কোনো সাইকেলচারীর উপাখ্যান

আমার জীবন ভাবো একবার। বস্তুত উড়নচণ্ডী আমি
চিরকেলে, সাইকেলে ঘুরে ঘুরে দিন যায়। অলিতে-গলিতে,
সদর রাস্তায় কিংবা মাংসের বাজার ঘেঁষে বিপণি তল্লাটে
চমৎকার তামাকের, সবুজ ঘ্রাণ শুঁকে দিন যায়।
কখনো রৌদ্রের নিরালায়,
কখনো-বা বৃষ্টি-ভেজা চুপসোনো, ধোঁয়াটে সন্ধ্যায় ছুটে চলি
বাজিয়ে মধুর ঘণ্টা চারদিকে। কতো কাঁটাবন,
বহুবর্ণ কতো গুল্মচ্ছাদিত পথের ধারে সাইকেলটাকে
মাঝে-মাঝে হঠাৎ ঘুরিয়ে নিই আপিলা চাপিলা শৈশবের
প্রচণ্ড আহ্বানে।

ক্রিং ক্রিং ধ্বনি শুনে এইতো আমার পকেটস্থ শহরের
হাজার জানালা দেখি ম্যাজিশিয়ানের
রঙিন তাসের মতো ওঠে দুলে। সাইকেল চালাতে চালাতে
দ্বিপ্রহরে কানে আসে বিপন্ন চীৎকার রাস্তা ছেড়ে,
দু’দশটা বাড়ি ছুঁয়ে মেঘে গেল দূরে
মেঘে গেল আর্তস্বর। ধাঁ করে উধাও ট্রাক, বালকের কোমল শরীর
ছিন্নভিন্ন গুল্মলতা, কাকের কর্কশ ডাক থ্যাৎলানো মাংসের
দলাকে করলো বিদ্ধ, আমাকেও। মনে হলো, অবসিত বালককে আমি সাইকেলে
বসিয়ে চলেছি
নিরাপদে পৌঁছে দিতে, এবং শরীর তার রূপালি ঝালর।

এইতো একটু আগে সেখানে এলাম দেখে ঝাঁঝালো দুপুরে
গোরস্থানে ক্রশের ওপর
খুঁটছিল ডানা চিল, যেমন তরুণ
পণ্ডিত খোঁটেন গ্রন্থ নিম আর্টিস্টের
মতো আত্মভোলা। প্যাডেল চঞ্চল পদযুগ, মাঝে-মাঝে দেখি
হুতুম প্যাঁচারা সব সহজিয়া কোটরে নিশ্চুপ
বসে থাকে, আলালের ঘরের দুলাল
মসৃণ মোটরে চেপে প্রগতির মান রাখে আর নব্য ডন যুয়ানেরা
প্রেমের চেয়েও বড়ো পরমার্থ খোঁজে
নানান পাড়ায়; বেশভূষা নাক্ষত্রিক, চলনে বলনে স্মার্ট আগাগোড়া।

আমার জীবন ভাবো একবার। সর্বদা পরণে
পুরোনো কাপড় জামা, গড়াগড়ি দিই সুখে স্বপ্নের বনেদী গালিচায়।
ধূসর পিতার স্মৃতি চোয়ালে, গলায় কিংবা পাকস্থলীতেই
রেখেছি গচ্ছিত আর পাতালে দেখেছি আসবাবপত্র সব
ব্যালে নর্তকীর মতো ভাসমান এবং একটি নারী বাণীহীন তীক্ষ্ম অহংকারে
জলমগ্ন নিয়ে খেলা করে-যেন তার কোনো স্মৃতি নেই
অথবা আগামীকাল নেই।

নিজেকে বুঝিনা ঠিক, তাই
কখনো শহীদ ভাবি জীবনের, কখনো কেবলি সাইকেলচারী এক,
কখনো-বা হাতুড়ে স্বাপ্নিক।
মাথার ভেতরে আজগুবি গোলাপের পাপড়ি পড়ে আছে কতো,
পড়ে আছে অনভ্যস্ত ভঙ্গিমায়, হৃদয়ে দাঁতের মতো চাঁদ
ভীষণ আমূল বিদ্ধ। জ্যোৎস্না রাতে হঠাৎ বাতাসে কালো চেন
উন্মোচিত, সাইকেল ভেসে যায়, গোরস্থান, কাগজের স্টল,
মেয়ে-পুরুষের আর ভুলচুক, করুণা, পাপের পরপারে
মেঘে-মেঘে, নক্ষত্রের বাগানে কেবলি ভেসে যায় দীপ্ত কী এক বোধিতে।