সত্যাশ্রয়ী

ছাত্র, যুবক ও সমবেত বন্ধুগণ,—বাংলাভাষায় শব্দের অভাব ছিল না; অথচ, এই আশ্রমের যাঁরা প্রতিষ্ঠাতা, তাঁরা বেছে বেছে এর নাম দিয়েছিলেন ‘অভয় আশ্রম’। বাইরের লোকসমাজে প্রতিষ্ঠানটিকে অভিহিত করার নানা নামই ত ছিল, তবু তাঁরা বললেন—অভয় আশ্রম। বাইরের পরিচয়টা গৌণ, মনে হয় যেন সঙ্ঘ স্থাপনা করে বিশেষভাবে তাঁরা নিজেদেরই বলতে চেয়েছিলেন—স্বদেশের কাজে যেন আমরা নির্ভয় হতে পারি, এ জীবনের যাত্রাপথে যেন আমাদের ভয় না থাকে। সর্বপ্রকার দুঃখ, দৈন্য ও হীনতার মূলে মনুষ্যত্বের চরম শত্রু ভয়কে উপলব্ধি করে বিধাতার কাছে তাঁরা অভয় বর প্রার্থনা করে নিয়েছিলেন। নামকরণের ইতিহাসে এই তথ্যটির মূল্য আছে; এবং আজ আমার মনের মধ্যে কোন সংশয় নেই যে, সে আবেদন তাঁদের বিধাতার দরবারে মঞ্জুর হয়েছে। কর্মসূত্রে এঁদের সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয়। দূরে থেকে সামান্য যা-কিছু বিবরণ শুনতে পেতাম, তার থেকে মনের মধ্যে আমার এই আকাঙ্ক্ষা প্রবল ছিল—একবার নিজের চোখে গিয়ে সমস্ত দেখে আসব। তাই, আমার পরম প্রীতিভাজন প্রফুল্লচন্দ্র যখন আমাকে সরস্বতীপূজা উপলক্ষে এখানে আহ্বান করলেন, তাঁর সে আমন্ত্রণ আমি নিরতিশয় আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করলাম। শুধু একটি মাত্র শর্ত করিয়ে নিলাম যে, অভয় আশ্রমের পক্ষ থেকে আমাকে অভয় দেওয়া হোক যে, মঞ্চে তুলে দিয়ে আমাকে অসাধ্য-সাধনে নিযুক্ত করা হবে না। বক্তৃতা দেবার বিভীষিকা থেকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হবে। জীবনে যদি কিছুকে ভয় করি ত একেই করি। তবে এটুকুও বলেছিলাম—যদি সময় পাই ত দু-এক ছত্র লিখে নিয়ে যাব। সে লেখা প্রয়োজনের দিক থেকেও যৎসামান্য, উপদেশের দিক দিয়েও অকিঞ্চিৎকর। ইচ্ছে ছিল, কথার বোঝা আর না বাড়িয়ে উৎসবের মেলামেশায় আপনাদের কাছ থেকে আনন্দের সঞ্চয় নিয়ে ঘরে ফিরব। আমি সে সঙ্কল্প ভুলিনি এবং এই দু-দিনে সঞ্চয়ের দিক থেকেও ঠকিনি। কিন্তু এ আমার নিজের দিক। বাইরেও একটা দিক আছে, সে যখন এসে পড়ে, তার দায়িত্বও অস্বীকার করা যায় না। তেমনি এলো প্রফুল্লচন্দ্রের ছাপানো কার্য-তালিকা। রওনা হতে হবে, সময় নেই,—কিন্তু পড়ে দেখলাম, অভয় আশ্রম পশ্চিম-বিক্রমপুর-নিবাসী ছাত্র ও যুবকদের মিলনক্ষেত্রের আয়োজন করেছে। ছেলেরা এখানে সমবেত হবেন। তাঁরা আমাকে অব্যাহতি দেবেন না; বলবেন,—কিশোর বয়স থেকে ছাপা-বইয়ের ভিতর দিয়ে আপনার অনেক কথা শুনেছি, আজও যখন কাছে পেয়েছি, তখন যা হোক কিছু না শুনে ছাড়ব না। তারই ফলে এই কয়েক ছত্র আমার লেখা। মনে হবে তা বেশ ত, কিন্তু এতবড় ভূমিকার কি আবশ্যক ছিল? তার উত্তরে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভিতরের বস্তু যখন কম থাকে, তখন মুখবন্ধের আড়ম্বর দিয়েই শ্রোতার মুখ বন্ধের প্রয়োজন হয়।

নিজের চিন্তাশীলতায় নূতন কথা বলবার আমার শক্তি-সামর্থ্য কিছুই নাই, স্বদেশবৎসল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মুখে বহু সভা-সমিতিতে যে-সকল কথা আপনারা বহুবার শুনেছেন, আমি সেই সবই শুধু লিপিবদ্ধ করে এনেছি। ভেবেছি, অভিনবত্ব নাই থাক, মৌলিকত্ব যত বড় হোক, তার চেয়েও বড় সত্য কথা। পুরানো বলে সে তুচ্ছ নয়, তাকে আর একবার স্মরণ করিয়ে দেওয়াও বড় কাজ। তেমনি মাত্র গুটি দুই-তিন কথাই আজ আমি আপনাদের কাছে উল্লেখ করব।

কিছুদিন থেকে একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করে আসছি। ভাবি, এতবড় সত্যটা এতকাল গোপনে ছিল কি করে? সেদিনও সবাই জানত, সবাই মানত—পলিটিক্স জিনিসটা কেবল বুড়োদেরই ইজারা মহল। আবেদন-নিবেদন, মান-অভিমান থেকে শুরু করে চোখ-রাঙ্গানো পর্যন্ত বিদেশী রাজশক্তির সঙ্গে যা-কিছু মোকাবিলার দায়িত্ব, সব তাদের। ছেলেদের এখানে একেবারে প্রবেশ নিষেধ। শুধু অনধিকার-চর্চা নয়, গর্হিত অপরাধ। তারা ইস্কুল-কলেজে যাবে, শান্তশিষ্ট ভাল ছেলে হয়ে পাস করে বাপ-মায়ের মুখোজ্জ্বল করবে—এই ছিল সর্ববাদিসম্মত ছাত্র-জীবনের নীতি। এর যে কোন ব্যত্যয় ঘটতে পারে, এর বিরুদ্ধে যে প্রশ্ন মাত্র উঠতে পারে, এ ছিল যেন লোকের স্বপ্নাতীত। হঠাৎ কোথাকার কোন্‌ উলটো ঝোড়ো হাওয়ায় এর কেন্দ্রটাকে ঠেলে নিয়ে একেবারে যেন পরিধির বাইরে ফেলে দিলে। বিদ্যুৎ-শিখা যেমন অকস্মাৎ ঘনান্ধকারের বুক চিরে বস্তুর প্রকাশ করে, নৈরাশ্য ও বেদনার অগ্নি-শিখা তেমনি করেই আজ সত্য উদ্ঘাটিত করেছে। যা চোখের অন্তরালে ছিল, তা দৃষ্টির সুমুখে এসে পড়েছে। সমস্ত ভারতবর্ষময় কোথাও আজ সন্দেহের লেশমাত্র নেই যে, এতদিন লোকে যা ভেবে এসেছে তা ভুল, সত্য তাতে ছিল না বলেই বিধাতা বারংবার ব্যর্থতার কালিমা দেশের সর্বাঙ্গে মাখিয়ে দিয়েছেন। এ গুরুভার বৃদ্ধদের জন্যে নয়, এ ভার যৌবনের। তাই ত আজ ইস্কুল-কলেজে, নগরে-পল্লীতে, ভারতের প্রত্যেক ঘরে ঘরে যৌবনের ডাক পড়েছে। ডাক বৃদ্ধরা দেয়নি, দিয়েছেন বিধাতাপুরুষ নিজে। তাঁর আহ্বান কানের মধ্যে দিয়ে এদের বুকে পৌঁছেছে যে, জননীর হাতে-পায়ে বাঁধা এই কঠিন শৃঙ্খল ভাঙ্গবার শক্তি অতি প্রাজ্ঞ প্রবীণের হিসাবী বুদ্ধির মধ্যে নেই, এই শক্তি আছে শুধু যৌবনের প্রাণচঞ্চল হৃদয়ের মধ্যে। এই নিঃসংশয় আত্মবিশ্বাসে আজ তাকে প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে। এতদিন বিদেশীয় বণিক রাজশক্তির কোন চিন্তাই ছিল না, বৃদ্ধের রাজনীতি চর্চাকে সে খেলাচ্ছলেই গ্রহণ করে এসেছিল, কিন্তু এখন তার আর খেলার অবকাশ নেই। দিকে দিকে এ চিহ্ন কি আপনাদের চোখে পড়েনি? যদি না পড়ে থাকে, চোখ মেলে চেয়ে দেখতে বলি। রাজশক্তি আজ ব্যাকুল এবং অচিরভবিষ্যতে এই অন্ধ-ব্যাকুলতায় দেশ ছেয়ে যাবে—এ সত্যও আজ আপনাদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে বলি। আরও বলি, সেদিন যেন এই সত্যোপলব্ধির অবমাননা না ঘটে।

এখানে একটা কথা বলে রাখি। কারণ, সন্দেহ হতে পারে, সর্বদেশেই ত রাজনীতি পরিচালনার ভার বৃদ্ধদের স্কন্ধে ন্যস্ত থাকে, কিন্তু এখানে তার অন্যথা হবে কেন? অন্যথা এখানেও হবে না, একদিন তাঁদের ‘পরেই রাজ্যশাসনের দায়িত্ব পড়বে। কিন্তু সেদিন আজ নয়। এখনও সে এসে পৌঁছয় নি। কারণ, দেশ শাসন করা ও স্বাধীন করা এক বস্তু নয়। এ কথা মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন যে, রাজনীতি-পরিচালনা একটা পেশা। যেমন ডাক্তারি, ওকালতি, প্রফেসারি,—এমনি। অন্যান্য সমুদয় বিদ্যার মত একেও শিক্ষা করতে হয়, আয়ত্ত করতে সময় লাগে। তর্কের মার-প্যাঁচ, কথা-কাটাকাটির লড়াই, আইনের ফাঁক খুঁজে কড়া করে দু-কথা শুনিয়ে দেওয়া,—আবার যথাসময়ে আত্মসংবরণ ও বিনীত ভাষণ,—এ-সকল কঠিন ব্যাপার, এবং বয়স ছাড়া এতে পারদর্শিতা জন্মে না। এরই নাম পলিটিক্স। স্বাধীন দেশে এর থেকে জীবিকা-নির্বাহ চলে। কিন্তু পরাধীন দেশে সে ব্যবস্থা নয়। সেখানে দেশের মুক্তি-অর্জন-পথে পদে পদে আপনাকে বঞ্চিত করে চলতে হয়ে। এ ত তার পেশা নয়, এ তার ধর্ম। তাই, এই পরম ত্যাগের ব্রত শুধু যৌবনই গ্রহণ করতে পারে। এ তার স্বাধিকার- চর্চা, অনধিকার-চর্চা নয় বলেই রাজশক্তি একে ভয়ের চক্ষে দেখতে আরম্ভ করেছে। এ-ই স্বাভাবিক, এবং এর গতিপথে বাধার অবধি থাকবে না, এ-ও তেমনি স্বাভাবিক। কিন্তু এই সত্যটাকে ক্ষোভের সঙ্গে নয়, আনন্দের সঙ্গেই মেনে নিয়ে অগ্রসর হতে আজ আপনাদের আমি আহ্বান করি।

শব্দের ঘটায় ও বাক্যের ছটায় উত্তেজনার সৃষ্টি করতে আমি অপারক। শান্ত-সমাহিত চিত্তে সত্যোপলব্ধি করতেই আমি অনুরোধ করি। আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি, আমাদের এই ছিল, এই ছিল, এই ছিল এবং এই আছে, এই আছে, এই আছে—সুতরাং ঘুম ভেঙ্গে চোখ রগড়ে উঠে বসলেই সব পাব, এ যাদুবিদ্যার আশ্বাস দিতে আমার কোন কালেই প্রবৃত্তি হয় না। জগৎ মানুক আর না মানুক, আমরা মস্ত বড় জাতি, এ কথা বহু আস্ফালনে দিকে দিকে ঘোষণা করে বেড়াতেও যেমন আমি গৌরব বোধ করিনে, তেমনি, বিদেশী রাজশক্তিকেও ধিক্কার দিয়ে ডেকে বলতে লজ্জা বোধ করি যে, হে ইংরাজ, তোমরা কিছুই নয়, কারণ, অতীতকালে আমরা যখন এই এই মস্ত বড় বড় কাজ করেছি, তোমরা তখন শুধু গাছের ডালে ডালে বেড়াতে।

এবং বিদ্রূপ করে কেউ যদি আমাকে বলে—তোমরা যদি সত্যই এত বড়, তবে হাজার বছর ধরে একবার পাঠান, একবার মোগল, একবার ইংরাজের পায়ের তলে তোমাদের মাথা মুড়োয় কেন, তবে এ উপহাসের প্রত্যুত্তরেও আমি ইতিহাসের পুঁথি ঘেঁটে অন্যান্য জাতির দুর্দশার নজির দেখাতেও ঘৃণা বোধ করি। বস্তুতঃ এ তর্কে লাভ নেই। বিগত দিনে তোমার আমার কি ছিল, এ নিয়ে গ্লানি বাড়িয়ে কি হবে,—আমি বলি, ইংরাজ, আজ তুমি বড়; শৌর্যে, বীর্যে, স্বদেশপ্রেমে তোমার জোড়া নেই; কিন্তু আমারও বড় হবার সমস্ত মালমশলা মজুত। আজ দেশের যৌবন-চিত্ত পথের খোঁজে চঞ্চল হয়ে উঠেছে, তাকে ঠেকাবার শক্তি কারও নেই, তোমারও না। তুমি যত বড়ই হও, সে তোমারই মত বড় হয়ে তার জন্মের অধিকার আদায় করে নেবেই নেবে।

কিন্তু কোন্‌ সংজ্ঞায় যৌবনকে নির্দেশ করা যায়? অতীত যার কাছে অতীতের বেশী নয়, সে যত বৃহৎ হোক, মুগ্ধ-চিত্ত তলে তাকেই লালন করে কালক্ষেপের অবসর যার নেই, যার বৃহত্তর আশা ও বিশ্বাস অনাগতের অন্তরালে কল্পনায় উদ্ভাসিত—সেই ত যৌবন। এখানেই বৃদ্ধের পরাজয়। শক্তি তার নিঃশেষিতপ্রায়, ভবিষ্যৎ আশাহীন শুষ্ক, সম্মুখ অবরুদ্ধ, শেষ জীবনের বাকী দিন-ক’টা তাই প্রাণপণে অতীতকে আঁকড়ে থাকাই তার সান্ত্বনা। এ অবলম্বন সে কোন মতেই ছাড়তে পারে না, কেবলই ভয় হয়, এর থেকে বিচ্যুত হলে তার দাঁড়াবার স্থান আর কোথাও থাকবে না। স্থিতিশীল শান্তিই তার একান্ত আশ্রয়, বহুদিন আবদ্ধ খাঁচার পাখির মত, মুক্তিই তার বন্ধন, মুক্তিই তার সুনিয়ন্ত্রিত অভ্যাসসিদ্ধ প্রাণধারণ-প্রণালীর যথার্থ অন্তরায়। এইখানেই যৌবনের সঙ্গে তার প্রচণ্ড বিভেদ। দেশের সমাজের জাতির মুক্তি-বিধানের দায়িত্ব যতদিন এই বৃদ্ধদের হাতেই থাকবে, বন্ধনের গ্রন্থিতে পাকের পর পাক পড়তেই থাকবে, খুলবে না। কিন্তু যৌবন-ধর্ম এর বিপরীত। তাই যেদিন থেকে শুনতে পেলাম, স্কুল-কলেজের ছাত্র আর রাজনীতিকে—যে রাজনীতি কেবল মাত্র পলিটিক্স নয়, যে রাজনীতি স্বদেশের মুক্তিযজ্ঞে ব্রতের মত, ধর্মের মত, তাকেই গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হয়ছে, এ কুসংস্কারের হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করেছে যে, এ বস্তু তার ছাত্রজীবনের পরিপন্থী—সেইদিনই আমার প্রতীতি জন্মেছে, এবার সত্য সত্যিই আমাদের দুর্গতি মোচন হবে। ছাত্র এবং দেশের যুবক-সম্প্রদায়ের কাছে আমার অন্তরের নিবেদন, এ সঙ্কল্প থেকে যেন তাঁরা কারও কথায় কোন প্রলোভনেই বিচ্যুত না হন।

এ সম্বন্ধে বহু মনীষী ব্যক্তিই বহু উপদেশ দিয়েছেন। তোমরা এই কর, এই কর, এই কর,—এই তোমাদের করণীয়, এই আচরণই প্রশস্ত, স্বার্থত্যাগ চাই, বুকের মধ্যে স্বদেশ-প্রীতি জ্বালিয়ে তোলা প্রয়োজন, জাতি-ভেদ অস্বীকার, ছুঁৎমার্গ পরিহার, খদ্দর পরিধান—এমনি অনেক আবশ্যকীয় ও মূল্যবান আদেশ এবং উপদেশ। এই হলো প্রোগ্রাম। আবার অন্যপ্রকার উপদেশ, ভিন্ন প্রোগ্রামও আছে। আপনাদেরই মত দেশের বহু ছাত্র ও যুবক আমাকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন—আমরা কি করব আপনি বলে দিন। উত্তরে আমি বলি,—প্রোগ্রাম ত আমি দিতে পারিনে, আমি শুধু তোমাদের বলতে পারি, তোমরা দৃঢ়পণে ‘সত্যাশ্রয়ী’ হও। তাঁরা প্রশ্ন করেন, এ ক্ষেত্রে সত্য কি? বিভিন্ন মতামত ও প্রোগ্রাম যে আমাদের উদ্‌ভ্রান্ত করে দেয়। জবাবে আমি বলি, সত্যের কোন শাশ্বত সংজ্ঞা আমার জানা নেই। দেশ, কাল ও পাত্রের সম্বন্ধ বা relation দিয়েই সত্যের যাচাই হয়। দেশ কাল পাত্রের পরস্পরের সম্বন্ধের সত্যজ্ঞানই সত্যের স্বরূপ। একের পরিবর্তনের সঙ্গে অপরের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। এই পরিবর্তন বুদ্ধিপূর্বক মেনে নেওয়াই সত্যকে জানা। যেমন বহু পূর্বকালে রাজাই ছিলেন ভগবানের প্রতিনিধি। দেশের লোকে এ কথা মেনে নিয়েছিল। একে অসত্য বলতে আমি চাইনে। সেই প্রাচীন যুগে হয়ত এই ছিল সত্য, কিন্তু আজ জ্ঞান ও পারিপার্শ্বিকের পরিবর্তনের ফলে এ কথা যদি ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়, তবুও কোন এক সাবেক দিনের যুক্তি ও উক্তি-মাত্রকেই অবলম্বন করে একেই সত্য বলে যদি কেউ তর্ক করে, তাকে আর যাই কেন না বলি, ‘সত্যাশ্রয়ী’ বলব না। কিন্তু শুদ্ধমাত্র মানাই এর সবটুকু নয়,—বস্তুতঃ, আর একদিক দিয়ে কোন সার্থকতাই এর নেই—যদি না চিন্তায়, বাক্যে ও ব্যবহারে, জীবনযাত্রার পদে পদে এ সত্য বিকশিত হয়ে ওঠে। ভুল জানা, ভ্রান্ত ধারণা, বরঞ্চ সেও ভালো, কিন্তু ভিতরের জানা ও বাইরের আচরণে যদি সামঞ্জস্য না থাকে,—অর্থাৎ যদি জানি একরকম, বলি আর একরকম এবং করি আর একরকম,—তবে জীবনের এতবড় ব্যর্থতা এতবড় ভীরুতা আর নেই। যৌবন-ধর্মকে এতখানি ছোট করতে আর দ্বিতীয় কিছু নেই। ছুঁৎমার্গ, জাতিভেদ, খদ্দর পরিধান, জাতীয় শিক্ষা, দেশের কাজ—এ-সব সত্য কি অসত্য, ভাল কি মন্দ, এ আলোচনা আমি করব না, এর সত্যাসত্য বুঝিয়ে দেবার আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি আপনারা অনেক পাবেন, কিন্তু আমি কেবল এই নিবেদনই করব, আপনাদের বুঝার সঙ্গে যেন কার্যের ঐক্য থাকে।

বুঝি, ছোঁয়াছুঁয়ি আচার-বিচারের অর্থ নেই, তবু মেনে চলি; বুঝি, জাতিভেদ মহা-অকল্যাণকর, তবু নিজের আচরণে তাকে প্রকাশ করিনে, বুঝি ও বলি, বিধবা-বিবাহ উচিত তবু নিজের জীবনে তাকে প্রত্যাহার করি, জানি খদ্দর পরা উচিত, তবু বিলাতী কাপড় পরি, একেই বলি আমি অসত্যাচরণ। দেশের দুর্দশা ও দুর্গতির মূলে এই মহাপাপ যে আমাদের কতখানি নীচে টেনে এনেছে, এ হয়ত আমরা কল্পনাও করিনে। এমনিধারা সকল দিকে। দৃষ্টান্ত দিয়ে সময় অতিবাহিত করবার প্রয়োজন নেই—প্রার্থনা, দীনতা ও কাপুরুষতার এই গভীর পঙ্ক থেকে দেশের যৌবন যেন মুক্তিলাভ করতে পারে। ভুল বুঝে ভুল কাজ করায় অজ্ঞতার অপরাধ হয়, সেও ঢের ভাল, কিন্তু ঠিক বুঝে বেঠিক কাজ করায় শুধু সত্যভ্রষ্টতার নয়, অসত্যনিষ্ঠার প্রত্যবায় হয়। তার প্রায়শ্চিত্তের যখন দিন আসে, তখন সমস্ত দেশের শক্তিতে কুলোয় না। এ কথা মনে রাখতে হবে, সত্যনিষ্ঠাই শক্তি, সত্যনিষ্ঠাই সমস্ত মঙ্গলের আধার এবং ইংরাজিতে যাকে বলে tenacity of purpose, সেও এই সত্যনিষ্ঠারই বিকাশ। তাই বারংবার স্বদেশের যৌবনের কাছে এই আবেদনই করি, সত্য-নিষ্ঠাই যেন তাদের ব্রত হয়। কেন না, নিশ্চয় জানি এই ব্রতধারণই তাদের সম্মুখের সমস্ত বাধা অপসারণ করে যথার্থ কল্যাণের পথ উদ্ঘাটিত করে দেবে। প্রোগ্রাম ও পথের জন্য দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

আজকের কার্য-তালিকায় একটা বিষয় আছে, সে হচ্ছে লাঠি, তলোয়ার ও ছোরা খেলা। এতদিন physical culture-এর দিকে ছাত্রসমাজ একেবারে বিমুখ হয়ে পড়েছিল। মনে হয়, এইটে ধীরে ধীরে আবার যেন ফিরে আসছে। এই প্রত্যাগমনকে আমি সর্বান্তঃকরণে অভিনন্দিত করি। তারা দেখেছে, দুর্বল শক্তিহীনেরই শুধু লাথির ঘায়ে প্লীহা ফাটে। শক্তিমান পাঠান-কাবলীওয়ালার ফাটে না। ফাটে বাঙ্গালীর। বোধ হয় বারংবার এই ধিক্কারেই শারীরিক শক্তি অর্জনের স্পৃহা ফিরে এলো। physical culture-এ শক্তি বাড়ে, আত্মরক্ষার কৌশল আয়ও হয়, সাহস বৃদ্ধি পায়—কিন্তু তবুও এ কথা ভুললে চলবে না যে, এ সমস্তই দেহের ব্যাপার। অতএব এই-ই সবটুকু নয়। সাহস বাড়া এবং নির্ভীকতা অর্জন কোনমতেই এক বস্তু নয়। একটা দৈহিক, অন্যটা মানসিক।

দেহের শক্তি ও কৌশল-বৃদ্ধিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অকৌশলীকে পরাভূত করা যায়, কিন্তু নির্ভয়ের সাধনায় শক্তিমানকে পরাস্ত করা যায়,—সংসারে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না, সে হয় অপরাজেয়। তাই প্রারম্ভে যে কথা একবার বলেছি, তাই পুনরুক্তি করে আবার বলি যে, এই অভয় আশ্রম সেই সাধনাতেই নিযুক্ত। এঁদের কৃচ্ছ্রসাধনা তারই একটা সোপান, একটা উপায়। এ তাঁদের পথ, শেষ লক্ষ্য নয়। অভাব, দুঃখ, ক্লেশ, প্রতিবেশীর লাঞ্ছনা, বন্ধুজনের গঞ্জনা, প্রবলের উৎপীড়ন, কোন কিছুই যেন এঁদের মুক্তির পথকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে—এ-ই এঁদের একান্ত পণ। এই ত নির্ভয়ের সাধনা এবং তাই সত্যনিষ্ঠাই এঁদের গন্তব্য-পথকে নিরন্তর আলোকিত করে চলেছে। খদ্দর প্রচার, জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল খোলা, আর্তের সেবা, এ-সব ভাল কি মন্দ, নির্ভীকতা ও দেশের স্বাধীনতা অর্জনে এ-সমস্ত কাজের কি না,—এ-সব প্রশ্ন বৃথা! এঁদের সত্যনিষ্ঠা কাল যদি এঁদের চক্ষে অন্য পথ নির্দেশ করে, এই সমস্ত আয়োজন নিজের হাতে ভেঙ্গে ফেলতে অভয় আশ্রমীদের একমুহূর্ত বিলম্ব হবে না—এই আমার বিশ্বাস। এবং কামনা করি, এ বিশ্বাস যেন আমার সত্য হয়।

আমার বয়েস অনেক হলো, তবু এখানে এসে অনেক কিছুই শিখলাম। এই অভয় আশ্রমে অতিথি হতে পারার সৌভাগ্য আমার শেষদিন পর্যন্ত মনে থাকবে।

পরিশেষে, এই ছাত্র ও যুব-সঙ্ঘকে আশীর্বাদ করি, যেন এঁদের মতই সত্যনিষ্ঠা তাঁদেরও জীবনের ধ্রুবতারা হয়।

আপনারা আমার সকৃতজ্ঞ অন্তরের নমস্কার গ্রহণ করুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *