এ কোথায়

এ কোথায় পড়ে আছি ভাবলেশহীন? কারা আমাকে
নিয়ে এসেছে এখানে? গুচ্ছের ঘাস
আমার নাকের ভেতর ঢুকছে, পিঁপড়ের ঝাঁক
চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হরেক রকমের
শব্দ আসছে কানে। কারা কী বলছে
মাথামুণ্ডু কিস্‌স্‌ বুঝতে পারছি না।

আমার সত্তর বছরের অস্থিচর্মসার শরীরে
এক রত্তি প্রাণ আছে কি নেই,
এ নিয়ে বড়ই ধন্দে পড়েছি। চিৎ হয়ে পড়ে-থাকা
আমি দেখি, আমার বাবা কালো শেরওয়ানি আর
সফেদ পাজামা পরে বসে আছেন আমার পাশে। তাঁকে
বলতে চাইলাম জালে আট্‌কে পড়া মাছের ভাষায়,
আপনি তো অনেক অনেক বছর আগে দুনিয়াকে
সালাম জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন, তাহলে এখানে
এলেন কী করে? তবে কি আমি মৃত্যুপুরীতে পড়ে আছি?
বাবা নিরুত্তর, আমার পরলোকবাসিনী মাকে কাছে ডেকে
আনলেন তাঁর দৃঢ়, ঋজু হাতের ইশারায়। আবছা পূর্ণিমা
এবং ঘোর অমাবস্যায় দুলতে থাকি ঝড়ে-পড়া নৌকার মতো।

অন্ধকারের জটিল জাল ছিঁড়ে কয়েকটি ঝাপসা
শব্দ আমার বন্দী শরীরের
চৌদিকে চক্কর কাটে। অনেক পুরোনো একটা
ডোবার পচা, দুর্গন্ধময় লতাপাতার ভেতর থেকে
শামসুর রাহমান নামটি জলপোকার মতো তাকায়।
কে এই শামসুর রাহমান? ঘাসফড়িং
গুবরে পোকা আপন মনে উড়ে, ঘরে বেড়ায়, পরস্পর
কথা কয়, ‘কোন্‌ দেশী লোক সে? কোথায় নিবাস?’

মনে হয়, অন্ধকারের বর্ষা নয়, অনেক
শতাব্দীর সোনালি বৃষ্টির মতো আলোর বান ডেকে যায়,
বসে আছি বোধিদ্রুমতলে, ন্যাড়া মাথা, কঙ্কালসার
পেটপিঠ একাকার, চারদিকে প্রণত
নানা জন, আমি উপবিষ্ট ঠায়
ধ্যানী গৌতম বুদ্ধের মুদ্রায়।

অন্ধকার ভয়ানক পিচ্ছিল পথে সেই কবে থেকে
ক্রশ টেনে চলেছি। আমার পিঠে
চাবুকের হিংস্রতার রক্ত ঝরানো অগণিত দাগ।
আমার মাথায় কাঁটার মুকুট, মুকুটের
প্রতিটি কাঁটা সকল আর্তজনের হয়ে অশ্রুপাত
করছে। আমার বেদনার আলোয় উদ্‌ভাসিত সারা পথ।

আমার বেডের চারপাশে দাঁড়ানো এরা কারা?
কেউই তো আমার চেনা নয়। তবে কি
আমি এক গহন ষড়যন্ত্রের শিকার? চকিতে
একটি কি দু’টি মুখ কেমন আপন মনে হয়। অথচ
ওদের কিছু জানাবার মতো ভাষা আমার অজানা। অথই
জলের স্রোতে কাঠের তক্তা আঁকড়ে ধরে, নাকে মুখে
পানির চড় চাপড় খেয়ে ভাসছি, ডুবছি। কয়েকটি অচেনা,
হিংস্র, ক্ষুধার্ত পাখি আমার ওপর কেবলি চক্কর কাটছে।
৩১.১০.৯৯