• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

জাত গোক্ষুর – ০২

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » জাত গোক্ষুর » জাত গোক্ষুর – ০২

লম্বা উইঢিবির গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে, মাথাটা বার কয়েক নেড়ে প্রিয় বন্ধু জুলহাস কায়সারের ছিনড়বভিনড়ব লাশটার কথা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করল রানা। ধীরে ধীরে দাঁড়াল, রডটা হাতে। বিধ্বস্ত প্লেনটার দিকে একবারও না তাকিয়ে হাঁটা ধরল-জানে না কোনদিকে যাচ্ছে, ওদিকে কোনও পথ পাওয়া যাবে কি না।

ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে এল। ঝোপের কাঁটা ট্রাউজারে আটকাচ্ছে, ছাড়াতে সময় লাগছে, ফলে এগোবার গতি মন্থর। সামনে পড়ল লম্বা ঘাস। এ যেন একটা সবুজ সাগর, অনায়াসে ডুবে যাওয়া যায়। একটুর জন্যে কুণ্ডলী পাকানো একটা বিষাক্ত সাপের গায়ে পা পড়ল না, দেখতে পেয়ে লাফ দিয়ে তিন হাত দূরে সরে এলো।

সারা শরীরে তীব্র ব্যথা, তবে গ্রাহ্য না করে ধীরে ধীরে হাঁটছে। দু’ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কোথায় পথ, কোথায় জনবসতি, কোথায় কি। রানা বুঝতে পারল, বিশ্রাম না নিয়ে ওর পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। এত দুর্বল, পা দুটো কাঁপছে। হাঁপানোর ধরনটা, যেন শ্বাসকষ্টে ভুগছে। মরা একটা গাছের গুঁড়ি দেখতে পেয়ে ধপ করে পাশের মাটিতে বসল ও, হেলান দিল সেটার গায়ে।

চোখ দুটো আপনা থেকে বুজে আসছে। উরুর একটা পেশি বার বার মোচড় খাচ্ছে। মশা-মাছি বসছে চোখে-মুখে। এ-সব গ্রাহ্য না করে অনড় থাকল রানা। জানে বিশ্রাম দরকার, যত বাধাই আসুক বিশ্রাম পেতে হবে।

ঘাসের রাজ্য থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো।

কেঁপে কেঁপে খুলে গেল চোখের পাতা। ওর কি শুনতে ভুল হয়েছে? লম্বা ঘাসের ভেতর দিয়ে যতদূর দৃষ্টি চলে, কোথাও কিছু নড়ছে না। ব্যাপারটা তাহলে কল্পনাই। আবার চোখ বুজল রানা। কিন্তু ঠিক তখুনি দ্বিতীয়বার শুনতে পেল।

এবার চোখের পাতা ঝট্‌ করে খুলে গেছে। আর কোন সন্দেহ নেই-পরিষ্কার শুনতে পেয়েছে ও মানুষের গলা। কান পেতে অপেক্ষায় থাকল। আরও একটা শব্দ হলো। একটা ডাল ভাঙার আওয়াজ।

‘হ্যালো!’ ডাকল রানা। গলা আরও কিছুটা চড়িয়ে বলল, ‘এইদিকে!’

একটু পরই ঘাসের ওপর দু’জন লোকের মাথা দেখা গেল। কালো মাথা। গায়ে বহুরঙা শার্ট। রানাকে দেখে তাদের একজনের গলার আওয়াজ বেড়ে গেল। একটা হাত লম্বা করে সঙ্গীকে দেখাল সে। সঙ্গীটিও উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল।

রানার ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না ওকে দেখেই এত উল−সিত হবার কি কারণ থাকতে পারে। স্প্যানিশ ভাষায় জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যালো। তোমাদের কাছে পানি আছে?’

ওর সামনে এসে দাঁড়াল দুই তরুণ। রোগা, তবে দুর্বল নয় তারা। চেহারা গম্ভীর, ভঙ্গিটাও-দু’জনেই নিজেদের কোমরে হাত রেখে রানাকে খুঁটিয়ে দেখছে। রানার প্রশ্ন শুনে পরস্পরের দিকে তাকাল, তারপর আবার ফিরল ওর দিকে। আরও একটু এগিয়ে এলো তারা। রানা দাঁড়াবার চেষ্টা করছে না। ‘পানি,’ আবার বলল ও।

দু’জনেই প্যান্ট-শার্ট পরে আছে, পায়ের স্যান্ডেলগুলো টায়ার কেটে তৈরি করা। এরা অসভ্য জংলী নয়, সভ্যজগতের বাসিন্দা। দু’জনের মধ্যে একজন বেশ লম্বা, হাত তুলে রানার পা দুটো দেখাল সে, তারপর রানা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটু গেড়ে বসে ওর জুতোর ফিতে খুলতে শুরু করল। কি করছে সে, এ প্রশ্ন তোলার সময় পাওয়া গেল না, এক পাটি জুতো খুলে সঙ্গীর দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। দ্বিতীয় তরুণ বেঁটে, মুখে কাটাকুটির শুকনো দাগ। জুতোটা নিয়ে পরীক্ষা করছে সে। তার সঙ্গীর কানে খুদে আয়না লাগানো দুল ঝুলছে। দু’জনের সঙ্গেই একটা করে ছোরা রয়েছে। খাপে মোড়া, কোমরে গোঁজা। সে-ই প্রথম কথা বলল, স্প্যানিশ ভাষায়, সঙ্গীকে উদ্দেশ করে, ‘আজ বোধহয় আমার কপালটাই খুলে যাবে।’

‘আমার কথা শোনো,’ নরম গলায় শুরু করল রানা।

ওকে তারা গ্রাহ্যই করল না। লম্বা লোকটা ঝুঁকে দ্বিতীয় জুতোটাও পা থেকে খুলে নিল। স্যান্ডেল জোড়া ফেলে দিয়ে জুতো দুটো পরে ফেলল সে। ‘ভালই ফিট করেছে, কি বলিস?’

তার সঙ্গী ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসি নিয়ে গোটা ব্যাপারটা উপভোগ করছে। ‘কি করে ধরে নিচ্ছিস ওগুলো তোর? আমরা তো লোকটাকে একই সময়ে দেখতে পেয়েছি, তাই না?’

‘না, আমি আগে দেখেছি,’ প্রথমজন বলল। ‘তুই ওর ট্রাউজার নিতে পারিস। বিদেশী লোক, মানিব্যাগে প্রচুর ডলার পাব।’

‘কিভাবে ভাগ হবে?’ জানতে চাইল বামন।

‘আধাআধি।’

‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো খর্বকায়, তবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে ছাড়ল না। ‘কিন্তু জুতো জোড়া তোর নেয়া উচিত হলো না।’

লম্বা লোকটা রানার দিকে ফিরল। ‘ট্রাউজার খোলো।’

‘দূর গাধা!’ বামন ধমক দিল। ‘আগে জিজ্ঞেস কর মানিব্যাগে কত টাকা আছে। ভুল হলো। জিজ্ঞেস করার দরকার কি, পকেটে হাত ঢুকিয়ে মানিব্যাগটা বের কর। যদি বেশি টাকা পাই, ট্রাউজার নেব না-জবাই করে কেটে পড়ব।’

লোকটার কথায় যুক্তি খুঁজে পেল রানা। বিদেশী একজন ট্যুরিস্টের সব কিছু ছিনিয়ে নেয়ার পর কোন্‌ বোকা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে?

কিন্তু রানাকে হতভম্ব করে দিয়ে দুই ছিনতাইকারী বুদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। আয়না লাগানো দুল দুলিয়ে লম্বা লোকটা বলল, ‘আমি যদি গাধা হই তো তুই কি? শুনে বল, আমার এই বুদ্ধিটা কেমন।’ কোমরে আটকানো খাপ থেকে ছোরাটা টেনে নিল সে। ‘আগে জবাই করাটা সব দিক থেকে নিরাপদ নয়?’

‘বেড়ে বলেছিস। নাহ্‌, সত্যি, তোর বুদ্ধি আছে! তো কর, ধড় থেকে মুণ্ডুটা আলাদা করে ফেল, দেরি করছিস কেন?’ ‘না, দেরি কিসের!’ বলেই লম্বা লোকটা রানার বুক লক্ষ্য করে ছুরি চালাল। জবাই যদি করেও, পরে; আগে আহত করে নিতে চাইছে।

খুন হতে হবে শুনে কোথায় পালিয়েছে দুর্বলতা আর ক্লান্তি, শরীরের পাশে লুকানো ইস্পাতের রডটা শক্ত মুঠোয় নিয়ে অপেক্ষা করছিল, যেই দেখল লোকটা ছুরি চালাতে যাচ্ছে অমনি সেটা তুলে লোকটার কব্জিতে আঘাত করল রানা। লোকটা কেঁদে ফেলল, নিশ্চয়ই ছুরি হারাবার শোকে নয়, কারণ তার কব্জির হাড় শুধু ভাঙেনি, গুঁড়ো হয়ে গেছে। তবে তার কানড়বা দেখার জন্যে থেমে নেই রানা, বসে বসেই একটা লাথি মারল লোকটার তলপেটে। ছিটকে ঘাসের ভেতর ডুবে গেল সে, কানড়বা ও নড়াচড়া দুটোই থেমে গেছে।

ইতিহাসের শিক্ষা নিল না দ্বিতীয় লোকটা, ছুটে এসে আক্রমণ করল, ছুরিটা লম্বা করা হাতের বর্ধিত অংশ যেন। একপাশে সরে গিয়ে ল্যাং মারল রানা। ছিটকে পড়ে যাচ্ছে, নিতম্বে ওর একটা লাথি গতিবেগ তিনগুণ বাড়িয়ে দিল।

ঘাসের ওপর পড়ায় আঘাত গুরুতর নয়, সিধে হয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করল লোকটা। কিন্তু ততক্ষণে ওর ছুরিটা কুড়িয়ে নিয়ে বাগিয়ে ধরেছে রানা। মারার ভঙ্গি করে ভয় দেখাল। তারপর সংক্ষেপে নির্দেশ দিল কয়েকটা। ওর কথা শেষ হতে মাথা ঝাঁকাল লোকটা নিঃশব্দে।

অজ্ঞান লোকটার পা থেকে জুতো খুলে রানার পায়ে পরাল খর্বকায়। রানার প্রশেড়বর উত্তরে জানাল, দক্ষিণ দিকে গেলে রাস্তা ও গাড়ি দুটোই পাওয়া যাবে। সে নিজে অবশ্য সদ্য জ্ঞান ফিরে পাওয়া সঙ্গীকে নিয়ে পুব দিকে ছুটল, যেদিক থেকে এসেছিল। লোকটা সত্যি কথা বলেছে, এরকম ভাবার কোন কারণ নেই; রানা উল্টো অর্থাৎ উত্তর দিকে রওনা হলো।

মাইলখানেক হাঁটার পর নিজের প্যাঁচালো বুদ্ধির তারিফ করল রানা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে উন্মুক্ত হলো চওড়া হাইওয়ে, তীর বেগে গাড়ি চলাচল করছে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে হাত তুলতে একটা লিফট পেতেও বেশি সময় লাগল না। ট্রাক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল কাছাকাছি এয়ারপোর্ট ডিয়ানোপলিস।

ট্রাক ছুটছে। রানা অন্যমনস্ক ও গম্ভীর। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে জুলহাস কায়সারের ক্ষতবিক্ষত লাশটা। তার এই করুণ পরিণতির জন্যে ডাফু সালজুনাস দায়ী হোক বা আকার্ডিয়া মারকাস, অবশ্যই তাকে চরম মূল্য দিতে হবে।

এথেন্সের কোলোসস বিল্ডিঙে কি ঘটছে জানতে হবে রানাকে। তবে তার আগে জানতে হবে আকার্ডিয়া মারকাস ব্রাজিলে আছে কিনা।

ডিয়ানোপলিস এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমে রিসর্ট শহর ফোর্টালেজায়, তারপর লং ডিসট্যান্স কল করল রানা বিসিআই হেডকোয়ার্টার ঢাকায়। ফোর্টালেজায় এক বান্ধবী ওর জন্যে অপেক্ষা করছে, ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করতে হলো হঠাৎ জরুরী একটা কাজ ঘাড়ে এসে চাপায় ব্রাজিল ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে ও।

তারপর বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (অপারেশন্স) প্রিয় বন্ধু সোহেল আহমেদকে জানাল কি ঘটেছে। সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেল সোহেল। ‘এখন তুই কি করতে চাস?’ প্রথম প্রশ্ন তার।

‘তুই জানিস কায়সারের সঙ্গে কি রকম সম্পর্ক ছিল আমার,’ বলল রানা। ‘এই হত্যাকাণ্ডের কারণটা আমার জানতে হবে।’

‘প্রতিশোধ নিতে চাস?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি তোকে বাধা দেব না,’ সোহেল শান্ত, ভেবেচিন্তে কথা বলছে, ‘কারণ জানি আমার বাধা তুই পাত্তাও দিবি না। কিন্তু একটা কথা জানিস তো, ব্যক্তিগত প্রতিশোধ নেয়ার ব্যাপারটাকে বস্‌ কোনদিনই ভাল চোখে দেখেন না…’

‘দ্যাখ, আমাকে জ্ঞান দান করতে আসিস না। কাজটা আমি অফিশিয়াল অনুমোদন না নিয়েও করতে পারি, সোহেল,’ ঠাণ্ডা গলায় বলল রানা, সোহেলের চেয়েও শান্ত। ‘কারণ আমি ছুটিতে।’

‘তাহলে ফোন করেছিস কেন? এই অসময়ে ফোন করে আমাকে ঘাবড়ে দেয়ার কি মানে?’

‘ফোন আমি বিসিআই-এর চীফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে করিনি, করেছি আমার বন্ধুকে।’

অপরপ্রান্তে বিশ সেকেন্ড কোন সাড়া নেই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দেয়ার আওয়াজ। ‘তাহলে সব কথা তোকে খুলেই বলতে হয়।’

‘কি কথা?’ রানা একটু অবাকই।

এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে সোহেল যা বলল, তার সার সংক্ষেপ হলো এরকম:

গত বছরের কথা। গ্রীক বিলিওনেয়ার ডাফু সালজুনাস তাঁর পার্সোন্যাল সেক্রেটারীর নেতৃত্বে একদল কর্মকর্তাকে বাংলাদেশে পাঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়ে। কোলোসস কোম্পানি ফ্লাইওয়ে, পাতালরেল, উপকূল থেকে গ্যাস উত্তোলন ইত্যাদি মোট বারোটা প্রজেক্টে বাংলাদেশে সব মিলিয়ে তিন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তাগাদা দিয়ে তড়িঘড়ি চুক্তির খসড়া তৈরি করালেন তাঁরা, তারপর সেই চুক্তি ডাফু সালজুনাসকে দিয়ে অনুমোদন করাতে এথেন্সে ফিরে গেলেন। সেই যে গেলেন, তারপর আর কোন খবর নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বারবার যোগাযোগ করে জানতে চেয়েছে খসড়া চুক্তি মিস্টার সালজুনাস অনুমোদন করেছেন কিনা। উত্তরে প্রথমে বলা হয়েছে, বিষয়টা তিনি এখনও বিবেচনা করে দেখছেন। তারপর বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও কোলোসস কোম্পানি কিছু বলছে না। বাণিজ্য মন্ত্রী নিজে এই ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত, তাঁর কেমন যেন সন্দেহ হয়। বিসিআই চীফ রাহাত খানকে চিঠি লিখে তিনি তাঁর সন্দেহের কথাটা জানান, এবং অনুরোধ করেন সম্ভব হলে বিসিআই যেন একটু খোঁজ নিয়ে দেখে-বাংলাদেশের কোনও শত্রু কি চাইছে না কোলোসস কোম্পানি এ-দেশে এত মোটা টাকা বিনিয়োগ করুক? তারা কি সালজুনাসকে বুঝিয়েছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করা তাঁর উচিত হবে না? তা না হলে এরকম উদ্ভট আচরণ কেন করা হলো?

সবশেষে সোহেল জানাল, লোকবলের অভাব থাকায় ব্যাপারটা তদন্ত করে দেখা হয়নি। তবে এথেন্স এজেন্টদের চোখকান খোলা রাখতে বলা হয়েছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘বন্ধুকে ফোন করেছিস, ভাল কথা। এবার বল, বন্ধুর কাছে কি চাস?’

‘কমপিউটর অন কর্‌।’

‘করাই।’

‘প্রথমে কয়েকটা তথ্য,’ বলল রানা। ‘এক, গ্রীক-আমেরিকান ক্রিমিন্যাল আকার্ডিয়া মারকাস এখন কোথায়। দুই, ব্রাজিলে তার যে র‍্যাঞ্চ বা প্ল্যানটেশনটা ছিল, এখনও কি সেটা আছে?’

ত্রিশ সেকেন্ড পর উত্তর দিল সোহেল, ‘মারকাস এখন কোথায় নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। শেষবার, গত হপ্তায়, এথেন্সে দেখা গেছে তাকে। হ্যাঁ, প্ল্যানটেশনটা আছে। ওটাই এখন তার হেডকোয়ার্টার।’

‘আমাদের দৃষ্টিতে আকার্ডিয়া মারকাসের সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটা?’

‘ইয়াসির আরাফাতের উত্তরাধিকারী হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হত, সেই আবু ইসহাক ইমাম সালেহকে গত বছর খুন করেছে মারকাস। তখন থেকেই বিসিআই-এর “ওয়ান্টেড” তালিকায় তার নাম আছে।’

উল্লাস বোধ করছে রানা। ‘তাহলে তো বলতে হয় লোকটার ব্যবস্থা করতে পারলে একটা অফিশিয়াল দায়িত্বই পালন করা হবে আমার।’

এ-প্রসঙ্গে কিছু বলল না সোহেল। ‘তুই বরং রিয়ো ডি জেনেরিওতে চলে যা। রানা এজেন্সির চ্যানেল ধরে খোঁজ নিয়ে দেখ মারকাস কোথায় আছে। কি সূত্র পাবি তার ওপর নির্ভর করবে আদৌ তোর এথেন্সে যাবার দরকার আছে কিনা।’

আরও তিন মিনিট আলাপ করার পর পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। রিয়ো ডি জেনেরিওতে পরদিন সকালে পৌঁছাল রানা। বিশ্রাম, ওষুধ, আর ভাল পথ্য যেমন ওর শরীরের শক্তি ফিরিয়ে এনেছে তেমনি নতুন এক প্রস্থ পোশাক চেহারায় ফিরিয়ে এনেছে ভদ্র ও মার্জিত ভাব। কোপাকাবানা প্যালেস-এর উত্তরে, ফাইভ স্টার হোটেল হিলটনে উঠল ও। একটু দূরেই সৈকত, ওর বারোতলা ঝুল-বারান্দা থেকে সাগর দেখা যায়। রানা এজেন্সির রিয়ো শাখায় গেল না ও, ফোন করে শাখা প্রধান রিয়াজুল হাসানকে জানাল কি কি দরকার ওর, কোথায় কিভাবে দেখা হবে।

লাঞ্চ খেতে নিচে নামবে, রূম সার্ভিস একটা প্যাকেজ ডেলিভারি দিয়ে গেল। প্যাকেজ থেকে বেরুল একটা ওয়ালথার পিস্তল ও একটা খাপে মোড়া ছুরি, সিপ্রঙ লাগানো স্ট্র্যাপ সহ। রিয়াজুল হাসান একটা চিরকুটও পাঠিয়েছে, তাতে লেখা- ‘পিস্তলের লাইসেন্স আপনার নামে অনেক আগেই করা ছিল’। কথাটা আসলে রানাকে শুধু মনে করিয়ে দেয়ার জন্যেই লেখা। রানা এজেন্সির এরকম অনেক শাখাতেই ওর নামে পিস্তলের লাইসেন্স তৈরি আছে।

নিচে নেমে রেস্তোরাঁয় বসল রানা। মেন্যু দেখে অর্ডার দিচ্ছে, টেবিলের পাশ ঘেঁষে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখল। মুখটা ভাল করে দেখার সুযোগ হয়নি, তা সত্ত্বেও চোখ ফেরাতে পারছে না। দীর্ঘ কাঠামো, স্বাস্থ্য ভরাট হওয়া সত্ত্বেও ক্ষীণ কটি। আঁটসাঁট জিনস আর ম্যাগাজিন টি-শার্ট পরেছে। কাঁধে লাল চুলের সতূপ। দশ গজ দূরে একটা টেবিলে বসল, এদিকে মুখ করে।

মেয়েটাকে চেনা চেনা লাগছে রানার, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না কবে বা কোথায় দেখেছে। আসলে এই পোশাকেও দেখেনি, এই মেকআপেও নয়, চিনতে দেরি হবার সেটাই কারণ। ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হেসে উঠল মেয়েটা, অমনি রানা চিনে ফেলল তাকে। ওর নাম তারানা আজিজ, প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর একজন অপারেটর। বছর কয়েক আগে ফাতেমা কোডনেম নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্টে রানার সঙ্গে কাজ করেছিল এই মেয়েটা, সেবার ওরা ইজরায়েলের রাজধানী জেরুজালেমে ঢুকে মোসাদের হেডকোয়ার্টার ধ্বংস করে দিয়ে এসেছিল।

তারানা ব্রাজিলে কেন?-এই প্রশ্নটাই প্রথমে জাগল রানার মনে। চুলের রঙ আর পোশাকের পরিবর্তন বলে দিচ্ছে ছদ্মবেশ নিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নামটাও বদলে গিয়ে থাকতে পারে। সরাসরি আলাপ করতে যাওয়াটা ঠিক হবে না। রানা সিদ্ধান্ত নিল, ওকে চিনতে পারার একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে তারানাকে।

লাঞ্চের অর্ডার বাতিল না করেই টেবিল ছাড়ল রানা, ধীর পায়ে তারানার টেবিলটাকে পাশ কাটাচ্ছে।

‘গ্রেট! জাস্ট গ্রেট!’ চেয়ার ছেড়ে রানার পথ আগলাল বেদুইনকন্যা। ‘এটাই সম্ভবত বছরের সেরা জোক, মাসুদ রানা আমাকে চিনতে পারেনি!’

হেসে ফেলল রানা। ‘চিনতে পেরেছি ঠিকই, তবে দু’সেকেন্ড দেরি হয়েছে, দায়ী তোমার চুল আর ড্রেস।’

‘কাভার অ্যান্ড ক্যামোফ্লেজ,’ চাপা হাসির সঙ্গে ফিসফিস করল তারানা, তারপর রানার একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের টেবিলে বসবে?’ রানা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে আবার বলল, ‘পরে একজন আসছে। তুমি আবার কিছু মনে করবে নাকি?’

আবার হাসল রানা। ‘উত্তরটা দিতে পারব তাকে দেখার পর।’ দু’জনে মুখোমুখি বসল ওরা। ইঙ্গিতে ওয়েটারকে ডেকে নতুন করে তিনজনের জন্যে লাঞ্চের অর্ডার দিল রানা, তারানার আপত্তি কানে তুলল না। ‘তারপর, তারানা?’ জিজ্ঞেস করল ও। ‘ভাল যে আছ তা তো দেখছিই। ব্রাজিলে কি? বেড়াতে?’

মাথা নাড়ল তারানা। ‘কাজে। তুমি?’

রানা ভাবল, ব্রাজিলে প্যালেস্টাইন ইন্টেলিজেন্সের কি কাজ থাকতে পারে, আবু ইসহাক ইমাম সালেহ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া ছাড়া? ‘আমিও কাজেই,’ বলল ও।

প্রায় ভোজবাজির মতই অকস্মাৎ ওদের টেবিলের পাশে দেখা গেল তরুণটিকে। বয়স কম, বিশ কি একুশ; তবে দীর্ঘ কাঠামোর ওপর কঠোর শ্রম ও যতেড়ব তৈরি করা পেশিগুলো কাপড়ের বাইরে থেকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চেহারায় খেপা-খেপা একটা ভাব, যেন সারাক্ষণ রেগে বোম হয়ে আছে। ছোকরার সামার-ওয়েট সুট বাম বগলের তলার ফোলা ভাবটুকু লুকাতে পারেনি।

‘এটা কি হলো, তারানা?’ কর্কশ সুরে জানতে চাইল তরুণ। ‘এ তো আমি জানতাম না যে তোমার সঙ্গে আর কেউ থাকবে।’

তার আচরণ সামান্য অভব্য যদি হয়েও থাকে, রানা ব্যাপারটাকে হালকা দৃষ্টিতেই দেখতে চাইছে। অন্যতম কারণ, অল্প বয়স; দ্বিতীয় কারণ, ছেলেটাকে চেনে ও। চেনে মানে ছবি দেখেছে, ফাইলও কিছুটা পড়া আছে। মাত্র ষোলো বছর বয়সে পি.আই.বি-তে ঢোকে হাবিব বাকারা-অবিশ্বাস্য শোনালেও, কথাটা সত্যি-একজন খুনী হিসেবে। গত পাঁচ-ছ’বছরে তার হাতে কম করেও ষাটজন ইজরায়েলি এজেন্ট মারা পড়েছে। তারানার সঙ্গে বাকারার উপস্থিতি রানার ধারণা আরও দৃঢ় করল, ওরা নিশ্চয়ই আকার্ডিয়া মারকাসকে ধরতে এসেছে।

‘ইনি আমার পুরানো এক বন্ধু, হাবিব,’ বলল তারানা।

‘আমার, এবং ফিলিস্তিনীদের।’

‘জানি।’ খালি চেয়ারটায় বসল বাকারা। ‘মাসুদ রানা।’ তার আচরণে কোন রকম শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ নেই, তবে তুচ্ছতাচি ছল্যও করছে না। ‘আমাদের হয়ে বেশ কয়েকবারই মোসাদকে আপনি ভাল মার দিয়েছেন।’

‘তোমার সম্পর্কে কিছু তথ্য আমিও জানি,’ বলল রানা। ‘মোসাদ তোমাকে আজরাইলের চেয়েও বেশি ভয় পায়।’ ‘কিছু যদি মনে না করেন তো একটা সত্যি কথা বলি।’ এই প্রথম সরাসরি রানার দিকে তাকাল বাকারা। ‘মোসাদ বলুন, সিআইএ বলুন, এতটা বাড়তে পেরেছে আপনাদের মত নরম প্রকৃতির কিছু এজেন্টের জন্যে। আপনারাও লড়েছেন, তবে সূক্ষ্ম কৌশলে, গা বাঁচিয়ে। আমার পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা।’ হাসিমুখেই জানতে চাইল রানা, ‘সেটা কি?’

‘আঙুল তুলে টার্গেট বা সাবজেক্ট দেখিয়ে দিন, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তার লাশ ফেলে দেব।’ হাবিব বাকারা হাসছে না; আসলে হাসতে সে জানেই না।

‘ব্রাজিলে, আমার ধারণা, সাবজেক্ট তো একটাই,’ বলল রানা। ‘দেখি তুমি তাকে ফেলে দিতে পারো কিনা। পারলে সত্যি আমি খুশি হব।’

হাঁ করে তাকিয়ে থাকল বাকারা। তারপর তারানার দিকে তাকাল। ‘কি বলছেন উনি?’

তারানাও অবাক হয়ে দেখছে রানাকে। ‘কি জানি, বুঝতে পারছি না। রানা?’

বাতাসে হাত নেড়ে ব্যাপারটা ভুলে যেতে বলল রানা, তারপর ইঙ্গিতে এগিয়ে ওয়েটারকে দেখিয়ে কথা বলতে নিষেধ করল। ‘তোমরা কি এই হিলটনেই উঠেছ, তারানা?’ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।

‘না,’ বলল তারানা। ‘আমরা উঠেছি ইন্টারকনে। আঠারোতলায়। আমার রূম নাম্বার একশো বারো।’

বাকারা কঠিন চোখে তারানাকে দেখছে।

‘আমি ওখানে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি তো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

বাকারা তাড়াতাড়ি তারানাকে বলল, ‘বন্ধুত্ব ঝালাই করার মত সময় কিন্তু তোমার হাতে নেই, তারানা।’

তার কথায় কান না দিয়ে তারানা প্রথমে একটু লাল হলো, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে রানাকে বলল, ‘অবশ্যই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে পারো। বরং দেখা না করলেই দুঃখ পাব আমি। মাত্র একটা অ্যাসাইনমেন্টে কাজ করেছি, কিন্তু পরস্পরকে আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাইনি? সে-সব স্মৃতি কি কখনও ভোলা যাবে?’

লাঞ্চ খাচ্ছে, পুরানো সেই সব স্মৃতি নিয়ে গল্পও চলছে। বাকারাকে দেখে মনে হলো রাগে বেলুনের মত ফুলছে সে। রানা উৎসাহ দিতেও ওদের আলোচনায় অংশ গ্রহণ করল না। এমন কি নিজের লাঞ্চের বিলটাও রানাকে দিতে বাধা দিল, বলল, ‘আমার বিল আমিই দেব।’

খানিক পর তারানার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এলো রানা, পিঠে বাকারার দৃষ্টি গরম আঁচের মত অনুভব করল।

« পূর্ববর্তী:
« জাত গোক্ষুর – ০১
পরবর্তী: »
জাত গোক্ষুর – ০৩ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top