৩১. মা

৩১
আজাদ নিজেকে সব সময়ই ননপলিটিক্যাল বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করত ৷ তবে ২৫শে মার্চ রাতে সে মগবাজারে পিকেটিং করছিল, ব্যারিকেড দিচ্ছিল রাস্তায়, এ কথা কাজী কামালের মনে আছে ৷ স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায় জায়েদেরও ৷ জায়েদ বলে, ২৫শে মার্চ রাতে মগবাজারে আজাদের সঙ্গে আশরাফুলসহ মগবাজার ইস্কাটন এলাকার বন্ধুরাও ছিল ৷ হাবিবুল আলমের মনে আছে, সেও ছিল মগবাজারের মোড়েই ৷ তার সঙ্গে ছিল শেখ কামাল ৷ মেলা রাত পর্যন্ত ৷ আর ছিল জনতা ৷ ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ৷ সবার হাতে বাঁশের লাঠি ৷ রড ৷ পৌনে ১২টার দিকে শেখ কামাল চলে যায় ৷
আজাদের এ রাতে পিকেটিং করতে যাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত ক্ষোভও আছে ৷ আজাদ আর জায়েদ সম্প্রতি দিনের বেলা গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে ৷ ওখানে আজাদের বাবার এক কর্মচারীর কাছ থেকে আজাদ মাসোহারার টাকা নিয়মিতভাবে তুলে থাকে ৷ অসহযোগের ভেতরে তার ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ যাওয়ায় একদিন হরতালের বিরতিতে আজাদ জায়েদকে নিয়ে গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে, মাসোহারার টাকা তুলতে ৷ কর্মচারীটি টাকা দিতে আপত্তি জানিয়েছিল ৷ ওজর দেখিয়েছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ, হাতে টাকা নাই ৷ জায়েদ ‘হারামজাদা’ বলে চেয়ার তুলে ছুড়ে মেরেছিল কর্মচারীটার মাথা বরাবর ৷ তাতে কাজ হয়েছিল ৷ কর্মচারী বাপ বাপ বলে টাকা তুলে দিয়েছিল আজাদের হাতে ৷ দুজন টাকা নিয়ে বেবিট্যাক্সিতে ফিরছিল ৷ পথে একটা জায়গায় ব্যারিকেড ৷ তারা ব্যারিকেডের ওখানে নেমে রাস্তা পার হবে হেঁটে, ঠিক করেছিল ৷ ঠিক এই সময় কতগুলো পাঞ্জাবি সৈন্য তাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ৷ বলেছিল, ব্যারিকেড নিকাল দো ৷ তারা তাদের রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে বাধ্য করেছিল রাস্তার ব্যারিকেড অপসারণের কাজ করতে ৷ কাজটা করতে আজাদের মোটেও ভালো লাগছিল না ৷ আর হারামজাদা ধরনের গালি, সঙ্গে রাইফেলের বাঁটের মৃদু প্রহার মোটেও সম্মানজনক বলে তার কাছে মনে হচ্ছিল না ৷ সে দাঁতে দাঁত ঘষে পণ করেছিল, সুযোগ পেলেই এ বেটা পাঞ্জাবিদের ছ্যাঁচা দিতে হবে ৷
আসলে আজাদ, আশরাফুল, কাজী কামাল, হাবিবুল আলম, জুয়েল-এরা সবাই বা এদের মতো ঢাকার আরো অসংখ্য তরুণ, প্রায় সব তরুণ-যুবক অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং কাজ করেছিল স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ববোধ, যৌবনের স্বাভাবিক অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদী চেতনা ও স্বভাবধর্ম ৷ হেলাল হাফিজের ওই সময়ে রচিত ওই কবিতাটাতেই এই ব্যাপারটা অভ্রান্তভাবে ধরা পড়েছে :
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
২৫শে মার্চ ১৯৭১-এও যৌবনের স্বভাবধর্ম মিছিলে ব্যারিকেডে টেনে নিয়ে এসেছিল আজাদকে, জায়েদকে, টগরকে, কাজী কামালকে, হাবিবুল আলমকে, সৈয়দ আশরাফুল হককে, লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসীকে ৷ ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানি নেতাদের আলোচনা ভেঙে গেছে, ২৩শে মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু নিজে তার বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন ৷ ২৪শে মার্চ দিনটা ছিল থমথমে ৷ মানুষ রাস্তা পাহারা দিচ্ছে, আর স্থানে স্থানে গুলি হচ্ছে, সারা বাংলায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ মারা গেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ৷ এদিকে আওয়ামী লীগ ২৬ তারিখ থেকে সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে, ২৫শে মার্চ রাতে তারই সমর্থনে ছাত্রজনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে ৷
আজাদের মা বসে আছেন ভাত নিয়ে ৷ এশার নামাজ পড়া হয়ে গেছে ৷ তিনি তেলাওয়াত করেন প্রতিটা ওয়াক্তের নামাজের শেষে, জায়নামাজে বসে, আজ তাও সমাপ্ত ৷ রাত বাড়ছে ৷ আজাদ কেন এখনও ফেরে না ৷ জায়েদ ফিরে এসেছে ৷ সে উত্তেজিত-’আম্মা, একটা পানির ট্যাঙ্ক দিয়া ব্যারিকেড দিছে ৷ মগবাজারের মোড়ে ৷ হেভি হইছে ৷ অহন ইটা ফেলতাছে ৷ দাদারা স’মিল থাইকা গাছের গুঁড়ি আনতে গেছে ৷ গাছের গুঁড়ি ফেললে ব্যারিকেডটা সলিড হইব ৷’
মায়ের কেমন যেন ভয় ভয় লাগে ৷ কখন কী হয় ? যদি মিলিটারি গুলি করে!
রাত বাড়তে থাকলে রাস্তায় ভারি যানবাহন চলাচলের শব্দ শোনা যায় ৷ জায়েদ বাইরে থেকে খোঁজ নিয়ে এসে বলে, ‘ট্যাংক নামায়া দিছে ৷ বুলডোজার নামাইছে ৷’
গুলির শব্দ ৷ গোলার শব্দ ৷ জানালায় দাঁড়ালে আকাশে দেখা যাচ্ছে, আলো- বোমা ছোড়া হচ্ছে আকাশে ৷ সমস্ত আকাশ হঠাৎ হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ৷ আর শোনা যাচ্ছে সম্মিলিত মানুষের হৈ-হল্লা ৷ এত জোরে জোরে আওয়াজ হচ্ছে, যেন আজই কেয়ামত হয়ে যাবে ৷ মা বাসার সবাইকে খাটের নিচে শুইয়ে দেন ৷ কিন্তু নিজে বারবার ছুটে যান গেটের দিকে ৷ আজাদ কেন ফেরে না ৷ আজাদ কোথায় গেল ? তার কিছু হয় নি তো!
দরজায় ধাক্কার শব্দ ৷ মা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলেন ৷ আজাদ নয়, বাশার ৷ মা বলেন, ‘এসেছ বাবা ৷’
বাশার বলে, ‘বাইরের অবস্থা খারাপ ৷’
‘আজাদকে দেখেছ ?’
বাশার উদ্বিগ্ন-‘আজাদ আসেনি ? ঠিক আছে, আমি দেখি, ও কোথায় ?’
মা বলেন, ‘না বাবা, তুমি যেও না ৷ কোথায় খুঁজতে যাবে ?’
এই সময় আজাদ ফেরে ৷ বলে, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ৷ আর্মি নেমেছে ৷ মাইকে এনাউন্স করছে, যেখানেই ব্যারিকেড দেখবে, সেইখানেই গুলি চলবে ৷ আশপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে ৷’
‘আরে, তোকে এত কিছু দেখতে শুনতে কে বলেছে! তুই মাটিতে শুয়ে পড়’-মা তাকে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দেন ৷
বাড়ির সবাই মেঝেতে শুয়ে আছে ৷ বোমার আওয়াজ, মেশিনগানের আওয়াজ, রাইফেলের গুলির আওয়াজ, মানুষের আর্তনাদ, ভেসে ভেসে আসছে ৷ মনে হচ্ছে আকাশের সমস্ত মেঘ বিদ্যুৎ আর বজ্রসমেত ভেঙে পড়ছে পৃথিবীর ওপর ৷
আজাদ ওঠে ৷ জানালার ধারে যায় ৷ বাইরের আকাশে ট্রেসার হাউই উড়ছে মাঝে মধ্যে, আকাশ আলোকিত করে, আর চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা ৷ মা বকতে থাকেন, ‘আজাদ, জানালার ধারে যাস কেন, এদিকে আয় ৷ এদিকে আয় ৷ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা পড় ৷ হে আল্লাহ, জালিমের জুলুম থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো ৷’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *