৩০. মা

৩০
‘আজাদ, কই যাস ?’ মা জিজ্ঞেস করেন ৷
‘এই তো, ইস্কাটনে’-আজাদ শার্টটা প্যান্টের ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে ৷
‘ইস্কাটনে ? ইস্কাটনে কার বাসায় ?’
‘আবুল খায়েরের বাসায় ৷ ক্রিকেট খেলতে ৷’
মা আশ্বস্ত হন ৷ দেশের অবস্থা খুবই খারাপ ৷ ইয়াহিয়া খান যে কী করছে, সে-ই জানে ৷ শেখ মুজিব ভোটে জিতেছে, তাকে তুমি গদি ছেড়ে দাও ৷ সে দেশ চালাক ৷ তা না ৷ ইয়াহিয়া চলছে ভুট্টোর কথামতো ৷ শেখ সাহেব কি সেটা মেনে নেবার মতো মানুষ! নাকি বাঙালিরা তাকে তা মানতে দেবে ৷ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন শেখ সাহেব ৷ সবকিছু তার কথামতো চলছে ৷ যদি মুজিবর বলে, বিকালবেলা অফিস বসবে, তো বিকালবেলাই বসছে ৷ হরতাল হচ্ছে ৷ কিন্তু ইয়াহিয়া কারফিউ দিলে সেটা কেউ মানছে না ৷ রাতের বেলা মিছিল বের হচ্ছে ৷ মিছিলে গুলি চলছে ৷ কতজন যে গুলিতে মারা গেল, ইয়ত্তা নাই ৷ মায়ের বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে ৷ কত মা আজ ছেলে ছেলে বলে কাঁদছে ৷ মা বেঁচে থাকতে ছেলের মৃত্যু, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী আছে মায়ের কাছে ? আহা, আমার ছেলেটাকে সহিসালামতে রেখো মাবুদ ৷ অজানা আশঙ্কায় তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে ৷
আজাদ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে নিউ ইস্কাটন রোডে আবুল খায়েরের বাসার উদ্দেশে ৷ আবুল খায়ের দারুণ ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে নিয়মিত ৷ তাদের বাসার ছাদটাও যেন একটা ছোটখাটো ক্রিকেট মাঠ ৷ ওখানে বেশ ক্রিকেট প্রাকটিস করা চলে ৷ ক্রিকেটের পাশাপাশি চলে আড্ডা ৷ এ ছাড়া আর তাদের কী-ইবা করার আছে ৷ কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ ৷ অফিস-আদালত বন্ধ ৷ রাস্তায় যানবাহন নাই ৷ শুধু আছে মিছিল আর মিটিং ৷ কত সভাই না হচ্ছে ৷ আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, ন্যাপের, ছাত্র ইউনিয়নের দু গ্রুপের, কমিউনিস্টদের, লেখক-শিল্পীদের, মিটিংয়ের কোনো শুমার নাই ৷ ধারাবাহিক মিটিং প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ৷ প্রত্যেকটাতে লোকসমাগম হচ্ছে প্রচুর ৷ ইতিমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা করা হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রনেতারা সে পতাকা উত্তোলন করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে, পতাকা ওড়ানো হচ্ছে চারদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-কে বেছে নেওয়া হয়েছে ৷ বামদলগুলো আহ্বান জানাচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷ তারা জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছড়াচ্ছে ৷ ছাত্ররাও শেখ মুজিবকে চাপ দিচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷
সব ঠিক আছে ৷ কিন্তু আজাদরা কী করবে! তারা তো আর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় ৷ কোনো মিটিং মিছিল তাদের জন্যে বসে নাই ৷ তারা তাই ক্রিকেট খেলে আর আড্ডা দেয় ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসা থেকে নিউ ইস্কাটন, সামান্যই পথ ৷ হেঁটে যাওয়া চলে ৷ রাস্তাঘাট ফাঁকা ৷ শুধু বস্তির পিচ্চিদের একটা মিছিল দেখা যাচ্ছে ৷ তাদের স্লোগানও খুব মজার ৷ ‘ইয়াহিয়ার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ৷ দুই হাতে ছেঁড়া জুতা পরে নিয়ে তারা ডাম্বেলের মতো বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে ৷
আবুল খায়েরদের বাসার ছাদে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই এসেছে ৷ ইব্রাহিম সাবের খোঁড়াচ্ছে ৷ খেলতে গিয়ে সে চোট পেয়েছে ৷ জুয়েল পরে এসেছে একটা নীল রঙের টিশার্ট ৷ চোখে একটা সানগ্লাস ৷ তাকে দেখাচ্ছে একেবারে ইংরেজি ছবির নায়কের মতো ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসাও কাছেই ৷ সেও এসে গেছে ৷ আশরাফুলও দারুণ ক্রিকেট খেলে ৷ হাবিবুল আলম আসে খানিকক্ষণ পরে ৷ তার বাসা দিলু রোডে ৷ সবাই কাছাকাছিই থাকে ৷ শুধু জুয়েলের বাসা হাটখোলা ৷
আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, কেমন করে আসলি ?’
জুয়েল বলে, ‘কেমন কইরা আসলাম মানে!’
আজাদ বলে, ‘হরতাল না! গাড়িঘোড়া কিছু আছে নাকি!’
‘পালকি চইড়া আসলাম ৷ ইয়াহিয়া খানের মাইয়ার লগে আমার বিয়ার কথা চলতেছে না ৷ পালকি কইরা নিয়া আইল ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে আমি জিগাই হেঁটে আসলি নাকি!’
জুয়েল বলে, ‘না, ক্রলিং কইরা আসলাম ৷ যুদ্ধ শুরু হইলে ক্রলিং করতে হইব তো ৷ তাই হাটখোলা থাইকা চার মাইল রাস্তা ক্রলিং কইরা আসলাম ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে জুয়েল খালি পেঁচায় ৷’
কাজী কামাল আসে ৷ লম্বা একটা ছেলে ৷ বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের লম্বা হতে হয় ৷ আজাদ ভাবে-অথচ ছোটবেলায় কামাল আর আমি একই সমান ছিলাম ৷
আবুল খায়ের বলে, ‘জুয়েল তো জোকসের হাঁড়ি ৷ উইকেটকিপিং করতে করতে জুয়েল এমন সব জোক্স বলে, ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে আউট হইয়া যায় ৷’
কামাল বলে, ‘একটা জোক ছাড় না জুয়েল ৷’
আবুল খায়ের বলে, ‘সুপারিরটা ক, জুয়েল সুপারিরটা ক ৷’
জুয়েল গা মোচড়ায়-’আরে এক জোক কয়বার কমু ৷ ইয়াহিয়া, আইয়ুব, ভুট্টো-তিনজন গেছে পরকালে ৷ ওইখানে প্রত্যেকরে কওয়া হইছে একটা কইরা ফল আনতে ৷ আইয়ুব খান নিয়া গেছে একটা সুপারি ৷ তার পিছন দিয়া সুপারি দিছে ঢুকাইয়া ৷ তারপর আসছে ইয়াহিয়া ৷ সে নিয়া গেছে কদবেল ৷ তখন হেরা কয় বলে এত বড় ফল আনছ ৷ সর্বনাশ করছ ৷ এইটা তোমার পিছন দিয়া ঢুকাইতে হইব ৷ শুইনা ইয়াহিয়া হাসে ৷ আরে ব্যাক্কল, হাসিস কেন ? ইয়াহিয়া কয়, আমি তো কদবেল আনছি ৷ এরপর ভুট্টো আসতেছে ৷ সে আনছে নারকেল ৷’
জুয়েলের কৌতুক শুনে সবাই হাসে ৷ নির্দোষ হাসি, তা বলা যাবে না ৷ ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর শরীরের সঙ্গে বাংলার বাঁশগুলোর কোনো একটা সম্পর্ক স্থাপন করার বাসনায় প্রত্যেকের মন দোষযুক্ত হয়ে আছে ৷
আশরাফুল ব্যাট নিয়ে নেমে গেছে ছাদের ওপরেই ৷ খায়ের বল করছে ৷ খায়ের আশরাফুলকে সাবধান করে দেয়, ‘বল ছাদ থেকে পড়ে গেলে কিন্তু আউট ৷ খালি আউট না, ৬ রান মাইনাস ৷ আর রেলিংয়ে লাগলে ৪ ৷’
কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলা চলে ৷ তারপর আবার সবাই বসে রেলিংয়ের ওপরে ৷ আবার জমে ওঠে আড্ডা ৷ দেশের কী হবে ? ইয়াহিয়া আসলে কী চায় ? ইন্টার কন্টিনেন্টালে আলোচনার নামে কী হচ্ছে! শেখ মুজিব কি ভুল করছেন! ছাত্রনেতারা, চার খলিফা কেন তাহলে চাপ দিয়ে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করাচ্ছেন না ৷
রুমী আসে ৷ এলিফ্যান্ট রোড থেকে হেঁটে আসায় তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ৷ তার গাল দুটো মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে ৷ আসলে সে হলো সর্বকনিষ্ঠ ৷ কিন্তু তার কথাবার্তায় একটা বুদ্ধিজীবী-বুদ্ধিজীবী ভাব আছে ৷ সে বলে, ‘এভাবে হবে না ৷ লড়াই করে স্বাধীনতা আনতে হবে ৷ একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলছে, আরেকদিকে প্লেনে করে মিলিটারি আনছে ৷ আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷ ঘটনা খুব খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে ৷ মাও সে তুংয়ের লাইন নিতে হবে ৷ গণযুদ্ধের রণনীতি বইয়ে আছে না…
জুয়েল তার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আইসা পড়ছে আমাদের তাত্তি্বক ৷ শোনো, এক মাইয়া ৷ আমগো গাঁয়ের মাইয়া ৷ তার সাথে বিয়া হইছে এক প্রফেসরের ৷ মহাপণ্ডিত ৷ বাসর রাতে প্রফেসর সাব খালি লেকচার দেয় ৷ কয়, ফ্রয়েড বলেছেন… এইভাবে এক রাত যায়, দুই রাত যায়, ফ্রয়েড আর শেষ হয় না ৷ মাইয়া কয়, আপনের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে তো… তাইলে লেকচার দেন ক্যান ?
প্রফেসর কয়, অহনও পূর্বরাগ চ্যাপ্টারই শেষ হয় নাই ৷ তারপর আইব ফোরপ্লে… তারপর… আস্তেধীরে আরো ২০০ পৃষ্ঠা পরে না অ্যাকশন… তা প্রফেসর সাহেব যখন ২০০ পৃষ্ঠা পড়ানো শেষ করলেন, মাইয়া তখন ৮ মাসের প্রেগন্যান্ট… প্রফেসর সাব কয় কেমনে হইল… আমি তো তোমারে টাচই করলাম না, মাইয়া কয় আপনে যে পড়াইছেন, এতেই হইয়া গেছে… প্রফেসর কয় হইতে পারে আমারই উচিত ছিল প্রিকশন লওয়া… ফ্যামিলি প্লানিং চ্যাপ্টার আগে না পড়ানোয় এই ভুলটা হইয়া গেছে… কী বুঝলা, থিয়োরি কপচাইবা না…’
রুমী বলে, ‘আমিও তো তাই বলি ৷ এখন আলোচনার সময় না, এখন চাই ডাইরেক্ট অ্যাকশন…’
এর মধ্যে এসে পড়েছে ফারুক ৷ সে বলে, ‘তোমরা লেফটিস্টরা যখন নানা রকমের থিয়োরি দিচ্ছ, বাংলার মানুষ কিন্তু তখন মুক্তির লাইনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কম তো শুনলাম না, ভোটের আগে ভাত চাই, এখন শুনছি, এই লড়াই হলো দুই কুকুরের লড়াই, আসল কাজ হলো শ্রেণীশত্রু খতম করা, মানুষ এসবকে পাত্তা দেয় নাই, ছয় দফার পেছনে বঙ্গবন্ধুর পেছনে একযোগে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এখন সামনে আর কোনো উপায় নাই, দেশ স্বাধীন হবেই, চারদিকে তো শুধু স্বাধীন বাংলার পতাকা…’
একজন বলে, ‘আরে ভোটের আগে ভাত চাই-এটা ভাসানী বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেই, যাতে বাঙালি ভোট ভাগ না হয় সেজন্য তিনি সরে গেছেন, আসলে বঙ্গবন্ধু আর ভাসানীর সম্পর্ক তো গুরুশিষ্য, না হলে ধরো পিতাপুত্রের…
‘আচ্ছা, এত যে যুদ্ধ যুদ্ধ করতেছ, যুদ্ধ আরম্ভ হইলে কে কে যুদ্ধে যাবা ?’ একজন প্রশ্ন তোলে ৷
হাবিবুল আলম বলে, ‘আমি যাব ৷’
কাজী কামাল বলে, ‘আমিও যাব ৷’
জুয়েল বলে, ‘আমি সবার আগে থাকব ৷’
রুমী বলে, ‘আমাকে তো যেতেই হবে ৷ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই…’
‘আজাদ, তুই কী করবি ?’
আজাদ বলে, ‘আমি মাকে গিয়ে বলব, মা, আমি যুদ্ধে যাব ৷ তুমি ‘না’ কোরো না ৷ মা যদি অনুমতি দেন, অবশ্যই যাব ৷ না দিলে কী করব, সেটা বলতে পারি না ৷ তোরা তো জানিসই, আমার মা বেঁচে আছে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে…’
আজাদ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরোটা আড্ডা নীরব হয়ে যায়, কারণ সবাই জানে আজাদের ব্যাপারটা, সবাই জানে এই ইস্কাটনের কোন বড়লোক বাড়ির ছেলে আজাদ, শুধু মায়ের সম্মান রক্ষার জন্যে মায়ের সঙ্গে মগবাজারের বাসায় একা পড়ে আছে ৷
সেই নীরবতা ভঙ্গ করে দূর থেকে মিছিলের স্লোগানের ধ্বনি ভেসে আসে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *