দত্তা – ২১-২২

একবিংশ পরিচ্ছেদ

বিলাস যথাসময়ে কাছারিতে আসিয়া নিজের কাজ করিয়া বাড়ি চলিয়া যাইত; নিতান্ত প্রয়োজন হইলে কর্মচারী পাঠাইয়া বিজয়ার মত লইত, কিন্তু আপনি আসিত না। তাহাকে ডাকাইয়া না পাঠাইলে যে নিজে যাচিয়া আসিবে না, ইহাও বিজয়া বুঝিয়াছিল। অথচ তাহার আচরণের মধ্যে অনুতাপ এবং আহত অভিমানের বেদনা ভিন্ন ক্রোধের জ্বালা প্রকাশ পাইত না বলিয়া বিজয়ার নিজেরও রাগ পড়িয়া গিয়াছিল।

বরঞ্চ, আপনার ব্যবহারের মধ্যেই কেমন যেন একটা নাটক অভিনয়ের আভাস অনুভব করিয়া তাহার মাঝে মাঝে ভারী লজ্জা করিত। প্রায়ই মনে হইত, কত লোকেই না জানি এই লইয়া হাসি-তামাশা করিতেছে। তা ছাড়া যে লোক সকলের চক্ষেই এতদিন সর্বময় হইয়া বিরাজ করিতেছিল, বিশেষ করিয়া জমিদারির কাজে-অকাজে সে যাহাদিগকে শাসন করিয়া শত্রু করিয়া তুলিয়াছে, তাহাদের সকলের কাছে তাহাকে অকস্মাৎ এতখানি ছোট করিয়া দিয়া বিজয়া আপনার নিভৃত হৃদয়ে সত্যকার ব্যথা অনুভব করিতেছিল। পূর্বের অবস্থাকে ফিরাইয়া না আনিয়া শুধু এই ঘটনাকে কোনমতে সে যদি সম্পূর্ণ ‘না’ করিয়া দিতে পারিত তাহা হইলে বাঁচিয়া যাইত। এমনি যখন তাহার মনের ভাব, সেই সময় হঠাৎ একদিন বিকালে কাছারির বেহারা আসিয়া জানাইল বিলাসবাবু দেখা করিতে চান।

ব্যাপারটা একেবারে নূতন। বিজয়া চিঠি লিখিতেছিল, মুখ না তুলিয়াই কহিল, আসতে বল। তাহার মনের ভিতরটা অজ্ঞাত আশঙ্কায় দুলিতে লাগিল; কিন্তু বিলাস প্রবেশ করিতেই সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া শান্তভাবে নমস্কার করিয়া কহিল, আসুন। বিলাস আসন গ্রহণ করিয়া বলিল, কাজের ভিড়ে আসতে পারিনে, তোমার শরীর ভাল আছে?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হাঁ।

সেই ওষুধটাই চলছে?

বিজয়া ইহার উত্তর দিল না, কিন্তু বিলাসও প্রশ্নের পুনরুক্তি না করিয়া অন্য কথা কহিল। বলিল, কাল নব-বৎসরের নূতন দিন—আমার ইচ্ছা হয় সকলকে একত্র করে কাল সকালবেলা একটু ভগবানের নাম করা হয়।

সে যে তাহার প্রশ্ন লইয়া পীড়াপীড়ি করিল না, কেবল ইহাতেই বিজয়ার মনের উপর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে খুশী হইয়া বলিয়া উঠিল, এ ত খুব ভাল কথা।

বিলাস বলিল, কিন্তু নানা কারণে মন্দিরে যাওয়ার সুবিধে হলো না। যদি তোমার অমত না হয় ত আমি বলি এইখানেই—

বিজয়া তৎক্ষণাৎ সম্মত হইয়া সায় দিল, এমন কি উৎসাহিত হইয়া উঠিল। কহিল, তা হলে ঘরটাকে একটুখানি ফুল-পাতা-লতা দিয়ে সাজালে ভাল হয় না? আপনাদের বাড়িতে ত ফুলের অভাব নেই—যদি মালীকে হুকুম দিয়ে কাল ভোর থাকতেই—কি বলেন? হতে পারে না কি?
বিলাস বিশেষ কোন প্রকার আনন্দের আড়ম্বর না দেখাইয়া সহজভাবে বলিল, বেশ, তাই হবে। আমি সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক করে দেব।

বিজয়া ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, কাল ত বৎসরের প্রথম দিন—আচ্ছা, আমি বলি কি অমনি একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করলে কি—

বিলাস এ প্রস্তাবও অনুমোদন করিল এবং উপাসনার পরে জলযোগের আয়োজন যাহাতে ভাল রকম হয়, সে বিষয়ে নায়েবকে হুকুম দিয়া যাইবে জানাইল। আরও দুই-চারিটা সাধারণ কথাবার্তার পরে সে বিদায় গ্রহণ করিলে বহুদিনের পরে বিজয়ার অন্তরের মধ্যে তৃপ্তি ও উল্লাসের দক্ষিণা-বাতাস দিতে লাগিল। সেদিনকার সেই প্রকাশ্য সংঘর্ষের পর হইতে অব্যক্ত গ্লানির আকারে যে বস্তুটি তাহাকে অনুক্ষণ দুঃখ দিতেছিল, তাহার ভার যে কত ছিল, আজ নিষ্কৃতি পাইয়া সে যেমন অনুভব করিল এমন বোধ করি কোনদিন করে নাই। তাই আজ তাহার ব্যথার সহিত মনে হইতে লাগিল, এই কয়েকদিনের মধ্যে বিলাস পূর্বেকার অপেক্ষা যেন অনেকটা রোগা হইয়া গিয়াছে। অপমান ও অনুশোচনার আঘাত ইহার প্রকৃতিকে যে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে তাহা চোখের উপর সুস্পষ্ট দেখিতে পাইয়া অজ্ঞাতসারে বিজয়ার দীর্ঘশ্বাস পড়িল, এবং বৃদ্ধ রাসবিহারীর সেদিনের কথাগুলি চুপ করিয়া বসিয়া মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিল। বিলাসবিহারী তাহাকে যে অত্যন্ত ভালবাসে তাহা ভাষায়, ইঙ্গিতে, ভঙ্গীতে, সর্বপ্রকারেই ব্যক্ত করা হইয়াছে, অথচ একটা দিনের জন্যও সঙ্গোপনে এই ভালবাসার কথা বিজয়ার মনে স্থান পায় না। বরঞ্চ, সন্ধ্যার ঘনীভূত অন্ধকারে একাকী ঘরের মধ্যে সঙ্গ-বিহীন প্রাণটা যখন ব্যথায় ব্যাকুল হইয়া উঠে, তখন কল্পনার নিঃশব্দ-পদসঞ্চারে ধীরে ধীরে যে আসিয়া তাহার পাশে বসে, সে বিলাস নয়, আর একজন। অলস মধ্যাহ্নে বইয়ে যখন মন বসে না, সেলাইয়ের কাজও অসহ্য বোধ হয়, প্রকাণ্ড শূন্য বাড়িটা রবি-করে খাঁ খাঁ করিতে থাকে তখন সুদূর ভবিষ্যতে একদিন এই শূন্য গৃহই পূর্ণ করিয়া যে ঘরকন্নার স্নিগ্ধ ছবিটি তাহার অন্তরে ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতে থাকে, তাহার মধ্যে কোথাও বিলাসের জন্য এতটুকু স্থান থাকে না।অথচ, যে লোকটি সমস্ত জায়গা জুড়িয়া বসে, সংসার-যাত্রার দুর্গম পথে সহায় বা সহযোগী হিসাবে মূল্য তাহার বিলাসের অপেক্ষা অনেক কম। সে যেমন অপটু, তেমনি নিরুপায়। বিপদের দিনে ইহার কাছে কোন সাহায্যই মিলিবে না। তবুও এই অকেজো মানুষটারই সমস্ত অকাজের বোঝা সে নিজে সারাজীবন মাথায় লইয়া চলিতেছে মনে করিতেও বিজয়ার সমস্ত দেহ-মন অপরিমিত আনন্দবেগে থরথর করিয়া কাঁপিতে থাকে। বিলাস চলিয়া গেলে বিজয়ার এই মনোভাবের আজও যে কোন ব্যতিক্রম ঘটিল তাহা নহে, কিন্তু আজ সে বিনা প্রার্থনায় বিলাসের দোষের পুনর্বিচারের ভার হাতে তুলিয়া লইল, এবং ঘটনাচক্রে তাহার স্বভাবের যে পরিচয় প্রকাশ পাইয়াছে বাস্তবিক স্বভাব যে তাহার এত হীন নহে, কাহারও সহিত কোন তর্ক না করিয়া সে আপনা-আপনি তাহা মানিয়া লইল।
এমন কি, নিরতিশয় উদারতার সহিত ইহাও আজ সে আপনার কাছে গোপন করিল না যে, বিলাসের মত মানসিক অবস্থায় পড়িয়া জগতে অধিকাংশ লোকেই হয়ত ভিন্নরূপ আচরণ দেখাইতে পারিত না। সে যে ভালবাসিয়াছে এবং ভালবাসার অপরাধই তাহাকে লাঞ্ছিত এবং দণ্ডিত করিয়াছে, ইহাই বার বার স্মরণ করিয়া আজ সে করুণামিশ্রিত মমতার সহিত তাহাকে মার্জনা করিল।

সকালে উঠিয়া শুনিল, বিলাস বহুপূর্বেই লোকজন লইয়া ঘর-সাজানোর কাজে লাগিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হইয়া নীচে নামিয়া আসিয়া লজ্জিতভাবে কহিল, আমাকে ডেকে পাঠান নি কেন?

বিলাস স্নিগ্ধস্বরে বলিল, দরকার কি!

বিজয়া একটু হাসিয়া প্রসন্নমুখে জবাব দিল, আমি বুঝি এতই অকর্মণ্য যে এদিকেও কিছু সাহায্য করতে পারিনে? আচ্ছা, এখন বলুন আমি কি করব?

অনেক দিনের পর বিলাস আজ হাসিল, কহিল, তুমি শুধু নজর রেখো, আমাদের কাজে ভুল হচ্ছে কিনা।

আচ্ছা, বলিয়া বিজয়া হাসিমুখে একটা কোচের উপর গিয়া বসিল। খানিক পরেই প্রশ্ন করিল, খাবার বন্দোবস্ত?

বিলাস ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, সমস্ত ঠিক হচ্চে—কোন চিন্তা নেই।

আচ্ছা, আমি কেন সেই দিকেই যাইনে?

বেশ ত। বলিয়া বিলাস পুনরায় কাজে মন দিল।

বেলা আটটার মধ্যেই সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হইয়া গেল। ইতিমধ্যে বিজয়া অনেকবার আনাগোনা করিয়া অনেক ছোটখাট ব্যাপারে বিলাসের পরামর্শ লইয়া গেছে—কোথাও বাধে নাই। না জানিয়া কখন যে সঞ্চিত বিরোধের গ্লানি কাটিয়া উভয়ের কথাবার্তার পথ এমন সহজ ও সুগম হইয়া গিয়াছিল, দুইজনের কেহই বোধ করি খেয়াল করে নাই।

বিজয়া হাসিয়া বলিল, আমাকে একবারে অপদার্থ মনে করে বাদ দিলেন কিন্তু আমিও আপনার একটা ভুল ধরেচি তা বলচি।

বিলাস একটু আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, অপদার্থ একবারও মনে করিনি, কিন্তু ভুল কি রকম?

বিজয়া বলিল, আমরা আছি ত মোটে চার-পাঁচজন, কিন্তু খাবারের আয়োজন হয়ে পড়েচে প্রায় কুড়ি জনের, তা জানেন?

বিলাস কহিল, সে ত বটেই। বাবা তাঁর কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে নিমন্ত্রণ করেচেন। তাঁরা ক’জন, কে কে আসবেন, তা ত ঠিক জানিনে।

বিজয়া ভয়ানক বিস্ময়াপন্ন হইয়া কহিল, কৈ, সে ত আমাকে বলেন নি?

বিলাস নিজেও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখান থেকে কাল আমি যাবার পরে বাবা তোমাকে চিঠি লিখে জানান নি?

না।

কিন্তু তিনি যে স্পষ্ট বললেন—বিলাস থমকিয়া গেল।

বিজয়া প্রশ্ন করিল, কি বললেন?

বিলাস ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিল, হয়ত আমারই শোনবার ভুল হয়েছে। তিনি চিঠি লিখে জানাবেন বলে বোধ করি ভুলে গেছেন।

বিজয়া আর কোন প্রশ্ন করিল না; কিন্তু তাহার মনের ভিতর জ্যোৎস্নার প্রসন্নতা সহসা যেন মেঘে ঢাকিয়া গেল।
আধ-ঘণ্টা পরে রাসবিহারী স্বয়ং আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং বেলা নয়টার মধ্যেই তাঁহার নিমন্ত্রিত বন্ধুর দল একে একে দেখা দিতে লাগিলেন। ইঁহাদের সকলেই ব্রাহ্মসমাজের নহেন, সম্ভবতঃ তাঁহারা রাসবিহারীর সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়াই আসিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

রাসবিহারী সকলকেই পরম সমাদরে গ্রহণ করিলেন এবং বিজয়ার সহিত যাঁহাদের সাক্ষাৎ-পরিচয় ছিল না, তাঁহাদের পরিচিত করাইতে গিয়া অচির-ভবিষ্যতে এই মেয়েটির সহিত নিজের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের ইঙ্গিত করিতেও ত্রুটি করিলেন না। বিজয়া অস্ফুট-কণ্ঠে অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাদিগকে আসন গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিল। এই সকল প্রচলিত ভদ্রতা-রক্ষার কার্যে সে যখন ব্যাপৃত, তখন অদূরে বাগানের সঙ্কীর্ণ পথে দয়ালবাবু দেখা দিলেন। কিন্তু তিনি একা নহেন, একজন অপরিচিত তরুণী আজ তাঁহার সঙ্গে। মেয়েটি সুশ্রী, বয়স বোধ করি বিজয়ার অপেক্ষা কিছু বেশী। কাছে আসিয়া দয়াল তাহাকে আপনার ভাগ্নী বলিয়া পরিচয় দিলেন। নাম নলিনী, কলিকাতার কলেজে বি. এ. পড়ে। এখনো গরমের ছুটি শুরু হয় নাই বটে, কিন্তু মামীর অসুখে সেবা করিবার জন্য কিছু পূর্বেই দিন-দুই হইল মামার কাছে আসিয়াছে, এবং স্থির হইয়াছে, গ্রীষ্মের অবকাশটা এইখানেই কাটাইয়া যাইবে।
নলিনীকে যে বিজয়া কলিকাতায় একেবারে দেখে নাই তাহা নহে, কিন্তু আলাপ ছিল না। তথাপি এতগুলি পরিচিত ও অপরিচিত পুরুষের মধ্যে আজ সেই তাহার কাছে সকলের চেয়ে অন্তরঙ্গ বলিয়া মনে হইল। বিজয়া দুই হাত বাড়াইয়া তাঁহাকে গ্রহণ করিয়া ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল, এবং পাশে বসাইয়া ভাব করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

উপাসনা সাড়ে-নয়টার সময় শুরু করিবার কথা। তখনো কিছু বিলম্ব ছিল বলিয়া, সকলেই বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইয়া আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় রাসবিহারীর উচ্চকণ্ঠ ঘরের মধ্যে হইতে শোনা গেল। তিনি অত্যন্ত আদর করিয়া কাহাকে যেন বলিতেছিলেন, এসো বাবা, এসো। তোমার কত কাজ, তুমি যে সময় করে আসতে পারবে এ আমি আশা করিনি।

এই সম্মানিত কাজের ব্যক্তিটি কে জানিবার জন্য বিজয়া মুখ তুলিয়া সম্মুখেই দেখিল নরেন্দ্র। কিন্তু অসম্ভব বলিয়া হঠাৎ তাহার প্রত্যয় হইল না। নলিনীও একই সঙ্গে কৌতূহলবশে মুখ তুলিয়া কহিল, নরেন্দ্রবাবু।

রাসবিহারী তাহাকে আহ্বান করিয়াছেন, এবং সে সেই নিমন্ত্রণ রাখিতে এই বাটীতে প্রবেশ করিয়াছে। ঘটনাটা এমনি অচিন্তনীয় যে, বিজয়ার সমস্ত চিন্তাশক্তি পর্যন্ত যেন বিপর্যস্ত হইয়া গেল। আর সে সেদিকে মুখ তুলিয়া চাহিতে পারিল না কিন্তু, রাসবিহারীর সবিনয় অভ্যর্থনা স্পষ্ট শুনিতে পাইল, এবং পরক্ষণেই উভয়কে লইয়া রাসবিহারী ঘরের মধ্যস্থলে আসিয়া দাঁড়াইলেন। সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আসিলেন। তখন বৃদ্ধ শান্ত, গম্ভীর স্বরে এই দুইটি যুবককে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, তোমাদের বাপেদের সম্পর্কে তোমরা দুজনে যে ভাই হও, এই কথাটাই আজ তোমাদের আমি বিশেষ করে বলতে চাই বিলাস।
বনমালী গেলেন, জগদীশ গেছেন, আমারও ডাক পড়েছে। ইহজগতে আমাদের যে শুধু দেহ ব্যতীত আর কিছুই ভিন্ন ছিল না এ কথা তোমরা আজকালকার ছেলেরা হয়ত বুঝবে না, বোঝা সম্ভবও নয়—আমি বোঝাতেও চাইনে। শুধু কেবল আজ নব-বৎসরের এই পুণ্যদিনটিতে তোমাদের উভয়ের কাছে অনুরোধ করতে চাই যে, তোমাদের গৃহ-বিচ্ছেদের কালি দিয়ে এই বৃদ্ধের বাকী দিন ক’টা আর অন্ধকার করে তুলো না। তাঁহার শেষ কথাটা কাঁপিয়া উঠিয়া ঠিক যেন কান্নায় রুদ্ধ হইয়া গেল। নরেন আর সহিতে পারিল না। সে অগ্রসর হইয়া গিয়া বিলাসের একটা হাত নিজের ডান হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আবেগের সহিত কহিল, বিলাসবাবু, আমার সকল অপরাধ আপনি মাপ করুন। আমি ক্ষমা চাইচি।

প্রত্যুত্তরে বিলাস হাত ছাড়িয়া দিয়া নরেন্দ্রকে সবলে আলিঙ্গন করিয়া বলিয়া উঠিল, অপরাধ আমিই করেচি নরেন। আমাকেই তুমি ক্ষমা কর।

বৃদ্ধ রাসবিহারী মুদিত-নেত্রে কম্পিত মৃদুকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, হে সর্বশক্তিমান পরম পিতা পরমেশ্বর! এই দয়া, এই করুণার জন্য তোমার শ্রীপাদপদ্মে আমার কোটী কোটী নমস্কার! এই বলিয়া তিনি দুই হাত জোড় করিয়া কপালে স্পর্শ করিলেন, এবং চাদরের কোণে চক্ষু মার্জনা করিয়া কহিলেন, আজিকার শুভ-মুহূর্ত তোমাদের উভয়ের জীবনে অক্ষয় হোক। আপনারাও আশীর্বাদ করুন! এই বলিয়া তিনি বিস্ময়-বিহ্বল অভ্যাগত ভদ্রলোকদিগের মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

দয়াল ভিন্ন কেহই কিছু জানিতেন না, সুতরাং এই মর্মস্পর্শী করুণ অনুষ্ঠানের যথার্থ তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিতে না পারিয়া ইহাদের বাস্তবিকই বিস্ময়ের পরিসীমা ছিল না। রাসবিহারী চক্ষের পলকে তাহা অনুভব করিয়া তাঁহাদের প্রতি চাহিয়া স্নিগ্ধভাবে একটু হাস্য করিয়া বলিলেন, মেয়েরা যে বলে শাঁকের করাত, আসতে কাটে যেতেও কাটে, আমারও হয়েছিল তাই। আমার এ-ও ছেলে, ও-ও ছেলে—বলিয়া নরেন-বিলাসকে চোখের ইঙ্গিতে দেখাইয়া কহিলেন, আমার ডান হাতেও যেমন ব্যথা, বাঁ হাতেও তেমনি। কিন্তু আপনাদের কৃপায় আজ আমার বড় শুভদিন, বড় আনন্দের দিন। আমি কি আর বলব।

ভিতরের ব্যাপারটা তলাইয়া না বুঝিলেও প্রত্যুত্তরে সকলেই হর্ষসূচক একপ্রকার অস্ফুট ধ্বনি করিলেন।

রাসবিহারী ঘাড়টা একটুখানি মাত্র হেলাইয়া উত্তরীয়-প্রান্তে পুনরায় চক্ষু মার্জনা করিয়া নিকটবর্তী আসনে গিয়া নিঃশব্দে উপবেশন করিলেন। সেই স্নিগ্ধ গম্ভীর মুখের প্রতি চাহিয়া উপস্থিত কাহারও অনুমান করিতে অবশিষ্ট রহিল না যে, হৃদয় তাঁহার অনির্বচনীয় ভাবরাশিতে এমনি পরিপূর্ণ হইয়া গেছে যে বাক্যের আর তিলার্ধ স্থান নাই। দয়াল তাঁহার পাকা দাড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন, এবং ভগবৎ-উপাসনার প্রারম্ভে ভূমিকাচ্ছলে বলিলেন, যেখানে বিরুদ্ধ-হৃদয় সম্মিলিত হয়, তথায় ভগবানের আসন পাতা হয়। সুতরাং আজ এখানে পরম পিতার আবির্ভাব সম্বন্ধে দ্বিধা করিবার কিছু নাই।
অতঃপর তিনি নূতন বৎসরের প্রথম দিনটিতে প্রায় পনর মিনিট ধরিয়া একটি সুন্দর উপাসনা করিলেন। তাঁহার নিজের মধ্যে অকপট বিশ্বাস ও আন্তরিক ভক্তি ছিল বলিয়া যাহা কিছু কহিলেন সমস্তই সত্য এবং মধুর হইয়া সকলের হৃদয়ে বাজিল। সকলের চক্ষু-পল্লবেই একটা সজলতার আভাস দেখা দিল; শুধু রাসবিহারীর নিমীলিত চোখ বাহিয়া দরদর ধারে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শেষ হইয়া গেলেও একই ভাবে বসিয়া রহিলেন। তিনি অচেতন, কিংবা সচেতন বহুক্ষণ পর্যন্ত ইহাই বুঝিতে পারা গেল না।

আর একজন, যাহার মনের কথা টের পাওয়া গেল না সে বিজয়া। সারাক্ষণ সে আনতনেত্রে পাষাণ-মূর্তির মত স্থির হইয়া বসিয়া রহিল। তার পরে যখন মুখ তুলিল, তখন মুখখানা শুধু পাথরের মতই অস্বাভাবিকরূপে সাদা দেখাইল।

দয়ালের ভক্তি-গদগদ ধ্বনির প্রতিধ্বনি তখন অনেকেরই হৃদয়ের মধ্যে ঝঙ্কৃত হইতেছিল, এমনি সময়ে রাসবিহারী চক্ষু মেলিলেন; এবং উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রায় কাঁদ-কাঁদ স্বরে কহিলেন, আমার সে সাধনার বল নাই, কিন্তু দয়ালের মহাবাক্য যে কত বড় সত্য আজ তাহা উপলব্ধি করিয়াছি। সম্মিলিত হৃদয়ের সন্ধিস্থলে যে সেই একমাত্র ও অদ্বিতীয় নিরাকার পরব্রহ্মের আবির্ভাব হয়, আজ তাহার অন্তরের মধ্যে প্রত্যক্ষ দেখিয়া আমার জীবন চিরদিনের জন্য ধন্য হইয়া গেল। এই বলিয়া তিনি অগ্রসর হইয়া গিয়া দয়ালকে বক্ষে চাপিয়া ধরিয়া কম্পিতকণ্ঠে কহিয়া উঠিলেন, দয়াল! ভাই! এ শুধু তোমারই পুণ্যে, তোমারই আশীর্বাদে।

দয়ালের চোখ ছলছল করিয়া আসিল কিন্তু তিনি কোন কথা কহিতে না পারিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

পাশের ঘরেই জলযোগের প্রচুর আয়োজন হইয়াছিল। এখন বিলাস সেই ইঙ্গিত করিতেই রাসবিহারী তাহাকে বাধা দিয়া অভ্যাগতগণকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আপনাদের কাছে আজ আর একটি বিষয়ে আশীর্বাদ ভিক্ষা করি।

বনমালী বেঁচে থাকলে আজ তাঁর কন্যার বিবাহের কথা তিনিই আপনাদিগকে জানাতেন, আমাকে বলতে হতো না; কিন্তু এখন সে ভার আমার উপরেই পড়েছে। এখন আমি বর-কন্যার পিতা। আমি এই মাসেরই শেষ-সপ্তাহে পূর্ণিমা-তিথিতে বিবাহের দিন স্থির করেচি—আপনারা সর্বান্তঃকরণে আশীর্বাদ করুন যেন শুভকর্ম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এই বলিয়া তিনি একজোড়া মোটা সোনার বালা পকেট হইতে বাহির করিয়া দয়ালের হাতে দিলেন।

দয়াল সেই দুটি লইয়া বিজয়ার কাছে অগ্রসর হইয়া গিয়া হাত বাড়াইয়া বলিলেন, শুভকর্মের সূচনায় কায়মনোবাক্যে তোমার কল্যাণ কামনা করি মা, হাত দুটি একবার দেখি!

কিন্তু সেই আনতমুখী, মূর্তির মত আসীনা রমণীর নিকট হইতে লেশমাত্র সাড়া আসিল না। দয়াল পুনরায় তাহার প্রার্থনা নিবেদন করিলেন; তথাপি সে তেমনি স্থির বসিয়া রহিল। নলিনী পাশেই ছিল; সে মামার অবস্থাসঙ্কট অনুভব করিয়া হাসিয়া বিজয়ার হাত দুটি তুলিয়া ধরিল, এবং দয়াল না জানিয়া এক-জোড়া অত্যাচারের হাতকড়ি আশীর্বাদের সুবর্ণ-বলয় জ্ঞানে সেই মূর্ছিত-প্রায় নিরুপায় নারীর অশক্ত অবশ দুটি হাতে একে একে পরাইয়া দিলেন।
কিন্তু কেহই কিছু জানিল না। বরঞ্চ ইহাকে মধুর লজ্জা কল্পনা করিয়া স্বাভাবিক এবং সঙ্গত ভাবিয়া তাঁহারা উৎফুল্ল হইয়া উঠিলেন, এবং নিমিষে শুভকামনার কলগুঞ্জনে সমস্ত ঘরটা মুখরিত হইয়া উঠিল।

খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার সমাধা হইয়া গেলে বেলা হইতেছিল বলিয়া সকলেই একে একে বিদায় গ্রহণ করিতে লাগিলেন। এই সময়টায় কি করিয়া যে বিজয়া আত্মসংবরণ করিয়া অতিথিদের সম্ভ্রম এবং মর্যাদা রক্ষা করিল তাহা অন্তর্যামী ভিন্ন আর যে লোকটির অগোচর রহিল না সে রাসবিহারী। কিন্তু তিনি আভাসমাত্র দিলেন না। জলযোগ সমাপন করিয়া একটি লবঙ্গ মুখে দিয়া হাসিমুখে কহিলেন, মা, আমি চললুম। বুড়োমানুষ রোদ উঠলে আর হাঁটতে পারব না। বলিয়া আর একপ্রস্থ আশীর্বাদ করিয়া ছাতাটি মাথায় দিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া পড়িলেন।

সবাই চলিয়া গিয়াছে। শুধু বিজয়া এবং নলিনী তখনও বাহিরের বারান্দায় একধারে দাঁড়াইয়া কথাবার্তা কহিতেছিল। বিজয়া কহিল, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে কত যে সুখী হলুম, সে বলতে পারিনে। এখানে এসে পর্যন্ত আমি একবারে একলা পড়ে গেছি—এমন কেউ নেই যে দুটো কথা বলি। আপনার যখন ইচ্ছে হবে, যখন সময় পাবেন আসবেন।

নলিনী খুশী হইয়া সম্মত হইল।

তখন বিজয়া কহিল, আমি নিজেও হয়ত ও-বেলায় আপনার মামীমাকে দেখতে যাব। কিন্তু তখনই রৌদ্রের দিকে চাহিয়া একটু ব্যস্ত হইয়াই বলিয়া উঠিল, দয়ালবাবু নিশ্চয় কাছারিতে ঢুকেছেন, ডেকে পাঠাই—বলিয়া বেহারার সন্ধানে পা বাড়াইবার উদ্যোগ করিতেই নলিনী বাধা দিয়া বলিল, তিনি ত এখন বাড়ি যাবেন না, একেবারে সন্ধ্যাবেলায় ফিরবেন।

বিজয়া লজ্জিত হইয়া বলিল, এ কথা আমাকে আগে বলেন নি কেন? আমি দরোয়ানকে ডেকে দিচ্চি, সে আপনার—

নলিনী কহিল, না, দরোয়ানের দরকার নেই, আমি নরেন্দ্রবাবুর জন্যে অপেক্ষা করছি। তিনি তাঁর মামার সঙ্গে একবার দেখা করতে গেছেন, এখুনি এসে পড়বেন।

বিজয়া অতিশয় আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার সঙ্গে কি তাঁর পরিচয় ছিল নাকি? কৈ, আমি ত এ কথা জানতুম না।

নলিনী কহিল, পরিচয় কিছুই ছিল না। শুধু পরশুদিন মামার চিঠি পেয়ে স্টেশনে এসে দেখি, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর সঙ্গেই এখানে এসেছি।

বিজয়া বলিল, ওঃ—তাই বুঝি?

নলিনী কহিল, কিন্তু কি চমৎকার লোক দেখেছেন! দু’দিনেই যেন কত দিনের আত্মীয় হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এ-বেলায় আমাদের ওখানেই উনি স্নানাহার করে বিকেলবেলা কলকাতায় যাবেন, স্থির হয়েছে। আমার মামীমা ত ওঁকে একবারে ছেলের মত ভালবাসেন।

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া শুধু কহিল, হাঁ চমৎকার লোক।

নলিনী কহিতে লাগিল, ওঁর সঙ্গে যে কারও কখনো মনোমালিন্য ঘটতে পারে, এ আমি চোখে না দেখলে হয়ত বিশ্বাস করতে পারতুম না। আমি বড় খুশী হয়েছি যে, আজ বিলাসবাবুর সঙ্গে তাঁর মিল হয়ে গেল; কিন্তু কি চমৎকার লোক ওঁর বাবা। আমার মনে হয়, আমাদের সমাজে সকলেরই ওঁর মত হবার চেষ্টা করা উচিত। রাসবিহারীবাবুর আদর্শ যেদিন ব্রাহ্মসমাজের ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হবে, সেদিনই বুঝব আমাদের ব্রাহ্মধর্ম সফল হল, সার্থক হল! কি বলেন? ঠিক নয়?
অদূরে দেখা গেল, নরেন্দ্র টুপিটা হাতে লইয়া দ্রুতবেগে এই দিকে আসিতেছে। বিজয়া নলিনীর প্রশ্নের উত্তরটা এড়াইয়া গিয়া শুধু সেই দিকে তাহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কহিল, ঐ যে উনি আসচেন।

নরেন্দ্র কাছে আসিয়া বিজয়াকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, এই যে, এরই মধ্যে দুজনের দিব্যি ভাব হয়ে গেছে। বাস্তবিক, আজ বছরের প্রথম দিনটায় আমার ভারী সুপ্রভাত! সকালটা চমৎকার কাটল। দেখে আশা হচ্ছে, এ বছরটা হয়ত ভালই কাটবে। কিন্তু আপনাকে অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন বলুন ত?

বিজয়া উত্যক্তস্বরে কহিল, একদিনের মধ্যে ও প্রশ্ন কতবার করা দরকার বলুন ত?

নরেন্দ্র হাসিয়া বলিল, আরও একবার জিজ্ঞাসা করেছি, না? তা হোলই বা। আচ্ছা, খপ্‌ কোরে অমন রেগে যান কেন বলুন দেখি? ওটা ত আপনার ভারী দোষ। বলিয়া হাসিতে লাগিল।

বিজয়া নিজেও কোন মতে হাসি চাপিয়া ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত জবাব দিল, ও বিষয়ে সবাই কি আপনার মত নির্দোষ হতে পারে? তবুও দেখুন, কালীপদর মত এমনও সব নিন্দুক আছে যারা আপনার মত সাধুকেও বদ্‌রাগী বলে অপবাদ দেয়।

কালীপদর নামে নরেন্দ্র উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। হাসি থামিলে কহিল, আপনি ভয়ানক অভিমানী, কিছুতেই কারও দোষ মার্জনা করতে পারেন না। কিন্তু ‘এমন সব’-এর সবটা কারা শুনি? কালীপদ আর আপনি নিজে, এই ত?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আর স্টেশনে যারা দেখেছে তারাও।

নরেন কহিল, আর?

বিজয়া কহিল, আর যারা শুনেছে তারাও।

নরেন কহিল, তা হলে আমার সম্বন্ধে রাজ্যসুদ্ধ লোকেরই এই মত বলুন?

বিজয়া পূর্বের গাম্ভীর্য বজায় রাখিয়াই জবাব দিল, হাঁ। আমদের সকলের মতই এই।

নরেন কহিল, তা হলে ধন্যবাদ। এইবার আপনার নিজের সম্বন্ধে সকলের মত কি, সেইটে বলুন। বলিয়া হাসিতে লাগিল।

তাহার ইঙ্গিতে বিজয়ার মুখ পলকের জন্য রাঙ্গা হইয়া উঠিল। কিন্তু পরক্ষণেই হাসিয়া কহিল, নিজের সুখ্যাতি নিজে করতে নেই—পাপ হয়। সেটা বরঞ্চ আপনি বলুন। কিন্তু এখন নয়, নাওয়া-খাওয়ার পরে। বলিয়া একটু থামিয়া কহিল, কিন্তু অনেক বেলা হয়ে গেছে, এ কাজটা এখানেই সেরে নিলে ভাল হত না? বলিয়া সে নলিনীর মুখের প্রতি চাহিল।

নলিনী কহিল, কিন্তু মামীমা যে অপেক্ষা করে থাকবেন।

বিজয়া কহিল, আমি এখ্‌খুনি লোক পাঠিয়ে খবর দিচ্ছি।

নলিনী কুণ্ঠিত হইয়া উঠিল। কহিল, আমাকে যেতেই হবে। মামীমা রোগী মানুষ, বাড়িতে সমস্ত দুপুরবেলাটা কেউ কাছে না থাকলে চলবে না।

কথাটা সত্য, তাই সে আর জিদ করিতে পারিল না; কিন্তু তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কি ভাবিয়া নলিনী তৎক্ষণাৎ কহিয়া উঠিল, কিন্তু আপনি না হয় এখানেই স্নানাহার করুন নরেনবাবু, আমি গিয়ে মামীমাকে জানাব। শুধু যাবার সময় একবার তাঁকে দেখা দিয়ে যাবেন।
আর আমাকে এমনি অকৃতজ্ঞ নরাধম পেয়েছেন যে, এই রোদের মধ্যে আপনাকে একলা ছেড়ে দেব? বলিয়া নরেন সহাস্যে বিজয়ার মুখের পানে চোখ তুলিয়া কহিল, আপনার কাছে একদিন ত ভালরকম খাওয়া পাওনা আছেই—সেদিন না হয় সকাল সকাল এসে এই খাওয়াটার শোধ তোলবার চেষ্টা করব। আচ্ছা নমস্কার। নলিনীকে কহিল, আর দেরি নয়, চলুন। বলিয়া হাতের টুপিটা মাথায় তুলিয়া দিল।

নলিনী নামিয়া কাছে আসিল, কিন্তু আর একজন যে কাঠের মত দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার দুই চক্ষে যে শান-দেওয়া ছুরির আলো ঝলসিতে লাগিল, তাহা দুজনের কেহই লক্ষ্য করিল না; করিলে বোধ করি, নরেন্দ্র দুই-এক পা অগ্রসর হইয়াই সহসা ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাসিয়া বলিতে সাহস করিত না—আচ্ছা, একটা কাজ করলে হয় না? যে জিনিসটা শুরু থেকেই এত দুঃখের মূল, যার জন্যে আমার দেশময় অখ্যাতি, আমাকেই কেন সেটা আজকের আনন্দের দিনে বকশিশ করে দিন না? সেই দুশো টাকাটা কাল-পরশু যেদিন হয় পাঠিয়ে দেব। বলিয়া আরও একবার হাসিবার চেষ্টা করিল বটে, কিন্তু উৎসাহের অভাবে সুবিধা হইল না। বরঞ্চ ও-পক্ষ হইতে প্রত্যুত্তরে একেবারে অপ্রত্যাশিত কড়া জবাব আসিল। বিজয়া কহিল, দাম নিয়ে দেওয়াকে আমি উপহার দেওয়া বলিনে, বিক্রি করা বলি। ও-রকম উপহার দিয়ে আপনি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারেন; কিন্তু আমাদের শিক্ষা আর এক রকম হয়েছিল। তাই আজ আনন্দের দিনে সেটা বেচতে ইচ্ছে করিনে।

এই আঘাতের কঠোরতায় নরেন্দ্র স্তম্ভিত হইয়া গেল। এমনিই ত সে বিজয়ার মেজাজের প্রায় কোন কূল-কিনারা পায় না—তাহাতে আজ তাহার বুকের মধ্যে তুষের আগুন জ্বলিতেছিল, তাহার দাহ যখন অকস্মাৎ অকারণে বাহির হইয়া পড়িল তখন নরেন তাহাকে চিনিয়া লইতে পারিল না। সে ক্ষণকাল তাহার কঠিন মুখের পানে নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া অত্যন্ত ব্যথার সহিত বলিল, আমার একান্ত দীন অবস্থা আমি ভুলেও যাইনি, গোপন করবার চেষ্টাও করিনি যে আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
নলিনীকে দেখাইয়া কহিল, আমি এঁকেও আমার সমস্ত ইতিহাস বলেছি। বাবা অনেক দুঃখ-কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে বাড়ি-ঘরদ্বার যা-কিছু এখানে ছিল সর্বস্ব দেনার দায়ে বিক্রি হয়ে গেছে, কিছুই কারো কাছে লুকোই নি। উপহার দিয়েছি এ কথা বলিনি। আচ্ছা, বলুন ত এসব কি আপনাকে জানাই নি?

নলিনী সলজ্জে সায় দিয়া কহিল, হ্যাঁ।

বিজয়ার মুখ বেদনায়, লজ্জায়, ক্ষোভে বিবর্ণ হইয়া উঠিল—সে শুধু বিহ্বল আচ্ছন্নের মত একদৃষ্টে উভয়ের দিকে নীরবে চাহিয়া রহিল।

তাহার সেই অপরিসীম বেদনাকে বিমথিত করিয়া নরেন্দ্র ম্লানমুখে পুনশ্চ কহিল, আমার কথায় আপনি প্রায়ই অত্যন্ত উত্যক্ত হয়ে উঠেন। হয়ত ভাবেন, নিজের অবস্থাকে ডিঙ্গিয়ে আমি নিজেকে আপনাদের সমান এবং সমকক্ষ বলে প্রচার করতে চাই—হতেও পারে সব কথায় আপনার ওজন ঠিক রাখতে পারিনে, কিন্তু সে আমার অন্যমনস্ক স্বভাবের দোষে। কিন্তু যাক, অসম্ভ্রম যদি করে থাকি আমাকে মাপ করবেন। বলিয়া মুখ ফিরাইয়া চলিতে আরম্ভ করিয়া দিল।

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

সমস্ত পথটার মধ্যে দুজনের শুধু এই কথাটাই হইল। নলিনী জিজ্ঞাসা করিল, কি উপহার দেবার কথা বলেছিলেন?

নরেন্দ্র ক্লান্তকণ্ঠে কহিল, আর একদিন এ কথা আপনাকে বলব—কিন্তু আজ নয়।

সেই বাঁশের পুলটার কাছে আসিয়া নরেন সহসা দাঁড়াইয়া পড়িয়া কহিল, আজ আমাকে মাপ করতে হবে—আমি ফিরে চললুম। কিন্তু নলিনীকে বিস্ময়ে অভিভূতপ্রায় দেখিয়া পুনরায় বলিল, এইভাবে হঠাৎ ফিরে যাওয়ায় আমার অন্যায় যে কি পর্যন্ত হচ্চে, সে আমি জানি। কিন্তু তবুও ক্ষমা করতে হবে—আজ আমি কোন মতে যেতে পারব না। আপনার মামীমাকে বলে দেবেন আমি আর একদিন এসে—

তাহার সঙ্কল্পের এই আকস্মিক পরিবর্তনে নলিনী যত আশ্চর্য হইয়াছিল, এখন তাহার কণ্ঠস্বর ও মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ঢের বেশী আশ্চর্য হইল। বোধ হয়, এই জন্যই সে এবিষয়ে আর অধিক অনুরোধ না করিয়া তাহাকে শুধু কহিল, আপনার যে খাওয়া হলো না। কিন্তু আবার কবে আসবেন?

পরশু আসবার চেষ্টা করব, বলিয়া নরেন যে পথে আসিয়াছিল, সেই পথে দ্রুতপদে রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশে প্রস্থান করিল।

মাঠ পার হইতে আর যখন দেরি নাই, এমন সময় দেখিল কে একটা ছেলে হাত উঁচু করিয়া তাহারই দিকে প্রাণপণে ছুটিয়া আসিতেছে। সে যে তাহার জন্য ছুটিতেছে, এবং হাত তুলিয়া তাহাকেই থামিতে ইঙ্গিত করিতেছে অনুমান করিয়া নরেন্দ্র থমকিয়া দাঁড়াইল। খানিক পরেই পরেশ আসিয়া উপস্থিত হইল এবং হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, মাঠান ডেকে পাঠালেন তোমাকে। চল।

আমাকে?

হিঁ—চল না।

নরেন্দ্র নিশ্চল হইয়া কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া সন্দিগ্ধ-কণ্ঠে কহিল, তুই বুঝতে পারিস নি রে—আমাকে নয়।

পরেশ প্রবলবেগে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, হিঁ তোমাকেই। তোমার মাথায় যে সাহেবের টুপি রয়েছে। চল।

নরেন্দ্র আবার কিছুক্ষণ মৌন থাকিয়া প্রশ্ন করিল, তোর মাঠান কি বলে দিলে তোকে?

পরেশ কহিল, মাঠান সেই চিলের ছাত থেকে দৌড়ে নেমে এসে বললে, পরেশ ছুটে যা—এই সোজা গিয়ে বাবুকে ধরে আন। মাথায় সাহেবের টুপি—যা—ছুটে যা—তোকে খুব ভাল একটা লাটাই কিনে দেব। চল না।

এতক্ষণে ইহার ব্যগ্রতার হেতু বুঝা গেল। সে লাটাইয়ের লোভে এই রৌদ্রের মধ্যে ইঞ্জিনের বেগে ছুটিয়া আসিয়াছে। সুতরাং কোনমতে ছাড়িয়া যাইবে না। তাহার একবার মনে হইল ছেলেটিকে নিজেই একটা লাটাইয়ের দাম দিয়া এইখান হইতে বিদায় করে। কিন্তু আজই এমন করিয়া ডাকিয়া পাঠাইবার কি কারণ, সে কৌতূহলও কিছুতেই নিবারণ করিতে পারিল না। কিন্তু যাওয়া উচিত কি না স্থির করিতে তাহার আরও কিছুক্ষণ লাগিল; এবং শেষ পর্যন্ত স্থিরও কিছু হইল না; তবুও অনিশ্চিত পথ তাহার ওই দিকেই ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল।
সমস্ত রাস্তাটা সে ডাকিবার কারণটাই মনে মনে হাতড়াইয়া মরিতে লাগিল, কিন্তু ডাকাটাই যে সব চেয়ে বড় কারণ সেটা আর তাহার চোখে পড়িল না। বাহিরের ঘরে পা দিতেই বিজয়া আসিয়া সুমুখে দাঁড়াইল। দুটি আর্দ্র উৎসুক চক্ষু তাহার মুখের উপর পাতিয়া তীক্ষ্ণকণ্ঠে কহিল, না খেয়ে এত বেলায় চলে যাচ্ছেন যে বড়? আমি মিছামিছি রাগ করি, আমি ভয়ানক মন্দ লোক—আর নিজে?

নরেন গভীর বিস্ময়ভরে বলিল, এর মানে? কে বলেছে আপনি মন্দ লোক, কে বলেছে ও-সব কথা আপনাকে?

বিজয়ার ঠোঁট কাঁপিতে লাগিল; কহিল, আপনি বলেছেন। কেন নলিনীর সামনে আমাকে অমন করে অপমান করলেন? আমাকেই অপমান করলেন, আবার আমাকেই শাস্তি দিতে না খেয়ে চলে যাচ্ছেন? কি করেছি আপনার আমি? বলিতে বলিতেই তাহার দুই চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসিল। বোধ করি, তাহাই সামলাইবার জন্য সে তৎক্ষণাৎ ও-দিকের জানালায় গিয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল। নরেন হতবুদ্ধির মত বাক্‌শূন্য হইয়া চাহিয়া রহিল। এ অভিযোগের কোথায় কি যে জবাব আছে তাহাও যেন খুঁজিয়া পাইল না, ইহার কারণই বা কি তাহাও তেমনি ভাবিয়া পাইল না।

স্নানের জল প্রভৃতি দেওয়া হইয়াছে বেহারা জানাইয়া গেলে বিজয়া ফিরিয়া আসিয়া শান্তভাবে শুধু কহিল, আর দেরি করবেন না, যান।

স্নান সারিয়া নরেন্দ্র আহারে বসিল। বিজয়া একখানা পাখা হাতে করিয়া তাহার অদূরে আসিয়া যখন উপবেশন করিল, তখন অত্যন্ত সংগোপনে তাহার সর্বাঙ্গ আলোড়িত করিয়া যেন লজ্জার ঝড় বহিয়া গেল। বাতাস করিতে উদ্যত দেখিয়া নরেন সঙ্কুচিত হইয়া কহিল, আমাকে হাওয়া করবার দরকার নেই, আপনি পাখাটা রেখে দিন।

বিজয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, আপনার দরকার না থাকলেও আমার দরকার আছে। বাবা বলতেন, মেয়েমানুষকে শুধু হাতে কখনও বসতে নেই।

নরেন জিজ্ঞাসা করিল, আপনার খাওয়াও ত হয়নি!

বিজয়া কহিল, না। পুরুষমানুষদের খাওয়া না হলে আমাদের খেতেও নেই।

নরেন খুশী হইয়া বলিল, আচ্ছা, ব্রাহ্ম হলেও ত আপনাদের আচার-ব্যবহার আমাদের মতই।

বিজয়া এ কথা বলিল না যে, অনেক ব্রাহ্মবাড়িতেই তাহা নয়, বরঞ্চ ঠিক উলটো, শুধু তাহার পিতাই কেবল এই-সকল হিন্দু-আচার নিজের বাড়িতে বজায় রাখিয়া গিয়াছিলেন। বরঞ্চ কহিল, এতে আশ্চর্য হবার ত কিছু নেই। আমরা বিলেত থেকেও আসিনি, কাবুল থেকেও আমাদের আচার-ব্যবহার আমদানী করে আনতে হয়নি। এ-রকম না হলেই বরং আশ্চর্য হবার কথা।

চাকর দ্বারের কাছে আসিয়া কহিল, মা, সরকারমশাই হিসেবের খাতা নিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন কি যেতে বলে দেব?

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, হাঁ, আজ আর আমার দেখবার সময় হবে না, তাঁকে কাল একবার আসতে বলে দাও।
ভৃত্য চলিয়া গেলে নরেন বিজয়ার মুখের প্রতি চোখ তুলিয়া কহিল, এইটি আমাকে সবচেয়ে বেশী আনন্দ দেয়।

কোন্‌টি?

চাকরদের মুখের এই ডাকটি। বলিয়া হাসিয়া কহিল, আপনি ব্রাহ্মমহিলাও বটে, আলোকপ্রাপ্তাও বটে, এবং বিশেষ করে বড়মানুষও বটে। এমনি আলোক-পাওয়া অনেক বাড়িতেই আমাকে আজকাল চিকিৎসা করতে যেতে হয়। তাঁদের চাকর-বাকরেরা মেয়েদের বলে ‘মেম-সাহেব’। সত্যিকারের মেম-সাহেবরা এঁদের যে চক্ষে দেখে, তা জানেন বলেই বোধ করি মাইনে-করা চাকরদের দিয়ে ‘মেম-সাহেব’ বলিয়ে নিয়ে আত্মমর্যাদা বজায় রাখেন। বলিয়া প্রকাণ্ড একটা পরিহাসের মত হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া অট্টহাস্যে বাড়িটা পরিপূর্ণ করিয়া দিল। বিজয়া নিজেও হাসিয়া ফেলিল। নরেনের হাসি থামিলে সে পুনরায় কহিল, বাড়ির দাসী-চাকরের মুখের মাতৃ-সম্বোধনের চেয়ে ‘মেম-সাহেব’ ডাকটা যেন বেশী ইজ্জতের! প্রথম দিন আমি বুঝতেই পারিনি বেহারাটা ‘মেম’ বলে কাকে? চাকরটা কি বললে জানেন? বলে, ‘আমি অনেক সাহেব-বাড়িতে চাকরি করেচি, সত্যকারের মেম-সাহেব কি, তা খুব জানি। কিন্তু, কি করব ডাক্তারবাবু? নতুন হিন্দুস্থানী দরোয়ানটা গিন্নীকে ‘মাইজী’ বলে ফেলেছিল বলে মেম-সাহেব তার একটাকা জরিমানা করে দিলেন। চাকরিটা যে বজায় রইল এই তার ভাগ্যি। এমনি রাগ। আচ্ছা, আপনি বোধ হয় এরকম অনেক দেখেছেন, না?

বিজয়া হাসিয়া ঘাড় নাড়িল।

নরেন কহিল, আমাকে এইটে একদিন দেখতে হবে, এই সব মেম-সাহেবদের ছেলে-মেয়েরা মাকে মা বলে, না ‘মেম-সাহেব’ বলে ডাকে! বলিয়া নিজের রসিকতার আনন্দে আর একবার ঘর ফাটাইয়া তুলিবার আয়োজন করিল।

বিজয়া হাসিমুখে কহিল, খেয়ে-দেয়ে সমস্ত দিন ধরে পরচর্চা করে আমোদ করবেন, আমার আপত্তি নেই; কিন্তু আমাকে কি আজ খেতে দেবেন না?

নরেন লজ্জিতভাবে তাড়াতাড়ি দু-চার গ্রাস গিলিয়া লইয়াই সব ভুলিয়া গেল। কহিল, আমিও ত চার-পাঁচ বছর বিলেতে ছিলুম, কিন্তু এই দিশী-সাহেবরা—

বিজয়া তর্জনী তুলিয়া কৃত্রিম শাসন করার ভঙ্গীতে কহিল, আবার পরের নিন্দে!

আচ্ছা, আর নয়—বলিয়া সে পুনরায় আহারে মন দিয়াই কহিল, কিন্তু আর খেতে পাচ্ছিনে—

বিজয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, বাঃ—কিছুই ত খাননি। না, এখন উঠতে পাবেন না। আচ্ছা, না হয় পরের নিন্দে করতে করতেই অন্যমনস্ক হয়ে খান, আমি কিছু বলব না।

নরেন হাসিতে গিয়া অকস্মাৎ অত্যন্ত গম্ভীর হইয়া উঠিল। কহিল,আপনি এতেই বলছেন খাওয়া হল না—কিন্তু আমার কলকাতার রোজকার খাওয়া যদি দেখেন ত অবাক হয়ে যাবেন। দেখছেন না, এই ক’মাসের মধ্যেই কি রকম রোগা হয়ে গেছি। আমার বাসায় বামুন-ব্যাটা হয়েছে যেমন পাজী, তেমনি বদমাইশ জুটেছে চাকরটা। সাত-সকালে রেঁধে রেখে কোথায় যায় তার ঠিকানা নেই—আমার কোন দিন ফিরতে হয় দুটো, কোন দিন বা চারটে বেজে যায়।
সেই ঠাণ্ডা কড়কড়ে ভাত—দুধ কোন দিন বা বেড়ালে খেয়ে যায়, কোন দিন বা জানালা দিয়ে কাক ঢুকে সমস্ত ছড়াছড়ি করে রাখে—সে দেখলেই ঘৃণা হয়। অর্ধেক দিন ত একেবারেই খাওয়া হয় না।

রাগে বিজয়ার মুখ আরক্ত হইয়া উঠিল। কহিল, এমন সব চাকর-বাকরদের দূর করে দিতে পারেন না? নিজের বাসায় এত টাকা মাইনে পেয়েও যদি এত কষ্ট, তবে চাকরি করাই বা কেন?

নরেন কহিল, এক হিসাবে আপনার কথা সত্যি। একদিন বাক্স থেকে কে দু শ’ টাকা চুরি করে নিলে, একদিন নিজেই কোথায় একশ’ টাকার নোট হারিয়ে ফেললুম। অন্যমনস্ক লোকের ত পদে পদে বিপদ কিনা! একটুখানি থামিয়া কহিল, তবে নাকি দুঃখ-কষ্ট আমার অনেকদিন থেকেই সয়ে গেছে, তাই তেমন গায়ে লাগে না। শুধু অত্যন্ত ক্ষিদের উপর খাওয়ার কষ্টটা এক-একদিন যেন অসহ্য বোধ হয়।

বিজয়া মুখ নীচু করিয়া চুপ করিয়া রহিল। নরেন কহিতে লাগিল, বাস্তবিক, চাকরি আমার ভালও লাগে না, পারিও না। অভাব আমার খুবই সামান্য—আপনার মত কোন বড়লোক দু’বেলা চারটি খেতে দিত, আর নিজের কাজ নিয়ে থাকতে পারতুম ত আমি আর কিছুই চাইতুম না—কিন্তু, সে-রকম বড়লোক কি আর আছে? বলিয়া আর এক দফা উচ্চহাসির ঢেউ তুলিয়া দিল। বিজয়া পূর্বের মতই নতমুখে নীরবে বসিয়া রহিল। নরেন কহিল, কিন্তু আপনার বাবা বেঁচে থাকলে, হয়ত এ সময়ে আমার অনেক উপকার হতে পারত—তিনি নিশ্চয় আমাকে উঞ্ছবৃত্তি থেকে রেহাই দিতেন।

বিজয়া উৎসুক-দৃষ্টিতে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কি করে জানলেন? তাঁকে ত আপনি চিনতেন না?

নরেন কহিল, না, আমিও তাঁকে কখনও দেখিনি, তিনিও বোধ হয় কখনো দেখেন নি। কিন্তু তবুও আমাকে খুব ভালবাসতেন। কে আমাকে টাকা দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিলেন জানেন? তিনিই। আচ্ছা, আমাদের ঋণের সম্বন্ধে আপনাকে কি কখনও তিনি কিছু বলে যাননি?

বিজয়া কহিল, বলাই ত সম্ভব। কিন্তু আপনি ঠিক কি ইঙ্গিত করচেন, তা না বুঝলে ত জবাব দিতে পারিনে।

নরেন ক্ষণকাল মনে মনে কি চিন্তা করিয়া কহিল, থাক গে। এখন এ আলোচনা একবারেই নিষ্প্রয়োজন।

বিজয়া ব্যগ্র হইয়া কহিল, না, বলুন। আমি শুনতে চাই।

নরেন আবার একটু ভাবিয়া বলিল, যা চুকে-বুকে শেষ হয়ে গেছে, তা শুনে আর কি হবে বলুন?

বিজয়া জিদ করিয়া কহিল, না, তা হবে না। আমি শুনতে চাই, আপনি বলুন।

তাহার আগ্রহাতিশয্য দেখিয়া নরেন হাসিল; কহিল, বলা শুধু যে নিরর্থক তাই নয়—বলতে আমার নিজেরও লজ্জা হচ্চে। হয়ত আপনার মনে হবে আমি কৌশলে আপনার সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে—বিজয়া অধীর হইয়া কথার মাঝখানেই বলিল, আমি আর খোশামোদ করতে পারিনে আপনাকে—পায়ে পড়ি, বলুন।

খাওয়া-দাওয়ার পরে।

না, এখ্‌খুনি—
আচ্ছা বলচি বলচি। কিন্তু একটা কথা পূর্বে জিজ্ঞাসা করি, আমাদের বাড়িটার বিষয়ে কোন কথা কি তিনি কখনো আপনাকে বলেন নি?

বিজয়া অধিকতর অসহিষ্ণু হইয়া উঠিল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না। নরেন মুচকিয়া হাসিয়া কহিল, আচ্ছা,রাগ করতে হবে না আমি বলচি। যখন বিলেত যাই তখনই বাবার কাছে শুনেছিলুম আপনার বাবাই আমাকে পাঠাচ্চেন। আজ তিনদিন হল, দয়ালবাবু আমাকে একতাড়া চিঠি দেন। যে ঘরটায় ভাঙ্গাচোরা কতকগুলো আসবাব পড়ে আছে, তারই একটা ভাঙ্গা দেরাজের মধ্যে চিঠিগুলো ছিল—বাবার জিনিস বলে দয়ালবাবু আমার হাতেই দেন। পড়ে দেখ‌লুম, খান-দুই চিটি আপনার বাবার লেখা। শুনেছেন বোধ হয় শেষ-বয়সে বাবা দেনার জ্বালায় জুয়া খেলতে শুরু করেন। বোধ করি সেই ইঙ্গিতই একটা চিঠির গোড়ায় ছিল। তার পরে নীচের দিকে এক জায়গায় তিনি উপদেশের ছলে সান্ত্বনা দিয়ে বাবাকে লিখেছিলেন, বাড়িটার জন্যে ভাবনা নেই—নরেন আমারও ত ছেলে, বাড়িটা তাকে যৌতুক দিলাম।

বিজয়া মুখ তুলিয়া কহিল, তার পরে?

নরেন কহিল, তার পরে সব অন্যান্য কথা। তবে এ পত্র বহুদিন পূর্বের লেখা। খুব সম্ভব, তাঁর এ অভিপ্রায় পরে বদলে গিয়েছিল বলেই কোন কথা আপনাকে বলে যাওয়া আবশ্যক মনে করেন নি।

পিতার শেষ ইচ্ছাগুলি বিজয়ার অক্ষরে অক্ষরে মনে পড়িয়া দীর্ঘশ্বাস পড়িল। কয়েক মুহূর্ত স্থির থাকিয়া বলিল, তা হলে বাড়িটা দাবী করবেন বলুন, বলিয়া হাসিল।

নরেন নিজেও হাসিল। প্রস্তাবটা চমৎকার পরিহাস কল্পনা করিয়া কহিল, দাবী নিশ্চয় করব, এবং আপনাকেও সাক্ষী মানব। আশা করি সত্য কথাই বলবেন।

বিজয়া ঘাড় নাড়িয়া কহিল, নিশ্চয়। কিন্তু সাক্ষী মানবেন কেন?

নরেন কহিল, নইলে প্রমাণ হবে কিসে? বাড়িটা যে সত্যই আমার সে কথা ত আদালতে প্রতিষ্ঠিত করা চাই।

বিজয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, অন্য আদালতের দরকার নেই—বাবার আদেশই আমার আদালত। ও বাড়ি আপনাকে আমি ফিরিয়ে দেব।

তাহার মুখের চেহারা এবং কণ্ঠস্বর ঠিক রহস্যের মত শোনাইল না বটে, কিন্তু সে ছাড়া যে আর কি হইতে পারে তাহাও মনে ঠাঁই দেওয়া যায় না। বিশেষতঃ বিজয়ার পরিহাসের ভঙ্গী এত নিগূঢ় যে, শুধু মুখ দেখিয়া জোর করিয়া কিছু বলা অত্যন্ত কঠিন। তাই নরেন্দ্র নিজেও ছদ্ম-গাম্ভীর্যের সহিত বলিল, তা হলে তাঁর চিঠিটা চোখে না দেখেই বোধ হয় বাড়িটা দিয়ে দেবেন?

বিজয়া কহিল, না, চিঠি আমি দেখতে চাই। কিন্তু, এই কথাই যদি তাতে থাকে তাঁর হুকুম আমি কোন মতেই অমান্য করব না।

নরেন্দ্র কহিল, তাঁর অভিপ্রায় যে শেষ পর্যন্ত এই ছিল তারই বা প্রমাণ কোথায়?

বিজয়া উত্তর দিল, ছিল না তার ত প্রমাণ নেই।

নরেন্দ্র কহিল, কিন্তু, আমি যদি না নিই? দাবী না করি?
বিজয়া কহিল, সে আপনার ইচ্ছা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আপনার পিসীর ছেলেরা আছেন। আমার বিশ্বাস, অনুরোধ করলে তারা দাবী করতে অসম্মত হবেন না।

নরেন্দ্র হাসিয়া কহিল, এ বিশ্বাস আমারও আছে। এমন কি, হলফ করে বলতেও রাজী আছি।

বিজয়া এ হাসিতে যোগ দিল না—চুপ করিয়া রহিল।

নরেন্দ্র পুনরায় কহিল, অর্থাৎ, আমি নিই, না নিই, আপনি দেবেনই?

বিজয়া কহিল, অর্থাৎ বাবার দান করা জিনিস আমি আত্মসাৎ করব না এই আমার প্রতিজ্ঞা।

তাহার সঙ্কল্পের দৃঢ়তা দেখিয়া নরেন মনে মনে বিস্মিত হইল, মুগ্ধ হইল। কিন্তু নিঃশব্দে কিছুক্ষণ থাকিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে বলিল, ও বাড়ি যখন সৎকর্মে দান করেছেন তখন আমি না নিলেও আপনার আত্মসাৎ করার পাপ হবে না। তা ছাড়া, ফিরিয়ে নিয়ে কি করব বলুন? আপনার কেউ নেই যে তারা বাস করবে। আমাকে বাইরের কোথাও না কোথাও কাজ করতেই হবে। তার চেয়ে যে ব্যবস্থা, হয়েছে, সেই ত সবচেয়ে ভাল হয়েছে। আরও এক কথা এই যে বিলাসবাবুকে কোনও মতেই রাজী করাতে পারবেন না।

এই শেষ কথাটায় বিজয়া মনে মনে জ্বলিয়া উঠিয়া কহিল, নিজের জিনিসে অপরকে রাজী করানোর চেষ্টা করার মত অপর্যাপ্ত সময় আমার নেই। কিন্তু, আপনি ত আর এক কাজ করতে পারেন। বাড়ি যখন আপনার দরকার নেই, তখন তার উচিত মূল্য আমার কাছে নিন। তা হলে চাকরিও করতে হবে না, অথচ নিজের কাজও স্বচ্ছন্দে করতে পারবেন। আপনি সম্মত হোন নরেনবাবু।

এই একান্ত মিনতিপূর্ণ অনুনয়ের স্বর অকস্মাৎ শরের মত গিয়া নরেনের হৃদয়ে বিঁধিয়া তাহাকে চঞ্চল করিয়া তুলিল; এবং যদিচ বিজয়ার অবনতমুখে এই মিনতির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পড়িয়া লইবার সুযোগ মিলিল না, তথাপি ইহা পরিহাস নয় সত্য, ইহাও বুঝিতে বিলম্ব ঘটিল না। পিতৃঋণের দায়ে তাহাকে গৃহহীন করিয়া এই মেয়েটি যে সুখী নয়, বরঞ্চ হৃদয়ে ব্যথাই অনুভব করিতেছে, এবং কোন একটা উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া তাহার দুঃখের ভার লঘু করিয়া দিতে চায় ইহা নিশ্চয় বুঝিয়া তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। কিন্তু, তাই বলিয়া এরূপ প্রস্তাবও ত স্বীকার করা চলে না। যাহা প্রাপ্য নয় গরীব বলিয়া তাহাই বা কিরূপে ভিক্ষা লইবে? আরও একটা কথা আছে। যে সকল সাংসারিক ব্যাপার পূর্বে একেবারেই সমস্যা ছিল, তাহার অনেকগুলিই এখন এই লোকটির কাছে সহজ হইয়া গেছে। সে স্পষ্ট দেখিতে পাইল, বিলাসের সম্বন্ধে বিজয়া আবেগের উপর যাহাই কেন না বলুক, তাহার বাধা ঠেলিয়া শেষ পর্যন্ত এ সঙ্কল্প কিছুতেই কার্যে পরিণত করিতে পারিবে না। ইহাতে শুধু কেবল তাহার লজ্জা এবং বেদনাই বাড়িবে আর কিছু হইবে না।

কিছুক্ষণ তাহার অবনত মুখের প্রতি সস্নেহ দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া পরিহাস-তরলকণ্ঠে বলিল, আপনার মনের কথা আমি বুঝেচি। গরীবকে কোন একটা ছলে কিছু দান করতে চান, এই ত?

ঠিক এই কথাটাই আজ একবার হইয়া গেছে। তাহারই পুনরাবৃত্তিতে বিজয়া বেদনায় ম্লান হইয়া চোখ তুলিয়া কহিল, এ কথায় আমি কত কষ্ট পাই, আপনি জানেন?
নরেন মনে মনে হাসিয়া প্রশ্ন করিল, তবে আসল কথাটা কি শুনি?

বিজয়া কহিল, সত্যি কথাই আমি বরাবর বলেচি; আপনার পাপ মন বলেই শুধু বিশ্বাস করতে পারেন নি। আপনি গরীব হোন, বড়লোক হোন, আমার কি? আমি কেবল বাবার আদেশ পালন করবার জন্যেই আপনাকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্চি।

নরেন সহসা গম্ভীর হইয়া বলিল, ওর মধ্যেও একটু মিথ্যে রয়ে গেল—তা থাক। কিন্তু খুব বড় বড় প্রতিজ্ঞা ত করচেন; কিন্তু বাবার হুকুমমত ফিরিয়ে দিতে হলে আরও কত জিনিস দিতে হয় জানেন? শুধু ওই বাড়িটাই নয়।

বিজয়া কহিল, বেশ। নিন, আপনার সম্পত্তি ফিরিয়ে নিন।

এইবার নরেন হাসিয়া ঘাড় নাড়িল। কহিল, খুব বড় গলায় চিৎকার করে ত আমাকে দাবী করতে বলচেন। আমি না করলে আমার পিসীমার ছেলেদের দাবী করতে বলবেন, ভয় দেখাচ্চেন। কিন্তু, তাঁরই আদেশমত দাবী আমার কোথা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে, জানেন কি? শুধু কেবল ওই বাড়িটা আর কয়েক বিঘে জমি নয়, তার ঢের-ঢের বেশী।

বিজয়া উৎসুক হইয়া কহিল, বাবা আর কি আপনাকে দিয়েছেন?

নরেন বলিল, তাঁর সে চিঠিও আমার কাছে আছে। তাতে যৌতুক শুধু তিনি ওইটুকু দিয়েই আমাকে বিদায় করেন নি। যেখানে যা কিছু আছে দেখচেন, সমস্তই তার মধ্যে। আমি দাবী শুধু ওই বাড়িটা করতে পারি তাই নয়। এ বাড়ি, এই ঘর, ওই সমস্ত টেবিল-চেয়ার-আয়না-দেয়ালগিরি-খাট-পালঙ্ক, বাড়ির দাস-দাসী-আমলা-কর্মচারী, মায় তাদের মনিবটিকে পর্যন্ত দাবী করতে পারি, তা জানেন কি? বাবার হুকুম—দেবেন এই সব?

বিজয়ার পদনখ হইতে চুল পর্যন্ত শিহরিয়া উঠিল, কিন্তু, সে কোন উত্তর না দিয়া অধোমুখে কাঠের মূর্তির মত বসিয়া রহিল। নরেন সগর্বে ভাতের গ্রাস মুখে তুলিয়া দিয়া খোঁচা দিয়া বলিল, কেমন, দিতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে? বরঞ্চ একবার না হয় বিলাসবাবুর সঙ্গে নিরিবিলি পরামর্শ করবেন! বলিয়া হাঃ হাঃ হাঃ করিয়া হাসিতে লাগিল।

কিন্তু, এইবার বিজয়া মুখ তুলিতেই তাহার প্রবল হাস্য সহসা যেন মার খাইয়া রুদ্ধ হইল। বিজয়ার মুখে যেন রক্তের আভাসমাত্র নাই—এমনি একটি শুষ্ক পাণ্ডুর মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া, নরেন উদ্বিগ্ন শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, আপনি পাগল হয়ে গেলেন নাকি? আমি কি সত্যি সত্যিই এই সব দাবী করতে যাচ্চি, না করলেই পাব? বরঞ্চ আমাকেই ত তা হলে ধরে নিয়ে পাগলা গারদে পুরে দেবে।

বিজয়া এ-সকল কথা যেন শুনিতেই পাইল না। কহিল, কৈ দেখি বাবার চিঠি?

নরেন আশ্চর্য হইয়া বলিল, বেশ, আমি কি পকেটে করে নিয়ে বেড়াচ্চি নাকি? আর সে দেখেই বা লাভ কি আপনার?

তা হোক। দরোয়ানের হাতে চিঠি দুটো আজই দেবেন। সে আপনার সঙ্গে কলকাতায় যাবে।

এত তাড়া?

হাঁ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *