• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

কান্তার মরু – ০২

লাইব্রেরি » সেবা প্রকাশনী » মাসুদ রানা সিরিজ » কান্তার মরু » কান্তার মরু – ০২

যে কোন জাহাজ সাগরে ভাসানো এক ঝকমারি, কিন্তু শেপ মাইয়ার-এর ক্রুরা যেন পণ করেছে হুল্লোড় করে যাত্রীদের জ্বালিয়ে মারবে। হাতঘড়িতে নজর বুলাল রানা। সাতটা। সিদ্ধান্ত নিতে হয় এখন। স্টিলেটো সঙ্গে নেবে? আলী আকবরের কাছে ছুরি থাকলে মানাবে? মনস্থির করতে পারল না। সুটকেসের গোপন কম্পার্টমেন্টে শেষতক লুগার ও খুদে গ্যাস বোমাটাকে সঙ্গ দিতে রয়ে গেল ওটা। আজ সকালে ঘুমকাতুরে এক স্টুয়ার্ড নয়, অনেক মানুষের কৌতূহলী চোখের সামনে পড়তে হবে ওকে।
রানা সামনে গিয়ে, হেড ব্যবহার করে, শাওয়ার নিল। তারপর কেবিনে ফিরে এসে কাপড় বাছাই করল। শেপ মাইয়ারে ফর্মালিটির কোন প্রয়োজন নেই। ফ্লানেল শার্ট, ওঅর্ক প্যান্ট আর ওয়াটারপ্রূফ জ্যাকেট গায়ে চড়াল রানা। এবার ব্রেকফাস্টের পালা।
ছিমছাম এক ওয়ার্ডরূম। দশ জনের মত বসার আয়োজন, তারমানে জাহাজে যাত্রী বেশি নেই। স্টুয়ার্ড ববি মুর রানাকে জুস, স্ক্র্যাম্বল্‌ড্‌ এগ, বীফ ও কফি পরিবেশন করল। ওর খাওয়া প্রায় সারা এসময় বয়স্ক দম্পতিটি ঘরে প্রবেশ করলেন।
ইংরেজ এঁরা-জ্যাক ও ডেবি চার্লটন। ভদ্রলোকের একহারা গড়ন ও ফ্যাকাসে গায়ের রং দেখে কেরানী মনে হয়, এবং ছিলেনও নাকি তাই, লটারিতে বাজি মেরে দিয়ে এবং তারপর বুদ্ধি করে টাকাটা খাটিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। ভদ্রমহিলার মোটাসোটা গিনড়বী-বানিড়ব চেহারা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই পঞ্চাশের কোঠায়, হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়াতে ভ্রমণ পিপাসু হয়ে উঠেছেন। এবং দু’জনেই বাক্যবাগীশ।
‘আপনি নরফোকের লোক, মিস্টার আকবর?’ জ্যাক প্রশ্ন করলেন।
‘না,’ বলল রানা। ‘বাংলাদেশী। ওপি ওয়ানে আমেরিকা এসেছি।’
‘ও, তাই নাকি,’ সুর তুললেন মিসেস চার্লটন। ‘আপনাদের বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ট্যুরিজমে মোটেও মনোযোগী নয়। দু’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়েছিলাম আমরা। কক্সবাজার, সুন্দরবন এসব জায়গা খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার প্রশংসা করতে পারছি না, দুঃখিত, আর…’
ভদ্রমহিলার বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হওয়ার জন্যে রানাও খানিকটা দায়ী। আলী আকবর হিসেবে ওকে শুনে যেতে হবে, কিন্তু মাঝেমধ্যে হুঁ, হাঁ করা ছাড়া কথোপকথনে ওর আর কোন অংশগ্রহণ থাকবে না। আলী আকবর প্যাচাল শুনবে তার কারণ বড়লোক সহযাত্রীদের কাছ থেকে ড্রিঙ্ক খসানোর তালে থাকবে সে। এবং সম্ভব হলে ডলারও।
অবশেষে, অবশ্যম্ভাবী সেই প্রশ্নটা করলেন মিসেস। ‘এই জাহাজে কেন উঠেছেন, মিস্টার আকবর?’
‘ইথিওপিয়া যাচ্ছি।’
‘কেন জানতে পারি?’
‘কাজে। আমি একজন এঞ্জিনিয়ার। রাস্তা-ঘাট, ড্রেনেজ সিস্টেম এসব তৈরি করি।’
‘বাহ, খুব ইন্টারেস্টিং কাজ মনে হচ্ছে?’
‘ডাল-ভাত জুটে যায় আরকি।’
রোডবিল্ডিং সম্বন্ধে বিশেষ জানার কথা নয় কেরানীর কিংবা গৃহবধূর, কাজেই চার্লটনদেরকে নিজ পরিচয় যা দিচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা নেই রানার। ও প্লেনে করে আদ্দিস আবাবা যেতে চেয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ আমেরিকার বোমা চুরির খবর পেয়ে মত পাল্টেছেন জেনারেল। এই জাহাজে উঠতে বলেছেন রানাকে। তাছাড়া রানার কভারের সঙ্গে নাকি চমৎকার খাপ খেয়ে যায় এই সুলভ ভ্রমণ। মিসেস চার্লটনের জেরা ও একতরফা বকবকানি মার খেয়ে গেল ওয়ার্ডরূমে ফ্রেইটারের আরেক যাত্রী প্রবেশ করতে। দরজা দিয়ে যুবতীটি ঢুকতেই রানার মনের ক্যাবিনেটে ফাইল কার্ড ওল্টানো শুরু হয়ে গেল। লম্বা, কুচকুচে কালো চুল, অপূর্ব সুন্দর দেহবল্লরী, আকর্ষণীয় মুখশ্রী — কোথায় দেখেছে একে রানা?
‘আমি জেন এসেক্স,’ বলল মেয়েটি। পরিচয় দিতেই রানা
চিনে ফেলল ওকে। সিআইয়ের এজেন্ট। এ-ই সম্ভবত ব্রিফ করবে ওকে।
চার্লটন দম্পতি নিজেদের পরিচয় দিলেন। রানার সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিলেন। মেয়েটির হাত ঝাঁকিয়ে দিল ও।
মুখের অর্গল খুলে দিলেন আবারও মিসেস চার্লটন। বিনীতভাবে শুনে গেল জেন, কিন্তু রানা নিশ্চিত ওর মত সে-ও এর কিছুই মনে রাখবে না। এবার ভদ্রমহিলার তদন্তের পালা।
‘কি কর তুমি?’ প্র ম প্রশ্ন মিসেস চার্লটনের।
‘আমি ফ্রীল্যান্স জার্নালিস্ট।’
‘বাহ, উইমেন্স লিবে বিশ্বাস কর বুঝি?’ মিস্টার চার্লটন।
‘করি। তবে সাংবাদিকতা করি নিছক অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে।’ রানার দিকে চাইল যুবতী।
‘আপনাকে চেনা চেনা লাগছে, মিস এসেক্স,’ বলল রানা। ‘আমি যদিও পত্রিকা-টত্রিকা পড়ি না তেমন একটা।’
‘পুরুষদের ম্যাগাজিন তো পড়েন, তাই না, মিস্টার আকবর?’ বলল মেয়েটি।
‘তা পড়ি।’
‘তাহলে ওখানেই দেখেছেন। এডিটরদের ধারণা, একা একা কোন্‌ মেয়ে কোথায় কি অ্যাডভেঞ্চার করল খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে পুরুষরা। পিক্স সহ বেশ কয়েকটা স্টোরি ছাপা হয়েছে আমার। তাই মনে হয় চেনা চেনা লাগছে।’
‘তাই হবে,’ বলল রানা।
‘পিক্স?’ মিসেস চার্লটন শুধালেন। ‘পিকচার, মানে ছবি?’
‘শিয়োর। এই যেমন ধরুন-প্রতিনিধি রিওতোলন করছে। ব্যাঙ্ককের পাতায়া বীচে নগড়ব হয়ে গায়ে রোদ মাখছে। এইসব আর কি।’
মেয়েটির সম্পূর্ণ ডোশিয়ে মুখস্থ রানার। সিআইএ কখনোই নিশ্চিত হতে পারেনি জেন এসেক্স এজেন্ট হিসেবে কোন্ মানের-ভাল না মন্দ। ওকে সামনাসামনি দেখে বিভ্রান্তির কারণটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে রানা। চার্লটন দম্পতি, বলাবাহুল্য, মনে রাখবেন ওকে, চোখ-মুখ লাল করে এইমাত্র ওয়ার্ডরূম ত্যাগ করলেন তাঁরা। কিন্তু মেয়েটি এ-ও নিশ্চিত করল ওকে আর বিরক্ত করবেন না স্বামী-স্ত্রী। চালটা চেলে চালাকির পরিচয় দিয়ে থাকতে পারে জেন, কিংবা বোকামিরও। রানা বুঝতে পারল না কোন্‌টা।
‘আপনাকে নিয়ে হয়তো একটা স্টোরি করা যায়, মিস্টার আকবর,’ বলল জেন। ‘আপনি এই ফ্রেইটারে কেন?’
সেই রাস্তা-ঘাট বানানর গপ্পো ফাঁদতে হলো রানাকে।
‘গেলেই কাজে জয়েন করতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ। মাসাওয়ার জেটিতে লোক থাকবে আমার জন্যে।’
‘বাজে দেশ, ইথিওপিয়া-দেখবেন চাকরি না খেয়ে দেয়।’
‘সাবধান থাকব আমি।’
আর যাদের চোখেই দিক না কেন, পরস্পরের চোখে ধুলো দিতে পারেনি ওরা। কিন্তু সবার সামনে মুখ খুলতে আপাতত রাজি নয় কেউ। কাজেই ওয়ার্ডরূম থেকে বিদায় নিয়ে জাহাজের ছোট্ট লাইব্রেরীটায় গেল রানা। গোটা দুই পেপারব্যাক বাছাই করে ফিরে এল কেবিনে।

জ্যাক চার্লটনের সঙ্গে প্র ম দু সন্ধে দাবা খেলে কাটানর চেষ্টা করল রানা। একটা করে নৌকা আর গজ দান করে প্রায় পঁয়ত্রিশ চাল পর্যন্ত খেলাটাকে টেনে নিয়ে গেল, তারপর নির্বোধের মত মাত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। সুতরাং দাবা ছেড়ে এরপর ব্রিজ ধরতে হলো। চরিত্র বিশে−ষণে আসলে সময়টা কাজে লাগাল রানা। চার্লটন দম্পতি নিপাট ভালমানুষ উপলব্ধি করছে ও, দুনিয়া ঘুরে বেড়াবে তারপর গল্পের ঝাঁপি নিয়ে বসে, প্রতিবেশীদের তাক লাগিয়ে দেবে। ওদিকে ধাঁধা হয়েই রইল জেন। তাস খেলায় রানার জুটি হয় সে, কখনও আমীর রানার আবার কখনও ফকির রানার।
যাত্রার তৃতীয় দিন সকালে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উত্তাপের আঁচ পাওয়া গেল। ওয়ার্ডরূমের চার্ট জানাচ্ছে, উইন্ডওয়ার্ড চ্যানেলে রয়েছে ওরা। স্পীড রেকর্ড সেট করেনি শেপ মাইয়ার। এ মুহূর্তে, কিউবার ঘন নীল পানির বুক চিরে, ঈষৎ টলমল করতে করতে এগিয়ে চলেছে জাহাজ। সেদিন সন্ধের দিকে জর্জটাউন পৌঁছানর কথা ওদের। সাতটার আগে বাঙ্ক ছেড়ে নাস্তা সারতে ওয়ার্ডরূমে গেল রানা। রাতে ঘুম ভাল হয়নি ওর। জাহাজের এয়ারকন্ডিশনিং ব্যবস্থা মোটেও জুতসই নয়।
চার্লটনদের কিংবা জেনের দেখা নেই। একটা ডেক চেয়ার টেনে নিয়ে, যাত্রীদের জন্যে নির্দিষ্ট ডেকের ছোট্ট অংশটায় বসল রানা। হঠাৎ খর্‌-খর্‌ শব্দ শুনে চোখ তুলতে জেনকে দেখতে পেল। আরেকটা ডেক চেয়ার টেনে আনছে ইস্পাতের ডেক পে−টের ওপর দিয়ে।
‘আমাদের ইংরেজ বন্ধুরা মনে হয় সকালের রোদ পছন্দ করে না,’ বলল যুবতী। জবাবে মুচকি হাসল কেবল রানা। কাটঅফ জিনস ও ব্যাকলেস হল্টার পরনে জেনের, উন্মুক্ত গায়ের চামড়া রোদে পোড়া তামাটে। ডেক চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসল ও, স্যান্ডেল লাথি মেরে খসিয়ে সিগারেট ধরাল।
‘মাসুদ রানা, এখন অভিনয় ছেড়ে বোধহয় কথাবার্তা বলা যায়।’
‘তথাস্তু। এরজন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।’
‘বিসিআই তোমাকে অনেক কিছুই জানায়নি।’
‘অনেক কিছু বলতে?’
‘রবার্তো মালদিনি সম্পর্কে ইনফর্মেশন। দায়িত্বটা সিআইএ আমার ওপর চাপিয়েছে। লেটেস্ট খবর হচ্ছে জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের এজেন্ট মারা পড়ার আগে একটা রিপোর্ট ফাইল করে গেছিল। আমরা সেটা ইন্টারসেপ্ট করি। আমাকে বলা হয়েছে জিওনিস্টদের নতুন একজনের সাথে লিয়াজোঁ করে চলতে। কিন্তু
ইথিওপিয়া পৌঁছানর আগে পরস্পরকে চিনব না আমরা।’ সিগারেটটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিল জেন। ‘কিন্তু আমি বাজিয়ে দেখে বুঝে ফেলেছি, সেই এজেন্ট হচ্ছে এই জাহাজের স্টুয়ার্ড।’
‘আগে মালদিনির কথা বলো,’ বলল রানা।
‘ধীরে, আকবর, ধীরে-ইংরেজ বন্ধুদের সম্বন্ধে দেখছি ভুল ধারণা করেছিলাম।’
চার্লটন দম্পতি ডেক চেয়ার হিঁচড়ে আনছেন। রানার সঙ্গে বই রয়েছে, কিন্তু পড়ার ভান করল না। মেরা আউটফিট রাখার খুদে বীচ ব্যাগটার ভেতর হাত ভরে দিল জেন। ৩৫ এমএম-এ টেলিফটো লেন্স পেঁচিয়ে ফেলল ত্রস্ত হাতে, উড়ুক্কু মাছের রঙিন ছবি নেয়ার চেষ্টা করবে বলে ঘোষণা দিল। ক্যামেরা স্থির রাখতে
রেইলের ওপর ঝুঁকে পড়ল সে।
রানার মাথায় তখন পাক খাচ্ছে নানান চিন্তা। ববি মুর, শেপ মাইয়ারের স্টুয়ার্ড, জিওনিস্টের এজেন্ট! বিসিআই তথ্যটা ওকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, নাকি চেয়েছে রানা জেনের কাছ থেকে জানুক? রাহাত খানের ভ্রূ দেখতে পেল রানা মনের চোখে। ইচ্ছে করেই ওকে ব্লাইণ্ড মিশনে পাঠানো হয়েছে? বুকের মাঝে অভিমান উথলে উঠল ওর। পরমুহূর্তে নিজেকে ছিছি করল। জেনে-বুঝে কখনোই ওকে এরকম ফাঁকি দেবেন না বস। বিসিআই তথ্যটা তাঁকে জানাতে ব্যর্থ হয়েছে, এছাড়া ব্যাপারটার আর কোন ব্যাখ্যা নেই। যাই হোক এই মিশনে রানার পাশাপাশি কাজ করতে পাঠানো হয়েছে সিআইএ এজেন্ট জেন এসেক্সকে। এবং মালদিনি সম্পর্কে আরও জানতে হলে রানাকে নির্ভর করতে হবে মেয়েটির ওপর। তেমনভাবেই সাজানো হয়েছে সেটআপটা। সাজিয়েছে সিআইএ। অগত্যা স্বামী-স্ত্রীর ভ্যাজর ভ্যাজর হজম করে সকালটা
পার করতে হলো ওকে।
সন্ধে নাগাদ জর্জটাউন পৌঁছল ওরা। কিন্তু রানা মনস্থির করল তীরে নামবে না। আলী আকবরের পকেটে টান পড়েছে এবং ভ্রমণের ক্লান্তিতে বড্ড বিরক্ত বোধ করছে সে। জিওনিস্ট ইন্টেলিজেন্সের কাছে মাসুদ রানার নামে একটা ফাইল আছে। কি আছে ওতে জানে না রানা, কিন্তু ববি মুর সম্ভবত শনাক্ত করতে
পেরেছে ওকে। স্থানীয় ইসরাইলী এজেন্টকে একটা খবর দিলে খুন করে গুম করে ফেলবে রানাকে। আলী আকবর নামে জনৈক আমেরিকান অভিবাসী যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়, কেউ আটকে রাখবে না শেপ মাইয়ারকে।

‘সাইটসিয়িঙের জন্যে যাবেন না?’ মিসেস চার্লটন প্রশ্ন করলেন।
‘না, মিসেস চার্লটন,’ বলল রানা। ‘সত্যি বলতে কি, ভ্রমণ তেমন একটা ভালবাসি না আমি। তাছাড়া সঙ্গে টাকা-পয়সাও বিশেষ নেই। ইথিওপিয়া যাচ্ছি যদি একটা হিলে− হয়। প্রমোদভ্রমণে আসলে বেরোইনি আমি। টাকা-পয়সা থাকলে…’
ত্বরিত নিষঙঊান্ত হলেন ভদ্রমহিলা, স্বামীকে পেছনে হিড়হিড় করে টানতে টানতে। এই লোককে খাওয়ার ও ব্রিজ খেলার সময় তিতিবিরক্ত করে মারা যায়, কিন্তু তাই বলে উপকূলে নামতে রাজি করাতে একটির বেশি দুটি শব্দ খরচ করতে বয়েই গেছে তাঁর। হায়রে, সবই আলী আকবরের কভারের দোষ, তেতো মনে ভাবল রানা। শালার অভাবী মানুষকে সবাই ডরায়।
জেন তীরে গেছে। কভার বজায় রাখতে হলে যেতেই হবে, রানাকে যেমন বসে থাকতে হবে জাহাজে। মালদিনির ব্যাপারে একান্তে কথা বলার সুযোগ এখনও পায়নি ওরা, কখন পাবে তাই বা কে জানে। ক্যাপ্টেন আর সেকেন্ড মেট বাদে জাহাজের বাদবাকি অফিসাররাও ডিনারের সময় তীরে নেমে গেছে।
অফিসার দু’জনের সঙ্গে সাত-পাঁচ গল্প করে সময় পার করল রানা; যদিও জমাতে পারল না।
ডিনার-পরবর্তী কনিয়্যাক পান শেষে, তীরে যাওয়ার জন্যে ক্যাপ্টেনের অনুমতি চাইল ববি মুর।
‘জাহাজে প্যাসেঞ্জার রেখে তুমি…’
‘কোন অসুবিধা নেই আমার,’ বলে উঠল রানা। ‘ব্রেকফাস্টের আগে আমার আর কিছু লাগবে না।’
‘আপনি যাচ্ছেন না, মিস্টার আকবর?’ জানতে চাইল ববি মুর।
‘না,’ বলল রানা, ‘আসল কথা, ট্যাঁক খালি।’
‘জর্জটাউন কিন্তু ভারী সুন্দর জায়গা, পরে পস্তাবেন,’ বলল ও।
ব্যাটার সাফাই শুনলে খুশির সীমা থাকবে না জর্জটাউন ট্যুরিজমের, কিন্তু রানা আগ্রহ দেখাল না। রানাকে উপকূলে চাইছে ববি মুর, কিন্তু এ ব্যাপারে চাপাচাপি করতে ভয়ও পাচ্ছে। যদি সন্দেহ করে বসে রানা। সে রাতে লুগার আর স্টিলেটোটা হাতের কাছে রাখল রানা।
পরদিনও চোখের আড়ালে থাকল ও। সাবধানতাটুকু সম্ভবত বৃথা গেল। ববি মুর তীরে নেমেছিল তেল আবিবকে জানাতে, রানা মাসাওয়া যাচ্ছে। আর সেজন্যে যদি নেমে না থাকে তাহলে চিনতে পারেনি ওকে। চিনতে পারলেও রানার করার কিছু নেই।
‘জর্জটাউনে আকর্ষণীয় কোন স্টোরি পেলে?’ সে রাতে ডিনারে বসে জেনকে জিজ্ঞেস করল রানা।
‘নাহ্‌, কিচ্ছু লাভ হয়নি নেমে।’
ডিনারের পর কেবিনের দরজায় মৃদু একটা আওয়াজ হবে আশা করছে রানা। দশটা বেজে সাত। চার্লটনরা আজ অন্যান্য দিনের চাইতে আগেভাগে কেবিনে আশ্রয় নিয়েছে, স্পষ্টতই ক্লান্ত। গত রাতের সাইটসিয়িঙের ধকল। জেনকে ঢুকতে দিল রানা। সাদা স্ল্যাক্স ও বডিশার্ট পরনে ওর।
‘ববি মুর তোমাকে চিনে ফেলেছে মনে হচ্ছে,’ বলল ও। রানাকে মাথা নাড়তে দেখে বলল, ‘মেইন ডেকের সুপারস্ট্রাকচারের কাছে দেখা করতে বলেছে আমাকে। রাত একটায়।’
‘তুমি চাইছ তোমাকে কাভার করি আমি?’
‘সেজন্যেই সাদা কাপড় পরেছি। আমাদের রেকর্ডে বলে, ছুরিতে তোমার নাকি হাত চালু, আকবর।’
‘অপেক্ষা করব আমি, আমাকে খোঁজার দরকার নেই,’ বলল রানা।
সায় দিল জেন।
নিঃশব্দে দরজা খুলে নগড়ব পায়ে প্যাসেজওয়েতে মিশে গেল মেয়েটা। স্টিলেটো তুলে নিল রানা। ঘরের বাতি নিভিয়ে মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর সন্তর্পণে প্যাসেজওয়েতে ঢুকে পথ করে দরজাটার কাছে চলে এল, মেইনডেকের পোর্টসাইডের দিকে খোলে এটা। আশপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বেশিরভাগ কার্গো শিপের মত শেপ মাইয়ারেরও বিশৃক্মখল অবস্থা। সুপারস্ট্রাকচার লাগোয়া ডেকে তেরপলের ছড়াছড়ি। রানা সাবধানে গোটা দুই জড়ো করে কার্গো বুমের বেস ঘিরে স্তূপ করে
রাখল। এবার বসে পড়ল ওগুলোর আড়ালে। ববি মুর এগুলোকে কুশন না বানালেই বাঁচি, বলল মনে মনে।
ওয়াচ-অ্যাফট বসানোর ধার ধারেনি শেপ মাইয়ার। ক্রুদের কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে ব্রিজে এসে মিশেছে ইনবোর্ড প্যাসেজওয়ে, রেডিও শ্যাক, এঞ্জিন রূম আর গ্যালী। রানার ধারণা হলো ব্রিজের লুকআউট ঘুমাচ্ছে, এবং অটোমেটিক পাইলটে চলছে জাহাজ। তবুও, আড়াল ছাড়ল না ও।
ঠিক একটায় দেখা দিল ববি। মেস জ্যাকেট পরে রয়েছে এখনও, আবছা সাদাটে দেখাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। বাঁ আস্তিন হাতড়াতে দেখল ওকে রানা, সম্ভবত ছুরি লুকানো আছে। এবার উদয় হলো জেন। রানার ডান হাতে উঠে এল স্টিলেটো।
কথোপকথনের টুকরো-টাকরা কেবল বাতাসে ভেসে আসছে ওর কানে।
‘তুমি আমাদের ডাবলμস করেছ,’ বলল লোকটা।
জেনের জবাবটা উড়ে গেল বাতাসে।
‘ও জাহাজে ওঠার সময়ই চিনতে পেরেছি,’ বলছে ববি। ‘তেল আবিব থোড়াই পরোয়া করে মাসুদ রানা মাসাওয়া পৌঁছল কি না।’
‘আমি করি।’
উত্তর শোনা গেল না লোকটার।
উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে বোঝা যায়, এবং সেই সঙ্গে মৃদুতর হচ্ছে ওদের কণ্ঠস্বর। রানার দিকে পিঠ দিয়ে জেনকে মেটাল সুপার স্ট্রাকচারটার উদ্দেশে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ববি, ব্রিজের যে কারও চোখের আড়ালে। আলগোছে তেরপল তুলে বেরিয়ে এল রানা, প্রায় হামাগুড়ির ভঙ্গিতে। হাতে স্টিলেটো তৈরি ওর, গুড়ি মেরে এগোল ওদের উদ্দেশে।
‘তোমার সাথে কাজ করব না আমি,’ বলল ববি।
‘মানে? কি বলতে চাইছ তুমি?’
‘তুমি ডাবলক্রস করেছ আমাকে — আর নয়তো তোমার প্রভুরা। আগে তোমাকে খতম করব, তারপর রানাকে। সাগরে কেমন সাঁতরাতে পারে শালা মুসলমানের বাচ্চা দেখা যাক।’
আস্তিনের কাছে হাত চলে গেল ওর। পা টিপে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ছুরি-ধরা বাঁ হাতে ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল রানা, রুদ্ধ করে দিল চেঁচানর সুযোগ। তারপর এক ঝটকায় ঘুরিয়ে দিয়ে পরপর দুটো বিরাশি সিক্কার ঘুসি ঝাড়ল লোকটার নাক বরাবর। মাথা ঘুরে টলে উঠতে, মেস জ্যাকেট থাবা মেরে ধরে রেইলের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিল শরীরটা। জোর বাতাসে চাপা পড়ে গেল লোকটার আর্তচিৎকার। ‘ঝপাৎ’ শব্দটা নিশ্চিন্ত করল রানাকে। মাত্র ক’মুহূর্তের মধ্যে ঘটে গেল পুরোটা।
ব্রিজ থেকে কোন শোরগোল উঠল না। পায়ের নিচে জাহাজের আফ্রিকাগামী এঞ্জিন ধড়ফড় করছে। স্টিলেটো খাপে ঢুকিয়ে জেনের কাছে এল ও। সুপারস্ট্রাকচারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সে।
‘থ্যাঙ্কস, রানা…ইয়ে, আকবর।’
‘পুরোটা শুনতে পাইনি,’ জানাল রানা। ‘ও কি তেল আবীবে রিপোর্ট করেছিল আমার সম্পর্কে?’
‘কিছু বলেনি আমাকে।’
‘শুনলাম মাসাওয়া গেলাম কি গেলাম না তাতে নাকি তেল আবিবের কিছু আসে যায় না।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু খুব সম্ভব ও কোন রিপোর্ট তৈরি করেনি।’
একটুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল, ‘রানা…আকবর, ওকে কি মেরে ফেলেছ?’
মৃদু হাসল রানা, মাথা নাড়ল। ‘জানি না। কপাল ভাল থাকলে বেঁচেও যেতে পারে।’
‘জবর দেখিয়েছ কিন্তু,’ বলল জেন। একটু আগে যে মরতে বসেছিল তার কোন ছাপ দেখা গেল না মেয়েটির আচরণে। যেন এমনি ঘটনা ওর জীবনে হরহামেশাই ঘটছে। ‘তোমার কেবিনে চলো, কথা আছে,’ শেষমেষ রানাকে বলল ও।

« পূর্ববর্তী:
« কান্তার মরু – ০১
পরবর্তী: »
কান্তার মরু – ০৩ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top