউঝিরা যেন পড়ে না যায়।

রাজা মিয়াদের বাড়ির পায়খানা ঘরখানা ঠিক এমন। বাঁশঝাড়তলা ছাড়িয়ে। এই জায়গাটা নিঝুম, ঝরাপাতায় ভর্তি। সারাদিন এই দিকটাতেই কাজ করছে আলফু। বাঁশঝাড় পরিষ্কার করছে, ঝরাপাতা ঝাড়ু দিয়ে এক জায়গায় ভুর দিচ্ছে। আগাছা ওপড়াচ্ছে। সাপখোপের বেদম ভয় রাজা মিয়ার মার। তার পায়খানায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার না থাকলে মুশকিল। আলফু সেই পথ পরিষ্কার রাখছে।

কুট্টি এসব জানে। জানে বলেই সোজা এদিকটায় এল। এসে একটু অবাকই হল। আলফু নাই। পরিষ্কার বাঁশঝাড়তলা নিঝুম হয়ে আছে। থেকে থেকে উত্তরের হাওয়া বইছে। সেই হাওয়ায় শন শন করছে বাঁশপাতা।

আলফু গেল কোথায়!

পশ্চিমের ঘরটার পিছন দিয়ে একটুখানি পথ আছে দক্ষিণ দিককার পুকুর ঘাটে যাওয়ার। সেই পথের মাঝ বরাবর পুরানা একটা চালতাগাছ। কুট্টি আনমনা ভঙ্গিতে সেই পথে পা বাড়াল। একটুখানি এগিয়েই আলফুকে দেখতে পেল উদাস হয়ে চালতাতলায় বসে আছে। হাতে বিড়ি জ্বলছে কিন্তু বিড়িতে টান দিচ্ছে না।

কুট্টি অবাক হল। রাজা মিয়ার মা আছেন বাড়িতে তারপরও কাজে ফাঁকি দিয়ে চালতাতলায় বসে আছে আলফু! এতবড় সাহস হল কী করে!

দূর থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলফুকে দেখতে লাগল কুট্টি।

জোঁকের মতো তেলতেলা শরীর আলফুর। মাথার ঘন চুল খাড়া খাড়া, কদমছাট দেওয়া। পিছন থেকে দেখছে বলে আলফুর মুখ কুট্টি দেখতে পাচ্ছে না। পিঠ দেখছে, ঘাড় দেখছে আর দেখছে মাজা। পরনে সবুজ রঙের লুঙ্গি। মাজার কাছে গামছা বাঁধা। গামছাটা এক সময় লাল ছিল, দিনে দিনে রঙ মুছে কালচে হয়ে গেছে।

চালতাপাতার ফাঁক দিয়ে আলফুর তেলতেলা পিঠে, ঘাড়ের কাছাকাছি এসে পড়েছে একটুকরা রোদ। সেই রোদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই শরীরের ভিতর অদ্ভুত এক উষ্ণতা টের পেল কুট্টি। অদ্ভুত এক উত্তেজনায় ভরে গেল তার শরীর। মুহূর্তের জন্য মনে পড়ল ফেলে আসা স্বামী মানুষটার কথা। রাত, অন্ধকার ঘর, পুরুষ শরীর, শ্বাস প্রশ্বাসের গন্ধ, ভিতরে ভিতরে দিশাহারা হয়ে গেল কুট্টি। ভুলে গেল সে কেন এখানে আসছে, কী কাজে!

মানুষের পিছনে যত নিঃশব্দেই এসে দাঁড়াক মানুষ, কোনও না কোনও সময় নিজের অজান্তেই মানুষ তা টের পায়। বুঝি আলফুও টের পেল। বিড়িতে টান দিয়ে আনমনা ভঙ্গিতেই পিছনে তাকাল সে। তাকিয়ে কুট্টিকে দেখে অবাক হয়ে গেল। কুট্টির দিকে তাকিয়ে রইল।

কুট্টির তখন এমন অবস্থা কিছুতেই আলফুর মুখের দিকে তাকাতে পারছে না। চোখ মুখ নত হয়ে গেছে গভীর লজ্জায়। এক পায়ে আঁকড়ে ধরেছে আরেক পায়ের আঙুল।

ধীর গম্ভীর গলায় আলফু বলল, কী?

লগে লগে স্বাভাবিক হয়ে গেল কুট্টি। নিজেকে সামলাল। আলফুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বুজানে কইলো দবির গাছিরে ডাইক্কা আনতে। মনে অয় হালদার বাইত্তে গেছে গাছ ঝোড়তে। যান তাড়াতাড়ি যান।

বিড়িতে শেষটান দিল আলফু তারপর উঠে দাঁড়াল। আর একবারও কুট্টির মুখের দিকে তাকাল না, একটাও কথা বলল না, বারবাড়ির দিকে চলে গেল।

তারপরও চালতাতলায় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কুট্টি।

.

দোতলা ঘরের সামনের দিককার বারান্দায় খেতে বসেছে ছনুবুড়ি। টিনের খাউব্বা (গামলা মতন) থালায় ভাত তরকারি নুন সব এক সঙ্গে দিয়েছে কুট্টি। টিনের মগের একমগ পানি দিয়েছে। তারপর নিজে চলে গেছে মাঝের কামরায়।

মাঝের কামরার একপাশে কালো রঙের কারুকাজ করা উঁচু পালঙ্ক। দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে সেই পালঙ্কে কাত হয়েছেন রাজা মিয়ার মা। কুট্টি তার পা টিপে দিচ্ছে। রাজা মিয়ার মা যতক্ষণ চোখ না বুজবেন, মুখ হাঁ করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ঙো ঙো করে শব্দ করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত ছুষ্টি নাই কুট্টির। চোখ বুজে মুখ হাঁ করে ওরকম শব্দ করার মানে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। বুজান ঘুমালে তবে খেতে যাবে কুট্টি। দুপুর বয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধায় পেট পুড়ে যাচ্ছে তার।

বুজানের পা টিপছে আর ভোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে ছনুবুড়ির খাওয়া দেখছে কুট্টি। কুঁজা হয়ে বসে ফোকলা মুখে হামহাম করে খাচ্ছে। একটার পর একটা লোকমা (নলা) দিচ্ছে মুখে। কোনওদিকে তাকাচ্ছে না।

এই বয়সেও এত খিদা থাকে মানুষের।

কুট্টির ইচ্ছা হল ছনুবুড়িকে জিজ্ঞাসা করে, ও বুজি আট্টু ভাত লইবানি? আট্টু ছালুন!

বুজানের ভয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় না। এখনও ঘুমাননি বুজান। তার পা টিপা ফেলে ছনুবুড়ির খাওয়ার তদারকি করছে কুট্টি এটা তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। পায়ের কাছে বসে থাকা কুট্টিকে লাথি মারবেন। ও রকম মোটা পায়ের একখানা লাথথি খেলে পাঁচদিন আর মাজা সোজা করে দাঁড়াতে হবে না কুট্টির।

তবে ছনুবুড়িকে একবারে যতটা ভাত দিয়েছে কুট্টি, তরকারি যতটা দিয়েছে তাতে পেট ভরেও কিছুটা ভাত থেকে যাওয়ার কথা। সেইট্টুকুও ফেলবে না বুড়ি। জোর করে খেয়ে নিবে।

তাহলে কুট্টির কেন ইচ্ছা হল ছনুবুড়িকে জিজ্ঞাসা করে, আটু ভাত লইবানি?

বোধহয় বুড়ির খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছে।

কিন্তু বুজান আজ ঘুমাচ্ছেন না কেন? মুখ হাঁ করে ঙো ঙো শব্দ করছেন না কেন? খিদায় তো পেট পুড়ে যাচ্ছে কুট্টির!

শরীরের সব শক্তি দিয়ে জোরে জোরে বুজানের পা টিপতে লাগল কুট্টি।

ঠিক তখনই দক্ষিণের বারান্দার দিকে কার গলা শোনা গেল। বুজান বলে বাইত্তে আইছেন? বুজান ও বুজান।

এই ডাকে মাত্র বুজে আসা চোখ চমকে খুললেন রাজা মিয়ার মা। মাথা তুলে বারান্দার দিকে তাকালেন। ক্যাডা?

আমি দবির, দবির গাছি।

হাছড় পাছড় করে বিছানায় উঠে বসলেন রাজা মিয়ার মা। দউবরা, খাড়ো।

তারপর কুট্টির কাঁধে ভর দিয়ে পালঙ্ক থেকে নামলেন। কুট্টির একটা হাত ধরে দক্ষিণের বারান্দার দিকে আগালেন। সেই ফাঁকে খেতে বসা ছনুবুড়ির দিকে একবার তাকাল কুট্টি। বুড়ির খাওয়ার গতি এখন আরও বেড়েছে। একটার পর একটা লোকমা যেন নাক মুখ দিয়ে খুঁজছে সে। কুট্টি বুঝে গেল দবির গাছির গলা শুনেই খবর হয়ে গেছে বুড়ির। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভাত শেষ করে পালাবে। কূটনামি ধরা পড়ার আগেই চোখের আঐলে (আড়ালে) চলে যাবে।

দুইমুঠ ভাতের জন্য যে কেন এমন করে মানুষ!

দক্ষিণের বারান্দায় এসে রেলিং ধরে দাঁড়ালেন রাজা মিয়ার মা। কীরে গোলামের পো, এতবড় সাহস তর অইল কেমতে?

রাজা মিয়ার মাকে দেখে মুখটা হাসি হাসি হয়েছিল দবিরের। এখন তার কথায় সেই মুখ চুন হয়ে গেল। কিয়ের সাহস বুজান?

জানচ না কিয়ের সাহস?

সত্যঐ জানি না বুজান। খোলসা কইরা কন।

আমারে না জিগাইয়া আমার বাড়ির গাছ ঝোড়ছস ক্যা? আমার বাড়ির রস আইজ থিকা বেচতে বাইর অইছস!

বুজানের কথা শুনে দবির আকাশ থেকে পড়ল। আপনে এই হগল কী কইতাছেন বুজান! আপনেরে না কইয়া আপনের বাড়ির গাছ ঝুড়ুম আমি! আপনে বাইত্তে না থাকলে বড়বুজানরে কমু না? আর রস বেচুম কেমতে? রস তো অহনতরি পড়েঐ নাই! পড়বো কেমতে, শীত পড়ছেনি? এই হগল কথা আপনেরে কেডা কইলো?

দবিরের কথায় থতমত খেলেন রাজা মিয়ার মা। তবু গলার জোর কমল না তার। আগের মতোই জোর গলায় বললেন, যেই কউক, কথা সত্য কী না ক?

দবির বুঝে গেল এটা ছনুবুড়ির কাজ। কাল বিকালে মিয়াদের ছাড়া বাড়ির খাজুরতলায় তাকে বসে থাকতে দেখেছে বুড়ি।

দবির বলল, আমি কইলাম বুজছি কথাডা আপনেরে কেডা কইছে। তয় আমার কথা আপনে হোনেন বুজান, দশবারো বছর ধইরা আপনের বাড়ির গাছ ঝুড়ি আমি, কোনওদিন আপনের লগে কথা না কইয়া আপনের গাছে উডি নাই। আপনে বাইত্তে না থাকলে বড়বুজানরে কইয়া যাই। কাইল থিকা উততইরা বাতাসটা ছাড়ছে। লগে লগে ছ্যান লইয়া, ভার লইয়া বাইত থিকা বাইর অইছি আমি। আপনের ছাড়া বাড়ির খাজুরতলায় আইছি। আটখান হাড়ি রাখছি খাজুরতলায়। রাইক্কা বাইত্তে গেছি গা। আইজ বিয়ানে উইট্টা গেছি হালদার বাড়ি। হেই বাইত্তে আছে চাইরখান গাছ। চাইরখান হাড়ি রাইক্কাইছি গাছতলায়। মরনি বুজির লগে বন্দবস্ত কইরাইছি। তারবাদে আইলাম আপনের কাছে। আপনের লগে কথা কইয়া বাইতে গিয়া ভাত খামু তারবাদে যামু আমিনদ্দি সারেঙের বাড়ি। উত্তর মেদিনমন্ডল, দক্ষিণ মেদিনমন্ডল, মাওয়া কালিরখিল এই কয়ড়া জাগার যেই কয়ডা বাড়ির গাছ ঝুড়তে পারি ঝুড়ুম। যাগো লগে বন্দবস্ত অইবো তাগো গাছতলায় হাড়ি রাইক্কামু, যাতে গাছতলায় হাড়ি দেইক্কা অন্য গাছিরা ঐ মিহি আর না যায়। আপনের ছাড়া বাইত্তে হাড়ি রাইক্কা গেছি আমি, গাছে অহনতরি উডি নাই, ছানের একখান পোচও দেই নাই। আইজ আপনের লগে কথা কইয়া কাইল থিকা ঝুড়ুম। যুদি আমার কথা বিশ্বাস না অয় আলফুরে পাডান ছাড়া বাইত্তে গিয়া দেইক্কাহুক। যুদি আমি মিছাকথা কইয়া থাকি তাইলে আপনের জুতা আমার গাল।

রাজা মিয়ার মা কথা বলবার আগেই কুট্টি বলল, আলফুর লগে আপনের দেহা অয় নাই?

দবির অবাক গলায় বলল, না।

বুজানে তো আলফুরে পাডাইছে আপনেরে ডাইক্কানতে!

আলফুর লগে আমার দেহা অয় নাই।

রাজা মিয়ার মা বললেন, তাইলে তুই আইলি কেমতে?

আমি তো নিজ থিকাই আইছি আপনের লগে বন্দবস্ত করতে! বুজান, আলফু যহন বাইত নাই তয় কুট্টিরে পাডান। এক দৌড় দিয়া দেইক্কাহুক আমি মিছাকথা কইছি কিনা!

রাজা মিয়ার মা মাথা দুলিয়ে বললেন, না তুই মিছাকথা কচ নাই। যা বোজনের আমি বুঝছি।

কুট্টির দিকে তাকালেন তিনি। ঐ কুট্টি দেকতো কূটনি মাগি আছেনি না ভাত খাইয়া গেছে গা?

কুট্টি গলা বাড়িয়ে সামনের দিককার বারান্দার দিকে তাকাল। তাকিয়ে দেখতে পেল ভয় পাওয়া শিশুর মতো টলোমলো পায়ে যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি ভেঙে উঠানে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করছে ছনুবুড়ি। বারান্দায় পড়ে আছে তার শূন্য থালা। সেখানে ঘুর ঘুর করছে হোলাটা।

পালিয়ে যাওয়া ছনুবুড়ির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক মায়ায় মন ভরে গেল কুট্টির। দুইমুঠ ভাতের জন্য এক মানুষের নামে আরেক মানুষের কাছে মিথ্যা কথা বলে বেড়াচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, গালাগাল খাচ্ছে। হায়রে পোড়া পেট, হায়রে পেটের খিদা!

ছুনুবুড়িকে বাঁচাবার জন্য ছনুবুড়ির মতো করে ঠাইট না ঠাইট (জলজ্যান্ত) একটা মিথ্যা বলল কুট্টি। না, ছনুবুড়ি নাই বুজান। খাইয়া দাইয়া গেছে গা।

তবু ছনুবুড়িকে বাঁচাতে পারল না কুট্টি। নিজের বাজখাঁই গলা দশগুণ চড়িয়ে গালিগালাজ শুরু করলেন রাজা মিয়ার মা। ঐ রাড়ি মাগি, ঐ কৃটনির বাচ্চা, এমনু ভাত তর গলা দিয়া নামলো কেমতে? গলায় ভাত আইটকা তুই মরলি না ক্যা? আয় গলায় পাড়াদা তর ভাত বাইর করি।

কুঁজা শরীর যতটা সম্ভব সোজা করে, দ্রুত পা চালিয়ে মিয়াবাড়ি থেকে নেমে যেতে যেতে বুজানের গালিগালাজ পরিষ্কার শুনতে পেল ছনুবুড়ি। ওসব একটুও গায়ে লাগল না তার। একটুও মন খারাপ হল না। এইসবে কী ক্ষতি হবে ছনুবুড়ির! ভাতটা তো ভরপেট খেয়ে নিয়েছে! পেট ভরা থাকলে গালিগালাজ গায়ে লাগে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *