৩৪. মা

৩৪
আজাদ ধীরে ধীরে জানতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারি বেঁধে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রদের, বাসায় গিয়ে গুলি করে খুন করা হয়েছে শিক্ষকদের, ছাত্রীহলে গিয়ে নারকীয় নির্যাতন করা হয়েছে মেয়েদের ৷ তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে ৷ ক্রোধের আগুনে শরীর হয়ে ওঠে তপ্ত ৷ তবে রাজনীতির সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকায় ঠিক কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না ৷ কিন্তু সে-সময়ই তার বন্ধুরা, পরবর্তীকালে যারা তার সহযোদ্ধা হবে, তাদের অনেকেই যুদ্ধের ময়দানের সন্ধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ৷ শহীদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ, বদিউল আলম, মাসুদ ওমর-ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের চার ছাত্র বেরিয়ে পড়ে যুদ্ধের সন্ধানে, তারা শুনতে পায় গাজিপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা লড়াই করছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে, সেখান থেকে তারা পিছু হটে ময়মনসিংহে যাবে, এটাই স্বাভাবিক, সুতরাং বাদল, আশফি, ওমর, বদি চার তরুণ কারফিউ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘন্টার বিরতির মধ্যেই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহের পথে পা বাড়ায় ৷ বাচ্চু, আসাদ এবং লক্ষাধিক ঢাকাবাসী ২৭শে মার্চে কারফিউ তুলে নেওয়ার ফাঁকে তাদের সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্রসহ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আশ্রয় নেয় জিঞ্জিরায় ৷ সেখানেই তারা প্রথম শুনতে পায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা, এম এ হান্নান, মেজর জিয়া, শমসের মবিন ও ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও মনে করতে পারে, মেজর জিয়ার কন্ঠস্বর তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল খুবই, কারণ তারা আর্মি খুঁজছিল, বাঙালি আর্মি বিদ্রোহ করেছে শুনে তারা বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধ সত্যই শুরু হয়ে গেছে ৷ রেডিওর এ ঘোষণা ত্রিমোহনীতে শুনতে পায় শাহাদত চৌধুরী আর ফতেহ, যারা সেখানে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের খোঁজে, রেডিওতে কান পেতে এ ঘোষণা শুনে যেন জেগে ওঠে ত্রিমোহনী, উৎসব শুরু হয় সেখানে ৷ ত্রিমোহনীতে তারা দেখা পায় রাজারবাগে যুদ্ধ করা চারজন পুলিশের ৷ তাদের সমস্ত অস্তিত্ব তখন প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের জন্যে উন্মুখ ৷ তারাও খুঁজছে যুদ্ধক্ষেত্র ৷ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই ট্রাক সৈন্য তারাবো পর্যন্ত এসে পড়লে সে খবর নিয়ে আসে ফতেহ চৌধুরী ৷
তবে যুদ্ধ ২৫শে মার্চ রাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধে, পিলখানায় ইপিআরের নাছোড় সাহসিকতায়, নয়াবাজারের নাদির গুণ্ডার এলএমজির গুলিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া আর পিছু হটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, সারা দেশে বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ আর প্রতিরোধে ৷ গাজীপুরে ২য় বেঙ্গল, চট্টগ্রামে ৮ম বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ বেঙ্গল বিদ্রোহ করে ৷ লড়তে থাকে বীরের মতো ৷ পাবনার ডিসি, মেহেরপুর কুষ্টিয়ার এসডিও, এসপি-এমনি করে অনেক জায়গায় বেসামরিক প্রশাসন আর জনগণ মিলেমিশে নিজ নিজ এলাকাকে দখল করে রেখে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ৷ রংপুর দিনাজপুরের মাটিও দখল করে রাখে সাধারণ মানুষ, বাঙালি সাঁওতাল, ওরাঁও আদিবাসী মিলেমিশে ৷
২৫শে মার্চ রাতে শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে পাকিস্তানি মিলিটারি ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে তোপের মুখে চিরকালের জন্যে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতে নয়, ২রা এপ্রিল জিঞ্জিরায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তাকে এখনও বাচ্চু, আসাদ বা যে-কানো প্রত্যক্ষদর্শীর দোজখ দেখার দুঃসহ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ৷ প্রাণভয়ে ভীত আশ্রয়সন্ধানী প্রায় লাখখানেক ঢাকাবাসী আশ্রয় নিয়েছে বুড়িগঙ্গার ওপারে ৷ তাদের কারো কারো কাছে দেশি অস্ত্র ৷ একটা-দুটো বন্দুক ৷ পুলিশ কিংবা ইপিআরের ফেলে যাওয়া থ্রি নট থ্রি ৷ ভোরবেলা হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি লঞ্চ আর স্টিমারযোগে চলে আসে নদীর এপারে, অতর্কিতে, বাচ্চুরা টের পেয়ে পেছাতে পেছাতে সৈয়দপুরে সরে আসে, আর পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় আকাশে হেলিকপ্টার জেট উড়ছে, হাজার হাজার মানুষ পালাচ্ছে দিগ্বিদিক, আর আর্মিরা কী একটা পাউডার নাকি পাইপ দিয়ে ফুয়েল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, মানুষ পুড়ে যাচ্ছে আর ছুটে যাচ্ছে, ছুটন্ত মানুষ পুড়ছে, পুড়ন্ত মানুষ ছুটছে, ছুটন্ত মানুষ ফুটন্ত, জ্বলন্ত, হাজার হাজার ছুটন্ত অগি্নকুণ্ড, আর চিৎকার, পুরোটা জনপদ পুড়ছে, আর গুলি, রিকোয়েললেস রাইফেল থেকে, আর হেলিকপটার জেট থেকে, ছুটন্ত মানুষ পড়ে যাচ্ছে, ধরাশায়ী হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ পড়ে গেল, মরে গেল, মরে গেল তো বেঁচে গেল, অন্তত ১০ হাজার মানুষ সেদিন মারা পড়েছে জিঞ্জিরায়-এই বিবরণ আজাদ জানতে পারবে, আর তার মনে হবে ট্রুম্যানের কথা, হ্যারি এস ট্রুম্যানের আত্মজীবনীর একটা বই তাকে পড়তে হয়েছে এমএ ক্লাসের জন্য, আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক ক্লাসে, ইয়ার অব ডিসিশনস, হিরোশিমায় যখন অ্যাটম বোমা ফেলা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তখন বাইরে লাঞ্চ করছিলেন, বোমা ফেলার পরে তাকে জানানো হয় নিউক্লিয়ার টেস্টের চেয়েও এবার ধ্বংস হয়েছে অনেক বেশি, ট্রুম্যান বলেছিলেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো এটা ৷ চলো, বাড়ি যাই ৷ এই বোমা ২০ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তিশালী ৷ I was greatly moved… I said to the sailors around me, this is the greatest thing in the history it’s time for us to go home (আজাদের নিজের হাতের ৩.৪.৭০ তারিখে স্বাক্ষর করা এই বইটা রয়ে গেছে জায়েদের সংগ্রহে) ৷ জিঞ্জিরার দিকে পালাতে গিয়েই সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদার আর ইলা মজুমদারের আঙুল থেকে এক সময় খুলে যায় তাদের বছর সাতেক বয়সী মেয়ে মধুমিতার হাতের মুঠো, তারা তাকে ডাকতেন মিতু বলে, তারপর মিতু মিতু বলে ইলা মজুমদার কত ডাকলেন, বারীণ মজুমদার কত ডাকলেন, তাদের ছোট ছেলে পার্থ কত ডাকল, মিতু আর ফিরে এল না ৷ যে যায় সে আর ফিরে আসে না, কিন্তু মায়েরা প্রতীক্ষায় থাকে, তাদের প্রতীক্ষা দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৪ বছর পরেও ফুরায় না ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *