রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট
মূল রচনা: উইলিয়াম শেকসপিয়র
ভাষান্তর: অজয় দাশগুপ্ত ও অরবিন্দ চক্রবর্তী
১
ইতালি দেশের এক সুন্দর শহর ভেরোনা—প্রাচীনত্ব আর ঐতিহ্যপূর্ণ। রাজা ছাড়াও এদেশে রয়েছে আরও দুটি অভিজাত পরিবার, ধন-সম্পত্তি আর ক্ষমতার দিক দিয়ে রাজার চেয়ে তারা কোনও অংশে কম নয়। এ দুটি বংশের একটি ক্যাপুলেট, অন্যটি মন্টেগু।
বংশ দুটি ধনী ও অভিজাত হলেও তাদের মধ্যে রয়েছে চিরকালীন শত্রুতা। এ শত্রুতা যে কবে শুরু হয়েছিল তা সবার অজানা। উভয়ের সম্পর্কটা ঠিক সাপে-নেউলের মতো। উভয় পরিবারের শত্রুতার প্রভাব তাদের চাকর-বাকরদের মধ্যেও পড়েছে। রাস্তা-ঘাটে যখনই যেখানে দেখা হয়, কোনও না কোনও অজুহাতে একে অপরের সাথে ঝগড়া বাধায়, মারামারি করে—যার পরিসমাপ্তি হয় রক্তপাতে।
একদিন সাতসকালে ক্যাপুলেট পরিবারের দুই চাকর স্যামসন আর গ্রেগরি এসে হাজির হল শহরের এক জনবহুল ব্যস্ত এলাকায়—তাদের উদ্দেশ্যে মন্টেগু পরিবারের চাকরদের সাথে ঝগড়া বাধানো।
বিরক্তি মেশান স্বরে গ্রেগরিকে বলল স্যামসন, ‘আমি তোকে পরিষ্কার বলে দিচ্ছি গ্রেগরি, এভাবে প্রতিদিন কয়লার বোঝা বইতে পারব না আমি।’
‘ঠিকই বলেছি,’ বলল গ্রেগরি, ‘ও কাজ করলে আমরা সবাই আমাদের কয়লাখনির কুলি-কামিন বলবে।’
গলাটা সামান্য চড়িয়ে বলল স্যামসন, ‘দেখ গ্রেগরি! তুই কিন্তু ভুলে যাস না আমি বেজায় রাগী। রাগ হলেই আমি তলোয়ার বের করি।’
‘যা! যা! তোর আবার রাগ আছে নাকি’—স্যামসনকে ইচ্ছে করে তাতিয়ে বলল গ্রেগরি।
‘দ্যাখ গ্রেগরি! ভালো হচ্ছে না কিন্তু’—খেঁকিয়ে বলল স্যামসন। ‘জানিস! মন্টেগুদের বাড়ির একটা কুকুর আজ আমার মেজাজ বিগড়ে দিয়েছে।’
জবাবে কী যেন বলতে চাচ্ছিল গ্রেগরি, এমন সময় তার চোখে পড়ল মন্টেগু বাড়ির দুজন বয়স্ক চাকর, আব্রাহাম আর বালথাজার তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে।
‘ওরে স্যামসন! মন্টেগু বাড়ির ধেড়ে চাকর দুটি যে এদিকেই আসছে। নে! এবার তো তলোয়ার বের কর’—বলল গ্রেগরি।
একটি ভেবে নিয়ে স্যামসন বলল, ‘নারে! আগে ওদেরই শুরু করতে দে। তাহলে আইন আমাদের পক্ষে থাকবে।’
‘বেশ তাই হলে’—বলল গ্রেগরি। ‘চল, আমরা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যেতে যেতে আমি কিন্তু বারবার ভ্রু কুঁচকিয়া এক চোখ বুজে ওদের ভ্যাভাব।’
‘উঁহু, ওতে কোনও কাজ হবে না,’ বলল স্যামসন। ‘বরঞ্চ ওদের দিকে আমি বুড়ো আঙুল নাচাব। দেখবি, ঠিক কাজ হবে তাতে।’
তাদের উদ্দেশ্য করে বুড়ো আঙুল নাচানো দেখে মন্টেগুদের একজন বয়স্ক চাকর আব্রাহাম এগিয়ে এসে বলল, ‘ওহে ছোকরা! তুমি আমাদের বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছ?’
‘বেশ করেছি, দেখাবই তো’, গলা চড়িয়ে বলল স্যামসন। ঠিক তখনই তাকে পেছন থেকে চিমটি কাটল গ্রেগরি। চিমটি খেয়েই সুর পালটে বলল স্যামসন, ‘না, ঠিক তোমাদের নয়, আমি এমনই বুড়ো আঙুল নাচাচ্ছি।’
গ্রেগরি জানতে চাইল, তোমরা কি আমাদের সাথে ঝগড়া বাধাতে চাও?’
‘ঝগড়া। তোমাদের সাথে?’ অবাক হয়ে বলল আব্রাহাম, ‘বলা নেই, কওয়া নেই, অহেতুক ঝগড়া করতে কেন যাব?’
একগুঁয়ের মতো বলল স্যামসন, ‘ধরো, ভুলবশতই তোমরা ঝগড়া করতে চাইছ আমাদের সাথে। তাহলে কিন্তু ছেড়ে দেব না তোমাদের। আমরাও জানি কীভাবে বিবাদ বাধাতে হয়।’
পরিহাসের সুরে বলল আব্রাহাম, ‘আমার মতো বলছে কেন, আমার চেয়ে বেশি জান না বোধ হয়?’
কানে কানে স্যামসনকে বলল গ্রেগরি, ‘অকে বলে দে তোমার চেয়ে ভালো জানি।’
‘ঠিক বলেছিস’ বলেই নির্বোধের মতো আঙুল নাচাতে নাচাতে বলল স্যামসন, ‘তোমার চেয়ে ভালো জানি কী করে ঝগড়া বাধাতে হয়।’
এতক্ষণে রেগে গিয়ে বলল আব্রাহাম, ‘ওহে মিথ্যেবাদী ছোকরা! আমার সাথে ঝগড়া করার মুরোদ নেই তোমার।’
কথা শুনে ফুঁসে উঠে বলল স্যামসন, ‘দাঁড়াও, আমাকে মিথ্যেবাদী বলার মজা দেখাচ্ছি তোমায়’, বলেই খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল আব্রাহামের উপর। আত্মরক্ষার জন্য আব্রাহামও বাধ্য হল তলোয়া বের করতে। ওদিকে স্যামসনের দেখাদেখি গ্রেগরিও তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল বালথাজারের উপর।
ওদের এভাবে লড়াই করতে দেখে ছুটে এলেন সেনর বেলভোলিও। নিজের তলোয়ার বের করে ওদের থামাতে থামাতে বললেন, ‘ওরে গাধার দল! কী করছিস তা জানিস তোরা। ফেলে দে তলোয়ার। থামা তোদের লড়াই।’
ঠিক সেসময় ক্যাপুলেট গিন্নির ভাইপো টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। বেনভোলিওকে দেখে সে বলল, কী হে বেনভোলিও। এসব ছোটোলোক চাকর-বাকরদের ব্যাপারে তুমি আবার নাক গলিয়েছ কেন? লড়ার ইচ্ছে হলে আমার সাথে লড়। বের কর তোমার তলোয়ার। চিরদিনের মতো তোমার সাধ মিটিয়ে দেব।’ বলেই তলোয়ার হাতে টিবল্ট ছুটে এল বেনভোলিওর দিকে।
বেনভোলিও জবাব দিলেন, ‘তুমি ভুল করছ টিবল্ট। আমি ওদের মিটমাটের চেষ্টা করছি।’
‘কী বললে, খোলা তলোয়ার হাতে শান্তিরক্ষা?’ হেসে উঠে বললেন টিবল্ট, ‘শুনে রাখ, মন্টেগু পরিবারের সবাইকে আমি চরম ঘৃণা করি। তোমরা শেয়াল-কুকুরের চেয়েও হীন। নাও, এবার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও’—বলেই খোলা তলোয়ার হাতে বেনভোলিওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল টিবল্ট। এবার শুরু হয়ে গেল লড়াই। খোলা রাস্তার উপর ক্যাপুলেট আর মন্টেগু পরিবারের দুই সদস্য ও দু-জোড়া চাকর নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে মেতে উঠল। নিমেষের মধ্যে রটে গেল ক্যাপুলেট আর মন্টেগুরা ফের শুরু করেছে নিজেদের মধ্যে লড়াই। খবর পেয়ে শান্তিরক্ষক তার কয়েকজন কর্মচারীকে সাথে নিয়ে সেখানে এলেন। দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত করতে কয়েকজন স্থানীয় নাগরিকও সেখানে গেলে অস্ত্র হাতে।
নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে শান্তিরক্ষক বললেন, ‘ধর ব্যাটাদের। মেরে শেষ করে দে সব কটাকে। এমন শিক্ষা দিবি যাতে চিরকালের জন্য ওদের মারামারির শখ মিটে যায়।’
‘মন্টেগু আর ক্যাপুলেট, দুপক্ষই নিপাত যাক’—বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল নাগরিকরা। দাঙ্গাবাজ দু-পক্ষকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে জমে উঠল লোকের ভিড়, হই-হট্টগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি। মারামারির খবর পেয়ে ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তা স্ত্রীকে নিয়ে হাজির হলেন সেখানে। গোলমাল দেখে স্ত্রীকে বললেন, ‘শয়তানগুলো বুঝি আবার মারামারি শুরু করেছে?’ যাও তো, কাউকে বাড়ি পাঠিয়ে আমার তলোয়ারগুলি নিয়ে আসতে বল। তারপর দেখাচ্ছি ওদের মজা।
বুড়োকর্তার স্ত্রী বললেন, ‘তুমি বুড়ো মানুষ। তলোয়ার দিয়ে কী করবে? তার চেয়ে বরং সেই ঠেঙ্গোটা পাঠিয়ে দেই যাতে ভরে দিয়ে তুমি চলা-ফেরা কর।’
‘নাঃ নাঃ ঠেঙ্গোতে হবে না, তলোয়ারই চাই আমার। দেখছ না, বুড়ো মন্টেগু তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে ওরও হাতে রয়েছে তলোয়ার।’
ক্যাপুলেটদের বুড়ো কর্তাকে দেখামাত্রই হেঁকে উঠলেন মন্টেগুদের বুড়ো কর্তা, ‘অ্যাই বদমাস ক্যাপুলেট! যদি বাঁচতে চাস তো ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক। মোটেই বাধা দিবি না আমার কাজে।’
স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে মন্টেগু গিন্নিও বলে উঠলেন, ‘সাবধান করে দিচ্ছি তোদের। আর একপাও এগুবি না।’
এবার ঝগড়া শুরু হয়ে গেল দু’পক্ষের বুড়ো-বুড়িদের মাঝে।
সে সময় ভেরোনার রাজা এসকেলাস তার সভাসদদের নিয়ে সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। গণ্ডোগোল আর চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে ঘোড়া থামিয়ে তিনি সেখানে দাঁড়ালেন। তারপর দাঙ্গাবাজদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আবার তোমরা রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধিয়েছ? ভালো চাও তো সবার হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দাও।’ রাজার আদেশে সবাই তলোয়ার ফেলে দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
এরপর মন্টেগু আর ক্যাপুলেট—দুই বুড়োর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রাজা বললেন, ‘আপনারা দুজনেই বয়স্ক লোক, কোথায় আপনারা থামাবেন, তা নয়, তলোয়ার হাতে দুজনেই ছুটে এসেছেন। এই নিয়ে পরপর তিনবার এরূপ কাণ্ড ঘটল শহরে। আমি আপনাদের সাবধান করে দিচ্ছি ভবিষ্যতে এরূপ কাণ্ড ঘটলে আমি বাধ্য হব আপনাদের সবার প্রাণদণ্ড দিতে। যান! হাতের তলোয়ার ফেলে নিজ নিজে কাজে চলে যান।’ এরপর ক্যাপুলেটদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি চলুন আমার সাথে। আর হ্যাঁ মন্টেগু, আপনি আজ দুপুরের বিচারসভায় যাবেন। আমার যা বলার সেখানেই বলব’—বলেই সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেলেন রাজা।
সবাই চলে যাবার পর মন্টেগু পরিবারের বুড়ো কর্তা জিজ্ঞেস করলেন তার ভাইপোকে, ‘আচ্ছা, বলতো কী হয়েছিল? কে আবার নতুন করে ঝগড়াটা বাধাল?’
কাকার প্রশ্নের জবাবে সেনর বেনভোলিও বললেন, ‘সে সময় আমি এপথ দিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দু বাড়ির কয়েকজন চাকর তলোয়ার নিয়ে লড়াই করছে। আমি ওদের ছাড়াতে গেছি এমন সময় কোথা থেকে খবর পেয়ে টিবল্ট এসে হাজির সেখানে। টিবল্টের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকেও তলোয়ার বের করতে হয়। এরপরই শুরু হল বেজায় লড়াই। ভাগ্যিস সে সময় এপথ দিয়ে আসছিলেন রাজামশাই। তিনি সাবধান করে দিলেন সবাইকে। নইলে দেখতে পেতেন দু-চারটে লাশ রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে।’
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, রোমিও ছিল না সেখানে—’ বললেন মন্টেগু গিন্নি, ‘তুমি জান এখন সে কোথায়?’
বেনভোলিও বললেন, ‘আমার মনটা ভারাক্রান্ত ছিল। খুব সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি বেরিয়েছিলাম পথে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম শহরের পশ্চিম অঞ্চলে। তখন দেখলাম একটা গাছের নিচে পায়চারি করছে রোমিও। আমাকে দেখেই পা চালিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। সেসময় নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে বিব্রত ছিলাম আমি। আতি ওকে আর ডাকিনি। শুনতে পেলাম রোমিওকে নাকি প্রায়ই এই বনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।’