২.০৮ অভিভাষণ

অভিভাষণ

বন্ধুজনের সমাদর, স্নেহাস্পদ কনিষ্ঠদের প্রীতি এবং পূজনীয়গণের আশীর্বাদ আমি সবিনয়ে গ্রহণ করলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা পাওয়া কঠিন। নিজের জন্য শুধু এই প্রার্থনা করি, আপনাদের হাত থেকে যে মর্যাদা আজ পেলাম, এর চেয়েও এ জীবনে বড় আর কিছু যেন কামনা না করি। যে মানপত্র এইমাত্র পড়া হোল, তা আকারে যেমন ছোট, আন্তরিক সহৃদয়তায় তেমনি বড়। এ তার প্রত্যুত্তর নয়; এ শুধু আমার মনের কথা, তাই আমারও বক্তব্যটুকু আমি ক্ষুদ্র করেই লিখে এনেছি।

এই যে অনুরাগ, এই যে আমার জন্মতিথিকে উপলক্ষ করে আনন্দ প্রকাশের আয়োজন—আমি জানি, এ আমার ব্যক্তিকে নয়। দরিদ্র গৃহে আমার জন্ম, এই ত সেদিনও দূর প্রবাসে তুচ্ছ কাজে জীবিকা অর্জনেই ব্যাপৃত ছিলাম; সেদিন পরিচয় দিবার আমার কোন সঞ্চয়ই ছিল না। তাই ত বুঝতে আজ বাকী নেই—এ শ্রদ্ধা নিবেদন কোন বিত্তকে নয়, বিদ্যাকে নয়, উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কোন অতীত দিনের গৌরবকে নয়, এ শুধু আমাকে অবলম্বন করে সাহিত্য-লক্ষ্মীর পদতলে ভক্ত মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন।

জানি এ সবই। তবুও যে সংশয় মনকে আজ আমার বারংবার নাড়া দিয়ে গেছে সে এই যে, সাহিত্যের দিক দিয়েই এ মর্যাদার যোগ্যতা কি আমি সত্যই অর্জন করেছি? কিছুই করিনি এ কথা আমি বলব না। কারণ এতবড় অতি-বিনয়ের অত্যুক্তি দিয়ে উপহাস করতে আমি নিজেকেও চাইনে, আপনাদেরও না। কিছু আমি করেছি। বন্ধুরা বলবেন শুধু কিছু নয়, অনেক কিছু। তুমি অনেক করেছ। কিন্তু তাঁদের দলভুক্ত যাঁরা নন, তাঁরা হয়ত একটু হেসে বলবেন, অনেক নয়, তবে সামান্য কিছু করেছেন, এইটিই সত্য এবং আমরাও তাই মানি। কিন্তু তাও বলি যে, সে সামান্যের ঊর্ধ্বস্থ বুদ্বুদ্, আর অধঃস্থ আবর্জনা বাদ দিলে অবশিষ্ট যা থাকে কালের বিচারালয়ে তার মূল্য লোভের বস্তু নয়। এ যাঁরা বলেন আমি তাঁদের প্রতিবাদ করিনে, কারণ তাঁদের কথা যে সত্য নয়, তা কোন মতেই জোর করে বলা চলে না। কিন্তু এর জন্যে আমার দুশ্চিন্তাও নেই। যে কাল আজও আসেনি, সেই অনাগত ভবিষ্যতে আমার লেখার মূল্য থাকবে, কি থাকবে না, সে আমার চিন্তার অতীত। আমার বর্তমানেরই সত্যোপলব্ধি যদি ভবিষ্যতের সত্যোপলব্ধির সঙ্গে এক হয়ে মিলতে না পারে পথ তাকে ত ছাড়তেই হবে। তার আয়ুষ্কাল যদি শেষ হয়েই যায় সে শুধু এই জন্যেই যাবে যে, আরও বৃহৎ, আরও সুন্দর, আরও পরিপূর্ণ সাহিত্যের সৃষ্টিকার্যে তার কঙ্কালের প্রয়োজন হয়েছে। ক্ষোভ না করে বরঞ্চ এই প্রার্থনাই জানাবো যে, আমার দেশে, আমার ভাষায় এতবড় সাহিত্যই জন্মলাভ করুক যার তুলনায় আমার লেখা যেন একদিন অকিঞ্চিৎকর হয়েই যেতে পারে।

নানা অবস্থা বিপর্যয়ে একদিন নানা ব্যক্তির সংশ্রবে আসতে হয়েছিল। তাতে ক্ষতি যে কিছু পৌঁছায় নি তা নয়, কিন্তু সেদিন দেখা যাদের পেয়েছিলাম, তারা সকল ক্ষতিই আমার পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। তারা মনের মধ্যে এই উপলব্ধিটুকু রেখে গেছে, ত্রুটি, বিচ্যুতি, অপরাধ, অধর্মই মানুষের সবটুকু নয়। মাঝখানে তার যে বস্তুটি আসল মানুষ—তাকে আত্মা বলা যেতেও পারে—সে তার সকল অভাব, সকল অপরাধের চেয়েও বড়। আমার সাহিত্য-রচনায় তাকে যেন অপমান না করি। হেতু যত বড়ই হোক, মানুষের প্রতি মানুষের ঘৃণা জন্মে যায় আমার লেখা কোন দিন যেন না এত বড় প্রশ্রয় পায়। কিন্তু অনেকেই তা আমার অপরাধ বলে গণ্য করেছেন, এবং যে অপরাধে আমি সবচেয়ে বড় লাঞ্ছনা পেয়েছি, সে আমার এই অপরাধ। পাপীর চিত্র আমার তুলিতে মনোহর হয়ে উঠেছে, আমার বিরুদ্ধে তাঁদের সবচেয়ে বড় এই অভিযোগ।

এ ভাল কি মন্দ আমি জানিনে, এতে মানবের কল্যাণ অপেক্ষা অকল্যাণ অধিক হয় কি না এ বিচার করেও দেখিনি—শুধু সেদিন যাকে সত্য বলে অনুভব করেছিলাম তাকেই অকপটে প্রকাশ করেছি। এ সত্য চিরন্তন ও শাশ্বত কি না এ চিন্তা আমার নয়, কাল যদি সে মিথ্যা হয়েও যায়—তা নিয়ে কারো সঙ্গে আমি বিবাদ করতে যাব না।

এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা আমার সর্বদাই মনে হয়। হঠাৎ শুনলে মনে ঘা লাগে, তথাপি এ কথা সত্য বলেই বিশ্বাস করি যে, কোন দেশের কোন সাহিত্যই কখনো নিত্যকালের হয়ে থাকে না। বিশ্বের সমস্ত সৃষ্ট বস্তুর মত তারও জন্ম আছে, পরিণতি আছে, বিনাশের ক্ষণ আছে। মানুষের মন ছাড়া ত সাহিত্যের দাঁড়াবার জায়গা নেই, মানব-চিত্তেই ত তার আশ্রয়, তার সকল ঐশ্বর্য বিকশিত হয়ে উঠে। মানবচিত্তই যে একস্থানে নিশ্চল হয়ে থাকতে পায় না! তার পরিবর্তন আছে, বিবর্তন আছে—তার রসবোধ ও সৌন্দর্য বিচারের ধারার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তাই এক যুগে যে মূল্য মানুষে খুশী হয়ে দেয়, আর এক যুগে তার অর্ধেক
দাম দিতেও তার কুণ্ঠার অবধি থাকে না।

মনে আছে দাশু রায়ের অনুপ্রাসের ছন্দে গাঁথা দুর্গার স্তব পিতামহের কণ্ঠহারে সেকালে কত বড় রত্নই না ছিল! আজ পৌত্রের হাতে বাসি মালার মত তারা অবজ্ঞাত। অথচ এতখানি অনাদরের কথা সেদিন কে ভেবেছিল?

কিন্তু কেন এমন হয়? কার দোষে এমন ঘটল? সেই অনুপ্রাসের অলঙ্কার ত আজও তেমনি গাঁথা আছে। আছে সবই, নেই শুধু তাকে গ্রহণ করবার মানুষের মন। তার আনন্দবোধের চিত্ত আজ দূরে সরে গেছে। দাশু রায়ের নয়, তার কাব্যেরও নয়, দোষ যদি কোথাও থাকে ত সে যুগধর্মের।

তর্ক উঠতে পারে, শুধু দাশু রায়ের দৃষ্টান্ত দিলেই ত চলে না। চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাবলী ত আজও আছে, কালিদাসের শকুন্তলা ত আজও তেমনি জীবন্ত। তাতে শুধু এইটুকুই প্রমাণিত হয় যে, তার আয়ুষ্কাল দীর্ঘ—অতি দীর্ঘ। কিন্তু এর থেকে তার অবিনশ্বরতাও সপ্রমাণ হয় না। তার দোষ-গুণেরও শেষ নিষ্পত্তি করা যায় না।

সমগ্র মানব জীবনে কেন, ব্যক্তিবিশেষের জীবনেও দেখি এই নিয়মই বিদ্যমান। ছেলেবেলায় আমার ‘ভবানী পাঠক’ ও ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ই ছিল একমাত্র সম্বল। তখন কত রস, কত আনন্দই যে এই দুইখানি বই থেকে উপভোগ করেছি, তার সীমা নেই। অথচ, আজ সে আমার কাছে নীরস। কিন্তু এ গ্রন্থের অপরাধ, কি আমার বৃদ্ধত্বের অপরাধ বলা কঠিন। অথচ এমনই পরিহাস, এমনই জগতের বদ্ধমূল সংস্কার যে, কাব্য উপন্যাসের ভালমন্দ বিচারের শেষ ভার গিয়ে পড়ে বৃদ্ধদের পরেই। কিন্তু এ কি বিজ্ঞান ইতিহাস? এ কি শুধু কর্তব্য কার্য, শুধু শিল্প যে, বয়সের দীর্ঘতাই হবে বিচার করবার সবচেয়ে বড় দাবী?

বার্ধক্যে নিজের জীবন যখন বিস্বাদ, কামনা যখন শুষ্কপ্রায়, ক্লান্তি অবসাদে জীর্ণ দেহ যখন ভারাক্রান্ত,—নিজের জীবন যখন রসহীন, বয়সের বিচারে যৌবন কি বার বার দ্বারস্থ হবে গিয়ে তারই?

ছেলেরা গল্প লিখে নিয়ে গিয়ে যখন আমার কাছে উপস্থিত হয়, তারা ভাবে এই বুড়ো লোকটার রায় দেওয়ার অধিকারই বুঝি সবচেয়ে বেশি। তারা জানে না যে, আমার নিজের যৌবনকালের রচনারও আজ আমি আর বড় বিচারক নই।

তাদের বলি, তোমাদের সম-বয়সের ছেলেদের গিয়ে দেখাও। তারা যদি আনন্দ পায়, তাদের যদি ভালো লাগে, সেইটিই জেনো সত্য বিচার।

তারা বিশ্বাস করে না, ভাবে দায় এড়াবার জন্যই বুঝি এ কথা বলচি—তখন নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি, বহু যুগের সংস্কার কাটিয়ে উঠাই কি সোজা? সোজা নয় জানি, তবুও বলব, রসের বিচারে এইটেই সত্য বিচার।

বিচারের দিক থেকে যেমন, সৃষ্টির দিক থেকেও ঠিক এই এক বিধান। সৃষ্টির কালটাই হলো যৌবনকাল—কি প্রজা সৃষ্টির দিক দিয়ে, কি সাহিত্য সৃষ্টির দিক দিয়ে | এই বয়স অতিক্রম করে’ মানুষের দূরের দৃষ্টি হয়ত ভীষণতর হয়, কিন্তু কাছের দৃষ্টি তেমনি ঝাপসা হয়ে আসে। প্রবীণতার পাকা বুদ্ধি দিয়ে তখন নীতিপূর্ণ কল্যাণকর বই লেখা চলে কিন্তু আত্মভোলা যৌবনের প্রস্রবণ বেয়ে যে রসের বস্তু ঝরে পড়ে, তার উৎসমুখ রুদ্ধ হয়ে যায়। আজ তিপ্পান্ন বছরে পা দিয়ে আমার এই কথাটাই আপনাদের কাছে সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই,—অতঃপর রসের পরিবেশনে ত্রুটি যদি আপনাদের চোখে পড়ে, নিশ্চয় জানবেন তার সকল অপরাধ আমার এই তিপ্পান্ন বছরের।

আজ আমি বৃদ্ধ, কিন্তু বুড়ো যখন হইনি, তখন পূজনীয়গণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে অনেকের সাথে ভাষা-জননীর পদতলে যেটুকু অর্ঘ্যের যোগান দিয়েছি, তার বহুগুণ মূল্য আজ দুই হাত পূর্ণ করে আপনারা ঢেলে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ চিত্তে আপনাদের নমস্কার করি।

(১৩৩৫ সালের ভাদ্র মাসে ৫৩তম বাৎসরিক জন্মদিন উপলক্ষে ইউনিভারসিটি ইন্‌স্টিটিউটে দেশবাসী প্রদত্ত অভিনন্দনের উত্তর।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *