মেয়েটির কোনও অপরাধ ছিল না

মেয়েটির কোনও অপরাধ ছিল না
ইমদাদুল হক মিলন

বহুকালের পুরনো যে কড়ুইগাছটি নদীতীর অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথার ওপরকার আকাশ একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে। গাছের ঘন ডালপালা এবং ঝিরঝিরে পাতায় জমে আছে গাঢ় অন্ধকার, সেই অন্ধকারের ছায়া পড়েছে তলায়। ফলে গাছতলায় যে একজন মানুষ বসে আছে তার মুখটি স্পষ্ট দেখা যায় না। সাদা শার্ট পরে আছে বলে অন্ধকার গাছতলায় অস্পষ্টভাবে ফুটে আছে সে। অস্থির ভঙ্গিতে বিড়ি টানছে বলে টানে টানে বিড়ির আগুন জোনাকির মতো জ্বলছে।

খানিক আগে ফজরের আজান হচ্ছিল। সেই পবিত্র শব্দে ঘুমক্লান্তিতে নিঝুম হয়ে থাকা চারপাশের গ্রাম আড়মোড়া ভেঙেছে। ধর্মপ্রাণ নামাজি মানুষ বিছানা ছেড়েছে। গৃহস্থ বাড়ির খোয়াড়ে বসে গলা ছেড়ে ডাকতে শুরু করেছে ডাকাবুকো মোরগগুলো। কাছে কোথাও, কোনও বাড়ির গোহাল থেকে ভেসে আসছে একটি গাইগরুর হাম্বা ডাক। থেকে থেকে এমন করে ডাকছে সে, বোধহয় পাল খাওয়ার সময় হয়েছে। গ্রাম জুড়ে নিবিড় হয়ে থাকা ঝোঁপঝাড় এবং গাছপালার ঝুঝকো অন্ধকার থেকে গলা বাড়িয়ে আকাশ এবং খোলা মাঠপ্রান্তর কিংবা শস্যের উদার মাঠের দিকে তাকাচ্ছিল সদ্য ঘুমভাঙা পাখি। কলকাকলিতে মুখর হচ্ছিল, আলোর আঁচে বুঝে নিচ্ছিল রাত পোহাবার কত দেরি! ভোরবেলাকার একলা দোয়েল অন্ধকারের তোয়াক্কা না করে লাফ দিয়ে নেমেছে গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়। গভীর আনন্দে বিভোর হয়ে ডাকছে, টুকটুক টুকটুক করে লাফাচ্ছে। ডাকে ডাকে লেজ পিঠে উঠছে দোয়েলের, লেজ নামছে।

 কড়ুই গাছটির গা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলে ছিল আশ্চর্য রকমের শান্ত সমাহিত ভাব। এই নদীর নাম রজতরেখা। বর্ষায় জলে টইটম্বুর নদী, বান বন্যায় অশান্ত, একাকার। গ্রীষ্মে যেন বা চিরল খাল, জলের টানে জল চলে যায় কোন সুদূরে।

নদীর এপারে মানুষের বসতি, কত গ্রাম! দক্ষিণে দিঘিরপার বেসনাল কামাড়খাড়া, উত্তরে বানীখাড়া পুরা। পশ্চিমে আছে গ্রাম নশঙ্কর। পুবে, নদীর ওপার জুড়ে দীর্ঘ চরাভূমি, ধু ধু মাঠপ্রান্তর। বহুদূরে গ্রামবালিকার ভুরুরেখার মতো গাছপালার আভাস, মানুষের ঘরবাড়ি। এপারকার রাখাল বালক নদী সাঁতরে গরুর পাল নিয়ে যায় ওপারে চরাতে। এপারকার সব পাখি খাদ্যের খোঁজে উড়ে যায় ওপারে, দিন শেষের আলো ভেঙে ফিরে আসে।

রজতরেখার জলতলা ভরে আছে হাজারো মাছে। চিংড়ি বেলে, পাবদা পুঁটি, চাপিলা টাটকিনি, কাজলি শিলং, ঘারুয়া খল্লা, বাচা রিঠা কত রকমের যে মাছ! মাছের লোভে দূর দূরান্তের বিল কিংবা নদীর চর থেকে উড়ে আসে ধলীবক, কানীবক। শীতকালে আসে দূরদেশের পাখি। সারস, বেলেহাঁস, চখা। তাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয় দেশগ্রামের পানকৌড়ি, কাদাখোঁচা। গৃহস্থের ছেড়ে যাওয়া বাড়ির ঝোঁপঝাড় কিংবা হিজলের ছায়া থেকে জলে এসে নামে ডাহুক ডাহুকী। পাখিদের সঙ্গে মানুষও নামে রজতরেখায়। মাছের লোভ পাখিদের চেয়ে মানুষেরও কম নয়। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নদীর দুপারে সাড়া পড়ে যায়। হাতজাল ঝাঁকিজাল টানাজাল, কত রকমের জাল যে নামে নদীর জলে! দুপুর অব্দি চলে জাল দিয়ে মাছ ধরা। দুপুরের পর ছোট ছোট ডিঙি নাওয়ে ভরে যায় নদীখানি। খাওয়াদাওয়া শেষ করে নৌকোয় বসে আয়েশি ভঙ্গিতে বড়শি ফেলে লোকে। টিমটিমে আলোর হারিকেন জ্বেলে সারারাত ধরেও বড়শি বায় কোনও কোনও গরিব জেলে! রাতভর বড়শি পেতে রাখে কেউ, চাই পেতে রাখে, ভোরবেলা এসে তোলে। নদীর ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে কত না মানুষ! এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই মাছ কিনে খায় না। এক ফাঁকে বাড়ির কেউ এসে নদীতে নামলেই হল, দিনের মাছটা হয়ে যায়।

কুসুমদের সংসারের মাছটা ধরে কুসুম। ভোরের আলো ফুটে উঠবার আগেই ছোট্ট হাতজাল নিয়ে নদীতে এসে নামে সে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যায়। ততক্ষণে হাতে ধরা মাটির হাঁড়ি মাছে প্রায় পরিপূর্ণ। দিনের মাছ জোগাড় হয়ে যায়। সেই কুসুম আজ এখনও কেন আসছে না? চারদিক তো ফর্সা হয়ে গেল! কভুইতলায় বসা মানুষটি অস্থির ভঙ্গিতে বিড়িতে শেষটান দিল, দিয়ে টোকা মেরে নদীর জলে ফেলে দিল। তারপর সড়কের ওপার, বেশ খানিকটা দূরে, গাছপালার আড়ালে ঢাকাপড়া কুসুমদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, আইজ তুমি এত দেরি করতাছ কেন কুসুম? আস, তাড়াতাড়ি আস।

কুসুম, ও কুসুম যাস না?

কুসুম বসে আছে রান্নাচালার সামনে। খানিক আগে বিছানা ছেড়েছে সে, ঘর থেকে বেরিয়ে এখানে এসে বসেছে। বসার ভঙ্গিতে আশ্চর্য এক উদাসীনতা ফুটে আছে মেয়েটির। হাত দুটো কোলের ওপর রেখে বড় ঘরের চালার দিকে তাকিয়ে আছে সে। বড় ঘরটির পেছনে দুটো জাম আর কয়েকটি সুপারি গাছ। একটা বাঁশঝাড় আছে খানিক দূরে। ঝাড় টপকে লম্বা মাথার একটি বাঁশ এসে হেলে পড়েছে জামগাছ দুটোর মাথা বরাবর। এই সব গাছপালায় এখন ভোরবেলার হাওয়া খেলা করছে। শন শন করে মনোমুগ্ধকর একখানা শব্দ হচ্ছে। হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছে। পাখপাখালির ডাক।

পুর্ব দিককার পাটাতন ঘরের মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়ছে খালেক মিস্ত্রি। আল্লাহু আকবার বলে এইমাত্র রুকুতে গেল সে। দুহাতে দুহাঁটু চেপে ধরে, মাথা পিঠ ও কোমর সমানভাবে রেখে দোয়া পড়ল। তারপর ছামিয়াল্লাহু লিমান হামিদা বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। এবার আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যাবে। ঠিক তখুনি স্বামীর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল মিস্ত্রিবউ। মেয়েকে তাড়া দিয়েই স্বামীর দিকে তাকিয়েছিল সে।

কিন্তু মেয়েটির আজ কী হয়েছে? এখনও যে বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে না! মায়ের কথার জবাবও তো দিল না!

মিস্ত্রিবউ তারপর কুসুমের সামনে এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে বলল, কী হইছে তোর?

ঘরের চালা থেকে চোখ ফিরিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাল কুসুম। আনমনা গলায় বলল, কিছু হয় নাই।

 তাইলে যে বইয়া রইছস!

কী করুম?

মিস্ত্রিবউ খুবই অবাক হল! কস কী? গাঙ্গে যাবি না?

আদুরে শিশুর মতো মুখ করে কুসুম বলল, আইজ গাঙ্গে যাইতে ইচ্ছা করতাছে না মা।

কেন?

এমনেই।

শইল খারাপ হইছেনি?

এ কথায় কুসুম বেশ লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে বলল, না।

তয়?

তয় আবার কী! কইলাম যে এমনেই!

এবার তীক্ষ্ণ চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল মিস্ত্রিবউ। তাকিয়ে চমকে উঠল। মিষ্টি মুখখানি মেয়েটির কেমন খসখসে হয়ে আছে। কালো, শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের কোল বেশ বসে গেছে, গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে। চোখের পাপড়িতে কীরকম একটা ঘুম ঘুম ভাব। এমন হয়েছে কেন? রাতের বেলা কি ঘুমোয়নি কুসুম! একরাত না ঘুমিয়েই কি এমন চেহারা হয়ে গেছে মেয়েটির! নাকি বেশ কয়েক রাত ধরেই ঘুম হচ্ছে না তার! উতলা গলায় মিস্ত্রিবউ তারপর বলল, রাইতে ঘুমাস নাই?

কুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না, ঘুম আসে নাই।

কেন?

কী জানি!

তোর চোখ মুখ দেইখা তো মনে হয় খালি আইজ রাইতেই না অনেক রাইত ধইরাই ঘুমাস না তুই।

হ তিন চাইর রাইত ধইরা ঘুম আসে না আমার। রাইতভর জাইগা থাকি।

আমারে কস নাই কেন?

কুসুম শুকনো মুখে হাসল। কইলে কী করতা? দোয়াদরুদ পইড়া ঘুম পাড়াইতা আমারে?

এ কথা শুনে মিস্ত্রিবউ একটু রাগল। গম্ভীর গলায় বলল, আল্লাখোদার নাম লইয়া ঠাট্টা করিস না।

কুসুম আবার উদাস হল, আনমনা হল। আল্লাখোদার নাম লইয়া ঠাট্টা আমি করি না মা। আল্লারে আমি বহুত ডরাই। ধর্মরে বহুত ডরাই। এর লেইগাই……।

কুসুমের কথা শেষ হওয়ার আগেই মিস্ত্রিবউ বলল, ডরানই ভালো। আল্লাখোদারে ডরাইলে মানুষে আর খারাপ কাম করতে পারে না। ধর্মরে ডরাইলে ভালো থাকে মানুষ। একটু থামল মিস্ত্রিবউ। তারপর বলল, তুই কোনও চিন্তাভাবনা করসনি?

কুসুম ম্লান হাসল। কী চিন্তা করুম?

এই বয়সের মাইয়াগো কতপদের চিন্তা থাকে! পুরুষমানুষের চিন্তা, বিয়াশাদির চিন্তা।

কথাটা শুনে ভেতরে ভেতরে বেশ চমকাল কুসুম। কিন্তু মাকে তা বুঝতে দিল না। চোখ পাকিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। রুক্ষ্ম গলায় বলল, আকথা কইয়ো না।

মিস্ত্রিবউ সঙ্গে সঙ্গে বলল, তয় ঘুম আসে না কেন তোর?

কুসুম উঠে দাঁড়াল। আমার ঘুম লইয়া তোমার আর চিন্তা করণ লাগব না। তুমি তোমার কাম কর গিয়া। আমি গেলাম।

রান্নাচালার একপাশে রাখা আছে ভেঁসালের মতো দেখতে একখানা হাতজাল। জালের পাশে রাখা সরু গলার মাটির একখানা হাঁড়ি। দ্রুত হাতে জালটা নিল কুসুম, হাঁড়িটা নিল। দেখে খুশি হয়ে গেল মিস্ত্রিবউ। মায়াবি গলায় বলল, মাছ ধইরা আসনের পর মাথায় নাইড়কল তেল দিয়া দিমুনে মা। নাইড়কল তেলে মাথা ঠাণ্ডা হয়। তেল দিয়া ভালো কইরা মাথা আঁচড়াইয়া দিলে বহুত আরাম লাগব। ঘুম হইব। বাড়িত আইসাই ঘুমাইয়া থাকিস তুই। আইজ আর কোনও কাম করণ লাগব না।

 কিন্তু মায়ের কথা তেমন পাত্তা দিল না কুসুম, মায়ের মুখের দিকে আর তাকালও না। তাকাল পাটাতন ঘরের দিকে। নামাজ শেষ করে কখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। খালেক মিস্ত্রি। মাথায় গোল সাদা টুপিটা এখনও আছে তার। বিড়বিড় করে দোয়াদরুদ পড়ছে আর খুবই মনোযোগ দিয়ে মিস্ত্রি কাজের যন্ত্রপাতি রাখার কাঠের বাক্সটা গোছাচ্ছে। অন্য কোনওদিকেই খেয়াল নেই তার।

এই দৃশ্য দেখে বেশ অবাক হল কুসুম। সে বেরুচ্ছে মাছ ধরতে, বেশ খানিকটা দেরি আজ হয়ে গেছে। তার ওপর মায়ের সঙ্গে হয়েছে ওসব কথা, সব ভুলে বলল, বাবায় আইজ কামে যাইতাছেনি? কোন বাড়ির কামে যায়?

 স্বামীকে যন্ত্রপাতির বাক্স গোছাতে দেখে মিস্ত্রিবউও কম অবাক হয়নি। কুসুমের কথা শুনে তার দিকে মুখ ফেরাল না সে। দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল, কী জানি! আমারে তো কিছু কয় নাই।

মা মেয়ে দুজনেই তারপর দ্রুত হেঁটে খালেক মিস্ত্রির সামনে এসে দাঁড়াল। কুসুম কথা বলবে তার আগেই হাসিমুখে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল খালেক মিস্ত্রি। কী গো মা অহনও যাও নাই?

কুসুম বলল, যাইতাছি।

তারপর একটু থেমে বলল, ও বাবা, কোন বাড়ির কামে যাও তুমি?

আমগ গেরামের কোনও বাড়িতে না মা। যামু নশঙ্কর। মণ্ডল বাড়িতে কাম আছে। মণ্ডল বাড়ির কথা শুনে বুকে কীরকম একটা ধাক্কা লাগল কুসুমের। মুখে উদাসীনতার ছায়া পড়ল। কেউ তা খেয়াল করল না।

মিস্ত্রি বলল, মণ্ডলগ তো বহুত বড় বাড়ি। আমগ এই বাড়ির চে অনেক বড়। আমগ বাড়িতে আমরা তিন শরিক মণ্ডল বাড়িতে পাঁচ শরিক। আমি যামু হরিপদর সীমানায়। বাপে পোলায় মাছের কারবার কইরা ভালো টেকার মালিক হইছে হরিপদ। দিঘিরপার বাজার থিকা শ্যালো নৌকায় কইরা মাছ চালান দেয় ঢাকার টাউনে। বাড়িতে দুইখান ঘর আছিল, বড় ঘরখান চৌচালা, চাইরদিকে ঢেউটিনের বেড়া। ছোট ঘরখানও চৌচালা তয় বেড়া টিনের না, মুলি বাঁশের। ওই বেড়া অহন বদলাইব। ঢেউটিনের বেড়া লাগাইব ঘরে। টিন কাঠ বেবাক আইন্না রাখছে। আইজ থিকা কাম করুম আমি। এই কাম শেষ হইলে আরেকখান বড় কাম আছে হরিপদর বাড়িতে। একমাত্র পোলা হইল পবন, পবনরে বিয়া করাইব। এর লেইগা একখান পাটাতন ঘর উঠাইব বাড়িতে। ওই ঘরটার কামও আমি করুম। এক দেড়টা মাস ভালোই কাম থাকব হাতে।

কথা শেষ করে বাক্সটা কাঁধে নিল মিস্ত্রি। তারপর কুসুমের দিকে তাকাল, তাকিয়ে অবাক হল। কোন ফাঁকে একেবারেই আনমনা হয়ে গেছে মেয়েটি। কী যেন ভাবছে।

মিস্ত্রি হাসিমুখে বলল, কী গো মা, কী চিন্তা কর?

কুসুম একটু চমকাল। তারপর বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল। কিছু না।

তয় লও বাইর হই।

কুসুম কথা বলবার আগেই মিস্ত্রিবউ বলল, মাইয়ার লগে বাইর হইয়া আপনের লাভ কী! মাইয়া যাইব একদিকে আপনে যাইবেন আরেক দিকে।

মিস্ত্রি আবার হাসল। তবুও বাপ মাইয়ায় এক লগে কামে বাইর হইলাম এইডা চিন্তা কইরা আমার বহুত ভালো লাগব। কুসুম যদি আমার মাইয়া না অইয়া পোলা হইত বহুত ভালো হইত!

কেন পোলা আপনের আছে না?

 যে আছে সে তো আমার পোলা না। জমিদারের পোলা। ঘুম থিকা ওঠে বেলা দশটায়। ও যদি পবনের মতোন কামের হইত তাইলে আমার সংসারের চেহারা ঘুইরা যাইত। বুড়াকালে মিস্ত্রিগিরি করণ লাগত না। হোন, মালেকরে আইজ বাজারে পাঠাইয়ো। দুই বোতল কীটনাশক যেন আইন্না রাখে। ইরি ক্ষেতে মাজরা পোকা হইছে। পানির লগে অষুদ মিশাইয়া পিচকারি দিয়া ক্ষেতে ছিটাইয়া দেওন লাগব। নইলে কিন্তু ধান বাচব না। মণ্ডল বাড়ির কাম আর ক্ষেতের ধান এই দুইডা এক কইরা এই বছরই কুসুমের বিয়া দিয়া দিমু।

 বিয়ের কথা শুনে হঠাৎ করেই ছটফট করে উঠল কুসুম। চঞ্চল গলায় বলল, আমি যাই বাবা। আমার দেরি হইয়া গেল।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল মিস্ত্রি। আর একটু খাড়াও মা। এক লগেই যাই।

 মিস্ত্রিবউ বিরক্ত হয়ে বলল, মাইয়াডারে আটকাইয়া রাখতাছেন কেন! ওর লগে আপনি কেমনে যাইবেন? নাস্তাপানি না খাইয়া বাড়িত থন বাইর হইবেননি! দোফইরার খাওন লইয়া যাইবেন না? হিন্দু বাড়িত কামে যাইবেন এই কথা তো আমারে আগে কন নাই! মিস্ত্রি অবাক গলায় বলল, কওনের কী আছে! কামের লগে হিন্দু বাড়ি মোসলমান বাড়ির সমন্ধ কী!

সমন্ধ আছে। হিন্দু বাড়িতে কি আপনে খাইতে পারবেন? গুড়মুড়ি লইয়া যান। আইজকার মতোন খাইয়া লইয়েন। কাইল থিকা আটারুটি বানাইয়া দিমুনে।

মুখের কাঁচাপাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে অমায়িক গলায় মিস্ত্রি বলল, এই সব লইয়া তুমি চিন্তা কইর না। গুড়মুড়ি মণ্ডল বাড়িত থিকাও দিব আমারে। আটারুটি না, দোফরে ভাতই খাওয়াইব। ধর্ম এত সস্তা জিনিস না যে হিন্দু বাড়িত ভাত খাইলে চইলা যাইব! তারপর মেয়ের দিকে তাকাল মিস্ত্রি। ল মা।

কুসুম কোনও কথা বলল না। বাবার পিছু পিছু দ্রুত হাঁটতে লাগল। বারবাড়ি তখনও ছাড়িয়ে যায়নি, পেছনে মিস্ত্রিবউর গলা শুনতে পেল দুজন মানুষ। চিৎকার করে ছোট মেয়েটিকে ডাকছে সে। পরী, ও পরী উঠছ না? বেলা হইয়া গেল তাও ঘুম ভাঙ্গে না মাইয়ার! ও পরী, ওঠ।

 হাঁটতে হাঁটতে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল মিস্ত্রি। হাসল। তোর মার কামডা দেখছচ মা! জুয়ান পোলাডা ঘুমাইয়া রইছে তারে ডাকে না, ডাকে ছোড মাইয়াডারে। কুসুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দুনিয়াতে মাইয়াগ কোনও দাম নাই।

.

পায়ে চলা পথটির পাশে বিষণ্ন একখানা মাঠ পড়ে আছে। মাঠের উত্তরে গ্রামের মসজিদ। এখনও পাকা হয়নি মসজিদ। টিনের বিশাল একখানা ঘরে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ আদায় করে মুসল্লিরা। ইমাম আছেন মাওলানা আবদুর রহিম।

মসজিদের লাগোয়া বাধান ঘাটলার সুন্দর একখানা পুকুর। পুকুরের তিনপার জুড়ে নানা রকমের আগাছার জঙ্গল। সেই জঙ্গল ফুটো করে আকাশে মাথা তুলেছে বেশ কয়েকটি হিজল মাদার আর একটি গাবগাছ। গাবগাছটির খোড়লে থাকত অতিকায় লম্বা শরীরের প্রাচীন এক কালজাত সাপ। কিছুকাল হল আবাস পাল্টেছে সে। দিনমান চারদিকের ঝোঁপ জঙ্গলে চড়ে, রাতেরবেলা এশার নামাজ সেরে মুসল্লিরা যখন বাড়ি ফিরে যায়, চারদিক যখন গভীর নির্জনতায় ডোবে, ঝিঁঝির ডাক আর গাছের পাতা ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ায় শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ যখন শোনা যায় না, লম্বা শরীর টেনে সাপটি তখন এসে ঢোকে মসজিদ ঘরে। ইমাম সাহেব যেখানে সেজদায় যান সেই জায়গাটির পাশে শুকনো শীতল মাটিতে শরীর গুটিয়ে পড়ে থাকে। ফজরের আজানের সময়, মানুষের সাড়া পেয়ে জায়গাটা সে ছেড়ে যায়। তবে আচমকা ঘুম ভাঙার ফলে মেজাজটা তখন খুবই তিরিক্ষি থাকে কালজাতের। চারপাশের সব মানুষকে দংশাতে ইচ্ছে করে।

পুকুরের এপারে, মাঠের কোণে আছে একটি বকুল গাছ। গাঢ় সবুজ পাতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে গাছটি। এই গাছতলায় গ্রামের বিচার সালিশ বসে। ইমাম সাহেব বিচার করেন। খুবই পরহেজগার লোক তিনি। গোড়ালি অব্দি লম্বা, সাদা ধপধপে পাঞ্জাবি পরে থাকেন। পাঞ্জাবির তলায় লুঙ্গি। তবে সেই লুঙ্গি বলতে গেলে দেখাই যায় না। পাঞ্জাবির আড়ালে চাপা পড়ে থাকে। পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল ইমাম সাহেবের, মাথায় সারাক্ষণই আছে সাদা গোলটুপি। টুপির চারপাশে জরির কাজ করা। ভাটার মতো চোখে তাঁর সুরমা দেয়া, গাবের ডালার মতো শক্ত হাতে তসবি। গাভীন গরুর পেটের মতো মোটা শরীর থেকে ভুরভুর করে বেরয় আতরের তীব্র গন্ধ। মুখের দাড়ি লম্বা হয়ে বুক ছুঁয়েছে। কাঁচা পাকায় মেশান দাড়ি মেহেদির রঙে রাঙানো।

এই মানুষের কথা অমান্য করে, কার সাধ্য! ইমাম সাহেবের বিচার দেশের আইন কানুনের তোয়াক্কা করে না। তিনি তাঁর মতো রায় ঘোষণা করেন, রায় কার্যকর করেন। প্রতি ওয়াক্তের আজান শেষ হওয়ার পর পরই চারপাশের বাড়িঘর থেকে নামাজি মানুষ বেরিয়ে মসজিদে এসে জড়ো হয়। ঘাটলায় বসে ওজু করে তারপর ইমাম সাহেবের পেছনে কাতার বেঁধে নামাজ পড়ে। মসজিদে মানুষের সাড়া পেয়ে বিরক্ত হয়ে গুটিয়ে রাখা শরীরের ভঁজ খোলে কালজাত। তারপর টিনের বেড়া এবং তলার মাটির ফাঁক দিয়ে শরীর গড়িয়ে বেরিয়ে যায়।

আজও গেছে, তবে বেশিদূর নয়। মসজিদের পেছনটা ঝোঁপঝাড়ে আকীর্ণ। দিনমান ছায়াময়, শীতল একখানা ভাব জায়গাটায়। সাপটি আজ এই জায়গায় চড়ছে। গতিটা ধীর মন্থর কিন্তু মেজাজটা তিরিক্ষি। অকারণেই ফণা তুলতে ইচ্ছে করছে। ওপরের পাটিতে ভাঁজ করে রাখা বিষদাঁত খুলে দংশাতে ইচ্ছে করছে কাউকে। বোধহয় এজন্যই থেকে থেকে মাথা তুলে চারপাশটা দেখছিল কালজাত।

ঠিক কালজাতের ভঙ্গিতে ইমাম সাহেবও আজ মাথা তুলছিলেন। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিলেন। খানিক আগে নামাজ শেষ করে যে যার বিষয় কর্মে ফিরে গেছে। কেবল ইমাম সাহেব যাননি, সামনের মাঠটায় পায়চারী করছেন। মেজাজটা কেন যে খারাপ হয়ে আছে তার! এ অবস্থায় কুসুম পড়ে গেল তার মুখোমুখি। এমনিতেই বেশ আনমনা ছিল মেয়েটি, তার ওপর চারদিকে পরিষ্কার আলো ফুটে উঠছে দেখে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল, ইমাম সাহেবকে সে খেয়াল করেনি। ফলে মাথায় ঘোমটা দেয়ার কথা মনে ছিল না। এই ব্যাপারটি মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল ইমাম সাহেবের। তসবি ধরা হাত বাড়িয়ে কুসুমের পথ রোধ করলেন তিনি। এই ছেমড়ি, খাড়া।

 থতমত খেয়ে দাঁড়াল কুসুম।

ইমাম সাহেব বললেন, তুই খালেক মিস্তিরির মাইয়া না?

 হ।

 মাথায় ঘোমটা নাই কেন?

কুসুম অপরাধীর গলায় বলল, ঘোমটা দিতে মনে আছিল না।

এবার ফণা তোলা কালজাতের মতো হিসহিস করে উঠলেন ইমাম সাহেব। বেশরম বেতমিজ মাইয়া, আবার মুখে মুখে কথা কয়! ঘোমটা দিতে মনে আছিল না! আগে না হয় মনে আছিল না, এতক্ষণ ধইরা যে আমার সামনে খাড়াইয়া রইছস ঘোমটা দিলি না কেন?

কুসুম একটা ঢোক গিলল। অসহায় গলায় বলল, কেমনে ঘোমটা দিমু! আমার একহাতে জাল আরেক হাতে হাঁড়ি।

কিন্তু একথায় বিন্দুমাত্র নরম হলেন না ইমাম সাহেব। বরং আরও রাগলেন। দাঁত কটমটিয়ে বললেন, কস কী! আরে কস কী তুই! জালহাঁড়ি ফালাইয়া দে। আগে পরদা তারপর অন্য কাম।

এবার কুসুম একটু রাগল। মুখ গোঁজ করে গম্ভীর গলায় বলল, আমগ মতোন মানুষের পরদা চলে না। পেটে ভাত না থাকলে পরদা দিয়া কী হইব! জালহাঁড়ি ফালামু কেন! আমি মাছ ধইরা না আনলে বাড়ির মানুষে খাইব কী! আগে খাওন তারপর পরদা।

 ইমাম সাহেব কল্পনাও করেননি মেয়েটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা বলবে। তিনি একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন। হা করে কুসুমের মুখের দিকে খানিক তাকিয়ে রইলেন, তারপর আগের মতোই দাঁত কটমটিয়ে বললেন, আমার সামনে খাড়াইয়া এইভাবে কথা! তোরে তো আমি কোতল কইরা ফালামু। একে বেপরদা তার উপর বড় বড় কথা। তোরে তো আল্লায়ও আমার হাত থিকা বাঁচাইতে পারব না।

কুসুম নির্বিকার গলায় বলল, আল্লায় যদি না বাঁচায় তাইলে আর বাঁচুম কেমনে! আল্লায় না বাঁচাইলে মানুষ কি বাঁচে?

বলে আর দাঁড়াল না। দ্রুত নদীর দিকে হাঁটতে লাগল। ইমাম সাহেব তখনও তাকিয়ে আছেন কুসুমের দিকে। বিশাল ক্রোধে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।

.

নদীর জলে মাত্র পা ছোঁয়াবে কুসুম, কড়ইতলার মানুষটি তার পেছনে এসে দাঁড়াল। এত দেরি করলা কেন? আমি সেই কখন থিকা বইসা আছি!

গলায় অভিমান এবং অপেক্ষার কষ্ট ছিল মানুষটির। শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল কুসুমের। মানুষটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল সে। মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকাল, তারপরই চোখ নামিয়ে নিল। মাছ রাখার হাঁড়িটা আছে পায়ের কাছে, দুহাতে বাগিয়ে ধরেছিল জাল, আলতো করে সেই জাল বুকের কাছে দাঁড় করাল কুসুম। তিনটি সরু বাঁশ ত্রিভুজের মতো করে, বাঁশের তিনকোণে বেঁধে দেয়া হয়েছে জাল। জালের যে মাথা দুহাতে ধরে জলের তলা দিয়ে ঠেলে নিতে হয় সেই মাথার বাঁশ দুটো। সামান্য বাড়িয়ে রাখা। বুকের কাছে দাঁড় করাবার ফলে জালের এই মাথাটি এখন কুসুমের মুখ ছাড়িয়ে অনেক দূর উঠেছে। হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় জালের ফাঁদে আটকা পড়েছে কুসুম। সে নিজেই যেন রজতরেখার একখানা অসহায় মাছ। হাতজালে তাকে বন্দি করেছে কোনও চতুর জেলে।

কিন্তু এসবের কোনও কিছুই খেয়াল করল না মানুষটি। বলল, আমি যখন কডুইতলায় আসলাম তার অনেকক্ষণ পর মোরগে বাগ দিল, আজান হইল। আসমানে চান্দ আছিল। চান্দের আলোয় নশঙ্কর থিকা হাঁইটা আসছি।

কুসুম নরম গলায় বলল, কেন আসছেন?

মানুষটি দুঃখী গলায় বলল, জান না কেন আসছি! তোমার লগে দেখা না কইরা কামে যাইতে পারি না আমি। আইজ মাছের চালানের লগে নিজেরও ঢাকা যাওনের কথা আমার। শ্যালো নৌকায় বরফ দেওয়া মাছ ভইরা বইসা রইছে মাঝিরা। আমি না গেলে নৌকা ছাড়ব না। আমার অনেক দেরি হইয়া গেল।

কুসুম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেন যে আপনে এমুন করতাছেন!

 এমুন আমি করতে চাই না। সত্যই করতে চাই না। চাই তোমারে ভুইলা যাইতে, ভুইলা থাকতে পারি না। আমার শুইয়া শান্তি নাই, বইসা শান্তি নাই, খাইয়া শান্তি নাই, কামে শান্তি নাই। সব সময় আমার খালি তোমার কথা মনে হয়। তোমার মুখখান খালি আমার চোখের সামনে দেখি। ঘুমাইলে স্বপ্ন দেখি তোমারে, জাইগা থাকলেও স্বপ্নের মতোনই দেখি তোমারে। কোনটা স্বপ্ন কোনটা সত্য বুঝতে পারি না। ঘুমে থাকি না। সজাগ থাকি বুঝতে পারি না। রাইত কাটে ছটফট ছটফট কইরা। খালি মনে হয় কখন সকাল হইব, কখন কড়ইতলায় যামু, কখন তোমার মুখখান একটু দেখুম! তোমার মুখ না দেইখা আমার শান্তি নাই। কুসুম মনে মনে বলল, আমারও তো এমুনই হয়। আমিও তো এক ফোঁটা ঘুমাইতে পারি না রাইতে। খালি মনে হয় সকাল হয় না কেন, গাঙ্গের পারে যাই না কেন আমি! আমারও তো আপনের মুখখান খালি দেখতে ইচ্ছা করে। আপনের কথা ভাইবা দেখেন আমার মুখখান কেমুন শুকাইয়া গেছে! চোখ দুইখান দেখেন কেমুন বইসা গেছে। চোখের কোলে এমুন কইরা কালি পড়ছে যেন চোখে কাজল দিছি আমি।

কিন্তু মুখে কুসুম বলল অন্য কথা। আমি তো আইজ গাঙ্গে আসতেই চাই নাই।

কথাটা শুনে আঁতকে উঠল মানুষটি। কেন আসতে চাও নাই?

আপনের লাইগা! আপনে যে কী শুরু করছেন!

খারাপ কিছু তো আমি করতাছি না। আমার মন চায় তোমারে দেখতে, আমি তোমারে দেখতে আসি।

মন চাইলেই কি সব কাম করতে পারে মানুষে! আমার মনও তো কত কিছু চায়। জোর কইরা মনরে বাইন্দা রাখি আমি।

তুমি পার, আমি পারি না।

কেন পারেন না আপনে?

কইতে পারি না। আমার খালি মনে হয় তোমার মুখখান একবার না দেখলে আমার কোনও কাম হইব না। তোমার মুখ না দেইখা আড়তে গেলে কোনও মাছ পামু না। বরফ দেওয়া মাছ নৌকায় উঠাইয়া দেখুম বরফের মইধ্যে থাইকাও পইচা গেছে বেবাক মাছ। হাজার হাজার টেকা লোকশান হইয়া যাইব। তয় সেই লোকশানরে আমি ডরাই না। আমি ডরাই নিজেরে, আমি ডরাই মরণরে। আমার খালি মনে হয় একদিন তোমার মুখ না দেখলে আমি আর বাচুম না। আমি মইরা যামু। আইজ তুমি না আইলে এই গাছতলায় বইসাই মইরা যাইতাম আমি।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ধরে এল মানুষটির। চোখ ছলছল করে উঠল। মানুষটির মুখের দিকে তাকাতে পারল না কুসুম। বুকটা উথালপাথাল করছে তার। চোখ দুটো ফেটে যেতে চাইছে। তবু নিজেকে সামলাল কুসুম। নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, এমুন করন ঠিক হইতাছে না আপনের। মন শান্ত করেন, জোর কইরা বান্ধেন মনরে। মা বাপের একমাত্র পোলা আপনে। আপনেরে লইয়া কত স্বপ্ন তাগ। বাড়িতে পাটাতন ঘর উঠাইব আপনের বাপে, আপনেরে বিয়া করাইব। মা-বাপের কথামতন বিয়া কইরা ফালান, বিয়া করলে সব ঠিক হইয়া যাইব।

না ঠিক হইব না। পাটাতন ঘরে সোনার পালঙ্কে রাজকন্যা লইয়া শুইলেও ঘুম আসব না আমার। আমার খালি তোমার কথা মনে হইব। তুমি লগে থাকলে আমার কোনও পাটাতন ঘর লাগব না, খাটপালঙ্ক কিচ্ছু লাগব না। তোমারে লইয়া গাছতলায় শুইয়া থাকলেও সুখে ঘুমাইতে পারুম আমি। তুমি ছাড়া কেউ আমার বউ হইতে পারব না।

কুসুম অসহায় গলায় বলল, এই কথা কইয়েন না। এই কথা শোনলে আমার পাপ হইব।

কিসের পাপ?

এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না কুসুম। বুক ফেটে গেল তার, চোখ ফেটে গেল। কান্নাকাতর গলায় কুসুম বলল, পবনদাদা, আপনে বোঝেন না কেন আপনে হিন্দু! মুসলমান মাইয়া আপনের বউ হইতে পারে না।

ফ্যাল ফ্যাল করে কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল পবন। তারপর বলল, আমি হিন্দু মুসলমান বুঝি না, আমি বুঝি তোমারে। আমি কোনও ধর্ম বুঝি না, আমি বুঝি মানুষ।

এই সব কথা সমাজের মানুষে শুনব না, বুঝব না। হিন্দু-মুসলমানের বিয়া দেশগেরামে কেউ মাইনা নিব না।

না নিলে দেশ গেরামে থাকুম না। তোমার হাত ধইরা এই গেরাম ছাইড়া চইলা যামু।

কই যাইবেন?

নদীর ওপারকার ধু ধু প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নময় হয়ে গেল পবনের দুচোখ।

বহুত দূরের অচিন কোনও নদীর তীরে গিয়া ঘর বান্ধুম। সারাদিন মাছ ধরুম নদীতে। দুইজন মানুষের জীবন সুখে কাটব। আমি হিন্দু তুমি মুসলমান এই কথা কেউ জানব না। দিনে দিনে আমরা দুইজনেও জাতধর্ম ভুইলা যামু। তুমি আমার লগে যাইবা কুসুম?

পবনের কথা শুনতে শুনতে তার চোখের স্বপ্ন যেন কুসুমের চোখে এসেও ভর করেছে। এরকম একটি জীবনের ছবি যেন সেও দেখতে শুরু করেছে। দেখতে দেখতে আশ্চর্য এক ঘোর লেগে গেছে তার চোখে। পবনের শেষ কথাটি সে শুনতেই পেল না।

পবন আবার বলল, যাইবা কুসুম?

আলতো করে পবনের দিকে মুখ ফেরাল কুসুম। কথা বলল না। জালের ভেতর থেকে কীরকম চোখ করে যে পবনের দিকে তাকিয়ে রইল!

 কুসুমের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়াবি গলায় পবন বলল, ঠিক আছে এখন না কইতে চাইলে রাইতে কইয়ো। রাইতে তোমগ বড়ঘরের পিছনে যে বাঁশঝাড় আছে ওই বাঁশঝাড় তলায় আসুম আমি। ঘরের দরজায় টুকটুক কইরা তিনখান টোকা পড়লে তুমি বুঝবা আমি আসছি। তখন সাবধানে দরজা খুইলা বাইর হইবা।

কুসুম মাথা নেড়ে বলল, না।

পবন ম্লান হাসল। ঢাকা থিকা একখান জিনিস আনুম তোমার লেইগা। ওইটা দিয়া আসুম আর শুইনা আসুম তুমি কী কও।

কুসুম আবার বলল, না। রাইতে আপনে আমগ বাড়িত যাইয়েন না। আমি বাইর হমু না।

কেন?

এমনেই। যা শোনতে চান এখনই শুইনা যান। আমি আপনের লগে কোনখানে যামু না। আল্লারে আমি বহুত ডরাই, ধর্মরে বহুত ডরাই। ধর্ম ত্যাগ আমি করতে পারুম না। আমার আশা আপনে ছাইড়া দেন।

পবন অবুঝ গলায় বলল, না তা আমি ছাড়ুম না। রাইতে তোমগ বাঁশঝাড় তলায় গিয়া দাঁড়াইয়া থাকুম। তোমার ইচ্ছা হইলে বাইর হইবা না ইচ্ছা হইলে হইবা না। আমি দাঁড়াইয়াই থাকুম।

পুবের আকাশ ঘারুয়া মাছের মুখের ভেতরকার মতো লাল হয়ে উঠেছে কখন! সূর্য উঠছে। নদীর দুপারে জড়ো হচ্ছে মাছলোভী মানুষ। এসব দেখে পবন আর দাঁড়াল না। কড়ুইতলা ছাড়িয়ে দ্রুত হেঁটে সড়কের দিকে চলে গেল।

কুসুমের তখন কী যে অসহায় লাগছে! বুক ফেটে যেতে চাইছে গভীর কান্নায়। ইচ্ছে করছে নদীতীরের বেলেমাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদে। কিন্তু তেমন কান্না কাঁদবারও ক্ষমতা নেই কুসুমের। তাকে ওভাবে কাঁদতে দেখলে নদীতে মাছ ধরতে আসা মানুষ ভিড় করবে চারপাশে, হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করবে কুসুমকে। তারচে বুকের কান্না বুকে চেপে রাখা ভালো। চোখের কান্না লুকিয়ে রাখা ভালো চোখের ভেতর।

তাই করল কুসুম। একহাতে চোখ দুটো খানিক চেপে রেখে গভীর করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর জাল বাগিয়ে জলে নামল।

.

টুকটুক করে তিনটি টোকা পড়ল দরজায়। সেই শব্দে চমকে উঠল কুসুম, বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। তবু নিঃশব্দে মাথাটা সামান্য তুলল সে, বুঝতে চাইল কেউ টের পেয়েছে কিনা। বোধহয় পায়নি, পেলে সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিত।

এই ঘরে চারজন মানুষ তারা। চৌকিতে আছে বাবা, মেঝেতে মা পরী আর কুসুম। মালেক থাকে পাটাতন ঘরে। জোয়ান মর্দ ছেলে মা-বাবা-বোনদের সঙ্গে একঘরে থাকে কী করে!

এখন কত রাত কে জানে! ঘরের ভেতর নিরেট অন্ধকার থাকার কথা কিন্তু অন্ধকারটা তেমন নয়। বেড়ার ফাঁকফোকড় দিয়ে চাঁদের আলো যতটুকু পারে এসে ঢুকেছে। জমাট অন্ধকার হালকা করে দিয়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকালে প্রতিটি মানুষের মুখ দেখা যায়। মানুষগুলোর মুখ দেখার চেষ্টা করল কুসুম।

তার পাশেই শুয়ে আছে পরী। দশ বারো বছরের মেয়ে কিন্তু শোয়ার ভঙ্গিটা একেবারেই শিশুর মতো। হাত পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে আছে। মুখটা কাত করা কুসুমের দিকে। মাথাটা হেলে পড়েছে বালিশ থেকে। ঠোঁট বোধহয় সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পরীর, লালা ঝরে বালিশ ভিজছে। বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে মুখের কাছ থেকে। নিশ্চয় গভীর ঘুমে পরী নয়ত হাত দিয়ে লালা মুছত।

 পরীর ওপাশে শুয়ে আছে মা। অদ্ভুত এক অভ্যেস আছে মায়ের, যখনই শোয় শাড়ির আঁচলে মুখখানি একেবারে ঢেকে শোয়। ঘুমোয় না জেগে থাকে বোঝা যায় না। মায়ের দিকে তাকিয়ে কুসুমের ইচ্ছে হল দু আঙুলের ডগায় আলতো করে ধরে আঁচলটা সরিয়ে দেয় মুখ থেকে। চোখ দেখে বোঝার চেষ্টা করে ঘুমিয়ে আছে সে না জেগে।

না, তা করা ঠিক হবে না। যদি ঘুমিয়ে থাকে মা তাহলে মুখ থেকে আঁচল সরাবার সঙ্গে সঙ্গে জেগে যাবে। ধড়ফড় করে উঠে বসবে। আর যদি জেগে থাকে তাহলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, কী হইছে কুসুম? এমুন করতাছস কেন? বাইরে যাবিনি?

রাত বিরেতে একা ঘরের বার কখনও হয় না কুসুম। মা কিংবা পরীকে ডেকে নেয়। মায়ের মুখের দিকে কুসুম তারপর মগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইল। কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাস বেশ ভারী হয়।

খানিক তাকিয়ে থেকে কুসুম বুঝে গেল মায়ের শ্বাসপ্রশ্বাস বেশ ভারী।

তারপর বাবার দিকে তাকাল কুসুম। অবশ্য না তাকালেও হত। দিনভর মণ্ডলবাড়িতে কাজ করে এসেছে, বেড়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে যেমন করে নাক ডাকাচ্ছে এখন ফজরের আজানের আগে কিছুতেই ঘুম ভাঙবে না তার। এত কিছু দেখে বুঝেও কিন্তু কুসুম তারপর উঠে দাঁড়াল না, দরজা খুলে বেরুল না। যেমন নিঃশব্দে মাথা তুলেছিল তেমন নিঃশব্দেই মাথা রাখল বালিশে। বুক কাঁপিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে চাইল, দীর্ঘশ্বাসটা কুসুম চেপে চেপে ফেলল। দীর্ঘশ্বাসের শব্দে যেন কেউ না জাগে!

 নদীতীর থেকে ফিরে আসার সময়ই কুসুম ভেবে রেখেছিল রাতেরবেলা কিছুতেই ঘর থেকে বেরুবে না সে। যতক্ষণ ইচ্ছে বাঁশঝাড় তলায় দাঁড়িয়ে থাক পবন। কতক্ষণই বা থাকবে! অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে এক সময় নিশ্চয় ফিরে যাবে। আর যদি একান্তই না যায় সকাল হলে তো যাবেই। লোকজন জেগে ওঠার পর কি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে! কাল থেকে নদীতে আর মাছও ধরতে যাবে না কুসুম। মাকে বলবে তার শরীর খারাপ। মা হয়ত পরীকে পাঠাবে। পরী ছোট্ট মানুষ, কুসুমের মতো দ্রুত মাছটা ধরতে পারবে না। সময় লাগবে, তবু কাজ তো চলবে। কিছুদিন নদীতীরে না গেলে, কুসুমের সঙ্গে দেখা না হলে টানটা পবনের কমে যাবে। যদি দরকার হয় নদীতীরে কুসুম আর কোনওদিন যাবেই না। কোনও না কোনও ভাবে মাকে বোঝাবে। বাবা বলেছে মণ্ডল বাড়ির কাজ শেষ করে কুসুমের বিয়ে দেবে। ততদিনে ক্ষেতের ধানও উঠবে ঘরে। সব মিলিয়ে দুতিন মাসের ব্যাপার। দুতিনটা মাস পবনের সঙ্গে আর দেখা না হলেই হল। তারপর পবন আর তাকে পাবে কোথায়! কোথাকার কোন গ্রামে বিয়ে হয়ে যাবে তার। বছর দুবছরে একবার বাপের বাড়ি নাইওর আসবে। পবনের সঙ্গে এই জীবনে হয়ত আর দেখাই হবে না।

কিন্তু পবনের কথা কী একেবারেই ভুলে যেতে পারবে কুসুম! চোখ জুড়ে কী থেকে যাবে পবনের মায়াবি মুখখানি! মনে কি রয়ে যাবে না তাকে নিয়ে অচিন নদীতীরে গিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল একজন মানুষ। যে কোনও সমাজ মানতে চায়নি, যে কোনও ধর্ম মানতে চায়নি! দূর কোনও গ্রামে গৃহস্থবাড়ির বউ হয়ে স্বামীসংসার নিয়ে যখন ব্যস্ত হবে কুসুম, হঠাৎ হাওয়ায় তার কাছে কি ভেসে আসবে না পবনের গায়ের একটুখানি গন্ধ! মনের ভেতরটা কি আনচান করে উঠবে না তার! পবনের কথা ভেবে কুসুম কি তখন উদাস হবে না! সারা জীবনের জন্য এ কোন কষ্টের মধ্যে পড়ে গেল কুসুম! এই যে পবন এখন বাঁশঝাড় তলায় দাঁড়িয়ে আছে এই কষ্টই তো সহ্য করতে পারছে না সে। তার কেবল মনে হচ্ছে কাল রাতদুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল পবন, দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে কুসুমের সঙ্গে দেখা করেছে তারপর শ্যালো নৌকোয় চড়ে গেছে ঢাকায়। ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় রাত হয়েছে। দুপুরে ভাত খেয়েছে কিনা, রাতে ভাত খেয়েছে কিনা কে জানে! এক পলকের জন্য ঘুমিয়েছে কি ঘুমোয়নি কে জানে, বাঁশঝাড়তলায় এসে অপেক্ষা করছে। যে মানুষটি এত কষ্ট করছে কুসুমের জন্য, কুসুম কি কিছুই করবে না তার জন্য?

কুসুম মনে মনে বলল, আর একটু খাড়ান পবনদাদা, আমি আসতেছি। তয় এইটাই আমাগ শেষ দেখা। আমি আপনেরে মাথার কিরা দিমু। আইজকার পর আপনে আমার লগে আর দেখা করতে পারবেন না। দেখা করতে চাইলে আমার মরা মুখ দেখবেন। আপনের লেইগা মইরা যামু আমি।

নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল কুসুম। দরজা খুলল।

বাঁশঝাড়ের মাথার ওপর কাত হয়ে আছে ক্ষয়া চাঁদ। চাঁদের আলো তেমন স্বচ্ছ নয়, রজতরেখার জলের মতো সামান্য ঘোলাটে। এরকম আলোয় মানুষের ঘরবাড়ি কেমন দুঃখী মনে হয়। যেন বা অনাদিকালের কোনও গভীর দুঃখ বুকে চেপে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের পাতায় পাতায় খেলছে নিশীথবেলার মগ্ন হাওয়া। হাওয়ার শব্দের সঙ্গে মিশেছে ঝিঁঝির ডাক। দূরে কোথায় একাকী ডেকে ক্লান্ত হচ্ছে এক রাতপাখি। ডানায় চাঁদের আলো মেখে উড়ে যায় বাদুড়। কুসুমদের বাড়ির বাশঝাড় তলায় দাঁড়ানো পবনের পায়ের কাছে ঘুর ঘুর করে একটি সাহসী ইঁদুর। ঝরা পাতায় সর সর করে শব্দ হয়। কিন্তু এসবের কিছুই খেয়াল করে না পবন। একদৃষ্টে কুসুমদের বড় ঘরটির দিকে তাকিয়ে আছে সে। অদ্ভুত এক অভিমানে বুক ফেটে যাচ্ছে তার, চোখ জ্বালা করছে।

কুসুম কি সত্যি সত্যি বেরুবে না! এতটা নিষ্ঠুর সে হয় কী করে! একবারও কি পবনের কথা সে ভাবছে না! নাকি নিশ্চিন্তে ডুবে আছে গভীর ঘুমে! পবন এসে যে দরজায় টোকা দিয়েছে শুনতে পায়নি! পবন এসে যে বাঁশঝাড় তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে কথা কি তার মনে নেই!

 পবন মনে মনে বলল, তবু আমি ফিরা যামু না। তবু আমি দাঁড়াইয়া থাকুম। সারারাত দাঁড়াইয়া থাকুম। সকাল হইলেও যামু না। দেখি কুসুম আমার কাছে কেমনে না আসে। দরকার হইলে কুসুমের বাপভাই আমারে ধরুক, মারুক যা ইচ্ছা তাই করুক, আমি যামু না।

ঠিক তখুনি ঘরের দরজা খুলে, সাবধানী চোখে চারদিক তাকাতে তাকাতে নরম পায়ে বাঁশঝাড় তলার দিকে হেঁটে এল কুসুম। দেখে আনন্দে একেবারে আত্মহারা হয়ে গেল পবন। সামান্য এগিয়ে গিয়ে দুহাতে কুসুমের একটা হাত ধরল সে। মুগ্ধ গলায় বলল, আমি জানতাম তুমি আসবা। তুমি না আইসা পারবা না।

আলতো করে হাতটা ছাড়িয়ে নিল কুসুম। ধীর শান্ত গলায় বলল, অনেক কিছু চিন্তা কইরা আসলাম।

কী চিন্তা?

শোনলে আপনে খুব কষ্ট পাইবেন। তাও না বইলা আমার কোনও উপায় নাই।

পবন একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, কপালে কষ্ট থাকলে তো পাইতেই হইব! কও শুনি।

কুসুম সরাসরি পবনের মুখের দিকে তাকাল। নদীর পারেও এই সব কথা আপনেরে আমি বলছি। আপনে শোনতে চান নাই, বোঝতে চান নাই। পবনদাদা, আমারে আপনের কথা দেওন লাগব আইজকার পর আপনে আর আমার লগে দেখা করনের চেষ্টা করবেন না। আমার চিন্তা আপনে বাদ দিয়া দিবেন।

পবন পরিষ্কার গলায় বলল, এইটা আমি পারুম না।

কথাটা শুনে কুসুম খুব দুঃখী হয়ে গেল। তাইলে তো আমার অন্য ব্যবস্থা করন লাগে।

কী ব্যবস্থা?

কুসুম উদাস গলায় বলল, না আপনেরে কোনও ঝামেলায় ফালামু না আমি। যা করনের নিজেই করুম।

পবন একটু ভয় পেয়ে গেল। এমুন কইরা কথা কইতাছ কেন? কী করবা কও আমারে! ইরিক্ষেতের মাজরা পোকা মারণের লেইগা কীটনাশক আইনা রাখছে ভাইজানে। কীটনাশক তো বিষ। পুরা এক শিশি খাইয়া ফালামু।

কুসুমের কথা শুনে পবন একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। দুহাতে পাগলের মতো কুসুমের একটা হাত ধরল। ভাঙাচোরা গলায় বলল, না না।

এছাড়া আমার কোনও উপায় নাই।

উপায় থাকব না কেন! আমি যে তোমারে বললাম চল দেশগেরাম ছাইড়া পলাইয়া যাই, তুমি রাজি হইতাছ না কেন?

এইটা আমার পক্ষে সম্ভব না।

কেন সম্ভব না? এমুন হয় না দুনিয়াতে? হিন্দু মাইয়া পলাইয়া যায় না মুসলমান পোলার হাত ধইরা? মুসলমান মাইয়া পলাইয়া যায় না হিন্দু পোলার হাত ধইরা?

যায়। কিন্তু আমি তেমুন মাইয়া না। আমি আপনেরে কতবার কমু আমি আল্লারে বহুত ডরাই, ধর্মরে বহুত ডরাই।

প্রেম কোনও ধর্ম মানে না। আমারে দেখ, আমি তো মানতাছি না।

সবাই এক রকম হয় না। আপনে যা পারতাছেন আমি তো পারতাছি না।

এবার কুসুমের হাত দুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরল পবন। কাতর গলায় বলল, তুমি এমুন কইর না কুসুম। তুমি আমারে একটু দয়া কর। আমার জীবনটা তুমি নষ্ট কইরা দিও না। আমার মনটা তুমি ভাইঙ্গা দিও না। আমি শুনছি তোমাগ ধর্মে আছে একজন মানুষের মন ভাঙ্গা আর একখান মসজিদ ভাঙ্গা সমান কথা। আমি হিন্দু হইতে পারি কিন্তু মানুষ তো! আমার মন তুমি কেন ভাঙ্গবা?

পবনের অনুনয়ে বুকটা হু হু করতে লাগল কুসুমের। তীব্র কান্নায় ফেটে যেতে চাইল। চোখ। তবু নিজেকে আগের মতোই শক্ত করে রাখল সে। নির্বিকার গলায় বলল, আপনে এমুন করলে আমার সামনে ওই একটাই রাস্তা।

নিজের অজান্তেই যেন কুসুমের হাত তারপর ছেড়ে দিল পবন। অপলক চোখে খানিক তাকিয়ে রইল কুসুমের মুখের দিকে, তারপর গভীর করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে, আমার মুখ তোমারে আমি আর কোনওদিন দেখামু না। এই আমগ শেষ দেখা। তয় আমার একখান অনুরোধ তুমি রাইখো। ঢাকা থিকা তোমার লেইগা ছোট্ট একখান নাকফুল আনছিলাম। সাদা পাথরের নাকফুল। কোনদিন আমার কথা মনে কইরা এই। নাকফুলটা তুমি পইরো।

কথা বলতে বলতে শেষদিকে গলা ধরে এল পবনের। বুক পকেটে হাত দিয়ে কাগজে ছোট্ট করে জড়িয়ে রাখা নাকফুলটা বের করল সে। কুসুমের হাতে দিল।

আনমনা ভঙ্গিতে জিনিসটা নিল কুসুম। নিয়ে ব্লাউজের ভেতর, বুকের কাছে রেখে দিল। তারপর দুহাতে আঁকড়ে ধরল পবনের দুটো হাত। কোত্থেকে যে আকুল করা এক কান্না এল কুসুমের, সেই কান্নায়, চোখ ভেসে গেল তার, গাল ভেসে গেল। কাঁদতে কাঁদতে কুসুম বলল, পবনদাদা, আমি আপনেরে বহুত কষ্ট দিলাম। মন ভাইঙ্গা দিলাম আপনের। আপনে আমারে মাফ কইরা দিয়েন।

একথায় পবনেরও বুক ফেটে গেল, চোখ ভেসে গেল কান্নায়। দুহাতে পাগলের মতো কুসুমকে সে বুকে চেপে ধরল। জড়ানো গলায় বলল, মানুষের ধর্ম মানুষরে কেন মানুষের কাছ থিকা দূরে সরাইয়া দেয়?

নিজের অজান্তে কুসুমও তখন জড়িয়ে ধরেছে পবনকে। হু হু করা কান্নায় বুক ভাসাচ্ছে পবনের।

.

রাত দুপুরে খালেক মিস্ত্রির বাঁশঝাড় তলায় দুজন মানুষকে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মিস্ত্রিবাড়ির তিন শরিকের এক শরিক কানা হাশেম। পেশাব করতে বেরিয়ে উঠোনের কোণের দিকটায় এসেছে সে, লুঙ্গি তুলে মাত্র বসতে যাবে, দেখে বাঁশঝাড়ের আলোআঁধারিতে এই দৃশ্য। প্রথমে সে খুব চমকেছে। কানা মানুষরা তো সব একচোখ দিয়ে দেখে! একচোখ দিয়ে দেখা কোনও কোনও বাস্তব দৃশ্যও কখনও কখনও অবাস্তব মনে হয়। তার ওপর সেই চোখে যদি থাকে ঘুমভাব তাহলে তো কোন কথাই নেই।

কানা হাশেমেরও তাই হল। দৃশ্যটি তার একেবারেই বাস্তব মনে হল না। মনে হল সে কোনও অলৌকিক দৃশ্য দেখছে। গৃহস্থ বাড়ির বাঁশঝাড়গুলোতে নিয়মিত আসাযাওয়া করেন তেনারা। রাত দুপুরের ম্যাট ম্যাটে জ্যোৎস্নায় সাদা পোশাকপরে আকাশে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মদ্দাগুলো, মাদিগুলো ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদেন। তেমন দুজন বোধহয় খালেক মিস্ত্রির বাঁশঝাড় তলায় আজ মিলিত হয়েছেন। মদ্দাটা পরে আছেন শাদা পোশাক, মাদিটা ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছেন।

তারপর আর কথা কী, তোলা লুঙ্গি মুহূর্তে নামিয়ে ফেলল হাশেম। তলপেটের একেবারে তলায় নেমে আসা পেশাব কখন যে ওপর দিকে উঠে গেল হাশেম তা টেরই পেল না। বাবাগো বলে চিল্লায়ে একখানা দৌড় দিয়ে ঘরে মাত্র ঢুকতে যাবে, খোলা দরজায় বউকে দেখতে পেল। একই উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরুচ্ছিল হাশেমের বউ। স্বামীর অমন। দিশেহারা ভাব দেখে বলল, কী হইছে আপনের? এমুন করতাছেন কেন?

বউকে দেখে ধরে প্রাণটা যেন এল হাশেমের। তবে গলার স্বর গলায় আটকে গেছে বলে কথা সে বলতে পারল না। কায়ক্লেশে আঙুল তুলে খালেক মিস্ত্রির বাঁশঝাড় তলাটা দেখাল। ব্যাপারটার আগামাথা কিছুই বুঝল না বউ। গলা নামিয়ে বলল, কী?

 হাশেমের গলায় এবার স্বর ফুটল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ক্ষীণ স্বরে সে বলল, তারা একজন না। দুইজন।

ব্যাপারটা তবু বুঝল না হাশেমের বউ। গভীর সন্দেহের গলায় বলল, কও কী! দেখি তো।

হাশেম আর কথা বলার সুযোগ পেল না। তার বউ দ্রুত হেঁটে উঠোনের কোণের দিকে চলে গেল।

হাশেমের হৃদপিণ্ডটা তখন চাঁইয়ে আটকেপড়া সরপুঁটির মতো লাফাচ্ছে। ঘরে ঢুকে যে দরজা দেবে, বউটা তো বাইরে রয়ে গেল! তেনাদের নজরে যদি পড়ে যায় তাহলে তো সর্বনাশ হবে!

কী করবে বুঝে ওঠার আগেই হাশেমের বউটি ফিরে এল। হাশেমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, মাইয়াডারে তো চিনলাম, কুসুম। পোলাডারে চিনলাম না।

একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কানা হাশেম একেবারে বীরপুরুষ হয়ে গেল। সিনা টান করে বলল, কও কী! বাঁশতলায় তাইলে কিষ্ণলীলা হইতাছে! তুমি এক কাম কর, বাড়ির বেবাকতেরে ডাইকা উঠাও আমি যাইয়া মালেকরে ডাকি। চাইরদিক দিয়া বেড় দিয়া ধরি দুইজনরে। কিষ্ণলীলা ছুটাইয়া দেই।

বউ কী বলল হাশেম আর পাত্তা দিল না। লুঙ্গি কাছা মেরে, দ্রুত তবে একেবারেই নিঃশব্দে খালেক মিস্ত্রির পাটাতন ঘরের পেছন দিকটায় গিয়ে দাঁড়াল। ঘরের এই দিককার জানালার সঙ্গে মালেকের চৌকি। জানালা খোলা রেখে ঘুমোয় মালেক। আজও রেখেছে। সেই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে গলা যতটা সম্ভব খাট করে মালেককে ডাকতে লাগল হাশেম। মালেক, ও মালেক ওঠ। তাড়াতাড়ি ওঠ।

দু তিনবার ডাকার পর সাড়া দিল মালেক। জানালার দিকে তাকিয়ে কানা হাশেমকে। চিনতে পারল। ধড়ফড় করে বিছানায় ওঠে বসল। কী হইছে?

মুখের হাসি কান পর্যন্ত টেনে হাশেম বলল, তগ বাঁশতলায় কিষ্ণলীলা হইতাছে। তাড়াতাড়ি আয়।

মালেক কিছুই বুঝল না, তবে দরজা খুলে বেরুল।

বাঁশঝাড় তলায় তখন মিস্ত্রিবাড়ির লোকজন তো আছেই আশপাশের বাড়ি থেকেও লোকজন এসে জুটেছে। চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে পবন আর কুসুমকে। কানা হাশেমের বউ খুবই তৎপরতার সঙ্গে করতে পেরেছে কাজটা। লোকজন বেশ হল্লাচিল্লা করছে, পবন আর কুসুম আছে স্তব্ধ হয়ে।

মালেককে নিয়ে বাশঝাড় তলায় এসেই প্রকাণ্ড একখানা লাফ দিল কানা হাশেম। চিৎকার করে বলল, এই বাড়িতে কিষ্ণলীলা! এত বড় সাহস! কেষ্ট ঠাকুরডা কে?

সবেধন নীলমণি চোখটি তীক্ষ্ণ করে পবনের মুখের দিকে তাকাল হাশেম। পবনকে চিনতে পেরে আরও জোরে চিৎকার দিল। আরে এইডা তো নশঙ্করের পবন না! হইরা জাউল্লার পোলা! ছ্যা ছ্যা ছ্যা! হিন্দু পোলার লগে মোসলমান মাইয়ার কিষ্ণলীলা! হায়। হায়রে মিস্ত্রিবাড়ির ইজ্জত আর রইল না! ওই মালেক, গরু বান্ধনের দড়ি ল। বান্ধ মালাউনের বাচ্চারে।

মালেক নড়ল না। পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে তার। টেনে তুলতে পারছে না। তার বোন কুসুম করেছে এমন কাজ এ যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

খালেক মিস্ত্রি মিস্ত্রিবউ আর পরীও এসে দাঁড়িয়েছে ভিড়ের মধ্যে। বয়সের তুলনায় পরী একটু বোকাসোকা। ব্যাপারটার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছিল না সে। মাকে জিজ্ঞেস করল, ওমা, কী হইছে? এত মানুষ কেন এখানে? বুবু কী করতাছে?

 পরীর কথা চাপা পড়ে গেল খালেক মিস্ত্রির হুংকারে। থাবা দিয়ে কুসুমের চুলের মুঠি ধরল সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বজ্জাত মাইয়া, এমনে চুনকালি দিলি আমার মুখে! তরে আমি জবাই কইরা ফালামু। জবাই কইরা তরে আমি গাঙ্গে ভাসাইয়া দিমু। আয় ঘরে আয়।

টেনে হেঁচড়ে কুসুমকে নিজের উঠোনের দিকে নিয়ে চলল মিস্ত্রি। কুসুম কোনও শব্দ করল না কিন্তু পরী একেবারে তেড়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার ওপর। কী করছে বুবু? তুমি এমুন করতাছ কেন? ছাইড়া দেও, বুবুরে তুমি ছাইড়া দেও বাবা।

একহাতে পরীর ঘাড় বরাবর বিশাল একটা ধাক্কা দিল মিস্ত্রি। পরী একেবারে উড়ে গিয়ে পড়ল খানিক দূরে। বেশ ব্যথা পেল, তবু তা গায়ে লাগাল না। ওঠে মিস্ত্রি এবং কুসুমের পিছু পিছু ছুটতে ছুটতে বলল, ছাইড়া দেও, বুবুরে তুমি ছাইড়া দেও বাবা। মিস্ত্রি পাত্তা দিল না।

.

বড়ঘরের দাওয়ায় বসে ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদছে মিস্ত্রিবউ। বিলাপ করছে। আমার পেটের মাইয়া হইয়া এমুন কাম করল কুসুম! এমুন কইরা মান ইজ্জত খোয়াইল!

কুসুম বসে আছে ঘরের মেঝেতে। একেবারেই যেন পাথর হয়ে আছে সে। চোখে পলক পড়ে না। মুখে কোনো বিকার নেই। পরী বসে আছে তার গা ছুঁয়ে। যেন বোনটিকে সে পাহারা দিচ্ছে।

কাঁদতে কাঁদতে, বিলাপ করতে করতে হঠাৎ করেই যেন ক্ষেপে গেল মিস্ত্রিবউ। কুসুমের দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বলল, ওই মাগি, করছিলি করছিলি মোসলমান পোলার লগে করতি। বিয়াশাদি দিয়া দিতাম। ইজ্জতটা বাচত। অহন তো আমার এই কূলও গেল ওই কূলও গেল! তোর মতন মাইয়ারে আমি বিয়া দিমু কেমনে? কে বিয়া করব তোরে?

চট চট করে তিনচারবার কপাল চাপড়াল মিস্ত্রিবউ। বেবাক এই কপালের দোষ! এমুন দুঃখও আছিল কপালে!

খালেক মিস্ত্রি বসে আছে অদূরে। আজ সে মণ্ডল বাড়ির কাজে যায়নি। অমায়িক মুখখানি তার থমথম করছে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড রাগে ফেটে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে রাগ সামলাচ্ছে বলে গালের চাপদাড়ির আড়ালে ফুলে ফুলে উঠছে মাংস। স্ত্রীকে কপাল চাপড়াতে দেখে মুখ ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল মিস্ত্রি। প্রকাণ্ড একটা ধমক দিল স্ত্রীকে। এই মাগি, অহন এত বিলাপ করছ কেন? অহন কেন কপাল থাবড়াস? আগে মনে আছিল না তোর? মাইয়া সিয়ানা হইলে যে চোখে চোখে রাখতে হয় বোঝছ নাই তুই?

বুঝুম না কেন? আমি তো চোখে চোখেই রাখছি! খারাপ তো কোনওদিন কিছু দেখি নাই! আমারে কইত আল্লারে ও বহুত ডরায়, ধর্মরে ডরায়। অহন তো দেহি সব মিথ্যা। আল্লারে ডরাইলে, ধর্মরে ডরাইলে কেউ এমুন কাম করে! ওরে জিগান কেন এমুন করল?

 স্ত্রীর কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল মিস্ত্রি। ঘরে ঢুকেই ধাম করে একটা লাথি মারল কুসুমের পেট বরাবর। কোক করে একটা শব্দ করল কুসুম, উড়ে গিয়ে বেড়ার সঙ্গে পড়ল। পাশে বসা পরী এতটা কল্পনাও করেনি। সে একেবারে হকচকিয়ে গেল। দিশেহারার মতো ছুটে গিয়ে কুসুমকে ধরল। কুসুম কোনও শব্দ করল না, কাঁদল না। আগের মতোই পাথর সে। চোখে পলক পড়ে না, মুখে কোনও বিকার নেই।

কুসুমকে বোধহয় আরও মারত মিস্ত্রি, মালেককে দেখে মারল না। মালেক এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। মুখখানা লজ্জিত দুঃখিত তার।

ছেলেকে দেখে ঘর থেকে বেরুতে খালেক মিস্ত্রি বলল, পবনারে কী করছে?

মালেক বলল, দেড় হাজার টেকা জরিমানা।

ইমাম সাবে বিচার করছে?

হ। মণ্ডলরা আইছিল পবনরে ছাড়াইয়া নিতে। হইরা মণ্ডল খাড়াইয়া হাতজোড় কইরা কইল, আমার পোলায় অন্যায় করছে এর লেইগা আমি হাতজোড় কইরা মাফ চাইতাছি। বিচারে আপনেরা আমার পোলারে যেই শাস্তি দেন আমি মাইনা নিমু। তয় আমার একখান কথা আছে, আমি মনে করি দোষ আমার পোলার থিকা মিস্তিরির মাইয়ায় বেশি করছে। পুরুষ মানুষে অনেক কিছু করতে পারে, মাইয়ারা পারে না। আমার পোলায় তো জোর কইরা মিস্তিরির মাইয়ারে ঘর থিকা বাইর করে নাই। মাইয়া স্বেচ্ছায় বাইর হইয়া আইছে। দোষ মাইয়াডারই বেশি।

খালেক মিস্ত্রি মাথা নাড়ল। সত্য কথাই কইছে মণ্ডলে।

সালিশের মানুষরাও কইল, ইমাম সাবেও কইল মণ্ডলের কথা ঠিক। এর লেইগাই পবনের গায়ে হাত উঠায় নাই। দুই হাজার টেকা জরিমানা করল। হইরা মণ্ডল ইমাম সাবের হাতে পায়ে ধইরা পাঁচশো টেকা কমাইছে।

টেকা আদায় হইছে?

 হ। লগে লগেই টেকা দিয়া পবনরে ছাড়াইয়া নিছে হইরা।

টেকাডাঃ কার কাছে?

ইমাম সাবের কাছে। এই টেকা বলে মসজিদ পাকা করনের কামে লাগব।

মিস্ত্রিবউ অস্থির গলায় বলল, যেই কামে ইচ্ছা লাগুক। কুসুমের কী হইব হেইডা কছ না কেন?

মালেক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কী হইব আমি কেমনে কমু! বৈকালে বিচার বসব। গেরামের বেবাক মানুষরে বকুলতলায় যাইতে কইছে ইমাম সাবে। কুসুমের লগে যাইতে কইছে আমগ বেবাকতেরে।

মিস্ত্রি কাঁদ কাঁদ গলায় বলল, তা তো কইবই।

তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বৈকালের আগে আমারে তুমি উঠাইয়া নেও আল্লা। আমারে তুমি মরণ দেও। এই অপমান আমি সহ্য করতে পারুম না।

মসজিদ ঘরটির পেছন দিককার জঙ্গলে তুর তুর করছে একটি মেঠো ইঁদুর। চঞ্চল চোখে এদিক চায় ওদিক চায় আর বুভুক্ষের মতো খাদ্য খুঁজে বেড়ায়। কালজাত সাপটি ছিল হিজলগাছের নিচের দিককার একটি ডাল প্যাচিয়ে। বিকেলের মুখে মুখে তীক্ষ্ণ এক টুকরো রোদ এসে পড়েছে কালজাতের গায়ে। শরীর এত তেলতেলে সাপটির, রোদ পড়ে পিছলে যাচ্ছিল। রোদের তাপ সইতে পারে না কালজাত। বিরক্ত হয়ে শরীরের প্যাঁচ খুলেছে, ছায়া খুঁজতে যাবে, জিভ বের করে শোনে বকুলতলায় বহু মানুষের হল্লাচিল্লা আর জঙ্গলের ছায়াময়তায় তুর তুর করছে একটি মেঠো ইঁদুর। মানুষের হল্লাচিল্লার শব্দ ভুলে কালজাত তারপর আততায়ীর মতো নিঃশব্দে এগুতে লাগল মেঠো ইঁদুরের দিকে।

.

পবিত্র কুআরান মাজিদে আল্লাহতায়ালা তার পেয়ারে নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লেল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লামকে বলেন, “হে নবী, তোমার স্ত্রীগণ, তোমার কন্যাগণ এবং মোমেন স্ত্রীগণকে বলিয়া দাও যে, তাহারা যেন তাহাদের চাঁদর নিজেদের মুখমণ্ডলের উপরে ঘোমটা আকারে টানিয়া দেয়। বিশ্বাসী নারীদের বল, তাহারা যেন তাহাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাহাদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে। তাহারা যাহা সাধারণত প্রকাশ করিয়া থাকে তাহা ছাড়া তাহাদের অন্য আভরণ প্রকাশ না করে, তাহাদের গ্রীবা বা বক্ষ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।

ঘাটলার অদূরে, মাঠের কোণে একটি হাতাওয়ালা চেয়ারে বসেছেন ইমাম সাহেব। তাঁর পেছনে মসজিদ ঘর, সামনে বকুলগাছ। মাঠের এদিকটায় এসে জড়ো হয়েছে সারা গ্রামের লোক। কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে। তবে কারও মুখে কোনও কথা নেই। ইমাম সাহেব কথা বলার সময় কথা বলা তো দূরের কথা সামান্য শব্দ পর্যন্ত করতে পারবে না কেউ।

খালেক মিস্ত্রি আর মালেক বসে আছে পাশাপাশি। দুজনেরই চেহারা এবং বসার ভঙ্গিতে ফুটে আছে গভীর অসহায়ত্ব, লজ্জা। তাদের পেছনে সার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিস্ত্রিবউ পরী এবং কুসুম। বিকেল বেলার রোদ উঠে গেছে মসজিদ ঘরের চালায়, গাছপালার মাথায়। তবুও কোত্থেকে কেমন করে যেন রোদের মোলায়েম একটি টুকরো এসে পড়েছে কুসুমের মুখে। সেই আলোয় কুসুমকে একেবারেই অচেনা মানুষ মনে হয়। এই মুখখানি যেন এতদিনকার কুসুমের নয়, এই মুখখানি যেন অন্য কারও। এরকম নির্বিকার মুখ কি কোনও মানুষের হয়!

কুসুমের চোখে কোনও পলক পড়ছিল না। ভিড় করা মানুষের মাথার ওপর দিয়ে সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কিন্তু আকাশ দেখছিল না কুসুম। কী যে দেখছিল, কেউ তা জানে না।

 কথা শেষ করে কুসুমের দিকে তাকালেন ইমাম সাহেব। তসবি ধরা হাতের আঙুল তুলে বললেন, এই মাইয়া মোমিন না। এই মাইয়া হইল কমিন। সে কোনও পরদা মানে না। সে মাছ ধরতে নদীতে যায়, সে কোনও ঘোমটা দেয় না। ঘোমটা দেওয়ার কথা বললে সে ইমাম সাহেবের মুখে মুখে তক্ক করে। ইমাম সাহেবরে চোখ রাঙ্গায়।

একথা শুনে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কুসুমের নিয়ে। মুখর হয়। ইমাম সাহেব হুংকার ছাড়েন, খামোস। সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয় সবাই। গাছের পাতায় হাওয়া বয়ে যাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ থাকে না।

ইমাম সাহেব বললেন, আমার কথা শোনে না, এত বড় কলিজার পাটা মাইয়ার! আমি কি কাঠমোল্লা? উল্টাপাল্টা ফতোয়া দেই? আমি প্রথমে হইলাম ক্বারী তারপর হইলাম হাফেজ তারপর মাওলানা। ছহি কইরা মানে শুদ্ধ কইরা কুরআন শরিফ পড়তে শিখেছি, তারপর কুরআন শরিফ মুখস্ত করেছি তারপর শিখেছি কোরানের অর্থ। দেশগেরামের বেবাক মানুষ আমারে মানে, এই মাইয়া মানে না। যেদিন আমার লগে বেদ্দপি করছে। ওই দিনই আমি বুঝছি এই মাইয়া বদ, চরিত্রহীন। ওর মনে যা চায় ও তাই করতে পারে। খালি মা বাপ ভাই বইনের ইজ্জত ও ডুবায় নাই, বংশের ইজ্জত ডুবায় নাই, পুরা গেরামের ইজ্জত ডুবাইছে। ও মিয়ারা, কী বলেন আপনেরা? ডুবায় নাই?

লোকজন সমস্বরে বলল, ডুবাইছে। ডুবাইছে।

ইমাম সাহেব খালেক মিস্ত্রির দিকে তাকালেন। তুমি কী কও মিস্তিরি?

এখানে এসে বসার পর থেকেই মাথা নিচু হয়ে আছে খালেক মিস্ত্রির। ইমাম সাহেবের কথায় আরও নিচু হয়ে গেল। থুতনি গিয়ে হাঁটুতে লাগল তার। জড়ানো গলায় কোনোরকমে সে বলল, জ্বে হুজুর ডুবাইছে।

তয় তোমার মাইয়ায় যে ব্যাভিচার করছে তুমি তা স্বীকার করলা?

এ কথার সঙ্গে সঙ্গে কানা হাশেম লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। স্বীকার না কইরা যাইব কই! বাড়ির বেবাক মানুষে গিয়া বেড় দিয়া ধরছে। পয়লা দেখছি আমি। দেইখা তো ডরাইয়া গেছি। মনে করছি বাঁশতলায় জ্বিনপরিতে মিলন ঘটছে। পরে দেখি, না, জ্বিনপরি না তো। এ তো আমগ কুসুম, এ তো নশঙ্করের পবনা। বাঁশতলায় কিষ্ণলীলা হইতাছে। পরে আমি গিয়াই তো মালেকরে ডাইকা উঠাইছি। কিরে মালেক, উঠাই নাই?

মালেক কোনও কথা বলল না।

পুর্ব পাড়ার নাদের দাঁড়িয়ে ছিল তার বন্ধু মিজানের সঙ্গে। হাশেমের কথা শুনে মিজানের দিকে তাকিয়ে বলল, হাশেম হমুন্দির পুতে কানা হইলে কী হইব আসল জিনিস বেবাকই দেখে।

নাদেরের কথা কেউ খেয়াল করল না।

কানা হাশেম তারপর ইমাম সাহেবকে বলল, মালেকরে আপনে জিগান হুজুর।

ইমাম সাহেব মালেকের দিকে তাকালেন। কথা সত্য নাকি মালেক?

মালেকও তার বাবার মতো মাথা নিচু করল। ক্ষীণ গলায় বলল, সত্য।

তাইলে আর কোনও সাক্ষীর দরকার নাই। যেই বাপ স্বীকার করে তার মাইয়া ব্যাভিচার করছে, যেই ভাই স্বীকার করে তার বইন ব্যাভিচার করছে, সেই মাইয়ার ব্যাভিচার প্রমাণের জইন্যে আর কোনও সাক্ষীসাবুদ লাগে না। এই মাইয়ার বিচার এখন করা যায়। কী মিয়ারা, করা যায় না?

লোকজন সমস্বরে বলল, যায়। যায়।

তসবি ধরা হাত নিজের দাড়িতে একবার বুলালেন ইমাম সাহেব। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, কুরআন শরিফে আল্লাহতায়ালা পরিষ্কার বলিয়াছেন যাহারা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানমতে বিচার-মীমাংসা না করিবে নিশ্চয় তাহারা কাফের রূপে পরিগণিত হইবে। আমি আল্লাহর খাসবান্দা। আমি কাফের হইতে পারি না। আল্লাহপাকের বিধানমতে এই মাইয়ার বিচার আমি করব। ভাইসব, সুরা বাকারার দ্বিতীয় পারায় দুইশ একুশ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলিয়াছেন রমণীদিগকে কাফের পুরুষদের সঙ্গে বিবাহ দিও না। যদিও সেই কাফের পুরুষ তোমাদের চিত্ত আকর্ষণ করে। এই মাইয়া কাফেরের সঙ্গে অর্থাৎ হিন্দু ছেলের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া করেছে, অন্যান্য কুকাজ করেছে। আল্লাহর কথা, কুরআনের কথা শোনে নাই। এই মাইয়ার বিচার আল্লাহপাকের বিধানমতেই করতে হবে। ব্যাভিচার সম্বন্ধে সুরা নুরের আঠার পারার দ্বিতীয় আয়াতে বলা হইয়াছে, ব্যাভিচারিণী নারী এবং ব্যাভিচারী পুরুষ, তাহাদের প্রত্যেককে একশত কোড়া লাগাও এবং আল্লাহতায়ালার বিধান পালনে তাহাদের দুইজনের প্রতি তোমাদের মনে কণামাত্র দয়া আসা উচিত নহে। যদি তোমরা আল্লাহতায়ালার প্রতি এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখ। আর উভয়কে শাস্তি প্রদান করিলে একদল মুসলমানের উপস্থিতি প্রয়োজন। একটু থামলেন ইমাম সাহেব, তারপর বললেন, ব্যাভিচারী পুরুষটি এইখানে নাই। আপনাদের উপস্থিতিতে তার বিচার আমরা করেছি। একশ কোড়া তাকে মারা হয় নি। দেড় হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। ওই টাকা মসজিদ পাকা করার কাজে লাগবে। এখন শুধু মাইয়ার বিচার হবে। আল্লাহর বিধান মতে একশ কোড়া মারতে হবে এই মাইয়াকে।

 কানা হাশেম বলল, কোড়া পাইবেন কই হুজুর? ইমাম সাহেব হাসলেন। আরে নাদান, কোড়া মানে কোড়া না। ঝাড়ু দিয়াও কোড়ার কাজ চলে। যা মসজিদ থিকা বড় শলার ঝাড়ুটা নিয়া আয়।

কানা হাশেম মহা উৎসাহে মসজিদ ঘরের দিকে ছুটে গেল।

লোকজনের চোখ তখন কুসুমের দিকে। কিন্তু কুসুম আগের মতোই নির্বিকার। মুখখানি পাথরের মতো, চোখে পলক পড়ে না। পাশে দাঁড়িয়ে যে ফুসফুস করে কাঁদছে মা, মুখে আঁচল চাপছে বারবার কুসুম তা খেয়ালই করল না। খেয়াল করল পরী। মাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ওমা কান্দ কেন তুমি? কী হইছে?

অদূরে দাঁড়ানো কানা হাশেমের বউ চাপা স্বরে একটা ধমক দিল পরীকে। এই ছেমড়ি চুপ কর তুই।

 পরীও প্রায় খেঁকিয়ে উঠতে গিয়েছিল কানা হাশেমকে ঝাড়ু হাতে ছুটে আসতে দেখে থেমে গেল।

 ইমাম সাহেব বললেন, গাছের লগে প্যাঁচ দিয়া বান্ধ। ঝাড়ু মারার সময় যেন দৌড়াইয়া পলাইতে না পারে।

ইমাম সাহেবের পায়ের কাছে ঝাডুটা রেখে দৌড়ে গিয়ে কুসুমকে ধরল কানা হাশেম। তার সঙ্গে জুটল মোল্লা বাড়ির বদর। কোত্থেকে যেন গরু বাঁধবার একগাছা দড়ি নিয়ে এল বদরের বড়ভাই মোতালেব। মুহূর্তে বকুলগাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলল কুসুমকে। দৃশ্যটি দেখে কেউ কোনও কথা বলল না, হাহাকার করে উঠল কেবল পরী। মাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ওমা বুবুরে বান্ধে কেন? তোমরা কিছু কও না? ও বাবা, ও ভাইজান তোমরা কিছু কও না? বুবুরে বান্ধে কেন?

 মিস্ত্রিবউর কান্না তখন আরও বেড়েছে। এতক্ষণ চাপাস্বরে কাঁদছিল এখন গুনগুন করে শব্দ হচ্ছে। খালেক মিস্ত্রির চোখও শুকনো নেই। দুহাটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে। মালেক হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়েছে। এই দৃশ্য সে সহ্য করতে পারবে না। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে যাবে, ইমাম সাহেব ঝাড়ু হাতে উঠে দাঁড়ালেন। মালেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেমড়া কই যাছ? খাড়া এখানে। এই মাইয়ার শাস্তি বাপ-ভাইয়ের চোখের সামনে দিতে হইব।

মালেক মাথা নিচু করে দাঁড়াল।

ইমাম সাহেব পায়ে পায়ে কুসুমের সামনে গেলেন, ঝাডুটা মাত্র তুলবেন, নাদের বলল, ঝাড়ু না মাইরা তো জরিমানাও করন যায়। মিস্ত্রির কাছ থিকাও যদি দেড়হাজার টেকা আদায় হইত ওই টেকাটাও তাইলে মসজিদ পাকা করনের কামে লাগত। মিস্ত্রিরে জিগান না হুজুর, টেকা দিতে রাজি আছেনি?

ইমাম সাহেব কথা বলবার আগেই হাঁটুতে গুঁজে রাখা মুখ তুলল খালেক মিস্ত্রি। এক হাতে চোখ মুছে পরিষ্কার গলায় বলল, টেকা দিতে রাজি না আমি। আমার কাছে টেকা। নাই। থাকলেও টেকা আমি দিতাম না। এমুন মাইয়া থাকন না থাকন এককথা। একশটা না এক হাজারটা ঝাড়ুর বাড়ি মারেন ওরে।

ইমাম সাহেব ছহি উচ্চারণে বললেন, বিসমিল্লাহির রহমানের রাহিম। তারপরই প্রথম বাড়িটা মারলেন কুসুমকে।

কুসুম এখনও আগের মতোই নির্বিকার। দুজন মানুষ যে তাকে ধরে এনে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধেছে, সারা গ্রামের মানুষ যে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে, ইমাম সাহেব যে মসজিদ ঝাড়ু দেয়ার বেশ লম্বা, বেশ শক্ত একখানা ঝাড়ু দিয়ে শরীরের যাবতীয় শক্তি একত্র করে এইমাত্র তাকে একটা বাড়ি দিলেন কোনও কিছুই যেন গায়ে লাগছে না তার।

প্রথম বাড়িটা দিয়ে ইমাম সাহেব একটু থামলেন। লোকজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ও মিয়ারা, আপনেরা কিন্তু গুনবেন। আমার তো খেয়াল থাকব না, একশটা হইলে বইলেন।

 লোকজন সব স্তব্ধ হয়ে আছে কেবল ছটফট করছে পরী। একবার মায়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছে সে, একবার বাপ-ভাইর দিকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ওমা, ও বাবা, ভাইজান হুজুর বুবুরে মারতাছে কেন? বুবু তো মইরা যাইব! তোমরা কিছু কও না? ওমা, ও বাবা!

 ততক্ষণে দ্বিতীয় বাড়িটা মেরেছেন ইমাম সাহেব, কেউ কিছু বুঝতে পারল না, হঠাৎ করেই পাগলের মতো ছুটে গিয়ে তার হাতের ঝাড়ুটা আঁকড়ে ধরল পরী। ঝাড়ুটা ইমাম সাহেবের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। আমার বুবুরে আপনে মারতাছেন। কেন? কেন মারতাছেন আমার বুবুরে?

আচমকা এরকম একটি কাণ্ড, ইমাম সাহেব বেশ থতমত খেলেন। তারপর কানা। হাশেমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ওই হাশেম, এই ছেমড়িডারে ধইরা রাখ।

সঙ্গে সঙ্গে লোহার মতো শক্ত দুহাতে পরীকে ধরল হাশেম। টেনেহেঁচড়ে ভিড়ের একপাশে এনে দুহাতে পরীর দুহাত এমন করে ধরে রাখল, অসহায় শিশুর মতো ছটফট করতে লাগল পরী, চিৎকার করতে লাগল। ছাইড়া দেও আমারে, ছাইড়া দেও। আমার বুবুরে তো মাইরা হালাইল?

পরীর কথা কেউ পাত্তা দিল না।

ইমাম সাহেব তখন অবিরাম ঝাড়ু চালাচ্ছেন। নাকমুখ দিয়ে হুমহাম করে জান্তব শব্দ হচ্ছে তার। কুসুমের গায়ে একটি ঝাড়ুর বাড়ি পড়ে, বহতা হাওয়া সেই লজ্জায় স্তব্ধ হয়। কুসুমের গায়ে একটি বাড়ি পড়ে, সূর্য গুটিয়ে নেয় তার সব আলো, পৃথিবী বিষণ্ণ হয় মেঘের ছায়ায়। কুসুমের গায়ে একটি বাড়ি পড়ে, বৃক্ষরা নত হয় গভীর শোকে, মৌন হয় মুখর পাখিরা। রজতরেখার জল রঙ বদলায়, নীল হয় আশ্চর্য এক বেদনায়। জলের ওপর শ্বাস ফেলতে উঠে দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায় নিরীহ মাছ। ঝোঁপঝাড়ের ছায়ায় বিষাক্ত কালজাত থাবা দিয়ে ধরে অসহায় মেঠো ইঁদুর।

.

কুসুমের গলা আঁকড়ে, তার বুকের কাছে মুখ গুঁজে শুয়ে আছে পরী। সন্ধ্যের মুখে মুখে ওই অতটুকু শরীরের যাবতীয় শক্তি একত্রিত করে প্রায় হাঁচড়েপাঁচড়ে কুসুমকে সে বাড়ি নিয়ে এসেছে। মা-বাবা এবং তাদের একমাত্র ভাইটি কেউ ফিরেও তাকায়নি কুসুমের দিকে। বাড়ি ফিরে একটি কথাও বলেনি কেউ। প্রত্যেকেই যেন কুসুমের মতো পাথর হয়ে গিয়েছিল। প্রাণ ছিল কেবল পরীর। বোনের জন্য কী রেখে কী করবে কিছুই যেন বুঝতে পারছিল না সে। একবার বোনকে জড়িয়ে ধরে, একবার ছোট্ট দুহাত বোনের মাথায় পিঠে বুলিয়ে দেয়। ঝাড়ুর বাড়িতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া শরীর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। গভীর মমতায় সান্ত্বনা দেয় বোনকে। তুমি খুব ব্যথা পাইছ বুবু। হুজুরে যেমনে তোমারে মারল, আমি জানি তুমি খুব ব্যথা পাইছ। আমারে তো কানা হাশেম ধইরা রাখল। নাইলে আমি তোমারে মাইর খাইতে দিতাম না। দরকার হইলে তোমার মাইরটা নিজে খাইতাম। আমারে যত ইচ্ছা মারত হুজুরে। আমি কিছু কইতাম না।

কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেছে পরী। কিন্তু কুসুম নির্বিকার। একবারও পরীর মুখের দিকে তাকায়নি, একবারও কোনও কষ্টের শব্দ করেনি। ঘরের মেঝেতে বিছানো ছেঁড়াখোঁড়া হোগলায় বসেছিল তো বসেই ছিল। চোখে পলক পড়ে না, বুক ঝাঁপিয়ে পড়ে না শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ। একেবারেই বাজ পড়া মানুষ যেন।

এই বাড়িতে আজ চুলো জ্বলেনি। বাড়ির মানুষের কারোরই পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষিদের কথা যেন মনেও নেই কারও। কুসুমকে সান্ত্বনা দিতে দিতে পরী এক সময় ফিসফিসে গলায় বলেছিল, সারাদিন তুমি কিছু খাও নি। আমি জানি তোমার খুব ক্ষিদা লাগছে। বেবাকতে ঘুমানের পর চুপে চুপে টিন থিকা মুড়ি ঢাইলা আনমুনে। দুইজনে মিল্লা। খামুনে। আস অহন শুইয়া থাকি।

 দুহাতে কুসুমকে ধরে বসে থাকা জায়গায়ই তারপর শুইয়ে দিয়েছিল পরী। নিজে শুয়েছিল কুসুমের গলা জড়িয়ে, বুকের কাছে মুখ গুঁজে। এখনও ওই একই অবস্থায় আছে। তবে গভীর ঘুমে।

আলতো করে পরীর হাতটা নামিয়ে দিল কুসুম, নিঃশব্দে উঠে বসল। বেড়ার ফাঁক ফোকর দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় গতরাতের মতোই তরল হয়ে আছে ঘরের অন্ধকার। আবছা মতো দেখা যায় পরীর পাশে মায়ের আঁচল ঢাকা মুখ, চৌকির ওপর কুসুমের দিকে কাত হয়ে থাকা বাবার মুখ। গভীর ঘুমে ডুবে আছে প্রতিটি মানুষ।

বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পবনের দেয়া নাকফুলটা তারপর বের করল কুসুম। এত ধকল গেল শরীরের ওপর দিয়ে তবু জায়গা মতো রয়ে গিয়েছিল জিনিসটা। এই নাকফুল তো নাকফুল নয়। কুসুমের জীবন, মরণ!

 আশ্চর্য এক ঘোর লাগা চোখে নাক ফুলটির দিকে খানিক তাকিয়ে রইল কুসুম। তারপর অতিযত্নে নাকে পরল। পরতে পরতে পবনের উদ্দেশ্যে মনে মনে বলল, এই যে আমি তোমার দেওয়া নাকফুল পরলাম! এই যে আমি তোমার কথা মনে করলাম। তোমার কথা মনে কইরা মরতে পারলেও সুখ আমার।

গতরাতের পর এই প্রথম বুকের ভেতর উথলে উঠল কুসমের তীব্র কষ্টের এককান্না। বুক ফেটে চৌচির হল কুসুমের, চোখ ফেটে চৌচির হল। নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়াল কুসুম। তাকের ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে নিল কীটনাশকের শিশি। ইরিক্ষেতের মাজরা পোকা মারার জন্য এনে রেখেছিল মালেক।

 শিশি হাতে কুসুম তারপর ঘর থেকে বেরুল।

 ঈশ্বরের পৃথিবী তখন আশ্চর্য রকম মোহনীয় হয়েছিল। চাঁদ ছিল আকাশের ঠিক মাঝখানে। ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। নিশীথবেলার হু হু হাওয়ায় দুলছিল গাছের পাতা, পাতার সঙ্গে মিলেমিশে দুলছিল পাতার ছায়া। বহুদুরে কেঁদে ফিরছিল একাকী এক রাতপাখি। হাওয়ার টানে পাখির কান্না কাছে আসে, দূরে যায়। রাতপোকারা গলা খুলেছিল মধুর স্বরে, গানে গানে শীতল করছিল উষ্ণ মাটি। প্রকৃতির এই মহান সৌন্দর্য একটুখানি নষ্ট হয়েছিল কুসুমের কান্নায়। চোখের জলে গাল ভেসে যাচ্ছিল কুসুমের, বুক ভেসে যাচ্ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিল সে, চাঁদের দিকে তাকিয়েছিল। তারপর মুখের ওপর উপুড় করেছিল কীটনাশকের শিশি। সেই তরল আগুন বুক পুড়িয়ে নেমে যায় কুসুমের। মুহূর্তে ঝাঁপসা করে ফেলে চোখের দৃষ্টি। আস্তে ধীরে উঠোনের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কুসুম। চাঁদের আলোর নাকের ফুলখানা জ্বলজ্বল করে তার। জড়িয়ে আসা ঝাঁপসা চোখে কুসুম তবু দেখতে পায়, আশ্চর্য সুন্দর একখানা নদী বয়ে যায়। নদীতীর অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে আছে এক বৃক্ষ। বৃক্ষতলায় অপেক্ষার কষ্ট বুকে নিয়ে বসে আছে এক দুরন্ত প্রেমিক। সে কোনও শাসন মানে না, সে কোনও ধর্ম মানে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *