৪৬. মা

৪৬
আজাদের মায়ের সময়গুলো যে কীভাবে কেটে যাচ্ছে, আল্লাহ জানে৷ জায়েদ আর টগরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ হাসপাতালে ভর্তি করলেই তো আর ঝামেলা শেষ হয়ে যায় না৷ কাগজে ছাপা হয়েছে সংবাদ, ঢাকায় পুলিশ আর সেনাবাহিনীর অভিযান, দুষ্কৃতকারী গ্রেফতার, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে গোপন খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এই মহান সাফল্য দেখিয়েছে৷ গুলিবিদ্ধ দুজন দুষ্কৃতকারী হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অচেতন হয়ে আছে৷ এই খবর কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পর মিলিটারি চলে আসে হলি ফ্যামিলিতে৷ এদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন ইমতি৷ তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলে, এই রোগী দুজনকে তাদের চাই৷ হলি ফ্যামিলি কর্তৃপক্ষ বলে, এটা রেডক্রসের হাসপাতাল৷ এখান থেকে কোনো রোগীকে কখনও ছাড়া হবে না৷ কাপ্টেন রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের খুঁজতে থাকে৷ আজাদের মাকে পাওয়া যায়৷ ক্যাপ্টেন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী ? এরা গুলিবিদ্ধ হয়েছে কীভাবে৷ আজাদের মা ঘটনাটা যতটুকু বলা নিরাপদ মনে করেন, বিবৃত করেন৷ তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে জানতে পেয়ে ক্যাপ্টেন জানতে চায়, ছেলের নাম কী৷ মা ছেলের ভালো নাম বলেন৷ ক্যাপ্টেন চমকে ওঠে৷ জানতে চায়, ডাকনাম কী৷ মা বলেন৷ ক্যাপ্টেন বলে, আজাদের কোনো তসবির তাঁদের সঙ্গে আছে কি না৷ আজাদের মা তাঁর সঙ্গে সারাক্ষণ রাখা আজাদের একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি বের করে দিলে ক্যাপ্টেন সেটা হাতে নেয়৷ ভালো করে দেখে৷ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্যাপ্টেনের দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে থাকে৷ ছবিটা ফেরত দিয়ে ক্যাপ্টেন কিছু না বলে চলে যায়৷ আজাদের মা ঘটনার কোনো কারণ বের করতে পারেন না, তবে ঘটনা শুনে অন্যরা এই অনুমান ব্যক্ত করে যে সম্ভবত এই ক্যাপ্টেনটা করাচি ইউনিভার্সিটিতে আজাদের সহপাঠী ছিল৷
রক্ত জোগাড় করা দরকার৷ জায়েদ-টগরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে রক্ত আর স্যালাইন দিয়ে৷ টাকা সংগ্রহ করতে হবে৷ হাতে কোনো নগদ টাকা নাই৷ এর মধ্যে আবার চেষ্টাচরিত করতে হবে আজাদ, মনোয়ার, বাশারকে ছাড়িয়ে আনার৷ তিনি কার কাছে যাবেন ? টাকা জোগাড়ের সহজ পথ সোনার গয়না বিক্রি করা৷ ওটা করা যাবে৷ রক্তও যে কার কাছে পাওয়া যাবে, খোদা জানেন৷ তিনি নিজেই দিতে পারেন, কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর রক্ত নিতে চায় না৷ কেন যে নিতে চায় না কে জানে৷
ডাক্তাররা তাঁর কাছে একটা ফরম নিয়ে আসে-’জায়েদের পা কেটে ফেলতে হবে৷ আপনি গার্জিয়ান হিসাবে পারমিশন দেন৷ এখানে আপনার সাইন লাগবে৷ সাইন করেন৷’
পা কেটে ফেলতে হবে ? আজাদের মা চিন্তায় পড়েন৷ ছেলে তাঁর নয়৷ ছেলের মা বেঁচে থাকলে সে-ই সিদ্ধান্ত দিতে পারত৷ ছেলের বাবা তো থেকেও নাই৷ এখন এই সিদ্ধান্ত তিনি কীভাবে দেবেন৷ তখন তাঁর মনে পড়ে যায় জুরাইনের মাজার শরিফের বড় হুজুরের কথা৷ আজাদকে যুদ্ধে যেতে দেবেন কি দেবেন না, এই দোটানায় যখন তিনি ভুগছিলেন, তখন তিনি হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন৷ হুজুর তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আজাদকে যুদ্ধে পাঠাও৷’ এখন তার এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় হুজুরের কাছে বুদ্ধি নেওয়া যেতে পারে৷
আমি একটু বুদ্ধিপরামর্শ নিয়ে আসি৷
তিনি জুরাইনে চলে যান৷ বড় হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন৷ হুজুরপাকের স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক৷ তাঁর সঙ্গেও দেখা করেন৷ তাঁদের খুলে বলেন তাঁর বিপদের কথা৷ ছেলেকে, ছেলের বন্ধুকে, ভাগি্নজামাইকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা৷ আর্মির গুলিতে দুই ভাগ্নে মরণাপন্ন৷ ছেলে কি তাঁর ফিরে আসবে না ? আর জায়েদের পা কাটার অনুমতি তিনি দেবেন কি দেবেন না!
হুজুর বলেন, ‘উসকো পাও মাত কাটো৷’
ব্যস৷ মা তাঁর সিদ্ধান্ত পেয়ে যান৷ ‘আর আমার ছেলে আজাদের কী হবে হুজুর!’
‘ও আপাস আয়েগা৷ আসবে৷ ফিরে আসবে৷ সহিসালামতেই ফিরে আসবে৷’
আজাদের মা কিছুটা আশ্বস্ত হন৷ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ফিরে আসেন৷ ডাক্তারদের বলেন, ‘না, জায়েদের পা কাটতে পারবেন না৷ আমার অনুমতি নাই৷’ শুনে ডাক্তাররা বিরক্ত হয়৷ পায়ে গুলি লেগেছে৷ পা না কাটলে এ ছেলেকে তো বাঁচানোই যাবে না৷
জায়েদ এ কথা চিরদিনের মতো স্মরণ করে রাখবে যে, জুরাইনের হুজুরের জন্যে তার পা-টা আজও আছে৷ নইলে তো কবেই সেটা কেটে ফেলে দিতেন হলি ফ্যামিলির ডাক্তাররা৷
আজাদের মা বাসায় ফেরেন৷ ঘরের মধ্যে এখনও পড়ে আছে ভাঙা খাট৷ ইস্পাতের আলমারি এখনও গুলিতে ছঁ্যাদা হয়ে আছে৷ মেঝেতে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে, কে মুছবে আর এসব!
হঠাৎ করে কামরুজ্জামান আসে আজাদের মায়ের কাছে, তাকে জায়েদ সব সময়ই সন্দেহ করে এসেছে আর্মির ইনফরমার বলে, তার সঙ্গে আরেকজন ছেলে, সেই ছেলে বলে, ‘নানি, অস্ত্রগুলা দ্যান৷’
আজাদের মা বলেন, ‘তুমি কে ?’
‘আমি বদির মামা৷ আজাদের বন্ধু৷ আজাদদের সাথে ছিলাম৷’
আজাদের মায়ের মাথায় মুহূর্তে এ প্রশ্ন উদিত হয় যে, আজাদের কোনো বন্ধু তো তাকে নানি বলে না৷ এ কে ? কেন এসেছে ? তিনি বলেন, ‘বাবা, এ বাসায় তো কোনো অস্ত্র নাই৷ তুমি ভুল শুনেছ!’ কামরুজ্জামান আগন্তুককে নিয়ে চলে যায়৷ আজাদের মা ভাবেন, ভাগ্যিস অস্ত্রগুলো তিনি আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন৷
মা সারাক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন৷ এর মধ্যে যতটুকু সময় পান তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *