৫৮. মা

৫৮
প্রতিবেশীদের অনেকেই, এবং তাদের সূত্র ধরে ঢাকা নগরবাসীর অনেকেই জেনে যায় যে, পুরানা পল্টনের এক বাড়িতে মিলি নামের একটা মেয়ে সারাক্ষণ শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলছে৷ সে কিছুই বলে না৷ তার কোনো অভিযোগ নাই৷ সে শুধু পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর নীরবে অশ্রুবর্ষণ করে৷
তার দুঃখের কারণ কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না৷ তবে নাগরিকেরা অনুমান করে, যুদ্ধের পরে সব মুক্তিযোদ্ধাই তো একে একে ফিরে আসছে, ফিরে এসেছে, হয়তো এই মেয়েটি যাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল, সে ফেরেনি৷
কার জন্যে অপেক্ষা করছিল মেয়েটা ?
নগরবাসী সেটা আর অনুমান করতে পারে না৷ কারণ যারা মিলিকে চেনে, তারা আজাদকে চেনে না৷ আর যারা আজাদের কথা জানে, তারা মিলির কথা জানে না৷
আর মিলিই তো একমাত্র মেয়ে নয় এই নগরে, যে পথের দিকে তাকিয়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন করছে ? আর আজাদই তো একমাত্র ছেলে নয় যে যুদ্ধের পরে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে কিন্তু ফিরে আসছে না৷
নগরবাসী একদিন মিলির কথা ভুলেই যায়৷
১৪ বছর পর, আজাদের মায়ের মৃত্যু মুক্তিযোদ্ধাদের আবার একত্র আর আজাদের বিষয়েই স্মৃতিদষ্ট করে তোলার পরে, কারো কারো মনে হতে থাকে, তাই তো, এ রকম একটা মেয়ে তো ছিল, কী যেন নাম, যে শুধু কাঁদত৷
মিলি হয়তো নীরবে অশ্রুবর্ষণ করেছে, মুখে শব্দ করেনি, কিন্তু এমন মেয়েও তো কিছু থেকে থাকবে, যারা প্রকাশ্যে অশ্রুও বর্ষণ করেনি, দীর্ঘশ্বাসটুকুও চেষ্টা করেছে গোপন করতে, অশ্রুটুকু বিসর্জন দিয়েছে গোপনভাবে, নিভৃতে, কাউকে জানতে না দিয়ে…
বাশারের জন্যে কি কেউ কাঁদেনি, জুয়েলের জন্যে, রুমীর জন্যে, বদির জন্যে, কী সুন্দর থোকা থোকা গুচ্ছ গুচ্ছ নাম, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো, অসংখ্য নাম, নিযুত শহীদের নাম, এদের প্রত্যেকের জন্যে, অনেকের জন্যে…নিশ্চয় কেঁদেছে, সম্মিলিত, একাকী, প্রকাশ্য, সংগোপন কত কান্না কত অশ্রু ভাপ হয়ে মিশে গেছে আকাশে বাতাসে, কে তার হিসাব রেখেছে ?
তরুণীদের কান্নার হিসাব কেউ রাখেনি, কিন্তু শহীদদের মায়েদের প্রকাশ্য কান্না, অশ্রুপাত, ব্যক্তিগত প্রতীক্ষা আর দীর্ঘশ্বাসের চিহ্নগুলোই বা কাল কোথায় ধরে রেখেছে ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *