তিন দিন বাদে, পানি, খাবার নিঃশেষ প্রায়, পশ্চিম দিকে তিগ্রাই প্রদেশের নিচু, পাথুরে পাহাড়সারির উদ্দেশে মোড় নিল দলটা। সূর্যাস্তের খানিক আগে, ছোট্ট এক ওয়াটার হোল খুঁজে পেল আবু হাতেম। প্রাণ ভরে পান করে, যতেড়বর সঙ্গে ক্যান্টিন ভরে নিল ওরা। ঝোপ-ঝাড় বিরল প্রায়, সেগুলো গলাধঃকরণের আগে উটেরা তাদের স্বাভাবিক লোভী আচরণ দেখাল।
‘বাজে জায়গা এটা,’ বলল আবু হাতেম। রানার প্রশ্নের জবাবে জানাল, ‘আমার লোকেরা ওখানে বাস করে।’ আঙুল দেখাল বিস্তীর্ণ মরুভূমির দিকে। ‘দু’দিনের মধ্যে এক শহরে পৌঁছব আমরা। তারপর নিরাপদ হব। পানির অভাব নেই এখানে, সেই সঙ্গে বদ লোকেরও।’
উটের দুধ ছাড়া আর কিছু জোটেনি গত ক’দিন। সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ওরা। সেদিন সন্ধেয় প্র ম পাহারা দিল রানা, অন্যরা ঘুমাল। রাত দশটার দিকে উঠে এসে প্রকাণ্ড এক পাথরে, রানার পাশে বসল আবু হাতেম।
‘তুমি ঘুমাতে যাও,’ বলল। ‘ক’ঘণ্টা পরে সোমালীকে ডেকে দেব আমি।’
টলতে টলতে তাঁবুতে গিয়ে ঢুকল রানা। ঘুমন্ত এক উটের পাশে পরম শান্তিতে শুয়ে জুলেখা। তার একটু দূরে বৃদ্ধ বিজ্ঞানী গম্ভীর মুখে বসে আছেন। কাজেই ওঁদেরকে বিরক্ত করল না রানা। ওয়াটার হোলের কাছে এক ফালি ঘাস-জমি খুঁজে নিয়ে শুয়ে পড়ল। দুনিয়াটা মনে হলো ক্ষণিকের জন্যে ঘুরে উঠল, তারপর তলিয়ে গেল রানা ঘুমে।
পা বাঁধা উটগুলোর মাঝে অস্থির নড়াচড়ার শব্দে ঘুমটা ভাঙল ওর, অচেনা এক বদগন্ধ নাকে এল, কিন্তু চিনতে পারল না রানা গন্ধটা কিসের। উটের সঙ্গে দিনের পর দিন বাস করতে হচ্ছে, স্নান করার সুযোগ নেই, ফলে ভোঁতা হয়ে গেছে ওর ঘ্রাণশক্তি। এবার
কাশির ও তারপর ঘোঁত ঘোঁত শব্দ কানে এল।
ডানদিকে মাথা কাত করল রানা। ওর ওপর ঝুঁকে রয়েছে বিশাল এক দেহ। গন্ধটা জোরাল হতে নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা চিনে ফেলল রানা। সিংহের শ্বাসে ভয়ানক দুর্গন্ধ হয়, জানা আছে ওর। কিন্তু এত কাছ থেকে যে কোনদিন তা পাবে ভাবতেও পারেনি রানা।
সাবমেশিনগানটা বাঁ পাশে পড়ে রয়েছে। শরীর মুচড়ে ওটা তুলে নিয়ে, শরীরের আড়াআড়ি এনে তাক করতে পারে পশুরাজের দিকে। কিংবা সাবমেশিনগানটার ওপর দিয়ে এক গড়ান দিয়ে, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারে অস্ত্র হাতে, সেফটি অফ করে একই সময়ে লক্ষ্য স্থির করতে পারে। দু’ভাবেই অবশ্য বাড়তি সুবিধা পাবে সিংহটা। রানা সাবমেশিনগান ঠিকভাবে বাগাতে পারার আগেই, ঝাঁপিয়ে পড়ে ওকে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে ওটা।
‘রানা, জেগে থাকলে মড়ার মত পড়ে থাকো,’ অনুচ্চ স্বরে বলল জুলেখা।
মাথা তুলে কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে চাইল পশুরাজ।
‘ওর পেট গোল দেখতে পাচ্ছি,’ বলল আবু হাতেম।
‘মানে কি?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
‘ও ক্ষুধার্ত না। চিমসে পেটের সিংহ খাবারের জন্যে আক্রমণ করে। এটা এইমাত্র খেয়ে এসেছে।’
রানার অবস্থান ডানাকিলের কথার সত্যতা যাচাইয়ের পক্ষে উপযুক্ত নয়; যদিও এটুকু বোঝা যাচ্ছে, ওর নতুন বন্ধু ঘন কেশরঅলা এক বিশালদেহী পুরুষ। মুখের ভেতর আস্ত এক জেট পে−ন ঢুকিয়ে রাখতে পারবে, চোয়াল এমনি বড় দেখাল রানার চোখে। সিংহ সম্পর্কে যা যা জানে সব মনে করার চেষ্টা করল ও। দেখল, তেমন কিছুই জানে না।
জুলেখা বলেছে নিঃসাড় পড়ে থাকতে। নিস্পন্দ হয়ে রয়েছে সিংহটাও, লেজ নাড়াটা বাদ দিলে। হঠাৎ মাথায় ঝিলিক মারল একটা ভাবনা-সিংহ গলিত শবদেহের মাংস ভালবাসে। শকুন তাড়া খায় এদের কাছে মাংস খেতে এলে। এভাবে মড়া সেজে পড়ে থাকলে, নিজের পছন্দসই জায়গায় জানোয়ারটা ওকে টেনে নিয়ে যায় যদি?
নড়েচড়ে গলা খাঁকারি দিল সিংহটা। দুর্গন্ধে নাড়ী উল্টে আসার জোগাড় রানার। নার্ভ আর ঠিক থাকতে চাইছে না। সাবমেশিনগানটা হাতে পাওয়ার তাগিদ অতিকষ্টে দমন করতে হলো ওকে।
খুব আস্তে আস্তে, শরীর রানার সমান্তরালে ঘুরিয়ে আনল সিংহটা। ওটার পেটটা লক্ষ করল রানা। গোলই বটে। রানার দিকে চাইতে পিঠ ফিরিয়েছে সিংহটা। এবার থপ্ থপ্ শব্দ তুলে চলে গেল ওয়াটার হোলটার উদ্দেশে।
মাথার কাছ দিয়ে জানোয়ারটা চলে যেতে চোখ উল্টে চাইল রানা। তারপর সাবধানে ঘাড় কাত করল। অসম্ভব মন্থর সিংহটার হাঁটার গতি, খাওয়া নাকি পানি পান করা বেশি প্রয়োজন হয়তো
বুঝে উঠতে পারছে না। ওটা ওয়াটার হোলের কাছাকাছি হওয়ামাত্র সাবমেশিনগান তুলে নেবে সিদ্ধান্ত নিল রানা। কিন্তু তা না করে মনের জোর খাটিয়ে আরেকটা মিনিট অপেক্ষা করল ও, পানির ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাম্পের দিকে জানোয়ারটা ঘাড় ফিরিয়ে চাইছে। জুলেখার কিংবা হাতেমের তরফ থেকে কোন নড়াচড়ার শব্দ শুনতে পেল না রানা। আর কুদরত চৌধুরী হয়তো কিছু টেরই পাননি, ঘুমিয়ে কাদা।
বিপদের আশঙ্কা নেই নিশ্চিত হয়ে, মাথা নামিয়ে সশব্দে পানি পান করতে লাগল জানোয়ারটা। প্রকাণ্ড জিভটা ওটার ছলকে তুলছে পানি। বাঁ হাত ছড়িয়ে দিল রানা, যতক্ষণ না ঠাণ্ডা ধাতব স্পর্শ পায় ওর আঙুল, হাতড়ে চলল মাটিতে। ওটা খুঁজে পেয়ে তুলে আনল নিজের কাছে। একাজ করতে, চোখ সরাতে হলো সিংহটার ওপর থেকে, তবে পানি পানের শব্দ এখনও কানে আসছে ওর।
গড়ান দিয়ে সাবমেশিনগানটা তাক করল রানা। একটু উল্টোসিধে করেছে কি ফুঁড়ে দেবে জানোয়ারটাকে। ম্যাগাজিন ভর্তি রয়েছে গুলিতে। শরীরের মোক্ষম কোন না কোন জায়গায় লাগবেই লাগবে। জানোয়ারটা মাথা তুলতে, নিশুতি রাতে কানে বাজল জুলেখার অস্ফুট আর্তনাদ।
‘এখন গুলি কোরো না,’ বলল আবু হাতেম।
রানা জবাব দিল না। জানোয়ারটা ঝামেলা না পাকিয়ে পানি পান করে চলে গেলে গুলি ছুঁড়বে না ও। কিন্তু দলের কারও ওপর কিংবা উটগুলোর ওপর হামলা করলে পশুরাজ বলে খাতির করবে না রানা।
আবু হাতেমের গুলি করতে বারণ করার পেছনে অন্তত দুটো জোরাল যুক্তি রয়েছে। এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিশ্বাস করে না সে, গুলির শব্দে দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে পারে তাদের। দ্বিতীয় যুক্তিটার কারণ সিংহরাজ স্বয়ং। ওটাকে উত্তেজিত করতে চাইছে না আবু হাতেম। অস্ত্রধারী যতই অব্যর্থলক্ষ্য হোক না কেন, মিস সে করতেই পারে।
আলোর অবস্থা বেগতিক। চাঁদটা, পূর্ণ এমুহূর্তে, ডুবতে বসেছে। পরিপার্শ্বের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে জানোয়ারটা। উপুড় হয়ে ভূতলশায়ী রানা সাবমেশিনগান ধরে রেখে, সিংহটাকে ধৈর্যের খেলায় হারিয়ে দিতে চাইছে।
আরও খানিকটা পানি খেল সিংহটা। সন্তুষ্টচিত্তে এবার মাথাটা শূন্যে তুলে, জলদগম্ভীর ডাক ছাড়ল। বিড়বিড় গুঞ্জন তুলল উটগুলো। জানোয়ারটা শ্লথ গতিতে বাঁয়ে মোড় নিল, ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। একটু পরেই রানার দৃষ্টিসীমার
আড়ালে চলে গেল।
‘চলে গেছে,’ দু’মিনিট বাদে বলল আবু হাতেম।
সিধে হয়ে দাঁড়াল রানা। ‘ওটা এখানে এল কিভাবে?’
ক্যাম্প ও আলী দাঈর অবস্থান নেয়া পাথরের মাঝখানে এক ফালি জায়গা। ওর সঙ্গে সেখানে দেখা হলো রানার।
‘আমি যে পাশটায় পাহারা দিইনি সেদিক থেকে এসেছে,’ বলল দাঈ।
‘ঘুমাচ্ছিলে নাকি?’
‘না। দেখতে পাইনি।’
‘যাও, নিচে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নাওগে,’ পরামর্শ দিল রানা। জুতিয়ে লোকটাকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠাতে মন চাইছে ওর। অমনোযোগের কারণে দেখতে পায়নি, নাকি দেখেও ইচ্ছে করে ছেড়ে দিয়েছে সিংহটাকে কে জানে।
আবু হাতেমের কাছ থেকে ওকে আলাদা করার পর লোকটার চোখের ভাষা, চেহারার অভিব্যক্তি পরিষ্কার মনে আছে রানার।
পরদিন দুপুরের একটু পরে, সাময়িক বিশ্রামের জন্যে আরেকটা ওয়াটার হোলের পাশে থামল দলটা। প্রচুর পরিমাণে স্বচ্ছ তাজা পানি দেখে বুকটা ভরে গেল রানার। অবশ্য খিদেও পেয়েছে জবর। আহা, আলী দাঈর উটটার একটা ঠ্যাং কেটে রোস্ট করে দিলে, কত মজা করেই না আস্তটা সাবড়াতে পারত! মরু যাত্রার ধকলের ফলে, প্রায় পনেরো পাউন্ড ওজন হারাতে হয়েছে ওকে, যতটা সম্ভব কষে কোমরে বেঁধেছে বেল্টটা; তারপরও অবশ্য যথেষ্ট শক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। শহরে পৌঁছতে আর একটা দিন লাগবে, অনায়াসে পার করতে পারবে সেটা।
‘ওই শহরে থানা-টানা আছে?’ জুলেখাকে প্রশ্ন করল রানা।
‘থাকবে। আমাকে কথা বলতে দিয়ো। নামগুলো সব জানা আছে আমার, রানা।’
‘গুড। যত জলদি পারি আদ্দিস আবাবা আর নয়তো আসমারায় পৌঁছতে হবে আমাকে।’
ওয়াটার হোল ত্যাগ করে, রওনা হয়ে এক ঢিবির ওপর উঠেছে, আচমকা তিন ডানাকিলের একটি দলের মুখোমুখি পড়ে গেল ওরা। চমকে গেলেও, রানাদের চাইতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া হলো ওদের। গুলি চালাতে লাগল ওরা। আর্তনাদ ছেড়ে উঠের পিঠ থেকে উড়ে গেল আলী দাঈ। পরক্ষণে আর্তচিৎকার ছাড়লেন কুদরত চৌধুরী।
সক্রিয় হলো এবার রানার সাবমেশিনগান। আবু হাতেম আর জুলেখাও ফায়ার ওপেন করল। ভূতলশায়ী হলো তিন শত্রু এক মিনিটের মধ্যে। জুলেখার দিকে চাইল রানা। মুচকি হাসল যুবতী। আবু হাতেম এবার স্যাডল থেকে স্লো মোশন ছবির মত গড়িয়ে
পড়ল মাটিতে।
উট থেকে লাফিয়ে নেমে বিজ্ঞানীর কাছে ছুটে গেল রানা। বৃদ্ধের বুকের কাছটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মারাত্মক আহত হয়েছেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। কেউ একজন মুখের ওপর ঝুঁকে পড়েছে টের পেয়ে অতিকষ্টে চোখ মেললেন তিনি। ফিসফিস করে বললেন, ‘কে, রানা? রানা…ড্রাগস…সবার ভেতর…ঝাঁঝরা করে দিয়েছে লোকটা আমাকে। ডানাকিলদেরও মারবে এভাবে। নিও ফ্যাসিস্ট…রানা…’ শেষদিকে নিস্তেজ হয়ে এলো তাঁর স্বর। ‘ওদের ঠেকিয়ো, রানা, ম্যাকলিন আর রবার্তো মালদিনি; ওরা উন্মাদ। রাজ্য গড়তে চায়…নিও ফ্যাসিস্ট…’
পালস দেখল রানা। নেই। মারা গেছেন বৃদ্ধ বিজ্ঞানী। এবার ছুটল আবু হাতেমের কাছে। কাঁধে গুলি খেয়েছে লোকটা, ভয়ের কিছু নেই। ফুটোটা পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল রানা। ওদিকে, আলী দাঈয়ের পতিত দেহের ওপর ঝুঁকে পড়েছে জুলেখা।
‘মারা গেছে,’ একটু পরে রানার পাশে এসে বলল যুবতী।
‘কুদরত চৌধুরীর কি খবর?’
‘ওই একই,’ জানাল রানা, তখনও ব্যস্ত আবু হাতেমের জখম নিয়ে। বলার মত কথা খুঁজে না পেয়ে বলল, ‘উটের দুধ খাইয়ে আমাদের জান বাঁচিয়েছিল দাঈ।’
‘হ্যাঁ,’ সায় দিল জুলেখা। বলল,‘আলী দাঈ তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছে। আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিল আমাদের-তোমাকে বিশেষ করে-সিংহের কথা চেপে গিয়ে।’
‘ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। দুর্জয় সাহসী ছিল, কিন্তু এধরনের জার্নির জন্যে যথেষ্ট এনার্জি ওর ছিল না। আর বিজ্ঞানীর তো নয়ই।’
‘ঘুমাচ্ছিল না ছাই,’ মৃদু শব্দে হেসে উঠল জুলেখা। ‘রানা, আলী দাঈদের কখনও বিশ্বাস কোরো না। ডানাকিলের সাথে লড়তে দাওনি বলে তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল ও।’
‘হতে পারে,’ বলল রানা। ‘এখন আর কি যায়-আসে?’
‘তা ঠিক।’
প্রসঙ্গ পরিবর্তন করল রানা। ‘আচ্ছা, তুমি ড্রাগ অ্যাডিক্ট নও তো?’
‘না, আমাকে বিয়ে করবে বলে সুস্থ রেখেছে বুড়ো শয়তানটা।’
‘আর ম্যাকলিন?’
‘সে অ্যাডিক্ট। মালদিনির চাকর। নিও ফ্যাসিস্ট। মালদিনিকে গুরু মানে। যা বলে তাই করে।’
চোখের পাতা পিটপিট করছে আবু হাতেমের জ্ঞান ফিরে আসতে। লোকটা গুঙিয়ে উঠবে ভাবল রানা, কিন্তু তা না করে একদৃষ্টে চেয়ে রইল ওর দিকে।
‘কতটা আহত আমি?’
‘কাঁধে গুলি খেয়েছ। ভেতরে তেমন ক্ষতি হয়নি, তবে বুলেটটা রয়ে গেছে।’
‘এখান থেকে আমাদের সরে পড়তে হবে,’ বলেই উঠে বসল লোকটা।
‘আগে একটা স্লিং বানাতে দাও,’ বলল রানা।
বাড়তি উটগুলোর পাশে তিন শত্রু ও আলীর দাঈয়ের লাশ ফেলে রেখে রওনা হলো ওরা। তার আগে রানা নিজ হাতে কবর দিল কুদরত চৌধুরীকে। বুকটা টনটন করছে ওর। অল্প ক’দিনের পরিচয়েই ভালবসে ফেলেছিল ও সরল বৃদ্ধকে। রানা আশা করছে, একদল বুভুক্ষু সিংহ এসে শীঘ্রিই লাশগুলোর সদ্ব্যবহার করবে, এদের উপস্থিতি কারও কৌতূহল জাগানোর আগেই। সন্ধে উতরালে থামতে হলো ওদের। আবু হাতেম, প্রচণ্ড যন্ত্রণা সত্ত্বেও সজাগ, এক অ্যারোয়োতে তাঁবু ফেলতে বলল।
‘খুব সম্ভব আর দু’ঘণ্টা পরেই শহর পাব,’ বলল ও। ‘কাল যাব ওখানে। রাতে আগুন জ্বালছি না আমরা।’
‘নিশ্চিন্তে ঘুমাও তুমি,’ বলল রানা।
‘পাহারা দিয়ো কিন্তু।’
‘দেব। তোমার ভাবতে হবে না।’
গুল্মে ছাওয়া এক ঝাড় ঝোপের সঙ্গে উটগুলোর পা বেঁধে রাখল রানা। খাবারের অসুবিধে হবে না ওদের। এরা সবই খায়, পাথরও চিবিয়ে হজম করে ফেলে কিনা কে জানে। বেচারা ছাগলদের না দুষে বরং বলা উচিত: উটে কিনা খায়। আত্মপ্রসাদ বোধ করছে রানা মনে মনে-আজব এই জানোয়ার সামলাতে রীতিমত দক্ষ হয়ে উঠেছে ও এ-কয়দিনে। মেজর জেনারেলকে বলতে হবে ওর নয়া প্রতিভার কথাটা ডোসিয়েতে যোগ করতে। নিচু এক পাহাড়ের ওপর মনপছন্দ এক জায়গা বেছে নিল রানা। এখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দেবে। জুলেখাকে পাঠিয়েছে ঘুমিয়ে নিতে। মেয়েটি অবশ্য প্র মে যেতে চায়নি, পরে রানা ওকে ডেকে দেবে কথা দেয়ায় রাজি হয়েছে।
সজাগ-সতর্ক থাকতে হবে, নিজেকে শোনাল রানা। দৈবাৎ ঘুমিয়ে পড়লে আর হয়তো সভ্য জগতে ফেরা হবে না কারও।
Leave a Reply