জাগরণ – ০৫

পাঁচ

পরদিন বাড়ি ফিরিয়া রে-সাহেব নয়ন গাঙ্গুলীর আত্মহত্যার বিবরণ শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। মেয়েকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া সোজা তাহাদের বাড়ি চলিয়া গেলেন। এতটা আলেখ্য আশা করে নাই। বিকালবেলা যখন ফিরিয়া আসিলেন, তখন মুখ তাঁহার কথঞ্চিৎ প্রসন্ন, তথাপি এ সম্বন্ধে চুপ করিয়াই রহিলেন। সেখানে কি বলিলেন, কি করিলেন, আলেখ্য তাহার কিছুই জানিতে পারিল না। সেদিনটা এইভাবেই কাটিল। পরদিন সকালে একখানা চিঠি হাতে করিয়া আসিয়া আলেখ্য পিতাকে কহিল—মিস্টার ঘোষ ইন্দুকে নিয়ে বোধ করি সন্ধ্যার ট্রেনেই এসে পৌঁছবেন।

কে, ঘোষ-সাহেব?

আলেখ্য মাথা নাড়িয়া বলিল—না, কমলকিরণ। ঘোষ-সাহেব এবং ইন্দুর মা বোধ হয় পাঁচ-ছ’দিন পরে আসবেন।

পিতা কহিলেন—আচ্ছা।

আলেখ্য কহিল—তাদের অভ্যর্থনার উপযুক্ত কিছুই বন্দোবস্ত করে উঠতে পারিনি।

পারনি? এই পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যেও কি হতে পারবে না মনে হয়?

আলেখ্য পূর্বের মত মাথা নাড়িয়া কহিল, সম্ভব নয় বাবা—এই বলিয়া সে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকিয়া কহিল, একটা অত্যন্ত বিশ্রী কাণ্ড হয়ে গেছে বাবা, তুমি বোধ হয় শুনেচ? কি দুঃখের বিষয়।

সাহেব বলিলেন, হাঁ।

তাদের সম্বন্ধে কি কোনরকম ব্যবস্থা করলে বাবা?

না, বিশেষ কিছুই করা হয়নি—এই বলিয়া সাহেব নীরব হইলেন। মেয়েকে তিনি কোনদিনই তিরস্কার করেন নাই, বিশেষতঃ সমস্ত মরিয়া-ঝরিয়া গিয়া এই বৃদ্ধ বয়সে সংসারের সর্বপ্রকার বন্ধন যখন এই কন্যাটাতেই স্থিরতা লাভ করিয়াছে, তখন হইতে এই মেয়ের কাছেই আপনাকে তিনি ধীরে ধীরে শিশুর মত করিয়া তুলিয়াছেন। সে-ই তাঁহার সর্ববিষয়ে অভিভাবক। তাহার বিরুদ্ধে বা অমতে কাজ করার শক্তি তাঁহার স্বভাবতই তিরোহিত হইয়াছে।

আলেখ্য কহিল—উপযুক্ত ব্যবস্থা কেন করে এলে না বাবা?

সাহেব বলিলেন—মা, বিষয় তোমার। সমস্ত তোমার হাতে তুলে দিয়ে আমি ছুটি নিয়েছি, এর ভাল-মন্দর ভার তোমার। যা কর্তব্য, তা তুমিই করবে।

আলেখ্য করুণকণ্ঠে কহিল—যদি বুঝতে না পেরে কোন অন্যায় করি বাবা, তবুও কি তুমি তার প্রতিকার করবে না?

পিতা বলিলেন—আমিই কি বড় বুদ্ধিমান? অন্তত: সংসারে সে প্রমাণ ত আজও দিতে পারিনি মা। আর, না বুঝে অন্যায় যদি কিছু করেই থাক, যিনি বুদ্ধি দেবার মালিক, তিনিই তোমাকে তার নিবারণের পথ বলে দেবেন।—এই বলিয়া বৃদ্ধের সজল দৃষ্টি একমুহূর্তে খোলা জানালার বাহিরে গিয়া অকস্মাৎ কোন্‌ অনির্দেশ্য শূন্যতায় স্থিতিলাভ করিল। পিতার ঠিক এই ভাবটি আলেখ্য পূর্বে কখনও লক্ষ্য করে নাই—সে যেন অবাক হইয়া গেল। ছেলেবেলা হইতে তাঁহাকে সে ষোল-আনা সাহেব বলিয়াই জানে। ধর্মমত লইয়া তিনি আলোচনা করিতেন না, ঈশ্বরে ভক্তি-বিশ্বাস আছে কি নাই, এ কথাও কোনদিন প্রকাশ করিতেন না, এবং করিতেন না বলিয়াই লোকের ঘরে-বাহিরে তাঁহাকে অবিশ্বাসী বলিয়া ধারণা ছিল। অথচ, সাবেক দিনের ক্রিয়া-কর্ম ঠাকুর-দেবতার পূজা-অর্চনা সমস্তই অব্যাহত ছিল। এই জটিল সমস্যার সমাধান করিতে আলেখ্যের জননী ইহাকে ভয় এবং দুর্বলতা বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন, আলেখ্যের নিজেরও তাহাতে সংশয় ছিল না, কিন্তু বৃদ্ধ পিতার আজ এই অদৃষ্টপূর্ব মুখের চেহারা চক্ষের পলকে যেন তাহাকে আর একটা দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল।

আলেখ্য ধীরে ধীরে বলিল—তুমি বেঁচে থাকতে আমাকে এ-দায়িত্ব দিয়ো না বাবা।

কেন মা?

আমি আদেশ তোমার লঙ্ঘন করেছি।

বৃদ্ধ সবিস্ময়ে কন্যার মুখের প্রতি চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—কি আদেশ আলো? আমার ত কোন আদেশের কথাই মনে পড়ে না মা!

আলেখ্য অধোমুখে অঞ্চলের পাড়টা আঙুলে জড়াইতে জড়াইতে চুপ করিয়া রহিল।

পিতা কহিলেন—কৈ, বললে না যে?

আলেখ্য তথাপি কিছুক্ষণ নীরবে থাকিয়া অভিমানরুদ্ধ-স্বরে আস্তে আস্তে বলিল—তবে এসে পর্যন্ত আমার সঙ্গে তুমি কথা কও না যে বড়? আমি ত এক শ’বার স্বীকার করছি, বাবা, আমি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করেছি। কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি, আমাকে তিনি এত বড় শাস্তি দিয়ে যাবেন। আমি তোমার কাছেও মুখ দেখাতে পারছি নে বাবা, আমি এদেশে আর থাকবো না।—এই বলিয়া সে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

সাহেব কাছে আসিয়া ধীরে ধীরে মেয়ের মাথায় হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন,—কিছুই বলিলেন না। এমনিভাবে কিছুক্ষণ কাটিল, বোধ হয় মিনিট পাঁচ-ছয়ের বেশী নয়, কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে তাহার দুর্বলচিত্ত বৃদ্ধ পিতার যে পরিচয় আলেখ্যের ভাগ্যে জুটিল, তাহা যেমন অভাবনীয়, তেমনি মধুর। এই বিশ বৎসর বয়েসের মধ্যে ইহার আভাস পর্যন্তও কখনও তাহার চোখে পড়ে নাই। আজ মায়ের জন্য তাহার ক্লেশ বোধ হইতে লাগিল, এত বড় মাধুর্যের কোন আস্বাদই তিনি জীবনে উপভোগ করিয়া যাইতে পারিলেন না। পিতা সমাজে কখনও যান নাই, উপাসনায় কোন দিন যোগ দেন নাই, ভগবৎ-বিশ্বাসহীন নাস্তিক বলিয়া মনে মনে জননীর যেমন ক্ষোভ ছিল, স্বামীর চিত্ত-দৌর্বল্যের জন্যও পরিচিত আত্মীয়বন্ধুজনের সমক্ষেও তাঁহার তেমনি লজ্জার কারণ ছিল। পিতার প্রতি আলেখ্যের স্নেহ ও প্রীতি সংসারে কোনও সন্তানের চেয়েই হয়ত কম ছিল না, কিন্তু পুরুষোচিত শক্তি, সামর্থ্য ও দৃঢ়তার অভাব এই রোগ-জীর্ণ নিরীহ লোকটির বিরুদ্ধে আরোপ করিয়া মায়ের নিকট হইতে একটা করুণ অশ্রদ্ধার ভাবই সে উত্তরাধিকারের মত পাইয়াছিল। সেই পিতাকে অকস্মাৎ আজ সে এক সম্পূর্ণ নূতন দিক হইতে লক্ষ্য করিবার অবকাশ পাইয়া ভক্তি, শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় একেবারে বিগলিত হইয়া গেল। এমন করিয়া সে একটা দিনও তাঁহাকে দেখিবার সুযোগ পায় নাই। নানা লোকের নানা উক্তি ও বিভিন্ন মতামত দিয়া এই দিকটাই যেন তাহার চোখের সম্মুখে একেবারে আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া ছিল। আজ অনুশোচনায় ও আত্মধিক্কারে হৃদয় পূর্ণ করিয়া সে পিতার স্নেহস্পর্শের নীচে নিঃশব্দে বসিয়া ভাবিতে লাগিল, হয়ত পিতা নিজের মত দুর্বল ও শক্তিহীন জানিয়াই তাঁহার বহুদিনের আশ্রিত অতিবৃদ্ধ গাঙ্গুলীকে মনে মনে স্নেহ করিতেন, তাঁহার প্রতি এত বড় কঠিন অবিচার হইয়া গেল, তিনি নিবারণ করিতে পারিলেন না, তাই নীরবে তাঁহার শোকাচ্ছন্ন কন্যা-দৌহিত্রের কাছে গিয়া তেমনি নীরবে কি যে করিয়া আসিলেন, কাহাকেও জানিতে দিলেন না, অথচ এতবড় অন্যায় যাহার দ্বারা অনুষ্ঠিত হইল, তাহাকে একটি ক্ষুদ্র তিরস্কারেও লাঞ্ছিত করিলেন না, দুই বিভিন্ন দিকের সমস্ত ব্যথাই নির্বাক হইয়া নিজের বুক পাতিয়া গ্রহণ করিলেন।

অপরাধী কন্যাকে যে ভার, যে দায়িত্ব একদিন তিনি নিজের হাতে অর্পণ করিয়াছিলেন, তাহা প্রত্যাহার করিয়া আর তাহার লজ্জার পরিমাণ বৃদ্ধি করিয়া দিলেন না। বাহিরের লোকের কাছে হয়ত ইহা দুর্বলতার নামান্তর বলিয়াই প্রতিভাত হইবে, কিন্তু আলেখ্য আজ তাহার নব-লব্ধ দৃষ্টি দিয়া স্পষ্ট দেখিতে পাইল, কত বড় বিশ্বাস ও স্নেহের শক্তি ইহারই মধ্যে সহজে আত্মগোপন করিয়া আছে।

আলেখ্য অঞ্চলে চোখ মুছিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল—বাবা! সংসারের ভার আর যদি তুমি ফিরে নিতে না চাও, আমাকে কি তুমি পথ দেখিয়েও দেবে না?

সাহেব হাসিয়া কহিলেন—তুমি ত জান মা, সংসারযাত্রায় আমি দ্রুতপদে চলতে পারিনি—সকলের পিছনেই আমি পড়ে গেছি। সেই পিছনের পথটাই আমি কেবল দেখাতে পারি, কিন্তু সে ত সকলের মনোমত হবে না।

আলেখ্য কহিল—আমার হবে বাবা।

সাহেব বলিলেন—যদি হয় নিয়ো; কিন্তু নিতেই হবে, তা কোনদিন মনে করো না।

আলেখ্য ক্ষণকালমাত্র চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল—আমরা সবাই মিলে যখন দৌড়ে চলেছিলাম, তখন কেন যে তুমি পেছিয়ে চলতে বাবা, আজ যেন তার আভাস পেয়েছি। এখন থেকে যেন তোমার পায়ের দাগ ধরেই চলতে পারি বাবা, আমাকে তুমি সেই আশীর্বাদ কর।

সাহেব হাসিয়া তাহার মাথায় আর একবার হাত বুলাইয়া দিয়া শুধু কহিলেন—পাগলি! এই বুড়োর সঙ্গে কি তোরা চলতে পারবি মা? সে ধৈর্য কি তোদের থাকবে?

আলেখ্য বলিল—তোমাকে দেখে আজ এই কথাটাই সবচেয়ে বেশী মনে হচ্ছে বাবা, কেবল দৌড়ে বেড়ানোই এগোনো নয়। তাই, তুমি যখন ধীরে ধীরে পা ফেলে চলতে, আমরা সবাই ভাবতুম, তুমি পেছিয়ে পড়ছ। আজ থেকে তোমার পায়ের চিহ্নই যেন সকল পথে আমার চোখে পড়ে।

সাহেব স্থির হইয়া রহিলেন। কিন্তু সে হাতখানি তাঁহার তখনও আলেখ্যের মাথার ’পরে ছিল, সেই পাঁচ আঙুলের স্পর্শ দিয়া যেন পিতার অন্তরের আশীর্বাদ কন্যার সর্বাঙ্গে ক্ষরিয়া পড়িতে লাগিল।

খানিকক্ষণ এমনি নিঃশব্দে কাটিবার পরে আলেখ্য কহিল—বাবা, কাল তোমার খুড়ো-মশাই এসেছিলেন।

খুড়ো-মশাই? সাহেব সবিস্ময়ে কন্যার প্রতি চাহিলেন।

কন্যা কহিল—ছেলেবেলায় তাঁকে তুমি এই বলে ডাকতে। পণ্ডিত ব্রাহ্মণ। নিমাই ভট্টাচায্যি নাম।

সাহেব অত্যন্ত আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—তিনি বেঁচে আছেন? এত বড় আসল মানুষ সহজে মেলে না, মা। তাঁর কোনরূপ অমর্যাদা হয়নি ত?

আলেখ্য মাথা নাড়িয়া জানাইল, না। কহিল, তিনি এসেছিলেন আমার পরিচয় নিতে এবং তাঁর ছেলেবেলায় এই ঐশ্বর্যময়ী বাংলাদেশে যে কত ঐশ্বর্য ছিল তার পরিচয় দিতে। সে কি আশ্চর্য ছবি বাবা! ফুলে-ফলে, শস্যে-ধানে, শোভায়-স্বাস্থ্যে কি সম্পদই না এদেশের ছিল! আমার ভুলের সীমা নেই; আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত নেই,—এ কথা আমি স্বপ্নেও অস্বীকার করিনে, কিন্তু আমার মত একটা সামান্য মেয়ের অন্যায়ের ফলে যে-দেশে এত বড় মর্মান্তিক ঘটনা ঘটতে পারে, তাকে নিবারণ করবার কোন সম্বল যে-দেশের হাতে নেই, সর্বরকমে কাঙাল করে যারা এই সোনার দেশকে এতবড় নিঃস্ব-নিরুপায় করে তুলেছে, তাদের অপরাধেরই কি অবধি আছে বাবা?

সাহেব গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া কহিলেন—হুঁ। তখনকার দিনে উপবাসের ভয়ে যে তাঁকে আত্মহত্যা করতে হত না, সে ঠিক। চাকরি গেলেও তাঁরা না খেয়ে মরতেন না। গ্রামের মধ্যে দু’মুঠো অন্ন তাঁদের জুটতো।

আলেখ্য বলিল,—অক্ষম অপারক বলে আমার ভুল ত সে থেকে তাঁকে বঞ্চিত করতে পারত না! এবং এত বড় কলঙ্কের ছাপ ত সে–দিনে আমার কপালেও ছাপ মেরে যেত না!—এই বলিয়া সে ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া পুনশ্চ রুদ্ধকণ্ঠে বলিতে লাগিল, বাবা, তোমরা সবাই বলো, পৃথিবী সম্পদে সভ্যতায় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই বাঙলাদেশে আমরাই তাদের অগ্রদূত,—নিমাই ভট্‌চায্যি তাই আজ আমাকে দেখতে এসেছিলেন, কিন্তু এত বড় তামাশা কি আর আছে? গাঙ্গুলী-মশায়ের পীড়িত উদ্‌ভ্রান্ত আত্মার কল্যাণ হোক, কিন্তু যে সভ্যতায় দরিদ্রের মুখের গ্রাস, দুঃখীর জীবন ধনীর মুঠোর মধ্যে এমন ভয়ানক নিরুপায় করে এনে দেয়, তাকে কেউ রক্ষে করতে পারে না, সে কি-রকম সভ্যতা? আর তাই যদি হয় বাবা, এ সভ্যতায় আমার কাজ নেই। এই নির্দয় প্রহসন থেকে আমার মুক্তি চাই।

পিতা মুখ তুলিয়া চাহিলেন। কন্যার বেদনাতুর হৃদয়ের ক্ষুব্ধ উত্তেজনাকে শান্ত করিতে নিজেও শান্তকণ্ঠে কহিলেন—উপায় কি মা? দুঃখী-দরিদ্র চিরদিনই ধনীর হাতের মধ্যে থাকে আলো, এমনিই সংসারের বিধান।

আলেখ্য শান্ত হইতে পারিল না, কহিল—না বাবা, এ বিধান যতই পুরানো, যতই কেননা চিরদিনের হউক, কিছুতেই ভাল না। জগতে ধনী ও দরিদ্র যদি থাকে ত থাক, কিন্তু এমন একান্তভাবে, এমন উপায়হীন কঠিন বাঁধনে কেউ কারও হাতের মধ্যে থাকা কোনমতেই মঙ্গলের বিধান হতে পারে না বাবা। ধনীরও না, দরিদ্রেরও না। এতটুকু মুঠোর চাপে যার মানুষ মারা পড়ে, অন্ততঃ, সে কিছুতেই বলতে পারে না। লোকে বলে, তার মাথা ঠিক ছিল না, তবু ত আমি এ কথাটাও জীবনে ভুলতে পারব না যে, তার পাঁচ বৎসরের আয়ু আমার ঐ একটা আয়নার মধ্যেই রয়ে গেছে। আরও কত লোকের মরণ-ইতিহাস যে আমার জুতো-জামার পরতে পরতে লেখা আছে, তাই বা কে জানে বাবা?

তাহার কথা শুনিয়া বৃদ্ধ পিতা ভয় পাইলেন; জোর করিয়া একটু হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন—পাগল আর কি! তা হলে ত সংসারে আর বাস করা চলে না আলো!

আলেখ্য জবাব দিল—তোমার কপালে ত বুড়োমানুষের রক্তের দাগ নেই বাবা।

পিতা কহিলেন—তোমার যত দোষ এঁরা তোমাকে বুঝিয়ে গেছেন মা, তার সবই সত্য নয়।

মেয়ে বলিল—আমি কি এর দাগ মুছতে পারব না বাবা?

বাবা বলিলেন—কেন পারবে না? তোমার কোন কাজেই ত আমি বাধা দিইনে মা।

রূপার রেকাবিতে একখানা হলদে রঙের খাম রাখিয়া বেহারা আসিয়া উপস্থিত হইল। আলেখ্য খুলিয়া দেখিয়া পিতার হাতে দিয়া কহিল—ইন্দুকে নিয়ে কমলকিরণ আসছেন।

কখন?

আজই সন্ধ্যার ট্রেনে।—এই বলিয়া আলেখ্য অন্যত্র চলিয়া গেল।

সে চলিয়া গেলে রে-সাহেব সেইখানে বসিয়াই নানা কথা চিন্তা করিতে লাগিলেন। এই অত্যন্ত শোকাবহ ঘটনার সুতীব্র আঘাতে আলেখ্যের মনের মধ্যে যে ঝড় বহিতে শুরু করিয়াছে, তাহার গুরুত্ব কত এবং কতখানি ব্যাপক হইয়া জীবনকে তাহার অধিকার করিবে, এবং সমাজের মধ্যে ইহার ফলাফল কি, তাহাই উদ্বিগ্নচিত্তে মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন।

যে ক্ষুদ্রায়তন সঙ্কীর্ণ সমাজের মাঝে তাঁহার জীবনের দীর্ঘকাল কাটিয়া গেল, তাহার প্রতি তাঁহার মমতা ও প্রীতি ধীরে ধীরে যে কমিয়া আসিতেছিল, এ কথা তিনি মুখ ফুটিয়া ব্যক্ত না করিলেও নেতৃস্থানীয়গণের অগোচর ছিল না। কিন্তু তাই বলিয়া মেয়ের সম্বন্ধে এমন কথা কখনও তিনি কল্পনাও করিতেন না যে, যে সমাজ ও সংস্কারের মধ্যে দিয়া সে বড় হইয়া উঠিয়াছে, তাহাকেই অশ্রদ্ধা করিয়া সে কিছুতেই সুখী হইতে পারে! এ আশ্রয় হইতে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাহার কোনমতেই চলিতে পারে না। এ বিশ্বাস তাঁহার দৃঢ় ছিল। ঘোষ-সাহেব ও তাঁহার পারিবারিক চালচলনের প্রতি মনে মনে তাঁহার অতিশয় বিরাগ ছিল, কন্যার প্রতি ইহাদের দৃষ্টি আছে, এ কথা মনে করিয়াও মনের মধ্যে তাঁহার জ্বালা করিত; কিন্তু আজ তাহাদের আসার সংবাদে তিনি শুধু খুশী নন, যেন নিশ্চিন্ত হইলেন। ইন্দুমতী আলেখ্যের ছেলেবেলার বন্ধু এবং কমলকিরণও যে অবাঞ্ছিত অতিথি নয়, এ ধারণা তাঁহার ছিল। সম্প্রতি যে অঘটন ঘটিয়া গেছে, যাহাকে ফিরাইবার আর পথ নাই, তাহাকেই কেন্দ্র করিয়া সমস্ত গ্রামের মধ্যে যে গ্লানি ও শোকোচ্ছ্বাসের তুফান ছুটিয়াছে, তাহারই ধাক্কা হইতে মেয়েটা যদি কিছুদিনের জন্যও নিষ্কৃতি পায়, ব্যাপারটাকে যদি দুটা দিনও ভুলিয়া থাকিতে পারে, এই মনে করিয়া সাহেব আগে হইতেই তাঁহার অতিথিদের অন্তরের মধ্যে সংবর্ধনা করিলেন। সেইদিন সন্ধ্যার অব্যবহিত পূর্বে ভগিনীকে লইয়া কমলকিরণ আলেখ্যের পৈতৃক বাসভবনে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সাহেব নিজে থাকিয়া তাঁহাদের আদর করিয়া গ্রহণ করিলেন। আলেখ্য পাশে দাঁড়াইয়া সভ্য-সমাজের সর্বপ্রকারে অনুমোদিত অভ্যর্থনার কোথাও কোন ত্রুটি করিল না, কিন্তু তবুও তাহার মুখের চেহারায় আগন্তুক এই দুটি ভাই-বোনে কি যে সহসা দেখিতে পাইল, তাহাদের মন যেন একেবারে দমিয়া গেল।

বাহিরে তাহার প্রকাশ নাই, রাত্রে ডিনারের আয়োজন একটু বিশেষ করিয়াই হইল।

মুসলমান বাবুর্চির এত দিন প্রায় একরকম ঘুমাইয়া কাটিতেছিল, সে তাহার যথাসাধ্য করিল। ফুলের সময় নয়, তথাপি টেব্‌লে তাহার অপ্রতুল হইল না, প্রয়োজনের অনেক বেশী আলো জ্বলিল, সদ্য-রং-করা দেওয়ালের গায়ে ও সাহেব-বাড়ির দীর্ঘায়তন মুকুরে তাহার সমস্ত রশ্মি প্রতিফলিত হইয়া ঘরটাকে যেন দিনের বেলা করিয়া দিল।

রূপার ছুরি-কাঁটা, রূপার চামচ, রৌপ্যের বাতিদান, দুর্মূল্য পাত্রে দুর্মূল্য ভোজ্য ও পেয়, তুষারশুভ্র চাদরের উপরে সে যেন কেবল চোখ মেলিয়া চাহিয়া দেখিবার। সজ্জায় ও শোভায়, পোশাক ও পরিচ্ছদে, হাসি ও গল্পে, বিলাস ও ব্যসনে মনে হইল, যেন একটা দুঃখ ও পীড়নের ভূত সহসা গয়ায় পিণ্ডলাভ করিয়া এই একটা বেলার মধ্যেই বাড়িটাকে ছাড়িয়া গিয়াছে।

ডিনার অগ্রসর হইয়া চলিল। অজীর্ণ-রোগগ্রস্ত রে-সাহেবের উৎসাহে, তাঁহার ছুরি ও কাঁটার ক্ষিপ্র পরিচালনে হঠাৎ যেন তাঁহাকে চেনাই যায় না। ঠিক এমনই সময়ে বেহারা আসিয়া তাঁহার হাতে একটুকরা কাগজ দিল। চশমার অভাবে তিনি হাত বাড়াইয়া কাগজটুকু ইন্দুর হাতে দিয়া বলিলেন—দেখ ত মা কে?

ইন্দু পড়িয়া কহিল, অমরনাথ।

সাহেব অত্যন্ত কৌতূহলী হইয়া বলিলেন—ফিরেছে সে? আমি কতই না ভাবছিলাম।—কমলকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, সে আমাদের বাড়ির ছেলের মত। ঝড়ু, তাকে এইখানেই ডেকে নিয়ে আয়।

আলেখ্য শঙ্কিত হইয়া কহিল—এই ঘরে?

সাহেবের সেদিকে চোখ ছিল না, বলিলেন—হ’লই বা। কমল, এমন একটি ছেলে কিন্তু বাবা, আর কখনও চোখে দেখনি। আমাদের মধ্যে ত ছেড়েই দাও, হয়ত বিলেতেও কখনও দেখতে পাওনি। যা না ঝড়ু, দাঁড়িয়ে রইলি কেন?

ঝড়ু চলিয়া গেল এবং অনতিকাল পরেই লোকটিকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া উপস্থিত হইল। তাহার খালি পা, মুখ অতিশয় শুষ্ক ও মলিন, মনে হয় যেন সমস্তদিন তাহার জলবিন্দুটুকুও জুটে নাই, মাথার একদিকে ব্যান্ডেজ করা—রক্তের দাগ তখনও কালো হইয়া আছে, সাহেব চমকিয়া উঠিলেন,—ব্যাপার কি অমরনাথ—এ কি কাণ্ড?

আগন্তুক চারিদিকে নিঃশব্দে বার বার দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। ভোজনে ক্ষণকালের জন্য তাঁহাদের বাধা পড়িল বটে, কিন্তু দরিদ্র, মূর্খ, ক্ষুধিত, বঞ্চিত এই পল্লীর মাঝখানে এই আহারের আয়োজন তাহার কাছে যেন বিড়ম্বনা একেবারে মূর্তিমান হইয়া দেখা দিল। (‘মাসিক বসুমতী,’ বৈশাখ ১৩৩১)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *