৩৯. মা

৩৯
আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে, জায়েদের কাছ থেকে ঠিকানা বুঝে নিয়ে, একদিন জুরাইনে যায় সৈয়দ আশরাফুল হক ৷ গোরস্তানে গিয়ে জিয়ারত করে আসে মায়ের কবরটা ৷ এখনও কবরটা পাকা করা হয়নি ৷ তবে মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা-এই পরিচয়-ফলকটা বাঁশের বেড়ার গায়ে লাগানো আছে ৷ কবরস্তান থেকে বেরিয়ে ভিক্ষুকদের পাল্লায় পড়ে আশরাফুল হক ৷ পকেট থেকে খুচরো টাকা বের করে বিলাতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভিক্ষুক-মিছিলের মধ্যখানে পড়ে যায় সে ৷ শেষে অসহায়ের মতো দৌড়ে এসে গাড়িতে ওঠে ৷
গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আশরাফুল হকের মনে পড়ে যায় বিগত দিনের নানা স্মৃতি ৷
একেকটা সফল অপারেশন করে ফিরত গেরিলারা, আর সেই বিজয়টাকে উদ্যাপন করত দুদিন ধরে ৷ আশরাফুলদের বাসাতেও হয়েছে এ রকম আড্ডা ৷ সবাই চলে আসত সেই ভোজসভায় ৷ আজাদ আসত ৷ রুমী আসত ৷
রুমীকে প্রথম দিন দেখে তো আশরাফুলের আকাশ থেকে পড়ার যোগাড় ৷ এ তো একদম বাচ্চাছেলে ৷ এ কি যুদ্ধ করবে ? এও ট্রেনিং নিয়ে এসেছে মেলাঘর থেকে ?
বদি আর রুমীর একটা বিষয়ে ছিল খুবই মিল ৷ দুজনই ছিল রোমাঞ্চপ্রিয় ৷ আবার দুজনেই ছিল মেধাবী ৷ বিভিন্ন ঘটনা তারা তাত্তি্বকভাবে বিশ্লেষণ করত ৷ একদিন বদি তাকে বলে তার ভঙ্ ওয়াগনে একটা লিফট্ দিতে ৷ আশরাফুল বের হয় গাড়ি নিয়ে ৷ সে গাড়ি চালাচ্ছে, যাত্রী বদি আর স্বপন ৷ বদির কাছে কেবল একটা পিস্তল ৷ ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে রেকিট অ্যান্ড কোলম্যানের অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হয় ৷ চুল্লু ভাই দুটো বস্তা আনে ৷ আশরাফুল বলে, ‘এর মধ্যে কী ?’
বদি বলে, ‘ইউ গেজ ৷’
আশরাফুলের সমস্তটা শরীর কাঁপতে থাকে ৷ বদি বলে, ‘লেট্স মুভ ৷’
মিরপুর রোডে উঠতেই দেখা যায় সামনে চেকপোস্ট ৷ আশরাফুলের কপালে ঘাম জমে ৷ সে বোঝে, আজই শেষ ৷ বদি কিন্তু নির্বিকার ৷ সে বলে, ‘ইফ দ্য বাস্টার্ডস স্টপ আস, আই উইল জাস্ট ফায়ার ৷ অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু ডু ইয়োর ওন বিজনেস ৷ তোরা কী করবি, তোরা বুইঝা নিস ৷’
শুনে আশরাফুলের সমস্তটা শরীর দুষ্টু ছেলের হাতে ধরা পড়া চড়ুইপাখির ছানার বুকের মতো কাঁপে ৷
গাড়ি চেকপোস্টের সামনে আসে ৷ সৈন্যরা গাড়ি থামাতে বললে তারা থামায় ৷ উর্দুতে কথাবার্তা হয় ৷ তারা জানতে চায় তারা কী করে, কোথায় যাচ্ছে ৷ সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর সৈন্যরা গাড়ি চেক করার কষ্ট স্বীকার না করে হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বলে ৷
সেই দুপুরটাই তো আশরাফুলের জীবনের শেষ দুপুর হতে পারত ৷ বদিরও হতে পারত ৷ কিন্তু বদি ছিল নির্বিকার ৷ মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলতে পছন্দ করত সে ৷ তার ছিল অপরিসীম সাহস ৷
আশরাফুলের অত সাহস ছিল না ৷ সে মনেপ্রাণে ছিল গেরিলাদের সঙ্গেই, কিন্তু যুদ্ধে সরাসরি যাওয়ার বা ট্রেনিং নিতে ভারত যাওয়ার কথা ভাবেনি ৷ তবে তার বাবা যেহেতু কৃষক শ্রমিক পার্টি করতেন, পাকিস্তানিরা তাদের সন্দেহের দৃষ্টির বাইরে রাখত, সে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিল তাদের বাড়িটাকেও ৷
আর ঢাকার গেরিলারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত ইংরেজিতে ৷ তারা ভালো পোশাক পরত, সব সময় থাকত ধোপদুরস্ত, যাতে পথেঘাটে চলাচলের সময় কেউ তাদের গেরিলা বলে সন্দেহ না করে ৷
এই ইংরেজি বলা সচ্ছল তরুণ গেরিলাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল কমলাপুর রেলস্টশনের কুলি সর্দার রশিদ ৷ শাহাদত চৌধুরীর মতো অভিজাতপন্থী লোক তার সঙ্গে একই সিগারেট ভাগ করে খায়-এটা শুনে আশরাফুলের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করে ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *