৪৯. মা

৪৯
জাহানারা ইমাম রুমীর একটা ফটো দোকানে দিয়েছিলেন এনলার্জ করতে৷ ৮ বাই ১০ ইঞ্চি ছবিটা তিনি আজকেই নিয়ে এসেছেন দোকান থেকে৷ সঙ্গে এনেছেন ফটোস্ট্যান্ড৷ ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন সেটার দিকে৷ কত দিন এই মুখ তিনি দেখেন না!
দিন কেটে যাচ্ছে৷ একটা একটা করে দিন কেটে যায়৷ আজ ৫০ দিন হলো রুমীকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে৷ ‘রুমী, আজ ৫০টা দিন হলো তোমাকে আমি দেখি না, ভাবা যায়!’ জাহানারা ইমাম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ তাদের পরিবারে সবারই মনের অবস্থা খারাপ৷ দুঃখ, হতাশা, নিষ্ফল ক্রোধ, ভয়, ভীতি-সব মিলে তাদেরকে কি পাগল বানিয়ে ছাড়বে ? তাঁর স্বামী শরীফ ইমামের শরীর দ্রুত ওজন হারাচ্ছে৷ তিনিও শুকিয়ে যাচ্ছেন৷ তবে সবাই বলে, রুমীর মাকে নিয়ে ভয় নাই, কারণ তিনি কাঁদেন, হাহুতাশ করেন, মনের বাষ্প বের করে দেন৷ কিন্তু রুমীর বাবা শরীফ কথা বলেন কম, কাঁদেন না, হা-হুতাশ করেন না৷ দৈনন্দিন সব কাজ তিনি করে চলেছেন নিখুঁতভাবে, সকালে উঠে শেভ, গোসল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, অফিস, বিকালে টেনিস, সন্ধ্যায় আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা-সবই তিনি এমনভাবে করছেন, যেন তাঁর মনে কোনো দুঃখ নাই, যেন তাঁর ছেলেকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়নি৷
কিন্তু জাহানারা ইমাম এতটা শান্ত ভাব বজায় রাখতে পারেন না৷ ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন : ‘এই কি ছিল বিধিলিপি, রুমী ? তুমি কি কেবল ছবি হয়েই থাকবে আমাদের জীবনে ?’
রুমীর ধরা পড়ার রাতেই, জাহানারা ইমাম যখন রুমীর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ রেডিওতে গান বেজে উঠল, খুদিরামের সেই বিখ্যাত ফাঁসির গান, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে জগৎবাসী…
তবে কি রুমী চলেই গেল ? ফিরে আসবে মাসীর ঘরে, গলায় ফাঁসির দাগ দেখে তাকে চিনে নিতে হবে ?
তা কি হয় ? রুমী কি চলে যেতে পারে ? এই অল্প বয়সে ? কেবল আইএসসি পাস একটা ছেলে ? কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যে ভর্তি হয়েছে!
রুমী আবৃত্তি করত খুব ভালো৷ জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটাও তার গলায় দারুণ ফুটে উঠত
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল মানুষের বেশে
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন এ কাঁঠাল ছায়ায়…
জাহানারা ইমামের দু চোখ জলে ভিজে আসছে৷ তিনি বিড়বিড় করেন, রুমী, তোমাকে ফিরে আসতেই হবে, আসতেই হবে৷
চোখ মুছে ছবিটার নিচে এক টুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে তিনি লেখেন : আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷ ফটোটা তিনি রাখেন নিচতলায় বসবার ঘরে, কোনার টেবিলে৷ আগামীকাল ২০ নভেম্বর, ঈদ৷ অনেক মানুষ আসবে এই বাসায়৷ সবাই দেখুক, কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো রুমী কীভাবে সদর্পে ঘোষণা করছে-আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *