৬১. মা

৬১
আজাদের মা থাকেন মালিবাগের বাসায়, আর ভাড়া পরিশোধ করেন মগবাজারের বাসারও৷ এইভাবে যায় কিছুদিন৷ তারপর এক সময় মগবাজারের বাসার ভাড়া দেওয়ার সঙ্গতি চলে যায় তাঁর৷ মালিবাগের বাসাও তাঁরা ছেড়ে দেন, বাসা ছেড়ে দিয়ে ওঠেন বিক্রমপুরে আরেক বোনের ছেলের বাড়িতে, কিছুদিন চলে যায়, সেখান থেকে এসে ভাড়া নেন খিলগাঁওয়ের এক বাসা, যাকে ঠিক হয়তো বাসা বলা যাবে না, বলতে হবে বস্তিঘর, অন্তত যে রাজপ্রাসাদে তিনি একদা থাকতেন, তার তুলনায় এ তো বস্তিই, নর্দমার গন্ধ ঘরের মধ্যে, কাঁচা বাঁশের বেড়া, চারদিকে গরিব মানুষের কোলাহল-খিস্তিখেউড়, জায়েদ কাজ নেয় গাড়ির ওয়ার্কশপে, সারা দিন কাটে তার কালিঝুলি মেখে গাড়ির নিচে৷ এই সময় আজাদের মায়ের কাছে আসতেন খোঁজখবর করতেন তাঁর খালাতো বোনের ছেলে শুভ, খুদু, খোঁজ নিতেন তাঁর খালাতো দুলাভাই আবদুস সালাম৷
জাহানারা ইমাম এ বাসায় আসেন, আজাদের মায়ের অবস্থা দেখে তাঁর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে, এতটা খারাপ অবস্থা কারো হতে পারে এ তাঁর কল্পনারও অতীত, দারিদ্র্যের কশাঘাতের চিহ্ন ঘরজুড়ে, আজাদের মায়ের চেহারাও খুবই খারাপ হয়ে গেছে, শুকিয়ে তিনি অর্ধেক হয়ে গেছেন, অথচ এই মহিলা একদিন এই শহরে রাজরানী ছিলেন৷ তার মনে পড়ে, ইস্কাটনের প্রাসাদোপম বাড়িতে বা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে সাফিয়া বেগমের সুখী পরিতৃপ্ত সেই বেশটা, গা ভরা গয়না, আঁচলে চাবি, মুখে হাসি… তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন৷
জাহানারা ইমাম তাঁর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে দেন সাফিয়া বেগমের হাতে, বলেন, ‘আপা, কিছু মনে করবেন না, এটা রাখেন৷’
সাফিয়া বেগম শান্তস্বরে বলেন, ‘এটা কী ?’
‘কিছু টাকা আছে৷’
‘আপা, আপনি কিছু মনে করবেন না, এটা আমি নিতে পারব না৷’ এমন স্পষ্ট উচ্চারণে সাফিয়া কথা বলেন যে জাহানারা ইমাম খামটা ফেরত নিয়ে ব্যাগে রাখেন৷
আজাদের মায়ের দু-একজন আত্মীয়স্বজন এসে তাঁকে বলেন, ‘আপনার নামে না অনেক অনেক সম্পত্তি, ইস্কাটনের বাড়ি, ফরাশগঞ্জের বাড়ি, এসব বিক্রি করলেও তো টাকা আসে, বিক্রি করে দেন, দখল নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের৷’
আজাদের মা বলেন, ‘দ্যাখো বাপু, ওসব সম্পত্তি আমার নামে বটে, কিন্তু ওসব তো আসলে চৌধুরীর, আমার নামে থাকলেই ওগুলো আমার হয়ে যায় না৷ ও চৌধুরীরই৷ উনি যা করার করবেন, আমি ওসবে লোভ করি না৷ তোমরাও এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে এসো না৷’
সৈয়দ আশরাফুল হক আসে এই বাসায়, ভুরু কুচকে চারদিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, তোমার এ কি অবস্থা, তুমি এইটা কোন জায়গায় উঠছ ?’
‘কোন জায়গায় উঠেছি ?’
‘এই যে, এইটা তো বস্তি৷ ঢোকা যায় না, এইখানে তুমি থাকো কেমন কইরা ?’
‘আমার তো অসুবিধা হয় না৷’
‘তোমার আত্মীয়স্বজন কই ?’
‘আত্মীয়স্বজন দিয়ে কী হবে ?’
‘তোমাকে কেউ সাহায্য করব না ? তুমি যে এদের জন্যে এত কিছু করলা ?’
‘আমি কারো সাহায্য নিলে তো বাবু৷’
‘আচ্ছা কাউরে লাগব না৷ তুমি আমার সাথে চলো আমার লগে থাকবা৷’
মা হাসেন৷ কিছু বলেন না৷
‘কি চলো ?’
‘যাও, পাগলামি কোরো না৷ আমি কারো সাহায্য চেয়েছি কখনও ? কেন নেব ?’
‘তাহলে তোমাকে এর চেয়ে ভালো জায়গায় থাকতে হবে৷’
মা এ কথার জবাবেও শুধু হাসেন৷ সৈয়দ আশরাফুল হক তাকে কিছু টাকা দিলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন৷ তারপর বলেন, ‘শোনো, আজাদের খবর পেয়েছি৷ ওই খায়রুল আছে না বিক্রমপুরের, তার ভায়রার বড় ছেলে, ও লন্ডনে দেখে এসেছে, টিউবে ওর পাশে বসেছিল, হুবহু এক চেহারা, আরেকটু নাকি ফরসা হয়েছে…’
আশরাফুলের মনে হয় মাকে বলে, মা, আজাদ ভাই বেঁচে থাকলে তো তোমাকে চিঠি লিখতে পারত, তোমাকে ছাড়া আজাদ ভাই একদণ্ড থাকার ছেলে নাকি, কিন্তু সে কিছু বলে না৷ মহিলা একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন, থাকুন…
মাঝে মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল আসে, সে তো আবার আজাদের সহপাঠী, তাকে তো আর তিনি ‘না’ করতে পারেন না, কাজী কামাল স্মৃতিতর্পণ করে, ‘মাঝে মধ্যে জুয়া খেইলা হয়তো পাইলাম ৫০০ টাকা, তারে দিয়া আসলাম, জুয়ার টাকা সেইটা অবশ্য কই নাই…’
আজাদের আরেক বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও এসে তাঁকে মা বলে ডাকে, সাফিয়া বেগম তার মাথায় হাত বোলান, সে তখন জোর করে তাঁর হাতে কিছু টাকা গছিয়ে দেয়, তিনি সেটাও গ্রহণ করেন৷ না, ভাত তিনি আর কোনোদিনই খান না, দুটো পাতলা রুটি, একটু সব্জি হলেই তাঁর দিন চলে যায়, কি শীত কি গ্রীষ্ম, তার বিছানা মেঝেতে, পাটি বিছিয়ে, খুব শীতের রাতে গায়ের ওপরে দুটো শাড়ি ভাঁজ করে ঢেকে দেওয়া থাকে৷
জাহানারা ইমাম আবার আসেন তাঁর বাসায়, বলেন, ‘আপনার এই কাহিনী আমি লিখতে চাই, আপনি আজাদের ফটো দেন, আপনার ফটো দেন’, তিনি বলেন, ‘না, আমি ইতিহাস হতে চাই না৷ কোনো কিছু লিখবেন না৷’
কী জানি, হয়তো তিনি চৌধুরীর কাছে নিজেকে ছোট করতে চাননি৷
‘আপনি শহীদের মা৷ আপনার কথা সবাইকে জানাতে হবে৷ এটা আপনার জন্যে নয়, সারা দেশের মানুষের ভালোর জন্যে জানাতে হবে’-জাহানারা ইমাম যুক্তি দেখান৷
সাফিয়া বেগম হেসে বলেন, ‘কিন্তু আপা, আমার আজাদ তো শহীদ হয়নি৷ ও তো বেঁচে আছে৷ ও ফিরে আসবে৷’
জাহানারা ইমাম চোখ মুছে সেই বস্তিঘর ত্যাগ করেন৷
জাহানারা ইমামের কাছে তাঁর সম্পর্কে লেখার প্রস্তাবটা শুনে সাফিয়া বেগম এক রাতে তাঁর ছেলের চিঠিগুলো বের করেন৷ সেখান থেকে আলাদা করেন আজাদের একটা বিশেষ চিঠি৷
মা,
কেমন আছ ? আমি ভালোভাবেই পৌঁছেছি৷ এবং এখন ভালোই আছি৷ হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে৷ রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে৷ পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে৷ দোয়া কোরো৷ তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই৷ আমি নিজে কী ধরনের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না৷ আচ্ছা তুমি বল ত সব দিক দিয়ে আমি কী ধরনের মানুষ৷ আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি৷ তুমি আমার মা দেখে বলছি না; তোমার মতো মা পাওয়া দুর্লভ৷ এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজবার জন্য নয়৷ যদি আমি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীর সবাইকে জানাব তোমার জীবনী, তোমার কথা৷
আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি৷
এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও৷
ইতি তোমার
অবাধ্য ছেলে
আজাদ
আজাদ লিখেছিল, সে যদি নামকরা হয় কোনো দিন, সে লিখবে তার মায়ের জীবনী৷ পৃথিবীকে জানাবে তার মায়ের কথা৷ আজাদ যদি বেঁচে থাকে, যদি ফিরে আসে, অবশ্যই সে বেঁচে আছে, অবশ্যই সে ফিরে আসবে, নিশ্চয় এই কাজ সে-ই করবে৷ তিনি তো এই কাজ অন্য কাউকে করতে দিতে পারেন না৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *