ময়নামতীর মূর্তিগণ

ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ গোলাপী রঙের রেলগাড়ি চেপে
সটান এলেন রাজধানীতেই সিটি-চমকিত স্টেশনের আস্তানায়।
মাননীয় গার্ড তার হুইসিল বাজাতে বাজাতে নিয়ে যান
বগী ভরে শৈবালিত, মেদুর বছরগুলি সুশীতল শেডে
সকরুণ দিব্যতায়। দুদ্দাড় পড়েন নেমে প্ল্যাটফর্মে ময়নামতীর
স্বপ্নপরায়ণ মূর্তিগণ-
কেউবা পটের বিবি, আকর্ণ বিস্তৃত চোখ, সুন্দর বগল,
উচ্ছল পানের রসে টসটসে ঠোঁট, যেন পাকা জাম; মসৃণ পাম্পসু পায়ে
আহ্লাদিত চতুর নাগর কেউ ফিটফাট, হয়তো কিণ্নর কুলোদ্ভব-
হন্‌হন্‌ হেঁটে গিয়ে মূর্তিগণ মেশেন নির্মুখ ভিড়ে। রাস্তায় রাস্তায়
কেমন বিকট চেল্লাচেল্লী, ঠেলাঠেলি, চতুর্দিকে দুঃস্বপ্নের পঙ্গপাল।
শহর এমন তপ্ত পারেনা আলতো হাত রাখতে কোথাও
কেউ, দপ্তরের
পাপোষে জমায় ভিড় দশজন শতজন প্রতিবেশী, দী
উমেদার। মাঝে-মাঝে তিল ধারণের ঠাঁই-নেই শহরকে ভয় পায়
পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই, চায় কোনোমতে
হাতের রৈখিক মাঠে চকিতে আসুক সুশোভন আমলকি। কখনো-বা
চাকারিতে এতল বেতল খেলে অবসাদ এলে
সখেদে দাখিল করে হাকিমের এজলাসে হলুদ দলিল।
কবেকার অব্দে সেই সুখদ বেলায়
বলো ছিল নাকি ভালো গোচরণ? বন দোয়েলের
শিস্‌ ঠুক্‌ ঠুক্‌ নুড়ি ঝুরু ঝুরু, আমের পাতার ঝিরিঝিরি,
এবং ঝাউয়ের আইমুশা
ইত্যাকার শব্দের মস্তকে মৃদু দুদণ্ড ফিরিয়ে হাত
ব্যাকুল আদর করা, লৈতন গাছের ফল কোঁচড়ে কুড়ানো,
অথবা সজল চোখে নৌকোর গলুইয়ে শুয়ে শুয়ে হাট-কারা আকাশের
লাউয়ের জালির মতো চাঁদ দেখা ছিল না কি ভালো?
শহরে নানান লোক, মধ্যবিত্ত প্যাণ্ডার সর্বত্র ঘোরে আর
চুটিয়ে ব্যবসা করে। কেউ কেউ পেট্রোম্যাক্স জ্বেলে
উৎসবে বিলোচ্ছে হৈ-হৈ জিলিপি বাতাসা। অন্যদিকে
মেঘমৃদু হাত নড়ে জানালায়, অপর্‌রাবি ফেলছে চটুল দৃষ্টিজাল
রাস্তায় গলিতে পার্কে, সিনেমায়, কাফেতে অতিল্‌।
‘কী মজা কাফে-র দিবা বর্ণচ্ছটা এবং বানান ভুলে ভর্তি
হে আমার পরম লুকোনো পত্রপাঠ’
পকেটের ছুঁচো হাৎড়ে বলে পথস্থ গেঁজেল, আউগারি যুবা।

ময়নামতীর মাটিপ্লুত মূর্তিগণ অবিরাম ইকর বিকর চলাফেরা
করছেন ফুটপাতে, রুক্ষ চুল, উস্‌কো-খুস্‌কো নীলাম্বরী,
পাদুকা ধুলোয় ম্লান। ওড়ের বিগড়া কেউ পা ধোবেন বলে
কোথায় আমার স্থান, কোন আঘাটায়?’- এমন স্বপ্নোজ কিছু
উচ্চারণে যান চলে কামিজের হাতা মুড়ে শহুরে অলীক সরোবরে।
রক্তে তার জলকিণ্নরীর গান, সন্ধ্যালোকে ঘোরেন কেবল
দিগ্ধিদিক, পাতালের বর্ণোচ্ছাসে, জাতিস্মর দোটানার পাকে।