প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
1 of 2

শ্রীকান্ত – ৩য় পর্ব – ০৮

আট

পূর্বেই বলিয়াছি, একদিন সুনন্দা আমাকে দাদা বলিয়া ডাকিয়াছিল, তাহাকে পরমাত্মীয়ের মত কাছে পাইয়াছিলাম। ইহার সমস্ত বিবরণ বিস্তৃত করিয়া না বলিলেও কথাটাকে প্রত্যয় না করিবার বিশেষ কোন হেতু নাই। কিন্তু আমাদের প্রথম পরিচয়ের ইতিহাসটা বিশ্বাস করান শক্ত হইবে হয়ত। অনেকেই মনে করিবেন ইহা অদ্ভুত; হয়ত, অনেকেই মাথা নাড়িয়া কহিবেন, এ-সকল কেবল গল্পেই চলে। তাঁহারা বলিবেন, আমরাও বাঙ্গালী, বাঙ্গলাদেশেরই মানুষ, কিন্তু সাধারণ গৃহস্থঘরে এমন হয় তাহা ত কখনো দেখি নাই! তা বটে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে শুধু ইহাই বলিতে পারি, আমিও এ দেশেরই মানুষ এবং একটির অধিক সুনন্দা এ দেশে আমারও চোখে পড়ে নাই। তত্রাচ ইহা সত্য।

রাজলক্ষ্মী ভিতরে প্রবেশ করিল। আমি তাহাদের ভাঙ্গা প্রাচীরের ধারে দাঁড়াইয়া কোথায় একটু ছায়া আছে খোঁজ করিতেছি, একটি সতেরো-আঠারো বছরের ছোকরা আসিয়া কহিল, আসুন, ভেতরে আসুন।

তর্কালঙ্কারমশাই কোথায়? বিশ্রাম করচেন বোধ হয়?

আজ্ঞে না, তিনি হাটে গেছেন। মা আছেন, আসুন। বলিয়া সে অগ্রবর্তী হইল, এবং যথেষ্ট দ্বিধাভরেই আমি তাহার অনুসরণ করিলাম। একদা কোনকালে হয়ত এ বাটীর সদর দরজা কোথাও ছিল, কিন্তু সম্প্রতি তাহার চিহ্ন পর্যন্ত বিলুপ্ত। অতএব ভূতপূর্ব একটা ঢেঁকিশালার পথে অন্তঃপুরে প্রবেশ করায় নিশ্চয়ই ইহার মর্যাদা লঙ্ঘন করি নাই। প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইয়া সুনন্দাকে দেখিলাম। উনিশ-কুড়ি বছরের শ্যামবর্ণ একটি মেয়ে এই বাড়িটির মতই একেবারে আভরণবর্জিত। সম্মুখের অপরিসর বারান্দার একধারে মুড়ি ভাজিতেছিল,—বোধ হয় রাজলক্ষ্মীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই উঠিয়া দাঁড়াইয়া,—আমাকে জীর্ণ একখানি কম্বলের আসন পাতিয়া দিয়া নমস্কার করিল। কহিল, বসুন। ছেলেটিকে বলিল, অজয়, উনুনে আগুন আছে, একটু তামাক সেজে দাও বাবা। রাজলক্ষ্মী বিনা আসনে পূর্বে উপবিষ্ট হইয়াছিল, তাহার প্রতি চাহিয়া ঈষৎ সলজ্জ হাস্যে কহিল, আপনাকে কিন্তু পান দিতে পারব না, পান আমাদের বাড়িতে নেই।

আমরা কে, অজয় বোধ হয় তাহা জানিতে পারিয়াছিল। সে তাহার গুরুপত্নীর কথায় সহসা অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, নেই? তাহলে পান বুঝি আজ হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে মা?

সুনন্দা তাহার মুখের দিকে একমুহূর্ত মুখ টিপিয়া চাহিয়া থাকিয়া, কহিল, ওটা হঠাৎ আজ ফুরিয়ে গেছে, না কেবল হঠাৎ একদিনই ছিল অজয়? এই বলিয়া সহসা খিল্‌খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিয়া রাজলক্ষ্মীকে বলিল, ও- রবিবারে ছোট মোহন্তঠাকুরের আসবার কথায় এক পয়সার পান কেনা হয়েছিল—সে প্রায় দিন দশেকের কথা। এই! এতেই আমার অজয় একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেছে, পান হঠাৎ ফুরাল কি করে? এই বলিয়া সে আবার হাসিতে লাগিল। অজয় মহা অপ্রতিভ হইয়া বলিতে লাগিল, বাঃ—এই বুঝি! তা বেশ ত, হলই বা ফুরোলই বা—

রাজলক্ষ্মী হাসিমুখে সদয়কণ্ঠে কহিল, তা সত্যিই ত ভাই, ও পুরুষমানুষ, ও কি করে জানবে কি তোমার সংসারে ফুরিয়েছে!

অজয় একজনকেও তাহার অনুকূলে পাইয়া কহিতে লাগিল, দেখুন ত! দেখুন ত! অথচ মা ভাবেন—

সুনন্দা তেম্‌নি সহাস্যে বলিল, হাঁ, মা ভাবেন বৈ কি! না দিদি, আমার অজয়ই হল বাড়ির গিন্নী—ও সব জানে। কেবল এখানে যে কোন কষ্ট আছে, মায় বাবুগিরি পর্যন্ত—এইটেই ও স্বীকার করতে পারে না।

কেন পারব না! বাঃ—বাবুগিরি কি ভাল! ও ত আমাদের—, বলিতে বলিতে কথাটা আর শেষ না করিয়াই সে বোধ করি আমার জন্য তামাক সাজিতেই বাহিরে প্রস্থান করিল।

সুনন্দা কহিল, বামুন-পণ্ডিতের ঘরে হত্তুকীই যথেষ্ট, খুঁজলে এক-আধটা সুপুরিও হয়ত পাওয়া যেতে পারে—আচ্ছা, আমি দেখচি,—এই বলিয়া সেও যাইবার উদ্যোগ করিতেই রাজলক্ষ্মী সহসা তাহার আঁচল ধরিয়া কহিল, হত্তুকী আমার সইবে না ভাই, সুপুরিতেও কাজ নেই। তুমি একটুখানি আমার কাছে স্থির হয়ে বোসো, দুটো কথা কই। এই বলিয়া সে একপ্রকার জোর করিয়াই তাহাকে পার্শ্বে বসাইল।

আতিথ্যের দায় হইতে অব্যাহতি পাইয়া ক্ষণকালের নিমিত্ত উভয়েই নীরব রহিল। এই অবকাশে আমি আর—একবার নূতন করিয়া সুনন্দাকে দেখিয়া লইলাম। প্রথমেই মনে হইল, বস্তুতঃ এই দারিদ্র জিনিসটা সংসারে কতই না অর্থহীন, একজন যদি তাহাকে স্বীকার না করে। এই যে আমাদের সাধারণ বাঙ্গালী-ঘরের সামান্য একটি মেয়ে, বাহির হইতে যাহার কোন বিশেষত্ব নাই—না আছে রূপ, না আছে বস্ত্র-অলঙ্কার; এই ভগ্নগৃহের যেদিকে দৃষ্টিপাত কর, কেবল অভাব-অনটনের ছায়া—কিন্তু তবুও সে যে ওই ছায়ামাত্রই, তার বেশি কিছু নয়, সে কথাও যেন সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পড়িতে বাকী থাকে না। অভাবের দুঃখটাকে এই মেয়েটি কেবলমাত্র যেন চোখের ইঙ্গিতে নিষেধ করিয়া দূরে রাখিয়াছে—জোর করিয়া সে ভিতরে প্রবেশ করে, এতবড় সাহস তাহার নাই। অথচ মাসকয়েক পূর্বেও ইহার সমস্তই ছিল—ঘরবাড়ি, লোকজন, আত্মীয়-বন্ধু—সচ্ছল সংসার, কোন বস্তুরই অভাব ছিল না—শুধু একটা কঠোর অন্যায়ের ততোধিক কঠোর প্রতিবাদ করিতে সমস্ত ছাড়িয়া আসিয়াছে একখণ্ড জীর্ণবস্ত্র ত্যাগ করার মত—মনস্থির করিতে একটা বেলাও লাগে নাই। অথচ, কোথাও কোন অঙ্গে ইহার কঠোরতার কোন চিহ্ন নাই।

রাজলক্ষ্মী হঠাৎ আমাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল, আমি ভেবেছিলুম সুনন্দার বুঝি বয়স হয়েচে। ও হরি! একেবারে ছেলেমানুষ।

অজয় বোধ হয় তাঁহার গুরুদেবের হুঁকাতেই তামাক সাজিয়া আনিতেছিল; সুনন্দা তাহাকে বলিল, ছেলেমানুষ কিরকম! ওই অত বড় বড় ছেলে যার, তার বয়স বুঝি কম! এই বলিয়া সে হাসিতে লাগিল। চমৎকার স্বচ্ছন্দ সরল হাসি। অজয় নিজেই উনুন হইতে আগুন লইবে কি না জিজ্ঞাসা করায় পরিহাস করিয়া কহিল, কি জানি কি জাতের ছেলে বাবা তুমি, কাজ নেই তোমার উনুন ছুঁয়ে। আসল কথা, জ্বলন্ত অঙ্গার চুল্লী হইতে উঠানো শক্ত বলিয়া সে আপনি গিয়া আগুন তুলিয়া কলিকাটার উপরে রাখিয়া দিয়া অজয়ের হাতে দিল, এবং হাসিমুখে ফিরিয়া আসিয়া স্বস্থানে উপবেশন করিল। সাধারণ পল্লীরমণী-সুলভ হাসি-তামাশা হইতে আরম্ভ করিয়া কথায়বার্তায় আচরণে কোনখানে কোন বিশেষত্ব ধরিবার জো নাই, অথচ, ইতিমধ্যে যে সামান্য পরিচয়টুকু তাহার পাইয়াছি তাহা কতই না অসামান্য! এই অসাধারণতার হেতুটা পরক্ষণেই আমাদের দু’জনের কাছেই পরিস্ফুট হইয়া উঠিল।

অজয় আমার হাতে হুঁকাটা দিয়া বলিল, মা ওটা তাহলে তুলে রেখে দি’?

সুনন্দা ইঙ্গিতে সায় দেওয়ায় তাহার দৃষ্টি অনুসরণ করিয়া দেখিলাম, আমারই অদূরে একখণ্ড কাঠের পিঁড়ার উপর মস্ত মোটা একটা পুঁথি এলোমেলোভাবে খোলা পড়িয়া আছে। এতক্ষণ কেহই উহা দেখে নাই। অজয় তাহার পাতাগুলি গুছাইয়া তুলিতে তুলিতে ক্ষুণ্ণস্বরে কহিল, মা, ‘উৎপত্তি-প্রকরণ’টা ত আজো শেষ হ’ল না, কবে আর হবে! ও আর হবেই না।

রাজলক্ষ্মী জিজ্ঞাসা করিল, ওটা কিসের পুঁথি অজয়?

যোগবাশিষ্ঠ।

তোমার মা মুড়ি ভাজছিলেন আর তুমি শোনাচ্ছিলে?

না, আমি মার কাছে পড়ি।

অজয়ের এই সরল ও সংক্ষিপ্ত উত্তরে সুনন্দা হঠাৎ যেন লজ্জায় রাঙ্গা হইয়া উঠিল; তাড়াতাড়ি কহিল, পড়াবার মত বিদ্যে ত ওর মায়ের ছাই আছে! না দিদি, দুপুরবেলা একলা সংসারে কাজ করি; উনি প্রায়ই থাকতে পারেন না, ছেলেরা বই নিয়ে কে যে কখন কি বকে যায় তার বারো আনা আমি শুনতেই পাই নে। ওর কি, যা হোক একটা বলে দিলে।

অজয় তাহার যোগবাশিষ্ঠ লইয়া প্রস্থান করিল। রাজলক্ষ্মী গম্ভীরমুখে স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। মুহূর্তকয়েক পরে সহসা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বাড়িটা আমার কাছাকাছি হ’লে আমিও তোমার চেলা হয়ে যেতুম ভাই। একে ত জানিনে কিছুই, তাতে আহ্নিক—পুজোর কথাগুলোও যদি ঠিকমত বলতে পারতুম!
৭১৪

মন্ত্রোচ্চারণ সম্বন্ধে তাহার সন্দিগ্ধ আক্ষেপ আমি অনেক শুনিয়াছি—ওটা আমার অভ্যাস ছিল; কিন্তু সুনন্দা এই প্রথমে শুনিয়াও কোন কথা কহিল না, কেবল মুচকিয়া একটু হাসিল মাত্র। কি জানি সে কি মনে করিল। হয়ত ভাবিল, যে তাৎপর্য বুঝে না, প্রয়োগ জানে না, শুধু অর্থহীন আবৃত্তির পরিশুদ্ধতায় তার এত দৃষ্টি কেন? হয়ত বা ইহা তাহার কাছেও নূতন নয়,—আমাদের সাধারণ বাঙ্গালী-ঘরের মেয়েদের মুখে এম্‌নি সকরুণ লোভ ও মোহের কথা সে অনেক শুনিয়াছে, ইহার উত্তর দেওয়া বা প্রতিবাদ করাও আর প্রয়োজন মনে করে না। অথবা এ-সকল কিছু নাও হইতে পারে, কেবল স্বাভাবিক বিনয়বশেই মৌন হইয়া রহিল। তবুও এ কথাটা ত মনে না করিয়া পারিলাম না, সে যদি আজ তাহার এই অপরিচিত অতিথিটিকে নিতান্তই সাধারণ মেয়েদের সমান করিয়া, ছোট করিয়া দেখিয়া থাকে ত আবার একদিন তাহার অতিশয় অনুতাপের সহিত মত বদলাইবার প্রয়োজন হইবে।

রাজলক্ষ্মী চোখের পলকে আপনাকে সামলাইয়া লইল। আমি জানি কেহ হাঁ করিলে সে তাহার মনের কথা বুঝিতে পারে। আর সে মন্ত্রতন্ত্রের ধার দিয়াও গেল না। এবং একটু পরেই নিছক ঘরকন্না ও গৃহস্থালীর কথা আরম্ভ করিয়া দিল। তাহাদের মৃদুকণ্ঠের সমস্ত আলোচনা আমার কানেও গেল না, কান দিবার চেষ্টাও করিলাম না। বরঞ্চ তর্কালঙ্কারের থেলো হুঁকায় অজয়-দত্ত শুষ্ক সুকঠোর তামাকু প্রাণপণ করিয়া নিঃশেষ করিতে নিযুক্ত হইলাম।

এই দুটি রমণী অস্পষ্ট মৃদুস্বরে সংসারযাত্রা সম্বন্ধে কোন্‌ জটিল তত্ত্বের সমাধান করিতে লাগিল, সে তাহারাই জানে; কিন্তু তাহাদেরই অদূরে হুঁকাহাতে নীরবে বসিয়া আমার মনে হইতে লাগিল, আজ সহসা একটা কঠিন প্রশ্নের উত্তর পাইয়াছি।

আমাদের বিরুদ্ধে একটা বিশ্রী অভিযোগ আছে, মেয়েদের আমরা হীন করিয়া রাখিয়াছি। এই শক্ত কাজটা যে কেমন করিয়া করিয়াছি এবং কোথায় উহার প্রতিকার, একথা অনেকবার অনেক দিক দিয়া আমি ভাবিয়া দেখিবার চেষ্টা করিয়াছি; কিন্তু আজ সুনন্দাকে ঠিক এমনি করিয়া নিজের চোখে না দেখিলে বোধ করি সংশয় চিরদিন রহিয়াই যাইত।

দেশে ও বিদেশে রকমারি স্ত্রী-স্বাধীনতা কতই না দেখিয়াছি। ইহার যে নমুনা বর্মামুলুকে পা দিয়াই চোখে পড়িয়াছিল তাহা ভুলিবার জো কি! জন-তিনেক ব্রহ্মসুন্দরী প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়াইয়া একটা ষণ্ডামার্কা পুরুষকে আখপেটা করিতেছেন দেখিয়া পুলকে রোমাঞ্চিত ও ঘর্মাক্ত-কলেবর হইয়া উঠিয়াছিলাম। অভয়া মুগ্ধচক্ষে নিরীক্ষণ করিয়া বলিয়াছিল, ‘শ্রীকান্তবাবু, আমাদের বাঙ্গালী মেয়েরা যদি এমনি—’। আমার খুড়ামশাই একবার জন-দুই মারোয়াড়ী রমণীর নামে নালিশ করতে গিয়েছিলেন, তাহারা রেলগাড়িতে নাকি খুড়ার নাক ও কান প্রবল পরাক্রমে মলিয়া দিয়াছিল। শুনিয়া খুড়ীমা আমায় দুঃখ করিয়া বলিয়াছিলেন, আচ্ছা, আমাদের বাঙালীর ঘরে ঘরে যদি ওর চলন থাকত! থাকিলে আমার খুড়ামশাই নিশ্চয় ঘোরতর আপত্তি করিতেন, কিন্তু ইহাতেই যে নারীজাতির হীন অবস্থার প্রতিবিধান হইত, তাহাও ত অসংশয়ে বলা যায় না। ইহাই যে কোথায় এবং কিরূপে হয়, সুনন্দার ভগ্নগৃহের ছিন্ন আসনখানিতে বসিয়া আজ নিঃশব্দে এবং নিঃসন্দেহে অনুভব করিতেছিলাম। কেবল একটা ‘আসুন’ বলিয়া অভ্যর্থনা করা ছাড়া সে আমার সহিত দ্বিতীয় বাক্যালাপ করে নাই, রাজলক্ষ্মীর সঙ্গেও যে কোন বড় কথার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিল তাহাও নয়, কিন্তু সেই যে অজয়ের মিথ্যা আড়ম্বরের প্রত্যুত্তরে হাসিমুখে জানাইয়াছিলে, এ বাড়িতে পান নাই; কিনিবার মত সামর্থ্য নাই,—এখানে উহা দুর্লভ বস্তু! তাহার সকল কথার মাঝে এই কথাটা যেন আমার কানে বাজিতেই ছিল। তাহার সঙ্কোচলেশহীন এইটুকু পরিহাসে দারিদ্র্যের সমস্ত লজ্জা কোথায় যে লজ্জায় মুখ লুকাইল, সারাক্ষণের মধ্যে আর তাহার দেখাই মিলিল না। এক মুহূর্তেই জানা গেল এই ভাঙ্গা বাড়ি, এই জীর্ণ গৃহসজ্জা, এই দুঃখ দৈন্য অনটন—এই নিরাভরণ মেয়েটি তাহাদের অনেক উপরে। অধ্যাপক পিতা দিবার মধ্যে তাঁহার কন্যাকে তাঁহার অশেষ যত্নে ধর্ম ও বিদ্যাদান করিয়া শ্বশুরকুলে পাঠাইয়াছিলেন; তৎপরে সে জুতা-মোজা পরিবে কি ঘোমটা খুলিয়া পথে বেড়াইবে, কিংবা অন্যায়ের প্রতিবাদ করিতে স্বামী-পুত্র লইয়া ভাঙ্গা বাড়িতে বাস করিবে, তথায় মুড়ি ভাজিবে, কি যোগবাশিষ্ঠ পড়াইবে, সে চিন্তা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। মেয়েদের আমরা হীন করিয়াছি কি না এ তর্ক নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু এই দিক দিয়া যদি তাহাদের বঞ্চিত করিয়া থাকি ত সে কর্মের ফলভোগ অনিবার্য। অজয়ের ‘উৎপত্তি প্রকরণ’ উঠিয়া না পড়িলে সুনন্দার লেখাপড়ার কথা আমরা জানিতেও পারিতাম না। তাহার মুড়িভাজা হইতে আরম্ভ করিয়া সরল ও সামান্য হাসি-তামাশার মধ্যে দিয়া যোগবাশিষ্ঠের ঝাঁজ কোথাও উঁকি মারে নাই।

অথচ স্বামীর অবর্তমানে অপরিচিত অতিথির অভ্যর্থনা করিতেও তাহার কোনখানে বাধিল না। নির্জন গৃহের মধ্যে একটা সতেরো-আঠারো বছরের ছেলের সে এতই সহজে ও অবলীলাক্রমে মা হইয়া গিয়াছে যে, শাসন ও সংশয়ের দড়িদড়া দিয়া তাহাকে বাঁধিবার কল্পনাও বোধ করি কোনদিন তাহার স্বামীর মনে উঠে নাই। অথচ ইহারই প্রহরা দিতে ঘরে ঘরে কত প্রহরীই না সৃষ্টি হইয়া গিয়াছে!

তর্কালঙ্কার মহাশয় ছেলেটিকে সঙ্গে করিয়া হাটে গিয়াছিলেন। তাঁহার সহিত দেখা করিয়া যাইবার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এদিকে বেলাও পড়িয়া আসিতেছিল। এই দরিদ্র গৃহলক্ষ্মীর কত কাজই না পড়িয়া আছে মনে করিয়া রাজলক্ষ্মী উঠিয়া পড়িল এবং বিদায় লইয়া কহিল, আজ চললুম, যদি বিরক্ত না হও ত আবার আসব।

আমিও উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলাম, আমারও কথা কইবার লোক কেউ নেই, যদি অভয় দেন ত মাঝে মাঝে আসব।

সুনন্দা মুখে কিছু কহিল না, কিন্তু হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

পথে আসিতে আসিতে রাজলক্ষ্মী কহিল, মেয়েটি চমৎকার। যেমন স্বামী তেমনি স্ত্রী।
ভগবান এদের বেশ মিলিয়েছেন।

আমি কহিলাম, হাঁ।

রাজলক্ষ্মী কহিল, এদের ও-বাড়ির কথাটা আজ আর তুললুম না। কুশারীমহাশয়কে আজও ভাল চিনতে পারিনি, কিন্তু এরা দুটি জা’ই বড় চমৎকার।

বলিলাম, খুব সম্ভব তাই; কিন্তু তোমার ত মানুষ বশ করবার অদ্ভুত ক্ষমতা, দেখ না চেষ্টা করে যদি এদের আবার মিল করে দিতে পার।

রাজলক্ষ্মী মুখ টিপিয়া একটু হাসিয়া বলিল, ক্ষমতা থাকতে পারে, কিন্তু তোমাকে বশ করাটা তার প্রমাণ নয়। চেষ্টা করলে ওটা অনেকেই পারত।

বলিলাম, হতেও পারে। তবে চেষ্টার যখন সুযোগ ঘটেনি তখন তর্ক করায় ফল হবে না।
রাজলক্ষ্মী তেমনি হাসিয়া কহিল, আচ্ছা গো আচ্ছা। দিন এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেছে ভেবে রেখো না।

আজ সারাদিনটাই কেমন একটা মেঘলাটেগোছের করিয়াছিল। অপরাহ্ণ-সূর্য অসময়েই একখণ্ড কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ায় আমাদের সামনের আকাশটা রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছিল। তাহারই গোলাপী ছায়া সম্মুখের কঠিন ধূসর মাঠে ও ইহারই একান্তবর্তী একঝাড় বাঁশ ও গোটা-দুই তেঁতুলগাছে যেন সোনা মাখাইয়া দিয়াছিল। রাজলক্ষ্মীর শেষ অনুযোগের জবাব দিলাম না, কিন্তু ভিতরের মনটা যেন বাহিরের দশদিকের মতই রাঙ্গিয়া উঠিল। অলক্ষ্যে একবার তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া দেখিলাম, ওষ্ঠাধরে হাসি তখনও সম্পূর্ণ মিলায় নাই, বিগলিত স্বর্ণপ্রভায় এই একান্ত পরিচিত হাসিমুখখানি একেবারে যেন অপূর্ব মনে হইল। হয়ত এ কেবল আকাশের রঙই নয়; হয়ত যে আলো আর এক নারীর কাছ হইতে এইমাত্র আমি আহরণ করিয়া আনিয়াছিলাম, তাহারই অপরূপ দীপ্তি ইহারও অন্তরে খেলিয়া বেড়াইতেছিল। পথে আমরা ছাড়া আর কেহ ছিল না। সে সুমুখে আঙ্গুল বাড়াইয়া কহিল, তোমার ছায়া পড়েনি কেন বল ত? চাহিয়া দেখিলাম অদূরে ডান দিকে আমাদের অস্পষ্ট ছায়া এক হইয়া মিলিয়াছে। কহিলাম, বস্তু থাকলে ছায়া পড়ে—বোধ হয় ওটা আর নেই।

আগে ছিল?

লক্ষ্য করে দেখিনি, ঠিক মনে পড়চে না।

রাজলক্ষ্মী হাসিয়া বলিল, আমার পড়চে—ছিল না। এতটুকু বয়স থেকে ওটা দেখতে শিখেছিলাম। এই বলিয়া সে একটা পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, আজকের দিনটা আমার বড় ভাল লেগেচে। মনে হচ্চে এতদিন পরে একটি সঙ্গী পেলাম। এই বলিয়া সে আমার প্রতি চাহিল। আমি কিছু কহিলাম না, কিন্তু মনে মনে নিশ্চয় বুঝিলাম, সে ঠিক সত্য কথাটাই কহিয়াছে।

বাটী আসিয়া পৌঁছিলাম। কিন্তু ধূলা-পা ধুইবার অবকাশ মিলিল না, শান্তি ও তৃপ্তি দুই-ই একই সঙ্গে অন্তর্হিত হইল। দেখি, বাহিরের উঠান ভরিয়া জন দশ-পনর লোক বসিয়া আছে। আমাদের দেখিয়া সসম্ভ্রমে উঠিয়া দাঁড়াইল। রতন বোধ হয় এতক্ষণ বক্তৃতা করিতেছিল, তাহার মুখ উত্তেজনা ও নিগূঢ় আনন্দে চক্‌চক্‌ করিতেছে; কাছে আসিয়া কহিল, মা, বার বার যা বলেচি ঠিক তাই হয়েচে।

রাজলক্ষ্মী অধীরভাবে কহিল, কি বলেছিলি আমার মনে নেই, আর একবার বল্‌।

রতন কহিল, নব্‌নেকে পুলিশের লোক হাতকড়ি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে গেছে।

বেঁধে নিয়ে গেছে! কখন? কি করেছিল সে?

মালতীকে সে এক্কেবারে খুন করে ফেলেচে।

বলিস কি রে! তাহার মুখ একেবারে সাদা হইয়া গেল।

কিন্তু কথা শেষ না হইতেই অনেকে একসঙ্গে বলিয়া উঠিল, না না, মাঠাকরুন, এক্কেবারে খুন করেনি। খুব মেরেচে বটে, কিন্তু মেরে ফেলেনি।

রতন চোখ রাঙ্গাইয়া কহিল, তোরা কি জানিস? তাকে হাসপাতালে পাঠাতে হবে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্চে না। গেল কোথা? তোদের সুদ্ধ হাতে দড়ি পড়তে পারে জানিস?

শুনিয়া সকলের মুখ শুকাইল। কেহ কেহ সরিবার চেষ্টাও করিল। রাজলক্ষ্মী রতনের প্রতি কঠিন দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, তুই ওধারে দাঁড়া গে যা। যখন জিজ্ঞেস করব বলিস। ভিড়ের মধ্যে মালতীর বুড়া বাপ পাংশুমুখে দাঁড়াইয়া ছিল। আমরা সবাই তাহাকে চিনিতাম, ইঙ্গিতে কাছে ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, কি হয়েচে সত্যি বল ত বিশ্বনাথ! লুকালে কিংবা মিছে কথা কইলে বিপদে পড়তে পার।

বিশ্বনাথ যাহা কহিল তাহা সংক্ষেপে এইরূপ। কাল রাত্রি হইতে মালতী তাহার পিতার বাটীতে ছিল। আজ দুপুরবেলা সে পুকুরে জল আনিতে গিয়াছিল। তাহার স্বামী নবীন কোথায় লুকাইয়া ছিল, একাকী পাইয়া বিষম প্রহার করিয়াছে—এমন কি মাথা ফাটাইয়া দিয়াছে। মালতী কাঁদিতে কাঁদিতে প্রথমে এখানে আসে, কিন্তু আমাদের দেখা না পাইয়া কুশারীমহাশয়ের সন্ধানে কাছারি বাটীতে যায়, সেখানে তাঁহারও সাক্ষাৎ না পাইয়া সোজা থানায় গিয়া সমস্ত মারধরের চিহ্ন দেখাইয়া পুলিশ সঙ্গে করিয়া আনিয়া নবীনকে ধরাইয়া দেয়। সে তখন ঘরেই ছিল, নিজের হাতে দুটো চাল সিদ্ধ করিয়া খাইতে বসিতেছিল, সুতরাং পলাইবার সুযোগ পায় নাই। দারোগাবাবু লাথি মারিয়া ভাত ফেলিয়া দিয়া তাহাকে বাঁধিয়া লইয়া গিয়াছেন।

ব্যাপার শুনিয়া রাজলক্ষ্মী অগ্নিমূর্তি হইয়া উঠিল। সে মালতীকে যেমন দেখিতে পারিত না, নবীনের প্রতিও তেম্‌নি প্রসন্ন ছিল না, কিন্তু তাহার সমস্ত রাগ পড়িল গিয়া আমার উপরে। ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, তোমাকে এক শ’ বার বলেচি, ছোটলোকদের এসব নোংরা কাণ্ডের মধ্যে তুমি যেয়ো না।

যাও এখন সামলাও গে—আমি কিছু জানিনে। এই বলিয়া সে আর কোনদিকে দৃক্‌পাত না করিয়া দ্রুতপদে বাটীর ভিতর চলিয়া গেল। বলিতে বলিতে গেল, নব্‌নের ফাঁসি হওয়াই উচিত। আর ও হারামজাদী যদি মরে থাকে ত আপদ গেছে।

কিছুক্ষণের নিমিত্ত আমরা সবাই যেন আড়ষ্ট হইয়া গেলাম। বকুনি খাইয়া মনে হইতে লাগিল কাল এম্‌নি সময়ে মধ্যস্থ হইয়া ইহাদের যে মীমাংসা করিয়া দিয়াছিলাম তাহা ভাল হয় নাই। না করিলে এ দুর্ঘটনা হয়ত আজ ঘটিত না। কিন্তু আমার মতলব ভাল ছিল। ভাবিয়াছিলাম, প্রেমলীলার যে অদৃশ্য চাপা-স্রোতটা অন্তরালে বহিয়া সমস্ত পাড়াটাকে নিরন্তর ঘুলাইয়া তুলিতেছে, তাহাকে মুক্ত করিয়া দিলে হয়ত ভাল হইবে। দেখিতেছি ভুল করিয়াছি। কিন্তু তার পূর্বে সমস্ত ব্যাপারটা একটু বিস্তৃত করিয়া বলা প্রয়োজন। মালতী নবীন ডোমের স্ত্রী বটে, কিন্তু এখানে আসিয়া পর্যন্ত দেখিতেছি, সমস্ত ডোমপাড়ার মধ্যে সে একটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ-বিশেষ। কখন কোন্‌ পরিবারের মাঝে সে যে অগ্নিকাণ্ড বাধাইয়া দিবে, এ লইয়া কোন মেয়ের মনেই শান্তি নাই। এই যুবতী মেয়েটা যেমন সুশ্রী তেমনি চপল। সে কাঁচপোকার টিপ পরে, নেবুর তেল মাখিয়া চুল বাঁধে, পরনে তার মিলের চওড়া কালোপেড়ে শাড়ি, তাহার মাথার ঘোমটা পথেঘাটে ঘাড়ে নামিয়া পড়িবার কোন বাধা নাই। এই মুখরা মেয়েটাকে মুখের সামনে বলিবার কাহারো সাহস নাই, কিন্তু অগোচরে তাহার নামের সঙ্গে যে বিশেষণ পাড়ার মেয়েরা যোগ করিয়া দেয়, তাহা লেখা চলে না। প্রথমে নাকি মালতী নবীনের ঘর করিতে চাহে নাই, বাপের বাড়িতেই থাকিত। বলিত, ও আমাকে খাওয়াবে কি? এবং সেই ধিক্কারেই নাকি নবীন দেশত্যাগী হইয়া কোথায় কোন শহরে গিয়া পিয়াদাগিরি চাকরি করিয়া বছরখানেক হইল গ্রামে ফিরিয়াছে। আসিবার সময় মালতীর রূপার পৈঁচা, মিহি সুতার শাড়ি, রেশমের ফিতা, এক বোতল গোলাপজল এবং একটা টিনের তোরঙ্গ সঙ্গে আনিয়াছে এবং এইগুলির পরিবর্তে স্ত্রীকে শুধু ঘরে আনা নয়, তাহার হৃদয় পর্যন্ত অধিকার করিয়াছিল; কিন্তু এ সকল আমার শোনা কথা। আবার কবে হইতে যে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ জাগিল, ঘাটে যাবার পথে আড়ি পাতিয়া লক্ষ্য করিতে লাগিল, এবং অতঃপর যাহা শুরু হইয়া গেল, আমি ঠিক জানি না। আমরা ত আসিয়া অবধি দেখিতেছি, ইহাদের বাক্‌ ও হাত-যুদ্ধ কোনদিন কামাই যায় না। মাথা ফাটাফাটি কেবল আজ নয়, আরও দিন-দুই হইয়া গেছে—বোধ করি, এই জন্যও আজ নবীন মোড়ল স্ত্রীর মাথা ভাঙ্গিয়া আসিয়াও নিশ্চিন্তচিত্তে আহারে বসিতেছিল, কল্পনাও করে নাই পুলিশ ডাকিয়া মালতী তাহাকে বাঁধিয়া চালান দিবে। কাল সকালে প্রভাতী রাগিণীর ন্যায় মালতীর তীক্ষ্ণকণ্ঠ যখন গগন ভেদ করিয়া উঠিল, রাজলক্ষ্মী ঘরের কাজ ফেলিয়া কাছে আসিয়া কহিল, বাড়ির পাশে রোজ এ হাঙ্গামা সহ্য হয় না—নাহয় কিছু টাকাকড়ি দিয়ে হতভাগীকে তুমি দূর করে দাও।

বলিলাম, নবীনটাও কম পাজী নয়। কাজকর্ম করবে না, কেবল টেরি কেটে আর মাছ ধরে বেড়াবে, আর হাতে পয়সা পেলেই তাড়ি খেয়ে মারপিট শুরু করবে। বলা বাহুল্য, এ-সকল সে শহরে শিখিয়া আসিয়াছিল।

দুই-ই সমান! বলিয়া সে ভিতরে চলিয়া গেল। বলিতে বলিতে গেল, কাজকর্ম করবেই বা কখন? হারামজাদী তার সময় দিলে ত!

বস্তুতঃ অসহ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ইহাদের গালিগালাজ ও মারামারির মকদ্দমা আরও বার-দুই করিয়াছি—কোন ফল হয় নাই। আজ ভাবিলাম খাওয়া-দাওয়ার পরে ডাকাইয়া আনিয়া এইবার শেষ মীমাংসা করিয়া দিব। কিন্তু ডাকিতে হইল না, দুপুরবেলা পাড়ার মেয়ে-পুরুষে বাড়ি ভরিয়া গেল। নবীন কহিল, বাবুমশায়, ওকে আর আমি চাইনে—নষ্ট মেয়েমানুষ। ও আমার ঘর থেকে দূর হয়ে যাক।

মুখরা মালতী ঘোমটার ভিতর হইতে কহিল, ও আমার শাঁখা-নোয়া খুলে দিক।

নবীন বলিল, তুই আমার রুপোর পৈঁচে ফিরিয়ে দে।

মালতী তৎক্ষণাৎ হাত হইতে সে-দুইগাছা টানিয়া খুলিয়া দূর করিয়া ফেলিয়া দিল।

নবীন কুড়াইয়া লইয়া কহিল, আমার টিনের তোরঙ্গ তুই নিতে পাবিনে।

মালতী কহিল, আমি চাইনে। এই বলিয়া সে আঁচল হইতে চাবি খুলিয়া তাহার পায়ের কাছে ছুঁড়িয়া দিল।

নবীন তখন বীরদর্পে অগ্রসর হইয়া মালতীর শাঁখা পটপট করিয়া ভাঙ্গিয়া দিল এবং নোয়াগাছটা টানিয়া খুলিয়া প্রাচীর ডিঙ্গাইয়া দূর করিয়া ফেলিয়া দিল। কহিল, যা, তোকে বিধবা করে দিলাম।

আমি ত অবাক হইয়া গেলাম। একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি তখন বুঝাইয়া বলিল যে, এরূপ না হইলে মালতীর নিকা করা আর হইত না—সমস্তই ঠিকঠাক আছে।

কথায় কথায় ব্যাপারটা আরও বিশদ হইল। বিশ্বেশ্বরের বড়জামায়ের ভাই আজ ছয় মাস ধরিয়া হাঁটাহাঁটি করিতেছে। তাহার অবস্থা ভাল, বিশুকে সে কুড়ি টাকা নগদ দিবে, এবং মালতীকে পায়ে মল, হাতে রুপোর চুড়ি এবং নাকে সোনার নথ দিবে বলিয়াছে, এমন কি এগুলি সে বিশুর কাছে জমা রাখিয়া পর্যন্ত দিয়াছে।

শুনিয়া সমস্ত জিনিসটাই অত্যন্ত বিশ্রী ঠেকিল। কিছুদিন হইতে যে একটা কদর্য ষড়যন্ত্র চলিতেছিল, তাহা নিঃসন্দেহ, এবং না জানিয়া হয়ত আমি তাহার সাহায্যই করিলাম। নবীন কহিল, আমি ত এই চাই। শহরে গিয়ে এবার মজা করে চাকরি করব—তোর মত অমন দশগণ্ডা বিয়ে করব। রাঙামাটির হরি মোড়ল ত তার মেয়ের জন্য সাধাসাধি করচে, তার পায়ের নোখেও তুই লাগিস নে। এই বলিয়া সে তাহার রূপার পৈঁচা ও তোরঙ্গের চাবি ট্যাঁকে গুঁজিয়া চলিয়া গেল। এই আস্ফালন সত্ত্বেও কিন্তু তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল না যে, তাহার শহরের চাকরি কিংবা হরি মোড়লের মেয়ে কোনটার আশাই তাহার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করিয়া ধরিয়াছে।

রতন আসিয়া কহিল, বাবু, মা বলচেন এ-সব নোংরা কাণ্ড বাড়ি থেকে বিদায় করুন।

আমাকে করিতে কিছু হইল না, বিশ্বেশ্বর মোড়ল তাহার মেয়েকে লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল; কিন্তু পাছে আমার পায়ের ধুলো লইতে আসে, এই ভয়ে তাড়াতাড়ি গিয়া ঘরে ঢুকিলাম। ভাবিবার চেষ্টা করিলাম, যাক, যা হইল তা ভালই হইল। মন যখন ভাঙ্গিয়াছে এবং উপায় যখন আছে, তখন ব্যর্থ আক্রোশে নিত্য-নিয়ত মারামারি কাটাকাটি করিয়া ঘর করার চেয়ে এ ভাল।

কিন্তু আজ সুনন্দার বাটী হইতে ফিরিয়া শুনিলাম, গত কল্যকার নিষ্পত্তি অমন নিছক ভালই হয় নাই। সদ্যবিধবা মালতীর উপর নবীন স্বামীত্বের দাবি-দাওয়া সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করিলেও মারপিটের অধিকার ছাড়ে নাই। সে এ-পাড়া হইতে ও-পাড়ায় গিয়া হয়ত সমস্ত সকালটা লুকাইয়া অপেক্ষা করিয়াছে এবং এক সময়ে একাকী পাইয়া বিষম কাণ্ড করিয়া আসিয়াছে। কিন্তু মেয়েটাই বা গেল কোথায়?

সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিমের জানালা দিয়া মাঠের দিকে চাহিয়া ভাবিতেছিলাম, খুব সম্ভব মালতী পুলিশের ভয়ে কোথায় লুকাইয়া আছে, কিন্তু নবীনকে সে যে ধরাইয়া দিয়াছে, ভালই করিয়াছে। হতভাগার উপযুক্ত শাস্তি হইয়াছে—মেয়েটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিবে।

রাজলক্ষ্মী সন্ধ্যার প্রদীপ হাতে ঘরে ঢুকিয়া ক্ষণকাল থমকিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু কোন কথা কহিল না। নীরবে বাহির হইয়া পাশের ঘরের চৌকাঠে পা দিয়াই কিন্তু কি একটা ভারী জিনিস পড়ার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল। ছুটিয়া গিয়া দেখি মস্ত একটা কাপড়ের পুঁটুলি দুই হাত বাড়াইয়া তাহার পা ধরিয়া তাহারি উপর মাথা খুঁড়িতেছে। রাজলক্ষ্মীর হাতের প্রদীপটা পাড়িয়া গেলেও জ্বলিতেছিল, তুলিয়া ধরিতেই সেই মিহি সূতার চওড়া কালাপেড়ে শাড়ি চোখে পড়িল!

বলিলাম, এ মালতী!

রাজলক্ষ্মী কহিল, হতভাগী, সন্ধ্যাবেলায় আমায় ছুঁলি? ইস্! এ কি বল্‌ ত?

প্রদীপের আলোকে ঠাহর করিয়া দেখিলাম, তাহার মাথার ক্ষত হইতে পুনরায় রক্ত ঝরিয়া অপরের পা-দুখানি রাঙ্গা হইয়া উঠিয়াছে, এবং সঙ্গে সঙ্গেই হতভাগিনীর কান্না যেন শতধারে ফাটিয়া পড়িল; কহিল, মা, আমাকে বাঁচাও—

রাজলক্ষ্মী কটুকণ্ঠে কহিল, কেন, তোর আবার হ’ল কি?

সে কাঁদিয়া কহিল, দারোগা বলচে কাল সকালেই তাকে চালান দেবে—দিলেই পাঁচ বচ্ছরের জেল হয়ে যাবে।

আমি কহিলাম, যেমন কর্ম তেমনি শাস্তি হওয়া ত চাই।

রাজলক্ষ্মী কহিল, হ’লই বা জেল, তাতে তোর কি?

মেয়েটার কান্না যেন দমকা ঝড়ের মত তাহার বুক ফাটিয়া উঠিল; বলিল, বাবু বলেন বলুন, মা, ও-কথা তুমি ব’লো না—তার মুখের ভাত আমি খেতে দিইনি। বলিতে বলিতে সে আবার মাথা কুটিতে লাগিল; কহিল, মা, আমাদের তুমি এইবারটি বাঁচিয়ে দাও, আমরা বিদেশে কোথাও চলে গিয়ে ভিক্ষে করে খাব। নইলে তোমারি পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে মরব।

হঠাৎ রাজলক্ষ্মীর দুই চোখ দিয়া বড় বড় জলের ফোঁটা গড়াইয়া পড়িল; ধীরে ধীরে তাহার একরাশ এলোচুলের উপর হাত রাখিয়া রুদ্ধস্বরে কহিল, আচ্ছা আচ্ছা, তুই চুপ কর্—আমি দেখচি।

দেখিতেও হইল। রাজলক্ষ্মীর বাক্স হইতে শ’-দুই টাকা সেই রাত্রেই কোথায় গিয়া অন্তর্হিত হইল, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই; কিন্তু নবীন মোড়ল কিংবা মালতী কাহাকেও সকাল হইতে গঙ্গামাটিতে দেখিত পাওয়া গেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *