জাগরণ – ০৬

ছয়

অত্যন্ত কৌতূহলে ভয় ও ভাবনা মিশিয়া সাহেবের আহারের রুচি ও প্রবৃত্তি মুহূর্তে তিরোহিত হইয়া গেল। হাতের কাঁটা ও ছুরি ফেলিয়া দিয়া চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন—এ-সব কি করে হল অমরনাথ?

অমরনাথ কহিল—আপনি কোন্‌টা জানতে চাইছেন?

সাহেব ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন—তুমি কি রাগ করলে বাবা? আমি সমস্ত ব্যাপারটাই জানতে চাইচি। কিন্তু সে না হয় পরে হবে, তোমাকে আঘাত করলে কে? পুলিশ?

অমরনাথ ঘাড় নাড়িয়া কহিল—না, গ্রামের লোকই আঘাত করেছে, কিন্তু এই যে ঠিক সত্য, তাও নয় রায়-মশায়।

তা হলে সত্যটা কি?

অমরনাথ বলিল—দেখুন, এর মধ্যে সত্য শুধু এইটুকু যে, আমার ফোঁটা – কয়েক রক্তপাত হয়েছে।

সাহেব ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিলেন—কিন্তু এ কাজ আমার হাটের মধ্যেই ত হল।

অমরনাথ নীরবে সায় দিয়া জানাইল—তাই বটে।

এখনও তোমার খাওয়া-দাওয়া বোধ করি কিছুই হয়নি?

না।

সাহেব বলিলেন—তোমার বাড়ি ত খুব কাছে নয়,—কিন্তু এ বাড়িতেও উদ্যোগ আয়োজন বোধ হয় কিছুই হতে পারবে না। এখানে তুমি কিছুই খাবে না, না?

অমরনাথ একটুখানি হাসিয়া বলিল—না।

সারাদিনটা তা হলে উপবাসেই কাটলো?

অমরনাথ ইহার উত্তর কিছুই দিল না, কিন্তু বুঝা গেল, সমস্ত দিনটা তাহার উপবাসেই কাটিয়াছে। সাহেব নিশ্বাস ফেলিয়া আস্তে আস্তে বলিলেন, তা হলে আর বিলম্ব করো না, বাবা, বাড়ি যাও।—এই বলিয়া তিনি সহসা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন—চল, তোমাকে একটুখানি এগিয়ে দিয়ে আসি।

অমরনাথ ব্যস্ত হইয়া উঠিল, কহিল—সে কি কথা? আমাকে আবার এগিয়ে দেবেন কি! তা ছাড়া, খাওয়া আপনার শেষ হয়নি,—উঠতে আপনি কিছুতে পারবেন না, রায়-মশায়।

সাহেব জিদ করিলেন না, কোন বিষয়েই জিদ করা তাঁহার স্বভাব নয়। শুধু যাইবার সময় ধীরে ধীরে বলিলেন—যেজন্যে তুমি এত রাত্রে এসেছিলে, তার আভাসমাত্র পাওয়া ভিন্ন আর কিছুই জানতে পারলাম না। কিন্তু কাল যখন হোক একবার এসো, অমরনাথ।

অমরনাথ স্বীকার করিয়া প্রস্থান করিলে সাহেব কহিলেন—এ অঞ্চলে অমরের গায়ে কেউ আঘাত করতে সাহস করবে, এ কথা সহজে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। ভিতরে ভিতরে ব্যাপারটা হয়ত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তা ছাড়া আমারই হাটের মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটলো!

ভাবে বুঝা গেল, রে-সাহেবের আহারে আর প্রবৃত্তি নাই, আলেখ্য বিমর্ষ অধোমুখে খাদ্যবস্তু লইয়া খাওয়ার ভান করিতে লাগিল মাত্র। মিনিট দশ-পনর পূর্বেও ডিনারের যে উৎসব পূর্ণ উদ্যমে চলিয়াছিল, ঐ অপরিচিত লোকটার আসা ও যাওয়ার মধ্যেই সমস্ত যেন নিরুৎসাহে নিবিয়া গেল। তাহার কথাবার্তা সংক্ষিপ্ত এবং প্রাঞ্জল, এমনকি, হিন্দুত্বের গোঁড়ামির দিক দিয়া একপ্রকার সরল রূঢ়তাও আছে, অনাড়ম্বর বেশভূষা একটু বিশেষ করিয়াই চোখে পড়ে, সম্প্রতি একটা মারামারি করিয়া আসিয়াছে এবং তাহা পুলিশের বিরুদ্ধে হইলে এক ধরনের বীরত্বও আছে। কিন্তু রে-সাহেবের উচ্ছ্বসিত প্রশংসার হেতু ইন্দু বা তাহার দাদা সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিতে পারিয়া ইন্দুই প্রথমে প্রশ্ন করিল—ইনি কে, আলো?

রে-সাহেব ইহার জবাব দিলেন; কহিলেন—ইনি একজন নবীন অধ্যাপক, টোলে অধ্যাপনা করেন, গুটিকয়েক বিদেশী ছাত্রও আছে, কিন্তু অধ্যাপনার কাজ এখন বিরল হয়ে এলেও এদেশে আরও অধ্যাপক আছেন, সুতরাং এ তাঁর বিশেষত্ব নয়; অধুনা দেশের কাজে লেগে গেছেন, কিন্তু একেও অসাধারণ বলিনে। অসাধারণত্ব যে এঁর ঠিক কোথায় তাও আমি জানিনে, কিন্তু এই ভবিষ্যদ্‌বাণী আমি নিঃসংশয়ে করে যেতে পারি, ইন্দু, অমরনাথ বেঁচে থাকলে একদিন এঁকে মানুষ বলেই দেশের মানুষকে স্বীকার করতে হবে।

কাহারও ভবিষ্যদ্‌বাণীর উপরে তর্ক করা চলে না, বিশেষতঃ তিনি গুরুজনস্থানীয় হইলে নীরব হইতেই হয়। ইন্দু চুপ করিয়া রহিল; কমলকিরণ প্রশ্ন করিল—মিস্টার রে, এই লোকটাই কি আপনার প্রজাদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করেছিলেন?

সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিলেন, হাঁ।

আপনার হাটের মধ্যে ইনি গিয়েছিলেন কেন? বোধ করি এই উদ্দেশ্যেই?

সাহেব প্রশ্ন শুনিয়া হাসিলেন; কহিলেন—বিলাতী কাপড়ের বিক্রি বন্ধ করতে।

কমল কহিল—অর্থাৎ নন্-কো-অপারেশনের ভিলেজ পাণ্ডা। দোকানদারের দল বিরক্ত হয়ে তাই নবীন অধ্যাপকের রক্তপাত করেছে, এই না মিস্টার রে?

সাহেব সায় দিয়া বলিলেন—খুব সম্ভব তাই।

কমল কহিল—এবং তারা খবর দিয়ে পুলিশ এনে হাজির রেখেছিল?

আলেখ্য এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিল, সে-ই ইহার উত্তর দিল, সলজ্জ মৃদুকণ্ঠে বলিল—আমিই একদিন পুলিশের সাহায্য চেয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি লিখে দিয়েছিলাম।

কমল কহিল—ঠিক কাজ করেছিলেন, এখন শুধু এইটুকু বাকী আছে—লোকটিকে প্রসিকিউট করা। অন্তত: মার্কেট আমার হলে আমি তাই করতাম।

সাহেব কি একটা বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু তাঁহার সেদিনের হরতালের কথা মনে পড়িল, যেদিন রাগ করিয়া রাস্তার লোক কমলের পিতার গাড়ির কাচ ভাঙ্গিয়া দিয়াছিল। এ অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন নাই, অনেককেই কারাগারে যাইতে হয়েছিল। ক্ষণকাল নিঃশব্দে থাকিয়া শেষে কহিলেন—আমার মনে হয়, তাতে লাভের চেয়ে লোকসানের মাত্রাই বেশী হত কমল। হয়ত কাল কিংবা পরশু আমাদের যাকে হোক হাটের একটা ব্যবস্থা করতে যেতেই হবে, সহজে মীমাংসা হবে না,—অথচ পুলিশের লোক মধ্যে না থাক্‌লে মনে হয়, এর প্রয়োজনই হত না।

ইন্দু কৌতূহলী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল—ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে খবর দেওয়া কি আপনার মত নিয়ে হয়নি?

সাহেব কন্যার অধোমুখের প্রতি কটাক্ষে চাহিয়া কহিলেন—আমার মতামতের আবশ্যকই ছিল না, ইন্দু। তোমরা একটা কথা জান না যে, সাংসারিক সকল ব্যাপার থেকেই আমি অবসর নিয়েছি, বিষয় এখন আলোর, বিলি-ব্যবস্থা যা-ই করতে হোক, তাকেই করতে হবে। ভুল যদি হয়েও থাকে, তাকেই এর সংশোধনের ভার নিতে হবে।

কমল চকিত হইয়া বলিল—আপনি জীবিত থাকতে সে কি করে হতে পারে?

সাহেব হাসিমুখে কহিলেন—তা হলে আমি বেঁচে নেই, এই কথাই মনে করে নিতে হব।

কমল বলিল—মনে করা কঠিন এবং আলেখ্যের মত অনভিজ্ঞের এ ভার বহন করা আরও বেশী কঠিন।

ইন্দু বলিল—বিস্তর ভুলচুক হবে।

সাহেব কহিলেন—ভুলচুকের দণ্ড আছে। হলে নিতে হবে।

ইন্দু কহিল—তা ছাড়া বিপদ বাধাবার শত্রু যখন আশেপাশে রয়েছে।

সাহেব কহিলেন—আশেপাশে শত্রুই শুধু থাকে না, ইন্দু, মিত্রও থাকে। তারা বিপদ-উদ্ধারের পথ দেখিয়ে দেবে। সে যার থাকে না, সংসারে সে পরাভূত হয়। একাকী বাপ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না, মা।

ইন্দু তাহা স্বীকার করিল এবং তাহার দাদা ইহাকে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত মনে করিয়া মৌন হইয়া রহিল।

পরদিন সকালেই রে-সাহেবের অনুজ্ঞামত অমরনাথ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রাতরাশ সেইমাত্র শেষ হইয়াছে, বসিবার ঘরে সকলে আসিয়া উপবেশন করিলে সাহেব যে কথাটা সর্বপ্রথম জানিতে চাহিলেন, তাহা লোকটার নাম, যে হাটের মধ্যে তাঁহাকে আক্রমণ করিয়াছিল।

অমরনাথের মুখের ভাবে বিস্ময় প্রকাশ পাইল, জিজ্ঞাসা করিল—কেন?

সাহেব বলিলেন—এর একটা প্রতিকার হওয়া চাই।

অমরনাথ কহিল—কিন্তু আপনি ত আর কিছুর মধ্যেই নেই, রায়-মশায়।

সাহেব বলিলেন—আমি নেই সত্য, কিন্তু যিনি আছেন, তাঁর ত এ বিষয়ে কর্তব্য আছে।

পিতার ইঙ্গিত আলেখ্য বুঝিল। নয়ন গাঙ্গুলীর আত্মহত্যার পর হইতে সে গ্রামের লোকজনের সম্মুখে সহজে আসিতে চাহিত না, আসিয়া পড়িলেও নীরব হইয়াই থাকিত। তাহার সর্বদাই মনে হইত, ইহারা এই দুর্ঘটনায় তাহাকেই সর্বতোভাবে দায়ী করিয়া রাখিয়াছে এবং অন্তরালে যে-সকল কঠিন ও কটু বাক্য তাহারা উচ্চারণ করে, কল্পনায় সমস্তই সে যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইত; এবং ইহার লজ্জা তাহাকে যে কতদূর আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা শুধু সে নিজেই অনুভব করিত।

আলেখ্য পিতার প্রশ্নের সূত্র ধরিয়া বলিল, বেশ, আমিই আপনাকে তাদের নাম জানাতে অনুরোধ করছি।—এই বলিয়া আজ সে অনেকদিনের পরে মুখ তুলিয়া চাহিল। সেই শান্ত, বিষণ্ণ মুখের প্রতি অমরনাথ তীক্ষ্ণদৃষ্টি পাতিয়া ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া শেষে ধীরে ধীরে বলিল—দেখুন, তারা আপনার প্রজা, কেবলমাত্র কৌতূহলবশেই যদি তাদের পরিচয় জানতে চেয়ে থাকেন, এ কৌতূহল আপনাকে দমন করতে হবে।

আলেখ্য কহিল—তারা আমার প্রজা না হলে আপনাকে আমি জিজ্ঞাসাও করতাম না। জমিদারের একটা কর্তব্য আছে, এই অন্যায়ের আমি প্রতিকার করতে চাই।

অমরনাথ বলিল,—আপনি তাদের শাস্তি দিতে চান, কিন্তু তাতে প্রতিকার হবে না।

আলেখ্য কহিল—অন্যায়ের প্রতিকার ত শুধু শাস্তি দিয়েই হয়।

অমরনাথ মুচকিয়া হাসিয়া কহিল—এই নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাইনে এবং জমিদার কি করে প্রজার শাসন করে থাকেন, তাও আমি জানিনে। কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জানি, অন্যায় এবং অজ্ঞতা এক জিনিস নয় এবং শাস্তি দিয়েও এর কিছু প্রতিকার হবে না।

একমুহূর্ত স্থির থাকিয়া অমরনাথ পুনশ্চ কহিল, আমাকে তারা আঘাত করেছে সত্য, কিন্তু সেই আঘাতের শাস্তি দিতে যাওয়ার মত পণ্ডশ্রম আর নেই। মার খাওয়াটাই যদি আমার কাছে বড় হত, সেখানে আমি যেতাম না। আমার আঘাতে যথার্থই যদি আপনি বিচলিত হয়ে থাকেন ত এইটুকু প্রার্থনা আমার মঞ্জুর করুন, এই নিয়ে আমার প্রতি তাদের আর বিরূপ করে তুলবেন না।—এই বলিয়া অমরনাথ উঠিয়া দাঁড়াইল।(‘মাসিক বসুমতী,’ আষাঢ় ১৩৩১)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *