৩৬. মা

৩৬
আজাদ যুদ্ধে যাওয়ার পরে, তার মাকে একাধিকবার বলেছিল, এটা তার খালাতো ভাইবোনদের মনে আছে এখনও যে আজাদ বলছে, ‘মা, আমি কিন্তু রাজনীতি করি না, পলিটিঙ্ করতে আমি যুদ্ধে যাই নাই, আমি যুদ্ধে গেছি বাঙালির উপরে পাকিস্তানিদের অত্যাচার মানতে পারছি না বলে, রাজারবাগের পুলিশ ব্যারাকে ওরা যা করছে… ৷
২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগে কী ঘটেছিল, সেটা আজাদ আর বাশার কিছুটা নিজের চোখে দেখেছিল ৷ আর এপ্রিল মে মাসে কী ঘটছে সেখানে, তার বিবরণ তারা পেয়েছিল এক পুলিশ সুবেদারের কাছ থেকে ৷ এই পুলিশ সুবেদারের বাড়ি ছিল মাওয়ায় ৷ আজাদরা তাকে ডাকত খলিল মামা বলে ৷
মা তাঁর কথা মাঝে মধ্যেই স্মরণ করতেন, ‘খলিলটা যে আর আসে না ৷ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে ? আজাদ, একটু খোঁজ নিস তো ৷ খলিল বেঁচে আছে নাকি ?’
এপ্রিলের মাঝামাঝি পুলিশের সুবেদার খলিল একদিন আসেন আজাদদের বাসায় ৷
মা বলেন, ‘আল্লাহ মালিক ৷ তুমি বেঁচে আছ খলিল ৷’
‘জি বুবু ৷ হায়াত আছে ৷ আপনাদের দোয়ায় বাঁইচা আছি ৷’
আজাদের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয় ৷ মা তাঁর জন্যে চাল চড়িয়ে দেন চুলায় ৷
মা বলেন, ‘তোমার কোনো খবর পাই না ৷ বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ৷ চারদিক থেকে কত দুঃসংবাদ আসছে ৷’
খলিল বলেন, “বুবু, কী দেখলাম এই জীবনে ৷ দোজখ দেখা হইয়া গেছে ৷ মার্চ মাসের ২৯ তারিখে কোতোয়ালি থানায় পোস্টিং হইল ৷ আমরা আটজন ৷ থানায় গিয়া দেখি, কী কবো বুবু, দেওয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত, থানার দেওয়াল মনে করেন গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হইয়া আছে ৷ বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়া খাড়াইলাম ৷ খালি লাশ আর লাশ ৷ নদীর পানি দেখা যায় না ৷ মনে করেন পুকুরে বিষ দিলে যেমন মাছে পানি ঢাইকা থাকে, বুড়িগঙ্গায় খালি মরা মানুষ ভাসতেছে ৷ একটা পুলিশের লাশ দেইখা আগায়া গেছি ৷ দেখি, আমাদের পিআরএফের কনস্টেবল আবু তাহের ৷ আমি চোখের পানি আটকাইতে পারি না ৷ আরো বহু সিপাহির ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভাসতেছে ৷ আমি তাহেরের বডি ধরতে গেছি, বেহুঁশের মতো, পেছন থাইকা এক পাঞ্জাবি সোলজার চিল্লায়া উঠল, ‘শুয়র কা বাচ্চা, তুমকো ভি পাকড়াতা হায়, কুত্তা কা বাচ্চা, তুমকো ভি সাথ মে গুলি করেগা ৷’ আমি মনে মনে কই, আমি সাব ইন্সপেক্টর আর তুমি একজন সোলজার, আমার সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করতেছ, করো ৷ আল্লাহ বিচার করবে ৷”
মা বলেন, ‘মহুয়া, দ্যাখো তো, চুলায় ভাতের কী অবস্থা ৷ আঁচটা একটু কমিয়ে দিও মা ৷ হ্যাঁ ভাই, বলো ৷’
খলিল বলে চলেন, ‘কোতোয়ালি থানার বরাবর সোজাসুজি গিয়া বুড়ীগঙ্গার লঞ্চঘাটটা আছে না, সেই পারে খাড়াইলাম ৷ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে লাশ, খালি লাশ, পইচা-গইলা যাইতেছে, বেশুমার মানুষের লাশ ভাসতেছে ৷ দেখলাম কত মানুষ মইরা ভাইসা আছে ৷ বাচ্চা, বুড়া, ছেলে, মেয়ে ৷ যতদূর চোখ যায়, দেখলাম বাদামতলি ঘাট থাইকা শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অগণিত মানুষের পচা-গলা লাশ ৷ বুবু, ভাইগ্না এখানে আছে, কওয়া যায় না আবার না কইয়াও পারি না, অনেক উলঙ্গ মহিলার লাশ দেখলাম, পাকিস্তানিরা অত্যাচার কইরা মারছে, দেইখাই বোঝা যাইতেছে ৷ ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের মনে হইল আছাড় মাইরা খুন করছে ৷ সদরঘাট টার্মিনালের শেডের মধ্যে ঢুইকা খালি রক্ত আর রক্ত দেখলাম…দেখলাম মানুষের তাজা রক্ত এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ৷ বহু মানুষরে ধইরা আইনা টার্মিনালে জবাই করছে ৷ বেটন আর বেয়নেট দিয়া খোঁচায়া মাইরা টাইনা হেঁচড়ায়া পানিতে ফেইলা দিছে ৷ শেডের বাইরের খোলা জায়গাটায় গিয়া দেখি, কাক আর শকুনে ছা্ইয়া গেছে ৷ সদরঘাট টার্মিনাল থাইকা পূর্ব দিকে পাক মিলিটারির সদর আউটপোস্টটা আছে না, সেই দিকে তাকাইলে দেখবেন নদীর পাড়ের সমস্ত বাড়িঘর ছাই কইরা ফেলছে ৷ দেখলাম রাস্তার পাশে ঢাকা মিউনিসিপালিটির কয়েকটা ময়লা পরিষ্কার করার ট্রাক খাড়ায়া আছে, সুইপাররা হাত-পা ধইরা টাইনা হেঁচড়ায়া ট্রাকে লাশ উঠাইতেছে ৷ কাপড়ের বাজারের চারদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সামনে খালি লাশ ৷ খ্রিষ্টান মিশনারি অফিসের সামনে, সদরঘাট বাসস্টপেজের চারদিকে, কলেজিয়েট হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ, পগোজ হাইস্কুল, ঢাকা জজকোর্ট, পুরাতন স্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, তারপরে ধরেন সদরঘাট গির্জা, নওয়াবপুর রোডের চারদিকে, ক্যাথলিক মিশনের বাইরে ভিতরে, আদালতের সামনে বহু মানুষের ডেড বডি পইড়া আছে ৷’
আজাদ মাথা নিচু করে সব শুনছে ৷ মায়ের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে ৷
মা ভাত বাড়েন ৷ আজাদ আর খলিল একসঙ্গে ভাত খেতে বসে ৷ খলিল এমনভাবে গোগ্রাসে খেতে থাকেন যে কতদিন তিনি খান না ৷ আজাদ ভাতের থালায় ভাত নাড়েচাড়ে. কিন্তু ভাত তুলে মুখে দিতে পারে না ৷ তার নাকে এসে লাগে লাশের গন্ধ ৷
আজাদের এই খলিল মামা পরে আবার আসেন তাদের বাসায় ৷ বাশার ছিল সেদিন ৷ আজাদ তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে আসে ৷ বলে, ‘খলিল মামা, কী অবস্থা বলেন তো ৷’
তিনি বলেন, ‘বাশার সাহেব তো আবার সাংবাদিক, সাংবাদিক মানে হইল সাংঘাতিক ৷ আমি তার সামনে কিছু বলব না ৷’
বাশার বলে, ‘মামা, আমি এসব লিখব না ৷ শুধু শুনে রাখি, দেশ যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তখন লিখব ৷’
খলিল মামা বলেন, ‘বাবা রে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আছি ৷ যা দেখতেছি, তা আল্লাহ কেমনে সহ্য করতেছে, বুঝতেছি না ৷ পাঞ্জাবি সৈন্যরা ট্রাকে কইরা, জিপে কইরা ডেলি স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের ধইরা আনে ৷ ঢাকার নানান জায়গা থাইকা বাচ্চামেয়ে ইয়ং মেয়ে সুন্দরী মহিলাদের ধইরা আনে ৷ হাতে বইখাতা দেইখাই বোঝা যায় স্টুডেন্ট ৷ মিলিটারি জিপে ট্রাকে যখন মেয়েদের পুলিশ লাইনে আনা হয়, তখন পুলিশ লাইনে হৈচৈ পইড়া যায় ৷ পাকিস্তানি পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সামনে আইসা মেয়েদের টাইনা হেঁচড়ায়া নামায়া কাপড়-চোপড় ছিঁইড়া-খুঁইড়া উলঙ্গ কইরা আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেইলা কুত্তার মতো অত্যাচার করে ৷ সারা দিন নির্বিচারে রেইপ করার পর বৈকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর চুলের সাথে লম্বা লোহার রড বাইন্ধা রাখে ৷ আবার রাতের বেলায় শুরু হয় অত্যাচার ৷ গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে মেয়েদের কান্না শুইনা সবাই ঘুম থাইকা জাইগা জাইগা উঠি ৷’ খলিল সাহেব কাঁদতে থাকেন ৷
আজাদ আর বাশার নীরব ৷
তারা বুঝতে পারে না, খলিল মামাকে তারা কীভাবে সান্ত্বনা দেবে ? তাদেরকেই বা সান্ত্বনা দেয় কে ? আজাদ ভেতরে ভেতের ফুঁসতে থাকে ৷ এই অত্যাচার মুখ বুজে যে সহ্য করে, সে কি মানুষ ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *