শিয়াল পণ্ডিত

কুমির দেখলে, সে শিয়ালের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তখন ভাবলে, ‘ ও ঢের লেখাপড়া জানে, তাতেই খালি আমাকে ফাঁকি দেয়। আমি মূর্খ লোক, তাই তাকে আঁটতে পারি না।’ অনেকক্ষণ ভেবে কুমির ঠিক করল যে, নিজের সাতটা ছেলেকে শিয়ালের কাছে দিয়ে খুব করে লেখাপড়া শেখাতে হবে। তার পরের দিনই সে ছানা সাতটাকে সঙ্গে করে শিয়ালের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হল। শিয়াল তখন তার গর্তের ভিতর বসে কাঁকড়া খাচ্ছিল। কুমির এসে ডাকলে, ‘শিয়াল পণ্ডিত, শিয়াল পণ্ডিত, বাড়ি আছ?’

শিয়াল বাইরে এসে বললে, ‘কি ভাই, কি মনে করে?’

কুমির বললে, ‘ভাই, এই আমার ছেলে সাতটাকে তোমার কাছে এনেছি। মূর্খ হলে করে খেতে পারবে না। ভাই, তুমি যদি এদের একটু লেখাপড়া শিখিয়ে দাও।’

শিয়াল বললে, ‘সে আর বলতে? আমি সাতদিনে সাতজনকে পড়িয়ে পণ্ডিত করে দেব।’ শুনে কুমির তো খুব খুশী হয়ে ছানা সাতটাকে রেখে চলে গেল।

তখন শিয়াল তাদের একটাকে আড়ালে নিয়ে বললে-

‘পড় তো বাপু-কানা খানা গানা ঘানা, কেমন লাগে কুমির ছানা?’

এই কথা বলে, সেটার ঘাড় ভেঙ্গে, খেয়ে ফেললে।

পরদিন যখন কুমির তার ছানা দেখতে এল, তখন শিয়াল তাদের একেকটি করে গর্তের বাইরে এনে দেখাতে লাগল।

ছয়টিকে ছয়বার দেখালে, শেষেরটা দেখালে দু’বার। বোকা কুমির তা বুঝতে না পেরে ভাবলে, সাতটাই দেখানো হয়েছে। তখন সে চলে গেল, আর অমনি শিয়াল ছানাগুলোর একটাকে আড়ালে নিয়ে বললে-

পড় তো বাপু- কানা খানা গানা ঘানা
কেমন লাগে কুমির ছানা?

এই কথা বলে, সেটার ঘাড় ভেঙ্গে, খেয়ে ফেলল।

পরদিন কুমির তো ছানা দেখতে এল। শিয়াল একেকটি করে গর্তের বাইরে এনে পাঁচবার পাঁচবার দেখাল, শেষেরটিকে দেখাল তিনবার। তাতেই কুমির খুশি হয়ে চলে গেল। তখন শিয়াল ঠিক আগের মতো করে আর একটা ছানাকে খেল।

এমনি করে সে রোজ একটি ছানা খায়, আর কুমির এলে তাকে ফাঁকি দিয়ে ভোলায়। শেষে যখন একটি ছানা বই আর রইল না, তখন সেই একটিকেই সাতবার দেখিয়ে সে কুমিরকে বোঝাল। তারপর কুমির চলে গেলে সেটিকেও খেয়ে ফেলল। তারপর আর একটিও রইল না।

তখন শিয়ালনী বললে, ‘এখন উপায়? কুমির এলে দেখাবে কি? ছানা দেখতে না পেলে তো অমনি আমাদের ধরে খাবে!’

শিয়াল বললে, ‘আমাদের পেলে তো ধরে খাবে। নদীর ওপারে বনটা খুব বড়, চল আমরা সেইখানে যাই, তাহলে কুমির আর আমাদের খুঁজে বার করতে পারবে না।’

এই বলে শিয়াল শিয়ালিনীকে নিয়ে তাদের পুরনো গর্ত ছেড়ে চলে গেল।

এর খানিক বাদেই কুমির এসেছে। সে এসে ‘শিয়াল পণ্ডিত, ‘শিয়াল পণ্ডিত, বলে কত ডাকল, কেউ তার কথার উত্তর দিল না! তখন সে গর্তের ভিতর-বার খুঁজে দেখল-শিয়ালও নেই, শিয়ালিনীও নেই! খালি তার ছানাদের হাড়গুলো পড়ে আছে।

তখন তার খুব রাগ হলো, আর সে চারদিকে ছুটোছুটি করে শিয়ালকে খুঁজতে লাগল। খুঁজতে-খুঁজতে নদীর ধারে গিয়ে দেখল, ঐ! শিয়াল আর শিয়ালিনী সাঁতরে নদী পার হচ্ছে।

অমনি ‘দাঁড়া হতভাগা!’ বলে সে জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল। জলের নীচে ছুটতে কুমিরের মত কেউ পারে না, দেখতে-দেখতে সে গিয়ে শিয়ালের পিছনের একটা পা কামড়ে ধরল!

শিয়াল সবে তার সামনের দু-পা ডাঙ্গায় তুলেছিল, শিয়ালিনী তার আগেই উঠে গিয়েছিল। কুমির এসে শিয়ালের পা ধরতেই সে শিয়ালিনীকে ডেকে বললে, ‘শিয়ালিনী, শিয়ালিনী, আমার লাঠিগাছা ধরে কে টানাটানি করছে! লাঠিটা বা নিয়েই যায়!’

একথা শুনে কুমির ভাবলে, ‘তাই তো, পা ধরতে গিয়ে লাঠি ধরে ফেলেছি! শিগগির লাঠি ছেড়ে পা ধরি।’

এই ভেবে যেই সে শিয়ালের পা ছেড়ে দিয়েছে, অমনি শিয়াল একলাফে ডাঙ্গায় উঠে গিয়েছে। উঠেই বোঁ করে দে ছুট। তারপর বনের ভিতরে ঢুকে পড়লে আর কার সাধ্য তাকে ধরে।

তারপর থেকে কুমির কেবলই শিয়ালকে খুঁজে বেড়ায়। কিন্ত শিয়াল বড্ড চালাক, তাই তাকে ধরতে পারে না। তখন সে অনেক ভেবে এক ফন্দি করল।

কুমির একদিন চড়ায় গিয়ে হাত পা ছাড়িয়ে মরার মতো পড়ে রইল। তারপর শিয়াল আর শিয়ালিনী কচ্ছপ খেতে এসে দেখল, কুমির কেমন হয়ে পড়ে আছে! তখন শিয়ালিনী বললে, ‘মরে গেছে! চল খাইগে! শিয়াল বললে, ‘রোস একটু দেখে নিই।’ এই বলে সে কুমিরের আর একটু কাছে গিয়ে বলতে লাগল, ‘না! এটা দেখছি বড্ড বেশী মরে গেছে! অত বেশী মরাটা আমরা খাই না। যেগুলো একটু-আধটু নড়ে-চড়ে, আমরা সেগুলো খাই।’

তা শুনে কুমির ভাবলে, ‘একটু নড়ি-চড়ি, নইলে খেতে আসবে না।’ এই মনে করে কুমির তার লেজের আগাটুকু নাড়তে লাগল। তা দেখে শিয়াল হেসে বললে, ‘ঐ দেখ, লেজ নাড়ছে! তুমি তো বলেছিলে, মরে গেছে!’ তারপর আর কি তারা সেখানে দাঁড়ায়! তখন কুমির বললে, ‘বড্ড ফাঁকি দিলে তো! আচ্ছা এবারে দেখাব!’

একটা জায়গায় শিয়াল রোজ জল খেতে আসত! কুমির তা দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে রইল। ভাবল, শিয়াল জল খেতে এলেই ধরে খাবে। সেদিন শিয়াল এসে দেখল, সেখানে একটাও মাছ নেই। অন্য দিন ঢের মাছ চলা-ফেরা করে। শিয়াল ভাবলে, ‘ভালো রে ভালো, আজ সব মাছ গেল কোথায়? বুঝেছি, এখানে কুমির আছে!’ তখন সে বললে, ‘এখানকার জলটা বেজায় পরিস্কার। একটু ঘোলা না হলে কি খাওয়া যায়? চল শিয়ালিনী, আর -এক জায়গায় যাই।’ এ কথা শুনেই কুমির তাড়াতাড়ি সেখানকার জল ঘোলা করতে আরম্ভ করলে। তা দেকে শিয়াল হাসতে হাসতে ছুটে পালিয়েছে!

আর একদিন শিয়াল এসেছে কাঁকড়া খেতে। কুমির তার আগেই সেখানে চুপ করে বসে আছে। শিয়াল তা টের পেয়ে বলল, ‘এখানে কাঁকড়া নেই, থাকলে দু-একটা ভাসত।’

অমনি কুমির তার লেজের আগাটুকু ভাসিয়ে দিল। কাজেই শিয়াল আর জলে নামল না।

অমনি করে বারবার শিয়ালের কাছে ঠকে গিয়ে, শেষে কুমিরের ভারি লজ্জা হল। তখন সে আর কি করে মুখ দেখাবে। কাজেই সে তার ঘরের ভিতরে গিয়ে বসে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *