তুমি অন্তর্হিতা

তুমি অন্তর্হিতা, আমি যেন সেই নিঃসঙ্গ ঘোটক,
রিল্‌কে যাকে সন্ধ্যায় দেখেছিলেন স্তব্ধ রাশিয়ায়।
তুমি অন্তর্হিতা, আমি মানিকবাবুর হারু, সন্দিগ্ধ শেয়াল
মরা শালিকের বাচ্চা মুখে নিয়ে যাচ্ছে ছপছপ,
কিছুই পাচ্ছি না টের। তুমি অন্তর্হিতা,
ঘরপোড়া মানুষের মতো আমি রৌদ্রবৃষ্টি, বাতাসের কুরুণার পাত্র,
একেবারে আর্ত আর নগ্ন।
শহরের সব রাস্তা, লেন-বাইলেন, কী চিত্তির বিচিত্তির
দোকানপাটের ফুল্ল রঙিন সাইনবোর্ড, যাবতীয় সামগ্রী, পোস্টার,
দিনের ট্রাফিক আর রাতের নিয়নমালা, স্বপ্নের মতন বিজ্ঞাপন
সবাই বলছে সমস্বরে?-
তুমি অন্তর্হিতা।

সমস্ত শহর আমি স্যান্ডেলের আঘাতে আঘাতে
বিক্ষত করছি শুধু, হাঁটছি হাঁটছি সঙ্গীহীন।
যে-লোকটা এইমাত্র আমার পাঞ্জাবি ঘেঁষে গেল,
তাকে দেখে মনে হল (হয়তো বা অকারণ এই মনে-হওয়া)
কখনো রবীন্দ্রনাথ লেখেননি এক ছত্র কবিতা অথবা ঋদ্ধ বড়ে
গোলাম আলীর কণ্ঠে কোনো দিন জ্বলজ্বল করেনি খেয়াল
নানা বর্ণে। যে-মহিলা ধাঁধিয়ে অনেক চোখ গটগট হেঁটে
মোটরে আহ্লাদী এক বেড়ালের মতো
বসলেন, তাঁকে দেখে মনে হলো গর্ভপাতে অতীব নিপুণা।
অন্ন চাই, বস্ত্র চাই বলে এক ঝাঁঝালো মিছিল শহরের
প্রধান সড়ক আলো করে এগোচ্ছে কেবলি;
‘তুমি অন্তর্হিতা’, এক নতুন স্লোগান তুলে সেই
মিছিলে শামিল হতে ভারি ইচ্ছে হল।
পোস্টারে পোস্টারে আর প্রতিটি ব্যানারে দেখলাম,-
বড় বড় রক্তাক্ত অক্ষরে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা, তুমি অন্তর্হিতা।

ভাদ্রের আকাশ ছিঁড়ে, মাটি খুঁড়ে ভদ্দর লোকের
শৌখিন বাগানে ঢুকে ফুলের গহন অভ্যন্তরে
দৃষ্টি মেলে, দৃষ্টি মেলে আপেলের ত্বকের ভেতর,
গাছতলা, পুকুরের ঘাটে, সতেজ মাছের পেটে,
শহরের প্রতিটি বাড়ির কড়া নেড়ে,
এরোড্রামে, যে-কোনো মার্কেটে,
সকল ঘুপটি কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখতে অত্যন্ত
লোভ হল। স্বচক্ষে দেখতে চাই তুমি আছো কি না
অন্তরালে লুকিয়ে কোথাও।
ঘরে ফিরে দেখি বন্ধ দরজায়, খোলা জানালায়,
টেবিলে দেয়ালে আছে লেখা
তুমি অন্তর্হিতা।
সমস্ত রহস্য নিয়ে তার রবরবা রাত্রি এলে
পুরোনো টেবিলে ঝুঁকে খাতার পাতার জনপথে
কখনো হোঁচট খাই, থমকে দাঁড়াই দেখে শত হিজিবিজি।
কবিতা রচনাকালে প্রতিটি পংক্তির ফাঁকে ফাঁকে খামোকাই
কে যেন লিখিয়ে নেয় অবিরত, তুমি অন্তর্হিতা।
আমার বর্বর ক্রোধ উঠোনে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো খয়েরি
পোষা হাঁসটাকে
হঠাৎ মারলো ছুড়ে ঢেলা, হাঁস খোঁড়াতে খোঁড়াতে
যেন তীব্র অভিমানে তাকাল আমার দিকে, লুকাল সভয়ে
মর্চে-পড়া টিনের আড়ালে!
পরমুহূর্তেই আমি তাকে খুঁজে নিয়ে
দিলাম ব্যান্ডেজ বেঁধে আর্ত লাল পায়ে,
অথচ আমার ক্ষত র’য়ে যায় অন্তরালে শুশ্রূষাবিহীন।
সে-ক্ষতের প্রতি রক্তবিন্দু ঝরে ঝরে
বলে বারবার-
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা,
তুমি অন্তর্হিতা…